বুধবার, ২০ জুন, ২০১২

মিয়ানমারের জাতিগত দাঙ্গা মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক মহলকে এগিয়ে আসতে হবে



মো.সেলিম আহমেদ ডালিম :
 মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রাখাইন এবং রোহিঙ্গাদের জাতিগত দাঙ্গায় এক অমানবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ দাঙ্গার পর জীবন বাঁচাতে হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় লাভের চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক কোন আইন বা কনভেনশনে অনুস্বাক্ষর না করলেও বিপদাপন্ন রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়েছে। নববই দশকে দাঙ্গা এবং জাতিগত নিপীড়নে মিয়ানমার থেকে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। বর্তমানে সেখানে নিবন্ধনকৃত রয়েছে ২৮ হাজার এবং অনিবন্ধনকৃত রয়েছে ৫ লাখেরও বেশি। এ ব্যাপারে পূর্বে পশ্চিমা দেশগুলোর অনুরোধে বাংলাদেশ এগিয়ে এলেও পরবর্তীতে তাদের ফিরিয়ে নেয়া এবং পুনর্বাসনে কোন ভূমিকা নিতে তাদের দেখা যায়নি। তাই শরণার্থী হিসেবে রোহিঙ্গা সমস্যা দীর্ঘ দিনের। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি সাহায্য-সহযোগিতার হাত এ ক্ষেত্রে প্রসারিত করতেন তাহলে রোহিঙ্গারা বর্তমান প্রেক্ষাপটে যে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে তা তাদের পড়তে হতো না। জাতিসংঘ এবং পশ্চিমা বিশ্ব গত দু'যুগ ধরে মিয়ানমারের ব্যাপারে কোন শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি বলে বর্তমান সময়ে জটিলতা আরো বেড়ে গেছে। মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে ৮ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী রয়েছে। মিয়ানমারের জাতিগত দাঙ্গায় সেখানে ত্রিশ হাজার রোহিঙ্গা তাদের আশ্রয় হারিয়েছে এবং বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করা কালে ১ হাজার পাঁচশত রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। মিয়ানমারে বর্তমানে যে মানবিক বিপর্যয় অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তাতে সেখানকার নারী-পুরুষ এবং শিশুরা চরম নিরাপত্তাহীনতা ভুগছে। সেখানে হত্যা, গুম ও নারী ধর্ষণের যে চিত্র পাওয়া যাচ্ছে তা অত্যন্ত করুণ এবং হৃদয়  বিদারক। জাতিগত দাঙ্গায় এখন বিশ্বের অনেক দেশ জড়িয়ে পড়েছে। এখন সেখানেও দেখা দিয়েছে মানবিক বিপর্যয়। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বর্তমানে সে পরিস্থিতি দেখা দেয়ায় পার্শ্ববর্তী দেশ হিসেবে আমরা উদ্বিগ্ন না হয়ে পারি না। সেখানে রাখাইনদের হামলা থেকে রক্ষা পেতে বাংলাদেশে আশ্রয় লাভের চেষ্টা করছে শত শত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশের মানুষ রোহিঙ্গা শরণার্থীর বিষয়টিকে বরাবরই মানবিক দৃষ্টিতে দেখছে। এর আগে নিজেদের সীমিত সম্পদ নিয়েও তাদের আশ্রয় দিতে কার্পণ্য করেনি। কিন্তু মিয়ানমার সরকার সে বিষয়ে কখনো কর্ণপাত করেনি। তারপরও একটা কথা থেকে যায় মানবতার কোন ভাষা নেই, কোন ধর্ম নেই। সর্বক্ষেত্রে মানবিকতার মূল্যেবোধ জাগিয়ে তুলতে হবে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মিয়ানমার সরকারের সাথে ফলপ্রসূ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে কিভাবে সংকটাপন্ন অবস্থা থেকে বের হওয়া যায় সে দিগটা বিবেচনায় রাখতে হবে সবার আগে। কারণ জীবন বাঁচানোর তাগিদে যারা আমাদের কাছে আশ্রয় লাভের চেষ্টা করছে তাদের আমরা ফিরিয়ে দিতে পারি না। মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। বৈষম্যমূলক আচরণ করছে সেখানকার রাখাইন সম্প্রদায়। সেখানে এখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় অনেক রোহিঙ্গা সংখ্যালঘু হতাহতের শিকার হয়েছেন। তাই জীবন বাঁচাবার তাগিদে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী দল বেঁধে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টায় দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেছেন, রোহিঙ্গাদের প্রবেশ করা কোন মতেই বাংলাদেশ মেনে নিবে না। এর আগে ১৯৯১-১৯৯২ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং ভূমি বিরোধের কারণে পাঁচ লাখের মতো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। কিন্তু মিয়ানমার সরকার তাদের ফিরিয়ে নিতে এখন পর্যন্ত কোন পদক্ষেপ নেয়নি। সে জন্যই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কঠোরতা। কিন্তু তারপরও মানবিক বিষয়টি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এড়িয়ে যেতে পারেন না। তাদের কিভাবে রক্ষা করা যায় সে ব্যাপারে মিয়ানমার সরকারের সাথে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখে আন্তর্জাতিক মহলকে সজাগ করে তুলতে হবে। বিভিন্ন সময় বাংলাদেশী শ্রমিকরা অনেক দেশে সরকার পতনের আন্দোলনের মুখে পড়ে তারা সীমান্তবর্তী দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছিল। তাছাড়া ১৯৭১ সালে ভারত বাংলাদেশের শরণার্থীদের জায়গা না দিলে বাংলাদেশ মৃতপুরীতে পরিণত হয়ে হতাহতের ঘটনা অনেক বেশি হতো, সে কথাটি ভুলে গেলে চলবে না। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সমস্যা মোকাবেলায় মিয়ানমার সরকারের সাথে বোঝাপড়া করে দ্রুত সংকট থেকে উত্তরণ ঘটাবে এটাই দেশবাসী প্রত্যাশা করেন। মানুষ মানুষের জন্য গানের এ কথাটি এখন যেন উঠে গেছে। মানবিকতার ন্যূনতম বোধটুকুও যেন মানুষের কাছ থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। তাদের দু'হাতের কাকুতি মিনতি যেন কারো মন গলাতে পারছে না। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সম্প্রদায় জাতিগত দাঙ্গার মুখে পড়ে তাদের দেশ থেকে পালিয়ে আসতে বাধ্য হচ্ছে। তাদের কোন গন্তব্য জানা নেই। পাশের সমুদ্র পাড়ি দিয়ে তাই সামান্য আশ্রয়ের সন্ধানে তারা বাংলদেশের দিকে ছুটে আসছে। একদিকে নিজ দেশের মানুষের দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত, অপরদিকে যেখানে আশ্রয়ের জন্য ছুটে আসছে সেখানে বন্দুকের নল তাক করানো। তাহলে তাদের এখন গন্তব্য কোথায়? বাংলাদেশ সরকার মানবিকতার দিকপাল ভুলে গিয়ে তাদের প্রবেশে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছে। জীবন রক্ষার্থে যাদের ছুটে আশা তাদের অমানবিক ভাবে তাড়িয়ে না দিয়ে অন্ততপক্ষে কিছুটা সহযোগিতার হাত প্রসারিত করতে পারে। তাহলেই মানবতা বেঁচে যায়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে প্রবেশের কোন সুযোগ নেই বলে ঘোষণা করেছেন। কিন্তু তার ভুলে গেলে চলবে না ১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী নৃশংস হত্যাকান্ড ঘটিয়ে অনেক নিরীহ মানুষ হত্যা করেছিল তখন ভারত শরণার্থী হিসেবে তাদের দুয়ার খুলে না দিলে আমাদের আরো অনেক হতাহতের শিকার হতে হতো। কিছু দিন আগে লিবিয়ায় আমাদের অনেক শ্রমিক সেখানকার দাঙ্গার মুখে পড়ে পার্শ্ববর্তী দেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় লাভ করেছিল। কিন্তু আজ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখে এরকম অমানবিক কথা শুনে মানুষ হিসেবে লজ্জবোধ হয়। তার হয়তো ব্যর্থতা রয়েছে আগের শরণার্থীদের মিয়ানমার সরকারকে বুঝিয়ে দিতে পারেননি বলে। কিন্তু যারা জীবন বাঁচার তাগিদে সামান্য আশ্রয়ের চেষ্টা করছে তাদের ক্ষেত্রে এতোটা অমানবিকতা প্রদর্শন তার না করলেও চলতো। আমরা আশা করবো বাংলাদেশ সরকার মানবিক দিকটি চিন্তা করে রোহিঙ্গাদের দুর্দশা মানবতার দৃষ্টিতে দেখবে। গত এক সপ্তাহে ৭৩১ জনকে মিয়ানমারে পুশব্যাক করা হয়েছে। মিয়ানমারের আকিয়াবের ৪৩ জন নাগরিককে বহনকারী একটি ট্রলার নষ্ট হওয়ায় বুধবার থেকে সেন্টমার্টিনে তাদের প্রহরায় রাখা হয়। এদিকে শাহপরীর দ্বীপ থেকে মিয়ানমারের চার নাগরিককে ট্রলারে সেন্টমার্টিনে পাঠায় বিজিবি। এরপর ৪৭ জনকে একটি ট্রলারে করে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়।  শাহপরীর দ্বীপে আরও ১৩ জন বিজিবির হেফাজতে রয়েছে। তাদের যে কোন সময় মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হতে পারে। মিয়ানমারের এসব নাগরিককে শাহপরীর দ্বীপের বিভিন্ন স্থান থেকে আটক করা হয়। তারা রাতের অন্ধকারে সেন্টমার্টিনে অনুপ্রবেশ করেছিল। আরাকান রাজ্যে রাখাইন-মুসলিম সহিংসতা ছড়িয়ে পড়লে তারা আকিয়াব জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে ৫-৭টি ট্রলারে করে চার-পাঁচশ' রোহিঙ্গা বাংলাদেশের জলসীমায় ঢুকে পড়ে এবং বিভিন্নভাবে কূলে ওঠার চেষ্টা করে। শাহপরীর দ্বীপ ও সেন্টমার্টিন উপকূল থেকে বারবার ফিরিয়ে দেয়া হলেও তারা অনুপ্রবেশ করে। মিয়ানমারের সহিংস পরিস্থিতি ক্রমশ শান্ত হয়ে আসছে। মিয়ানমারের মংডু জেলার মুসলমানরা তাদের বাড়িঘরে ফিরতে শুরু করেছেন। মংডু টাউনশিপে কিছু কিছু দোকানপাট খুলেছে। সীমান্ত বাণিজ্যের আওতায় বাংলাদেশে আসা মিয়ানমারের ২৭১ নাগরিকের মধ্যে ২৫৯ জন ফেরত যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন। অপরদিকে মিয়ানমারে থাকা ৫৫ জন বাংলাদেশীর মধ্যে ৪৯ জন ফিরে এলেও সেখানে রয়ে গেছেন ৬ জন। সহিংসতা শুরুর পর থেকে মিয়ানমার থেকে পণ্যবাহী কোন জাহাজ টেকনাফ স্থলবন্দরে প্রবেশ করেনি। আগে আসা ট্রলারগুলো পণ্য খালাস করে ফিরে যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে।
-লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন