শুক্রবার, ২২ জুন, ২০১২

মিয়ানমারে মানবাধিকার শাশ্বত স্বরূপ



মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান : 
সম্প্রতি মিয়ানমারে একটি অভিযোগকে কেন্দ্র করে সে দেশে সূচনা হয়েছে এক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার। এই দাঙ্গাসূত্রে সেখানে কার্যত চলছে রোহিঙ্গা বিতাড়ন আর নির্যাতনের পরাকাষ্ঠা। অভিযোগে প্রকাশ, তিনজন রোহিঙ্গা মুসলমান দুইজন বৌদ্ধ রাখাইনসহ একটি রাখাইন তরুণীকে ধর্ষণ করে গত ২৮মে। অভিযোগ মতে, ধর্ষণের পর এরা এই তরুণীকে হত্যা করে। পুলিশ সন্দেহভাজনদের আটক করে কারাগারে পাঠায়। ৪ জুন এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ বৌদ্ধ রাখাইনেরা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় একটি বাসে আক্রমণ চালিয়ে ১০ জন রোহিঙ্গা মুসলমানকে হত্যা করে। এরা একটি ধর্মীয় সমাবেশ থেকে বাসে করে ফিরছিলেন। হামলাকারী রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাড়িঘর ও দোকানপাটে আগুন ধরিয়ে দেয়। রাখাইনেরা মুসলমানবিরোধী প্রচারপত্রও বিলি করে। মিয়ানমারের সেনাসমর্থিত সরকার মুসলমানদের ওপর এই হামলা ও তাদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ঠেকাতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়।
অভিযোগের বিষয়টি আইনী পন্থা অনুসরণ করে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধান সম্ভব ছিল। কিন্তু সে দেশের সরকার তা হতে দেয়নি। বরং ঠুনকো এই অজুহাতে মিয়ানমারের রাখাইনরা রাষ্ট্রীয় পোষকতায় এখন সে দেশে রাখাইন রাজ্যের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে কার্যত এক এথনিক কিনসিং বা জাতিগত শুদ্ধি অভিযান অব্যাহত রেখেছে। এখন রাখাইন রাজ্যের মংডু ও আকিয়াব এলাকায় চলছে গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও বেপরোয়া লুটতরাজ। এরই মধ্যে রোহিঙ্গাদের হাজার হাজার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। বিরানভূমিতে পরিণত করা হয়েছে রোহিঙ্গাদের গ্রামগুলো। রয়টার্স ও এএফপির খবর মতে, চলমান এ সহিংসতায় ৩০ হাজার লোক উদ্বাস্তু হয়েছে। এরা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে চেয়েও প্রবেশ করতে পারছে না। বাংলাদেশের বর্ডার গার্ড তাদের বাংলাদেশে ঢুকতে দিচ্ছে না। বাংলাদেশ সরকার বলছে, ইতোমধ্যেই লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে অবস্থান করছে। নতুন করে আরো শরণার্থী নেয়া বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয় এবং বাংলাদেশ তা নিতে বাধ্যও নয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহল বাংলাদেশে শরণার্থী ঢুকতে দেয়ার জন্য আহবান জানাচ্ছে।
শত শত বছর ধরে মিয়ানমারে বসবাস করে আসা রোহিঙ্গা মুসলমানদের নাগরিক বলে স্বীকার করে না সে দেশের সরকার। ফলে এরা সে দেশের যাবতীয় নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তাদের স্বাস্থ্যসেবা, খাদ্য ও শিক্ষা সম্পর্কে কোনো দায়দায়িত্ব নেই সরকারের। সরকারের এই অবস্থানের কারণে রোহিঙ্গারা সে দেশে বসবাস করছে ‘রাষ্ট্রহীন' হয়ে। সে দেশের আট লাখ মুসলমান রাষ্ট্রহীন যাদের বেশির ভাগই রোহিঙ্গা। ৯০ শতাংশ রোহিঙ্গার বসবাস রাখাইন রাজ্যে। এ রাজ্যটি আমাদের বাংলাদেশের সীমান্তের লাগোয়া। তাই রোহিঙ্গাদের বিতাড়ন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে যখন মিয়ানমার তাদের ওপর উচ্ছেদ অভিযান চালায়, তখন এরা বাংলাদেশে এসে শরণার্থী হয়। একসময় এ রাজ্যটির নাম ছিল আরাকান। ১৯৮৯ সালে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা আরাকান রাজ্য নাম পাল্টে এর নাম দেয় রাখাইন রাজ্য। এর মাধ্যমে এরা বোঝাতে চাইছে এ রাজ্য বৌদ্ধ রাখাইন সম্প্রদায়ের, রোহিঙ্গা মুসলমানদের নয়।
মিয়ানমারের সামরিক জান্তা জানতে চায় না, অন্যদেরও জানতে দিতে চায় না- সে দেশের রোহিঙ্গাদের রয়েছে নিজস্ব সুদীর্ঘ ইতিহাস-ঐতিহ্য, ভাষা ও সংস্কৃতি। মিয়ানমারে তাদের শেকড় গভীরভাবে প্রোথিত। সে দেশে এরা রাষ্ট্রহীন বা নাগরিকত্বহীন থাকতে পারে না। শত শত বছর ধরে বসবাস করে আসা রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার কেউ ছিনিয়ে নিতে পারে না। কিন্তু মিয়ানমারের বৌদ্ধরা জেনেশুনে মিথ্যে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে- রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক হতে পারে না। এরা বিদেশী।
রোহিঙ্গা শব্দটি এসেছে ‘রোহাঙ্গ' শব্দ থেকে। আর আরাকান রাজ্যের মূল নাম ছিল রোহাঙ্গ। মধ্যযুগের আরাকান ও চট্টগ্রামের কবিরা- আলাওল, দৌলত কাজী, মরদান, শমসের আলী, আইনুদ্দীন, আব্দুল গনি ও অন্যরা তাদের লেখায় আরাকানকে বারবার উল্লেখ করেছেন রোসাং, রোসাঙ্গো দেশ ও রোসাঙ্গো শহর নামে। বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেঁষে থাকা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে এখন বসবাস করে প্রধান দুই জাতি-সম্প্রদায় ঃ বৌদ্ধ রাখাইন ও রোহিঙ্গা মুসলমান। রাখাইন বৌদ্ধরা ভাষা ও ধর্মে ঘনিষ্ঠ বার্মিজদের সাথে। অপরদিকে রোহিঙ্গারা ভাষা ও কর্মে ঘনিষ্ঠ চট্টগ্রাম ও বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের মানুষের সাথে।
রোহাঙ্গ রাজ্যের মূল অধিবাসীরা ছিল হিন্দু, বৌদ্ধ ও অ্যানিমিস্টেরা। প্রাক-ইসলামি আমল থেকেই এই অঞ্চলটি আরব সমুদ্র-অভিযাত্রীদের কাছে সুপরিচিত ছিল। অনেক আরব স্থানীয় লোকদের সাথে মিশে গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন আরাকান রাজ্যে। এরাই আজ রোহিঙ্গা নামে পরিচিত। কোনো কোনো ইতিহাসবিদ উল্লেখ করেছেন, আরাকানে আরবরা প্রথম বসত গড়ে তোলে সপ্তম শতাব্দীতে, মোহাম্মদ ইবনে হানিফিয়ার নেতৃত্বে। তিনি বিয়ে করেন রানী কৈয়াপুইকে, যিনি মুসলমান হয়ে যান। তার প্রজারাও তখন দলবদ্ধ হয়ে মুসলমান হয়ে যায়। যে পাহাড়ের চূড়ায় এরা বসবাস করতেন, তা এখনো হানিফা টঙ্কি ও কৈয়াপুই টঙ্কি নামে পরিচিত।
এ এলাকায় মুসলমানদের আগমনের বড় ধরনের ঘটনা ঘটে অষ্টম শতাব্দীতে। ব্রিটিশ বার্মা গ্যাজেটিয়ারে (১৯৫৭) বলা হয়, ৭৮৮ সালে এডি মাহাতেইং সান্দিয়া ভেসালির সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং পুরনো রামাওয়াদিতে গড়ে তোলেন নতুন নগরী ভেসালি (Vesali)। তিনি ২০ বছর রাজত্ব করে মারা যান। এ এলাকার বামব্রি দ্বীপে বেশ কয়েকটি জাহাজ ধ্বংস হয়। এতে থাকা মুসলমান নাবিকদের আরাকানে পাঠানো হয়। এরা আরাকানে একটি গ্রামে স্থায়ীভাবেই বসবাস করতে শুরু করে। এরা ছিল আরব মুর মুসলমান।
এ এলাকায় মুসলমানদের তৃতীয় বড় ধরনের আগমন ঘটে ১৪০৪ সালের পর। তখন আরাকান রাজা পরাজিত হন বার্মিজদের কাছে। আরাকান রাজা আশ্রয় নেন বাংলার রাজধানী গৌড়ে। সেখানে বাংলার সুলতান জালালুদ্দিন মোহাম্মদ শাহের সাহায্য প্রার্থনা করেন আরাকানের সিংহাসন পুনরুদ্ধারের জন্য। সুলতান হাজার হাজার সৈন্য পাঠান আরাকান দখলের জন্য। এসব সৈন্যের অনেকেই পরে সেখানে স্থায়ী বসবাস গড়ে তোলেন।
পরে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী যেমন-মোগল (১৬৬০ সালে মোগল রাজপুত্র শাহ সুজার আগমনের মধ্য দিয়ে), তুর্কি, পার্সি, মধ্যএশীয় পাঠান ও বাঙালিরা সে অঞ্চলে গিয়ে রোহিঙ্গাদের সাথে মিশে যায়। আরাকানে ইসলামের বিস্তার প্রধানত ঘটে সমুদ্রপথে আসা সুফি ও বণিকদের মাধ্যমে। আরাকান ও বার্মা উপকূলে বিদ্যমান নানা দরগাহ এর প্রমাণবহ। বার্মিজ ইতিহাসবিদ ড. কিই লিখেছেন : The superior morality of those devout Muslims attracted large number of people towards Islam, who embraced it en masse (The Essential History of Burma, by U.Kyi, Page-160).
অতএব ইতিহাস বলে আরাকানে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বসতির সূচনা সপ্তম শতাব্দীতে। রোহিঙ্গাদের এমন একটি এথনিক গ্রুপ বা জাতি সম্প্রদায়ের চিহ্নিত করা যাবে না, যা গড়ে ওঠে একটি মাত্র উপজাতি থেকে। বরং রোহিঙ্গারা এমন একটি এথনিক গ্রুপ, যা গড়ে ওঠে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সমন্বয়ে। ধর্মগতভাবে রোহিঙ্গারা মুসলমান জাতিগোষ্ঠী, যাদের রয়েছে নিজস্ব সভ্যতা ও সংস্কৃতি। তাই রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নয়, এমন দাবি অযৌক্তিক। একটি দেশে বা অঞ্চলে ১৩০০ বছর ধরে বসবাস করে আসা একটি জনগোষ্ঠী, সে দেশের নাগরিক স্বীকৃতি পাবে না, তা হতে পারে না। কিন্তু মিয়ানমারের সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করে মাঝে মধ্যেই নানা ঘটনার সূত্রপাত করে কার্যত রোহিঙ্গা বিতাড়নের কাজ চালু রেখেছে। তাদেরকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে তাদের বাপ-দাদার ভিটেমাটি থেকে। এদের অনেককেই বাধ্য হয়ে শরণার্থী হিসেবে জীবনযাপন করতে হচ্ছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, সৌদি আরব, আরব-আমিরাত, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে। সত্যিকার অর্থে এদের অবস্থা আমেরিকান নেটিভ, লাতিন আমেরিকার মায়ান ও অধিকৃত আরব ভূখন্ডের ফিলিস্তিনিদের চেয়েও খারাপ। এদের মিয়ানমার থেকে অত্যাচার-নিপীড়ন করে তাড়িয়ে দিয়ে রাখাইন রাজ্যের জনসংখ্যাগত কাঠামোই পাল্টে দেয়া হচ্ছে। লক্ষ্যটা তাদের এমন- রাখাইন রাজ্য শুধুই রাখাইনদের জন্য, অন্য কোনো জাতি সম্প্রদায়ের অধিকার নেই সেখানে বসবাসের। সে জন্য সেখানে বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে মুসলমানদের সম্পত্তি, এমনকি ওয়াক্ফ করা সম্পত্তিও। মুসলমানদের মসজদি ধ্বংস করে সে স্থানে তৈরি করা হচ্ছে প্যাগোডা ও মঠ। যেন মিয়ানমার থেকে মুসলমানদের যাবতীয় চিহ্ন মুছে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেছে মিয়ানমার সরকার। এ জন্য রাখাইন রাজ্যের উত্তর কোণে আরো বেশি সংখ্যায় প্যাগোডা ও মঠ নির্মাণ কাজও চলছে পূর্ণোদ্যমে।
সে দেশের সিপিডিসি সৈন্যরা প্রায়ই হয়রানি করছে রোহিঙ্গা উলেমা, নারী ও তরুণদের। রোহিঙ্গা সমাজের অনেক নেতাই দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে আটক রয়েছেন। এর একটি উদাহরণ এখানে উল্লেখ করা যায়। ২০০৫ সালের উকিয়া মিনকে (ওরফে মোহাম্মদ শামসুল আনোয়ারুল হক) দেয়া হয়েছে ৪৭ বছরের কারাদন্ড। তার অপরাধ, তিনি কথা বলেন রোহিঙ্গা জাতীয়তার স্বীকৃতির দাবি নিয়ে।
উল্লেখ্য, তিনি ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ফর হিউম্যান রাইটসের নেতা এবং বোবিদং সাহারা অঞ্চলের ১ নম্বর নির্বাচনী এলাকার পার্লামেন্ট সদস্য। তার স্ত্রী ও তিন সন্তানকে একই অভিযোগে ১৭ বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়েছে।
তাদের আটক করা সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ১-৩, ৫, ৯, ১০ এবং ১৫-২১ নম্বর অনুচ্ছেদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। অন্যান্য নেতারা অনেকে জেল খাটার ভয়ে ভিনদেশে শরণার্থীর জীবন যাপন করছেন। কিছু সময় পরপর সেখানে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় মুসলমান ও বৌদ্ধদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানো হয়। স্বাভাবিক কারণেই এতে বিপুল জানমালের ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়ে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গারা। এ ক্ষেত্রে সংখ্যাগুরু রাখাইনদের পাশে যথারীতি রয়েছে রাষ্ট্রীয় পোষকতা। প্রতিটি রায়টের সময় বেশ কিছু রোহিঙ্গা দেশ ছেড়ে অন্য দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। এতদিন বাংলাদেশ ছিল তাদের জন্য সর্বোত্তম আশ্রয়। এখন বাংলাদেশ আর কোনো রোহিঙ্গাকে ঢুকতে দিচ্ছে না। এই জুনের প্রথম দিকে সূচিত রায়টের সময় এমনটি ঘটতেই আমরা দেখতে পাচ্ছি।
রোহিঙ্গা বিতাড়ানের পাশাপাশি মিয়ানমার সরকারনিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমে মুসলমানবিরোধী অপপ্রচারও চলছে সমতালে। ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারির দিকে ইসলাম ও মুসলমানদের হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য প্রচুর বই ও টেপ করা বক্তৃতা প্রকাশ্যে সে দেশে বিতরণ ও বিক্রি করতে দেখা গেছে। ২০০৪ সালে অনেক রোহিঙ্গা মুসলমান গ্রামবাসীকে জোর করে বৌদ্ধ ধর্ম চর্চা করতে বাধ্য করা হয়। তাদেরকে বিভিন্ন বৌদ্ধ উৎসবে যোগ দিতেও বাধ্য করা হয়। বৌদ্ধ উৎসবে চাঁদা নেয়া হয় জোর-জবরদস্তি করে। মুসলমানদের কবরস্থানগুলো দখল করে সেখানে বৌদ্ধদের সমাহিত করা হচ্ছে। সেই সাথে তাদের সমাহিত করার খরচও মুসলমানদের দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। সামরিক স্থাপনা, সড়ক নির্মাণ, সেতু ও বাঁধ নির্মাণ, প্যাগোডা, স্কুল, হাসপাতাল নির্মাণ, পুকুর খননের কাজে রোহিঙ্গাদের জোর করে নিয়োগ করা হচ্ছে কোনো মজুরি ছাড়াই। রোহিঙ্গাদের অস্তিত্বহীন করার জন্য সেখানে রোহিঙ্গা দম্পতিদের বিয়ের চুক্তির ওপরও আরোপ করা হয় নানা ধরনের বিধিনিষেধ। ঘুষ ছাড়া সেখানে বিয়ের অনুমতি মিলে না। অনেক রোহিঙ্গা মহিলা সৈনিক ও তাদের দালালদের ধর্ষণ ও অন্যান্য যৌন হয়রানির শিকার হন। পেশাজীবী প্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে আরাকান রাজ্যের বাইরে। ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা থাকার কারণে রোহিঙ্গা ছাত্ররা সেখানে পড়াশোনা করতে পারে না।
১৯৮২ সালে নতুন ‘বার্মা সিটিজেনশিপ ল' ঘোষণার পর থেকে আরাকানের বাইরে রোহিঙ্গাদের শিক্ষার মৌল অধিকার অস্বীকার করে আসছে সে দেশের সরকার। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রোহিঙ্গা ছাত্রদের আরাকানের রাজধানী আকিয়াবের Sittwe University-তে পড়তে যেতেও দেয়া হচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন পেশাজীবী প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে না পেরে রোহিঙ্গারা সে দেশে পরিণত হচ্ছে লেখাপড়ায় সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা একটি জনগোষ্ঠীতে। এরা আজ মূলত একটি চাষি ও জেলে জনগোষ্ঠী। পশুচারণ ও হাঁস-মুরগি পালন করেও অনেকে জীবিকা নির্বাহ করছে। অধিকন্তু তাদের ওপর আরোপ করা হয় অতিমাত্রায় কর। এমনকি নিজেদের ঘরের ছোটখাটো মেরামতের জন্য এদেরকে কর দিতে হয়। পশুর জন্ম ও মৃত্যুর খবরটিও এদের জানাতে হয় সরকারি কর্তৃপক্ষকে। এ রিপোর্টের জন্য দিতে হয় কর। সব কিছু মিলে এরা এক চরম দারিদ্রে্য নিপতিত এক জনগোষ্ঠী। ২০১১ সালে জাতিসঙ্ঘের বিশ্বখাদ্য কর্মসূচির রিপোর্ট মতে ৪৫ শতাংশ রোহিঙ্গা পরিবারের খাদ্যনিরাপত্তা নেই। ২০০৯ সালে এ হার ছিল ৩৪ শতাংশ। বাংলাদেশ সে দেশের রোহিঙ্গাদের জন্য ছিল এক স্বপ্নভূমি। ইদানীং বাংলাদেশের দুয়ারও তাদের জন্য পুরোপুরি বন্ধ।
১৭৮৪ সালের আগ পর্যন্ত আরাকান রাজ্য বার্মার অংশ ছিল না, ভারতেরও অংশ ছিল না। এর আগ পর্যন্ত আরাকান মোটামুটিভাবে এর স্বাধীন বা আধা-স্বাধীন অস্তিত্ব রক্ষা করে আসতে সক্ষম ছিল। ১৭৮৪ সালে বার্মিজ সৈন্যরা হাজার হাজার আরাকানিকে হত্যা করে-নিহতদের মধ্যে যেমনি ছিল রোহিঙ্গা, তেমনি রাখাইনরাও। বার্মার সৈন্যরা মসজিদ, দরগাহ, মন্দিরও ধ্বংস করে। সেখানে বার্মার নিপীড়নমূলক শাসন চলে ৪০ বছর (১৭৮৪-১৮২৪)। এ সময় দুই-তৃতীয়াংশ বা দুই লাখ আরাকানি বাংলাদেশের চট্টগ্রমে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। প্রথম অ্যাংলো-বার্মিজ যুদ্ধ (১৮২৪-২৬) শেষ হয় ১৮২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এরপর বার্মা স্বাক্ষর করে ‘ট্রিটি অব ইয়ান্দারো'। এর ফলে আরাকান ও টেনাসারিম চলে যায় ব্রিটিশ-ভারতের দখলে। তখন আরাকানের দুই শতাংশ লোকই ছিল মুসলমান। ১৯৩৫ সালে ভারত সরকার আইনের আওতায় ১৯৩৭ সালের ১ এপ্রিল বার্মাকে ব্রিটিশ-ভারত থেকে আলাদা করে। জনতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আরাকানকে ব্রিটিশ-বার্মার একটি অংশ করা হয়। এভাবেই আরাকান ১৯৪৮ সালে স্বাধীন বার্মার একটি প্রদেশে রূপ নেয়।
ইতিহাস বলে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে রোহিঙ্গা মুসলমানেরা আবাসনে সহাবস্থান করে আসছিল শান্তিপূর্ণভাবে বৌদ্ধ রাখাইনদের সাথে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এসে অবস্থা পাল্টে যায়। তৃতীয়পক্ষ তথা ব্রিটিশ রাজের প্ররোচনায় এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ঘটে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ। ১৯৪২ সালের ২৮ মার্চে ঘটা এক হত্যা-লুণ্ঠন ঘটনায় তিক্ততা শতভাগ বেড়ে যায়। এ সময় হত্যা করা হয় এক লাখ রোহিঙ্গাকে। ৮০ হাজার রোহিঙ্গা তাদের বাপ-দাদার বাড়িঘর ফেলে পালিয়ে যায়। ২৯৪টি রোহিঙ্গা গ্রাম তখন পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়া হয়। তখন থেকে রোহিঙ্গা ও রাখাইনের মধ্যে সম্পর্ক দিন দিন আরো খারাপ থেকে খারাপের দিকে যাচ্ছে। ১৯৪৮ সালে বার্মা স্বাধীন হলে মুসলমানেরা বার্মা ইউনিয়নের আওতায় আরাকানের স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে এক ব্যর্থ সশস্ত্র বিদ্রোহ করে। এরপর তাদের বেসামরিক চাকরিতেও নিয়োগ সুবিধা বন্ধ হয়ে যায়। তাদের চলাচলে আসে নানা বিধিনিষেধ। বাজেয়াপ্ত হয় অনেকের সম্পত্তি।
১৯৬২ সালে শুরু হয় জেনারেল নে-উইনের সামরিক শাসন। এরপর রোহিঙ্গাদের ঘোষণা করা হয় অবৈধ অভিবাসী বলে। বলা হয়, এরা ব্রিটিশ শাসনামলে আরাকানে অবৈধ অভিবাসন করে, যা ইতিহাসের চরম এক বিকৃতি ছাড়া আর কিছুই নয়। ১৯৭৪ সালে ইমার্জেন্সি ইমিগ্রেশন অ্যাক্টের মাধ্যমে বার্মার রোহিঙ্গাদের জাতীয়তা কেড়ে নেয়া হয়। এর মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে পরবাসী করে তোলা হয়, করা হয় তাদের রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠী। এরপর আসে ‘বার্মা সিটিজেনশিপ ল' ১৯৮২। এর মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত বেশ কিছু মৌল অধিকার ছিনিয়ে নেয়া হয়। এভাবে একের পর এক পদক্ষেপ নিয়ে বার্মাকে রোহিঙ্গামুক্ত করার অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করে চলেছে মিয়ানমার সরকার।
আরাকানে তথা রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গাদের শেকড় গভীরভাবে প্রোথিত। ১৩০০ বছর আগে রোহিঙ্গাদের বসতির সূচনা সেখানে। এই রাখাইন প্রদেশের এরা নাগরিক হবে না, তা কোনো দিনই যৌক্তিক হতে পারে না। আজ রোহিঙ্গা মৌল অধিকার নাগরিকত্ব অস্বীকার করে মিয়ানমার সেখানে জন্ম দিয়েছে এক মানবিক বিপর্যয়ের। এর একমাত্র সমাধান রোহিঙ্গাদের ভিত্তিভূমিতে তাদের নাগরিকত্ব স্বীকার করে নেয়া। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এবং সেই সাথে বাংলাদেশকেও জোরদার কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে মিয়ানমারকে রাজি করাতে হবে রোহিঙ্গাদের যাবতীয় মৌল অধিকার স্বীকার করে নিতে। এ কাজটি যত তাড়াতাড়ি করা সম্ভব হবে, তবেই মঙ্গল। বৌদ্ধদের দেশ মিয়ানমার বুদ্ধের অহিংস নীতি অনুসরণ করার মাধ্যমে এ মানবিক সমস্যার সর্বোত্তম সমাধান করতে পারে।
লেখকঃ শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও কলামিস্ট।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন