শুক্রবার, ৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

বৈশ্বিক শ্রেণীযুদ্ধের নতুন রূপ ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলন


ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলন সব ধর্মের, সব বর্ণের, সব লিঙ্গের, সব মতাদর্শের মানুষের। ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-রাজনীতির ভেদ থাকলেও একটি জায়গায় সবাই ৯৯ শতাংশ। লড়াইয়ের ময়দান চিনতে ভুল করেনি আমেরিকানরা। অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড ওয়াল স্ট্রিটেই একাট্টা হয়েছে শোষিত, দলিত আর বঞ্চিতরা। ­োগান দিচ্ছে বৈষম্য, দারিদ্র্য, দুর্নীতি, যুদ্ধ, পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। আর দেখতে দেখতে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের অনেক দেশে। এ আন্দোলন নিয়ে বিশিষ্ট
অর্থনীতিবিদ ও  জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন,  এটা শুধু ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলন না, এটা একদিকে আন্দোলনের ইতিহাসে একটা নতুন পরিচয় দাঁড়িয়েছে ৯৯%। এটাকে আমরা শ্রমিক, ছাত্র, পেশাজীবী এরকম আন্দোলন দেখছি। ৯৯% মানে জনগণের প্রধান অংশ। সকল শ্রেণী পেশার মানুষের ঐক্যের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে ১%। এরকম একটা মেরুকরণ এই আন্দোলনের  বৈশিষ্ট্য। যেটা আন্দোলনের নতুন একটা গতিমুখ দিচ্ছে। এটা শ্রেণীযুদ্ধের নতুন একটা ধরণ এবং এই ­োগানটা শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের জন্য না এটা হলো বৈশ্বিকভাবে এটা প্রাসঙ্গিক, প্রযোজ্য। এজন্যই এটা যুক্তরাষ্ট্র শহর থেকে শহরে ছড়াচ্ছে। ইতোমধ্যে সারা পৃথিবীতে এক হাজারের বেশি শহরে এর সমর্থনে প্রোগ্রাম হয়েছে। এটার একটা আন্তর্জাতিক ঐক্যসূত্র আছে। সমস্ত দেশের সম্পদ এবং ক্ষমতা কেন্দ্রিভূত হয়ে আছে ১% মানুষের হাতে। যার জন্য সেই শক্তিকে এক পাশে ৯৯%।  সেই মেরুকরণ এই আন্দোলনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। দুই নম্বর হলো, আঘাতের  লক্ষ্যটা হচ্ছে নিছক সরকার নাÑ ওয়াল স্ট্রিট হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতার কেন্দ্র। মানে এক চেটিয়া কর্তৃত্ব।
এই আন্দোলন রাজনীতির মধ্যে অনেক ধরনের পরিবর্তন আনবে।  যুক্তরাষ্ট্রের এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তারা যে বক্তব্যটি নিয়ে আসছে তা হলো রিপাবলিকান এবং ডেমোক্রেট; দুজনেই ক্ষমতার কেন্দ্রের সাথে বাঁধা। ক্ষমতার কেন্দ্র হচ্ছে ওয়াল স্ট্রিট। আরেকটা হচ্ছে পেন্টাগণ। একচেটিয়া চুক্তি, অস্ত্র কোম্পানী বা সমরাস্ত্র বিভাগ। এই দুটা একটি আরেকটির সাথে বাঁধা- এ দুটার সাথে ক্ষমতার কেন্দ্র অটুট রেখে সরকার পরিবর্তন করা। এটা হলো আন্দোলনের একটা মূল বক্তব্য। এর তাৎপর্য- আগে একদল বাদ দিয়ে আরেকদল গ্রহণ করে, আবার সেই দল ব্যর্থ হলে আরেকদল গ্রহণ করা; এভাবে পেন্ডোলামের মতো ঘুরছিল বাংলাদেশের মতো যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ। সেটা থেকে মানুষ বের হবার চেষ্টা করছে, ক্ষমতার কেন্দ্র যদি অটুট থাকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এটা সত্য। ক্ষমতার কেন্দ্র যেটা- যারা লুটেরা, কমিশনভোগী, দুর্নিতীবাজ, দখলদার এদের ক্ষমতা যদি অটুক থাকে আওয়ামী লীগ আসুক বিএনপি আসুকÑ একই কথা। মার্কিন জনগণের মাথায় এ জিনিসটা এখনও আসেনি। সুতরা এটা রাজনীতির একটা নতুন গতিমুখের ভিত তৈরি করছে। যেখানে দ্বিদলীয় বা দ্বি-জোটীয় যে বিভাজনের মধ্যে এতদিন  বিভিন্ন দেশে আমাদের জনগণকে মোহগ্রস্থ করে রাখা হয়েছে। সেখান থেকে মানুষ বের হয়ে তার নিজের স্বার্থ, নিজের জায়গায় আনার জন্য নতুন রাজনীতিতে যুক্ত হচ্ছে। এটাতে ভবিষ্যতের রাজনীতির ধারাটা পরিবর্তন ঘটবেÑ আমরা দেখতে পাবো।  এটা ডেমোক্রেট বা রিপাবলিকানরা তাদের পকেটের মধ্যে নিয়ে আসতে পারবে না।
বাংলাদেশের মতো দেশগুলিতে এই ধরনের আন্দোলন বিভিন্নভাবে আসে। যেমন বাংলাদেশে আমরা যখন বলি যে জাতীয় সম্পদের ওপর জনগণের একটা অংশ মালিকানা আছে কিংবা দেশের ওপর। একথাটা কিন্তু বহুজাতিক পুঁজি বা লুটেরা ধনিগোষ্ঠির হাত থেকে জনগণের হাতে তার সম্পদ তুলে দেওয়া। এখন যুক্তরাষ্ট্রের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যেটা হলো, এই আন্দোলনটা আসলে বৈশ্বিক একটা যোগসূত্র। বহুজাতিক কোম্পানি, মার্কিন কোম্পানি বাংলাদেশে এসে যুক্ত। সেই বহুজাতিক কোম্পানির বিরুদ্ধে আমরা আন্দোলন করছি, যুক্তরাষ্ট্রও আন্দোলন করছে। যে কমিশন ভোগী- তার কাছ থেকে কমিশন খেয়ে চুক্তি করছে। সেই কমিশন ভুগি ভাবছে যে, এখান থেকে কমিশন খেয়ে ভবিষ্যতটা চলবে।  এই ভবিষ্যতটা চলবে না আর। কারণ এই আন্দোলনটা বিকশিত হলো যুক্তরাষ্ট্রে। যুক্তরাষ্ট্রেও বহুজাতিক কোম্পানী এবং তার সাথে সম্পর্ক রেখে কারা কারা আছে তার বিরুদ্ধে নজর রাখছে। সুতরাং গোটা বিশ্বব্যাপি তার যুগসূত্রটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। যেটা বাংলাদেশের জন্য, যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও। মানেÑ সারা পৃথিবীর মানুষের জন্য।
আমাদের শেয়ারবাজারের বিক্ষোভটা এ আন্দোলনের সাথে যুক্ত হবে। শেয়ার বাজারের বিক্ষোভকারীরা তো আলাদা একটা শক্তি হিসেবে দাঁড়াতে পারবে না। তবে শুধু শেয়ারবাজার না। বিগত ক‘য়েক বছরে শেয়ারবাজার ছাড়াও, অর্থকড়ি খাতে আরও বেশকিছু দুর্বৃত্তের তৎপরতা আমরা দেখতে পাচ্ছি। মানে মানুষকে প্রতারণা করে, লক্ষ লক্ষ মানুষকে পথে বসানোর বিভিন্ন রকম তৎপরতা। শেয়ারবাজারও তার মধ্যে একটা বড় ক্ষেত্র। এই শেয়ারে যারা লক্ষ লক্ষ মানুষের বিনিয়োগ, লক্ষ লক্ষ টাকা বিদেশে পাচার করছে। এ ধরনের যারা দুর্বৃত্তগোষ্ঠী তাদের সংখ্যা খুব একটা বেশি না। তদন্ত কমিটি এটা বের করছে। এরা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে যারা ওয়াল স্ট্রিট আছে তাদের জুনিয়র পার্টনার। ওয়াল স্ট্্িরটে যারা যুক্তরাষ্ট্রে অর্থনীতির ধ্বস নামাতো এবং আবার ধস নামানোর পরেও যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের আশির্বাদ পেয়ে এখনও এরা বহাল তবিয়তে আছে। যাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন হচ্ছে। তাদেরই বাংলাদেশী সংস্করণ হলো এরা। শেয়ারবাজারের মধ্য দিয়ে এত লোকজন, এত বিশাল সম্পদ পাচার করছে, শুধুমাত্র শেয়ারমার্কেটের বিনিয়োগকারীরা। পুরা বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন বিপন্ন অবস্থায়। সেই কারণে এই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলন তো একটা বড় আন্দোলনের সাথেই যুক্ত। শেয়ার বাজারে যারা বিনিয়োগকারী  তারা তো আন্দোলন করার জন্য এখানে আসেনি। তারা এসেছিল তাদের কর্মসংস্থানের অভাবে। এখানে বিনিয়োগ করে কিছু একটা তৎবির করার জন্য। তাদের এখন নিশ্চয় একটা উপলব্ধি হয়েছে যে, তারা একটা বড় ধরনের জালের মধ্যে পড়ে গেছে। এ জাল থেকে বের হতে সরকার তাদের কোন ভরসা দিতে পারছে না। বিরোধী দল বা অন্য রাজনৈতিক দল কোন ভরসা দিতে পারবে না। তাদের নিজেদেরই জায়গা তৈরি করতে হবে সেই ক্ষেত্র তৈরি করার জন্য। আর যে অন্যান্য যেসমস্ত আন্দোলন আছে সেগুলোর সাথে সম্পর্ক করতে হবে নইলে তার কোন উপায় নেই। এটা অনিবার্য একটা গতি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন