ব্রুস রিডেল
ভারতীয় অর্থনীতির গতিপ্রবাহ এখন নিম্নমুখী। এই মন্থরতার প্রভাব বিশ্ব অর্থনীতিতেও পড়বে। গত এক দশক ধরে ভারতীয় অর্থনীতি ছিল দ্রুত বর্ধনশীল। কিন্তু এখন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রায় ৯ ভাগের জায়গায় নেমে এসেছে ৬ ভাগের কাছাকাছি। কারণ বহুবিধ। তবে শীর্ষ নেতৃত্ব নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে সেটাই বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। গত এক দশকের অধিকাংশ সময় ধরে পৃথিবীর সর্ববৃহত্ গণতান্ত্রিক দেশ ভারতকে যিনি নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন তাঁর নাম সোনিয়া গান্ধী। বর্তমানে তার স্বাস্থ্য ভঙুর। তাই ভারতের রাজনৈতিক প্রভাবালয়ে পরিবর্তনের আলামত বেশ স্পষ্ট।
সোনিয়া গান্ধী আজকের বিশ্বে সবচে’ ক্ষমতাবান নারী নিঃসন্দেহে। এমনকি সম্ভবত বিশ্ব ইতিহাসেও তিনি একজন অধিক প্রভাবশালী নারী। তিনি পৃথিবীর সর্ববৃহত্ গণতান্ত্রিক দেশের রাজনৈতিক নেতা, যে দেশটি জনসংখ্যার দিক থেকে অচিরেই বৃহত্তম দেশের তালিকায় নাম লিখাতে যাচ্ছে। কিন্তু গত বছর আগস্টে ভারতের কংগ্রেস পার্টি একটি ঘোষণা দেয়। এই পার্টি ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন অবসানের পর অধিকাংশ সময় ভারত শাসন করেছে। তাদের সেই ঘোষণায় বলা হয়, দলনেতা সোনিয়া গান্ধী স্বাস্থ্যগত কারণে বিদেশ যাচ্ছেন। তার কী অসুখ, তা ফাঁস করা হয়নি। এক মাস পর তিনি দেশে ফিরে আসেন। কিন্তু তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি-অবনতি বা তিনি কেন বিদেশে চিকিত্সা নিতে গেলেন সে ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু বলা হয়নি। এরপর গত ফেব্রুয়ারিতে তিনি চেকআপের জন্য আবার বিদেশ যাত্রা করলেন। ফিরে এসে তিনি পুনরায় পার্টির হাল ধরলেন। প্রকৃতপক্ষে তিনিই আজকের ভারতের বস। তাকে জনসম্মক্ষে কয়েকবার দেখা গেছে। কিন্তু যখনই তার ছবি তোলা হয়েছে, তখনই তাকে চনমনে ও কর্মক্ষম মনে হয়েছে।
নেত্রী সোনিয়া গান্ধীকে কোন্ অসুখে পেয়েছে সে সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং অবশ্যই অবগত আছেন। অন্তত আমাদেরকে তাই বলা হয়েছে। কিন্তু অন্য ভারতীয় কর্মকর্তারা সে ব্যাপারে কিছু জানেন না বললেই চলে। কেননা সোনিয়া গান্ধী খুব সতর্কভাবে তার ব্যক্তিগত বিষয়-আশয় আড়াল করে চলেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি নিজ সম্পর্কে ও নিজের নীতিগত চিন্তাধারার বিষয়ে সর্বদা রহস্যের জাল তৈরি করেন। এ পর্যন্ত তার জীবনীর যতটুকু প্রকাশিত হয়েছে তা খুবই মামুলি বিষয়। কিভাবে তিনি এত ক্ষমতাধর হয়ে উঠলেন সে ব্যাপারে বলতে গেলে গভীরভাবে তেমন কিছু বলা হয়নি কোথাও। সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার হল, ভারতীয় গণমাধ্যম পৃথিবীর সবচেয়ে স্পন্দমান গণমাধ্যমের অন্যতম। তারাও এ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেননি। তারা সোনিয়া গান্ধীর বিষয়ে সম্মিলিতভাবে নীরব থেকেছেন।
সিংহাসনের নেপথ্যে তার ক্ষমতার প্রয়োগ নিয়ে কারও কোন প্রশ্ন নেই। তিনি ১৯৯৮ সাল থেকে কংগ্রেসের প্রেডিডেন্ট হিসেবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ২০০৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে তার নেতৃত্বে এই দলটি বিস্ময়করভাবে জয়লাভ করে। এমনকি ২০০৮ সালের বিজয়ও সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়। কংগ্রেসের ১২৫ বছরের ইতিহাসে এখন তিনিই সবচেয়ে দীর্ঘদিনের প্রেসিডেন্ট। তিনি ক্ষমতাসীন জোট ইউপিএ’র (ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স) চেয়ারম্যানও বটে। ভারতীয় অর্থনীতি তার হাত ধরেই উন্নতি লাভ করেছে। লাখ লাখ মানুষ দারিদ্রের কশাঘাত থেকে মুক্তি পেয়েছে। তার সময়ে সংস্কার কর্মসূচির সূচনা হয়েছে। আমেরিকার সাথে বেসামরিক পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। ২০০৮ সালের নভেম্বরে মুম্বাইয়ে সন্ত্রাসী হামলার পরও চির প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের সাথে ভারতের সম্পর্কের অবনতির বদলে উন্নতি হয়েছে। অথচ নাইন ইলেভেনের ঘটনার (টুইন টাওয়ারে হামলা) পর মুম্বাই হামলাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী কর্মকান্ড। মুম্বাই হামলার জবাবে সামরিক পদক্ষেপের পরিবর্তে কূটনৈতিক তত্পরতাকেই অগ্রাধিকার দেয়া হয়। এই ক্রেডিট সোনিয়া গান্ধীকেই দিতে হয়।
সোনিয়া গান্ধী ১৯৪৬ সালের ৯ ডিসেম্বর ইতালির ভেনেটো প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একটি আদর্শ গ্রামে বেড়ে ওঠেন। তার পিতা ছিলেন মুসোলিনির সমর্থক। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পূর্বাঞ্চলীয় রণাঙ্গনে হিটলারের নািস বাহিনী ও ইতালীয় সেনাবাহিনীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেন। সোনিয়া গান্ধী এখনও ক্যাথলিক খ্রিস্টানই রয়ে গেছেন। তবে তিনি হিন্দু উত্সব ও ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করে থাকেন। ১৯৬৫ সালে ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজে রাজীব গান্ধীর সাথে তার দেখা হয়। সোনিয়া তখন ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংলিশের ছাত্রী। আর রাজিব গান্ধী সবে মাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন। সোনিয়া সে সময় সেখানকার একটি গ্রীক রেস্টুরেন্টে পরিচারিকারও কাজ করতেন। সেখানেই দেখা হয় দু’জনের। এরপর মধুর প্রণয় বা ভালবাসার সূত্রপাত হয়। সব বিচারেই এটা একটি নিরেট প্রেম কাহিনী । পরবর্তীতে রাজিব ও সোনিয়া গান্ধীর এক ছেলে ও এক মেয়ে জন্ম নেয়। তারা হলেন রাহুল গান্ধী ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। ১৯৮৪ সালে মা ইন্দিরা গান্ধী আততায়ী শিখ দেহরক্ষীর ব্রাশ ফায়ারে নিহত হন। এরপর প্রধানমন্ত্রী হন রাজীব গান্ধী। রাজীব গান্ধীও ১৯৯১ সালে একজন তামিল নারী সন্ত্রাসীর বোমা হামলায় নিহত হন।
শাশুড়ী ইন্দিরা গান্ধী ও স্বামী রাজীব গান্ধীর হত্যাকান্ড সোনিয়া গান্ধীকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে। তিনি ইন্দিরা গান্ধীর খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন। কেউ কেউ বলে থাকেন যে, সোনিয়া গান্ধীর রোল মডেল হচ্ছেন ইন্দিরা গান্ধী এবং তিনি প্রতিটি ক্ষেত্রে তাকে অনুসরণ করার চেষ্টা করেন। রাজীব গান্ধীর মৃত্যুর পর সোনিয়া গান্ধীর নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়। আমার মনে আছে, ১৯৯৮ সালে নয়াদিল্লীতে তার বাসভবনে যাওয়ার সময় দুইবার গাড়ি বদল করা হয়। উভয় গাড়ি বহর ছিল তার নিজস্ব নিরাপত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ। তারপরও তা যথেষ্ট মনে হচ্ছিল না। প্রথমদিকে তিনি ক্ষমতা গ্রহণে অনিচ্ছুক ছিলেন। কিন্তু পরিশেষে তাকে সম্মতি জ্ঞাপন করতে হয়। বর্তমানে এই মহীয়সী নারীর কাছে ক্ষমতা যেন প্রকৃতির ন্যায় স্বাভাবিক।
গণমাধ্যমের অনুমান হল, সোনিয়া গান্ধী গত আগস্টে নিউইয়র্কে ক্যান্সারের চিকিত্সা নিয়েছেন। কিন্তু এটা এখনও সুনিশ্চিত নয়। সোনিয়া গান্ধীর পরবর্তীতে ছেলে রাহুল গান্ধী ক্ষমতা গ্রহণ করবেন বলে ব্যাপক জনশ্রুতি আছে। কিন্তু তিনি প্রস্তুত কি না তা ভারতীয়দের এখনও সত্যিকার অর্থে নিশ্চিত করতে পারেননি। স্বাধীন ভারতের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জওহার লাল নেহরু ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি ভারত শাসন করেন ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত। একটানা ১৭ বছর। ফলে ভারতের রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা আসে। তার মেয়ে ইন্দিরা গান্ধী ১৯৬৬-১৯৭৭ পর্যন্ত ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তারপর আবার দায়িত্ব পালন করেন ১৯৮০ থেকে ১৯৮৪ সালের মৃত্যু অবধি। তার পুত্র রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন পাঁচ বছর। সম্মিলিতভাবে একই পরিবারের এই তিনজন নেতা ভারতীয় স্বাধীনতা লাভের প্রথম ৪২ বছরের মধ্যে ৩৯ বছরই ভারত শাসন করার গৌরব লাভ করেন।
একদিকে সোনিয়া গান্ধীর ভবিষ্যত্ নিয়ে অন্ধকারে ভারতবাসী। অন্যদিকে মনমোহন সিং আবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন না বলে আশা করা হচ্ছে। এ প্রেক্ষিতে ভারতের রাজনীতি কিছুটা ভাসমান ও দোদুল্যমান অবস্থায় রয়েছে। অর্থনৈতিক সংস্কার ও বিনিয়োগ নীতিমালা প্রণয়নে কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণের পথ বন্ধ হয়ে পড়েছে। ফলে অর্থনীতির প্রবাহ নিম্নগামী হচ্ছে। তবে পরাশক্তি হিসেবে ভারতের উত্থানের পেছনে যে মৌলিক কারণগুলো বিরাজমান তা অপরিবর্তিত রয়েছে। একুশ শতকে পৃথিবীর বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ভারতই হবে, এটা এখনও নিশ্চিত। বাণিজ্যিক মেধার গুণে ভারত বিশ্ব নেতার আসন গ্রহণ করবে। কিন্তু সোনিয়া গান্ধীর অনুপস্থিতিতে এটা কিছুটা বিলম্ব হবে মাত্র। অতীতে মাঝেমধ্যে তাকে নিয়ে অনেক ভুল বোঝাবুঝিরও সৃষ্টি হয়েছে।
লেখক : ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের সিনিয়র ফেলো, সাবেক সিআইএ অফিসার ও ওবামা প্রশাসনের পাকিস্তান ও আফগানিস্তান নীতি সংক্রান্ত রিভিউ কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান।
দ্য ডেইলি বিস্ট থেকে ভাষান্তর :ফাইজুল ইসলাম
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন