বৃহস্পতিবার, ১৯ জানুয়ারী, ২০১২

বিশ্বজুড়ে আরব বসন্তের প্রভাব


॥ মহীউদ্দীন আহমদ ॥


২০১১ সাল আরব বসন্তের সূচনাকাল। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে উৎসারিত হয়েছে আরব বসন্তের গণজোয়ার। তিউনিসিয়া, মিসর, লিবিয়া ও ইয়েমেনে জনতার লড়াই-সংগ্রাম ও শক্তির সামনে পতন ঘটেছে স্বৈরশাসকদের। লড়াই চলছে সিরিয়ায়। নব্যস্বৈরাচার বাশার আল আসাদ সেখানে জনগণের শক্তিপরীক্ষায় অবতীর্ণ, পতন এখন সময়ের ব্যাপার। জনগণের ভোটে সরকার গঠন করার মাধ্যমে মরক্কোর বাদশাহ হাঁপ ছেড়ে বেঁচে গেছেন। জর্ডানে বিরোধী দল শক্তিশালী নয়, তবে পরিবর্তনের বাতাস বইতে শুরু করেছে। উপসাগরীয় অঞ্চল ওমান এখন শান্ত হলেও পরিসি'তি বেঁকে বসতে পারে। কুয়েতে বিক্ষোভ হয়েছে। পার্লামেন্ট উত্তপ্ত হলেও সরকারের বিভিন্নমুখী অর্থনৈতিক নিরাপত্তা কর্মসূচি গ্রহণে জনগণও শান্ত রয়েছে। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী হামাস-ফাতাহ সমঝোতা আরব বসন্তের অন্যতম বড় অর্জন। ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে সম্মিলিত প্রয়াসের মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন ও ঐকমত্যের সরকার গঠনের অঙ্গীকার ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে শান্তি ও সি'তিশীলতা অর্জনের সবচেয়ে অর্থবহ অর্জন বললে অত্যুক্তি হবে না। ফিলিস্তিনিদের বিবদমান উভয় গ্রুপের কৌশল পরিবর্তন এবং কর্মপন'া নতুনভাবে পুনর্বিন্যাসের অঙ্গীকারে এর সুবাতাস বইতে শুরু করেছে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে। আরব বসন্তের পরিবর্তিত পরিসি'তিতে হামাসের নীতি ও কৌশল যুগোপযোগী করার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলে এবং ফাতাহ একলা চলার নীতি পরিত্যাগ করতে সক্ষম হলে ফিলিস্তিনিদের বৃহত্তর ঐক্যপ্রচেষ্টায় সফলতা আসবে। আরব ভূখণ্ডে ইসলামী শক্তির পুনরুত্থান ফিলিস্তিনিদের অবস'ান জোরদারে বড় সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়। আরব বসন্তের প্রভাব পড়েছে ইসরাইলেও। বিগত মাসগুলোতে তেল আবিবসহ অন্য শহরগুলোতে বড় বড় প্রতিবাদী মিছিল হয়েছে, জনগণ রাস্তায় নেমে পড়েছে, সাথে সাথে ইসরাইলি গণমাধ্যমেও প্রতিবাদী আওয়াজ উঠতে দেখা গেছে। ইসরাইলি বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ ফিলিস্তিনিদের সাথে বোঝাপড়ার জন্য নেতানিয়াহুকে পরামর্শ দিতেও দেখা গেছে।
আরব বসন্তের হাওয়া লেগেছে রুশ ফেডারেশন ও এশিয়ার কোনো কোনো দেশেও। কোথাও কোথাও এর প্রভাব পড়তে দেখা গেছে সরকারের ক্রিয়াকল্পেও। মিয়ানমার ও মালয়েশিয়া এর অন্যতম। গণতন্ত্রের দাবিতে বিক্ষোভে উত্তাল সোভিয়েত রাশিয়া। সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল ইউনাইটেড রাশিয়া বিজয়ী হলেও ব্যাপক কারচুপি ও অনিয়মের অভিযোগ এনেছে যুক্তরাষ্ট্র ও নির্বাচনে পরাস্ত দলগুলো। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন এ নির্বাচনকে অস্বচ্ছ ও পক্ষপাতদুষ্ট বলে অভিযোগ করেছেন। তিনি বলেন, রাশিয়ার নির্বাচন অবাধ বা নিরপেক্ষ কোনোটাই হয়নি। সোভিয়েট ইউনিয়নের সাবেক প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভ ভোট জালিয়াতি হওয়ায় পুনরায় নির্বাচন দাবি করেছেন। পুতিন ও মেদভেদেভের সময় শেষ হয়ে আসছেও বলে তিনি মন্তব্য করেন। গর্বাচেভ বলেন, এটা ভীষণ লজ্জা ও বিব্রতকর। আমি এ জন্য লজ্জিত। রাশিয়ায় ঘুরেফিরে চলছে ভ্লাদিমির পুতিন ও দিমিত্রি মেদভেদেভের ক্ষমতায় টিকে থাকার নাটক। রাশিয়ার চলমান বিক্ষোভকে রুশ বসন্ত বলেও অভিমত বিশ্লেষকদের। ডুমার নির্বাচনের পর যে বিক্ষোভ চলছে সে দেশের রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের আভাস তাতে সন্দেহ নেই। রাশিয়ার নিষ্প্রাণ রাজনীতি এখন দ্রুত গতি সঞ্চার করছে, চলমান বিক্ষোভে তাই প্রমাণিত। ডুমার নির্বাচনের ফলাফল যা-ই হোক না কেন, ভোটাররা ক্ষমতাসীনদের প্রতি জোরালো একটি বার্তা দিয়েছেন এবং বাস্তবে এর প্রভাব পড়বে আগামী মার্চ মাসের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময়। কেননা তৃতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে ক্রেমলিনের ক্ষমতায় আসতে চাইছেন পুতিন। আগামীতে পুতিন যদি পাতানো নির্বাচনের খেলা খেলতে চান, তাহলে আরব বসন্তের মতো গণ-অসন্তোষ ও ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়বেন তিনি। মিয়ানমারে সংস্কারপ্রক্রিয়া চলছে। অং সান সুচি এখন মুক্ত। বর্তমান রাজনৈতিক পরিসি'তি আগের তুলনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন। সুচি পুরোপুরি রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্মে অংশগ্রহণ করতে পারছেন। বিদেশী অতিথি ও রাষ্ট্রপ্রধানদের সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন। সব মিলিয়ে মিয়ানমার গণতন্ত্রের পথে চলা শুরু করেছে এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দ্রুত পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্রে ফিরে আসবে- এটাই সবার প্রত্যাশা। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও সুচির দলকে নির্বিঘ্নে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের অধিকার নিশ্চিত করা হলে মিয়ানমার দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে আসবে। মালয়েশিয়ায় স্বাধীনতার পর একদলীয় শাসন চলছে। গণতন্ত্র সেখানে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রিত। সংবাদপত্র ও বিচার বিভাগ সরকারের অধীন। কিন' ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর জন্ম নেয়া অসন্তোষ এ বছর জুলাই মাসে নতুন মাত্রা লাভ করেছে। রাজধানী কুয়ালালামপুরে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা কার্যত রাজধানীকে অচল করে রেখেছিল, যা নাকি মালয়েশিয়ার মতো দেশে অকল্পনীয়। সরকারের দমনপীড়ন অব্যাহত রয়েছে। প্রধান বিরোধী নেতা আনোয়ার ইব্রাহিমকে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে নানা মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়েছে; কিন' তার জনপ্রিয়তা এখনো তুঙ্গে। আরব বসন্তের পথ ধরে জনগণ যেমন উদ্বেলিত, তেমনই সরকার অপাতত নির্বাচন পদ্ধতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কিছু কিছু সংস্কার মেনে নিয়ে বিক্ষোভ প্রশমনের উদ্যোগ নিয়েছে। সব মিলিয়ে পরিসি'তি আগামী নির্বাচন নাগাদ ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে যাবে নাকি বিপক্ষে তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতেই হবে।
মধ্যপ্রাচ্যে যা ঘটেছে তা কোনো ভূমিকম্পের চেয়ে কম নয়। তিউনিসিয়ার গণবিস্ফোরণ এত দ্রুত পুরো আরব বিশ্বকে কাঁপিয়ে তুলবে তা ২০১০ সালের শেষার্ধেও কেউ ভাবতে পারেনি। বু আজিজির আত্মত্যাগের জন্যই অপেক্ষা করছিল আরব দুনিয়া। যেন স্বৈরাচারদের বিদায় ঘণ্টা বাজানোর জন্যই জন্মেছিলেন এই তরুণ। দীর্ঘ দিনের চাপা অসন্তোষ, দুর্নীতি, বেকারত্ব, দারিদ্র্য, রাজতন্ত্র, পরিবারতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র ও সামরিক শাসনের যাঁতাকলে অতিষ্ঠ আরব বিশ্বের জনগণ খুঁজে পেল এক বু আজিজিকে তাদের দিশারী ও কাণ্ডারি হিসেবে। বাস্তবতা হলো, আরব জনগণ বরাবরই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে; সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার মধ্যে ছিল না কোনো কিছুই। আর তাই আন্দোলন বেগবান হতে সময় লাগেনি। স্বাভাবিকভাবেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে পড়ে অকাতরে রক্তে সিক্ত করেছে রাজপথ। আরব গণআন্দোলন বর্তমান শতাব্দীর সবচেয়ে অর্থবহ আন্দোলন। এর পুরোটাই চলেছে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে। কোনো ষড়যন্ত্র বা বহির্বিশ্বের অংশগ্রহণ ছাড়াই এটা সম্ভব হয়েছে।
আরব বসন্তের সূচনাকারী দেশ তিউনিসিয়ায় অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের পর একটি অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান পেয়েছে দেশটি। তিউনিসিয়ার ২১৭ সদস্যের নির্বাচিত পার্লামেন্ট নতুন সংবিধানের প্রস্তাবিত ২৬টি অনুচ্ছেদই অনুমোদন দিয়েছে। নতুন সংবিধান পাস হওয়ার পর সাংবিধানিক পরিষদের প্রধান মুস্তফা বেন জাফর বলেন, ‘এটা ঐতিহাসিক এক মুহূর্ত, স্মরণীয় এক রাত, এখন থেকে নতুন তিউনিসিয়ার যাত্রা শুরু হলো।’ ইয়েমেনে শপথ নিয়েছে জাতীয় ঐকমত্যের সরকার। রাজধানী সানার রিপাবলিকান প্যালেসে নতুন সরকারের সদস্যরা আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পাদিত চুক্তি অনুসারে শপথ নেন। ৩৪ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় ঐকমত্যের সরকারে অর্ধেক সদস্য বিরোধী জোটের, বাকি অর্ধেক প্রেসিডেন্ট আলী আবদুল্লাহ সালেহের অনুগত। ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদ-রাব্বু মানসুর হাদি শপথ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন এবং সরকার পরিচালনা করবেন। নতুন সরকার তিন মাস ক্ষমতায় থাকার কথা রয়েছে। আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান কাজ। ইয়েমেনে আলী আবদুল্লাহ সালেহ ক্ষমতা ছাড়লেও তিনি এখনো প্রতীকী রাষ্ট্রপ্রধান। তার বিরুদ্ধে কোনো বিচারকাজ পরিচালনা করা যাবে না। রাষ্ট্রের পুরো নিয়ন্ত্রণ বাস্তবে সালেহর অনুগত লোকজনের হাতেই থাকবে এবং তারাই নির্বাচন করবেন এমন বাস্তবতায় ইয়েমেনের জনগণের রায়ের প্রতিফলন ব্যালেট বক্সে ঘটবে কি না সেই সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।
এ দিকে মরক্কোর ইসলামী দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির প্রধান আবদুল্লাহ বেন কিরান দেশটির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সরকার গঠন করেছেন। বাদশাহ ষষ্ঠ মোহাম্মদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের পর জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি প্রধানকে সরকার গঠনের আমন্ত্রণ জানান। পার্লামেন্টের ৩৯৫টি আসনের মধ্যে জাস্টিস পার্টি ১০৭টি আসন লাভ করে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। অন্য ছোট দলগুলোর জোট গঠনের পর নতুন প্রধানমন্ত্রী শপথ নেন। আরব অঞ্চলে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পর তার প্রভাব থেকে মরক্কোকে দূরে রাখতে মরক্কোর বাদশাহ ষষ্ঠ মোহাম্মদ দ্রুত সংস্কার হাতে নেন। বিশেষ করে সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর মরক্কোর বাদশাহের পদক্ষেপ বলে বিবেচিত হয়েছে। নতুন প্রধানমন্ত্রী দেশে সুশাসন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও দারিদ্র্য কমিয়ে আনার ঘোষণা দেন। সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন ৫০ শতাংশ বৃদ্ধির ঘোষণা নতুন সরকারের বড় সাফল্য। তবে মরক্কোর নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা হলেও অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং জাতীয় নিরাপত্তার মতো কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা এখনো বাদশাহর হাতেই রয়ে গেছে। পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও পার্লামেন্টকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে মরক্কোর এখনো অনেক কিছু করার বাকি। মিসরে পার্লামেন্ট নির্বাচন সম্পন্ন হলেও পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও সামরিক শাসকদের অভিপ্রায় নিয়ে সংশয় ও সন্দেহ বাড়ছে। নতুন সংবিধানে সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিশ্চিত করার বিষয়ে সামরিক কাউন্সিলের সদস্য জেনারেল মামদো শাহীদের খোলামেলা বক্তব্যে এই সন্দেহ সৃষ্টির কারণ। পরবর্তীতে ব্যাপক সমালোচনার মুখে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে নতুন সংবিধান প্রণয়নে কোনো ভূমিকা থাকবে না বলে ঘোষণা দেয়ার পর আপাতত সমালোচনা শেষ হয়েছে। কিন' সন্দেহ ও উৎকণ্ঠা রয়েই গেছে। জেনারেল মামদো শাহীদের বক্তব্য তার ব্যক্তিগত বক্তব্য নয়, বরং মিসরীয় সেনাবাহিনীর অভিপ্রায় বললে বাস্তবে অত্যুক্তি হবে না। পার্লামেন্ট নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে মুসলিম ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক শাখা জাস্টিস ফ্রিডম পার্টির আত্মপ্রকাশের পর মিসরীয় সেনাবাহিনীর ঘোষণায় তাদের আন্তরিকতা ও ভবিষ্যৎ ভূমিকা আবারো প্রশ্নবিদ্ধ হলো। জাস্টিস ও ডেভেলপমেন্ট পার্টি মিসরে সত্যিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর। আজ ইসরাইলের সাথে শান্তিচুক্তি মেনে চলা ও আগেকার সম্পর্ক রক্ষা করার বিষয়ে জনরায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। মিসরের সেনাবাহিনী মোবারকের প্রতি অনুগত না থাকলেও ইসরাইলের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার পক্ষপাতী। সেই বিবেচনায় তারা মুসলিম ব্রাদারহুডের উত্থানকে মেনে নিতে পারছে না। অন্য দিকে গণরায়কে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতাও তাদের নেই। তাই নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও ভবিষ্যৎ সরকারের সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিশ্চিত করার মাধ্যমে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করতে চাইছে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। মিসরে সরকার পরিবর্তন ও জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি ও ইসলামপন'ী সালাফি পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল তাদের স্বার্থপরিপন'ী বলে বিবেচনা করছে। এমন বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের স্বার্থ সংরক্ষণকারী মিসরের সেনাবাহিনী পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের যে স্বপ্ন দেখছে, তার ফলে মিসরে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে পড়বে। ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী জাস্টিস পার্টির উপপ্রধান এশাম এল ইরিয়ন ঘোষণা দিয়েছেন, ব্রাদারহুড মিসরে কঠোর ইসলামী বিধিনিষেধ জরবদস্তি চাপিয়ে দিতে আগ্রহী নয়। কারণ মিসরে মুসলিমদের পাশাপাশি সংখ্যালঘু খ্রিষ্টান ও অন্য সমপ্রদায়ের লোকের বাস। তিনি বলেন, শরিয়া আইনের মৌলিক বিষয়গুলো উদারভাবে প্রয়োগ করতে চাই, যাতে মানবাধিকার ও ব্যক্তিগত অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকে। মিসরের পার্লামেন্ট নির্বাচনে সালাফিপন'ী আল নূর পার্টির দ্বিতীয় স'ান দখল করার ফলে কঠোর শরিয়া আইন প্রয়োগ নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কে জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি তাদের অবস'ান পরিষ্কার করল।
আরব গণজাগরণের ফলে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিসি'তিতে পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছে। বিশ্বের যে প্রান্তেই মানবাধিকার পদদলিত বা ভুলুণ্ঠিত হচ্ছে, সেখানেই আরব বসন্তের প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে। আরব বিশ্বে পরিবর্তনের যে সুর লক্ষ করা গেছে, তা তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছেই শেষ হবে। মিসর ও লিবিয়ায় এখনো জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মিসরে পার্লামেন্ট ডাকা এবং শাসনতন্ত্র রচনার প্রক্রিয়ার সাথে ষড়যন্ত্র চলছে- তবে জনরায়কে হাইজ্যাক করার যেকোনো প্রচেষ্টা মিসরীয় জনগণ প্রতিহত করবে সন্দেই নেই। লিবিয়ার দুর্বল অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিজেদের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
তাই আন্দোলনকারী জনতাকে সতর্ক থাকতে হবে। সিরিয়ায় স্বৈরাচার সরকারের পতন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ইসলামী শক্তির পুনরুত্থান আরব বসন্তের সবচেয়ে বড় অর্জন। আরব দেশগুলোতে গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত থাকলে আঞ্চলিক রাজনীতি এবং মধ্যপ্রাচ্যের নীতিনির্ধারণে ইসলামপন'ীদের জোরালো ভূমিকা থাকবে এতে সন্দেহের অবকাশ নেই। মধ্যপ্রাচ্যের কৌশলগত রাজনীতিতে ইসলামী শক্তির পুনরুত্থানের পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে- এটা বর্তমান বাস্তবতায় প্রমাণিত। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ইসরাইলের একরোখা মনোভাবের পরিবর্তনের দাবি খোদ ইসরাইলি নেতৃত্বের কাছ থেকেই এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রকে এ বিষয়ে ভাবতে হবে বাস্তবতার আলোকে। কেননা পুরো আরব ভূমিতে ইসরাইলবিরোধী মনোভাব এখন অনেক বেশি চাঙ্গা। প্রকৃতপক্ষে ইসরাইল একঘরে হয়ে পড়েছে। সুতরাং মধ্যপ্রাচ্যের নতুন বাস্তবতায় ও ভূরাজনীতির প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রসহ সমগ্র পশ্চিমা বিশ্বকে ইসরাইল তোষননীতি পরিহার করে বাস্তবসম্মত পন'া অবলম্বন করতে হবে। আরব বসন্তের আলোকে পশ্চিমাদের পররাষ্ট্রনীতির পুনর্মূল্যায়ন এখন সময়ের দাবি।
লেখক : প্রাবন্ধিক
mohi_ahmad15@yahoo.com

সোমবার, ৯ জানুয়ারী, ২০১২

ইতিহাসের মহানায়ক কমরেড জ্যোতি বসু

হায়দার আকবর খান রনো

জানুয়ারী ১৮, ২০১০


১৯৮১ সালে কলকাতার আলীমুদ্দিন স্ট্রিটে সিপিএম অফিসে জ্যোতিবসুর সঙ্গে বাঁ থেকে হায়দার আকবর খান রনো, রাশেদ খান মেনন ও প্রয়াত কমরেড অমল সেন।
ভারতের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির নেতা জীবন্ত কিংবদন্তী কমরেড জ্যোতি বসুর জীবনাবসানের খবর পেয়ে আমার মনে হলো এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের পতন ঘটেছে। যে নক্ষত্রটি কয়েক দশক ধরে জ্বলজ্বল করে জ্বলছিল তা আর আলো দেবে না। সত্যি কি তাই! কথাটা বোধহয় আংশিক সত্য। যে আলো তিনি জ্বালিয়ে গেছেন তা বহুদিন পর্যন্ত ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনই শুধু নয়, গণতান্ত্রিক ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনকেও পথ দেখাবে। তবু এই মৃত্যু বড়ই বেদনাদায়ক। বাংলাদেশ হারালো এক অকৃত্রিম বন্ধুকে আর ভারতবাসী হারালো তাদের প্রিয় নেতাকে।
এক শিক্ষিত উচ্চবিত্ত পরিবারে তাঁর জন্ম। তিনি লেখাপড়া করেছেন কলকাতার অভিজাত স্কুল ও কলেজে। ইংরেজী সাহিত্যে অনার্স নিয়ে বিএ পাশ করেছেন প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে। তখনো তিনি মার্কসবাদের সংস্পর্শে আসেননি। তাঁর পরিবারের মধ্যে স্বদেশী ও বৃটিশ বিরোধী চেতনাবোধ ছিল, যা স্বাভাবিক কারণেই বালক ও তরুণ জ্যোতি বসুর মধ্যে সঞ্চায়িত হয়েছিল। তাঁর পিতার সঙ্গে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল। সশস্ত্র জাতীয়তাবাদী অনুশীলন সমিতির সদস্যদের সঙ্গে তাঁর পৈত্রিক পরিবারের যোগাযোগ ছিল। একবার কোলকাতায় সুভাষ চন্দ্র বসুর সভায় গিয়ে তিনি পুলিশের লাঠি চার্জে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন।
কোলকাতার পড়াশোনা শেষে তিনি লন্ডন গিয়েছিলেন ব্যরিস্টারি পড়তে। বিলাত থেকে ব্যরিস্টার হয়ে তিনি দেশে ফিরে আসলেন, কিন্তু ব্যরিস্টারী করলেন না। তিনি হলেন কমিউনিস্ট পার্টির সার্বক্ষনিক কর্মী। বিলাতে থাকাকালীন তিনি ব্যরিস্টারী পাশ করার পাশাপাশি আরেকটি অনেক বড় অর্জন করেছিলেন। তা হলো মার্কসবাদে দীক্ষাগ্রহণ। গ্রেট বৃটেনের কমিউনিস্ট পার্টির হ্যারি পাল্টি, রজনীপাম দত্ত, বেন ব্রেডলি প্রমুখ তাঁকে সাহায্য করেছিলেন মার্কসবাদে শিক্ষিত করে তুলতে। উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তান ব্যরিস্টার জ্যোতি বসু দেশে ফিরে আসলেন কমিউনিস্ট হয়ে। কমরেড মোজাফফর আহমদ তাঁকে কমিউনিস্ট হিসাবে কাজ করার পথ দেখালেন। প্রথমে তিনি শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। রেলওয়ে শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়নে কাজ শুরু করেন। জ্যোতি বসুর আত্মজীবনীমূলক “জনগণের সঙ্গে” গ্রন্থটির প্রথম খন্ডের ভূমিকায় আরেক কমিউনিস্ট নেতা প্রয়াত কমরেড সরোজ মুখার্জি লিখেছিলেন।
“তাঁর (জ্যোতি বসুর) লেখাগুলির মধ্য দিয়ে বিশেষভাবে স্বচ্ছ হয়ে ফুটেছে, কীভাবে একজন ব্যারিস্টার ব্যক্তিগত জীবনে স্বাচ্ছন্দের কথা উপেক্ষা করে কমিউনিস্ট পার্টির কর্মতৎপরতার সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। মার্কসবাদের জ্ঞান ও আদর্শের প্রতি নিষ্ঠা কত গভীর হলে একজন মধ্যবিত্ত ঘরের যুবক বাড়ি-ঘর-সংসার সম্পর্কে নিষ্পৃহ থেকে সব সময়ের জন্য কমিউনিস্ট কর্মী হিসাবে কাজ করতে পারেন তা জ্যোতি বসুর কর্মজীবনের কাহিনীর মধ্যে পরিস্ফুট। পার্টির নির্দেশ পালন করে কীভাবে ধীরে ধীরে নিজেকে শ্রমিক নেতা হিসাবে এবং পরবর্তী যুগে একজন জননেতা হিসাবে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন তা-ও তার লেখার মধ্যে পরিস্ফুট হয়েছে।”
কমিউনিস্ট হয়ে যাওয়া ব্যরিস্টার জ্যোতি বসু ট্রামে বাসে রাস্তায় পার্টির পত্রিকা বিক্রি করেছেন, রেলওয়ে শ্রমিকদের সংগঠিত করতে নানা জায়গায় ঘুরেছেন, শ্রমিক বস্তিতে থেকেছেন। এইভাবে তিনি নিজেকে শ্রেণীচ্যুত করেছিলেন। কমরেড জ্যোতিবসুর রাজনৈতিক জীবনকে কয়েকটি পর্বে ভাগ করা যায়। প্রথম পর্বে বৃটিশ আমলে শ্রমিক আন্দোলন। দ্বিতীয় পর্বে সংসদীয় রাজনীতিতে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন। এই পার্টি শুরু হয়েছিল ১৯৪৬ সাল থেকে। সংসদীয় সংগ্রামের পাশাপাশি তিনি রাস্তায় সংগ্রামও করেছেন। বিশেষ করে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে কংগ্রেস সরকার বিরোধী গণ আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব প্রদান করেছিলেন। এই সময় খাদ্য আন্দোলন খুবই ব্যাপক ও জঙ্গী রূপ নিয়েছিল যার পুরোভাগে যারা ছিলেন তাদের অন্যতম কমরেড জ্যোতি বসু। তৃতীয় পর্বটি হচ্ছে পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে একটি রাজ্য পরিচালনা করা। টানা ২৪ বছর ধরে বার বার নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। পরে বার্ধক্যের কারণে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্বটি তুলে দেন তারই দলের কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টচার্য্যেের হাতে।
১৯৪৬ সালে রেলওয়ে শ্রমিক কর্মচারীদের জন্য নির্দিষ্ট নির্বাচনী এলাকা থেকে তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁর এই বিজয়টি তখন বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছিল। কারণ তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন কংগ্রেসের নেতা হুমায়ুন কবীর যার তখন ছিল ব্যাপক নাম ডাক। সেই তুলনায় জ্যোতি বসু তখনো স্বল্প পরিচিত। কমিউনিস্ট পার্টির কাজ ও জ্যোতি বসুর নিজস্ব গুণাবলীর কারণেই তিনি বিজয়ী হতে পেরেছিলেন। সেই নির্বাচনে বঙ্গীয় পরিষদে (তখন বাংলা বিভক্ত হয়নি, দুই বাংলা মিলে বৃটিশ ভারতে একটি প্রদেশ হিসাবে ছিল) আর দুইজন কমিউনিস্ট পার্টি থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেনÑ দার্জিলিং-এর চা শ্রমিক নেতা রতনলাল ব্রাক্ষণ এবং দিনাজপুরের কৃষক নেতা রূপ নারায়ণ রায়। বঙ্গীয় পরিষদে মাত্র তিনজন সদস্য নিয়ে ছিল কমিউনিস্টদের এক এই ছোট গ্র“প যার নেতা ছিলেন জ্যোতিবসু। রেলশ্রমিক নেতা জ্যোতিবসু এই ছোট গ্র“প নিয়েও সংসদীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। মনে রাখতে হবে যে, কমিনউনিস্টরা হলেন সর্বহারা বিপ্লবী। কিন্তু ভবিষ্যতের বিপ্লবের স্বার্থে প্রয়োজনে সংসদীয় সংগ্রামকেও যোগ্যতার সঙ্গে ব্যবহার করা হচ্ছে লেখিনীয় কৌশলের অন্যতম নীতি। জ্যোতি বসু সংসদীয় রাজনীতির মোহে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েননি। সুখ সুবিধা ইত্যাদি তাঁকে গ্রাস করতে পারেনি। বরং শাসক শ্রেণীর চরিত্র উম্মোচিত করা এবং মেহনতী জনগণের স্বার্থের কথা তুলে ধরার কাজটি তিনি যোগ্যতার সঙ্গে করতে পেরেছিলেন। স্বাধীনতা পরবর্তী যুগে প্রথম দিকে ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনী ছিল এবং পার্টির উপর কংগ্রেসী সরকারের অত্যাচারও ছিল চরম। উপরন্ত গান্ধী, সুভাষ, নেহেরুর কংগ্রেস তখনো যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিল। ১৯৫২ সালে স্বাধীন ভারতে প্রথম নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টি বঙ্গীয় পরিষদে (বিধানসভা) তিনজনের গ্র“প থেকে প্রধান বিরোধী দলের মর্যাদা পেয়েছিল। তখনও জ্যোতি বসু প্রধান বিরোধদলীয় নেতা। পঞ্চাশের দশকে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গে বড় রকমের কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলন, শিক্ষক আন্দোলন, রিফিইজি সমস্যা নিয়ে আন্দোলন ও খাদ্য আন্দোলন হয়েছিল। জ্যোতি বসু বাইরের গণ আন্দোলনের সঙ্গে সংসদীয় আন্দোলনকে সমন্বিত করতে পেরেছিলেন অত্যন্ত যোগ্যতার সঙ্গে। এইভাবে তিনি শ্রমিক নেতা থেকে পার্লামেন্টেরিয়ান এবং কমিউনিস্ট পার্টির নেতা থেকে গণনেতায় পরিণত হন। সংসদীয় সংগ্রামে তার কি ধরণের যোগ্যতা ছিল সে সম্পর্কে কৃষ্ণ ধরের এক রচনা থেকে জানা যায়, “তিন সদস্য নিয়ে গঠিত কমিউনিস্ট গোষ্ঠীর নেতা হিসাবে তখনই তিনি আইনসভার মুসলিম লিগ, কংগ্রেস ও কৃষক প্রজা পার্টির দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। স্পিকার ছিলেন সৈয়দ নওশের আলী। তিনিও জ্যোতিবসুর সংসদীয় রীতিনীতি সম্পর্কে জ্ঞান এবং পয়েন্ট অফ অর্ডার তুলে অত্যন্ত প্রশাসনিক বক্তব্য  সভায় পেশ করার দক্ষতার প্রশংসা করেন। ….. অত্যন্ত ছোট কমিউনিস্ট গোষ্ঠীর নেতা হিসাবে তরুণ ও স্বল্প পরিচিত জ্যোতি বসুর দক্ষতা ও সংসদে প্রশ্ন উত্থাপন করার ভঙ্গি ও ভাষা অল্প সময়ের মধ্যেই সভার ভিতরে ও বাইরে, সংবাদপত্র ও সর্বত্র আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে।”
১৯৬৪ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে বিভক্তি আসে। ভারতের বিপ্লবের রণনীতি, রাষ্ট্রের চরিত্র, কংগ্রেস দল ও সরকারের চরিত্র বিশ্লেষণ এবং আন্তর্জাতিক মহাবিতর্ক এতগুলি বিষয়ে গুরুতর মত পার্থক্যের কারণে পার্টি বিভক্ত হয়েছিল। ১৯৬৪ সালে নতুন করে যে মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়েছিল জ্যোতি বসু প্রথম থেকেই ছিলেন তাঁর পলিব্যুরোর সদস্য। জ্যোতি বসুকে অনেকে গণ আন্দোলনের নেতা বা পার্লামেন্টেরিয়ান বা সফল মুখ্যমন্ত্রীরূপে দেখেন। এটা খন্ডিত দেখা। তিনি ছিলেন প্রধানতঃ ও মূলত কমিউনিস্ট বিপ্লবী। মতাদর্শের ক্ষেত্রে তাঁর অবস্থান ছিল খুবই স্বচ্ছ। মার্কসীয় মতাদর্শের মর্মবস্তুকে তিনি বুঝতেন এবং সার্থকভাবে প্রয়োগ করতে পারতেন। মার্কসবাদে তাঁর দখল ছিল আর সেই সঙ্গে ছিল প্রখর বাস্তব জ্ঞান। সবটা মিলিয়েই তিনি ছিলেন কমিউনিস্ট গণ নেতা, যাঁর জনপ্রিয়তা ছিল প্রায় আকাশ ছোঁয়া।
১৯৬২ চীন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষ হয়। তখন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির যে অংশ তথাকথিত চীনপন্থী বলে পরিচিত ছিল তাদেরকে সরকার গ্রেপ্তার করেছিল। জ্যোতি বসুও গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তখন সরকার চীনকে আক্রমনকারী বলে ঘোষণা দিয়ে সমাজতান্ত্রিক চীন বিরোধী প্রচার তুঙ্গে তুলেছিল। সেই সময় জ্যোতিবসু ও অন্যান্য কমিউনিস্টরা প্রকাশ্যে বলেছিলেন যে, এটা সরকারের মিথ্যা প্রচার এবং মার্কিন ষড়যন্ত্রের ফসল। তিনি বললেন, সমাজতান্ত্রিক দেশ আগ্রাসী হতে পারে না। ঐ রকম যুদ্ধ পরিস্থিতিতে নিজ দেশের উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সত্য কথা বলতে যে হিম্মত লাগে তা জ্যোতি বসুর ছিল। তখন চীন বিরোধীরা প্রচার দেশকে এমন ভাবে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল যে,  মাকর্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টি (জ্যোত্যি বসু যার অন্যতম নেতা) সাময়িকভাবে গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু মাত্র কিছুদিনের জন্যই। আবার প্রবল গণ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সিপিআই (এম) পশ্চিমবঙ্গে বৃহত্তম রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছিল, যার ফল পাওয়া গেল ১৯৬৭ সালের নির্বাচনে।
জ্যোতি বসু সর্ম্পকে কিছু লিখতে হলে অবশ্যই ১৯৭১ সালে তাঁর এবং তাঁর পার্টির ভূমিকার কথা স্মরণ করতেই হবে। সেই সময় ১ ও ২ জুন কলকাতার বেলেঘাটার এক স্কুলে কয়েকটি বামসংগঠন এক সম্মেলনের মাধ্যমে গঠন করেছিল “ বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি।” এই সংগঠনটি বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারকে মেনে নিয়েই দেশের অভ্যন্তরে স্বতন্ত্রভাবে যুদ্ধ করেছিল (ছোট বড় ১৪টি সশস্ত্র গেরিলা ঘাঁটি যাদের ছিল) এবং ভারতে অবস্থিত মুক্তিফৌজের ভেতরে থেকেও যুদ্ধ করেছিল। সিপিআই (এম) তাদের সংগৃহীত অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছিল। প্রধানত সাহায্য করেছিল বামপন্থী মুক্তিযোদ্ধাদের। তখন বামপন্থীদের বিশেষ করে যারা চীনপন্থী বলে পরিচিত ছিলেন, তাদের ভারতে চলাফেরা বেশ অসুবিধাজনক ছিল। এক্ষেত্রে সিপিআই (এম) এবং তার নেতা জ্যোতি বসু বাংলাদেশের বামকর্মীদের নিরাপত্তা প্রদান ও অন্যান্য সহয়তা প্রদান করেছিলেন।
প্রসঙ্গক্রমে একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে একবার আমাকে ভারতীয় সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার লোক আগরতলা থেকে ধরে নিয়ে শিলং এ নিয়ে যান। সেখানে ভারতের সামরিক বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান জেনারেল সুব্রাহ্মনিয়াম আমাকে দুদিন ইন্টারোগেট করে পরে সসম্মানেই প্লেনে করে কলকাতায় পাঠিয়ে দেন। ঘটনাটি আমাকে বেশ বিচলিত করেছিল। কারণ কোন ধরনের গোয়েন্দা সংস্থার সংস্পর্শ আমার পছন্দীয় নয়। কোলকাতায় এসে বিষয়টি কমরেড প্রমোদ দাসগুপ্ত ও কমরেড জ্যোতি বসুর কাছে বিবৃত করলাম। আমার মানসিক অবস্থা থেকে জ্যোতি বসু একটু হেসে øেহসুলভ ভঙ্গিতে বললেন “বিপ্লব করতে হলে তো কত রকম সংস্পর্শে আসতে হবে। এতে ঘাবড়ানোর কি আছে।” তিনি বলেছিলেন যে, “আমরা বাংলাদেশের বামপন্থীদের একমাত্র অস্ত্র দেয়া ছাড়া সবরকম সাহায্য করবো। কারণ অস্ত্রের বিষয়টি কেন্দ্রীয় সরকারের।”
অবশ্য একথা মনে করার কোন কারণ নেই যে, জ্যোতি বসু সংকীর্ণতাবাদী ছিলেন। তিনি সর্বপ্রথমে চাইতেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সফল হোক। একই সঙ্গে অবশ্যই তিনি কামনা করতেন সঠিক লাইন গ্রহণের মধ্য দিয়ে এই যুদ্ধের মাধ্যমে কমিউনিস্টরা সামনে আসুক। এটাই তো স্বাভাবিক।
জ্যোতি বসু এক সময় সোভিয়েত লাইনকে সংশোধনবাদ বলে প্রত্যাখান করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি এবং তাঁর পার্টি চীনের অনেক বিষয়ে সমালোচনা করেছিলেন। চীনের পার্টির সংকীর্ণতা ও কতিপয় ভুল তত্ত্ব (যেমন ত্রি-বিশ্ব তত্ত্ব) তাঁরা কখনই গ্রহণ করেননি। অর্থাৎ অনুকরণ নয় বরং স্বাধীনভাবে মাকর্সবাদী তত্ত্বের ভিত্তিতে নীতি গ্রহণ করা ছিল তাঁর ও তাঁর দলের লাইন।
সত্তরের দশকে ইন্দিরা গান্ধী ইমার্জেন্সী জারি করলে ভারতের মার্কবাদী কমিউনিস্ট পার্টি দারুন আক্রমণের মুখে পড়ে। সেই সময় জ্যোতি বসু ও তাঁর পার্টি প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে কাজের সমন্বয় করতে শিখিয়েছিলেন সমগ্র পার্টিকে। যারা জ্যোতি বসুকে একজন ভালো প্রশাসক এবং “বিপ্লব বিরোধী সংস্কারবাদী শান্তিপূর্ণ পথে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী” বলে মনে করেন তারা পরিপূর্ণরূপে ভ্রান্ত। বস্তুতঃ জ্যোতিবসু আগাগোড়া বিপ্লবী এবং মাকর্সবাদের বিপ্লবী সত্ত্বায় আস্থাশীল নেতা ছিলেন।
১৯৭৭ সাল থেকে টানা ২৪ বছর জ্যোতিবসু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। বারবার নির্বাচনে তাঁর দল বিজয়ী হয়েছিল। এমন ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে আরেকটি আছে বলে আমার মনে হয় জানা নেই। প্রশাসক হিসাবে জ্যোতিবসু আসাধারণ দক্ষতার ও প্রখর বাস্তব বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন। ২৪ বছর মুখ্যমন্ত্রীত্ব করার পর তিনি ঐ দায়িত্বটি তুলে দেন তাঁরই দলের কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্যরে হাতে। এই যে বিরাট সাফল্য তার পেছনে জ্যোতি বসুর ব্যক্তিগত যোগ্যতাও যেমন ছিল, তেমনি ছিল অত্যন্ত সুসংগঠিত, সুশৃঙ্খল ও আদর্শনিষ্ঠ পার্টির ভূমিকা। এই সময়কালে তিনি পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যের ক্ষেত্রে তিনি যা করছেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ভূমি সংস্কার, বর্গা অপারেশন, শিল্পায়ন এবং পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মাধ্যমে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। ফলে গরিব জনগণ কিছুটা ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছিল। গরীব সীমিত আকারে হলেও গরীব জনগণের যে ক্ষমতায়নের কাজটি করতে পেরেছিলেন সেটাই ছিল তাঁর দলের এবং তাঁর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার মূল কারণ। আরও উল্লেখ্য যে পশ্চিমবঙ্গে অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় জাতপাত ও সা¤প্রদায়িকতার বিষয়টি খুবই কম ছিল।
জ্যোতি বসুর বাংলাদেশের প্রতি দুর্বলতা ছিল সবসময়। তিনি ছিলেন আসলেই বাংলাদেশের জনগণের অকৃত্রিম বন্ধু। ১৯৯৬ সালে তিনি ঢাকায় এসেছিলেন মূলত গঙ্গার পানি বন্টন বিষয়ে আলোচনা করতে, যদিও তিনি কেন্দ্রীয় সরকারে ছিলেন না। তখনি লক্ষ্য করা গেছে যে বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষা করার ব্যাপারে তাঁর ছিল আন্তরিক প্রচেষ্টা। সম্ভবতঃ নাড়ির টানে তাঁর এই বিশেষ দুর্বলতা ছিল।
জ্যোতি বসু ব্যক্তি হিসাবে ছিলেন সন্দেহাতীতভাবে সৎ ও আর্দশনিষ্ঠ। তাঁর মধ্যে ছিল এক দরদী মন। মানুষ হিসাবে তিনি ছিলেন অতি উঁচু এবং কঠিন বিষয়কে সহজে ব্যাখ্যা করার অসাধারণ যোগ্যতা তাঁর ছিল। তাঁর মাঠের বক্তৃতাও আমি শুনেছি। আমাদের দেশে যে ধরনের জ্বালাময়ী বা আবেগপ্রবণ বক্তৃতা করার অথবা নাটকীয় ঢং এ বক্তৃতা করার প্রবণতা আছে অধিকাংশ রাজনীতিবিদদের মধ্যে, জ্যোতি বসুর বক্তৃতায় তা পাওয়া যাবে না। তাঁর বক্তৃতা শুনলে মনে হয় যেন তিনি লক্ষ লক্ষ মানুষের সঙ্গে সহজভাবে আলাপ করছেন। তবে তাঁর বক্তৃতায় এক ভিন্ন ধরনের সম্মোহনী ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যায়।
পাঠক নিশ্চয় জানেন যে, একবার জ্যোতি বসুর ভারতের প্রধানমন্ত্রী হবার কথা উঠেছিল। ভারতের লোকসভায় সিপিআই (এম) এর সদস্যসংখ্যা ছিল বেশ নগণ্য। তারপরও অধিকাংশ দল তাকেই প্রধানমন্ত্রী করতে চেয়েছিলেন। এটা খুব সাধারণ ব্যাপার নয়। অর্থাৎ সর্বভারতীয় পর্যায়েও তিনি ছিলেন জনগণের আস্থাভাজন নেতা। তাঁর পার্টি সিপিআই (এম) এই প্রস্তাবে রাজী হয়নি। তিনি পার্টি সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে এমন আপাত লোভনীয় প্রস্তাব প্রত্যাখান করেছিলেন। আমাদের দেশের ক্ষেত্রে এমনটা ভাবাই যায় না। আর এর থেকেই বোঝা যায় যে, জ্যোতি বসু ছিলেন আসলেই এক ব্যতিক্রমী নেতা।
৯৫ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। এটা স্বাভাবিক বলেই মেনে নেয়া উচিত। তবু মন মানতে চায় না। মনে হয়, তাঁর আরও কিছুদিন বাঁচা উচিত ছিল। বাংলাদেশের স্বার্থে। ভারতের জনগণের স্বার্থে। সর্বোপরি ভারতবর্ষ ও উপমহাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলন বিকাশের স্বার্থে। যে আদর্শ তিনি রেখে গেছেন কাস্তে হাতুড়ি খচিত যে লাল পতাকা তিনি তুলে ধরেছিলেন, তাকে আরও উঁচুতে তুলে ধরে আমরা যেন তাঁকে যুগ যুগ বাঁচিয়ে রাখি।