না দি রা ম জু ম দা র
আরব বসন্তের প্রধান দুই টার্গেট দেশ সিরিয়া ও ইরান সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান খুব সহজে হ”েছ না। কেমন পালাবদল করে করে দেশ দুটো আলোচনায় প্রাধান্য পা”েছÑ যখন ইরান প্রসঙ্গ প্রাধান্য পায়, তখন সিরিয়ার কথা শোনা যায় না, আবার সিরিয়া আলোচনার লাইম লাইটে এলে ইরান চলে যায় মুখ্য আলোচনার আড়ালে। বাংলাদেশসহ এশিয়া মহাদেশের বাসিন্দাদের জন্য বিষয়টি মোটেই স্বস্তিদায়ক নয়!
যে আদি অকৃত্রিম আসাদবিরোধী গণতন্ত্রকামীরা বসন্তের মাতাল হাওয়ার বালুঝড়ে ‘আসাদ হটাও’ আন্দোলনে নেমেছিল, সেই দলটিকে অনেক আগেই জঙ্গি মেজাজি বিভিন্ন দল ও উপদল হটিয়ে দিয়েছে; আবার তারা নিজেদের মধ্যেও নিরন্তর মারামারি, গোলাগুলি, বিস্ফোরণ ইত্যাদি করে যা”েছ। তাদের নিয়ে সৃষ্টি হয় সিরীয় জাতীয় পরিষদ, তুরস্কে তাদের হেড অফিস, বৈধতার স্বীকৃতিও পায় তারা। আর রয়েছে ফ্রি সিরীয় আর্মি। তবে এদেরও ওপরওয়ালা রয়েছে, যারা নাকি তাদের মতামতের তোয়াক্কা আর করে না। হোমস প্রদেশের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের প্রায় ১৪ সপ্তাহ পর সিরিয়া ও বিশেষ করে আসাদকে নিয়ে আবার তুলকালামের সূচনা করে একই প্রদেশের হুলা শহরের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। এ হত্যাকাণ্ডের অনুরণন ইউরোপীয় রাজধানীগুলোতে আবার সিরিয়ার বির“দ্ধে সামরিক হস্তক্ষেপের অপ”ছায়ার আবির্ভাব ঘটা”েছ। কিš‘ বাদ সেধেছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ¯’ায়ী দুই সদস্য, যারা আবার ব্রিকসের দুই প্রধান দেশ রাশিয়া ও চীন। রাশিয়া খোলামেলা বলে দিয়েছে, সিরিয়াতে বিদেশী সেনার হস্তক্ষেপের কোন প্রস্তাব নিরাপত্তা পরিষদে পাস হবে না। বেইজিং তার সরকারি অব¯’ান জানিয়েছে রাশিয়ার সমর্থনে। ফলে, আপাতত প্রতিবাদস্বরূপ প্রথম দফায় কানাডা, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, স্পেন, যুক্তরাষ্ট্র, বেলজিয়ামসহ আরও কয়েকটি দেশ সমন্বিতভাবে সিরীয় কূটনৈতিক মিশনকে তাড়িয়ে দিয়েছে। পরে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ বলেন, নিরাপত্তা পরিষদের অনুমতি ছাড়া ফ্রান্স সামরিক হস্তক্ষেপের অংশীদার হবে না; তবে ‘হস্তক্ষেপবিহীন’ বিদেশী সেনার উপ¯ি’তি হয়তো থাকতে পারে অথবা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ হতে পারে। বেলজিয়াম ও অস্ট্রেলিয়ারও একই মত। কিš‘ ‘ডিস্টার্বিং’ বিষয় হল, ওলাঁদ তার বক্তৃতায় বার্নার্ড-হেনরি লেভি নামক যে ফরাসি বুদ্ধিজীবী, দার্শনিক ও সাংবাদিকের রেফারেন্স দেন, সেই ব্যক্তিটি ২০১১ সালের মার্চে নিকোলা সারকোজিকে লিবীয় জাতীয় পরিষদকে স্বীকৃতি দিতে ও গাদ্দাফি বিরোধী সামরিক প্রচারণা চালানোর বুদ্ধি দিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রও বর্তমানে সামরিক হস্তক্ষেপ চায় না। তবে আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এর একটি কারণ। দ্বিতীয়ত, ইউরো-আটলান্টিকের গৃহীত সামরিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘চৌহদ্দির’ দায়দায়িত্ব মূলত ইইউ’র আওতাধীন। লিবিয়ার ক্ষেত্রেও তাই ছিল।
হুলা হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী কে? শহরটি বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে ছিল; সরকারি বাহিনী বাইরে থেকে তাদের ঘিরে রেখেছিল। রাশিয়া এজন্য সরকার ও বিদ্রোহী দুই পক্ষকেই দায়ী করে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ সরকারি বাহিনী কর্তৃক কামান ও ট্যাংকের গোলাগুলির জন্য সিরিয়ার ওপর দোষারোপ করে। কিš‘ সমস্যা হল, ৩৪ জন নারী ও ৪৯ জন শিশুসহ সর্বমোট যে ১০৮ জন মানুষ খামোখা মারা গেলÑ সবই ছিল ‘ক্লোজ-রেঞ্জের’ গুলিজনিত হত্যা, সেই সঙ্গে মৃতদেহের অমার্জনীয় অমর্যাদাকরণ; যেমন, শিরñেদ, গলা চেরা, অঙ্গ”েছদ ইত্যাদি। সাবেক ব্রিটিশ ইনটেলিজেন্স অফিসার অ্যালিস্টার ক্রুকের মতে, হত্যাকাণ্ডের বৈশিষ্ট্য থেকে বলা যায় যে লেভান্ট অঞ্চলের ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা এটি করেনি। সিরিয়া, লেবানন ইত্যাদি লেভান্ট অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। সিরীয় সরকার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছে। হতে পারে। কারণ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ইব্রাহিম আলুশের মতে, যেভাবে আক্রমণ ও সময় নির্ধারণ করা হয়েছে, তা থেকে বোঝা যা”েছ দামেস্ক জড়িত ছিল না। একি বিশ্বাসযোগ্য যে সরকারি বাহিনী খুন করে চলে যাবে, যাতে বিদ্রোহীরা তাদের কুকর্মের ছবি তুলতে, ডকুমেন্টারি বানাতে সক্ষম হয়? তার মতে, বহিরাগত সশস্ত্র গ্যাং নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী; তারা আসে উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের (জিসিসি) কোন কোন দেশ ও তুরস্কের মাধ্যমে ন্যাটো থেকে। তারা ¯’ানীয় হাসপাতালও আক্রমণ করে, আগুন লাগিয়ে দেয়। আলুশের মতে, যখন সিরীয় সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের সূচনা হয়েছে মাত্র, তখনই অপরাধটি সংঘটিত হল। হত্যাকাণ্ডের ধুয়া তুলে সিরিয়াতে বৈদেশিক হস্তক্ষেপের ক্ষেত্র তৈরির চেষ্টা এটি!
অনুরূপ ধ্বনি শোনা যায়, অ্যাকটিভিস্ট ও সাংবাদিক মারিনেলা করেগিয়ার বক্তব্যেও। যেমন, জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক মিশনের প্রধান জেনারেল রবার্ট মুড হত্যাকাণ্ডের দায় কারও ওপরে আরোপ না করে উভয় পক্ষকে যখন সংযম হওয়ার কথা বলছেন, তখন কয়েকটি মেইনস্ট্রিম মিডিয়া জাতিসংঘের বরাত দিয়ে বলতে থাকে, সরকারই দায়ী। এ নৃশংসতা থেকে আর যারই লাভ হোক, সরকারের নিশ্চয় নয়। নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকের আগ মুহূর্তে ফেব্র“য়ারি মাসে ঘটে হোমের নৃশংস হত্যাকাণ্ড। আবার কফি আনানের আসার আগে বা তার অব¯’ানকালে, কখনো বা সামরিক পরাজয় ঘটার পর নৃশংস হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটছে। সরকার যদি এসব ঘটায় তো ক্ষতিটা তো সরকারেরই বেশি! করেগিয়ার আশংকা, হুলা হত্যাকাণ্ড হয়তোবা বল্গাহীন গোষ্ঠীগত সহিংসতার বহিঃপ্রকাশ।
মে মাসে অনুষ্ঠিত জি-৮ ও ন্যাটোর সভায় র“শ প্রেসিডেন্ট ভাদিমির পুতিন উপ¯ি’ত ছিলেন না। সিরিয়া ও ইরান অস্তগামী শক্তির তুর“পের তাস। ইস্তাম্বুল বৈঠকের পর মে মাসে বাগদাদে অনুষ্ঠিত হয় ইরানবিষয়ক দ্বিতীয় বৈঠক, আর প্রায় সপ্তাহখানেকের ব্যবধানে ঘটে হুলা হত্যাকাণ্ড। শুর“ হয় সিরীয় সমস্যার। পুতিনের বার্লিন ও প্যারিসের পথে ঝটিকা সফরে বেরিয়ে পড়া এবং বার্লিনে যাওয়ার পথে বেলার“শে যাত্রাবিরতিতে বিশ্ব নিরাপত্তা প্রশ্নে ক্রমবর্ধমান সংশয়, বিশেষ করে সিরীয় সমস্যায় র“শ উদ্বেগেরই প্রতিফলন ঘটে। ইইউ ও ইউরো জোনের জন্য রাশিয়া অপরিহার্য; বার্লিন ও প্যারিস রাশিয়ার কৌশলগত অংশীদারও। তাই আলোচনার বিষয় সিরিয়া ছাড়াও ছিল অর্থনৈতিক পরি¯ি’তি, ইউরোপ, অর্থনৈতিক সহযোগিতা ইত্যাদি। বার্লিনে পুতিন ও মেরকেল ঘোষণা করেন, সিরিয়া সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের সমর্থক তারা। তাই কফি আনানের প্রচেষ্টায় সব ধরনের সহায়তা অব্যাহত থাকবে। গৃহযুদ্ধের যে আশংকা সিরিয়াতে উঁকিঝুঁকি দি”েছ, তার শরিক দুই দলই; এবং যেহেতু ‘সিরিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার বন্ধুত্ব অনেক দিনের’, তাই রাশিয়া একতরফাভাবে আসাদকেও সমর্থন করে না। পুতিন ও মেরকেল একমত হন যে গৃহযুদ্ধ ঠেকাতে সিরীয় সংকটের সমাধান হতে হবে একতরফা ব্যব¯’া গ্রহণের মাধ্যমে নয়, বরং রাজনৈতিকভাবে।
পুতিনের জন্য প্যারিস বৈঠকও ইতিবাচক ছিল। নিরাপত্তা পরিষদ প্রস্তাব পাস না করলে যুগোস্লাভিয়া কায়দায় অনুমতি ছাড়াই সিরিয়ার বির“দ্ধে সামরিক ব্যব¯’া নেয়া হবে বলে যখন জল্পনা-কল্পনা শুর“ হয়, ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ তখন পরিষ্কার ভাষায় এর বিরোধিতা করেন। ওলাঁদ সারকোজি নন; সারকোজি ছিলেন লিবিয়া, সিরিয়া ও পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপ সংক্রান্ত এজেন্ডার উৎসাহী সমর্থক। ফলে, দীর্ঘদিনের র“শ-ফরাসি সম্পর্কের ক্ষেত্রে যুগপৎ কর্মোদ্যমের ঘাটতি পড়েছিল। ওলাঁদ হয়তো বা ওয়াশিংটনের একশ’ ভাগ সঙ্গী হবেন না, বরং অধিকতর নিরপেক্ষ ভূমিকা গ্রহণের চেষ্টা করবেন তিনি।
নাদিরা মজুমদার : প্রাগ প্রবাসী সাংবাদিক
হধফরৎধযসধলঁসফধৎ@মসধরষ.পড়স
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন