মাসুমুর রহমান খলিলী
মধ্যপ্রাচ্যে হৃৎপিণ্ডসম জনপদ মিসরের আকাশে কালো মেঘ ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে। বেসরকারি ফলাফল অনুসারে দ্বিতীয় দফা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রায় ১০ লাখ ভোটের ব্যবধানে মুসলিম ব্রাদারহুড প্রার্থী ড. মুরসি বিজয়ী হওয়ার পরও বেসামরিক কর্তৃপক্ষের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর অনিশ্চিত হয়ে রয়েছে। পরাজিত প্রার্থী হোসনি মোবারকের সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী এয়ার মার্শাল (অব:) আহমদ শফিকও বিজয় দাবি করে সরকারি ফলাফল পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলেছেন। ড. মুরসি এক কোটি ৩০ লাখ এবং আহমদ শফিক এক কোটি ২০ লাখ ভোট পেয়েছেন বলে বেসরকারি ফলাফলে বেরিয়ে এসেছে। দু’জনের ভোটের ব্যবধান ৫ শতাংশের মতো।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এই ফলাফল যখন গণমাধ্যমে প্রচার হচ্ছিল, তখন সামরিক জান্তার এক মুখপাত্র জনাকীর্ণ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, চলতি মাসের শেষ দিকে সামরিক পরিষদ বেসামরিক প্রেসিডেন্টের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। তবে মিসরের সংবিধান প্রণয়ন করবে সেনা পরিষদ যে ১০০ জনের সমন্বয়ে সংবিধান পরিষদ গঠন করেছে তারা। প্রেসিডেন্টকে যেকোনো বড় সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সেনা কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে। এর আগে মোবারক আমলে নিযুক্ত সাংবিধানিক আদালতের প্রধান বিচারপতি এক মামলার জের ধরে মিসরের এ যাবৎকালের সবচেয়ে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে গঠিত সংসদের এক-তৃতীয়াংশ আসন বাতিল ঘোষণা করে। এর জের ধরে সেনা পরিষদ পুরো সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করে সংসদকক্ষে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে।
সেনা পরিষদের এ পদক্ষেপের পরই মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিওন প্যানেটার সাথে কথা বলেছেন সামরিক জান্তাপ্রধান ও মোবারকের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় জেনারেল হোসেন তানতাবি। বাতিল ঘোষিত সংসদের স্পিকার অবশ্য সেনা পরিষদের সিদ্ধান্ত অবৈধ উল্লেখ করে বলেছেন, নির্বাচিত সংসদকে কেবল গণভোটের অনুমোদন নিয়েই বাতিল করা যেতে পারে। সামরিক আমলাদের কর্তৃত্ব গ্রহণের এ তৎপরতাকে ‘অভ্যুত্থান’ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এ ধরনের তৎপরতার বিরুদ্ধে লাখ লাখ লোক সমবেত হয়েছে তাহরির স্কয়ারে। সব মিলিয়ে একধরনের কালো মেঘ ক্রমেই আচ্ছন্ন করে ফেলছে নীল নদ ও পিরামিডের দেশ মিসরকে।
মিসরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে শুরু থেকেই একধরনের অনিশ্চয়তা ছিল। এর বেসরকারি ফলাফল ঘোষণার পর ‘সামরিক সরকারের পতন হোক’ বলে স্লোগান দিতে থাকে জনগণ। এ সময় ড. মুরসি সংপ্তি ভাষণও দেন। এতে তিনি বলেন, মোবারকবিরোধী গণ-আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন, আইন করে তিনি তাদের পরিবারের অধিকার সংরতি করবেন। এ ছাড়া মিসরের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় কপটিক খ্রিষ্টানদের উদ্দেশেও কথা বলেন মুরসি। তিনি বলেন, মিসরের সব মানুষকে তিনি নিজ পরিবারের সদস্যের মতো দেখবেন। কোনো প্রতিশোধ নেয়া হবে না বলেও জোরালো প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে মুরসি বলেন, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তিনি সবার জন্য কাজ করে যাবেন।
ড. মুরসি বলেন, ‘আল্লাহ মিসরের জনগণকে সঠিক পথে পরিচালনা করেছেন; তাদেরকে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার পথে পরিচালিত করেছেন।’ একটি সুশীল, সংবিধানভিত্তিক ও গণতান্ত্রিক আধুনিক মিসর গড়ার প্রতিশ্রুতিও দেন মুরসি।
আহমদ শফিক এই বেসরকারি ফলাফল মেনে নিতে অস্বীকার করে সরকারি ফলাফলের জন্য অপো করবেন বলে জানিয়েছেন। তার সহকারীরা নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার দাবিও করেছেন। এই সরকারি ফলাফল প্রকাশ হতে আরো কয়েক দিন লেগে যাবে।
মিসরে দুই পক্ষের বিজয় দাবি সেনা কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন পদক্ষেপ অনেকের মধ্যে প্রশ্ন সৃষ্টি করেছেÑ সাড়াজাগানো মিসরের তাহরির স্কয়ারের গণবিপ্লব ইসরাইলি স্বার্থের কাছে পরাভূত হয়ে যাচ্ছে কি না। মিসরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত অবাধ ও মুক্ত নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদ পতিত স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের নিযুক্ত সাংবিধানিক আদালতের প্রধান বিচারপতি বাতিল ও বিলুপ্ত ঘোষণার পর এ প্রশ্ন আলোচিত হচ্ছে দেশে-বিদেশে। প্রধান বিচারপতির রায় ঘোষণার আগে বিচারক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ঘটা করে সাংবাদিক সমাবেশের মাধ্যমে মুসলিম ব্রাদারহুড ইস্যুতে রাজনীতি নিরপেক্ষ না থাকার ঘোষণা দেয়ার পর বোঝা গিয়েছিলÑ মিসরের রাজনৈতিক আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। সব কিছুই যে সামরিক জান্তাপ্রধান জেনারেল তানতাবির ইচ্ছায় ঘটছে তা স্পষ্ট হয় সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণার আগে ও পরের ঘটনাপরম্পরায়। কোর্ট প্রথমে সংসদে এক-তৃতীয়াংশ আসন অবৈধ বলে উল্লেখ করে এর পরে আবার সেনা পরিষদের ইচ্ছায় পুরো সংসদই বাতিল ঘোষণা করে। এরপরই তানতাবির জান্তা কর্তৃপক্ষ সংসদ সদস্যদের অধিবেশনকক্ষে প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। সাংবিধানিক আদালতের প্রধান বিচারপতির ঘোষিত অদ্ভুত ধরনের সিদ্ধান্তে বলা হয়Ñ সংসদ ও সংবিধানের অনুপস্থিতিতে সামরিক কর্তৃপক্ষের ডিক্রি দিয়ে চালিত হবে মিসর। তারাই ঠিক করবে সংবিধান প্রণয়ন পরিষদে কারা কারা সদস্য থাকবেন।
মিসরে সর্বজনস্বীকৃত মুক্ত ও অবাধ নির্বাচনে গঠিত সংসদ সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের আগেই বাতিল ঘোষণার বিস্ময়কর রায়ের পরপর মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিওন প্যানেটা কথা বলেছেন ফিল্ডমার্শাল হোসেন তানতাবির সাথে। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বর্তমান সংসদ বাতিল করার পর দ্রুত নতুন সংসদ নির্বাচনের আশাবাদ ব্যক্ত করে পরোক্ষভাবে মিসরের চলমান ঘটনার প্রতি তাদের সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। ইসরাইলের পত্রপত্রিকায় মিসরের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উন্নয়নে উল্লাস প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দুই দিন আগে মোবারকপন্থী বিচারপতিদের সংসদ বাতিলের এই উদ্যোগের পেছনের মার্কিন-ইসরাইল বলয় সক্রিয় ছিল বলে বেশির ভাগ মিসরবাসীর বিশ্বাস। এই উসকানিমূলক পদক্ষেপের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে দুই ধরনের ঘটনা প্রত্যাশা করা হয়েছিল। প্রথমত, সংসদ বাতিল করার পর এ ধরনের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ব্রাদারহুড প্রেসিডেন্ট নির্বাচন বর্জন করে তাহরির স্কয়ারে নতুন করে আন্দোলনের ঘোষণা দিতে পারে বলে মনে করা হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা না দেয়া হলেও এর প্রতিবাদে গোটা মিসরে প্রতিবাদ বিক্ষোভ হবে আর এতে সংঘর্ষ ও দাঙ্গা বেধে যেতে পারে। এ সুযোগে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনও বাতিল ঘোষণা করে তানতাবির কঠোর সামরিক শাসন চাপিয়ে দেয়া হবে মিসরে। প্রতিরোধ দমানোর জন্য প্রয়োজনে আলজেরিয়ার মতো হাজার হাজার লোক হত্যা করা হবে।
সাংবিধানিক কোর্টের বিতর্কিত সিদ্ধান্তের পর মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতিক্রিয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ পেলেও প্রেসিডেন্ট নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠানের কৌশল নেয় তারা। এই নির্বাচনে ব্রাদারহুড বিপ্লবের পক্ষের শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করে। অন্য দিকে আহমদ শফিক সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী ও সামরিক বেসামরিক প্রশাসন সংশ্লিষ্টদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে স্থিতিশীলতা আনার প্রতিশ্রুতি দেয়। এই মেরুকরণের ফলাফল ব্রাদারহুড প্রার্থী ড. মুরসির পক্ষে এলেও নির্বাচনকে নিয়ে সামরিক জান্তা কী পরিকল্পনা করছে সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। সরকারিভাবে নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে আহমদ শফিককে জেতানোর চেষ্টা হলে এর ফলাফল মিসরকে চরম এক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেবে। সেটি নিয়ন্ত্রণে কতটুকু সক্ষম জান্তা সরকার হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে। সেনা সরকার তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে তাহরির স্কয়ারকে জনমুক্ত রাখতে বারবার চেষ্টা করে সফল হয়নি।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বেসরকারি ফলে ড. মুরসি জয়ী হলেও সামরিক জান্তার প্রস্তাব অনুসারে ১ জুলাই বেসামরিক কর্তৃপক্ষের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর হবেÑ এমন নিশ্চয়তা নেই। নির্বাচনের ইস্যু আবার কেউ সুপ্রিম কোর্টে নিয়ে যেতে পারেন। এর সূত্র ধরে মোবারকের নিযুক্ত বিচারপতিরা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনও বাতিল ঘোষণা করতে পারেন। সেটি হলে মিসর আবার অরাজকতার দিকে চলে যেতে পারে।
মুসলিম ব্রাদারহুডের ব্যাপারে ভীতি ছড়াতে ইরানের শাসনব্যবস্থা মিসরে নিয়ে আসার প্রচারণা চালানো হয়েছে। বলা হয়েছে, মিসরে ইসলামপন্থীরা ক্ষমতায় গিয়ে সেনাবাহিনীর সমান্তরালে বিপ্লবী গার্ড গঠন করে তাদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেবে। মোবারক আমলের বিচারপতিদের অপসারণ করে ব্রাদারহুড সমর্থকদের নিয়োগ দেয়া হবে। প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন পদগুলোতে পরিবর্তন আসবে। এ ব্যাপারে সংসদের প্রাধান্য সংবলিত সংবিধান পরিষদ গঠনকে নিয়েও বিতর্ক তৈরি করা হয়েছে। সে সাথে সংসদ নির্বাচন যেখানে তুলনামূলক স্বচ্ছ ও অবাধ হয়েছিল, সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিভিন্ন ধরনের জালিয়াতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে। জাল ব্যালটের কারখানার সন্ধান পাওয়া গেছে। সব মিলিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত কতটুকু জনমতের প্রতিফলন ঘটে তা নিয়ে অনেকে শঙ্কিত ছিলেন।
সেনা নেতৃত্বের কৌশলে একটি বিতর্ক এবার তুলে দিয়েছে যে, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ড. মুরসি ও আহমদ শফিক কেউ কাক্সিত নন। আহমদ শফিক জয়ী হলে বিপ্লব সমর্থকেরা সারা দেশে প্রতিবাদ বিক্ষোভ করবে। মুরসি জিতলে সেকুলারিস্টদের মাঠে নামিয়ে বিক্ষোভ করা হবে। এতে যে অরাজক অবস্থা তৈরি হবে তাকে সামরিক নেতৃত্ব দীর্ঘ সময়ের জন্য ক্ষমতা নেয়ার যুুক্তি হিসেবে দাঁড় করাবে। মোবারকের ভাইস প্রেসিডেন্ট ওমর সোলাইমান নির্বাচনের আগেই মন্তব্য করেনÑ আহমদ শফিক জিতলে দেশের মানুষ তা মানবে না। ড. মুরসি জিতলে সেনাবাহিনী অভ্যুত্থান ঘটাবে। ওমর সোলাইমানের এই মন্তব্যের পরই সাংবিধানিক কোর্ট সংসদে এক-তৃতীয়াংশ আসন বাতিল করে আর সেনা পরিষদ পুরো সংসদই বাতিল করে দেয়।
মিসরের বিপ্লবকে ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য ষড়যন্ত্রের জাল যে সর্বগ্রাসী হয়ে উঠছে তাতে সংশয় নেই। সেনা নেতৃত্ব আলজেরিয়ার মতো দমন করে সফল হবে মনে করলে সেনাশাসন জারির পথেই যাবে। অন্য দিকে নতুন করে গণবিদ্রোহের আশঙ্কা থাকলে তারা বিপ্লবকারীদের সাথে সমঝোতার চেষ্টা করবে। তবে মিসরের পরিস্থিতিকে নেপথ্যে থেকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে তেল-আবিব ও ওয়াশিংটন। সেনা নেতৃত্ব নিজেদের কায়েমি স্বার্থের কারণে হয়তো বা সেই চক্রান্ত ষড়যন্ত্রে দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে।
mrkmmb@gmail.com
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এই ফলাফল যখন গণমাধ্যমে প্রচার হচ্ছিল, তখন সামরিক জান্তার এক মুখপাত্র জনাকীর্ণ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, চলতি মাসের শেষ দিকে সামরিক পরিষদ বেসামরিক প্রেসিডেন্টের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। তবে মিসরের সংবিধান প্রণয়ন করবে সেনা পরিষদ যে ১০০ জনের সমন্বয়ে সংবিধান পরিষদ গঠন করেছে তারা। প্রেসিডেন্টকে যেকোনো বড় সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সেনা কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে। এর আগে মোবারক আমলে নিযুক্ত সাংবিধানিক আদালতের প্রধান বিচারপতি এক মামলার জের ধরে মিসরের এ যাবৎকালের সবচেয়ে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে গঠিত সংসদের এক-তৃতীয়াংশ আসন বাতিল ঘোষণা করে। এর জের ধরে সেনা পরিষদ পুরো সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করে সংসদকক্ষে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে।
সেনা পরিষদের এ পদক্ষেপের পরই মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিওন প্যানেটার সাথে কথা বলেছেন সামরিক জান্তাপ্রধান ও মোবারকের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় জেনারেল হোসেন তানতাবি। বাতিল ঘোষিত সংসদের স্পিকার অবশ্য সেনা পরিষদের সিদ্ধান্ত অবৈধ উল্লেখ করে বলেছেন, নির্বাচিত সংসদকে কেবল গণভোটের অনুমোদন নিয়েই বাতিল করা যেতে পারে। সামরিক আমলাদের কর্তৃত্ব গ্রহণের এ তৎপরতাকে ‘অভ্যুত্থান’ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এ ধরনের তৎপরতার বিরুদ্ধে লাখ লাখ লোক সমবেত হয়েছে তাহরির স্কয়ারে। সব মিলিয়ে একধরনের কালো মেঘ ক্রমেই আচ্ছন্ন করে ফেলছে নীল নদ ও পিরামিডের দেশ মিসরকে।
মিসরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে শুরু থেকেই একধরনের অনিশ্চয়তা ছিল। এর বেসরকারি ফলাফল ঘোষণার পর ‘সামরিক সরকারের পতন হোক’ বলে স্লোগান দিতে থাকে জনগণ। এ সময় ড. মুরসি সংপ্তি ভাষণও দেন। এতে তিনি বলেন, মোবারকবিরোধী গণ-আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন, আইন করে তিনি তাদের পরিবারের অধিকার সংরতি করবেন। এ ছাড়া মিসরের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় কপটিক খ্রিষ্টানদের উদ্দেশেও কথা বলেন মুরসি। তিনি বলেন, মিসরের সব মানুষকে তিনি নিজ পরিবারের সদস্যের মতো দেখবেন। কোনো প্রতিশোধ নেয়া হবে না বলেও জোরালো প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে মুরসি বলেন, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তিনি সবার জন্য কাজ করে যাবেন।
ড. মুরসি বলেন, ‘আল্লাহ মিসরের জনগণকে সঠিক পথে পরিচালনা করেছেন; তাদেরকে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার পথে পরিচালিত করেছেন।’ একটি সুশীল, সংবিধানভিত্তিক ও গণতান্ত্রিক আধুনিক মিসর গড়ার প্রতিশ্রুতিও দেন মুরসি।
আহমদ শফিক এই বেসরকারি ফলাফল মেনে নিতে অস্বীকার করে সরকারি ফলাফলের জন্য অপো করবেন বলে জানিয়েছেন। তার সহকারীরা নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার দাবিও করেছেন। এই সরকারি ফলাফল প্রকাশ হতে আরো কয়েক দিন লেগে যাবে।
মিসরে দুই পক্ষের বিজয় দাবি সেনা কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন পদক্ষেপ অনেকের মধ্যে প্রশ্ন সৃষ্টি করেছেÑ সাড়াজাগানো মিসরের তাহরির স্কয়ারের গণবিপ্লব ইসরাইলি স্বার্থের কাছে পরাভূত হয়ে যাচ্ছে কি না। মিসরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত অবাধ ও মুক্ত নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদ পতিত স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের নিযুক্ত সাংবিধানিক আদালতের প্রধান বিচারপতি বাতিল ও বিলুপ্ত ঘোষণার পর এ প্রশ্ন আলোচিত হচ্ছে দেশে-বিদেশে। প্রধান বিচারপতির রায় ঘোষণার আগে বিচারক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ঘটা করে সাংবাদিক সমাবেশের মাধ্যমে মুসলিম ব্রাদারহুড ইস্যুতে রাজনীতি নিরপেক্ষ না থাকার ঘোষণা দেয়ার পর বোঝা গিয়েছিলÑ মিসরের রাজনৈতিক আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। সব কিছুই যে সামরিক জান্তাপ্রধান জেনারেল তানতাবির ইচ্ছায় ঘটছে তা স্পষ্ট হয় সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণার আগে ও পরের ঘটনাপরম্পরায়। কোর্ট প্রথমে সংসদে এক-তৃতীয়াংশ আসন অবৈধ বলে উল্লেখ করে এর পরে আবার সেনা পরিষদের ইচ্ছায় পুরো সংসদই বাতিল ঘোষণা করে। এরপরই তানতাবির জান্তা কর্তৃপক্ষ সংসদ সদস্যদের অধিবেশনকক্ষে প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। সাংবিধানিক আদালতের প্রধান বিচারপতির ঘোষিত অদ্ভুত ধরনের সিদ্ধান্তে বলা হয়Ñ সংসদ ও সংবিধানের অনুপস্থিতিতে সামরিক কর্তৃপক্ষের ডিক্রি দিয়ে চালিত হবে মিসর। তারাই ঠিক করবে সংবিধান প্রণয়ন পরিষদে কারা কারা সদস্য থাকবেন।
মিসরে সর্বজনস্বীকৃত মুক্ত ও অবাধ নির্বাচনে গঠিত সংসদ সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের আগেই বাতিল ঘোষণার বিস্ময়কর রায়ের পরপর মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিওন প্যানেটা কথা বলেছেন ফিল্ডমার্শাল হোসেন তানতাবির সাথে। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বর্তমান সংসদ বাতিল করার পর দ্রুত নতুন সংসদ নির্বাচনের আশাবাদ ব্যক্ত করে পরোক্ষভাবে মিসরের চলমান ঘটনার প্রতি তাদের সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। ইসরাইলের পত্রপত্রিকায় মিসরের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উন্নয়নে উল্লাস প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দুই দিন আগে মোবারকপন্থী বিচারপতিদের সংসদ বাতিলের এই উদ্যোগের পেছনের মার্কিন-ইসরাইল বলয় সক্রিয় ছিল বলে বেশির ভাগ মিসরবাসীর বিশ্বাস। এই উসকানিমূলক পদক্ষেপের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে দুই ধরনের ঘটনা প্রত্যাশা করা হয়েছিল। প্রথমত, সংসদ বাতিল করার পর এ ধরনের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ব্রাদারহুড প্রেসিডেন্ট নির্বাচন বর্জন করে তাহরির স্কয়ারে নতুন করে আন্দোলনের ঘোষণা দিতে পারে বলে মনে করা হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা না দেয়া হলেও এর প্রতিবাদে গোটা মিসরে প্রতিবাদ বিক্ষোভ হবে আর এতে সংঘর্ষ ও দাঙ্গা বেধে যেতে পারে। এ সুযোগে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনও বাতিল ঘোষণা করে তানতাবির কঠোর সামরিক শাসন চাপিয়ে দেয়া হবে মিসরে। প্রতিরোধ দমানোর জন্য প্রয়োজনে আলজেরিয়ার মতো হাজার হাজার লোক হত্যা করা হবে।
সাংবিধানিক কোর্টের বিতর্কিত সিদ্ধান্তের পর মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতিক্রিয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ পেলেও প্রেসিডেন্ট নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠানের কৌশল নেয় তারা। এই নির্বাচনে ব্রাদারহুড বিপ্লবের পক্ষের শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করে। অন্য দিকে আহমদ শফিক সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী ও সামরিক বেসামরিক প্রশাসন সংশ্লিষ্টদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে স্থিতিশীলতা আনার প্রতিশ্রুতি দেয়। এই মেরুকরণের ফলাফল ব্রাদারহুড প্রার্থী ড. মুরসির পক্ষে এলেও নির্বাচনকে নিয়ে সামরিক জান্তা কী পরিকল্পনা করছে সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। সরকারিভাবে নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে আহমদ শফিককে জেতানোর চেষ্টা হলে এর ফলাফল মিসরকে চরম এক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেবে। সেটি নিয়ন্ত্রণে কতটুকু সক্ষম জান্তা সরকার হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে। সেনা সরকার তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে তাহরির স্কয়ারকে জনমুক্ত রাখতে বারবার চেষ্টা করে সফল হয়নি।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বেসরকারি ফলে ড. মুরসি জয়ী হলেও সামরিক জান্তার প্রস্তাব অনুসারে ১ জুলাই বেসামরিক কর্তৃপক্ষের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর হবেÑ এমন নিশ্চয়তা নেই। নির্বাচনের ইস্যু আবার কেউ সুপ্রিম কোর্টে নিয়ে যেতে পারেন। এর সূত্র ধরে মোবারকের নিযুক্ত বিচারপতিরা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনও বাতিল ঘোষণা করতে পারেন। সেটি হলে মিসর আবার অরাজকতার দিকে চলে যেতে পারে।
মুসলিম ব্রাদারহুডের ব্যাপারে ভীতি ছড়াতে ইরানের শাসনব্যবস্থা মিসরে নিয়ে আসার প্রচারণা চালানো হয়েছে। বলা হয়েছে, মিসরে ইসলামপন্থীরা ক্ষমতায় গিয়ে সেনাবাহিনীর সমান্তরালে বিপ্লবী গার্ড গঠন করে তাদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেবে। মোবারক আমলের বিচারপতিদের অপসারণ করে ব্রাদারহুড সমর্থকদের নিয়োগ দেয়া হবে। প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন পদগুলোতে পরিবর্তন আসবে। এ ব্যাপারে সংসদের প্রাধান্য সংবলিত সংবিধান পরিষদ গঠনকে নিয়েও বিতর্ক তৈরি করা হয়েছে। সে সাথে সংসদ নির্বাচন যেখানে তুলনামূলক স্বচ্ছ ও অবাধ হয়েছিল, সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিভিন্ন ধরনের জালিয়াতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে। জাল ব্যালটের কারখানার সন্ধান পাওয়া গেছে। সব মিলিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত কতটুকু জনমতের প্রতিফলন ঘটে তা নিয়ে অনেকে শঙ্কিত ছিলেন।
সেনা নেতৃত্বের কৌশলে একটি বিতর্ক এবার তুলে দিয়েছে যে, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ড. মুরসি ও আহমদ শফিক কেউ কাক্সিত নন। আহমদ শফিক জয়ী হলে বিপ্লব সমর্থকেরা সারা দেশে প্রতিবাদ বিক্ষোভ করবে। মুরসি জিতলে সেকুলারিস্টদের মাঠে নামিয়ে বিক্ষোভ করা হবে। এতে যে অরাজক অবস্থা তৈরি হবে তাকে সামরিক নেতৃত্ব দীর্ঘ সময়ের জন্য ক্ষমতা নেয়ার যুুক্তি হিসেবে দাঁড় করাবে। মোবারকের ভাইস প্রেসিডেন্ট ওমর সোলাইমান নির্বাচনের আগেই মন্তব্য করেনÑ আহমদ শফিক জিতলে দেশের মানুষ তা মানবে না। ড. মুরসি জিতলে সেনাবাহিনী অভ্যুত্থান ঘটাবে। ওমর সোলাইমানের এই মন্তব্যের পরই সাংবিধানিক কোর্ট সংসদে এক-তৃতীয়াংশ আসন বাতিল করে আর সেনা পরিষদ পুরো সংসদই বাতিল করে দেয়।
মিসরের বিপ্লবকে ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য ষড়যন্ত্রের জাল যে সর্বগ্রাসী হয়ে উঠছে তাতে সংশয় নেই। সেনা নেতৃত্ব আলজেরিয়ার মতো দমন করে সফল হবে মনে করলে সেনাশাসন জারির পথেই যাবে। অন্য দিকে নতুন করে গণবিদ্রোহের আশঙ্কা থাকলে তারা বিপ্লবকারীদের সাথে সমঝোতার চেষ্টা করবে। তবে মিসরের পরিস্থিতিকে নেপথ্যে থেকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে তেল-আবিব ও ওয়াশিংটন। সেনা নেতৃত্ব নিজেদের কায়েমি স্বার্থের কারণে হয়তো বা সেই চক্রান্ত ষড়যন্ত্রে দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে।
mrkmmb@gmail.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন