শনিবার, ২৩ জুন, ২০১২

রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর নির্যাতন : ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট


॥ আকবর আহমদ ॥


মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক নেত্রী অং সান সু চি সম্প্রতি তার সমর্থকদের কাছ থেকে হাসিমুখে যে ফুলেল শুভেচ্ছা গ্রহণ করেছেন তাতে মিয়ানমারের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের ব্যাপারে আশাবাদের একটি শক্তিশালী বার্তা ও তার নতুন ভাবমূর্তি গড়ে ওঠার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। তিনি কয়েক দশক ধরে স্বৈরাচারী সরকারের নির্যাতন সহ্য করে দেশে গণতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। বর্তমানে মিয়ানমারে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর চরম নির্যাতন চলছে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে তার ভূমিকা কী সেটা অনেকের প্রশ্ন।
বিবিসির ভাষ্য অনুযায়ী, ‘রোহিঙ্গারা হচ্ছে ধর্মীয় কারণে বিশ্বে তীব্র দুঃখযন্ত্রণা ও হয়রানির শিকার হওয়া অন্যতম একটি সংখ্যালঘু গ্রুপ।’ তারা মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় উপকূলীয় রাখাইন রাজ্যের অবহেলিত মুসলিম। রোহিঙ্গারা আন্তর্জাতিকভাবে তেমন একটা প্রচার পায়নি। শত শত বছর ধরে জেলে ও কৃষক হিসেবে সেখানেই বসবাস করে আসছে তারা। গত তিন দশকে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা পরিকল্পিতভাবে তাদের মাতৃভূমি থেকে ক্রমান্বয়ে উচ্ছেদ করে। ফলে ব্যাপক সহিংসতার সৃষ্টি হয়। সামরিক জান্তা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের অভ্যন্তরে অধিকার এবং নাগরিকত্ব প্রদানে অস্বীকৃতি জানায়। তাদেরকে রাষ্ট্রবিহীন মুসলিম সংখ্যালঘুতে পরিণত করা হয়। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি না দিয়ে তাদের দুঃখদুর্দশা অব্যাহত রাখা হয়েছে। সহিংসতা ও গৃহযুদ্ধে জর্জরিত একটি দেশে যখন গণতন্ত্র ও সমৃদ্ধির ব্যাপারে ব্যাপক আশাবাদের সৃষ্টি হয়েছে, তখন এ ধরনের ঘটনা সেখানে গভীরভাবে ছায়াপাত ও হতাশার সৃষ্টি করবে।
মুক্ত মিয়ানমারে অং সান সু চি রোহিঙ্গাসহ সব জাতিগোষ্ঠীর জনগণের মধ্যে গণতান্ত্রিক সংস্কার ছড়িয়ে দেবেনÑ এটাই পর্যবেক্ষক মহল আশা করে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ২০ লাখের কম হলেও আরব বসন্তের সত্যিকারের শিক্ষা হচ্ছে, একটি দেশের সীমান্তের অভ্যন্তরে সব জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করা ব্যতীত গণতন্ত্রের কোনো ভাবনা সফল হবে না। সমাজের সব সদস্যকে ধর্ম, জাতি, গোষ্ঠী নির্বিশেষে অবশ্যই নাগরিক হিসেবে তাদের যথাযথ অধিকার দিতে হবে। মিয়ানমারে যখন অনেক জাতিগোষ্ঠীগত সংখ্যালঘু কেন্দ্রীয় সরকারের অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, তখন রোহিঙ্গাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে।
রোহিঙ্গারা প্রাণে বাঁচার জন্য বাংলাদেশ এবং থাইল্যান্ডের মতো দেশে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে উদ্বাস্তু বা শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু কেন তাদেরকে দেশ ছেড়ে পালাতে হচ্ছে এবং তারা যে নিজের দেশে সহিংসতা ও সাংস্কৃতিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, সে বিষয়টা মিডিয়ায় ভালোভাবে সম্প্রচার হয়নি।
কেবল মুসলমান হওয়ায় এবং জাতি গোষ্ঠীগতভাবে ভিন্ন হওয়ার কারণেই মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের দেশ থেকে জোর করে বের করে দেয়ার নীতি গ্রহণ করেছে। সরকার ভ্রান্তভাবে তাদেরকে অবৈধ বাঙালি অভিবাসী হিসেবে চিত্রিত করে রোহিঙ্গা সংস্কৃতি ধ্বংস বা মুছে দেয়ার অপপ্রয়াস শুরু করে।
রোহিঙ্গা ও রাখাইন রাজ্যের দীর্ঘ ইতিহাস সরকারের দাবির সাথে মেলে না। মধ্যযুগের আরাকান রাজ্যে মুসলমান রোহিঙ্গারাই ছিল প্রধান শক্তি। তারাই একসময় সংস্কৃতি, জ্ঞান এবং বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। আরাকান রাজ্যের রাজপ্রাসাদ ও প্রশাসনে একসময় ইসলাম এবং বৌদ্ধ ধর্মের মধ্যে পরস্পর ঐক্যতান ও বন্ধন ছিল। রাজ্যের কসমোপলিটান এবং আন্তর্জাতিক রাজধানী শহর ম্রাউক উকে ১৭০০ শতাব্দীতে দ্বিতীয় ভেনিস হিসেবে বর্ণনা করা হতো। একজন পর্তুগিজ ধর্মযাজক এই বর্ণনা দিয়েছিলেন। সে সময়ের ভ্রমণকারী এবং লেখকেরা ওটাকে প্রায়ই আমস্টারডাম ও লন্ডনের সাথে তুলনা করতেন। ১৭৮৪ সালে বর্মি রাজা বোদাপায়া আরাকান দখল করে নেয় সামরিক বাহিনী দিয়ে। একসময়কার প্রাণবস্তু রাজ্যটি পরবর্তী সময়ে সীমান্তবর্তী নির্যাতিত অঞ্চলে পরিণত হয়। বর্মি সেনাদের রোমহর্ষক নির্যাতনের বনকাহিনী চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। এমন নৃশংস ঘটনাও শোনা যায় যে, বর্মি সৈন্যরা রোহিঙ্গা মুসলিমদের বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে জীবান্ত পুড়িয়ে মেরেছে এবং হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে কাজ করানোর জন্য আমারাপুরায় নিয়ে যায়। সেখানে তাদেরকে অবকাঠামো প্রকল্পে দাস হিসেবে শ্রম দিতে বাধ্য করে।
জেনারেল নেইনের অধীনে ১৯৬২ সালে সামরিক জান্তার ক্ষমতা গ্রহণের পর বৌদ্ধ ধর্মীয় বিশ্বাসকে ধারণ করে জাতিগত শুদ্ধি অভিযানের ভিত্তিতে মিয়ানমারীকরণ নীতি নামে একটি উগ্র জাতীয়তাবাদী আদর্শ বাস্তবায়ন শুরু হয়। রোহিঙ্গাদের মুসলিম এবং মিয়ানমার-বহির্ভূত হিসেবে মিয়ানমারে আইনগত বৈধতা বাতিল করা হয় এবং নিজেদের আবাসভূমি তথা মাতৃভূমিতে তাদেরকে বিদেশী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সামরিক শাসকেরা ১৯৮২ সালে তথাকথিত সিটিজেনশিপ ল বা নাগরিকত্ব আইনের দোহাই দিয়ে আইনগতভাবে তাদের নাগরিক অধিকার কেড়ে নেয়। নাগরিকত্ব আনুষ্ঠানিকভাবে বাতিল করার পর রোহিঙ্গারা দেখতে পেল, তারা বাস্তবে অত্যন্ত অবহেলিত ও নির্যাতিত জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। তাদের নিজেদের জমি ও সম্পদের অধিকারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। তাদের ওপর গ্রামের বাইরে যাওয়ার ব্যাপারে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। এমনকি মসজিদসহ ধর্মীয় স্থান মেরামতের কাজেও বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে। তারা রোহিঙ্গাদের যেকোনো ভাষায় শিক্ষা গ্রহণ, এমনকি বিয়েশাদি করা এবং সন্তানসন্ততি জন্মদানের ব্যাপারেও তাদের অনুমতি গ্রহণের নির্দেশ জারি করে। রোহিঙ্গাদের আধুনিক যুগের দাসে পরিণত করা হয়। তাদেরকে আদর্শ গ্রাম নির্মাণের জন্য অবকাঠামো প্রকল্পগুলোতে কাজ করতে জোরপূর্বক বাধ্য করা হয়। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে রোহিঙ্গাদের নিজেদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে সেখানেই বসতি স্থাপনকারীদের বাড়িঘর নির্মাণ প্রকল্পে শ্রম দিতে জোরপূর্বক বাধ্য করা হয়। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার থেকে উচ্ছেদ করে বাইরে পাঠিয়ে দেয়ার সামরিক কৌশলের অংশ হিসেবে তাদের বিরুদ্ধে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন শুরু এবং সাথে সাথে তাদের নাগরিক অধিকারদানে অস্বীকৃতি জানানো হয়।
অপারেশন কিং ড্রাগন বা অপারেশন নাগামিনের আওতায় ১৯৭৮ সালে সামরিক জান্তা জাতিগত শুদ্ধি অভিযানের প্রাথমিক ধাপ শুরু করে। ওই অপারেশনের উদ্দেশ্য ছিল, প্রত্যেককে তাদের রাজ্যের মধ্যে হয় একজন নাগরিক অথবা অবৈধ অভিবাসী হিসেবে বাছাই তথা চিহ্নিত করা। এটা করতে গিয়ে ব্যাপক হারে ধর্ষণ, নির্বিচারে গ্রেফতার, মসজিদ গুঁড়িয়ে দেয়া, রোহিঙ্গাদের গ্রাম ধ্বংস ও তাদের ভূমি বা জমিজমা বাজেয়াপ্ত করা হয়। এই সহিংসতার মুখে প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে গিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। তাদের অনেকেই পরে মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তন করে এবং পুনরায় তারা সেখানে নির্যাতন, ধর্ষণ, জেলজুলুম ও মৃত্যুমুখে পড়ে। একই উদ্দেশ্যে ১৯৯১ সালে অপারেশন পি থায়া বা অপারেশন কিন এবং বিউটিফুল ন্যাশন নামে দ্বিতীয় পর্যায়ে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়। ফলে আবার সহিংস পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় এবং আরো দুই লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার এনজিও বা বেসরকারি সংস্থাগুলোর মতে, প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী এখন বাংলাদেশে অবস্থান করছে। মাত্র ৩৫ হাজার শরণার্থী রেজিস্টার্ড উদ্বাস্তু হিসেবে শরণার্থী শিবিরে অবস্থান করছে এবং তারা এনজিওর কাছ থেকে কিছু সাহায্য পাচ্ছে। আড়াই লাখেরও বেশি অবশিষ্ট শরণার্থী খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা ব্যতীত অমানবিক পরিস্থিতিতে বসবাস করছে, যাদের বেশির ভাগই অভাবের তাড়নায় মৃত্যুবরণ করছে।
মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট থিন সিন এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে ২০১১ সালের ডিসেম্বর মাসে উদ্বাস্তু প্রত্যর্পণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু তাতে রোহিঙ্গাদের বাইরে রাখা হয়, তাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব না থাকার অজুহাতে বাইরে রাখা হলো। শেখ হাসিনা দেশ থেকে উচ্ছেদ করা আড়াই হাজার উদ্বাস্তুকে প্রত্যাবর্তনের শর্তে মিয়ানমারে পাঠানোর চেষ্টা করছে। বর্তমান সমীক্ষার অংশ হিসেবে আমরা সম্প্রতি বার্মিজ রোহিঙ্গা অ্যাসোসিয়েশন অব নর্থ আমেরিকার (বিআরএএনএ) চেয়ারম্যান ড. ওয়াকার উদ্দিনের সাক্ষাৎকার নিয়েছি। তিনি তার রোহিঙ্গা জনগণের আঞ্চলিক ইতিহাস উপলব্ধি করেন এবং তাদের একজন শক্তিশালী রাষ্ট্রদূত। তিনি বলেন, সব রোহিঙ্গা তাদের নিজেদের আবাসভূমিতে নাগরিকত্ব ফিরে পেতে চায়। তারা তাদের ভিটেমাটি বাড়িঘর, মর্যাদা ও মানবাধিকার যা সামরিক স্বৈরাচারী জেনারেল নিউ ইন কেড়ে নিয়েছে, তা ফিরে পেতে চায়।
সু চি এবং ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির জন্য রোহিঙ্গা জনগণের পাশে দাঁড়ানোর এবং তাদেরকে নতুন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করে নেয়ার অনন্য সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এনএলডিকে সব জাতিগোষ্ঠীগত সংখ্যালঘুকে মিয়ানমারের পরিপূর্ণ নাগরিক করে নেয়ার ব্যাপারে ভূমিকা পালন করতে হবে এবং অবশ্যই কেন্দ্রীয় সরকারকে এ জন্য কাজ করতে হবে। অধিকার স্বীকার করে সরকার রোহিঙ্গাদের মর্যাদা এবং পারস্পরিক সাংস্কৃতিক বোঝাপড়ার সুবিধা প্রদান এবং হাজার হাজার উদ্বাস্তু যাদেরকে বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে, দেশে ফিরে আসার সুযোগ দিতে হবে। মিয়ানমার সরকার সম্প্রতি খোলামেলা ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা চালু করার জন্য এবং জাতিগোষ্ঠীগত সহিংসতার অবসান ঘটানোর জন্য বড় ধরনের ও সুদৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। অবশ্য এটা সবে শুরু হয়েছে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিলে অং সান সু চি তার পিতা অং সানের স্মৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবেন। অং সান তার অসময়ে মর্মান্তিক মৃত্যুর আগে একটি স্বাধীন মিয়ানমারের অংশীদার হওয়ার জন্য জাতিগোষ্ঠীগত সংখ্যালঘুদের প্রতি হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাদের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। কেবল তখনই একটি গণতান্ত্রিক ও আধুনিক মিয়ানমার নিজের জনগণের চোখে বৈধতা ও সফলতা অর্জন করতে পারবে, যখন প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে রোহিঙ্গাদের অস্তিত্ব তথা তাদের বসবাসের বিষয়টিকে স্বীকার করে নেয়া হবে।
এই নিবন্ধটির তথ্যসূত্র হচ্ছেÑ ওয়াশিংটন ডিসির আমেরিকান ইউনিভার্সিটির ইবনে খালদুন চেয়ার অব ইসলামিক স্টাডিজের প্রফেসর আকবর আহমদ এবং ওই চেয়ারের সাথে সংশ্লিষ্ট রিচার্স ফেলো হ্যারিসন একিনসের গবেষণাকর্ম : জার্নি টু ট্রাইবাল ইসলাম : আমেরিকা অ্যান্ড দ্য কনফিক্ট বিটুইন সেন্টার অ্যান্ড পেরিফেরি ইন দ্য মুসলিম ওয়ার্ল্ড। 
লেখক : যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত পাকিস্তানের সাবেক হাইকমিশনার এবং ওয়াজিরিস্তান ও বেলুচিস্তানের সাবেক প্রশাসক, তিনি ডিসকভারিং ইসলাম এবং জার্নি ইন টু আমেরিকা : দ্য চ্যালেঞ্জ অব ইসলামসহ বহু গ্রন্থের রচয়িতা।
ইংরেজি থেকে ভাষান্তর : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন