মঙ্গলবার, ১২ জুন, ২০১২

সপ্তম নৌবহরের সাতকথা


মোহাম্মদ নুরাল হক
সপ্তম নৌবহর নিয়ে অভিজ্ঞতা তো ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় আমেরিকার অবস্থান থেকেই পরিষ্কার। সে সময় পাকিস্তানের সঙ্গে মাখামাখির বিষয়টি তো তারা কখনোই ভুলবে না। কারণ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে পাকিস্তানের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র একটি পরাজিত শক্তি। তা কি এত সহজে ভোলা যায়? তাই এখন চীনকে টার্গেট করে তাদের অতীতের ক্ষোভ মেটাতে আবার সপ্তম নৌবহর নিয়ে এ অঞ্চলে নড়াচড়াসহ মাথাচাড়া
দেওয়ার প্রয়াস

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহাক্ষমতাধর পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশে ঝটিকা সফরের ঝড় শেষ হতে না হতেই যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহরের বাংলাদেশের জলসীমায় ঘাঁটি স্থাপনের বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলে এখন রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহলে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেরই চিৎকার_ 'গেল গেল, সব গেল।' কিন্তু কেন গেল, কীভাবে গেল এবং কোথায় গেল তার কোনো যৌক্তিক উপস্থাপনা কিন্তু খুবই কম। যা হোক, 'দশে চক্রে ভগবান ভূত।' আমরা বাদ যাব কেন? তাই বাধ্য হয়েই আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনাকে তাৎক্ষণিকভাবেই বিবৃতি দিতে হলো এই বলে যে, সপ্তম নৌবহর নিয়ে সেরকম কোনো ইচ্ছাই আপাতত যুক্তরাষ্ট্রের নেই। আমরা সবাই মনে হয় হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা বলেছেন তাই।
এখানে রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনার বক্তব্য যদি বাস্তবিক অর্থেই সত্য হয় তাহলে আল হামদুলিল্লাহ। অর্থাৎ এত কিছুর পর বুঝতে হবে যে, ইদানীং পশ্চিমা দেশগুলোর নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের একটু একটু বোধোদয় হচ্ছে। ইসরায়েলকে নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে যেভাবে গ্যাঁড়াকলে ফেঁসে আছে যুক্তরাষ্ট্র, তা থেকে পরিত্রাণের একটা উপায় পেয়ে যায় সেদিন আফগানিস্তানে রাশিয়াবিরোধী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। কিন্তু বিধিবাম, পাকিস্তানের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদে রাশিয়াকে হটিয়ে তালেবানরা যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যায় এই বলে যে, তারা আফগান সন্তান। তাই আফগানিস্তান তারা শাসন করবে। সেই ঠেলা সামলাতে গিয়ে খোদ নিউইয়র্ক সিটির 'ইজ্জত' টুইন টাওয়ার ধরাশায়ী হলো।
আফগান ধ্বংসযজ্ঞ শেষ হতে না হতেই ইরাকের ওপর চড়াও, 'গণবিধ্বংসী অস্ত্রের' অজুহাতে। কিন্তু ইরাকের কোথাও 'গণবিধ্বংসী অস্ত্রের' সন্ধান না পেয়ে এখন টার্গেট ইরানের পরমাণু কর্মসূচি। কারণ ম্লেচ্ছদের হাতে পরমাণু বিষয়? অসম্ভব। পরমাণু কর্মসূচি ও পরমাণু অস্ত্রের অধিকার তো কুলীনদের বিষয়। আসলে এসব ধ্বংসযজ্ঞের পেছনে পশ্চিমা দেশগুলোর নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের মূল উদ্দেশ্য হলো, এ অঞ্চলে নিরঙ্কুশ আধিপত্য আর এ অঞ্চলের সমুদয় ধন-সম্পদ লুট। দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে যুদ্ধবিগ্রহ বাধিয়ে মধ্যস্বত্বভোগী হয়ে সমুদয় ফায়দা লোটাই যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র উদ্দেশ্য। দুঃখের বিষয়, ওরাই আবার গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা ও নারী স্বাধীনতার একমাত্র ঠিকাদার। মূল কথা হলো, এককালের ব্রিটিশ রাজের পর এখন চলছে আমেরিকান রাজ।
সপ্তম নৌবহর নিয়ে অভিজ্ঞতা তো ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় আমেরিকার অবস্থান থেকেই পরিষ্কার। সে সময় পাকিস্তানের সঙ্গে মাখামাখির বিষয়টি তো তারা কখনোই ভুলবে না। কারণ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে পাকিস্তানের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র একটি পরাজিত শক্তি। তা কি এত সহজে ভোলা যায়? তাই এখন চীনকে টার্গেট করে তাদের অতীতের ক্ষোভ মেটাতে আবার সপ্তম নৌবহর নিয়ে এ অঞ্চলে নড়াচড়াসহ মাথাচাড়া দেওয়ার প্রয়াস। পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মাখামাখির কারণ হলো, পাকিস্তানিরা নিজেদের 'মার্শাল রেস' পরিচয়ে গৌরববোধ করে। আর আমেরিকানরা তো ঐতিহ্যগতভাবেই 'ওয়াইল্ড ওয়াইল্ড ওয়েস্ট'-এর ধ্বজাধারী। অর্থাৎ 'সব শিয়ালের এক রা'।
আমার বুঝতে খুবই কষ্ট হয় এ জন্য যে, মানুষ কি ঠেকেও শেখে না? স্মরণকালের এমন কোনো যুদ্ধের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে, যে যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র মাটিতে পা রেখে এককভাবে জয়ী হয়েছে? আমার জানা মতে একটিও নেই। আর এই তো সেদিনই ল্যাংটাপুটো ভিয়েতকংদের হাতে আমেরিকা ও ফ্রান্স যেভাবে নাকানি-চোবানি খেল, তাতেও তাদের হুঁশ হয় না। তাই শতোর্ধ্ব বয়সী ভিয়েতকংদের বিজয়ী বীর জেনারেল গিয়াপকে যখন জিজ্ঞাসা করা হলো_ 'আমেরিকা কর্তৃক দখলকৃত ইরাকে কী ঘটতে যাচ্ছে?'
বয়সের ভারে নুয়ে পড়া জেনারেল গিয়াপের সহজ-সরল উত্তর_ 'এ পৃথিবীতে কোনো দেশে কেউই দেশের মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়ী হতে পারেনি।' আফসোসের বিষয় হলো, বাংলাদেশের সমাজপতি ও নীতিনির্ধারকরা প্রায়ই বেমালুম ভুলে যান যে, দেশের জনগণের সামনে সপ্তম নৌবহরের সাতকথা কোনো কিছুই নয়। অথচ প্রায়ই কথার তুবড়ি ছোটে এই বলে যে, 'জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস।' বাস্তবতায় শেষ বিকেলে সপ্তম নৌবহর শুধু পশ্চাদপসরণই করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে কোরিয়ান যুদ্ধ, ষাটের দশকে ভিয়েতনাম যুদ্ধ ও '৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ এর জলজ্যান্ত প্রমাণ। তাই সময় থাকতেই সপ্তম নৌবহরের সাতকথা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে আমাদের উচিত, বাংলাদেশের জনগণকে সংঘবদ্ধ করে সামনের দিনগুলোতে দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে যাওয়া। মোটকথা হলো, যন্ত্রশক্তি সময়ের ব্যবধানে জনশক্তির কাছে মাথানত করতেই বাধ্য। যুগের পর যুগ ধরে এটাই সত্য। এই হলো বাস্তবতা।

ব্রিগেডিয়ার (অব.) মোহাম্মদ নুরাল হক পিএসসি :সাবেক সেনা কর্মকর্তা
haquenoor@yahoo.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন