মেজর জেনারেল (অব.) এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার, পিএসসি
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ঘোষিত নতুন সামরিক কৌশল এবং তদানুসারে ফোর্সের অবস্থান পুনর্বিন্যাস পরিকল্পনার প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া নিয়ে বিশ্বের তাবৎ থিংক ট্যাংকগুলো এখন ঘর্মাক্ত সময় পার করছেন। বিশ্বজুড়ে সব মিডিয়াই প্রতিনিয়ত এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ করছে। হিলারি ক্লিনটনের সাম্প্রতিক সফর এবং নতুন পরিকল্পনায় ঘোষিত গুরুত্ববাহী প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের আওতাভুক্ত একটি দেশ হওয়ায় বাংলাদেশের মিডিয়া এবং মানুষের মধ্যেও এ নিয়ে ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে। নতুন পরিকল্পনা অনুসারে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কৌশলের কেন্দ্রবিন্দু হবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে ঘিরে, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এ পর্যন্ত ছিল ইউরোপকেন্দ্রিক আটলান্টিক মহাসাগরীয় অঞ্চলকে ঘিরে। ২০২০ সাল নাগাদ এ পরিকল্পনা পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন হবে বলে পেন্টাগন সূত্রে জানা গেছে। নতুন সামরিক কৌশলের অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র তাদের নৌবহরের প্রায় ৬০ ভাগ যুদ্ধজাহাজ এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মোতায়েন করবে, যা এতদিন ছিল ৫০ ভাগ। উল্লেখ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌবহরে বর্তমানে ২৮২টি যুদ্ধজাহাজ রয়েছে, যা ২০২০ সাল নাগাদ ৩০০টিতে উন্নীত হবে। গত ২ জুন সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত একটি গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিওন পেনেট্রা আনুষ্ঠানিকভাবে এ নতুন পরিকল্পনার ঘোষণা দেন। যদিও এ বছরের শুরুতেই প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা অস্ট্রেলিয়া সফরের সময় সে দেশের উত্তর প্রান্তে এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নিকটবর্তী ডারউইন বন্দরে বাড়তি মার্কিন মেরিন সেনা মোতায়েনের ঘোষণা দিয়ে নতুন সামরিক কৌশলের পর্দা উন্মোচন করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছেন, 'মার্কিন নতুন নীতি কোনো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয়, বরং সুপরিকল্পিত টেকসই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে এই নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে, যাতে এ অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়।' কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, ঠিক উল্টো কথা। জো বাইডেন অল্প কিছুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের মর্যাদাপূর্ণ সামরিক প্রতিষ্ঠান ওয়েস্ট পয়েন্ট একাডেমীতে বত্তৃদ্ধতাকালে বলেছেন, 'চীনের ক্রমবর্ধমান সামরিক শক্তিকে মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের সমর কৌশলকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানো হচ্ছে।' চীন যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করে বলেছে, 'যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সামরিক কৌশল দুই দেশের সম্পর্কে চির ধরাতে পারে, যা এ অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলবে।' চীনের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কারণে সম্পর্কের সমীকরণে ভারসাম্য রচনায় এতদঞ্চলের অন্যান্য রাষ্ট্রকে নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে বলে মন্তব্য করেন সিঙ্গাপুরের প্রতিরক্ষামন্ত্রী এনজি ইংহেন। অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী স্টিফেন স্মিথ নতুন সামরিক কৌশল ও তার অংশ হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার উত্তর অংশে বাড়তি আরও ২ হাজার ৫০০ মার্কিন মেরিন সেনা মোতায়েনের ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছেন এবং বলেছেন, এর পরিপ্রেক্ষিতে চীনের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের কোনো পরিবর্তন হবে না। নিউজিল্যান্ড যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সামরিক নীতিকে সমর্থন দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয়ের সঙ্গে কাজ করার কথা বলেছে মালয়েশিয়া। লক্ষণীয় বিষয়, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সামরিক কৌশলের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে ভারতকে গণ্য করা হলেও নতুন নীতিমালা সম্পর্কে ভারতের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়নি। পক্ষান্তরে ভারতের বেসরকারি একটি টেলিভিশন চ্যানেল সপ্তম নৌবহর ও বাংলাদেশকে জড়িয়ে কল্পনাপ্রসূত একটি সংবাদ প্রচার করে, যাকে রহস্যজনক বলে মনে করছেন বাংলাদেশের বিশ্লেষকরা। একটি দেশের সামরিক নীতি প্রণয়নে বহুবিধ উপাদানকে বিবেচনায় নেওয়া হয়ে থাকে। রাষ্ট্রের ভৌগোলিক অখণ্ডতা এবং জনগণের নিরাপত্তার পরপরই বাধ্যবাধকতা হিসেবে আসে জাতীয় অর্থনৈতিক ও ব্যবসা-বাণিজ্যিক স্বার্থের প্রতিরক্ষা এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় ভূ-রাজনৈতিক অবকাঠামোসমূহের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কৌশলের প্রধান লক্ষ্য ছিল কমিউনিজমকে প্রতিহত করা এবং আধুনিক সভ্যতার চালিকাশক্তি জ্বালানি সম্পদের সরবরাহ নিজ দেশের জন্য নিশ্চিত রাখা। ফলে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের আধিপত্য বিস্তার রোধে গঠিত হয় পশ্চিম ইউরোপকেন্দ্রিক সামরিক জোট ন্যাটো বা নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন। একই সময় মধ্যপ্রাচ্যের তেলসম্পদের ওপর নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে সামরিক কৌশল বিন্যাসে গুরুত্ব পায় ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন, ওয়ারশ সামরিক জোটের বিলুপ্তি এবং পূর্ব ইউরোপের দেশসমূহের ন্যাটোতে যোগদানসহ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পশ্চিম ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের প্রতি প্রত্যক্ষ হুমকি বহলাংশে হ্রাস পায়। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ভূমধ্যসাগর ও সুয়েজ খালের গুরুত্ব যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কখনো কমে যাবে না। তেলের স্বার্থ বজায় রাখা এবং ইরান ইস্যুর কারণে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক নীতিতে আপাতত বড় কোনো পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা কম। বরং দক্ষিণ ও দক্ষিণ এশিয়াকেন্দ্রিক নতুন সামরিক কৌশলে ফোর্সের অবস্থান বিন্যাস এমনভাবে করা হতে পারে, যাতে পারস্য উপসাগর ও লোহিত সাগর অঞ্চলে যে কোনো আকস্মিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল থেকে স্বল্প সময়ের মধ্যে যেন হস্তক্ষেপ করা যায়। নতুন কৌশলের অধীনে ফোর্সের অবস্থান বিন্যাসে যেসব উপাদান যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অগ্রগণ্য হিসেবে বিবেচিত হতে পারে, তা হলো_ এক. ভারত, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারসহ এতদঞ্চলের উপকূলীয় এলাকা এবং সমুদ্র সীমানায় তেল, গ্যাসসহ সামুদ্রিক সম্পদের যে বিপুল সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে, সেসব সম্পদ সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে যেন মার্কিন কোম্পানিগুলো প্রাধান্য পায় এবং প্রয়োজনবোধে এসব সম্পদ যাতে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে ভূমিকা রাখতে পারে, তা নিশ্চিত করা। দুই. জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থ জড়িত। তাই উত্তর প্রান্তে জাপান সাগর থেকে শুরু করে পূর্ব চীন সাগর, দক্ষিণ চীন সাগর, মালাক্কা প্রণালী ধরে ভারত মহাসাগর হয়ে সুয়েজ খাল পর্যন্ত সামুদ্রিক চ্যানেলে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষায় বাণিজ্যিক ও সামরিক জাহাজের চলাচল নির্বিঘ্ন করা। এ ছাড়া দক্ষিণ চীন সাগরের সীমানা নিয়ে ফিলিপাইন ও ভিয়েতনামের সঙ্গে চীনের যে বিরোধ রয়েছে, তা যেন চীনের একতরফা সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল না হয়, তাও এখন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বিবেচনায় থাকবে। তিন. কথিত ৯/১১-এর জের ধরে যুক্তরাষ্ট্র বিগত ১২ বছর যাবৎ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে, তার সমাপ্তি যুক্তরাষ্ট্র সহজে টানতে পারবে বলে মনে হয় না। সাম্প্রতিককালে ইয়েমেন, সোমালিয়া, সুদান, নাইজেরিয়া ও ইরাকসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে আল-কায়েদা ও সংশ্লিষ্ট জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের তৎপরতা লক্ষ্য করলেই এটা বোঝা যায়। সন্ত্রাসী ও জঙ্গিদের মূল উৎপত্তিস্থল হচ্ছে পাকিস্তান ও আফগানিস্তান। পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। পুরনো দিনের কথা বাদ দিলেও বিগত ১১ বছর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের ফ্রন্টলাইন মিত্র হিসেবে থাকা সত্ত্বেও দুই রাষ্ট্রের সম্পর্ক এখন সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। এ অবস্থায় ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী প্রত্যাহার হলে পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক বর্তমানে যতটুকু যা আছে, তারও অবসান ঘটবে। সে ক্ষেত্রে পাকিস্তান-আফগানকেন্দ্রিক সন্ত্রাসী জঙ্গিদের পুনরুত্থান ঘটবে এবং পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, ওইসব সন্ত্রাসী-জঙ্গির অপকর্মের বিস্তৃতি ভারত-বাংলাদেশসহ অন্যান্য অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়বে। অন্যদিকে গুরুত্বপূর্ণ সুয়েজ খালের সংযোগ চ্যানেল লোহিত সাগরের প্রবেশমুখে অবস্থিত ইয়েমেন ও সোমালিয়ায় সাম্প্রতিককালে আল-কায়েদার উত্থানের বিষয়টিও সঙ্গত কারণেই নতুন সামরিক কৌশল রচনায় পেন্টাগনের বিশেষজ্ঞদের নজরের বাইরে থাকবে না। ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যবর্তী জায়গায় বিরাট দেশ ইন্দোনেশিয়া। সর্ববৃহৎ মুসলিম জনঅধ্যুষিত রাষ্ট্র, সেখানেও প্রায়শই জঙ্গি সন্ত্রাসীদের তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়। পাকিস্তান-আফগানভিত্তিক সন্ত্রাসী-জঙ্গি ও অন্যান্য দেশে তাদের বর্ধিত গোষ্ঠীর অপকর্মের তৎপরতা এর আগে ভারতে যেমন দেখা গেছে, তেমনি ২০০১-০৬ পর্যন্ত বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। এসব সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর প্রধান টার্গেট হলো উদারপন্থি সেক্যুলার রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী এবং একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থসংশ্লিষ্ট অবকাঠামোসমূহ। চার. এতদঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য অর্জনে চীন যেহেতু প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী, তাই এখানে চীনের প্রভাব বিস্তার যাতে একটি সীমারেখা অতিক্রম করতে না পারে, সেরকম একটি শক্তিশালী প্রতিরোধক সৃষ্টি করাই হবে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সামরিক কৌশলের অন্যতম অনুষঙ্গ। তবে চীন-যুক্তরাষ্ট্র পরস্পরের যত বড় প্রতিদ্বন্দ্বীই হোক না কেন, তার তিক্ততা প্রলম্বিত হয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর সোভিয়েত-যুক্তরাষ্ট্রের মতো স্নায়ুযুদ্ধে রূপ নেওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ, তখন ওই দুই পক্ষের পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে অবিশ্বাস ও সন্দেহপ্রবণতার মাত্রা এতদূর গড়িয়েছিল যে, প্রতিদ্বন্দ্বী দুই পক্ষের মধ্যে অর্থপূর্ণ কোনো সংযোগ পর্যন্ত ছিল না। কিন্তু বর্তমানে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক সম্পর্ক অন্য যে কোনো একক রাষ্ট্র থেকে অনেক বেশি। অধিকন্তু চীন হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান ঋণদাতা দেশ। তা ছাড়া চীন এ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো ধরনের সামরিক সংঘর্ষে জড়িয়ে নিজের অগ্রগতিকে ব্যাহত করতে চাইবে না। যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহরের প্রধান ঘাঁটি বা সদর দফতর বর্তমানে জাপানের ইয়োকোসুকা বন্দরে অবস্থিত। মোট ৮টি টাস্ক ফোর্সে বিভক্ত হয়ে সপ্তম নৌবহর এখন জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর এবং ভারত মহাসাগরের দিয়াগো গার্সিয়া পর্যন্ত মোতায়েন আছে। সপ্তম নৌবহরে সাধারণত ৫০-৬০টি যুদ্ধ জাহাজ, ৩৫০টি জঙ্গি বিমান এবং প্রায় ৬০ হাজার মেরিন কোরের নেভি সদস্য থাকে। বর্তমানে সপ্তম নৌবহরের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে_ 'কোরীয় উপদ্বীপের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং এতদঞ্চলের যে কোনো বন্ধু রাষ্ট্রের প্রাকৃতিক দুর্যোগে ওই দেশের সেনাবাহিনীর সঙ্গে একত্রিত হয়ে ত্রাণ ও উদ্ধার অভিযানে অংশ নেওয়া। যে কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ে সপ্তম নৌবহরের ৫০ ভাগ জাহাজ সমুদ্রপথে ক্রসিংয়ে থাকে। আর বাকি অর্ধেক নির্ধারিত বন্দরে ঘাঁটি অথবা পোতাশ্রয়ের মর্যাদায় রিফুয়েলিং, বিশ্রাম এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নোঙর করা অবস্থায় থাকে। উপরে বর্ণিত পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এবং নতুন নীতিমালার চাহিদা মিটাতে ফোর্সের পুনর্বিন্যাসের জন্য এতদঞ্চলে নতুন ঘাঁটি ও পোতাশ্রয়ের দরকার হবে। নতুনভাবে কোন কোন দেশে পোতাশ্রয় ও ঘাঁটি হতে পারে তা যুক্তরাষ্ট্র এখনো স্পষ্ট করেনি। তবে এ নিয়ে জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। জাপান থেকে দিয়াগো গার্সিয়া হয়ে পারস্য উপসাগর পর্যন্ত, এ দীর্ঘ সমুদ্রপথের ওপর সমভাবে নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব বিস্তারের জন্য ফোর্সের বৃহত্তর অংশ মোতায়েনের জন্য অগ্রাধিকার তালিকায় মালাক্কা প্রণালীর নিকটবর্তী দেশসমূহের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নজর থাকা স্বাভাবিক। তবে জাপান, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ফোর্সেস স্ট্যাটাস সম্পর্কিত চুক্তি থাকায় সেসব দেশে যত সহজে নতুন ফোর্সের জন্য পোতাশ্রয় বা ঘাঁটি করা যাবে, অন্য দেশের সঙ্গে সেটি তত সহজে করা যাবে না। এটি এখন স্পষ্ট, এতদঞ্চলে সম্পর্কোন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে ভারতকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। ভারত-যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে পারমাণবিক ও সামরিক সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। গুরুত্বপূর্ণ মালাক্কা প্রণালীর মাথায় অবস্থিত নিকোবর ও আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের কারণে ভারত এতদঞ্চলের অন্যান্য রাষ্ট্রের তুলনায় সামরিকভাবে অতিরিক্ত সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। দৃশ্যমান লক্ষণ দেখে বোঝা যায়, সম্পর্কের সমীকরণে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ভারতের পাল্লা ভারী থাকবে। তবে একই সময়ে ভারত চীনের প্রভাব বিস্তার যেমন ঠেকাতে চায়, তেমনি এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার হোক তা-ও সে চায় না। কারণ অদূর বা দূর-ভবিষ্যতে এতদঞ্চলের বৃহৎ শক্তি হিসেবে ভারত নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার একটা আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বহুদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে। তার জন্য সর্বাগ্রে ভারতের প্রয়োজন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্যপদ লাভ করা। যার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয়ের সমর্থন দরকার আছে ভারতের। তাই প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সামরিক কৌশলে ভারতের সহযোগিতার মাত্রা কতখানি হবে, তা এখনো সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না। তবে এতটুকু বলা যায়, নতুন সামরিক কৌশলের অংশ হিসেবে বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগর থেকে শুরু করে আরব সাগর পর্যন্ত ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে প্রতি বছর অসংখ্য যৌথ সামরিক মহড়া হবে এবং সেসব মহড়ার জের ধরে বা তার অংশ হিসেবে ভারতের অধীনস্থ দ্বীপ এবং বন্দরসমূহে মার্কিন মেরিন বাহিনী বিশ্রাম ও রিফুয়েলিংয়ের সুযোগ পাবে। বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে উলি্লখিত হুমকি মোকাবিলায় এবং নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় ভৌগোলিক বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ইন্দোনেশিয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র হওয়ার কথা। হাজার হাজার দ্বীপ সংবলিত ইন্দোনেশিয়ার দীর্ঘ বিস্তৃতি বঙ্গোপসাগরের নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ থেকে মালাক্কা প্রণালী হয়ে পূর্বপ্রান্তে প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যস্থানের দেশ পাপুয়া নিউগিনি পর্যন্ত। কিন্তু ইন্দোনেশিয়া পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মুসলমান জনঅধ্যুষিত দেশ। সেখানে ইসলামী কট্টর মৌলবাদী গোষ্ঠীর একটি বড় প্রভাব রয়েছে, যারা পশ্চিমা দেশের যে কোনো নীতি ও স্বার্থের বিরোধী। সন্ত্রাস দমন এবং জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী হিসেবে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের মডেল। প্রাকৃতিক সম্পদ সমৃদ্ধ মিয়ানমারের ওপর চীনের বর্তমান প্রভাব ও কর্তৃত্ব মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব রয়েছে।
বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, তার প্রাকৃতিক সম্পদের মূল্য ও গুরুত্বকে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সামরিক নীতিতে যে গুরুত্বসহকারে বিবেচিত হবে, তার প্রমাণ হিলারি ক্লিনটনের সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফর। তবে সংকীর্ণ চ্যানেল ও নাব্য সংকটের কারণে বাংলাদেশের প্রধান সামুদ্রিক বন্দর চট্টগ্রাম বড় ধরনের কোনো নৌবহরের উপযুক্ত নয়। তা ছাড়া মালাক্কা প্রণালী হয়ে সুয়েজখাল পর্যন্ত জাহাজ চলাচলের যে সামুদ্রিক চ্যানেল, সেখান থেকে চট্টগ্রামের অবস্থান অনেক ভেতরে। বাংলাদেশ এখনো স্বল্পোন্নত রাষ্ট্র। চলমান উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখার জন্য বাংলাদেশকে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের সঙ্গে সম্পর্ক রচনায় অবশ্যই সব পক্ষের সঙ্গে একটি শান্তিপূর্ণ ও ভারসাম্য অবস্থা বজায় রাখা জরুরি।
লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক
ই-মেইল: sikder52@gmail.com
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ঘোষিত নতুন সামরিক কৌশল এবং তদানুসারে ফোর্সের অবস্থান পুনর্বিন্যাস পরিকল্পনার প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া নিয়ে বিশ্বের তাবৎ থিংক ট্যাংকগুলো এখন ঘর্মাক্ত সময় পার করছেন। বিশ্বজুড়ে সব মিডিয়াই প্রতিনিয়ত এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ করছে। হিলারি ক্লিনটনের সাম্প্রতিক সফর এবং নতুন পরিকল্পনায় ঘোষিত গুরুত্ববাহী প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের আওতাভুক্ত একটি দেশ হওয়ায় বাংলাদেশের মিডিয়া এবং মানুষের মধ্যেও এ নিয়ে ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে। নতুন পরিকল্পনা অনুসারে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কৌশলের কেন্দ্রবিন্দু হবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে ঘিরে, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এ পর্যন্ত ছিল ইউরোপকেন্দ্রিক আটলান্টিক মহাসাগরীয় অঞ্চলকে ঘিরে। ২০২০ সাল নাগাদ এ পরিকল্পনা পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন হবে বলে পেন্টাগন সূত্রে জানা গেছে। নতুন সামরিক কৌশলের অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র তাদের নৌবহরের প্রায় ৬০ ভাগ যুদ্ধজাহাজ এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মোতায়েন করবে, যা এতদিন ছিল ৫০ ভাগ। উল্লেখ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌবহরে বর্তমানে ২৮২টি যুদ্ধজাহাজ রয়েছে, যা ২০২০ সাল নাগাদ ৩০০টিতে উন্নীত হবে। গত ২ জুন সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত একটি গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিওন পেনেট্রা আনুষ্ঠানিকভাবে এ নতুন পরিকল্পনার ঘোষণা দেন। যদিও এ বছরের শুরুতেই প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা অস্ট্রেলিয়া সফরের সময় সে দেশের উত্তর প্রান্তে এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নিকটবর্তী ডারউইন বন্দরে বাড়তি মার্কিন মেরিন সেনা মোতায়েনের ঘোষণা দিয়ে নতুন সামরিক কৌশলের পর্দা উন্মোচন করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছেন, 'মার্কিন নতুন নীতি কোনো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয়, বরং সুপরিকল্পিত টেকসই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে এই নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে, যাতে এ অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়।' কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, ঠিক উল্টো কথা। জো বাইডেন অল্প কিছুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের মর্যাদাপূর্ণ সামরিক প্রতিষ্ঠান ওয়েস্ট পয়েন্ট একাডেমীতে বত্তৃদ্ধতাকালে বলেছেন, 'চীনের ক্রমবর্ধমান সামরিক শক্তিকে মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের সমর কৌশলকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানো হচ্ছে।' চীন যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করে বলেছে, 'যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সামরিক কৌশল দুই দেশের সম্পর্কে চির ধরাতে পারে, যা এ অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলবে।' চীনের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কারণে সম্পর্কের সমীকরণে ভারসাম্য রচনায় এতদঞ্চলের অন্যান্য রাষ্ট্রকে নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে বলে মন্তব্য করেন সিঙ্গাপুরের প্রতিরক্ষামন্ত্রী এনজি ইংহেন। অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী স্টিফেন স্মিথ নতুন সামরিক কৌশল ও তার অংশ হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার উত্তর অংশে বাড়তি আরও ২ হাজার ৫০০ মার্কিন মেরিন সেনা মোতায়েনের ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছেন এবং বলেছেন, এর পরিপ্রেক্ষিতে চীনের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের কোনো পরিবর্তন হবে না। নিউজিল্যান্ড যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সামরিক নীতিকে সমর্থন দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয়ের সঙ্গে কাজ করার কথা বলেছে মালয়েশিয়া। লক্ষণীয় বিষয়, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সামরিক কৌশলের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে ভারতকে গণ্য করা হলেও নতুন নীতিমালা সম্পর্কে ভারতের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়নি। পক্ষান্তরে ভারতের বেসরকারি একটি টেলিভিশন চ্যানেল সপ্তম নৌবহর ও বাংলাদেশকে জড়িয়ে কল্পনাপ্রসূত একটি সংবাদ প্রচার করে, যাকে রহস্যজনক বলে মনে করছেন বাংলাদেশের বিশ্লেষকরা। একটি দেশের সামরিক নীতি প্রণয়নে বহুবিধ উপাদানকে বিবেচনায় নেওয়া হয়ে থাকে। রাষ্ট্রের ভৌগোলিক অখণ্ডতা এবং জনগণের নিরাপত্তার পরপরই বাধ্যবাধকতা হিসেবে আসে জাতীয় অর্থনৈতিক ও ব্যবসা-বাণিজ্যিক স্বার্থের প্রতিরক্ষা এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় ভূ-রাজনৈতিক অবকাঠামোসমূহের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কৌশলের প্রধান লক্ষ্য ছিল কমিউনিজমকে প্রতিহত করা এবং আধুনিক সভ্যতার চালিকাশক্তি জ্বালানি সম্পদের সরবরাহ নিজ দেশের জন্য নিশ্চিত রাখা। ফলে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের আধিপত্য বিস্তার রোধে গঠিত হয় পশ্চিম ইউরোপকেন্দ্রিক সামরিক জোট ন্যাটো বা নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন। একই সময় মধ্যপ্রাচ্যের তেলসম্পদের ওপর নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে সামরিক কৌশল বিন্যাসে গুরুত্ব পায় ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন, ওয়ারশ সামরিক জোটের বিলুপ্তি এবং পূর্ব ইউরোপের দেশসমূহের ন্যাটোতে যোগদানসহ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পশ্চিম ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের প্রতি প্রত্যক্ষ হুমকি বহলাংশে হ্রাস পায়। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ভূমধ্যসাগর ও সুয়েজ খালের গুরুত্ব যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কখনো কমে যাবে না। তেলের স্বার্থ বজায় রাখা এবং ইরান ইস্যুর কারণে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক নীতিতে আপাতত বড় কোনো পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা কম। বরং দক্ষিণ ও দক্ষিণ এশিয়াকেন্দ্রিক নতুন সামরিক কৌশলে ফোর্সের অবস্থান বিন্যাস এমনভাবে করা হতে পারে, যাতে পারস্য উপসাগর ও লোহিত সাগর অঞ্চলে যে কোনো আকস্মিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল থেকে স্বল্প সময়ের মধ্যে যেন হস্তক্ষেপ করা যায়। নতুন কৌশলের অধীনে ফোর্সের অবস্থান বিন্যাসে যেসব উপাদান যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অগ্রগণ্য হিসেবে বিবেচিত হতে পারে, তা হলো_ এক. ভারত, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারসহ এতদঞ্চলের উপকূলীয় এলাকা এবং সমুদ্র সীমানায় তেল, গ্যাসসহ সামুদ্রিক সম্পদের যে বিপুল সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে, সেসব সম্পদ সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে যেন মার্কিন কোম্পানিগুলো প্রাধান্য পায় এবং প্রয়োজনবোধে এসব সম্পদ যাতে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে ভূমিকা রাখতে পারে, তা নিশ্চিত করা। দুই. জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থ জড়িত। তাই উত্তর প্রান্তে জাপান সাগর থেকে শুরু করে পূর্ব চীন সাগর, দক্ষিণ চীন সাগর, মালাক্কা প্রণালী ধরে ভারত মহাসাগর হয়ে সুয়েজ খাল পর্যন্ত সামুদ্রিক চ্যানেলে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষায় বাণিজ্যিক ও সামরিক জাহাজের চলাচল নির্বিঘ্ন করা। এ ছাড়া দক্ষিণ চীন সাগরের সীমানা নিয়ে ফিলিপাইন ও ভিয়েতনামের সঙ্গে চীনের যে বিরোধ রয়েছে, তা যেন চীনের একতরফা সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল না হয়, তাও এখন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বিবেচনায় থাকবে। তিন. কথিত ৯/১১-এর জের ধরে যুক্তরাষ্ট্র বিগত ১২ বছর যাবৎ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে, তার সমাপ্তি যুক্তরাষ্ট্র সহজে টানতে পারবে বলে মনে হয় না। সাম্প্রতিককালে ইয়েমেন, সোমালিয়া, সুদান, নাইজেরিয়া ও ইরাকসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে আল-কায়েদা ও সংশ্লিষ্ট জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের তৎপরতা লক্ষ্য করলেই এটা বোঝা যায়। সন্ত্রাসী ও জঙ্গিদের মূল উৎপত্তিস্থল হচ্ছে পাকিস্তান ও আফগানিস্তান। পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। পুরনো দিনের কথা বাদ দিলেও বিগত ১১ বছর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের ফ্রন্টলাইন মিত্র হিসেবে থাকা সত্ত্বেও দুই রাষ্ট্রের সম্পর্ক এখন সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। এ অবস্থায় ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী প্রত্যাহার হলে পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক বর্তমানে যতটুকু যা আছে, তারও অবসান ঘটবে। সে ক্ষেত্রে পাকিস্তান-আফগানকেন্দ্রিক সন্ত্রাসী জঙ্গিদের পুনরুত্থান ঘটবে এবং পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, ওইসব সন্ত্রাসী-জঙ্গির অপকর্মের বিস্তৃতি ভারত-বাংলাদেশসহ অন্যান্য অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়বে। অন্যদিকে গুরুত্বপূর্ণ সুয়েজ খালের সংযোগ চ্যানেল লোহিত সাগরের প্রবেশমুখে অবস্থিত ইয়েমেন ও সোমালিয়ায় সাম্প্রতিককালে আল-কায়েদার উত্থানের বিষয়টিও সঙ্গত কারণেই নতুন সামরিক কৌশল রচনায় পেন্টাগনের বিশেষজ্ঞদের নজরের বাইরে থাকবে না। ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যবর্তী জায়গায় বিরাট দেশ ইন্দোনেশিয়া। সর্ববৃহৎ মুসলিম জনঅধ্যুষিত রাষ্ট্র, সেখানেও প্রায়শই জঙ্গি সন্ত্রাসীদের তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়। পাকিস্তান-আফগানভিত্তিক সন্ত্রাসী-জঙ্গি ও অন্যান্য দেশে তাদের বর্ধিত গোষ্ঠীর অপকর্মের তৎপরতা এর আগে ভারতে যেমন দেখা গেছে, তেমনি ২০০১-০৬ পর্যন্ত বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। এসব সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর প্রধান টার্গেট হলো উদারপন্থি সেক্যুলার রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী এবং একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থসংশ্লিষ্ট অবকাঠামোসমূহ। চার. এতদঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য অর্জনে চীন যেহেতু প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী, তাই এখানে চীনের প্রভাব বিস্তার যাতে একটি সীমারেখা অতিক্রম করতে না পারে, সেরকম একটি শক্তিশালী প্রতিরোধক সৃষ্টি করাই হবে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সামরিক কৌশলের অন্যতম অনুষঙ্গ। তবে চীন-যুক্তরাষ্ট্র পরস্পরের যত বড় প্রতিদ্বন্দ্বীই হোক না কেন, তার তিক্ততা প্রলম্বিত হয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর সোভিয়েত-যুক্তরাষ্ট্রের মতো স্নায়ুযুদ্ধে রূপ নেওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ, তখন ওই দুই পক্ষের পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে অবিশ্বাস ও সন্দেহপ্রবণতার মাত্রা এতদূর গড়িয়েছিল যে, প্রতিদ্বন্দ্বী দুই পক্ষের মধ্যে অর্থপূর্ণ কোনো সংযোগ পর্যন্ত ছিল না। কিন্তু বর্তমানে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক সম্পর্ক অন্য যে কোনো একক রাষ্ট্র থেকে অনেক বেশি। অধিকন্তু চীন হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান ঋণদাতা দেশ। তা ছাড়া চীন এ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো ধরনের সামরিক সংঘর্ষে জড়িয়ে নিজের অগ্রগতিকে ব্যাহত করতে চাইবে না। যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহরের প্রধান ঘাঁটি বা সদর দফতর বর্তমানে জাপানের ইয়োকোসুকা বন্দরে অবস্থিত। মোট ৮টি টাস্ক ফোর্সে বিভক্ত হয়ে সপ্তম নৌবহর এখন জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর এবং ভারত মহাসাগরের দিয়াগো গার্সিয়া পর্যন্ত মোতায়েন আছে। সপ্তম নৌবহরে সাধারণত ৫০-৬০টি যুদ্ধ জাহাজ, ৩৫০টি জঙ্গি বিমান এবং প্রায় ৬০ হাজার মেরিন কোরের নেভি সদস্য থাকে। বর্তমানে সপ্তম নৌবহরের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে_ 'কোরীয় উপদ্বীপের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং এতদঞ্চলের যে কোনো বন্ধু রাষ্ট্রের প্রাকৃতিক দুর্যোগে ওই দেশের সেনাবাহিনীর সঙ্গে একত্রিত হয়ে ত্রাণ ও উদ্ধার অভিযানে অংশ নেওয়া। যে কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ে সপ্তম নৌবহরের ৫০ ভাগ জাহাজ সমুদ্রপথে ক্রসিংয়ে থাকে। আর বাকি অর্ধেক নির্ধারিত বন্দরে ঘাঁটি অথবা পোতাশ্রয়ের মর্যাদায় রিফুয়েলিং, বিশ্রাম এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নোঙর করা অবস্থায় থাকে। উপরে বর্ণিত পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এবং নতুন নীতিমালার চাহিদা মিটাতে ফোর্সের পুনর্বিন্যাসের জন্য এতদঞ্চলে নতুন ঘাঁটি ও পোতাশ্রয়ের দরকার হবে। নতুনভাবে কোন কোন দেশে পোতাশ্রয় ও ঘাঁটি হতে পারে তা যুক্তরাষ্ট্র এখনো স্পষ্ট করেনি। তবে এ নিয়ে জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। জাপান থেকে দিয়াগো গার্সিয়া হয়ে পারস্য উপসাগর পর্যন্ত, এ দীর্ঘ সমুদ্রপথের ওপর সমভাবে নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব বিস্তারের জন্য ফোর্সের বৃহত্তর অংশ মোতায়েনের জন্য অগ্রাধিকার তালিকায় মালাক্কা প্রণালীর নিকটবর্তী দেশসমূহের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নজর থাকা স্বাভাবিক। তবে জাপান, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ফোর্সেস স্ট্যাটাস সম্পর্কিত চুক্তি থাকায় সেসব দেশে যত সহজে নতুন ফোর্সের জন্য পোতাশ্রয় বা ঘাঁটি করা যাবে, অন্য দেশের সঙ্গে সেটি তত সহজে করা যাবে না। এটি এখন স্পষ্ট, এতদঞ্চলে সম্পর্কোন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে ভারতকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। ভারত-যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে পারমাণবিক ও সামরিক সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। গুরুত্বপূর্ণ মালাক্কা প্রণালীর মাথায় অবস্থিত নিকোবর ও আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের কারণে ভারত এতদঞ্চলের অন্যান্য রাষ্ট্রের তুলনায় সামরিকভাবে অতিরিক্ত সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। দৃশ্যমান লক্ষণ দেখে বোঝা যায়, সম্পর্কের সমীকরণে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ভারতের পাল্লা ভারী থাকবে। তবে একই সময়ে ভারত চীনের প্রভাব বিস্তার যেমন ঠেকাতে চায়, তেমনি এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার হোক তা-ও সে চায় না। কারণ অদূর বা দূর-ভবিষ্যতে এতদঞ্চলের বৃহৎ শক্তি হিসেবে ভারত নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার একটা আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বহুদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে। তার জন্য সর্বাগ্রে ভারতের প্রয়োজন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্যপদ লাভ করা। যার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয়ের সমর্থন দরকার আছে ভারতের। তাই প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সামরিক কৌশলে ভারতের সহযোগিতার মাত্রা কতখানি হবে, তা এখনো সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না। তবে এতটুকু বলা যায়, নতুন সামরিক কৌশলের অংশ হিসেবে বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগর থেকে শুরু করে আরব সাগর পর্যন্ত ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে প্রতি বছর অসংখ্য যৌথ সামরিক মহড়া হবে এবং সেসব মহড়ার জের ধরে বা তার অংশ হিসেবে ভারতের অধীনস্থ দ্বীপ এবং বন্দরসমূহে মার্কিন মেরিন বাহিনী বিশ্রাম ও রিফুয়েলিংয়ের সুযোগ পাবে। বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে উলি্লখিত হুমকি মোকাবিলায় এবং নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় ভৌগোলিক বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ইন্দোনেশিয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র হওয়ার কথা। হাজার হাজার দ্বীপ সংবলিত ইন্দোনেশিয়ার দীর্ঘ বিস্তৃতি বঙ্গোপসাগরের নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ থেকে মালাক্কা প্রণালী হয়ে পূর্বপ্রান্তে প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যস্থানের দেশ পাপুয়া নিউগিনি পর্যন্ত। কিন্তু ইন্দোনেশিয়া পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মুসলমান জনঅধ্যুষিত দেশ। সেখানে ইসলামী কট্টর মৌলবাদী গোষ্ঠীর একটি বড় প্রভাব রয়েছে, যারা পশ্চিমা দেশের যে কোনো নীতি ও স্বার্থের বিরোধী। সন্ত্রাস দমন এবং জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী হিসেবে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের মডেল। প্রাকৃতিক সম্পদ সমৃদ্ধ মিয়ানমারের ওপর চীনের বর্তমান প্রভাব ও কর্তৃত্ব মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব রয়েছে।
বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, তার প্রাকৃতিক সম্পদের মূল্য ও গুরুত্বকে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সামরিক নীতিতে যে গুরুত্বসহকারে বিবেচিত হবে, তার প্রমাণ হিলারি ক্লিনটনের সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফর। তবে সংকীর্ণ চ্যানেল ও নাব্য সংকটের কারণে বাংলাদেশের প্রধান সামুদ্রিক বন্দর চট্টগ্রাম বড় ধরনের কোনো নৌবহরের উপযুক্ত নয়। তা ছাড়া মালাক্কা প্রণালী হয়ে সুয়েজখাল পর্যন্ত জাহাজ চলাচলের যে সামুদ্রিক চ্যানেল, সেখান থেকে চট্টগ্রামের অবস্থান অনেক ভেতরে। বাংলাদেশ এখনো স্বল্পোন্নত রাষ্ট্র। চলমান উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখার জন্য বাংলাদেশকে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের সঙ্গে সম্পর্ক রচনায় অবশ্যই সব পক্ষের সঙ্গে একটি শান্তিপূর্ণ ও ভারসাম্য অবস্থা বজায় রাখা জরুরি।
লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক
ই-মেইল: sikder52@gmail.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন