মুহাম্মদ রুহুল আমীন
গত ১৯ জুন পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি ইফতিখার মোহাম্মদ চৌধুরী সেদেশের প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানিকে প্রধানমন্ত্রী ও পার্লামেন্টের সদস্যপদে অযোগ্য ঘোষণা করে এক যুগান্তকারী রায় দেন। গিলানির প্রধানমন্ত্রিত্বের পদ আদালতের রায়ে বাতিল হবার পর ক্ষমতাসীন পিপিপি জোট সাহাবুদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রীর পদে মনোনয়ন দানের বিষয়টি মোটামুটি চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে আসে। কিন্তু হঠাত্ করে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির দায়ে গ্রেফতার আদেশ জারি হয়। তার এই গ্রেফতারের ব্যাপারটি আন্দাজ করতে পেরেই সম্ভবত ক্ষমতাসীন জোট রাজা পারভেজ আশরাফকে নতুন প্রধানমন্ত্রী মনোনয়ন করেন। কিন্তু শোনা যাচ্ছে তার বিরুদ্ধেও ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্বের পদটি অলংকরণে অনির্দিষ্টকালের জন্য চরম অনিশ্চয়তা বিরাজ করবে। এ রায়টি ক্ষমতাসীন পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি), জাতীয় পরিষদের স্পিকার, পার্লামেন্ট এবং রাষ্ট্রের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠান ও শ্রেণীর স্বার্থ ও মতামতের পরিপন্থি হওয়ায় অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক একে পাকিস্তানের গণতন্ত্র ও স্থিতিশীলতার প্রতি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচনা করছেন। অনেকে আবার ‘ক্ষমতায় পৃথকীকরণ তত্ত্ব’ আলোচনাপূর্বক গিলানি ইস্যুকে পাকিস্তানের গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় মাইলফলক হিসেবে বিবেচনা করছেন।
১৯৪৭ সনে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ হতে স্বাধীন হওয়ার পর থেকে একের পর এক অগণতান্ত্রিক রাজনৈতিক চর্চা, সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক দৌরাত্ম্য, রাজনীতিবিদদের নীতিচ্যুতি, পাকিস্তানের বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে বৈষম্যমূলক রীতি-নীতি দেশটিকে অগণতান্ত্রিক, নিষ্ঠুর এবং অমানবিক রাষ্ট্র হিসেবে পৃথিবীতে দাঁড় করায়।
ইসলামের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হলেও পাকিস্তানে কখনো ইসলামী রীতি-নীতি অনুসৃত হয়নি; এমনকি জনগণের মধ্যেও সুখ, সম্পদ, সৌভাগ্য সমান ভাগ করে নেওয়ার ইসলামী বিধানের ন্যূনতমও পালিত হয়নি। আয়ুব, ইয়াহিয়া, জিয়াউল হক, পারভেজ মোশাররফ প্রমুখ সামরিক শাসকগণ বন্দুকের নলের মুখে শাসন ক্ষমতা দখল করে জনগণের অধিকার হরণ করে এবং স্বীয় স্বার্থে বিচার বিভাগকেও যথেচ্ছ ব্যবহার করে পাকিস্তানকে স্বৈরতন্ত্রের দেশ হিসেবে বিশ্বসভায় পরিচিত করায়।
নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে সম্প্রতি পাকিস্তানের গণতন্ত্র-যাত্রা অভিষিক্ত হওয়ার আগেই পারভেজ মোশাররফ আবার খড়গহস্ত হন এবং পাকিস্তানকে আবারো গণতন্ত্রহীনতায় নিক্ষেপ করেন। পারভেজ মোশাররফের সাথে প্রধান বিচারপতি ইফতিখার চৌধুরীর নানা মতপার্থক্য দিন দিন স্পষ্ট হতে থাকে এবং এক পর্যায়ে প্রধান বিচারপতিকে তার দায়িত্ব পালন থেকে সরে দাঁড়াতে হয়। রাজনৈতিক পালাবদলের বিপরীত হাওয়ায় পুনরায় তিনি প্রধান বিচারপতির আসনে উপবিষ্ট হন।
আদালত প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা পুনরুজ্জীবিত করার ব্যাপারে সুইজারল্যান্ডে চিঠি পাঠানোর নির্দেশ দেন গিলানিকে, কিন্তু গিলানি যুক্তি দেখান যে, প্রেসিডেন্ট সংবিধান অনুযায়ী দায়মুক্তি ভোগ করেন এবং সে যুক্তিতে তিনি আদালতের আদেশ পালনে বিরত থাকেন। তখন গিলানিকে দোষী সাব্যস্ত করে প্রতীকী শাস্তিও দেওয়া হয়। ইতিপূর্বে পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ জাতীয় পরিষদের স্পিকার ফাহমিদা মির্জা পার্লামেন্টের কর্তৃত্ব তত্ত্ব উপস্থাপনপূর্বক গিলানির পক্ষাবলম্বন করেন। পরবর্তী সময়ে স্পিকারের রুলিংকে বৈধতা দিয়ে প্রস্তাব পাস করে সাধারণ পরিষদ।
স্পিকারের এ রুলিং চালেঞ্জ করে নওয়াজ শরীফের পিএমএলএন এবং ইমরান খানের তাহরিক-ই-ইনসাফ পার্টি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯ জুন গিলানির প্রধানমন্ত্রিত্ব ও পার্লামেন্টের সদস্যপদ বাতিল করে সুপ্রিম কোর্ট রায় ঘোষণা করেন। নিঃসন্দেহে এ রায়টি পাকিস্তানের বিচার বিভাগ ও পার্লামেন্টকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। একটি রাষ্ট্রের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পরিচালনাকারী অংগ হলো শাসন বিভাগ, আইন প্রণয়ন বিভাগ ও বিচার বিভাগ। নির্বাহী ও আইন বিভাগের সাথে প্রকাশ্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা সৃষ্টি করে বিচার বিভাগ পাকিস্তানের গণতন্ত্রকে দীর্ঘমেয়াদী সংকটে নিপতিত করছে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন। রায়টিকে পার্লামেন্টের প্রতি মারাত্মক চপেটাঘাত বলে তারা বিবেচনা করছেন। কারণ পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠের অবস্থান ছিল গিলানির পক্ষে।
কোন কোন গবেষক সাম্প্রতিক রায়কে আদালতের অভ্যুত্থান হিসেবে বিবেচনা করছেন। তবে সেই অভ্যুত্থান সরাসরি সাংঘর্ষিক রূপ নিবে বলে মনে হয় না। রায় ঘোষণার পর পর ক্ষমতাসীন জোট তেমন কোন গ্রাসী তত্পরতা দেখায়নি; বরং পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের ব্যাপারে তাদেরকে সবচেয়ে বেশি মনোযোগী দেখা গেছে। আদালতের ছুঁড়ে দেওয়া উত্তপ্ত বলটি এখন স্বঘোষিত সর্বোচ্চ কর্তৃত্বসম্পন্ন পার্লামেন্টের কোর্টে থাকলেও পাল্টা মারের কোন পূর্বাভাস পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
পাকিস্তানের ক্রমবর্ধমান বিস্ফোরণোন্মুখ রাজনৈতিক বাস্তবতা সত্ত্বেও ইউসুফ রাজা গিলানি স্বীয় দল, পার্লামেন্ট এবং অরাজনৈতিক অংগনে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৪৯৪ দিন ক্ষমতায় থেকে পাকিস্তানের দ্বিতীয় দীর্ঘমেয়াদী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার গড়ে তুলেছিলেন গিলানি। পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ১৫২৪ দিন ক্ষমতায় থেকে সর্বাপেক্ষা দীর্ঘমেয়াদী প্রধানমন্ত্রিত্বের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। স্বৈরশাসন, সেনাশাসন, বিদেশি হস্তক্ষেপ প্রভৃতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে তিনি দেশহিতৈষী নেতা হিসেবে একটি সুদৃঢ় ভিত্তি তৈরি করতে সক্ষম হন। এমন এক জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রীর ক্যারিয়ারে বিচারিক মার আমজনতাকে স্তম্ভিত করেছে। তাঁর অবর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর শূন্য পদে অন্য কারো গ্রহণযোগ্যতা খুব টেকসই হবে না বলে অনুমিত হচ্ছে। ফলে গিলানি ইস্যুটি পার্লামেন্টকে উত্তপ্ত রাখবে এবং অবধারিতভাবে পাকিস্তানে চরম রাজনৈতিক অশ্চিয়তা সৃষ্টি করবে।
সবচেয়ে মারাত্মক পরিণতি অপেক্ষা করছে আগামী দিনের রাজনীতিতে। ক্ষমতাসীন জোটের সামনে এমন কোন নিশ্চয়তা নেই যে, তাদের মনোনীত পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীও একই ধরনের রাজনৈতিক গ্যাঁড়াকলে পড়বেন না। দ্য ডন জানাচ্ছে, ইতোমধ্যে পিপিপির উদ্বেগের এ অংশটি নিয়ে রাজনৈতিক প্রচারণা চালিয়ে পরিস্থিতিকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে তত্পর হয়েছে পিএমএলএন।
নতুন প্রধানমন্ত্রীকে রাজনীতির শ্বাপদসংকুল অরণ্যে বিচরণ করতে হবে একথা নিশ্চিত করে বলা যায়। তিনি পিপিপির দলীয় প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারীর বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নিতে সুইজারল্যান্ডকে চিঠি দিবেন কিনা, দিলে পার্লামেন্ট ও দলের ভিতর কি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে, আর না দিলে বিচার বিভাগ গিলানির ন্যায় তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে দুর্ভাগ্যের বিস্বাদ শর্বরী চাপিয়ে দিবে কিনা এ রকম নানা বিরক্তিকর পরিস্থিতি পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আনয়ন করবে। এরূপ পরিস্থিতিতে পিপিপির মধ্যে আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বও প্রকট হতে পারে এবং এক পর্যায়ে বর্তমান পার্লামেন্ট ভেঙ্গেও যেতে পারে। এমনি অস্থিতিশীলতার সুযোগে অতীতের সকল সময়ের মত সেনাবাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করতে পারে। এমতাবস্থায় পাকিস্তানে গণতন্ত্র ভূলুণ্ঠিত হয়ে পুনরায় স্বৈরতন্ত্র চেপে বসতে পারে।
অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে, এতসব অশনিসংকেত সত্ত্বেও পাকিস্তানের গণতন্ত্রের জন্য শুভ সংবাদ হলো বিচার বিভাগের সাম্প্রতিক নিষ্ঠা ও স্বাধীনতা আর যার অতন্দ্র প্রহরী হলেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ইফতিখার চৌধুরী। দীর্ঘসময় ধরে সেনাশাসনের কদর্য ইতিহাসে পাকিস্তানের বিচার বিভাগ অতীতে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রাখেনি। বরং সেনাশাসনের বৈধতা দিয়ে বিচার বিভাগকে কলংকিত করা হয়েছে বার বার। তৃতীয় বিশ্বের গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ কেবল বিচার বিভাগ, সাধারণ জনগণের নির্ভরতা ও আস্থার শেষ আশ্রয়। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও কর্তৃত্ব। বিচারপতি ইফতিখার সুদৃঢ়ভাবে সেই বিচার বিভাগীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় অকপট ও বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে সচেষ্ট বলে মনে হয়।
প্রেসিডেন্ট জারদারীর বিরুদ্ধে আইনী প্রক্রিয়া শুরু করতে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি বিচারিক নির্দেশ, এ নির্দেশ অমান্য করায় স্পিকার ফাহমিদা মির্জা ও প্রধানমন্ত্রীকে আদালতে তলব, প্রধানমন্ত্রীকে প্রতীকী শাস্তি প্রদান এবং সর্বোপরি প্রধানমন্ত্রিত্ব বাতিল করে আদালতের রায় প্রদান প্রধান বিচারপতি ইফতিখারের বিচারিক দৃঢ়তার পরিচয়বাহক। ইতোপূর্বে প্রেসিডেন্ট জারদারীর সাথে প্রধান বিচারপতি ইফতেখার চৌধুরীর দ্বন্দ্ব প্রকট হলে প্রেসিডেন্ট তাকে অপসারণ করেন। কিন্তু এর প্রতিবাদে প্রধান বিচারপতি এককভাবে প্রতি জেলার বারগুলোতে সভা করে ব্যাপক জনমত গড়ে তুলে আদালতের রায় নিয়ে স্বপদে বহাল হন। ন্যায় বিচারের প্রশ্নে বিচারপতি ইফতিখার কোন আপোষে বিশ্বাসী নন, এমনকি বিচারের রায় যদি তার আপনজনের বিরুদ্ধেও যায়। উদাহরণস্বরূপ সম্প্রতি নিজের ছেলের বিরুদ্ধে স্বপ্রণোদিত হয়ে তিনি রুল জারি করে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছেন। তার ছেলে আরসালান ইফতিখার ও ধনাঢ্য রিয়াল এস্টেট ব্যবসায়ী মালিক রিয়াজ হোসেনের মধ্যে অবৈধ অর্থ লেনদেনের সংবাদ প্রকাশিত হলে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন ৩ সদস্যের একটি বেঞ্চ স্বপ্রণোদিত হয়ে সুয়োমোটো রুল জারি করেন।
তবে ইফতিখার চৌধুরীর সাধুতা ও অকপটতাও প্রশ্নসাপেক্ষে। জারদারীর সাথে তার বৈরিতার কারণেই গিলানি ইস্যুতে প্রধান বিচারপতি কঠোর অবস্থানে গেছেন। কেউ কেউ মনে করেন, সেনাবাহিনীর সাথে প্রধান বিচারপতির সখ্যতাও কম নয়।
এতসব জটিল সমীকরণে পাকিস্তানের গণতন্ত্র এক নাজুক অবস্থানে। বর্তমান পার্লামেন্ট ও নির্বাহী মিলে পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক যাত্রার যে অভিঘাত রচনা করতে যাচ্ছিল, তা বিচার বিভাগের পাল্টা আঘাতে ভন্ডুল হতে চলেছে বলে মনে হচ্ছে। পাকিস্তানে গণতন্ত্রের ভবিষ্যত্ নির্ভর করছে সেনাবাহিনীর সাথে বিচার বিভাগের যৌক্তিক ও আইনগত দূরত্ব রক্ষার কৌশলের উপর। আর সেই দেশের সেনাবাহিনী ও বিচার বিভাগের সাথে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের আন্তঃক্রিয়ার ধরন ও প্রকৃতির উপরও নির্ভর করছে অনেক কিছু। তাহরিক-ই-ইনসাফ, পিএমএলএন-সহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন দল এবং বিচার বিভাগের এ দ্বান্দ্বিক অবস্থাকে কিভাবে হ্যান্ডেল করবে তার উপরও নির্ভর করছে পাকিস্তানের গণতন্ত্রের ভবিষ্যত্।
n লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন