নাদিরা মজুমদার
জুন মাসে একের পর এক অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। সবই মেইনস্ট্র্রিম মিডিয়াতে চলে আসছে; বিশ্বায়িত সমাজব্যবস্থায় ঘটনাগুলো আমাদের সবার অস্তিত্বের সঙ্গে কোন না কোনভাবে জড়িত বলেই হয়ত। যেমন, আফগানিস্তান।
আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা সহায়ক শক্তি ইসাফের (ইসাফ-ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি এসিস্ট্যান্স ফোর্স) প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ন্যাটোর (উত্তর আটলান্টিক মৈত্রী জোট) সদস্য হিসেবে চেক রিপাবলিকও আফগানিস্তানকে সাহায্য দিয়ে আসছে। ইসাফের অধীনে নানা ধরনের দায়দায়িত্ব পালনে চেকরা বেশ সুনামও অর্জন করেছে। ২০০১ সালের নাইন ইলেভেনের নিষ্ঠুর ঘটনার প্রতিশোধ নিতে আফগানদের বিরুদ্ধে প্রথমে শুরু হয় ‘অপারেশন স্থায়ী মুক্তি’র (অপারেশন ইনডিউরিং ফ্রিডম), ঐ বছরেরই অক্টোবর মাসে। বছরের শেষের দিকে অপারেশনের কাজ ন্যাটোর হাতে চালান করে দেয়া হয় ইসাফ মিশন নাম দিয়ে। ফলে ন্যাটো-সদস্য হিসেবে চেকদের জন্যও সামরিক কনটিনজেন্ট পাঠানো কর্তব্য হয়ে পড়ে। তাই ইসাফ মিশনের সঙ্গে চেকরা শুরু থেকেই যুক্ত রয়েছে।
ঐতিহ্যগতভাবে, শিল্প বিপ্লবের কাল থেকেই চেক রিপাবলিক শিল্প ও ভারিশিল্পভিত্তিক হিসেবে গড়ে ওঠে; এবং তারা মূলত প্রতিযোগিতা করত ইউরোপের আরেক শিল্পভিত্তিক দেশ জার্মানির সঙ্গে; গাড়ি শিল্প থেকে শুরু করে ভারি যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা চলত। সাগরবিহীন চেকদের কাছে আকাশসমুদ্র প্রাধান্য পায় এবং বিমাণ নির্মাণে মনোযোগ দেয় তারা। রাইট ভাইদের সফল বিমান নির্মাণ ও উড্ডয়নের সমসাময়িককাল থেকেই চেকরা বিমান নির্মাণ ও উড্ডয়নে পারদর্শিতা অর্জন করতে থাকে। ফলে চেক বা চেকোসোভাক বিমানবাহিনী সামরিক বাহিনীর প্রধান অঙ্গে পরিণত হয়। (সামরিক প্রয়োজনের বাইরে, একাধিক ব্যক্তিগত মালিকাধীন পারিবারিক কোম্পানি এখনও আল্ট্রা লাইট বিমান বানাচ্ছে, দেশীবিদেশীরা কিনছেও। আবার চেকদের এল ১৫৯ ও তার বিভিন্ন সংস্করণ বাংলাদেশ বিমানবাহিনীসহ পৃথিবীর অনেক দেশের বিমানবাহিনীই সামরিক অনুশীলন কাজে ব্যবহার করছে)।
চেক বিমানবাহিনীর প্রথম রণকৌশল দেখা যায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়, তবে ভিনদেশের ভূখ-ে। সরকারীভাবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরুর আগেই, ১৯৩৮ সালে হিটলার চেকোসেøাভাকিয়াকে জার্মানির সঙ্গে সংযুক্ত করে নেয়। বিশাল চেক বিমানবাহিনী যখন প্রতিআঘাত হানার জন্য প্রেসিডেন্টের ’অর্ডারের’ জন্য অধীর প্রতিক্ষা করছিল, বিপুল রক্তপাত এড়ানোর জন্য প্রেসিডেন্ট এডয়ার্ড বেনেশ ও তাঁর প্রায় সম্পূর্ণ সরকারই লন্ডনে নির্বাসনে চলে যান। বিমানবাহিনীর একটা বিশাল অংশ তখন নিজেরাই নিজেদের মধ্যে সমন্বয়সাধন করে বিমানসমেত ইংল্যান্ডে চলে যায়; ইংল্যান্ড তাতে খুশিই হয়। কারণ বিমানবহর ও ট্রেনিংপ্রাপ্ত কুশলী চালক-দুইয়েই ইংল্যান্ডের ছিল বিশাল কমতি; ফলে রয়েল এয়ারফোর্সের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে তারা গৃহীত হয়। উত্তর আফ্রিকা, লেবাননসহ বিভিন্ন রণক্ষেত্রে চেক সামরিক বাহিনী যেমন অংশ নেয়, আবার ব্যাটল অব ব্রিটেনের মূল রক্ষাব্যূহের প্রধান দায়িত্বও পালন করে চেক ফাইটার চালকরা। জার্মান লুফ্ট ভাফের নিদারুণ বোমাবর্ষণে লন্ডনকে মাটির সঙ্গে গুঁড়িয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে চেক ফাইটার চালকরাই।
এই চেক সামরিকবাহিনী আবার অনেকদিন পরে ভিনদেশের অপারেশনের অংশীদার হয়ে ফিরে আসে ১৯৯০ সালে। ওই বছরের আগস্ট মাসে সাদ্দাম হোসাইনের বাহিনী যখন স্টেট অব কুয়েতের সীমান্ত অতিক্রম করে ও কুয়েতকে দখল করে নেয়, তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বুশ জ্যেষ্ঠের নেতৃত্বে বহুজাতিভিত্তিক সামরিক কোয়ালিশন গঠিত হয়। চেকোসেøাভাকিয়ার ভূতর্পূব ফেডারেল এ্যাসেম্বলির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পারস্য উপসাগরীয় এই অঞ্চলে ইরাকবিরোধী কোয়ালিশনের শরিক হিসেবে সামরিক বাহিনীর কেমিক্যাল ইউনিটকে পাঠানো হয়। প্রথম দলটি ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে সৌদি আরবে চলে যায়। পারস্য উপসাগরীয় এই যুদ্ধে কেমিক্যাল ইউনিট ছাড়াও বায়োলজিক্যাল, রেডিয়োলজিক্যাল ও পারমাণবিক নিরাপত্তা ব্যাটালিয়নও অংশগ্রহণ করেছিল। চেক রিপাবলিকের আধুনিক সামরিক ইতিহাসে সঙ্কটকালীন সমাধানের নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হয়। ১৯৯০ সালে, ডেজার্ট শিল্ড ও ডেজার্ট স্টর্মে প্রথম অংশগ্রহণের পর থেকে এ পর্যন্ত চেকবাহিনী বিভিন্ন দেশে বহুবিচিত্র অপারেশনের ও মিশনের শরিক হয়েছে।
আপাত সর্বশেষ ইসাফ মিশন পর্বের কথাই বলা যাক। চেকবাহিনী ২০০১ সাল থেকেই আফগানিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত রয়েছে। ফিঙ্গাল নামক শান্তি রক্ষাকারী অপারেশনের অধীনে ২০০২ সালে চেক কনটিনজেন্টে ছিল ষষ্ঠ ফিল্ড হাসপাতাল, এক প্লাটুন গার্ড এবং সামরিক পুলিশের একটি দল। চেক কনটিনজেন্টকে সরাসরি ইসাফ কমান্ডারের কাছে রিপোর্ট করতে হতো। ২০০৩ সালে ন্যাটো প্রাদেশিক পুনর্নির্মাণ দলকে (পিআরটি) রাজধানীর সীমানা ছাড়িয়ে আরও বাইরের দিকে সম্প্রসার করলে, একটি চেক দলকে পাঠানো হয় স্থানীয়দের বাড়িঘর তৈরির কাজে সাহায্যের জন্য। সেই সঙ্গে ড্যানিশ সৈনিক ও জার্মান বুন্ডেসভেরের সঙ্গে একত্রে এলাকার নিরাপত্তা, আন্তর্জাতিক ইউনিটগুলোর সংরক্ষণের কাজও করতে হয়। ইত্যবসরে, ২০০৫ সালের অক্টোবর মাসে পাকিস্তানের কাশ্মীর অঞ্চলে যে মারাত্মক ভূমিকম্প হয়, চেক মেডিক্যাল দলের একটি অংশ, ‘উইন্টার রেইস’ নামক ন্যাটোর মানবিক অপারেশনের আওতায় ডাচদের ফিল্ড হাসপাতালেও কাজ করতে চলে যায়। এই সময়ে মেডিক্যাল ও প্রকৌশলগত সাহায্য ছাড়াও জনহিতৈষী রিলিফ পরিচালনার জন্য ন্যাটো জার্মানি ও তুরস্ক থেকেও দুটো ‘এয়ার ব্রিজ’ও পরিচালনা করেছিল।
২০০৭ সালের দিকে এলায়াড কমান্ড অপারেশন্সের অনুরোধক্রমে আফগানিস্তানে চেক উপস্থিতি বৃদ্ধি করা হয়। ফলস্বরূপ ফিল্ড হাসপাতাল, রাসায়নিক বা কেমিক্যাল দল ও সামরিক পুলিশ বাহিনীর একটি স্কোয়াডকে পাঠানো হয়; আফগানিস্তানে এদের মেয়াদ নিয়মিতভাবে বাড়ানোও হতে থাকে। ইত্যবসরে, ২০০৪ সালে মিত্রদের অনুরোধে চেক সশস্ত্র বাহিনীর এসিআরয়ের একটি ইউনিট যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একযোগে সহযোগিতা শুরু করে। এসিআরয়ের সপ্তম ইউনিটের অংশ হিসেবে চেকবাহিনীর দায়িত্ব ২০১১ সাল পর্যন্ত স্থায়ী ছিল; এসিআরয়ের এই সাতটি ইউনিটই ছিল হেলিকপ্টার ইউনিট। সর্বশেষ ইউনিটে ২১ জন চেক হেলিচালক অংশ নেয় এবং অত্যাধুনিক এমআইএল এমআই ১৭১ এস হেলিকপ্টার ব্যবহার হয়।
উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের সঙ্গে দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার কি বা কোন সম্পর্ক রয়েছে, জানি না, তবে যুক্তরাষ্ট্রের ‘স্থায়ী মুক্তি’ অপারেশন তথা ন্যাটোর ইসাফ মিশনে ন্যাটোর সবটি সদস্য দেশ (২৮টি) তো বটেই কয়েকটি অ-ন্যাটো দেশও অংশ নিয়েছে। এমনকি আইসল্যান্ড (বিশ্ব মন্দার ঝাপ্টায় প্রথম ইউরোপীয় দেউলিয়া দেশ হিসেবে ঘোষিত), ও তিনটে বাল্টিক রিপাবলিক আফগানিস্তানে তাদের সক্রিয় উপস্থিতি বজায় রেখেছে। এই প্রেক্ষিতে এই চারটি ন্যাটো দেশের জন্য চেক রিপাবলিকের আরেকটি বাড়তি দায়দায়িত্ব জুটেছে। চারটি দেশের কারোই নিজস্ব আকাশসীমার নিরাপত্তা দেখাশোনার কোন ফাইটার বিমান নেই, তাই চালকও নেই। ফলে চেক ফাইটার চালকরা অত্যাধুনিক গ্রিপেন ফাইটার ভাড়া করে ওদের আকাশসীমা পাহারা দিচ্ছে। ন্যাটোর নীতিমালা অনুযায়ী সমর্থ সদস্যদের সলিডারিটি দেখাতে হয়।
একইভাবে বিগত বারো বছর ধরে আফগানিস্তানে ইসাফ মিশনকে আরো জোরদার করতেও চেক রিপাবলিকের অবদান তুলনাহীন। যেমন, পান্ডুরের কথাই ধরা যাক। পান্ডুর হলো বর্ম আচ্ছাদিত সামরিক যান বা আরমার্ড পার্সোনাল ক্যারিয়ার (এপিসি); কাজ হলো পদাতিক বাহিনীকে স্থানান্তর করা; আদর করে তাই ‘ব্যাটল ট্যাক্সি’ বা ‘ব্যাটল বাস’ও বলা হয়। চেকরা যে পান্ডুর ২ সিজেড এম ১-য়ের সংযোজন করেছে, সে হলো আরো অনেক বেশি স্মার্ট। ২০১১ সালে প্রথম ব্যাচের যে সতেরোটি পান্ডুর ব্যবহার শুরু হয়, সেগুলোতে এমন সব ব্যবস্থা রয়েছে যে নিজের গা বাঁচিয়ে দিব্যি শত্রু ঘায়েল সম্ভব; শুনলেও লোম খাড়া হয়, ভয়মিশ্রিত গভীর ভক্তিও জাগে।
ইসাফ মিশনে এত খরচাপাতি করে চেকরা যখন ন্যাটোর অন্যতম আধুনিক বাহিনীতে পরিণত হচ্ছে, ঠিক তখনই পরবর্তী দুই বছরে ‘ওভারসিস’ মিশনে চেক বাহিনীর কর্মপ্রক্রিয়া কি রকম হবে বিষয়ক প্রস্তাব আনা হয় চেক সংসদে। বিগত ২২ বছরে বৈদেশিক মিশনে চেকবাহিনীর ভূমিকাবিষয়ক যত প্রস্তাব চেক সংসদে আনা হয়েছে, ২০১২ সালের ১২ জুনের প্রস্তাবটির মতো আর কোন প্রস্তাবই এত মসৃণভাবে, এত সহজে পাস হয়নি। হবেই বা না কেন? সোশ্যালিস্টরা ও কমিউনিস্টরা সবসময়েই সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধির বিরোধিতা করে এসেছে, কিন্তু এবারের প্রস্তাব ছিল সংখ্যা কমিয়ে আনা। সেই মতে ২০১৩ সালে সৈন্যসংখ্যা কমে দাঁড়াবে ৫৩৯, পরের বছর ৩৪০। সৈন্যসংখ্যা কমিয়ে আনার বিষয়টি মে মাসে অনুষ্ঠিত ন্যাটোর শিকাগো ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। ২০১৪ সাল থেকে যুদ্ধ করতে সক্ষম কোন ন্যাটোবাহিনী আফগানিস্তানে থাকবে না; থাকবে কেবলমাত্র আফগান সেনাবাহিনী ও পুলিশবাহিনীকে ট্রেনিং দেওয়ার জন্য উপযুক্ত সেনা শিক্ষকরা। চেকরা আফগানদের হেলি চালনা, পুলিশী ট্রেনিংও দিয়ে আসছে। মনে করা যেতে পারে যে, সেনাবাহিনীকে সরিয়ে আনা হলেও ট্রেনিং দেয়ার লোক কিছু থেকে যাবে; হয়ত বা চেক দূতাবাসের নিরাপত্তা রক্ষার জন্যও গোটা বিশজন সেনা জোয়ানও থাকবে। সংসদীয় আলোচনায়, দুর্নীতিগ্রস্ত বর্তমান আফগান সরকার ও ন্যাটো বাহিনীকে ২০১৪ সালের মধ্যে সম্পূর্ণভাবে সরিয়ে নিলে আফগানদের অবস্থাটি কি হবে, নিয়েও বেশ দুর্ভাবনা প্রকাশিত হয়। (চীন অবশ্য ইত্যবসরেই আফগানিস্তানকে সহায়সাহায্য দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে)।
বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরনের ’ওভারসিস’ মিশন পরিচালনা ও অংশগ্রহণের সবচেয়ে বড় লাভ হলো যে ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো রণকৌশলসহ বিভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগসুবিধাগুলো পাচ্ছে। তবে সৈন্য সরিয়ে আনার সরাসরি নেতিবাচক অর্থনৈতিক প্রভাব অনুভব করবে একক ব্যক্তিগত সৈনিকটি। বৈদেশিক মিশনে থাকাকালীন মোটা অংকের যে ডিয়ে টিয়ে থাকে, তা থেকে সৈনিক বঞ্চিত হবে। অবশ্য আফগানিস্তান থেকে সরিয়ে আনা চেক সৈন্যদের সিনাই উপদ্বীপ, বসনিয়া বা কসোভোতে পাঠানোর একটি পরিকল্পনা রয়েছে; ইত্যবসরে হয়ত অন্য কোথাও মিশন পাঠানোর প্রয়োজনও হয়ে যেতে পারে। ২০০১ সাল থেকে ২০১২ সালের ২৬ মে পর্যন্ত আফগানিস্তানে কোয়ালিশন শক্তির পক্ষে নিহতের সংখ্যা ৩০১২। তার মধ্যে চেক নিহতের সংখ্যা চার। আফগান বেসামরিক নিহতের পরিসংখ্যানের খতিয়ান এখনও সম্পূর্ণ হয়নি। চালকবিহীন বিমান বা ড্রোনের হামলা অনেক অসংখ্য বেসামরিক নারীপুরুষ, শিশুর মৃত্যুকে অবিশ্বাস্য হারে বৃদ্ধিতে সাহায্য যে করছে, বলাই বাহুল্য। প্রেসিডেন্ট কারজাই তাই বার কয়েক বৈদেশিক দূতাবাসকে সতর্কও করে দেন।
আফগানিস্তান, ইরাক বা লিবিয়া- যে দেশই হোক না কেন, যুদ্ধবাবদ বিপুল খরচ তো একটি রয়েছে! সাধারণত ‘হোস্ট’ কান্ট্রি বা আতিথ্যকর্তা সেই ব্যয়ভার বহন করে থাকে। যেমন, প্রথম মহাযুদ্ধের ব্যয়ভার পরাজিত জার্মানি ‘ক্ষেপেক্ষেপে’ শোধ করেছে এবং শেষ কিস্তি শোধ করে বছর দেড় দুই আগে; ইরাক কি লিবিয়ার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটি অনুরূপ। কিন্তু আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে নাকি অন্যরকম নীতি নেয়া হয়েছে। তাদের কোন খরচ বহন করতে হবে না! খুব সম্ভব আফগানিস্তানে তেল, গ্যাসের সঞ্চয় রয়েছে। কারণ, আফগানিস্তানের ভূতাত্ত্বিক জন্ম বৃত্তান্ত অনুযায়ী থাকাটাই হবে স্বাভাবিক। মোটামুটি প্রায় চল্লিশ কি পঞ্চাশ মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীতে যে সর্বশেষ মহা মহাদেশীয় বা সুপার মহাদেশীয় সংঘর্ষটি ঘটে, তার ফলে ভারতীয় টেকটোনিক প্লেট, ইউরেশীয় প্লেট এবং এমনকি এশীয় ও আফ্রিকীয় প্লেট- নিজেদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কির এক মহা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। ফলস্বরূপ, আকস্মিক ভূমি-অভ্যুত্থান ঘটিয়ে বিস্তৃত এলাকাজুড়ে যে হিমালয় পর্বতমালার সৃষ্টি হয়, তার মধ্যে আফগানিস্তানও অন্তর্ভুক্ত। আফগানিস্তানের বিভিন্ন এলাকাজুড়ে সোনা, তামা, লিথিয়াম, ইউরেনিয়াম, কোবাল্ট, ধাতব লোহাসহ আরও কত ধরনের মূল্যবান খনিজের অপরিমেয় ভা-ার ভূমির অতলে রয়েছে; বর্তমানে দেশটিতে নব্বইটিরও অধিক খনিজ ফিল্ড রয়েছে, যা থেকে বেশ সহজেই খনিজ আহরণ সম্ভব। ২০১০ সালের এক রিপোর্টে সিআইএ ও যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-তত্ত্ববিদদের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে যে, আফগানিস্তানের এই অমূল্য খনিজের মূল্য কম করে এক ট্রিলিয়ন (এক ট্রিলিয়ন= একের পরে বারোটি শূন্য) ডলার তো হবেই। তবে আফগান সরকারের সঙ্গে কেউ কোন চুক্তি নাকি করেনি।
nadirahmajumdar@gmail.com
জুন মাসে একের পর এক অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। সবই মেইনস্ট্র্রিম মিডিয়াতে চলে আসছে; বিশ্বায়িত সমাজব্যবস্থায় ঘটনাগুলো আমাদের সবার অস্তিত্বের সঙ্গে কোন না কোনভাবে জড়িত বলেই হয়ত। যেমন, আফগানিস্তান।
আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা সহায়ক শক্তি ইসাফের (ইসাফ-ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি এসিস্ট্যান্স ফোর্স) প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ন্যাটোর (উত্তর আটলান্টিক মৈত্রী জোট) সদস্য হিসেবে চেক রিপাবলিকও আফগানিস্তানকে সাহায্য দিয়ে আসছে। ইসাফের অধীনে নানা ধরনের দায়দায়িত্ব পালনে চেকরা বেশ সুনামও অর্জন করেছে। ২০০১ সালের নাইন ইলেভেনের নিষ্ঠুর ঘটনার প্রতিশোধ নিতে আফগানদের বিরুদ্ধে প্রথমে শুরু হয় ‘অপারেশন স্থায়ী মুক্তি’র (অপারেশন ইনডিউরিং ফ্রিডম), ঐ বছরেরই অক্টোবর মাসে। বছরের শেষের দিকে অপারেশনের কাজ ন্যাটোর হাতে চালান করে দেয়া হয় ইসাফ মিশন নাম দিয়ে। ফলে ন্যাটো-সদস্য হিসেবে চেকদের জন্যও সামরিক কনটিনজেন্ট পাঠানো কর্তব্য হয়ে পড়ে। তাই ইসাফ মিশনের সঙ্গে চেকরা শুরু থেকেই যুক্ত রয়েছে।
ঐতিহ্যগতভাবে, শিল্প বিপ্লবের কাল থেকেই চেক রিপাবলিক শিল্প ও ভারিশিল্পভিত্তিক হিসেবে গড়ে ওঠে; এবং তারা মূলত প্রতিযোগিতা করত ইউরোপের আরেক শিল্পভিত্তিক দেশ জার্মানির সঙ্গে; গাড়ি শিল্প থেকে শুরু করে ভারি যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা চলত। সাগরবিহীন চেকদের কাছে আকাশসমুদ্র প্রাধান্য পায় এবং বিমাণ নির্মাণে মনোযোগ দেয় তারা। রাইট ভাইদের সফল বিমান নির্মাণ ও উড্ডয়নের সমসাময়িককাল থেকেই চেকরা বিমান নির্মাণ ও উড্ডয়নে পারদর্শিতা অর্জন করতে থাকে। ফলে চেক বা চেকোসোভাক বিমানবাহিনী সামরিক বাহিনীর প্রধান অঙ্গে পরিণত হয়। (সামরিক প্রয়োজনের বাইরে, একাধিক ব্যক্তিগত মালিকাধীন পারিবারিক কোম্পানি এখনও আল্ট্রা লাইট বিমান বানাচ্ছে, দেশীবিদেশীরা কিনছেও। আবার চেকদের এল ১৫৯ ও তার বিভিন্ন সংস্করণ বাংলাদেশ বিমানবাহিনীসহ পৃথিবীর অনেক দেশের বিমানবাহিনীই সামরিক অনুশীলন কাজে ব্যবহার করছে)।
চেক বিমানবাহিনীর প্রথম রণকৌশল দেখা যায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়, তবে ভিনদেশের ভূখ-ে। সরকারীভাবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরুর আগেই, ১৯৩৮ সালে হিটলার চেকোসেøাভাকিয়াকে জার্মানির সঙ্গে সংযুক্ত করে নেয়। বিশাল চেক বিমানবাহিনী যখন প্রতিআঘাত হানার জন্য প্রেসিডেন্টের ’অর্ডারের’ জন্য অধীর প্রতিক্ষা করছিল, বিপুল রক্তপাত এড়ানোর জন্য প্রেসিডেন্ট এডয়ার্ড বেনেশ ও তাঁর প্রায় সম্পূর্ণ সরকারই লন্ডনে নির্বাসনে চলে যান। বিমানবাহিনীর একটা বিশাল অংশ তখন নিজেরাই নিজেদের মধ্যে সমন্বয়সাধন করে বিমানসমেত ইংল্যান্ডে চলে যায়; ইংল্যান্ড তাতে খুশিই হয়। কারণ বিমানবহর ও ট্রেনিংপ্রাপ্ত কুশলী চালক-দুইয়েই ইংল্যান্ডের ছিল বিশাল কমতি; ফলে রয়েল এয়ারফোর্সের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে তারা গৃহীত হয়। উত্তর আফ্রিকা, লেবাননসহ বিভিন্ন রণক্ষেত্রে চেক সামরিক বাহিনী যেমন অংশ নেয়, আবার ব্যাটল অব ব্রিটেনের মূল রক্ষাব্যূহের প্রধান দায়িত্বও পালন করে চেক ফাইটার চালকরা। জার্মান লুফ্ট ভাফের নিদারুণ বোমাবর্ষণে লন্ডনকে মাটির সঙ্গে গুঁড়িয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে চেক ফাইটার চালকরাই।
এই চেক সামরিকবাহিনী আবার অনেকদিন পরে ভিনদেশের অপারেশনের অংশীদার হয়ে ফিরে আসে ১৯৯০ সালে। ওই বছরের আগস্ট মাসে সাদ্দাম হোসাইনের বাহিনী যখন স্টেট অব কুয়েতের সীমান্ত অতিক্রম করে ও কুয়েতকে দখল করে নেয়, তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বুশ জ্যেষ্ঠের নেতৃত্বে বহুজাতিভিত্তিক সামরিক কোয়ালিশন গঠিত হয়। চেকোসেøাভাকিয়ার ভূতর্পূব ফেডারেল এ্যাসেম্বলির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পারস্য উপসাগরীয় এই অঞ্চলে ইরাকবিরোধী কোয়ালিশনের শরিক হিসেবে সামরিক বাহিনীর কেমিক্যাল ইউনিটকে পাঠানো হয়। প্রথম দলটি ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে সৌদি আরবে চলে যায়। পারস্য উপসাগরীয় এই যুদ্ধে কেমিক্যাল ইউনিট ছাড়াও বায়োলজিক্যাল, রেডিয়োলজিক্যাল ও পারমাণবিক নিরাপত্তা ব্যাটালিয়নও অংশগ্রহণ করেছিল। চেক রিপাবলিকের আধুনিক সামরিক ইতিহাসে সঙ্কটকালীন সমাধানের নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হয়। ১৯৯০ সালে, ডেজার্ট শিল্ড ও ডেজার্ট স্টর্মে প্রথম অংশগ্রহণের পর থেকে এ পর্যন্ত চেকবাহিনী বিভিন্ন দেশে বহুবিচিত্র অপারেশনের ও মিশনের শরিক হয়েছে।
আপাত সর্বশেষ ইসাফ মিশন পর্বের কথাই বলা যাক। চেকবাহিনী ২০০১ সাল থেকেই আফগানিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত রয়েছে। ফিঙ্গাল নামক শান্তি রক্ষাকারী অপারেশনের অধীনে ২০০২ সালে চেক কনটিনজেন্টে ছিল ষষ্ঠ ফিল্ড হাসপাতাল, এক প্লাটুন গার্ড এবং সামরিক পুলিশের একটি দল। চেক কনটিনজেন্টকে সরাসরি ইসাফ কমান্ডারের কাছে রিপোর্ট করতে হতো। ২০০৩ সালে ন্যাটো প্রাদেশিক পুনর্নির্মাণ দলকে (পিআরটি) রাজধানীর সীমানা ছাড়িয়ে আরও বাইরের দিকে সম্প্রসার করলে, একটি চেক দলকে পাঠানো হয় স্থানীয়দের বাড়িঘর তৈরির কাজে সাহায্যের জন্য। সেই সঙ্গে ড্যানিশ সৈনিক ও জার্মান বুন্ডেসভেরের সঙ্গে একত্রে এলাকার নিরাপত্তা, আন্তর্জাতিক ইউনিটগুলোর সংরক্ষণের কাজও করতে হয়। ইত্যবসরে, ২০০৫ সালের অক্টোবর মাসে পাকিস্তানের কাশ্মীর অঞ্চলে যে মারাত্মক ভূমিকম্প হয়, চেক মেডিক্যাল দলের একটি অংশ, ‘উইন্টার রেইস’ নামক ন্যাটোর মানবিক অপারেশনের আওতায় ডাচদের ফিল্ড হাসপাতালেও কাজ করতে চলে যায়। এই সময়ে মেডিক্যাল ও প্রকৌশলগত সাহায্য ছাড়াও জনহিতৈষী রিলিফ পরিচালনার জন্য ন্যাটো জার্মানি ও তুরস্ক থেকেও দুটো ‘এয়ার ব্রিজ’ও পরিচালনা করেছিল।
২০০৭ সালের দিকে এলায়াড কমান্ড অপারেশন্সের অনুরোধক্রমে আফগানিস্তানে চেক উপস্থিতি বৃদ্ধি করা হয়। ফলস্বরূপ ফিল্ড হাসপাতাল, রাসায়নিক বা কেমিক্যাল দল ও সামরিক পুলিশ বাহিনীর একটি স্কোয়াডকে পাঠানো হয়; আফগানিস্তানে এদের মেয়াদ নিয়মিতভাবে বাড়ানোও হতে থাকে। ইত্যবসরে, ২০০৪ সালে মিত্রদের অনুরোধে চেক সশস্ত্র বাহিনীর এসিআরয়ের একটি ইউনিট যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একযোগে সহযোগিতা শুরু করে। এসিআরয়ের সপ্তম ইউনিটের অংশ হিসেবে চেকবাহিনীর দায়িত্ব ২০১১ সাল পর্যন্ত স্থায়ী ছিল; এসিআরয়ের এই সাতটি ইউনিটই ছিল হেলিকপ্টার ইউনিট। সর্বশেষ ইউনিটে ২১ জন চেক হেলিচালক অংশ নেয় এবং অত্যাধুনিক এমআইএল এমআই ১৭১ এস হেলিকপ্টার ব্যবহার হয়।
উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের সঙ্গে দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার কি বা কোন সম্পর্ক রয়েছে, জানি না, তবে যুক্তরাষ্ট্রের ‘স্থায়ী মুক্তি’ অপারেশন তথা ন্যাটোর ইসাফ মিশনে ন্যাটোর সবটি সদস্য দেশ (২৮টি) তো বটেই কয়েকটি অ-ন্যাটো দেশও অংশ নিয়েছে। এমনকি আইসল্যান্ড (বিশ্ব মন্দার ঝাপ্টায় প্রথম ইউরোপীয় দেউলিয়া দেশ হিসেবে ঘোষিত), ও তিনটে বাল্টিক রিপাবলিক আফগানিস্তানে তাদের সক্রিয় উপস্থিতি বজায় রেখেছে। এই প্রেক্ষিতে এই চারটি ন্যাটো দেশের জন্য চেক রিপাবলিকের আরেকটি বাড়তি দায়দায়িত্ব জুটেছে। চারটি দেশের কারোই নিজস্ব আকাশসীমার নিরাপত্তা দেখাশোনার কোন ফাইটার বিমান নেই, তাই চালকও নেই। ফলে চেক ফাইটার চালকরা অত্যাধুনিক গ্রিপেন ফাইটার ভাড়া করে ওদের আকাশসীমা পাহারা দিচ্ছে। ন্যাটোর নীতিমালা অনুযায়ী সমর্থ সদস্যদের সলিডারিটি দেখাতে হয়।
একইভাবে বিগত বারো বছর ধরে আফগানিস্তানে ইসাফ মিশনকে আরো জোরদার করতেও চেক রিপাবলিকের অবদান তুলনাহীন। যেমন, পান্ডুরের কথাই ধরা যাক। পান্ডুর হলো বর্ম আচ্ছাদিত সামরিক যান বা আরমার্ড পার্সোনাল ক্যারিয়ার (এপিসি); কাজ হলো পদাতিক বাহিনীকে স্থানান্তর করা; আদর করে তাই ‘ব্যাটল ট্যাক্সি’ বা ‘ব্যাটল বাস’ও বলা হয়। চেকরা যে পান্ডুর ২ সিজেড এম ১-য়ের সংযোজন করেছে, সে হলো আরো অনেক বেশি স্মার্ট। ২০১১ সালে প্রথম ব্যাচের যে সতেরোটি পান্ডুর ব্যবহার শুরু হয়, সেগুলোতে এমন সব ব্যবস্থা রয়েছে যে নিজের গা বাঁচিয়ে দিব্যি শত্রু ঘায়েল সম্ভব; শুনলেও লোম খাড়া হয়, ভয়মিশ্রিত গভীর ভক্তিও জাগে।
ইসাফ মিশনে এত খরচাপাতি করে চেকরা যখন ন্যাটোর অন্যতম আধুনিক বাহিনীতে পরিণত হচ্ছে, ঠিক তখনই পরবর্তী দুই বছরে ‘ওভারসিস’ মিশনে চেক বাহিনীর কর্মপ্রক্রিয়া কি রকম হবে বিষয়ক প্রস্তাব আনা হয় চেক সংসদে। বিগত ২২ বছরে বৈদেশিক মিশনে চেকবাহিনীর ভূমিকাবিষয়ক যত প্রস্তাব চেক সংসদে আনা হয়েছে, ২০১২ সালের ১২ জুনের প্রস্তাবটির মতো আর কোন প্রস্তাবই এত মসৃণভাবে, এত সহজে পাস হয়নি। হবেই বা না কেন? সোশ্যালিস্টরা ও কমিউনিস্টরা সবসময়েই সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধির বিরোধিতা করে এসেছে, কিন্তু এবারের প্রস্তাব ছিল সংখ্যা কমিয়ে আনা। সেই মতে ২০১৩ সালে সৈন্যসংখ্যা কমে দাঁড়াবে ৫৩৯, পরের বছর ৩৪০। সৈন্যসংখ্যা কমিয়ে আনার বিষয়টি মে মাসে অনুষ্ঠিত ন্যাটোর শিকাগো ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। ২০১৪ সাল থেকে যুদ্ধ করতে সক্ষম কোন ন্যাটোবাহিনী আফগানিস্তানে থাকবে না; থাকবে কেবলমাত্র আফগান সেনাবাহিনী ও পুলিশবাহিনীকে ট্রেনিং দেওয়ার জন্য উপযুক্ত সেনা শিক্ষকরা। চেকরা আফগানদের হেলি চালনা, পুলিশী ট্রেনিংও দিয়ে আসছে। মনে করা যেতে পারে যে, সেনাবাহিনীকে সরিয়ে আনা হলেও ট্রেনিং দেয়ার লোক কিছু থেকে যাবে; হয়ত বা চেক দূতাবাসের নিরাপত্তা রক্ষার জন্যও গোটা বিশজন সেনা জোয়ানও থাকবে। সংসদীয় আলোচনায়, দুর্নীতিগ্রস্ত বর্তমান আফগান সরকার ও ন্যাটো বাহিনীকে ২০১৪ সালের মধ্যে সম্পূর্ণভাবে সরিয়ে নিলে আফগানদের অবস্থাটি কি হবে, নিয়েও বেশ দুর্ভাবনা প্রকাশিত হয়। (চীন অবশ্য ইত্যবসরেই আফগানিস্তানকে সহায়সাহায্য দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে)।
বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরনের ’ওভারসিস’ মিশন পরিচালনা ও অংশগ্রহণের সবচেয়ে বড় লাভ হলো যে ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো রণকৌশলসহ বিভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগসুবিধাগুলো পাচ্ছে। তবে সৈন্য সরিয়ে আনার সরাসরি নেতিবাচক অর্থনৈতিক প্রভাব অনুভব করবে একক ব্যক্তিগত সৈনিকটি। বৈদেশিক মিশনে থাকাকালীন মোটা অংকের যে ডিয়ে টিয়ে থাকে, তা থেকে সৈনিক বঞ্চিত হবে। অবশ্য আফগানিস্তান থেকে সরিয়ে আনা চেক সৈন্যদের সিনাই উপদ্বীপ, বসনিয়া বা কসোভোতে পাঠানোর একটি পরিকল্পনা রয়েছে; ইত্যবসরে হয়ত অন্য কোথাও মিশন পাঠানোর প্রয়োজনও হয়ে যেতে পারে। ২০০১ সাল থেকে ২০১২ সালের ২৬ মে পর্যন্ত আফগানিস্তানে কোয়ালিশন শক্তির পক্ষে নিহতের সংখ্যা ৩০১২। তার মধ্যে চেক নিহতের সংখ্যা চার। আফগান বেসামরিক নিহতের পরিসংখ্যানের খতিয়ান এখনও সম্পূর্ণ হয়নি। চালকবিহীন বিমান বা ড্রোনের হামলা অনেক অসংখ্য বেসামরিক নারীপুরুষ, শিশুর মৃত্যুকে অবিশ্বাস্য হারে বৃদ্ধিতে সাহায্য যে করছে, বলাই বাহুল্য। প্রেসিডেন্ট কারজাই তাই বার কয়েক বৈদেশিক দূতাবাসকে সতর্কও করে দেন।
আফগানিস্তান, ইরাক বা লিবিয়া- যে দেশই হোক না কেন, যুদ্ধবাবদ বিপুল খরচ তো একটি রয়েছে! সাধারণত ‘হোস্ট’ কান্ট্রি বা আতিথ্যকর্তা সেই ব্যয়ভার বহন করে থাকে। যেমন, প্রথম মহাযুদ্ধের ব্যয়ভার পরাজিত জার্মানি ‘ক্ষেপেক্ষেপে’ শোধ করেছে এবং শেষ কিস্তি শোধ করে বছর দেড় দুই আগে; ইরাক কি লিবিয়ার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটি অনুরূপ। কিন্তু আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে নাকি অন্যরকম নীতি নেয়া হয়েছে। তাদের কোন খরচ বহন করতে হবে না! খুব সম্ভব আফগানিস্তানে তেল, গ্যাসের সঞ্চয় রয়েছে। কারণ, আফগানিস্তানের ভূতাত্ত্বিক জন্ম বৃত্তান্ত অনুযায়ী থাকাটাই হবে স্বাভাবিক। মোটামুটি প্রায় চল্লিশ কি পঞ্চাশ মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীতে যে সর্বশেষ মহা মহাদেশীয় বা সুপার মহাদেশীয় সংঘর্ষটি ঘটে, তার ফলে ভারতীয় টেকটোনিক প্লেট, ইউরেশীয় প্লেট এবং এমনকি এশীয় ও আফ্রিকীয় প্লেট- নিজেদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কির এক মহা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। ফলস্বরূপ, আকস্মিক ভূমি-অভ্যুত্থান ঘটিয়ে বিস্তৃত এলাকাজুড়ে যে হিমালয় পর্বতমালার সৃষ্টি হয়, তার মধ্যে আফগানিস্তানও অন্তর্ভুক্ত। আফগানিস্তানের বিভিন্ন এলাকাজুড়ে সোনা, তামা, লিথিয়াম, ইউরেনিয়াম, কোবাল্ট, ধাতব লোহাসহ আরও কত ধরনের মূল্যবান খনিজের অপরিমেয় ভা-ার ভূমির অতলে রয়েছে; বর্তমানে দেশটিতে নব্বইটিরও অধিক খনিজ ফিল্ড রয়েছে, যা থেকে বেশ সহজেই খনিজ আহরণ সম্ভব। ২০১০ সালের এক রিপোর্টে সিআইএ ও যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-তত্ত্ববিদদের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে যে, আফগানিস্তানের এই অমূল্য খনিজের মূল্য কম করে এক ট্রিলিয়ন (এক ট্রিলিয়ন= একের পরে বারোটি শূন্য) ডলার তো হবেই। তবে আফগান সরকারের সঙ্গে কেউ কোন চুক্তি নাকি করেনি।
nadirahmajumdar@gmail.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন