২০১১ সাল শেষ হয়ে গেল আন্তর্জাতিক
রাজনীতিতে অনেক ঘটনার মধ্যে দিয়ে। বিদায়ী বছরটি শুরু হয়েছিল আরব বিশ্বে
গণজাগরণের মধ্যে দিয়ে। আর শেষ হল উত্তর কোরিয়ার ‘মহান নেতা’ কিম জং ইলের
মৃত্যু ও তার ছোট সন্তান কিম জং উনের ক্ষমতা গ্রহণের মধ্যে দিয়ে। কোন
সমাজতান্ত্রিক দেশ যে পারিবারিকভাবে শাসিত হতে পারে উত্তর কোরিয়া তার বড়
প্রমাণ। একসময় উত্তর কোরিয়া শাসন করতেন ‘লৌহমানব’ কিম উল সুং। তার মৃত্যুর
পর (১৯৯৪) ক্ষমতা নেন তার সন্তান কিম জং ইল। আর এখন ক্ষমতা নিলেন কিম জং
উন। ২০১১ সালের অনেক ঘটনার মধ্যে এই ঘটনাটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। কেননা,
কিম জং উন উত্তর কোরিয়ায় এক ধরনের সংস্কার আনতে পারেন, দক্ষিণ কোরিয়ার
সঙ্গে ‘যুদ্ধে’ জড়িয়ে পড়তে পারেন কিংবা তার শাসনামলে দুই কোরিয়া একত্রিত
হতে পারে। এমনকি পারিবারিক দ্বন্দ্বেও জড়িয়ে পড়তে পারেন কিম জং উন। অনেক
প্রশ্নকে সামনে রেখে এখন কোরিয়ার রাজনীতি আবর্তিত হবে। মনে রাখতে হবে,
উত্তর কোরিয়া অষ্টম পারমাণবিক শক্তিধর দেশ। একদিকে উত্তর কোরিয়ায় চরম খাদ্য
সংকট, অন্যদিকে উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচি, সব মিলিয়ে কোরীয়
উপদ্বীপের রাজনীতি যে আগামী দিনগুলোতে আলোচিত হতে থাকবে, তা বলার অপেক্ষা
রাখে না।
২০১১ সালে বেশক’টি বিষয় আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ঝড় তুলেছিল। ১৯৬৮ সালে সাবেক চেকোস্লাভিয়ার রাজধানী প্রাগে সমাজতন্ত্রবিরোধী যে আন্দোলনের জš§ হয়েছিল এবং সোভিয়েত সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে যা নস্যাৎ হয়ে গিয়েছিল, ইতিহাসে ওই আন্দোলন চিহ্নিত হয়ে আছে ‘প্রাগ বসন্ত’ হিসেবে। ২০১১ সালের পুরোটা সময় আরব বিশ্বে একটা গণআন্দোলনের জš§ হয়েছিল, যা চিহ্নিত হয়েছে ‘আরব বসন্ত’ হিসেবে। যুক্তরাষ্ট্রে পুঁজিবাদবিরোধী যে ‘অকুপাই মুভমেন্ট’-এর জš§ হয়েছে, তার রেশ এখনও রয়ে গেছে। ওই মুভমেন্টের সঙ্গে ‘আরব বসন্ত’-এর সরাসরি কোন মিল নেই সত্য, কিন্তু অসমতা আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে ‘অকুপাই মুভমেন্ট’-এর স্পিরিট এর সঙ্গে ‘আরব বসন্ত’-এর স্পিরিটের একটা মিল আছে। কেননা আরব বিশ্বে একটা শ্রেণী দীর্ঘদিন ধরে সব ধরনের ক্ষমতা ভোগ করে আসছিলেন। সেখানেও একটা অসমতা ও বৈষম্য তৈরি হয়েছিল। তিউনেসিয়ার তরুণ ফল বিক্রেতা (সনি ছিলেন বেকার এক কম্পিউটার গ্রাজুয়েট) বুয়াজিজি ছিলেন সেই অসমতা আর বৈষমের প্রতীক। বুয়াজিজির আÍহত্যা তিউনেসিয়ায় ‘আরব বসন্ত’র সূচনা করেছিল, যা ছড়িয়ে গিয়েছিল মিসর, মরক্কো, বাহরাইন, লিবিয়া ও সিরিয়াতে। সিরিয়া বা বাহরাইনে এখন অবদি সরকার পরিবর্তন না হলেও, এক নায়কতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটেছে তিউনেসিয়ায় জয়নাল আবেদিন বেন আলীর, মিসরের হোসনি মোবারকের, লিবিয়ার গাদ্দাফির, আর ইয়েমেনের আলী আবদুল্লাহ সালেহের। সঙ্গত কারণেই টাইমস সাময়িকী যখন এই গণঅভ্যুত্থানকে বছরের সেরা ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করে, এর পেছনে যুক্তি রয়েছে বৈকি! কিন্তু শুধু ওই গণঅভ্যুত্থানকে সেরা ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না। আমার বিবেচনায় মে মাসে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদ শহরে আল কায়দার শীর্ষ নেতা ওসামা বিন লাদেনের হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও বিশ্ব রাজনীতিতে ২০১১ সালের অন্যতম সেরা ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হতে বাধ্য। এর পেছনে যুক্তিও রয়েছে।
বিশ্ব রাজনীতিতে আল কায়দার উত্থান ও ইসলামী সন্ত্রাসবাদের জš§ বিশ্ব রাজনীতিকে পরিপূর্ণভাবে বদলে দিয়েছিল। একসময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বব্যাপী আগ্রাসী মনোভাবের কারণে বিশ্ব রাজনীতিতে জš§ হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একমাত্র চ্যালেঞ্জকারী শক্তি। কিন্তু ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী মনোভাবকে চ্যালেঞ্জ করার কেউ থাকল না। কিন্তু ২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে টুইন টাওয়ারে হামলা ও তা ধ্বংস করা, পেন্টাগনের ব্যর্থ বিমান হামলা চালানোর মধ্যে দিয়ে সারা বিশ্ব জানলো আল-কায়দা নামের একটি সংগঠনের নাম, যারা ইসলাম ধর্মকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করেছিল। যদিও এটা আজো অস্পষ্ট রয়ে গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একসঙ্গে একই সময়ে চারটি বিমান হাইজ্যাক করে আÍঘাতী হামলা চালানোর সঙ্গে ইসলামী জঙ্গিরা কতটুকু জড়িত ছিল। যদিও আল-কায়দা ওই হামলার সঙ্গে তার দায় স্বীকার করে নিয়েছিল, কিন্তু আরেক প্রশ্নের জবাব আজও মেলেনি। টুইন টাওয়ার হামলাকে কেন্দ্র করে আফগানিস্তান আক্রমণ করা ও দেশটি দখল করে নেয়া, পাকিস্তানে লাদেনের আশ্রয় ও পাকিস্তান গোয়েন্দা সংস্থার তা না জানার কথা, ইত্যাদি গত দশ বছরে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে, যেসব প্রশ্নের জবাব এই মুহূর্তে হয়তো পাওয়া যাবে না, কিন্তু ইতিহাস হয়তো একদিন বলবে কী ঘটেছিল লাদেনকে ঘিরে। লাদেন অ্যাবোটাবাদে বসবাস করতেন পাঁচ বছর ধরে এবং দুই স্ত্রীসহ কোন রকম নিরাপত্তা ব্যুহ ছাড়াই। যাকে সারা বিশ্বের গোয়েন্দারা হন্যে হয়ে খুঁজছিল, তিনি কিনা একাকী বসবাস করতেন একটি বাড়িতে! পাকিস্তানের কোন গোয়েন্দা সংস্থাই তা জানবে নাÑ এটা কী বিশ্বাসযোগ্য? লাদেনকে হত্যার পর ‘ফরেন পলিসি’ ম্যাগাজিনের অনেকগুলো ছবি ছাপা হয়েছিল অ্যাবোটাবাদের ওই বাড়িকে নিয়ে। একটি ছবি ছিল পাঁচ বছর আগের তোলা। সূত্র সিআইএ। স্যাটেলাইট থেকে তোলা ওই বাড়িটি দেখানো হয়েছিল। প্রশ্ন এসে যায়, পাঁচ বছর আগে যদি সিআইএ ওই বাড়িটি চিহ্নিত করে থাকে (যেখানে লাদেন লুকিয়ে থাকতে পারেন এমন আশংকা করা হয়েছিল), তাহলে সিআইএ এত সময় নিল কেন লাদেনকে হত্যা করার? আরও একটা প্রশ্ন মৃত লাদেনের ছবি সিআইএ ‘রিলিজ’ করল না কেন? নাকি লাদেনের নামে যাকে হত্যা করা হয়েছিল, সে অন্য কেউ! এসব প্রশ্নের কোন জবাব নেই। তবে লাদেনকে নিয়ে একটা ‘মিথ’ তৈরি হয়েছিল। এই ‘মিথ’কে উসকে দিয়ে বিশ্বব্যাপী ইসলামের বিরুদ্ধে একটা প্রচারণা চালানো হয়েছিল। আর এর মধ্যে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার স্বার্থ আদায় করে নিয়েছে। বিশ্বব্যাপী তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইরাক দখল করে নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। আর সর্বশেষ ঘটনায় গাদ্দাফিও উৎখাত হলেন।
যুদ্ধ মানেই ব্যবসা। যুদ্ধের নামে কোটি কোটি ডলারের ব্যবসা করেছে মার্কিন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো। ইরাক ও আফগানিস্তানে যুদ্ধের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের মতো ৩ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার। প্রতি মাসে এই দুটো দেশে যুক্তরাষ্ট্রের খরচ ৯ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলার। চিন্তা করা যায় কী বিপুল পরিমাণ অর্থ যুক্তরাষ্ট্র ব্যয় করেছে এই ‘যুদ্ধ’ এর পেছনে। সুতরাং অবিশ্বাস্য লাদেনের মৃত্যু আমার কাছে ২০১১ সালের অন্যতম একটি ঘটনা। এর গুরুত্ব এ কারণে বেশি যে লাদেনের মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড আদৌ বন্ধ হয়ে যাবে কিনা? যদিও লাদেনের মৃত্যুর ছ’মাস পার হয়ে গেছে এবং আল কায়দার কোন বড় ধরনের আক্রমণ আমরা বিশ্বের কোথাও লক্ষ্য করছি না। যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ এর যে ধারণা উসকে দিয়েছিল, তাতে কোটি কোটি ডলার খরচ করেও ওই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আদৌ বন্ধ করা যায়নি। ইরাকে ও আফগানিস্তানে আÍঘাতী বোমা সংস্কৃতির জš§ হয়েছে। পাকিস্তান আজ ভেঙে যাওয়ার উপক্রম। আগামী ২০ বছরে এ অঞ্চলের মানচিত্র যদি বদলে যায়, আমি অবাক হব না। ২০১১ সালের আরও বেশ কয়েকটি ঘটনা গুরুত্বের দাবি রাখে। যেমন বলা যেতে পারে ইউরোপের অর্থনৈতিক সংকট। ইউরোপের এই অর্থনৈতিক সংকটে পর্তুগাল, চীন ও ইটালির সরকারের পতন ঘটেছে। গ্রিসের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। রাষ্ট্রটি দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম। কৃচ্ছ্র সাধন করেও অর্থনীতিকে বাগে আনা যাচ্ছে না। ইউরোপের ওই অর্থনৈতিক সংকট দু’টো বিষয়কে সামনে নিয়ে এসেছে। এক. একক মুদ্রা হিসেবে ইউরো টিকে থাকবে কিনা? দুই. ইউরোপীয় ইউনিয়ন তার ঐক্যকে ধরে রাখতে পারবে কিনা? ২৭টি দেশ নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এর মাঝে ১৭টি দেশে ইউরো চালু রয়েছে। একটা প্রশ্ন ইতিমধ্যে উঠেছে যে ইউরোপের ধনী দেশগুলো ইউরোপের অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যেই ধনী ও গরিব রাষ্ট্রের জš§ হয়েছে। ইউরোপের এই সংকট ২০১২ সালেও অব্যাহত থাকবে, যা নতুন নতুন সংকটের জš§ দেবে।
ফুকুসিমায় পারমাণবিক বিস্ফোরণ, ডারবানে ব্যর্থ জলবায়ু সম্মেলন, ইরানের পারমাণবিক সংকট, ইত্যাদি বিষয়গুলোকেও হালকাভাবে দেখার কোন সুযোগ নেই। ফুকুসিমায় পারমাণবিক বিস্ফোরণের পর এখন পারমাণবিক বিদ্যুতের ভবিষ্যৎ একটা প্রশ্নের মুখে থাকল। খোদ জাপানের মতো দেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন যেখানে ঝুঁকির মুখে, সেখানে বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে একটা প্রশ্ন থাকবেই। বাংলাদেশ এরই মাঝে রাশিয়ার সঙ্গে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের ব্যাপারে একটি চুক্তি করেছে। ডারবানে কপ-১৭ সম্মেলনে বিশ্বের উষ্ণতা হ্রাসকল্পে একটি চুক্তিতে উপনীত হতে ব্যর্থ হওয়ায় ধনী ও গরিব দেশগুলোর মধ্যে ‘জলবায়ু বৈষম্য’ আরও বাড়লো। গত বেশকয়েক বছর ধরে ‘কপ’ সম্মেলন হয়ে আসছে। কিন্তু কোন ঐকমত্যে পৌঁছান সম্ভব হচ্ছে না। ইতিমধ্যে বিশ্বের দেশগুলোয় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রশ্নে নানা ধরনের প্রশ্নের জš§ হয়েছে। ডারবানে কিয়োটো চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে সত্য, কিন্তু কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ যদি হ্রাস করা না যায়, তাহলে বিশ্ববাসীর জন্য তা কোন ভালো সংবাদ নয়।
গেল বছর পাকিস্তান ও রাশিয়ার জন্যও কোন ভালো সংবাদ ছিল না। পাকিস্তানে একাধিকবার সামরিক অভ্যুত্থানের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। সর্বশেষ ঘটনায় সেনাবাহিনীর সঙ্গে প্রেসিডেন্ট জারদারির সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। এমনকি রাজনৈতিক নেতৃত্বের মাঝেও বিভক্তি লক্ষ্য করা গেছে। পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কেরও অবনতি ঘটেছে। পাকিস্তান আফগান শান্তি আলোচনা থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে। ফলে আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ একটি অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। পাকিস্তানের অংশগ্রহণ ছাড়া আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে না। রাশিয়ার রাজনীতিতে অস্থিরতা বাড়ছে। ডিসেম্বরে ‘ডুমা’র নির্বাচন নিয়ে যা হল, তা নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বে ইতিমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। রাশিয়া এক ভিন্ন আঙ্গিকে গণতন্ত্র চর্চা করছেÑ সেখানে ব্যক্তি ও দলীয় কর্তৃত্ব বাড়ছে। পুতিনকে ঘিরে তৈরি হয়েছে একটি ‘রাজনৈতিক বলয়’, যারা যেভাবে হোক ক্ষমতা ধরে রাখতে চাইছে, অনেকটা সাবেক সোভিয়েত শাসনামলে কমিউনিস্ট পার্টির মতো। পুতিন আবার মার্চে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ক্ষমতায় তিনি থাকতে চান। ১৯৯৯ সালের পর থেকেই তিনি ক্ষমতায় আছেন। প্রথমে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত, পরে পর পর দু’বার প্রেসিডেন্ট, এর পর আবার প্রধানমন্ত্রী। ইতিমধ্যে সেখানে যে গণবিক্ষোভের জš§ হয়েছে, তার নামকরণ করা হয়েছে ‘স্লাভিক বসন্ত’ হিসেবে। রাশিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট মেদভেদেভ রাশিয়ায় একটি সংস্কারের আহ্বান জানালেও, সেখানে আদৌ কোন সংস্কার আনা হবে কিনা, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। মূলত একদিকে গণতন্ত্রের লড়াই অন্যদিকে অসমতা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ২০১১ সালের বিশ্ব রাজনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছিল। এর প্রভাব চলতি বছরেও অনুভূত হবে।
২০১১ সালে বেশক’টি বিষয় আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ঝড় তুলেছিল। ১৯৬৮ সালে সাবেক চেকোস্লাভিয়ার রাজধানী প্রাগে সমাজতন্ত্রবিরোধী যে আন্দোলনের জš§ হয়েছিল এবং সোভিয়েত সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে যা নস্যাৎ হয়ে গিয়েছিল, ইতিহাসে ওই আন্দোলন চিহ্নিত হয়ে আছে ‘প্রাগ বসন্ত’ হিসেবে। ২০১১ সালের পুরোটা সময় আরব বিশ্বে একটা গণআন্দোলনের জš§ হয়েছিল, যা চিহ্নিত হয়েছে ‘আরব বসন্ত’ হিসেবে। যুক্তরাষ্ট্রে পুঁজিবাদবিরোধী যে ‘অকুপাই মুভমেন্ট’-এর জš§ হয়েছে, তার রেশ এখনও রয়ে গেছে। ওই মুভমেন্টের সঙ্গে ‘আরব বসন্ত’-এর সরাসরি কোন মিল নেই সত্য, কিন্তু অসমতা আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে ‘অকুপাই মুভমেন্ট’-এর স্পিরিট এর সঙ্গে ‘আরব বসন্ত’-এর স্পিরিটের একটা মিল আছে। কেননা আরব বিশ্বে একটা শ্রেণী দীর্ঘদিন ধরে সব ধরনের ক্ষমতা ভোগ করে আসছিলেন। সেখানেও একটা অসমতা ও বৈষম্য তৈরি হয়েছিল। তিউনেসিয়ার তরুণ ফল বিক্রেতা (সনি ছিলেন বেকার এক কম্পিউটার গ্রাজুয়েট) বুয়াজিজি ছিলেন সেই অসমতা আর বৈষমের প্রতীক। বুয়াজিজির আÍহত্যা তিউনেসিয়ায় ‘আরব বসন্ত’র সূচনা করেছিল, যা ছড়িয়ে গিয়েছিল মিসর, মরক্কো, বাহরাইন, লিবিয়া ও সিরিয়াতে। সিরিয়া বা বাহরাইনে এখন অবদি সরকার পরিবর্তন না হলেও, এক নায়কতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটেছে তিউনেসিয়ায় জয়নাল আবেদিন বেন আলীর, মিসরের হোসনি মোবারকের, লিবিয়ার গাদ্দাফির, আর ইয়েমেনের আলী আবদুল্লাহ সালেহের। সঙ্গত কারণেই টাইমস সাময়িকী যখন এই গণঅভ্যুত্থানকে বছরের সেরা ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করে, এর পেছনে যুক্তি রয়েছে বৈকি! কিন্তু শুধু ওই গণঅভ্যুত্থানকে সেরা ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না। আমার বিবেচনায় মে মাসে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদ শহরে আল কায়দার শীর্ষ নেতা ওসামা বিন লাদেনের হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও বিশ্ব রাজনীতিতে ২০১১ সালের অন্যতম সেরা ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হতে বাধ্য। এর পেছনে যুক্তিও রয়েছে।
বিশ্ব রাজনীতিতে আল কায়দার উত্থান ও ইসলামী সন্ত্রাসবাদের জš§ বিশ্ব রাজনীতিকে পরিপূর্ণভাবে বদলে দিয়েছিল। একসময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বব্যাপী আগ্রাসী মনোভাবের কারণে বিশ্ব রাজনীতিতে জš§ হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একমাত্র চ্যালেঞ্জকারী শক্তি। কিন্তু ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী মনোভাবকে চ্যালেঞ্জ করার কেউ থাকল না। কিন্তু ২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে টুইন টাওয়ারে হামলা ও তা ধ্বংস করা, পেন্টাগনের ব্যর্থ বিমান হামলা চালানোর মধ্যে দিয়ে সারা বিশ্ব জানলো আল-কায়দা নামের একটি সংগঠনের নাম, যারা ইসলাম ধর্মকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করেছিল। যদিও এটা আজো অস্পষ্ট রয়ে গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একসঙ্গে একই সময়ে চারটি বিমান হাইজ্যাক করে আÍঘাতী হামলা চালানোর সঙ্গে ইসলামী জঙ্গিরা কতটুকু জড়িত ছিল। যদিও আল-কায়দা ওই হামলার সঙ্গে তার দায় স্বীকার করে নিয়েছিল, কিন্তু আরেক প্রশ্নের জবাব আজও মেলেনি। টুইন টাওয়ার হামলাকে কেন্দ্র করে আফগানিস্তান আক্রমণ করা ও দেশটি দখল করে নেয়া, পাকিস্তানে লাদেনের আশ্রয় ও পাকিস্তান গোয়েন্দা সংস্থার তা না জানার কথা, ইত্যাদি গত দশ বছরে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে, যেসব প্রশ্নের জবাব এই মুহূর্তে হয়তো পাওয়া যাবে না, কিন্তু ইতিহাস হয়তো একদিন বলবে কী ঘটেছিল লাদেনকে ঘিরে। লাদেন অ্যাবোটাবাদে বসবাস করতেন পাঁচ বছর ধরে এবং দুই স্ত্রীসহ কোন রকম নিরাপত্তা ব্যুহ ছাড়াই। যাকে সারা বিশ্বের গোয়েন্দারা হন্যে হয়ে খুঁজছিল, তিনি কিনা একাকী বসবাস করতেন একটি বাড়িতে! পাকিস্তানের কোন গোয়েন্দা সংস্থাই তা জানবে নাÑ এটা কী বিশ্বাসযোগ্য? লাদেনকে হত্যার পর ‘ফরেন পলিসি’ ম্যাগাজিনের অনেকগুলো ছবি ছাপা হয়েছিল অ্যাবোটাবাদের ওই বাড়িকে নিয়ে। একটি ছবি ছিল পাঁচ বছর আগের তোলা। সূত্র সিআইএ। স্যাটেলাইট থেকে তোলা ওই বাড়িটি দেখানো হয়েছিল। প্রশ্ন এসে যায়, পাঁচ বছর আগে যদি সিআইএ ওই বাড়িটি চিহ্নিত করে থাকে (যেখানে লাদেন লুকিয়ে থাকতে পারেন এমন আশংকা করা হয়েছিল), তাহলে সিআইএ এত সময় নিল কেন লাদেনকে হত্যা করার? আরও একটা প্রশ্ন মৃত লাদেনের ছবি সিআইএ ‘রিলিজ’ করল না কেন? নাকি লাদেনের নামে যাকে হত্যা করা হয়েছিল, সে অন্য কেউ! এসব প্রশ্নের কোন জবাব নেই। তবে লাদেনকে নিয়ে একটা ‘মিথ’ তৈরি হয়েছিল। এই ‘মিথ’কে উসকে দিয়ে বিশ্বব্যাপী ইসলামের বিরুদ্ধে একটা প্রচারণা চালানো হয়েছিল। আর এর মধ্যে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার স্বার্থ আদায় করে নিয়েছে। বিশ্বব্যাপী তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইরাক দখল করে নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। আর সর্বশেষ ঘটনায় গাদ্দাফিও উৎখাত হলেন।
যুদ্ধ মানেই ব্যবসা। যুদ্ধের নামে কোটি কোটি ডলারের ব্যবসা করেছে মার্কিন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো। ইরাক ও আফগানিস্তানে যুদ্ধের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের মতো ৩ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার। প্রতি মাসে এই দুটো দেশে যুক্তরাষ্ট্রের খরচ ৯ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলার। চিন্তা করা যায় কী বিপুল পরিমাণ অর্থ যুক্তরাষ্ট্র ব্যয় করেছে এই ‘যুদ্ধ’ এর পেছনে। সুতরাং অবিশ্বাস্য লাদেনের মৃত্যু আমার কাছে ২০১১ সালের অন্যতম একটি ঘটনা। এর গুরুত্ব এ কারণে বেশি যে লাদেনের মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড আদৌ বন্ধ হয়ে যাবে কিনা? যদিও লাদেনের মৃত্যুর ছ’মাস পার হয়ে গেছে এবং আল কায়দার কোন বড় ধরনের আক্রমণ আমরা বিশ্বের কোথাও লক্ষ্য করছি না। যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ এর যে ধারণা উসকে দিয়েছিল, তাতে কোটি কোটি ডলার খরচ করেও ওই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আদৌ বন্ধ করা যায়নি। ইরাকে ও আফগানিস্তানে আÍঘাতী বোমা সংস্কৃতির জš§ হয়েছে। পাকিস্তান আজ ভেঙে যাওয়ার উপক্রম। আগামী ২০ বছরে এ অঞ্চলের মানচিত্র যদি বদলে যায়, আমি অবাক হব না। ২০১১ সালের আরও বেশ কয়েকটি ঘটনা গুরুত্বের দাবি রাখে। যেমন বলা যেতে পারে ইউরোপের অর্থনৈতিক সংকট। ইউরোপের এই অর্থনৈতিক সংকটে পর্তুগাল, চীন ও ইটালির সরকারের পতন ঘটেছে। গ্রিসের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। রাষ্ট্রটি দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম। কৃচ্ছ্র সাধন করেও অর্থনীতিকে বাগে আনা যাচ্ছে না। ইউরোপের ওই অর্থনৈতিক সংকট দু’টো বিষয়কে সামনে নিয়ে এসেছে। এক. একক মুদ্রা হিসেবে ইউরো টিকে থাকবে কিনা? দুই. ইউরোপীয় ইউনিয়ন তার ঐক্যকে ধরে রাখতে পারবে কিনা? ২৭টি দেশ নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এর মাঝে ১৭টি দেশে ইউরো চালু রয়েছে। একটা প্রশ্ন ইতিমধ্যে উঠেছে যে ইউরোপের ধনী দেশগুলো ইউরোপের অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যেই ধনী ও গরিব রাষ্ট্রের জš§ হয়েছে। ইউরোপের এই সংকট ২০১২ সালেও অব্যাহত থাকবে, যা নতুন নতুন সংকটের জš§ দেবে।
ফুকুসিমায় পারমাণবিক বিস্ফোরণ, ডারবানে ব্যর্থ জলবায়ু সম্মেলন, ইরানের পারমাণবিক সংকট, ইত্যাদি বিষয়গুলোকেও হালকাভাবে দেখার কোন সুযোগ নেই। ফুকুসিমায় পারমাণবিক বিস্ফোরণের পর এখন পারমাণবিক বিদ্যুতের ভবিষ্যৎ একটা প্রশ্নের মুখে থাকল। খোদ জাপানের মতো দেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন যেখানে ঝুঁকির মুখে, সেখানে বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে একটা প্রশ্ন থাকবেই। বাংলাদেশ এরই মাঝে রাশিয়ার সঙ্গে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের ব্যাপারে একটি চুক্তি করেছে। ডারবানে কপ-১৭ সম্মেলনে বিশ্বের উষ্ণতা হ্রাসকল্পে একটি চুক্তিতে উপনীত হতে ব্যর্থ হওয়ায় ধনী ও গরিব দেশগুলোর মধ্যে ‘জলবায়ু বৈষম্য’ আরও বাড়লো। গত বেশকয়েক বছর ধরে ‘কপ’ সম্মেলন হয়ে আসছে। কিন্তু কোন ঐকমত্যে পৌঁছান সম্ভব হচ্ছে না। ইতিমধ্যে বিশ্বের দেশগুলোয় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রশ্নে নানা ধরনের প্রশ্নের জš§ হয়েছে। ডারবানে কিয়োটো চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে সত্য, কিন্তু কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ যদি হ্রাস করা না যায়, তাহলে বিশ্ববাসীর জন্য তা কোন ভালো সংবাদ নয়।
গেল বছর পাকিস্তান ও রাশিয়ার জন্যও কোন ভালো সংবাদ ছিল না। পাকিস্তানে একাধিকবার সামরিক অভ্যুত্থানের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। সর্বশেষ ঘটনায় সেনাবাহিনীর সঙ্গে প্রেসিডেন্ট জারদারির সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। এমনকি রাজনৈতিক নেতৃত্বের মাঝেও বিভক্তি লক্ষ্য করা গেছে। পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কেরও অবনতি ঘটেছে। পাকিস্তান আফগান শান্তি আলোচনা থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে। ফলে আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ একটি অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। পাকিস্তানের অংশগ্রহণ ছাড়া আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে না। রাশিয়ার রাজনীতিতে অস্থিরতা বাড়ছে। ডিসেম্বরে ‘ডুমা’র নির্বাচন নিয়ে যা হল, তা নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বে ইতিমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। রাশিয়া এক ভিন্ন আঙ্গিকে গণতন্ত্র চর্চা করছেÑ সেখানে ব্যক্তি ও দলীয় কর্তৃত্ব বাড়ছে। পুতিনকে ঘিরে তৈরি হয়েছে একটি ‘রাজনৈতিক বলয়’, যারা যেভাবে হোক ক্ষমতা ধরে রাখতে চাইছে, অনেকটা সাবেক সোভিয়েত শাসনামলে কমিউনিস্ট পার্টির মতো। পুতিন আবার মার্চে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ক্ষমতায় তিনি থাকতে চান। ১৯৯৯ সালের পর থেকেই তিনি ক্ষমতায় আছেন। প্রথমে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত, পরে পর পর দু’বার প্রেসিডেন্ট, এর পর আবার প্রধানমন্ত্রী। ইতিমধ্যে সেখানে যে গণবিক্ষোভের জš§ হয়েছে, তার নামকরণ করা হয়েছে ‘স্লাভিক বসন্ত’ হিসেবে। রাশিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট মেদভেদেভ রাশিয়ায় একটি সংস্কারের আহ্বান জানালেও, সেখানে আদৌ কোন সংস্কার আনা হবে কিনা, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। মূলত একদিকে গণতন্ত্রের লড়াই অন্যদিকে অসমতা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ২০১১ সালের বিশ্ব রাজনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছিল। এর প্রভাব চলতি বছরেও অনুভূত হবে।
দৈনিক যুগান্তর, ১ জানুয়ারি ২০১২
ড. তারেক শামসুর রেহমান
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন