রবিবার, ২৪ জুন, ২০১২

রোহিঙ্গা সমস্যা ও সু চির ইউরোপ সফর



 আবু তাহের খান  
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার শিকার হয়ে মায়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশের অনুমতিদানের জন্য পশ্চিমের অধিকাংশ প্রভাবশালী দেশ ও মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশের প্রতি উপর্যুপরি যে আহ্বান জানিয়ে আসছিল, তা ইতোমধ্যে কিছুটা ম্রিয়মাণ হয়ে আসলেও একেবারে থিতিয়ে যায়নি। আর লক্ষণীয় যে, জাতিসংঘও এ আহ্বান জানানো থেকে বাদ থাকেনি।
সে যাই হোক, পশ্চিমের বিভিন্ন দেশ, সংগঠন  ও জাতিসংঘ এবং বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর ভাষ্যমতে উপরোক্ত আহ্বানের মূল ভিত্তি হচ্ছে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার রক্ষায় তাদের পাশে দাঁড়ানো। আপাতদৃষ্টে এ আহ্বান জানানোর মধ্যে মোটেও দোষের কিছু নেই, বরং তা উচ্চতর মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন সর্বজনীন মৌলিক মানবাধিকার নীতির বহিঃপ্রকাশ বলেই মনে হয়। আর সে অনুযায়ী দুর্ভাগ্যজনক ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার শিকার অসহায় রোহিঙ্গাদের প্রতি সর্বোচ্চ সহানুভূতিশীল আচরণ করা অবশ্যই মৌলিক মানবাধিকার নীতির আওতায় পড়ে এবং তাদের মানবাধিকার রক্ষায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অবশ্যই এগিয়ে আসা উচিত বলেও মনে করি। কিন্তু কথা হচ্ছে, মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ন্যূনতম মৌলিক মানবাধিকার রক্ষার প্রথম দায়িত্বটি কার ? অবশ্যই মিয়ানমার সরকারের নয় কি ?
তাহলে স্বভাবতঃই প্রশ্ন আসে: রোহিঙ্গাদের মৌলিক মানবাধিকার রক্ষার প্রথম দায়িত্বটি যদি মিয়ানমার সরকারেরই হয়ে থাকে, তাহলে ঐ বিপন্ন রোহিঙ্গাদেরকে এ মানবিক সংকটাপন্ন পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করে স্বাভাবিক নাগরিক মর্যাদায় সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য সর্বপ্রথম ও সর্বোচ্চ কণ্ঠের আহ্বানটি ওই মিয়ানমার সরকারের প্রতিই জানানো হলো না কেন ? রোহিঙ্গাদেরকে আশ্রয়দানের জন্য পশ্চিমাদেশ ও তথাকথিত  মানবাধিকার  সংগঠনগুলো  বাংলাদেশের  প্রতি  উপর্যুপরি  যতবার ও  যত  বিভিন্ন  ভাষায় আহ্বান জানিয়েছে, তাদেরতো উচিত ছিল তারচেয়েও বেশিবার ও এর চেয়েও কঠোর ভাষায় মিয়ানমার সরকারকে বলা যে, নিজ দেশের নাগরিককে তারা কিছুতেই এভাবে বিপর্যস্ত অমানবিক অবস্থার মুখে ঠেলে দিতে পারে না। আর তারা যদি তা দেয়ই, তাহলে সেটি প্রতিরোধ করাও বিশ্বসম্প্রদায়ের মৌলিক মানবাধিকার নীতির আওতার মধ্যে পড়ে।  কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব সেটি না করে রোহিঙ্গাদেরকে আশ্রয়দানের জন্য বাংলাদেশের প্রতি যে আহ্বান জানিয়েছে, সেটি  আসলে এক ধরনের লোক দেখানো মায়াকান্না এবং প্রকারান্তরে বাংলাদেশকে চাপে রাখার সামিল।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রাখাইন বৌদ্ধ ও রোহিঙ্গা মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের পুরনো। তবে বর্তমান পর্যায়ে এ সংঘাতের শুরু গত ৩ জুন (২০১২)। তারপর থেকে এ পর্যন্ত তিন সপ্তাহেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। কিন্তু উক্ত দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিরসনে আজ পর্যন্ত মিয়ানমারের সামরিক সরকার জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা ছাড়া সেখানে আর কঠোর কোনো ব্যবস্থা বা উদ্যোগ কি গ্রহণ করেছে? যদি না করে থাকে, তাহলে পশ্চিমা বিশ্বের যে সব দেশ ও সংগঠন রোহিঙ্গাদেরকে আশ্রয়দানের জন্য বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, এ বিষয়ে তাদের জবাবটি কী ? রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার রক্ষার জন্য যে আহ্বান তারা বাংলাদেশের প্রতি জানালেন, সেই একই অধিকার রক্ষায় গত ৩ সপ্তাহেও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করার কারণে মিয়ানমার সরকারের প্রতি তারা চাপ প্রয়োগ করলেন না কেন ? মানবাধিকার রক্ষার দাবিটি তাহলে এ ক্ষেত্রে খুবই একপেশে হয়ে গেল না কি ?
গত ১৬ জুন নরওয়েতে নোবেল শান্তি পুরস্কার (১৯৯১ সালের জন্য দেয়া) গ্রহণকালে প্রদত্ত বক্তৃতায় অং সান সু চি রোহিঙ্গা সমস্যা তথা রাখাইন রাজ্যের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কথা উল্লেখ করলেও তা বন্ধে সরকারের প্রতি কঠোর কোনো আহ্বান জানাননি। আর গত ২১ জুন যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে দেয়া ভাষণে মিয়ানমারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় পশ্চিমা শক্তির সাহায্য চাইলেও দেশে বিরাজমান সাম্প্রদায়িক সংঘাতমূলক পরিস্থিতির বিষয়ে তিনি সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলেননি।
আসলে প্রাচ্যের ব্যাপারে পশ্চিমা বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গির প্রায় পুরোটাই নিজেদের কৌশলগত স্বার্থের হিসাব-নিকাশের ঘেরা টোপে বন্দি, যেখানে মানবাধিকারের প্রসঙ্গটি অনেকটাই লোক দেখানো প্রসাধন মাত্র। আর সু চি হচ্ছেন পশ্চিমা স্বার্থের প্রতিভূ এমন এক নেত্রী, যিনি মাঝে মাঝে নিজেই সে প্রসাধনের উপকরণ হয়ে উঠেন বৈকি ! এটা তাঁর কাছ থেকে খুবই প্রত্যাশিত ছিল যে, ‘শান্তি’তে নোবেল পুরস্কার গ্রহণকে মর্যাদাবান করে তোলার জন্য হলেও এ উপলক্ষে  প্রদত্ত বক্তৃতায় তিনি রোহিঙ্গা সমস্যার প্রসঙ্গটি উত্থাপন করবেন। কিন্তু তিনি তা করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন।
বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে এবং এখনো কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বৈধ ও অবৈধভাবে এ দেশে বসবাস করছে। আর এখানে বসবাসকারী রোহিঙ্গারা অতি জনঘনত্বপূর্ণ এ দেশের অর্থনীতির উপরই শুধু চাপ ফেলেনি, এখানকার জঙ্গিবাদ নির্ভর মৌলবাদী ধারার রাজনৈতিক কর্মী হিসেবেও যুক্ত হয়ে পড়ছে। ফলে রোহিঙ্গারদের আশ্রয়দানের বিষয়টির সাথে মানবাধিকারের বিষয়টি যুক্ত থাকলেও এর সাথে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক বিষয়টিকেও কিন্তু উপেক্ষা করা সম্ভব নয়।
অন্যদিকে মিয়ানমারের পরোক্ষ রাষ্ট্রীয় ইন্ধনে আরাকান রাজ্যে বৌদ্ধ ও মুসলমানদের মধ্যে দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে চলে আসা ধর্মীয় সংঘাত নিরসনে বিশ্বসম্প্রদায়ের কিছু করতে না পারার দায় এককভাবে বাংলাদেশ বহন করবে কেন ? রোহিঙ্গাদের আশ্রায়দানের জন্য যারা বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, গত ৩৫ বছরে তারা এ ব্যাপারে কী করেছেন, সে প্রশ্ন করা যায় না কি ?
পরিশেষে বলবো, রোহিঙ্গাদের মানবাধিকারের প্রতি আমরা পরিপূর্ণভাবে শ্রদ্ধাশীল। তাদের কষ্ট আমরা বুঝি, যেমনটি আমরা বুঝি পশ্চিমা লবির কারসাজির কারণে এখনো মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে শরণার্থী হয়ে থাকা  লাখ লাখ প্যালেস্টাইনীর  কষ্টের কথা। কিন্তু সে প্যালেস্টাইনী শরণার্থীদের ব্যাপারে পশ্চিমের কোনো আগ্রহ না থাকলেও রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে তাদের উদ্বেগের  গূঢ় রহস্য আমরা বুঝতে পারি। কারণ ভারত মহাসাগর ও এর সন্নিহিত এলাকায় তাদের পছন্দসই এমন কিছু ঘটনা বরাবরই থাকা দরকার, যেগুলোকে উপলক্ষ করে তারা এ অঞ্চলে তাদের পদচারণা ক্রমশঃই বাড়াতে পারবে। রোহিঙ্গাদের বিষয়টি তেমনি একটি ঘটনা বৈকি ! এরপরও আমরা রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতিশীল। নয় মাসের  সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভকারী একটি গৌরবদীপ্ত জাতির সদস্য হিসেবে পৃথিবীর একটি মাত্র মানুষের মানবাধিকার লঙ্ঘনকেও আমরা সমর্থন করতে পারি না। রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আমরা মিয়ানমার সরকারের প্রতি জোর দাবি জানাচ্ছি এবং সেটি করতে তাদেরকে বাধ্য করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি বিশ্বসম্প্রদায়ের প্রতি।
[ লেখক :পরিচালক, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)
ই-মেইল :atkhan56@ gmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন