বুধবার, ২০ জুন, ২০১২

মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় আমেরিকাকে নতুন করে ভাবতে হবে


 লেসলি এইচ গেল্ব  

মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক এমন কিছু বিশেষজ্ঞ রয়েছেন, যারা মধ্যপ্রাচ্যে হত্যাযজ্ঞ ও সংঘাত সহিংসতায় বিভিন্ন দেশকে কেবলই পক্ষাবলম্বনে উস্কে দিয়ে থাকেন। তেমন বিশেষজ্ঞরাই মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত নিরসনে যুক্তরাষ্ট্রকে সামরিক হস্তক্ষেপের পরামর্শ দেন। অথচ মধ্যপ্রাচ্যের বাস্তবতা হচ্ছে তাতে পরিস্থিতির উন্নতি না হয়ে বরং সহিংসতা এবং রক্তপাতের ঘটনা বেড়েই চলেছে। এক্ষেত্রে মিসরের কথাই ধরা যাক।
মিসরে সদ্য অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট গণনা শেষের দিকে। আজ নির্বাচন কমিশন ফলাফল ঘোষণা করবে। আপাতদৃষ্টিতে অনুমেয় যে, এ নির্বাচনে কেউই প্রকৃতপক্ষে বিজয়ী হবেন না। ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী আহমেদ শফিক যদি এ নির্বাচনে বিজয়ী হন মুসলিম ব্রাদারহুড প্রার্থী মোহাম্মদ মুরসি তা গ্রহণ করবেন না। তেমন পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীই তাদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করবে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ইতিমধ্যে সেনাবাহিনী একটি সাংবিধানিক ডিক্রি জারিও করেছে। তারা তাদের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার চেষ্টা করলে শেষ পর্যন্ত ফের দেশটির রাজপথ উত্তাল হয়ে উঠবে। আর তা কেবলই কায়রোর তাহরির স্কোয়ারেই সীমাবদ্ধ থাকবে তেমনটি ভাবা যায় না। বরং সে আগুন ছড়িয়ে পড়তে পারে গোটা দেশে। অন্যদিকে মুরসি বিজয়ী হলে সেনাবাহিনী তাদের ওপর দমন-নিপীড়নের স্টিম রোলার চালাবে। পরিণতিতে সংঘাত-সহিংসতা ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। তেমন পরিস্থিতিতে গুলি বিনিময় বন্ধতো হবেই না উপরন্তু মিসর-ইসরাইল সম্পর্ক আরো খারাপের দিকে যাবে। এক্ষেত্রে ওয়াশিংটনের কোন পক্ষ বেছে নেয়া উচিত কিনা সে ব্যাপারে বিতর্ক উঠতেই পারে। তবে মনে রাখা দরকার, অধিকাংশ মিসরী দেশটির দুর্নীতিবাজ ও বর্বর নিষ্ঠুর সেনাবাহিনীকে ঘৃণা করে। বস্তুত তারই পরিপ্রেক্ষিতে একবছর আগে দেশটির জনগণ সেনাবাহিনীর দমন-নিপীড়ন থেকে রক্ষা পেতে তাহরির স্কোয়ারে সমবেত হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছিল। তাদের নেতৃত্ব দিয়েছিল মুসলিম ব্রাদারহুড ও অন্যান্য মুসলিম চরমপন্থি। সে সময় বিক্ষোভকারীরাই আমাদের হূদয় জয় করেছিল। সেনাবাহিনী চিরদিনের জন্য ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে পারে না। মিসরের সেনাবাহিনীর ক্ষমতারও হয়তো অবসান হবে। তাতে যদি ইসলামি চরমপন্থি গোষ্ঠী ক্ষমতাসীন হয় তাতে করে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পাদিত শান্তি চুক্তি ভেঙ্গে পড়বে। মুসলিম ব্রাদারহুড নেতৃবৃন্দ সে ব্যাপারে অঙ্গীকারও ব্যক্ত করেছেন। একই সঙ্গে স্মরণযোগ্য যে, কয়েক দশক যাবত্ তারা ইসরাইলের ওপর প্রতিশোধ নেয়ার জন্যও প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। বাস্তবতা হচ্ছে মিসর-ইসরাইল শান্তিচুক্তি ছাড়া গোটা মধ্যপ্রাচ্যে অশান্তির আগুন ছড়িয়ে পড়বে।
এ প্রসঙ্গে সিরিয়ার দিকে তাকালে তেমন পরিস্থিতির কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। যদিও হুভার ইনস্টিটিউশনের ফুয়াদ আজমি একে গৃহযুদ্ধ হিসাবে দেখছেন তথাপি বাস্তবতা হচ্ছে সংখ্যালঘু ক্ষমতাসীন আলাবিদস দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতাকে বরাবরই ঘৃণার চোখে দেখে আসছে। কেবল তাই নয়, ক্ষমতাসীনদের মধ্যে ৭৫ শতাংশের সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠদের ব্যাপারে ভীতিরও জন্ম দিয়েছে। ক্ষমতাসীন বাশার আল আসাদ ও তার  সমবর্ণ বিশিষ্ট অপরাপর সহযোগীরা ভাল করেই জানেন, যদি তারা ক্ষমতাচ্যুত হন সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নিরা তাদের কচুকাটা করবে। কাজেই আলাবিদসরা তাদের শেষ রক্ষায় লড়াই চালিয়ে যেতে চান। পক্ষান্তরে সুন্নি বিদ্রোহীরাও সমঝোতায় আসতে নারাজ। কেননা তাদের ধারণা তারা যদি অস্ত্র সংবরণ করেন তাহলে কল্লা কাটা যাবে অচিরেই। এমন পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষের কারণেই দুই পক্ষের মধ্যে কোন ধরনের সমঝোতার লক্ষণ নেই।
এদিকে সিনেটর ও জনহিতৈষী কাজে  হস্তক্ষেপকারীদের একটি গ্রুপ বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রকে সিরিয়ায় বিমান হামলা চালানো এমনকি প্রয়োজনে আরো কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রস্তাব দিচ্ছে। যদিও এসব কাজে তাদের মোটেও অভিজ্ঞতা নেই। অথচ প্রকৃত সামরিক বিশেষজ্ঞরা ঠিকই জানেন যে, এ ধরনের হামলায় বর্তমান সংঘাত সহিংসতার চেয়ে আরো বেশি সিরীয় নাগরিক প্রাণ হারাবে। স্বাভাবিক নিয়ম হচ্ছে সম্ভাব্য হামলার শিকার সিরিয়া তার বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরো জোরদার করবে। হয়তো ঐ নির্দিষ্ট গ্রুপ বলতে চাইবে খুব সহজেই আমরা সে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবো। কিন্তু কথা হচ্ছে বিমান হামলার পরও যদি কাঙ্ক্ষিত ফল না আসে তাহলে কি পদাতিক সৈন্য পাঠাতে হবে? প্রকৃতপক্ষে এমনতর হস্তক্ষেপকারীরা সর্বশেষ চেষ্টায় বিফল হলে কি অবস্থা দাঁড়াবে তা বুঝতে চায় না।  উপরন্তু সহজ উপায়ের প্রতি ইঙ্গিত করে তারা কেবলই একের পর এক সৈন্য সংখ্যা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়ে থাকেন। তাও বিফল হলে তাদের হাতে থাকে একমাত্র শেষ মন্ত্র উদ্বাস্তু রক্ষায় সিরিয়ার সীমান্ত এলাকায় নিরাপদ জোন গড়ে তোলা। সামরিক ব্যবস্থার একমাত্র লক্ষ্য সেটাই।
লিবিয়ার বিষয়টিই এখানে স্মরণযোগ্য। একনায়ক কর্নেল গাদ্দাফির নিপীড়ন নির্যাতন থেকে দেশটির জনগণকে রক্ষায় এবং তাদের ক্ষমতায় অংশীদার করার জন্যই গণতন্ত্রকামী ইউরোপীয় ও আমেরিকানরা ছাড়াও বিশ্বের অন্যান্য দেশের মানবতাবাদীরা এক সুরে সমর্থন ব্যক্ত করেন। এমনকি একনায়কত্বের অবসান-পরবর্তী সময়ে তারা লিবিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু এখনও দেশটিতে ৬০টিও বেশি বিভিন্ন মিলিশিয়া গ্রুপ নিজ নিজ স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সংঘাতে লিপ্ত রয়েছে। এবারে আসা যাক তেলসমৃদ্ধ এবং কৌশলগত দিক দিয়ে অবস্থিত এ দেশটিতে আল-কায়েদা ও তাদের মিত্রদের ক্ষমতায়ন প্রসঙ্গে।
লিবিয়ার ত্রাণকর্তারা কখনই তাদের বিজয়ের ব্যাপারে প্রতিবেশী দেশে কি ধরনের প্রভাব পড়তে পারে তা চিন্তা করেনি। অথচ গাদ্দাফিকে নানাভাবে সাহায্যকারী মালির একটি গ্রুপ দেশটির উত্তরাঞ্চলে একটি ইসলামি রাষ্ট্রের ঘোষণা দিয়েছে। তাছাড়া ইয়েমেন ও বাহরাইনে সহিংসতার কথাও ভুললে চলবে না। মার্কিন ড্রোন ও কমান্ডো হামলা সত্ত্বেও ইয়েমেনের কয়েকটি অঞ্চলে এখনও আল-কায়েদার ঘাঁটি অটুট রয়েছে। পারস্য উপসাগরে মার্কিন পঞ্চম নৌবহরের উপস্থিতি সত্ত্বেও শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ বাহরাইনে ক্ষমতাসীন সংখ্যালঘু সুন্নিরা। কেবল তিউনিসিয়ায় কিছু প্রতিশ্রুতি রক্ষা হয়েছে। যদিও তা নগণ্য। এমন পরিবেশ পরিস্থিতিতে সিরিয়ায় ওয়াশিংটনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার বিষয়টি নিতান্তই বোকামি। অথচ কেবল নির্বোধ বিশেষজ্ঞরাই এ ব্যাপারে অজ্ঞ যে, ঐ অঞ্চলের মানুষ অন্য কিছুও ভাবতে পারে। অন্য বিবেচনায় একথাও বলা যায়, মধ্যপ্রাচ্য হচ্ছে একদিকে ওয়াশিংটন ও অন্যদিকে রাশিয়া ও চীনের যুদ্ধক্ষেত্র। মধ্যপ্রাচ্যে একটি বৃহত্ শক্তি বিপরীত অবস্থানে থাকায় সিরিয়ার মতো দেশে যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রণী ভূমিকা পালন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক্ষেত্রে ওয়াশিংটনের উচিত এ অঞ্চলে কার্যকরী ক্ষমতাচর্চার আগে অন্যতম শক্তিধর দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করা। এজন্য প্রথমত আমেরিকাকে বুঝতে হবে যে, কেবলই গণতন্ত্র কায়েমের দায়িত্ব তাদের নয়। অবাধ ও সুষ্ঠু ভোটের মাধ্যমেই একনায়কত্ব, দুর্নীতি, বর্বরতা ও নারীর দাসত্ব দশা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। সে কাজেই অধিকতর ভূমিকা রাখা দরকার। দ্বিতীয়ত, একে অপরের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব পোষণ করলে কূটনৈতিক সমঝোতায় উপনীত হওয়া প্রায়ই অসম্ভব হয়ে পড়ে। বিশেষ করে যদি এক পক্ষ মনে করে, হয় শাসন করবো নতুবা মরবো। আবার অন্য পক্ষ যদি ভাবে একই গোষ্ঠী বা পক্ষের অব্যাহত শাসন দেখার চেয়ে মরাও ভাল—তাহলে সংঘাতময় পরিস্থিতিতে কূটনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছা সম্ভব হয় না। মনে রাখা দরকার কখনও কখনও যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটরাও এ ধরনের উদ্যোগে সফল হয় না। কিন্তু তাই বলে হাত গুঠিয়ে বসে থাকলে চলে না। উদ্যোগ অব্যাহত রাখতেই হয়। কেননা কোন কোন ক্ষেত্রে অসম্ভবও সম্ভব হয়। যেমন সর্বশেষ ঘটনা সুদান। তৃতীয়ত, মনে রাখা দরকার একনায়ককে উত্খাত করলেই শান্তি-স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হবে—তেমনটি কল্পনা করা উচিত নয়। তার প্রমাণ ইরাক থেকে সাদ্দাম হোসেন এবং আফগানিস্তান থেকে তালেবান উত্খাত হওয়া সত্ত্বেও রক্তপাত ও সহিংসতা বজায় রয়েছে। তাই দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজ করা উচিত। অহেতুক প্রাণহানি থেকে দূরে থাকতে প্রত্যেকটি দেশের বিবদমান পক্ষগুলোকে অনুরোধ করতে হবে। এক্ষেত্রে বিজয়ী হতে পারবে না এমন পক্ষকে বেছে নেয়া মোটেই ঠিক নয়। বরং বিজিত এবং পরাজিত উভয় পক্ষের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়তে প্রস্তুত থাকতে হবে। সর্বশেষ তেলসমৃদ্ধ আরব দেশগুলোর সঙ্গে এমনভাবে কাজ করতে হবে, যাতে সেখানকার বিজিত ও পরাজিত উভয় পক্ষের মধ্যের দেয়াল অপসারণে ভূমিকা রাখা যায়।
++ভাষান্তর :জাকিরুল ইসলাম

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন