শুক্রবার, ৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলনের নেপথ্যে

  • নিউইয়র্কের ওয়াল স্ট্রিটের কাছে জুকটি পার্কে ১৮ অক্টোবর বিক্ষোভকারীদের অবস্থান নিউইয়র্কের ওয়াল স্ট্রিটের কাছে জুকটি পার্কে ১৮ অক্টোবর বিক্ষোভকারীদের অবস্থান
    ছবি: এএফপি
  • নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জের কাছ থেকে ওয়াল স্ট্রিট নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জের কাছ থেকে ওয়াল স্ট্রিট
এক মাস পার হয়েছে ‘ওয়াল স্ট্রিট দখল করো’ আন্দোলনের। পুঁজিবাদবিরোধী এ আন্দোলন এখন কেবল যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে সীমাবদ্ধ নেই, ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বজুড়ে। গত ১৫ অক্টোবর পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী বিশ্বজুড়ে শত শত শহরে হয়েছে নিউ ইয়র্ক কায়দার বিক্ষোভ। পুঁজিবাদী সংস্কৃতির একতরফা স্বার্থ হাসিল, ধনী ও গরিবের ব্যবধান দিন দিন বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের দায় এড়াতে সরকারি ব্যয়-সংকোচন নীতির বিরুদ্ধেই এই প্রতিবাদ।
আন্দোলনকারীদের কথায়, ওয়াল স্ট্রিট বিক্ষোভের মূল লক্ষ্য পুঁজিবাদী সমাজের লালসার জিভ কেটে দেওয়া। বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ, পুঁজিবাদের দৌরাত্ম্যে ক্ষুদ্রসংখ্যক ধনী দিন দিন অঢেল সম্পদের অধিকারী হচ্ছে, অন্যদিকে সাধারণ মানুষ নিষ্পেষিত হচ্ছে দুর্ভোগের জাঁতাকলে। জীবনযাপনের ন্যূনতম চাহিদা পূরণে হিমশিম খেতে হচ্ছে নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের। ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে এ ব্যবধান ঘোচাতেই তাদের আন্দোলন।
তবে গুঞ্জন উঠেছে এ আন্দোলনের মূলেও রয়েছে এক ধরনের বিনিয়োগ। আর তা করেছেন বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের কাতারে থাকা একজন। এই বিনিয়োগকারী হিসেবে যাঁর নাম শোনা যাচ্ছে, তিনি জর্জ সরোস। গত সেপ্টেম্বরে এক জরিপে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ ১০ জন ধনী ব্যক্তির তালিকায় স্থান করে নেন তিনি। রক্ষণশীল সমালোচকেরা এ আন্দোলনকে ‘ট্রয়ের ঘোড়া’ হিসেবে দেখছেন, যার পেছনে রয়েছে সরোসের গোপন কোনো লক্ষ্য।
সরোস ও বিক্ষোভকারীরা তাঁদের পারস্পরিক যোগাযোগ থাকার কথা অস্বীকার করেছেন। তবে কিছু সাংবাদিকের দাবি, অনুসন্ধানে সরোসের সঙ্গে কানাডার পুঁজিবাদবিরোধী প্রতিষ্ঠান অ্যাডবাস্টার্স-এর অর্থনৈতিক যোগসূত্র পাওয়া গেছে। ওয়াল স্ট্রিটে ‘আরব বসন্ত’ ধাঁচের আন্দোলন গড়ে তুলতে এক ধরনের উদ্ভাবনী বিপণন প্রচারণা শুরু করে তারা। এ ক্ষেত্রে সরোস ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে নীতিগত কিছু ব্যাপারে মিল লক্ষণীয়।
বিশ্বজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার সপ্তাহ খানেক আগে জাতিসংঘে সাংবাদিকদের সরোস বলেন, ‘আমি তাঁদের (বিক্ষোভকারী) অনুভূতিটা বুঝি।’ আন্দোলন ও বিক্ষোভকারীদের সম্পর্কে আরও কিছু বলার জন্য সাংবাদিকেরা অনুরোধ করলেও সরোস মুখ খোলেননি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের রক্ষণশীল বেতার উপস্থাপক রাশ লিমবাউ বলেন, ‘জর্জ সরোসের বিনিয়োগ করা অর্থ রয়েছে এই আন্দোলনের পেছনে।’
বিখ্যাত ফর্বস সাময়িকী সম্প্রতি বিশ্বের শীর্ষ ধনী ৪০০ জন ব্যক্তির যে তালিকা প্রকাশ করে, এর মধ্যে সপ্তম স্থানে রয়েছেন সরোস। দুই হাজার ২০০ কোটি ডলারের সম্পদের মালিক তিনি। অস্থিতিশীল বিনিয়োগ বাজারে চাতুর্যের সঙ্গে পুঁজি খাটিয়ে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিত্তবৈভবে ফুলেফেঁপে ওঠেন তিনি। নিজের সব সম্পদ বিলিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকারও করেছেন তিনি। অঙ্গীকার অনুযায়ী সম্পদের অর্ধেক দান করবেন জীবদ্দশায়, বাকি অর্ধেক দানের খাতে যাবে তাঁর মৃত্যুর পর।
২০০৮ সালে ওয়াল স্ট্রিটের ব্যাংকগুলো অর্থনৈতিক দুরবস্থা থেকে জনগণকে উদ্ধারে যে ঋণ বা পুঁজি সরবরাহের প্রকল্পের কথা ঘোষণা করে, বিক্ষোভকারীদের মতো সরোসও তার সমর্থক নন। পরবর্তী সময়ে সরকারের ব্যাংকে আটকে থাকা ‘বিষাক্ত সম্পদ’ (বন্ধকভিত্তিক পরিত্যক্ত বন্ড) কেনার প্রকল্পেও একাত্ম হতে পারেননি এ ধনকুবের।
মার্কিন বিক্ষোভকারীদের ভাষ্য, ২০০৮ সালে সাধারণ মানুষকে অর্থনৈতিক দুরবস্থা থেকে উদ্ধারে ওয়াল স্ট্রিট ব্যাংকের প্রকল্প বিপুল মুনাফা নিয়ে এলেও সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের যেন সীমা নেই। বেকারত্ব তো বেড়েছেই, বেড়েছে চাকরি নিয়ে অনিশ্চয়তা। সে ক্ষেত্রে ওয়াশিংটন থেকে সহায়তা যা পাওয়া যাচ্ছে, তা না পাওয়ার মতো। তাঁদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ধনী যে এক শতাংশ নাগরিক, তাঁরা বিপুল সম্পদের মালিক হয়েও বেশির ভাগ মানুষের চেয়ে কম হারে কর দিচ্ছেন।
২০০৯ সালে সংবাদপত্রের কলামে সরোস লিখেছিলেন, ‘বিষাক্ত সম্পদ’ বলে পরিচিত ব্যাংকে আটকে পড়া যেসব পরিত্যক্ত সম্পদ সরকার কিনছে, বাস্তবে তা ব্যাংকগুলোর জন্য নিঃশ্বাস চালিয়ে রাখা কৃত্রিম যন্ত্রের মতো কাজ করবে। স্বাভাবিক ফল বয়ে আনবে না। প্রেসিডেন্ট ওবামাকে তিনি বরং আরও জোরালো পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দেন। বলেন, ব্যাংকগুলোকে হয় নতুন করে পুঁজি দিয়ে আর্থিকভাবে সবল করা হোক, নয় তো এসব প্রতিষ্ঠানের জাতীয়করণ হোক। কিন্তু তাঁর এ পরামর্শ গ্রহণ করা হয়নি।
হাঙ্গেরীয়-মার্কিন বংশোদ্ভূত সরোস ২০০৮ সালের নির্বাচনে শুরুর দিকে বর্তমান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সমর্থক ছিলেন। তিনি যেসব বড় প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাকে সমর্থন করেন, তার মধ্যে রয়েছে ওপেন সোসাইটি ইনস্টিটিউট, পররাষ্ট্রবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ওপেন সোসাইটির সঙ্গে সরোস সরাসরি যুক্ত। ফাঁস হওয়া ২০০৭ থেকে ২০০৯ সালের নথির তথ্য অনুযায়ী সরোসের ওপেন সোসাইটি অলাভজনক মার্কিন সংস্থা টাইডস সেন্টারকে ৩৫ লাখ ডলার মঞ্জুরি হিসেবে দিয়েছে। সানফ্রান্সিসকোভিত্তিক এ সংস্থা অন্যান্য দাতাদের জন্যও নিকাশ ঘর (ক্লিয়ারিং হাউস) হিসেবে কাজ করে থাকে। দাতাদের অনুদানের অর্থ উদারপন্থী অলাভজনক সংস্থা বা গোষ্ঠীকে দিয়ে থাকে। ফোর্ড ফাউন্ডেশন ও বিল গেটস ফাউন্ডেশনের সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে তাদের।
ফাঁস হওয়া নথির তথ্যে দেখা গেছে, ২০০১ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে অ্যাডবাস্টার্সকে এক লাখ ৮৫ হাজার ডলার অনুদান দিয়েছে টাইডস। এর মধ্যে ২০০৭ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে অ্যাডবাস্টার্সকে তারা দিয়েছে ২৬ হাজার ডলার। এসব তথ্যের ব্যাপারে টাইডস কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানায়।
সরোসের সহযোগীদের দাবি, অ্যাডবাস্টার্স-এর নামই কখনো শোনেননি তিনি। এ ব্যাপারে সরোস কোনো মন্তব্য করতে চাননি। ভ্যাঙ্কুভারভিত্তিক অ্যাডবাস্টার্স এ নামেই একটি সাময়িকী প্রকাশ করে থাকে। এ প্রতিষ্ঠানের ভাষ্য, তারা বিনিয়োগ বাজারে বিভিন্ন সংস্থার কুক্ষিগত থাকা ক্ষমতার পরিবর্তন চায়। বিদ্যমান ক্ষমতাগত কাঠামোর পরিবর্তনও তাদের কাম্য।
অ্যাডবাস্টার্স সাময়িকীর প্রচারসংখ্যা এক লাখ ২০ হাজার। বিজ্ঞাপনের চমকের জন্য এর বিশেষ পরিচিতি রয়েছে। ‘ডিজিটাল ডিটক্স ডে’, ‘বাই নাথিং ডে’ এসব শিরোনামে বিভিন্ন প্রচারণা চালিয়ে সাময়িকীটি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এ ধারায় নতুন সংযোজন ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’, অর্থাৎ ‘ওয়াল স্ট্রিট দখল করো’।
অ্যাডবাস্টার্স-এর যুগ্ম প্রতিষ্ঠাতা ক্যাল লাসন (৬৯) বলেন, ‘আরব বসন্ত’ বিপ্লবের জোয়ারে মিসর, লিবিয়া ও তিউনিসিয়ায় একে একে সরকার পতনের পর ওয়াল স্ট্রিটবিষয়ক বুদ্ধিটা মাথায় খেলে তাঁদের। তাঁরা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াল স্ট্রিট আরব বিশ্বের তাহরির স্কয়ারের মতো হতে পারে।
ক্যাল লাসন বলেন, ‘আমরা অনুভব করি যে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সত্যিকারের ক্ষোভ দানা বেঁধেছে যুক্তরাষ্ট্রে। এখন এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে প্রয়োজন কেবল একটি স্ফুলিঙ্গ।’
এ স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টির কথা স্বীকার করলেও সরোস কোনো অর্থ দিয়েছেন বলে স্বীকার করেননি লাসন। তিনি বলেন, অ্যাডবাস্টার্স-এর ৯৫ শতাংশ অর্থই আসে গ্রাহকের কাছ থেকে। সরোস কখনো এক পয়সাও দেননি। তবে তাঁর কিছু মতাদর্শ খুব ভালো বলে মন্তব্য করেন লাসন। একই সঙ্গে সরোস অ্যাডবাস্টার্সকে কিছু টাকা-পয়সা দেবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলনের আরেক বড় সমর্থক হচ্ছে অনলাইন তহবিল জোগানদাতা ওয়েবসাইট কিকস্টার্টার। তারা এ আন্দোলনে ৭৫ হাজার ডলারের বেশি আর্থিক সহায়তা দেওয়ার অঙ্গীকার করে। উদারপন্থী চলচ্চিত্র নির্মাতা মাইকেল মুরও এ আন্দোলনে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর জোরেশোরে শুরু হয় ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলন। এতে ভূমিকা রাখে অ্যাডবাস্টার্স-এর একটি প্রচারণামূলক পোস্টার। এতে দেখা যায়, নিউইয়র্কের বিখ্যাত ব্রোঞ্জের ষাঁড়ের ভাস্কর্যের ওপর নাচছেন এক ব্যালেশিল্পী। পেছনে ধোঁয়াশাময় পটভূমিতে গ্যাস-মুখোশ পরে দাঁড়িয়ে আছে একদল বিক্ষোভকারী। পোস্টারে একই সঙ্গে যৌনতা, সহিংসতা, উত্তেজনা ও অভিযানের আভাস। এটি চাকরি খোয়ানো অনেক বেকার তরুণকে আন্দোলনে নামতে প্ররোচিত করে।
ফ্লোরিডার যুবক রবার্ট ড্যারস একটি রেস্তোরাঁয় এ পোস্টার দেখেন। কাঠমিস্ত্রির কাজ ছেড়ে একটি বারে ওয়েটার হিসেবে কাজ করছিলেন তিনি। পোস্টার দেখে উজ্জীবিত হয়ে আন্দোলন করতে নিউইয়র্ক চলে আসেন। ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলনে প্রথমদিকে যাঁরা যোগ দেন, ড্যারস তাঁদের একজন। তিনি জানান, কাঠমিস্ত্রি হিসেবে ভালোই ছিলেন।কিন্তু তাঁর প্রকল্পের বিনিয়োগকারী করপোরেট জালিয়াতির অভিযোগে গ্রেপ্তার হন। এতে চাকরি হারিয়ে বেকার হয়ে যান তিনি।
শুরুতে ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলন সংবাদ মাধ্যমের দৃষ্টি কাড়লেও এটি জোরালো হয়ে উঠবে কি না তা নিয়ে সংশয় ছিল। দ্য টাইমস অব লন্ডন-এর মন্তব্য ছিল, ‘ এ আন্দোলনে আবেগ আছে, তবে তা লক্ষ্যহীন।’ কিন্তু সাম্প্রতিক বিশ্বব্যাপী বিক্ষোভ সে সংশয় দূর করেছে।

ওয়াল স্ট্রিট
ওয়াল স্ট্রিট বলতে নিউইয়র্কসিটির অর্থবাজার এলাকাকে বোঝানো হয়। দক্ষিণ ম্যানহাটানে ব্রডওয়েথেকে সাউথ স্ট্রিট পর্যন্ত বিস্তৃত সড়ক ওয়াল স্ট্রিটের নামে এর নাম। কালক্রমে এটি সার্বিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থবাজার বা নিউইয়র্কভিত্তিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সমার্থক হয়ে উঠেছে। বিশ্বের বৃহত্তম স্টক এক্সচেঞ্জ নিউইয়র্কস্টক এক্সচেঞ্জ ওয়াল স্ট্রিটেই। সড়কটির আদি ডাচ নাম ‘ওয়াল স্ত্রাত’-এর উৎস কীতা নিয়ে নানা ধরনের বিবরণ আছে। মোটামুটি সর্বজনস্বীকৃত একটি ব্যাখ্যা হচ্ছে, এলাকার প্রাচীন ডাচ বসতি ‘নিউ আমস্টারডাম’-এর উত্তর প্রান্তের একটি মাটির দেয়াল এ নামের উৎস। সম্ভবত ইংরেজ উপনিবেশের সম্প্রসারণ ঠেকানো বা আদিবাসী আমেরিকানদের হাত থেকে সুরক্ষার উদ্দেশ্যেই ওই প্রাচীর নির্মিত হয়েছিল।
শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া | তারিখ: ২১-১০-২০১১

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন