বুধবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১২

মন্তব্য প্রতিবেদন : মুসলমানের মানবাধিকার থাকতে নেই


মাহমুদুর রহমান




বাড়ির পাশে মিয়ানমারে গত পঞ্চাশ বছর ধরে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে জাতিগত শুদ্ধি অভিযান (Ethnic Cleansing) চলছে। দেশটিতে সামরিক জান্তা এবং শান্তিতে নোবেল জয়ী, গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামরত অং সাং সুচি’র মধ্যে তীব্র রাজনৈতিক বিরোধ থাকলেও মুসলমান নিধনে তারা একাট্টা। মহামতি গৌতম বুদ্ধের মহান বাণী ‘প্রাণী হত্যা মহাপাপ’ এবং ‘জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক’ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের বাইরেও বিশ্বের তাবত্ শান্তিবাদীদের আবেগাপ্লুত করে থাকে। অথচ মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ কট্টর সাম্প্রদায়িক বৌদ্ধ সম্প্রদায় সে দেশের রোহিঙ্গা মুসলমানদের মানুষ তো দূরের কথা গৌতম বুদ্ধ বর্ণিত জগতের যে কোনো প্রাণীর মর্যাদা দিতেও নারাজ। সংখ্যালঘু মুসলমানদের বিরুদ্ধে পরিচালিত শুদ্ধি অভিযানকে ন্যায্যতা দিতে অং সাং সুচিসহ মিয়ানমারের শাসক-গোষ্ঠী তাদের নাগরিকত্ব থাকা না থাকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।
আরব বণিকদের মাধ্যমে মিয়ানমারের জনগণ ১২শ’ বছর আগে ইসলাম ধর্মের সংস্পর্শে আসে। গত সহস্রাব্দের প্রথমার্ধে আরাকানের বৌদ্ধ রাজা বিদ্রোহীদের দ্বারা ক্ষমতাচ্যুত হলে তার অনুরোধে গৌড়ের সুলতান কয়েক দফায় সেখানে সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন।
১৪৩২ সালে গৌড়ের সেনাপতি সিন্দি খান আরাকানের প্রাচীন রাজধানী ম্রোহংয়ে মসজিদ নির্মাণ করেন। ওই সময় থেকেই বৃহত্তর চট্টগ্রাম এবং স্বাধীন আরাকান রাজ্যের জনগণের মধ্যে ভ্রাতৃত্বমূলক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। আরাকানে মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং রাজসভায় বাংলাভাষা বিশেষ স্থান লাভ করে। মহাকবি আলাওল, শাহ ছগির, মাগন ঠাকুরের মতো মধ্যযুগের বিখ্যাত কবিরা আরাকান রাজ্যের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। আরাকান রাজারা বৌদ্ধ ধর্ম চর্চা করলেও মুসলমান পোশাকি নাম গ্রহণ করেন। অর্থাত্ মিয়ানমারের আরাকান অংশে ইসলাম ধর্ম এবং বাংলা ভাষার বিস্তার লাভ ৬শ’ বছরেরও অধিককাল আগের ঘটনা। সে তুলনায় পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমাদের আগমন সেদিন ঘটেছে। অথচ মিয়ানমারে ওইসব মুসলমানের নাগরিকত্ব নিয়ে এই শতাব্দীতে এসে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। এদিকে সীমান্তের এ পারে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মদতে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী একদল চিহ্নিত দালাল শ্রেণীর নাগরিক চাকমা জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী সাব্যস্ত করে এদেশের প্রকৃত ভূমিপুত্রদের অধিকার হরণের ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। মিয়ানমারে মুসলমানদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চললেও তথাকথিত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় (International Community) নিশ্চুপ রয়েছে। জাতিসংঘ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের পরিবর্তে অধিক সংখ্যায় উদ্বাস্তু গ্রহণের জন্য বাংলাদেশের ওপর অন্যায় চাপ সৃষ্টি করে তাদের দায়িত্ব সেরেছে। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকারি মহল নিরাশ্রয় রোহিঙ্গা নারী-শিশুদের প্রতি যে চরম অমানবিকতার পরিচয় দিয়েছে তার নিন্দা জানালেও এ কথা মানতে হবে, মিয়ানমারের মুসলমান শরণার্থীদের বাংলাদেশে আশ্রয় দিলেই মূল সমস্যার সমাধান হচ্ছে না।
কয়েক লাখ রোহিঙ্গা দুই যুগেরও অধিককাল টেকনাফ অঞ্চলে শরণার্থী শিবিরে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ রাষ্ট্র। অর্থনৈতিকভাবে আমরা এখনও একটি পশ্চাদপদ দেশের নাগরিক। যৌক্তিক কারণেই আমাদের পক্ষে দীর্ঘস্থায়ীভাবে কোনো অতিরিক্ত জনগোষ্ঠীর ভার বহন করা সম্ভব নয়। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশ বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর বিষয়ে সচরাচর যে উত্কণ্ঠা, উত্সাহ দেখিয়ে থাকে তার কিয়দাংশ রোহিঙ্গাদের প্রতি প্রদর্শন করলে সমস্যাটির দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে সহায়ক হতো। এসব রাষ্ট্র বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর আদিবাসী নামকরণে বাংলাদেশকে অব্যাহত অন্যায় চাপ দিলেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে তাদের নীরবতা বিস্ময়কর। এমন ধারণা পোষণ করা অমূলক হবে না, মিয়ানমারের সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী যদি মুসলমান ধর্মাবলম্বী হয়ে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গারা ভিন্নধর্মের হতো তাহলে দ্বিমুখী চরিত্রের (Double Standard) পশ্চিমাদের সুর পাল্টে যেত। অবশ্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা কিছুদিন আগে মিয়ানমার সফরে এসে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে অন্তত উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তার প্রকাশ্য প্রতিক্রিয়ার ফলে মিয়ানমার সরকার সাময়িকভাবে হলেও মুসলমান নির্যাতনে বিরতি দিয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে গঠিত সংগঠন ওআইসি (OIC) তার দায়িত্ব পালনে ধারাবাহিক ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলেছে। রোহিঙ্গাদের পাশে এসে দাঁড়ানো তো দূরের কথা, জতিগত শুদ্ধি অভিযান পরিচালনার জন্য মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে একটা নিন্দা প্রস্তাবও এ নির্বিষ সংগঠনটি আনতে পারেনি। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে মুসলমানদের ওপর নিপীড়ন চললেও ওআইসির যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে অমার্জনীয় ব্যর্থতা সংগঠনটির কার্যকারিতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
এবার ফিলিস্তিনের নির্যাতিত জনগণের দিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক। এক সময়ের ঔপনিবেশিক শক্তি ব্রিটেনের পররাষ্ট্র সচিব আর্থার জেম্স্ বালফুর (Arthur James Balfour) ১৯১৭ সালে তার দেশের ইহুদি (British Jewish Community) নেতা ব্যারন রথচাইল্ডকে (ইধত্ড়হ জড়ঃযংপযরষফ) লিখিত এক পত্রের মাধ্যমে প্যালেস্টাইনের আরব ভূমিতে একটি ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের প্রতিশ্রুতি দেন। ১৯৩৯ সালে যুদ্ধের ডামাডোল বাজার প্রাক্কালে ব্রিটেন ওই প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসার প্রচেষ্টা নিলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বিশ্ব ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। ওই যুদ্ধে নাত্সী জার্মানি ও তার ফ্যাসিস্ট মিত্ররা পরাজিত হলে ইউরোপব্যাপী খ্রিস্টানদের মধ্যে ইহুদিদের প্রতি হলোকস্টজনিত (Holocaust) এক প্রকার যৌথ অপরাধবোধ (Collective Guilt) জন্ম নেয়। জার্মানি, পূর্ব ইউরোপ ও রাশিয়ার অধিকৃত অঞ্চলের ইহুদিদের প্রতি হিটলারের পৈশাচিক আচরণের সঙ্গে আরবের মুসলমানদের কোনোরকম সম্পৃক্ততা না থাকলেও যুদ্ধে বিজয়ী ইঙ্গ-মার্কিন জোট অসহায় ফিলিস্তিনিদের তাদেরই ভূখণ্ড থেকে উত্খাত করে সেখানে ইহুদিবাদী রাষ্ট্র (Zionist State) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বালফুর ডিক্লারেশন বাস্তবায়ন করে। অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জর্জরিত আরবরা সামরিক দুর্বলতা ও ইঙ্গ-মার্কিন ষড়যন্ত্রের ফলে ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। শুরু হয় ফিলিস্তিনিদের উদ্বাস্তু জীবন। তারপর ৬৪ বছর পেরিয়ে গেছে। ফিলিস্তিনিরা তাদের আপন আবাসে আজও ফিরতে পারেনি, পূর্বপুুরুষের ভূমিতে তাদের ন্যায্য অধিকারও ফিরে পায়নি। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের অন্ধ সমর্থনে মৌলবাদী ইসরাইল এক দুর্বিনীত রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। আন্তর্জাতিক আইনের কোনোরকম তোয়াক্কা না করে রাষ্ট্রটি ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে একের পর এক ভয়াবহ সব মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে চলেছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল পারমাণবিক এবং অন্যান্য গণবিধ্বংসী অস্ত্রের সর্ববৃহত্ ভাণ্ডার গড়ে তুলেছে। অথচ সেদিকে দৃষ্টি না দিয়ে গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগে ইরাককে ধ্বংস করা হয়েছে। দীর্ঘদিনের অন্যায় অবরোধ ও নির্বিচারে বোমাবর্ষণে সে দেশের লাখ লাখ শিশু, নারী, পুরুষ নিহত হয়েছে। পশ্চিমাদের দ্বিমুখী নীতির এখানেই শেষ নয়। ইসলামিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের পারমাণবিক বোমাকে পশ্চিমা মিডিয়ায় ‘ইসলামিক বোমা’ নামে উল্লেখ করা হলেও ইসরাইলের বোমাকে ‘ইহুদি বোমা’ কিংবা ভারতের বোমাকে ‘হিন্দু বোমা’ কখনও বলতে শুনিনি।
ফিলিস্তিনিদের প্রতি অর্ধ শতাব্দীরও অধিককাল ধরে এত নির্যাতন, এত অবিচার অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও আরব রাষ্ট্রগুলো ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পরিবর্তে একে অপরের বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের দ্বারা সোত্সাহে ব্যবহৃত হচ্ছে। ইরাক, লিবিয়া এবং সিরিয়ার বিরুদ্ধে হামলায় মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন আরব রাষ্ট্রও যোগদান করেছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কুখ্যাত Divide and rule (বিভক্তি ও শাসন) কৌশল আজও নির্বোধ, ভ্রাতৃঘাতী মুসলমানদের বিরুদ্ধে সফলভাবে প্রয়োগ চলছে। ইরাক আক্রমণের প্রাক্কালে তত্কালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ (জুনিয়র) এবং যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার মুসলিম বিশ্বকে প্রতারিত করার জন্য যুদ্ধ শেষে ফিলিস্তিনি সমস্যার আশু সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ইরাক- ধ্বংসযজ্ঞের প্রায় দশ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। রাজনীতিতে কপটতার জন্য বহুল পরিচিত টনি ব্লেয়ার অসংখ্য মুসলমানের রক্তমাখা হাত নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে জাতিসংঘের বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। তার বেতন কত কিংবা তাকে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রদানে বছরে জাতিসংঘের কত লাখ ডলার ব্যয় হয় সে সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই। তবে অর্থের অংকটি বিশাল না হলে টনি ব্লেয়ার তার ‘মূল্যবান’ সময় নষ্ট করে মুসলমানদের প্রতি বদান্যতা দেখাচ্ছেন এটা বিশ্বাস করা কঠিন। ইরাকের লাখো শিশু হত্যাকারী টনি ব্লেয়ারকে মধ্যপ্রাচ্যে এ দায়িত্ব প্রদান করাটাই বিশ্বের সব মুসলমানের জন্য চরম অবমাননাকর। আশ্চর্যের বিষয় হলো আজ পর্যন্ত জাতিসংঘের সদস্য কোনো ইসলামিক রাষ্ট্রই টনি ব্লেয়ারের পদ প্রাপ্তি নিয়ে আপত্তি জানায়নি। যাই হোক, টনি ব্লেয়ার এখন পর্যন্ত ফিলিস্তিনি সমস্যার সমাধানে কোনোরকম অবদান রাখতে পারেননি। সমস্যা সমাধানে তার আদৌ কোনো আগ্রহ আছে সেটাও প্রতিভাত হয়নি। বরঞ্চ, এ সময়ের মধ্যে ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে ইসরাইলের আগ্রাসন আরও তীব্র হয়েছে। প্রায় প্রতিদিন ফিলিস্তিনি নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ, শিশু নিহত হচ্ছে। এই একতরফা গণহত্যাকে পশ্চিমাবিশ্ব জায়নবাদী ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকার বলে বর্ণনা করে বৈধতা দিচ্ছে। সুতরাং, আরব বিশ্বের একতা ব্যতীত সে অঞ্চলের মুসলমানদের সাম্রাজ্যবাদের নির্যাতন থেকে মুক্তির কোনো সম্ভাবনা নেই।
কাশ্মীর নিয়ে আলোচনা ছাড়া আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মুসলমানের বঞ্চনার কাহিনী সমাপ্ত হতে পারে না। ১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশ বিভক্ত হয়েছিল সংখ্যা-সাম্যের ভিত্তিতে। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান এবং হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে ভারত গঠিত হয়। কিন্তু, কাশ্মীর এবং হায়দরাবাদের মতো কয়েকটি রাজাশাসিত অঞ্চলের (Princely state) ভাগ্য অসত্ উদ্দেশে অনির্ধারিত রেখেই ব্রিটিশরা ভারত ত্যাগ করে। কাশ্মীরের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মুসলমান হলেও ডোগরা রাজা ছিলেন হিন্দু। অপরদিকে হায়দরাবাদের পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ উল্টো। ভারত সরকার হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতার যুক্তিতে সেনা অভিযান চালিয়ে মুসলমান শাসক নিজামকে ক্ষমতাচ্যুত করে হায়দরাবাদ দখল করে। একই যুক্তিতে কাশ্মীর পাকিস্তানের অংশভুক্ত কিংবা স্বাধীন হওয়ার কথা থাকলেও হিন্দু রাজা অন্যায়ভাবে ভারতভুক্তির ঘোষণা দেন। ১৯৪৮ সালের ২১ এপ্রিল জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ৩৯-৫ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ৪৭ নম্বর প্রস্তাব (Resolution 47) গৃহীত হয়। কাশ্মীরের ভবিষ্যত্ নির্ধারণে সেখানকার জনগণের অধিকার মেনে নিয়ে ওই প্রস্তাবে গণভোটের (Plebiscite) সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তবে জাতিসংঘের প্রস্তাবে একটা ফাঁক থেকে যায়। জাতিসংঘ চ্যাপ্টারের ৭ (Chapter VII)-এর পরিবর্তে নিরাপত্তা পরিষদ চ্যাপটার ৬ (Chapter VI)-এর অধীনে প্রস্তাব গ্রহণ করে। চ্যাপ্টার ৭-এর প্রয়োগ হলে ওই সিদ্ধান্ত ভারতের ওপর বাধ্যতামূলক (Binding and enforceable) হতো। সে সময় ভারত সরকার নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিলেও আন্তর্জাতিক আইনের ওই ফাঁকফোকরের সুযোগ নিয়ে সম্পূর্ণ গায়ের জোরে কাশ্মীরের জনগণকে আজ পর্যন্ত ভবিষ্যত্ নির্ধারণের অধিকার প্রয়োগ করতে দেয়নি। ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদের বুটের তলায় নিষ্পেষিত হচ্ছে সেখানকার নারীর সম্ভ্রম, তরুণের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। ৬৫ বছরের সংগ্রামে কাশ্মীরের লাখ লাখ স্বাধীনতাকামী নারী-পুরুষ ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে নির্যাতিত হয়েছে, নিহত হয়েছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আমাদের ওপর যে আচরণ করেছে তার সঙ্গে কাশ্মীরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর আচরণের কোনো ফারাক নেই। ৯০-এর দশকে কাশ্মীরের তত্কালীন গভর্নর জগমোহন বিক্ষোভকারীদের দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দিয়ে এক সময়ের ভূস্বর্গকে মৃত্যুপুরিতে পরিণত করেছিলেন। সেখানে পাঁচ লক্ষাধিক ভারতীয় সেনা শতাধিক নির্যাতন কেন্দ্র পরিচালনা করে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে সংগ্রামরত মুক্তিযোদ্ধাদের নির্যাতন করে চলেছে। ১ কোটি ২৫ লাখ জনসংখ্যার একটি অঞ্চলে ৫ লাখ সেনা মোতায়েন থেকেই ভারত সরকারের শক্তি প্রদর্শনের আন্দাজ পাওয়া সম্ভব। উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে সাড়ে সাত কোটি বাংলাদেশীকে দমন করতে পাকিস্তান সরকার ১ লাখ সেনা পাঠিয়েছিল। ফিলিস্তিনের নিপীড়িত মানুষের মতো কাশ্মীরের জনগণেরও মুক্তি কবে আসবে সেই ভবিষ্যদ্বাণী আমার পক্ষে করা সম্ভব না হলেও স্বাধীনতার অদম্য আকাঙ্ক্ষা যে কোনোদিন নির্বাপিত করা যায় না সেটা ইতিহাসেরই শিক্ষা।
এবার মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এক রাষ্ট্রে মুসলমানদেরই অসহায়ত্বের কথা বলি। সেক্যুলারত্বের আবরণে এক ইসলাম বিদ্বেষী সরকারের আমলের বাংলাদেশে সংখ্যাগুরু নাগরিকদের মানবাধিকার পরিস্থিতির চিত্র সংক্ষেপে তুলে ধরে লেখার ইতি টানব। তিনটি ঘটনার উল্লেখ করলেই আশা করি, পাঠক দেশের সার্বিক অবস্থা বুঝতে পারবেন। বিশ্বজিত্ নামে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক খেটে খাওয়া নিরীহ তরুণ প্রকাশ্য দিবালোকে মুজিববাদী ছাত্রলীগের চাপাতি বাহিনীর নৃশংসতার শিকার হয়ে এই বিজয়ের মাসেই নিহত হয়েছে। ছেলেটিকে লাঠি দিয়ে প্রহার এবং চাপাতি দিয়ে কোপানোর দৃশ্য টেলিভিশনের পর্দায় শেষ পর্যন্ত দেখা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। এই লেখার সময়ও তার উদভ্রান্ত, রক্তাক্ত চেহারা চোখের সামনে ভাসছে। প্রধানমন্ত্রী এবং তার মন্ত্রিসভার চাটুকার বাহিনী ব্যতীত দলমত নির্বিশেষে দেশবাসী সরকারের খুনি বাহিনীর বর্বর, নৃশংস আচরণে ঘৃণা প্রকাশ করেছেন। বিশ্বজিতের হত্যাকাণ্ডের দৃশ্য দেখতে গিয়ে আমার ২০০৭ সালের ২৮ অক্টোবরে ঢাকার রাস্তায় লগি-বৈঠার তাণ্ডবের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। সেদিন জামায়াত-শিবিরের একাধিক তরুণ আজকের বিশ্বজিতের মতোই অগুনতি টেলিভিশন ক্যামেরা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অসংখ্য সদস্যের চোখের সামনে নিহত হয়েছিলেন। দেশবাসী লাশের উপর আওয়ামী সন্ত্রাসীদের তাণ্ডব নৃত্যের একটি অতি লোমহর্ষক দৃশ্য দেখে শিউরে উঠেছিলেন। হত্যাকারীরা একই দলভুক্ত ছিল। আজকে তাদের মাঠে নামার হুকুম দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর আর সেদিন হুকুম দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। ঘটনার প্রকৃতি এবং হুকুমদাতার পরিচয়ে তফাত্ সামান্যই। কিন্তু, বড় তফাত্ হলো ২৮ অক্টোবর যারা নিহত হয়েছিলেন তারা সবাই ধর্মে মুসলমান ছিলেন। মুসলমান প্রধান দেশে সেই নৃশংসতায় বিস্ময়করভাবে বিবেক জাগ্রত না হলেও আজ বিশ্বজিতের জন্য সবাই আহাজারি করছেন। বিদেশি কূটনীতিকরাও দেশবাসীর উদ্বেগে শামিল হয়েছেন। আচ্ছা, ২৮ অক্টোবর লগি-বৈঠার তাণ্ডবে যারা নিহত হয়েছিলেন তাদের নামগুলোও কি স্মরণে আছে আপনাদের? এ সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় টকশো স্টার মাহমুদুর রহমান মান্না ক’দিন আগে টেলিভিশনে বললেন বিশ্বজিতের ঘটনা নাকি বেশি নির্মম। হতেও পারে। তবে আমার কাছে হিন্দু ও মুসলমানের রক্তের রঙ, তাদের মৃত্যুযন্ত্রণা একই রকম মনে হয়। প্রসঙ্গক্রমে আরও একটি তথ্যের উল্লেখ করছি। যেদিন ঢাকায় বিশ্বজিত্ নিহত হয়েছে সেই একইদিনে সিরাজগঞ্জে, জামায়াতে ইসলামীর কর্মী ওয়ারেস আলীকেও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা গণপিটুনিতে হত্যা করেছে। সেই খুনের ঘটনাতেও নৃশংসভাবে লাঠি এবং ছুরি ব্যবহৃত হয়েছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো বিশ্বজিত্ হত্যা নিয়ে মিডিয়াতে মাতামাতি হলেও ওয়ারেস আলীর খবর ছাপাতে পত্রিকায় সিঙ্গেল কলামের বেশি জায়গা হয়নি। তাও আবার হাতে গোনা দু-একটি পত্রিকায়। অধিকাংশ পত্রিকা এবং টেলিভিশন ওয়ারেস আলীকে সংবাদের মর্যাদা দিতেও কুণ্ঠিত হয়েছে।
পরাগ নামে এক নিষ্পাপ শিশু কিছুদিন আগে স্কুলে যাওয়ার পথে অপহৃত হয়েছিল। শিশুটির বাবা কেরানীগঞ্জের একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। কয়েকদিন নিখোঁজ থাকার পর বিশাল অংকের মুক্তিপণের বিনিময়ে পরাগকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়। পরাগের পরিবার সংখ্যালঘু এবং আওয়ামী লীগ সমর্থক। অপহরণকারীরাও সরকারি দলের চিহ্নিত সন্ত্রাসী। পরাগের অপহরণে সারা দেশে শোকের বন্যা বয়ে গিয়েছিল। আমার পরিচিত অনেক পরিবারে শিশুটির মুক্তির জন্য নামাজ পড়ে দোয়া করার কাহিনী শুনেছি। ক’দিন অন্তত টেলিভিশনে প্রায় ২৪ ঘণ্টাই কেবল পরাগকে নিয়ে সংবাদ প্রচার এবং টক শো’তে আলোচনা চলেছে। অপহরণকারীরা তাকে মুক্তি দিলে দেশের মানুষ আন্তরিকভাবেই স্বস্তি প্রকাশ করেছে। ধনবানদের জন্য নির্মিত স্কয়ার হাসপাতালে চিকিত্সা শেষে পরাগ নিজ বাসায় মায়ের কোলে ফিরে গেলে এলাকায় আনন্দের বন্যা বয়ে গিয়েছিল। উলুধ্বনি, ফুল ছিটানো, মিষ্টি বিতরণ, ইত্যাদি টেলিভিশনে দেখেছি। পরাগের মতোই এবার আর এক শিশুর গল্প বলি। সে এতই দরিদ্র পরিবারের যে তার নাম জানার আপনাদের কারও আগ্রহ হবে না। পঞ্চগড়ে এক অনুষ্ঠানে গিয়ে তার হত্যার নির্মম কাহিনী শুনেছিলাম। শিশুটির বাবা কলা ফেরি করে সংসার চালান। দু’বেলা আহার জোটা মুশকিল। অপহরণকারীরা শিশুটিকে তুলে নিয়ে এক লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেছিল। হাজার টাকা দেয়ার যার সামর্থ্য নেই সে লাখ টাকা কোথায় পাবে? ক্লাস থ্রিতে পড়া মাসুম বাচ্চাটিকে নরপিশাচরা বড় নির্মমভাবে হত্যা করে রাস্তার পাশে ডোবায় লাশ ফেলে গিয়েছিল। আমি যে অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম সেটা আমার সংবর্ধনা সভা ছিল। কিন্তু, সংবর্ধনা সভা পরিণত হয় শোক সভায়। সভাস্থলে উপস্থিত গ্রামের মহিলাদের বুকফাঁটা কান্নায় পরিবেশ ভারি হয়ে উঠেছিল; আমার মতো পাষাণ হৃদয়ও চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। এই হতদরিদ্র, মুসলমান পরিবারের অভাগা সেই শিশুর করুণ কাহিনী কোনো টেলিভিশন চ্যানেলে সবিস্তারে বর্ণনা হতে কি কেউ দেখেছেন? পঞ্চগড়ের দরিদ্র বাবা-মা প্রাণের চেয়ে প্রিয় শিশুটিকে হারিয়ে কেমন করে শোকাতুর জীবন কাটাচ্ছেন আমিও তার খবর রাখিনি। তারা বেঁচে আছেন কিনা তাও জানি না।
ক’দিন আগে ২১ জন নারীকে কয়েকশ’ বীরপুঙ্গব পুরুষ পুলিশ কয়েক ঘণ্টা ‘অপারেশন’ চালিয়ে মগবাজারের এক বাসা থেকে গ্রেফতার করে রমনা থানায় নিয়ে যায়। তাদের কাছ থেকে ‘ভয়ঙ্কর’ সব ইসলামী বইপত্র উদ্ধার করা হয়েছে যা কিনা আওয়ামী পুলিশের দৃষ্টিতে বন্দুক বোমার চেয়েও প্রাণঘাতী। একরাত থানা হাজতে রেখে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত সেই তরুণীদের সিএমএম আদালতে নেয়া হয়। ম্যাজিস্ট্রেট ২০ জনের জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে দু’দিনের রিমান্ড প্রেরণ করেন। মামলা কিন্তু দায়ের হয়েছিল ৫৪ ধারায় যাতে রিমান্ড তো দূরের কথা তত্ক্ষণাত্ জামিন মঞ্জুর হওয়া উচিত ছিল। পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ২০ বছরের কান্তাকে অবশ্য ম্যাজিস্ট্রেট দয়া দেখিয়ে রিমান্ডের পরিবর্তে জেলহাজতে পাঠিয়ে দেন। তবে কান্তাকে ম্যাজিস্ট্রেটের আট তলার এজলাসে সিঁড়ি দিয়ে হাঁটিয়ে, টেনে-হিঁচড়ে ওঠানো এবং নামানো হয়। সিএমএম আদালতে লিফ্ট থাকলেও কান্তাকে সেটা ব্যবহার করতে দেয়া হয়নি। আমি যে বিশেষ ধরনের ক্ষ্যাপাটে কিসিমের মানুষ সে তথ্য তো দেশবাসী শেখ হাসিনার আমলে জেনে গেছেন। এতগুলো নিরপরাধ নারীকে রিমান্ডে পাঠানোর বিষয়টি জানার পর থেকে একটা প্রশ্ন মাথার ভেতরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যে পুলিশ কর্মকর্তা রিমান্ড চেয়েছেন এবং সিএমএম আদালতের যে ম্যাজিস্ট্রেট তা মঞ্জুর করেছেন তাদের এসব দুষ্কর্ম করার সময় কখনও কি নিজ স্ত্রী, বোন অথবা কন্যার কথা মনে পড়ে? চাকরি বাঁচানোর দোহাই দিয়ে বিবেককে কি এভাবে কবর দেয়া সম্ভব? অফিস শেষে নিজগৃহে ফিরে স্ত্রী কিংবা বোন কিংবা কন্যার দিকে তাকানোর সময় তাদের দৃষ্টি কি লজ্জায় নত হয়ে আসে না?
যাই হোক, দু’দিন রিমান্ড শেষে পর্দানশীন ২০ নারীকে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। এদের মধ্যে অনেকের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা চলছে। প্রস্তুতি নেয়ার জন্য তাদের পাঠ্যবই পাঠানো হলেও জেল কর্তৃপক্ষ সেগুলো আটকে দিয়েছে। বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী উভয়ই নারী। সেক্যুলার সরকারের সর্বত্র প্রগতিশীল নারীবাদীরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারপার্সন সুলতানা কামাল অন্য সব ব্যাপারে সরব হলেও এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত মুখ খোলেননি। আর এক মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খানের কাছে মন্তব্যের জন্য আমার দেশ থেকে ফোন করা হলে কথা বলতে শুরু করেও বন্দী নারীরা সবাই জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রী সংগঠনের সদস্য জানা মাত্রই রূঢ় কণ্ঠে বলে উঠেছেন, আমার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। ক্যামেরার সামনে বিচিত্র অঙ্গভঙ্গিতে নাটক করতে পারঙ্গম, মানবাধিকার কমিশনের আওয়ামী চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান লিমনকে নিয়ে কান্নাকাটি করলেও এক্ষেত্রে নীরব। অবশ্য কথা বলেননি, ভালোই হয়েছে। বন্দিনীদের রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে হয়তো নির্লজ্জের মতো বলে বসতেন, মাত্র দু’দিনের রিমান্ড অনেক কম হয়ে গেছে, এখনও ডাণ্ডাবেড়ি কেন পরানো হয়নি, বিনাবিচারে ফাঁসি দেয়া হচ্ছে না কেন, ইত্যাদি, ইত্যাদি। সমাজের এই ভয়াবহ চিত্র চরম ফ্যাসিবাদের লক্ষণ। জার্মানির হিটলার তার নাত্সীবাদী শাসনকালে ইহুদিদের বসবাসের জন্য বস্তির (Ghetto) ব্যবস্থা করেছিলেন, সহজে চেনার জন্য সব ইহুদি নাগরিকের বাহু বন্ধনী (Arm band) লাগানো বাধ্যতামূলক করেছিলেন। সেক্যুলারিজমের নামে বাংলাদেশের নব্য ফ্যাসিস্টরা প্রায় সেদিকেই ধাবিত হচ্ছেন বলেই মনে হচ্ছে।
বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক নাকি মুসলমান ধর্মাবলম্বী! অবস্থাদৃষ্টে এই তথ্যে বিশ্বাস করা ক্রমেই কষ্টকর হয়ে উঠছে। আরবি নামে কেউ পরিচিত হলেই তাকে কি মুসলমান বলা যাবে? আরবে নাম শুনে কারও ধর্ম বিশ্বাস সম্পর্কে ধারণা করা কঠিন। খ্রিস্টান, ইহুদি, মুসলমানদের প্রায় কাছাকাছি নাম। লেবাননের প্রখ্যাত দার্শনিক, লেখক, কবি, চিত্রকর কাহলিল জিবরানকে দীর্ঘদিন আমি মুসলমান বলেই জানতাম। প্রায় বুড়ো বয়সে আমার সেই ভুল ভেঙেছে। বাংলাদেশেও প্রকৃত মুসলমানরা নীরবে সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছেন কিনা সেটা জানার জন্য বোধহয় সমীক্ষার সময় এসেছে। ফেরদৌস, নুর, শরীফ, কবীর, আলী, আহমেদ, হক, রহমান ইত্যাদি নামের আড়ালে কারা লুকিয়ে আছেন কে জানে?
ইমেইল : admahmudrahman@gmail.com

মঙ্গলবার, ২৭ নভেম্বর, ২০১২

গাজায় আগ্রাসন : ফিলিস্তিনের বোঝা ও সমঝোতার ওঝা


মীযানুল করীম
তারিখ: ২৮ নভেম্বর, ২০১২
গাজায় আগ্রাসন
হাজার হাজার ফিলিস্তিনি গাজার রাস্তায় আনন্দ উৎসবে মেতে উঠেছে। শিশু-কিশোর-যুবকেরা উল্লাসে হর্ষধ্বনি দিচ্ছে। কেউ কেউ দেখাচ্ছে বিজয়চিহ্ন ‘ভি’। এই দৃশ্য গাজা ভূখণ্ডের, যেখানে এবার ইসরাইল আবার ব্যাপক হামলা চালিয়ে হত্যা ও ধ্বংসের মহোৎসবে মেতে উঠেছিল। তার অবসানেই ফিলিস্তিনিদের এই স্বস্তি ও আনন্দ। টিভিতে ও পত্রপত্রিকায় তাদের বিষাদ-বেদনার ছবিও তুলে ধরা হয়েছে। বিবিসি টিভিতে দেখা যায়, বয়স্ক গাজাবাসী কোলাকুলি করছেন। তবে মুখে ঈদের হাসি নয়, দুঃখ ও উদ্বেগ। পাশেই ইহুদিবাদী আগ্রাসনে বিধ্বস্ত বড় বড় ভবন। এএফপি হামাস সদর দফতরের ছবি দিয়েছে। দেখা যাচ্ছে, সেখানে বিরাট দেয়ালজুড়ে রণাঙ্গনের ছবি আঁকা। পাশেই রাস্তা থেকে সরানো হচ্ছে এই সদর দফতর ভবনের ধ্বংসস্তূপ। ইসরাইল এখানেও ভয়াবহ হামলা চালিয়েছে। তাদের নৃশংসতায় চিরতরে হারিয়ে গেছে বহু শিশু-কিশোর। একটি ছবিতে গাজার এক শিশুর হাতে ফিলিস্তিনের প্রিয় পতাকা, চোখে অপার বেদনার অরোধ্য অশ্রু। স্বজন হারানো কচি মেয়েটির বুকের ওপর একটি পোস্টারে রয়েছে তার আপনজনের ছবি। এর ওপর কিছু কথা আরবিতে লেখা। সম্ভবত কুরআন শরিফের বাণীও আছে এর মধ্যে।
এ সব কিছুই গাজায় আট দিনের সর্বাত্মক হামলা থেমে যাওয়ার পরবর্তী দৃশ্য। ২১ নভেম্বর পর্যন্ত ইসরাইলি হামলায় ১৬৭ জন নিহত হয়েছে। হানাদার ইহুদি বাহিনীর পৈশাচিকতার বলি হয়েছে প্রধানত শিশু ও নারীসহ নিরীহ মানুষ। এতে মাত্র পাঁচ ইসরাইলি প্রাণ হারিয়েছে। বাকিরা সবাই ফিলিস্তিনি। ফিলিস্তিনিদের ভবন ও স্থাপনা মিলিয়ে সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি বিপুল। ২১ তারিখ রাত ১টায় যুদ্ধবিরতির সমঝোতার ঘোষণা দেয়া হয়। মিসরীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ কামাল আমর সংবাদ সম্মেলনে বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তার পাশে ছিলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি কিনটন।
স্মর্তব্য, ফিলিস্তিনের বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ড গাজার ১৫ লাখ মানুষের ওপর ইসরাইল ছয় বছর ধরে বেআইনি অবরোধ চাপিয়ে রেখেছে। ফলে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে গাজাবাসী। এর মধ্যে ২০০৮ সালে ইসরাইল ভয়াবহ হামলা চালিয়ে গাজাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল। তখন প্রাণ ও সম্পদের ক্ষতি হয় অপরিমেয়। এমনকি রাসায়নিক অস্ত্রও ব্যবহার করেছে ইসরাইল। তাই আজো গাজায় জন্ম নিচ্ছে পঙ্গু শিশু।
গাজার ব্যাপারে ইসরাইল ও ফিলিস্তিন শর্তসাপেক্ষে সমঝোতায় এসেছে। চারটি শর্ত ইসরাইল আর দু’টি শর্ত ফিলিস্তিনের বেলায় প্রযোজ্য। শর্ত হলো, ইসরাইল (১) নৌ, স্থল বা আকাশপথে গাজা উপত্যকায় কোনো প্রকার আগ্রাসন চালাবে না। (২) সীমান্তে কোনো গুলিবর্ষণ করবে না। (৩) ফিলিস্তিনি নেতাদের ‘পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড’ ঘটাবে না। (৪) যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই এই উপত্যকার সব ক্রসিং খুলে দেবে। গাজায় লোকজনের যাতায়াত কিংবা পণ্য আনা-নেয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা সৃষ্টি করতে পারবে না। অন্য দিকে ফিলিস্তিনিরা (১) ইসরাইলের দিকে মিসাইল ও রকেট ছুড়বে না। (২) সীমান্তে ইসরাইলি নাগরিকদের ওপর হামাস সরকার হামলা চালাবে না।
সম্প্রতি হামাস সামরিক বিভাগ প্রধান আহমদ জাবারিকে এমন একসময়ে হত্যা করা হয়, যখন গাজায় উত্তেজনা ছিল না। বরং ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীর ভূমিকায় মনে হচ্ছিল, তারা গাজায় নয়, গৃহযুদ্ধ-জর্জরিত সিরিয়া সীমান্তে হামলা চালাবেন। তাই গাজায় তখন স্বস্তিপূর্ণ স্বাভাবিক পরিস্থিতি। জাবারি সামরিক তৎপরতায় নিয়োজিত থাকাকালে নিহত হননি। এবার যুদ্ধবিরতি চুক্তির যে চারটি শর্ত ইসরাইলের ওপর প্রযোজ্য, এর তৃতীয় শর্ত হলোÑ তারা ফিলিস্তিনি নেতাদের ‘পরিকল্পিতভাবে’ হত্যা করবে না। বিশেষত জাবারির হত্যাকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে এটা উল্লেখ করা হয়েছে। ইসরাইলি কলামিস্ট উরি আভনারির ভাষায়, পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের ইসরাইলি নাম ‘টার্গেট করা প্রতিরোধ’ অথবা ‘উচ্ছেদ’। এই আইটেম অলিম্পিকে থাকলে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, মোসাদ শিনবেত সোনার মেডেল পেত বলে আভনারি লিখেছেন। জাবারির ‘অপরাধ’ ইসরাইলি সৈন্য গিদ শালিতকে পাঁচ বছর লুকিয়ে রাখার পেছনে তিনিই। অথচ শালিতের মুক্তির মধ্যস্থতাকারী গেরশন বাসকিন জাবারি হত্যার পরদিনই জানালেন, এই হামাস নেতা দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধবিরতি চেয়েছেন। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তার সাথে বাসকিনের যোগাযোগও ছিল।
মার্কিন মতলব ও মিসরের মুরসি
মাত্র কয়েক মাস আগে নির্বাচিত মিসরীয় প্রেসিডেন্ট ড. মোহাম্মদ মুরসি গাজায় যুদ্ধবিরতির নায়ক হিসেবে আখ্যা পেয়েছেন। তিনিই সবার আগে উদ্যোগ নেন, যাতে ইসরাইল ও হামাস অবিলম্বে সমঝোতায় উপনীত হয়ে অস্ত্রসংবরণ করে। মুরসি কয়েক দফা বৈঠক করেন উভয় পক্ষের সাথে। তবে প্রত্যাশিত সময়ের এক দিন পরে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়েছে। তবুও তিনি সন্তুষ্ট এবং দুই পক্ষের কাছে এ জন্য কৃতজ্ঞ বলে জানান। গাজায় হামলা বন্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব তার সহায়ক ভূমিকা রেখেছেন। বড়জোর কিছুটা ত্বরান্বিত করেছেন যুদ্ধবিরতিকে। মিসরের এ অবস্থানে ব্যক্তি হিসেবে মুরসির গ্রহণযোগ্যতা এবং দেশ হিসেবে মিসরের মর্যাদা বেড়েছে। তা ছাড়া ব্রাদারহুডকে যারা ইসরাইলের চরম বিরোধী ‘কট্টরপন্থী’ মনে করেন, তাদের ধারণা বদলানোর মতো অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। গাজায় শান্তি স্থাপনে মিসর ভবিষ্যতেও কাণ্ডারির ভূমিকা নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এবারকার যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে বিবদমান দুই পক্ষের পালনীয় মোট ছয়টি শর্তের উল্লেখ আছে।
কিন্তু ইসরাইল চুক্তি স্বাক্ষর করার পর দুই দিন না যেতেই গাজা সীমান্তে গুলি চালিয়ে একজন ফিলিস্তিনিকে হত্যা এবং নয়জনকে আহত করে। এমন একটা ঘটনা সত্ত্বেও ইসরাইলের দাবি, এর মাধ্যমে অস্ত্রবিরতি চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করা হয়নি। তবে এ ঘটনায় চুক্তির স্থায়িত্ব ও বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
গাজায় ইসরাইলি ধ্বংসযজ্ঞের ঘটনায় মার্কিন ডাবল স্ট্যান্ডার্ড বা দুই মুখো নীতি আবার প্রকটভাবে উন্মোচিত হয়েছে। ওবামা নিজেকে শান্তিকামী ও অনাগ্রাসী হিসেবে তুলে ধরেছেন এবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারাভিযানে। ইরানে হামলার ব্যাপারে ইসরাইলসহ ইহুদি লবির সাথে ভিন্ন মত পোষণ করে ওবামা নিজের ইতিবাচক ইমেজ গড়ে তুলেছিলেন, বিশেষ করে মুসলিম ভোটারদের মাঝে। অপর দিকে, তার প্রতিদ্বন্দ্বী মিট রমনি ইহুদিদের দরদি হিসেবে অভিযোগ আনলেন, ‘ওবামা আমাদের বিশ্বস্ত মিত্র ইসরাইলের পাশে দাঁড়াচ্ছেন না।’ সেই ওবামা নির্বাচনে জিতে দ্বিতীয়বার কর্ণধার হলেন বৃহত্তম বৃহৎ শক্তির। এরপরই কালো মানুষটির মুখে ভালো ভালো কথাগুলো আর শোনা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত একটা কথা, ‘গাঙ পার হলে নাইয়া শালা’। নির্বাচনের কয়েক দিন পর এবং ইসরাইল যখন গাজায় আবার আগ্রাসনের প্রস্তুতি শেষ করে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, তখন বারাক ওবামা বললেন, ‘ইসরাইলেরও বাঁচার অধিকার আছে।’
আজ যদি ইসরাইল এমন কোনো রাষ্ট্রের নাম হতো যে নিরীহ, শান্তিপ্রিয়, দুর্বল ও বিপন্ন; বলদর্পী আগ্রাসী শক্তি যাকে আক্রমণ করছে, তাহলে ওবামার এ কথাটি যুক্তিযুক্ত হতো। ইসরাইল পারমাণবিক শক্তিধর দেশ, যে শক্তি কোনো আরব দেশের নেই। এমনকি ইরানেরও নেই এই বোমা। অথচ সেটা ইহুদি রাষ্ট্রটি অনেক আগেই বানিয়েছে এবং তা সম্ভব করেছে ওবামার দেশ যুক্তরাষ্ট্রই। ইসরাইলের অন্যায় প্রতিষ্ঠা ফিলিস্তিনিদের সহিংসভাবে উচ্ছেদ করে। তার নারকীয় আগ্রাসনের শিকার হয়েছে লেবানন। এখনো তার দখলে জর্ডানের একাংশ। ইসরাইলি হামলায় ধ্বংস হয়েছে ইরাক-সিরিয়ার পরমাণু স্থাপনা। তার মিসাইল হাজার মাইল দূরের মুসলিম রাষ্ট্রেও ধ্বংস ঘটাতে সক্ষম। ইসরাইল চরম বর্ণবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা এবং সম্প্রসারণবাদ ও আধিপত্যবাদের প্রতীক ও প্রতিভু। এমন একটি অপরাষ্ট্রশক্তিকে ওবামা মূলত মদদ দিলেন গাজায় আবার ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যা ঘটাতে। ওবামা তো জানেন, ১৯৮২ সালে লেবাননে ফিলিস্তিনিদের সাবরা ও শাতিলা শিবিরে ইসরাইলের গণহত্যাযজ্ঞ আধুনিক বিশ্বের নজিরবিহীন কলঙ্ক।
আর ওবামার পররাষ্ট্রমন্ত্রী অর্থাৎ মার্কিন সরকারে ওবামার পরই যার অবস্থান, সেই হিলারি গাজা ইস্যুতে অবতীর্ণ হলেন ‘হিলার’ (Healer) বা নিরাময়কারিণীরূপে। শান্তিদূতীর সে কী দৌড়ঝাঁপ! তিনি ইসরাইল গেলেন কয়েক দিনের ভয়াবহ হামলায় গাজা বিধ্বস্ত হওয়ার পর, এর আগে নয়। মিডিয়ায় ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট আব্বাসের আশাবাদ দেখা গেল, ‘হিলারির এই সফরকালেই গাজায় হামলা বন্ধ হবে।’ অর্থাৎ ‘শান্তির দেবী’ ছাড়া কেউ ইসরাইলকে শান্ত করতে পারবে না। আমেরিকা ফিলিস্তিনিসহ আরব বিশ্ব এবং অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রকেও বোঝাতে চেয়েছে যে, “ফিলিস্তিনে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং এই ইস্যুর ‘সুরাহা’র জন্য ওয়াশিংটনের দ্বারস্থ না হয়ে উপায় নেই। অতএব, স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের খায়েশ ছেড়ে আমেরিকার কথা মতো ইসরাইলের আবদারগুলো মেনে নাও।” ফিলিস্তিন প্রশ্নে আমরা বারবার দেখছি, যুক্তরাষ্ট্র ‘সর্প হইয়া দংশন করে, ওঝা হইয়া ঝাড়ে।’

আমেরিকা শান্তিপ্রয়াসের নামে বহু দিন ধরে ইসরাইলকে সুযোগ দিচ্ছে অশান্তি জিইয়ে রাখার। এবার গাজায় (আপাত) শান্তি আনার কৃতিত্ব নিতে চেয়ে ওবামা-হিলারি ধাক্কা খেলেন মিসরের মুরসির কারণে। বিশ্ব দেখেছে, মিসর এবার সত্যিকার আঞ্চলিক মুরব্বির ভূমিকা সাফল্যের সাথে পালন করেছে। মার্কিন বশংবদ মোবারকের আমলে যা সম্ভব হয়নি, তা হলো ইসলামপন্থী ব্রাদারহুড নেতার এই আমলে। মিসরের এই প্রশংসনীয় ভূমিকায় তুরস্ক ও মালয়েশিয়ার মতো প্রভাবশালী মুসলিম রাষ্ট্র আঞ্চলিক সঙ্কটে মধ্যস্থতা করার আরো প্রেরণা পাবে আশা করা যায়।
আজকের হামাস : অতীতের প্রেক্ষাপট
গাজার নিয়ন্ত্রণ হামাসের হাতে। তারা এটা জবরদখল করেনি। সেখানকার শুধু নয়, ‘ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ’-এর আওতাধীন পশ্চিম তীরসহ গোটা এলাকায় হামাস নির্বাচনে গণরায় পেয়েছিল দেশ শাসনের। কিন্তু বাইরের ইহুদি মার্কিন চক্রান্ত আর ভেতরে মাহমুদ আব্বাসদের বিদ্বেষ-বৈরিতার দরুন হামাস ফিলিস্তিনিদের সরকার পরিচালনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলো। গণতন্ত্রের প্রবক্তা আমেরিকা এবং তার নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দুনিয়ার কাছে অসৎ, অযোগ্য, দুর্নীতিবাজ, আপসকামী আল ফাতাহ তথা পিএলও নেতারা হামাসের সৎ, যোগ্য, জনসেবক, আদর্শবাদী নেতৃত্বের চেয়ে অনেক বেশি প্রিয়। কারণ, মাহমুদ আব্বাস গং সেক্যুলার এবং ইসরাইল-আমেরিকাকে তোয়াজ করে চলে। অপরদিকে ইসমাইল হানিয়ারা ইসলামি জীবনব্যবস্থায় একনিষ্ঠ আস্থাবান এবং সে কারণে ইহুদিবাদ ও এর মুরব্বিদের কাছে নতজানু হতে নারাজ। তাই ইসরাইল হামাসকে ফিলিস্তিন মুক্তি সংগ্রামের অনমনীয় শক্তি মনে করে তাদের টার্গেট করেছে হত্যা, ধ্বংস ও নির্যাতনের। হামাসের তুলনায় আব্বাস ও তার পিএলও ইসরাইলের কাছে অনেক কম বিপজ্জনক এবং আমেরিকার কাছে অনেক বেশি পছন্দের। ইসরাইলের উপলব্ধি, ইহুদিবাদের সর্বপ্রধান দুশমন ইসলাম, আর হামাস এর চেতনায় উজ্জীবিত। যুক্তরাষ্ট্রের যুক্তি, হামাস মৌলবাদী আর পিএলও সেক্যুলার। তাই হামাস যাতে কোনো দিন ফিলিস্তিন জনগণের মূল নেতৃত্বরূপে প্রতিষ্ঠিত ও স্বীকৃত হতে না পারে, সেজন্য ওয়াশিংটন-তেল আবিব চেষ্টার ত্রুটি করছে না।
হামাস নিয়ে আমার স্মৃতি থেকে কিছু কথা বলছি। সম্ভবত ১৯৮৭ সালের শেষ দিকে হামাস গঠিত হয়। তবে এর নাম প্রথম দু-এক বছর বাংলাদেশে প্রায় অজানা ছিল। কারণ তখনো এর সংগঠন গড়ে তোলার প্রক্রিয়া চলছিল এবং বাইরের প্রকাশ্য তৎপরতা তেমন শুরু হয়নি। ১৯৮৮ সালে একজন সিনিয়র সাংবাদিক জানান, ইয়াসির আরাফাতের আল ফাতাহর পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের আরেকটি মুক্তিসংগ্রামী সংগঠন যাত্রা করেছে। তারা ইসলামি আদর্শে আস্থাবান এবং আপসকামিতার বিরোধী। হামাসের সমর্থক ছিলেন বাংলাদেশে অধ্যয়নরত ফিলিস্তিনি ছাত্রদের মাঝেও। তাদের একজন সংগঠক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। তার সাথে আলাপে হামাস তথা ফিলিস্তিনের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারি। অন্যদের মতো আমার কাছেও ‘হামাস’ নামটি ছিল একেবারে নতুন। ওই ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থী জানিয়েছিলেন, আসলে এটা হলো সংগঠনটির পুরো নামের সব ক’টি শব্দের আদ্যাক্ষরের সমষ্টি। তখন ঢাকায় হামাসের বাংলা লিফলেট বিভিন্ন স্থানে মসজিদে জুমার নামাজ শেষ হওয়ার পর বিলি হয়েছিল প্রচারকাজের অংশ হিসেবে। হামাস কিন্তু ইয়াসির আরাফাত এবং তার সংগঠনবিরোধী বক্তব্য তখন দিত না। বরং শুধু ইহুদিবাদী আগ্রাসন প্রতিরোধ এবং বায়তুল মুকাদ্দাস উদ্ধারে ইসলামি চেতনার ওপর জোর দেয়া হতো। ১৯৮৮ সালে ফিলিস্তিনে হামাসের তৎপরতা শুরুর কিছু দিনের মধ্যেই ঐতিহাসিক ইনতিফাদার সূচনা হওয়া খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
এর আগের এক দশকে ফিলিস্তিনি মুক্তিসংগ্রামের মূল ধারা অর্থাৎ আরাফাতের ‘ফাতাহ’সহ পিএলও কিছুটা আপসকামী হয়ে পড়েছিল। এর পেছনে বিশেষ ভূমিকা ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। এ দিকে ইসরাইলি দখলদারি ও দমননীতি ছিল অব্যাহত। ফলে ফিলিস্তিনিদের মাঝে ক্ষোভ বাড়ছিল এবং অবিসংবাদিত নেতা ইয়াসির আরাফাতের প্রতি আস্থা হ্রাস পাচ্ছিল। যে কারণেই হোক, পিএলওর মূল সংগঠন ফাতাহর আগের সেই লড়াকু মনোভাব আর ছিল না। আরাফাত রণনীতির বদলে কূটনীতি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। মার্কিন উদ্যোগে ‘শান্তিপ্রয়াস’-এর পরিকল্পিত প্রহসন মঞ্চস্থ হচ্ছিল মাঝে মধ্যে। এই প্রেক্ষাপটে রেডিক্যাল হামাসের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ফিলিস্তিনি জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার এবং ইসরাইলি আগ্রাসন মোকাবেলার প্রশ্নে হামাসের বক্তব্য ছিল একই সাথে বলিষ্ঠ ও ঝুঁকিপূর্ণ। তাদের আবির্ভাবে এই ইঙ্গিত ছিল যে, ভবিষ্যতে ফাতাহ বা পিএলও যেমন ফিলিস্তিনিদের একক প্রতিনিধিত্ব করতে পারবে না, তেমনি আরাফাতের পরবর্তী বা বিকল্প নেতৃত্বও গড়ে উঠতে পারে। কৌশলী আরাফাত হামাসের সাথে প্রত্যক্ষ দ্বন্দ্বে লিপ্ত না হয়ে মোটামুটি সহাবস্থান বজায় রেখেছিলেন।
ফিলিস্তিনের সংগ্রাম : জানা-অজানা কথা
১৯৪৮ সালে ইঙ্গ-মার্কিন ষড়যন্ত্র ও সোভিয়েত মদদে অবৈধ ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্ম ‘মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া’ হিসেবে। এর পরপরই ফিলিস্তিনি তথা আরবদের সাথে ইহুদিদের যুদ্ধ বেধে যায়। এটা ফিলিস্তিনিদের কাছে ‘নাকবা’ নামে পরিচিত। পাশ্চাত্যের চক্রান্তে ইসরাইল এই বিরোধিতা কাটিয়ে উঠে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে থাকে। লাখ লাখ ফিলিস্তিনি হাজার বছরের ভিটেমাটি হারিয়ে আশপাশের দেশে উদ্বাস্তু হতে বাধ্য হয়। পরে ১৯৬৫ সালে গঠিত হয় ফিলিস্তিনি মুক্তি সংস্থা (পিএলও)। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ৩২ বছরের এক প্রকৌশলী, যার ছদ্মনাম আবু ইয়াম্মার। কিছুটা শ্মশ্রুশোভিত, ‘কাফিয়া’ দিয়ে মস্তকাবৃত, ছোটখাটো মানুষটির প্রকৃত নাম ইয়াসির আরাফাত। পিএলও মোর্চায় তার আল ফাতাহর সাথে বামপন্থী একাধিক সংগঠন ছিল। ফাতাহ তখন কিছুটা ইসলামি মনোভাবাপন্ন জাতীয়তাবাদী সংগঠন। পিএলওর গেরিলা তৎপরতার মাঝে ১৯৬৭ সালের জুন মাসে আরব-ইসরাইল যুদ্ধ বাধে। এতে মিসর, জর্ডান ও সিরিয়ার বিশাল ভূখণ্ড ইসরাইল দখল করে নেয়। এমনকি মুসলিম উম্মাহর পয়লা কিবলা বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত ইহুদিদের কুক্ষিগত হয়ে যায়। আরবদের শোচনীয় পরাজয়ের একটা বড় কারণ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের শঠতা। বহুলালোচিত নাসেরের শাসিত মিসর আর বাথ পার্টির শাসিত সিরিয়া তখন সমাজতন্ত্রের নেশায় সোভিয়েত প্রেমে বুঁদ হয়ে ছিল। এসব দেশকে মস্কোর দেয়া সমরাস্ত্র ওই যুদ্ধে অকার্যকর প্রমাণিত হওয়ায় ফিলিস্তিনিসহ আরবদের অনেকের মোহভঙ্গ ঘটে। তারা উপলব্ধি করেন, পুঁজিবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের প্রত্যক্ষ মদদগার, আর সমাজবাদী সোভিয়েত মহারাষ্ট্র ওদের পরোক্ষ দোসর। যুদ্ধের পরাজয় মিসরের প্রেসিডেন্ট নাসেরের আমৃত্যু হতাশা এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদুল হাকিম আমরের আশু আত্মহত্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তখন আরাফাতের আল ফাতাহ সোভিয়েত সমর্থক মহল, তথা বামপন্থীদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখত। ১৯৬৯ সালে ফাতাহ নেতা আবু মুনিরের তদানীন্তন পাকিস্তান সফরকালে সমাজতন্ত্রীদের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কথা অনেকের স্মরণে থাকার কথা। অবশ্য, পরবর্তী দুই দশকে সেই ফাতাহ ও এর নেতা আরাফাত বেশ কিছুটা সেকুলার হয়ে পড়ায় ইসলামপন্থীদের মনে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়। তা ছাড়া, আরাফাতকে ‘উদার’ এবং ইসলামপন্থীদের ‘উগ্রপন্থী’ হিসেবে চিত্রিত করার প্রয়াস দীর্ঘ দিন চলেছিল।
যে ইসরাইল ’৬৭ সালের যুদ্ধে সম্মিলিত আরব সমর শক্তিকে নাস্তানাবুদ করে পশ্চিম তীর, গাজা, সিনাই, গোলান দখল করে নিয়েছিল, ’৮৯ সালের ইনতিফাদা তার মহাউদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ‘ইনতিফাদা’ মানে গণজাগরণ বা গণ-অভ্যুত্থান। নবগঠিত হামাস এর নেপথ্যে বিরাট ভূমিকা রেখেছিল। এটা ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র ভালো করেই জানত। ইনতিফাদা চলতে থাকে বছরের পর বছর। এ অবস্থায় হামাসকে ইসরাইল টার্গেট করে নিধন ও নির্মূল করার জন্য। মোসাদ ও সিআইএ বুঝতে পেরেছিল, অবিলম্বে প্রচণ্ড আঘাত না হানলে উদীয়মান হামাস ভবিষ্যতে অপ্রতিরোধ্য হয়ে দাঁড়াবে। তাই নীলনকশা মোতাবেক এর প্রধান নেতা এবং আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব শায়খ আহমদ ইয়াসিনকে ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে হত্যা করা হয়। আশীতিপর ইয়াসিন ছিলেন চলচ্ছক্তিরহিত। ফজরের নামাজের সময় মসজিদের কাছে তিনি নিহত হন। তার উত্তরসূরি আবদুল আজিজ রানতিসিকে একই বর্বরোচিত পন্থায় হত্যা করা হলো মাত্র এক মাসের ব্যবধানে। এই পটভূমিতে হামাসের জনপ্রিয়তা বেড়ে গেল ফিলিস্তিনিদের মাঝে। অপর দিকে ‘বৃদ্ধ সিংহ’ আরাফাত ক্রমশ নিস্তেজ হওয়া ছাড়াও ‘পাশ্চাত্যপন্থী’ হিসেবে অভিহিত হতে থাকেন। এমনতরো পটভূমিতেই ফিলিস্তিনিদের প্রথমে স্থানীয় সরকার, পরে জাতীয় সরকার নির্বাচনে হামাসের অভাবনীয় সাফল্য এবং এর কিছু পরে হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজায় ইসরাইলের নারকীয় হামলা ও হত্যাযজ্ঞের ঘটনা মূল্যায়ন করতে হবে।
যুদ্ধবিরতি শান্তির গ্যারান্টি নয়
গাজায় তো যুদ্ধবিরতি হলো। সে জন্য সমঝোতা চুক্তি হয়েছে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে। সবাই জানে, গাজায় এবার যেভাবে যুদ্ধ শুরু হলো, তা কোনো বিচ্ছিন্ন বা আকস্মিক কিংবা নতুন ঘটনা নয়। বহু বছরের সঙ্কট ও সঙ্ঘাতের একটি ুদ্র অংশ মাত্র। গোলাগুলি, মিসাইল-মারণাস্ত্রের মহাতাণ্ডব থেমে যাওয়ায় সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। কিন্তু এবারের হামলা-পাল্টাহামলাই কি গাজার শেষ লড়াই কিংবা ইসরাইলের সর্বশেষ আগ্রাসী আক্রমণ? কেউ তা মনে করে না। অতীত অভিজ্ঞতা ইহুদিবাদী শক্তিকে মহাষড়যন্ত্রকারী, শান্তির শত্রু ও ধ্বংসের প্রতীক হিসেবেই চিনতে শেখায়। সেই ইসরাইলের যদি সুমতি হয়, সবার মঙ্গল। আর যদি পালন নয়, লঙ্ঘনের মতলবে যুদ্ধবিরতি চুক্তি করে থাকে, তাহলে গাজাবাসীই শুধু বিপন্ন হবে না, নিজেদেরও বিপদ ডেকে আনবে। এবার একটি আরব ও মুসলিম রাষ্ট্রের ইসলামপন্থী রাষ্ট্রপ্রধানের সমঝোতা-উদ্যোগে সাড়া দেয়ায় ইসরাইলের ব্যাপারে শান্তিকামীদের যতটুকু আশা জেগেছে, তারা এটাকে ধুলায় মিশিয়ে না দিক, সর্বান্তকরণে এটাই আমাদের কামনা।
এ তো গেল আশাবাদের কথা। এর বিপরীতে হতাশার হেতুও কম নয়। গাজায় রসায়নশাস্ত্রের Chain Reaction- এর মতো ধারাবাহিকভাবে (যদিও মাঝে বিরতি থাকে) ‘ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া-পাল্টা প্রতিক্রিয়াÑ আবার প্রতিক্রিয়া-পুনরায় প্রতিক্রিয়া’, এসব ঘটতে থাকে দুই পক্ষের মাঝে। বছরের পর বছর এভাবে চলে আসছে। ইসরাইলের প্রখ্যাত শান্তিবাদী পার্লামেন্টারিয়ান ও আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত কলামিস্ট উরি আভনারি ওই বিষয়টি তুলে ধরে এবার তার কলাম শুরু করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, এবার যে বড় ঘটনার পর গাজা সীমান্ত বেশি তপ্ত হয়েছে, হামাস কমান্ডার আহমদ জাবারির সেই হত্যাকাণ্ড হঠাৎ ঘটেনি। ইসরাইল তাকে টার্গেট করেছিল আগেই। তার মতো দক্ষ ও চৌকস সেনানায়ককে খুনের জন্য যাবতীয় গোয়েন্দা তথ্য জোগাড় করে হত্যার সুযোগের অপেক্ষায় ছিল ইসরাইল।
একজন ইহুদি হয়েও উরি আভনারি তীব্র সমালোচনা করলেন গাজায় ইসরাইলি অপারেশন পিলার অব কাউড (মেঘের স্তম্ভ)-এর। হামাস প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘The real remedy is peace. Peace with the Palestinian people. Hamas has already solemnly declared that it would respect a peace agreement concluded by the PLO¾ i.e. Mahmud Abbas¾ that would establish a Palestinian state along with 1967 borders, provided this agreement were confirmed in a Palestinian referendum. Without it, the bloodletting will just go on, round after round forever.’ (এ সঙ্কটের প্রকৃত প্রতিকার শান্তির মাঝে নিহিত। সে শান্তি ফিলিস্তিনি জনগণের ক্ষেত্রে। হামাস ইতোমধ্যেই গুরুত্বের সাথে ঘোষণা করেছে, তারা পিএলওÑ উদাহরণস্বরূপ মাহমুদ আব্বাস কর্তৃক সম্পাদিত শান্তিচুক্তির প্রতি সম্মান জানাবে, যার মাধ্যমে ১৯৬৭ সালের সীমান্ত বরাবর ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে। শর্ত হলো, ফিলিস্তিনিরা গণভোটে এর অনুমোদন দেবে। এটা ছাড়া শুধু রক্তপাতই অব্যাহত থাকবে, এক পালার পর অন্য পালা। এভাবে চিরদিন।
সবই শান্তি চায় ফিলিস্তিনে। এই ইস্যু শুধু মধ্যপ্রাচ্যে নয়, আধুনিক বিশ্বে অশান্তির সবচেয়ে বড় কারণ এবং বিদ্যমান আন্তর্জাতিক সঙ্কটগুলোর মধ্যে সর্বাধিক দীর্ঘস্থায়ী। বাস্তবতা হলো, ইসরাইল না চাইলে শান্তি আসবে না। গাজায় একের পর এক খোঁড়া অজুহাতে সর্বাত্মক আগ্রাসন এবং নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসতাণ্ডব চালিয়ে কি শান্তি কামনার প্রমাণ দেয়া যায়? ইসরাইলের মানবাধিকার সংগ্রামী উরি আভনারির প্রশ্ন : শান্তিই সঙ্কটের সমাধান। কিন্তু ‘মেঘের স্তম্ভ’ অপারেশনের মেঘ দৃষ্টিশক্তি ঢেকে দিলে কেউ কি শান্তির পথটি দেখতে পাবে?

দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানেই শান্তি নিহিত



ইসরায়েল-ফিলিস্তিন
 হারলেম ব্রান্ডল্যান্ড জিমি কার্টার
সম্প্রতি ইসরায়েলে পরিচালিত রকেট হামলা ও গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলার ঘটনায় পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, মধ্যপ্রাচ্যে বিরাজমান পরিস্থিতি ইসরায়েল বা ফিলিস্তিন কারও জন্যই মঙ্গল বয়ে আনবে না। বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে আলোচনা শুরু হওয়ার সম্ভাবনাও তেমন নেই বললেই চলে। বর্তমান পরিস্থিতির মোড় ঘোরানোর জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করার প্রয়োজন পড়বে। আমরা প্রবীণরা মনে করি, জাতিসংঘে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতির উদ্যোগের মুহূর্তটি সে ধরনের একটি সুযোগ। ২৯ নভেম্বর জাতিসংঘে ফিলিস্তিনকে 'অসদস্য পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র মর্যাদা'দানের ওপর ভোটাভুটি হবে। এতে ফিলিস্তিনের সত্তার পর্যায় থেকে মর্যাদা উচ্চমাত্রায় লক্ষণীয়ভাবে উন্নীত হবে। আমরা এর পক্ষে ভোট দেওয়ার জন্য প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানাই।
জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে গিয়ে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস নিশ্চয়ই কোনো প্ররোচনামূলক বক্তব্য দেবেন না। তিনি বিশ্বাস বা আস্থা নষ্ট হওয়ার মতো কিছু করা থেকে যেমন বিরত থাকবেন, তেমনি প্রত্যাশা অনুযায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা থেকে সরে আসবেন না।
এই ভোট অবশ্যই আইনের শাসন ও মানবাধিকারের পক্ষে। টেকসই ও ইসরায়েলের প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতির পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও বাদবাকি বিশ্বের যে দশকের পর দশক ধরে অঙ্গীকার তার সঙ্গে এটা পুরোপুরি সাযুজ্যপূর্ণ। এটা জাতিসংঘের অতীতে নেওয়া প্রস্তাবগুলো ও আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ একটি আইনসম্মত, শান্তিপূর্ণ ও কূটনৈতিক উদ্যোগ। যদিও এটা স্পর্শকাতর ভোট, তবুও অনেক রাষ্ট্র এ সময় হয় অনুপস্থিত থাকতে পারে অথবা বিরুদ্ধে ভোট প্রদান করতে পারে। আর এই প্রস্তাব যদি ভোটে হেরে যায়, তাহলে দুই রাষ্ট্র তত্ত্বের মৃত্যু হবে এবং তখন আমরা এক রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের দিকে ধাবিত হবো। আর এটা হবে একটা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত পরিস্থিতি এবং এর ফলে ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি উভয়ের জন্যই বিপর্যয়কর পরিণতি বয়ে আনবে।
এক রাষ্ট্র ফলাফলের পরিণতি কেমন হতে পারে তা আমরা অনুমান করে নিতে পারি। এর একটা অর্থ হতে পারে, ইসরায়েল পুরো পশ্চিম তীর দখল করে ফিলিস্তিনিদের ইসরায়েলিদের সমান ভোটাধিকার প্রদান করবে। তখন তো ইসরায়েলিরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হবে। অথবা এমন হতে পারে যে, ইসরায়েলিরা ফিলিস্তিনিদের সমানাধিকার দিল না। এ ধরনের একটা পরিস্থিতি ফিলিস্তিন বা ইহুদি জনগোষ্ঠী কারও কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে না এবং বিশেষ করে ফিলিস্তিনিদের জন্য মর্যাদাকরও হবে না। এতে কোনো পক্ষেরই নিরাপদ নিজ আবাসভূমির স্বপ্ন পূরণ হবে না। বিশেষ করে ইহুদি জনগোষ্ঠীর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে না।
অন্যদিকে, জাতিসংঘে ফিলিস্তিনিকে রাষ্ট্র মর্যাদাদানের পক্ষে ভোট দিয়ে একে জয়যুক্ত করলে বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ এবং এমনকি সাধারণ ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিরাও সমস্বরে একে স্বাগত জানাবে। দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানই হলো মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার নিশ্চিত পথ। মাস দুই আগে আমরা একত্রে পূর্ব জেরুজালেমের জলপাই পাহাড়ে ওগস্তা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হাসপাতালের মাঠে দাঁড়িয়েছিলাম। এই মেডিকেলটি ফিলিস্তিনিদের একটি চমৎকার ক্যান্সার চিকিৎসা কেন্দ্র এবং এটি পশ্চিম তীর থেকে কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত। তবে এই হাসপাতালে ফিলিস্তিনিদের চিকিৎসা সেবা নিতে হলে ইসরায়েলিদের কাছ থেকে ছাড়পত্র নিতে হয়।
আমরা হাসপাতালের ওই এলাকা থেকে পশ্চিম তীরজুড়ে ইহুদি বসতি ও ইসরায়েলের স্থাপিত তারের বেড়া দেখতে পেলাম। এখানে-ওখানে উঁচু উঁচু দেয়াল ও সড়ক বসতিগুলোকে ফিলিস্তিনিদের থেকে পৃথক করে রেখেছে। এভাইে আরব-ইসরায়েলিদের মধ্যে পার্থক্য রেখা টানা ক্রমবর্ধমানভাবেই চলছে। পূর্ব জেরুজালেম ও পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি বিস্তারের হার হতবুদ্ধিকর। ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে ৫ লাখের মতো ইহুদি ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে বসতি গড়ে তুলেছে। ১৯৯৩ সালে অসলো শান্তি চুক্তি হওয়ার পর এ ধরনের ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। আরও হাজার হাজার বসতবাড়ি নির্মাণ করা হচ্ছে বা নির্মাণ পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে। অসলো শান্তি প্রক্রিয়া শুধু স্থবিরই হয়ে পড়েনি, এর পশ্চাৎমুখী যাত্রা দ্রুততর হচ্ছে। প্রতিটি ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীর আবাস গড়ার জন্য এক একটি ফিলিস্তিনি পরিবারকে তাদের নিজেদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ ও ওই বাড়িঘর বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিতে হয়েছে। এভাবে ফিলিস্তিনিদের যে ভূখণ্ড দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল বা যে অংশ নিয়ে ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা ছিল সেটা এখন আর একই অবস্থায় নেই।
জাতিসংঘ প্রস্তাবের পক্ষে ২৯ নভেম্বর ভোট প্রদান করার মাধ্যমে দুই রাষ্ট্র ব্যবস্থার পক্ষে একটা রক্ষাকবচ তৈরি হতে পারে এবং এর ফলে আলোচনার দরজাও খুলবে। আমরা আরও আশা করি, ফিলিস্তিনের ওপর অর্থনৈতিক শাস্তিমূলক যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে সেগুলো তুলে নেওয়া হবে এই পদক্ষেপকে ফলপ্রসূ করার স্বার্থেই। কেউ কেউ ভোট বিলম্বিত করার কথা বলেছেন। কিন্তু এতে কোনো সুফল অর্জিত হবে না।
ফিলিস্তিনিদের মধ্যে বিরাজমান হতাশা ও ইসরায়েলদের মধ্যে ক্লান্তির যে ছায়া রয়েছে তাকে দূর করতে হলে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেই এগিয়ে আসতে হবে। আমরা জানি, অনেক ইসরায়েলি আমাদের মতো একই মনোভাব পোষণ করেন। তারাও চান দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান। এর মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে বলে আমাদের মতো তারাও মনে করেন। আর এটা ইসরায়েলের মৌলিক স্বার্থের পক্ষেও বটে। আমরা যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, আরব রাষ্ট্রগুলোকে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানকে কার্যকর করার জন্য একযোগে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাই।

লেখকদ্বয় : হারলেম ব্রান্ডল্যান্ড অসলো শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের সময় নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং জিমি কার্টার ১৯৭৮ সালে ক্যাম্পডেভিড চুক্তি ও ১৯৭৯ সালে মিসর-ইসরায়েল শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। খালিজ টাইমস থেকে ভাষান্তর সুভাষ সাহা

শুক্রবার, ৬ জুলাই, ২০১২

রোহিঙ্গা সমস্যা : বাস্তবতা ও করণীয়



॥ ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী ॥

আরাকানের আদি নৃগোষ্ঠীর নাম রোহিঙ্গা। এরা ধর্ম বিশ্বাসে মুসলমান। আরাকান বর্তমান মিয়ানমারের বাংলাদেশসংলগ্ন একটি অঞ্চল। এ হিসাবে মিয়ানমার দক্ষিণ-পূর্বাংশের কক্সবাজার জেলার সীমান্তঘেঁষা আমাদের প্রতিবেশী দেশ। আরাকানে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ইতিহাস অতি প্রাচীন। চট্টগ্রামকে বলা হয়, এই ভূখণ্ডে ইসলামের প্রবেশদ্বার। ঐতিহাসিকেরা বলেছেন, খোলাফায়ে রাশেদিনের যুগে চট্টগ্রাম বন্দরে আরব বণিকদের যাতায়াত সূত্রে এখানে ইসলামের প্রচার ঘটে। তখন থেকে আরাকানও ইসলামের ছায়ায় আশ্রয় নেয়।
সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের আগ্রাসনের আগে আরাকানের রাজসভা ছিল বাংলাভাষার চর্চা ও উৎকর্ষতার প্রাণকেন্দ্র। মহাকবি আলাওল, সৈয়দ সুলতান শাহ মুহাম্মদ ছগীর প্রমুখ আরাকান রাজসভাকে কেন্দ্র করে সাহিত্যচর্চা করেন। পদ্মাবতীসহ মধ্যযুগের পুঁথিসাহিত্যের লালনভূমি ছিল আরাকান।
বার্মা ও উপমহাদেশ যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশদের দখলমুক্ত হয়, তখন আরাকান বার্মার সাথে যুক্ত হয়। আরাকান সীমান্তের নাফ নদীর এপারের কক্সবাজার ও টেকনাফ অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত হয় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও বর্তমান বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে। আইয়ুব আমলে পাকিস্তানি শাসকদের ভুল নীতির কারণে বার্মা ও পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তে সব সময় গোলযোগ লেগে থাকত। ফলে অবিশ্বাস ও অশান্তি বলবৎ থাকত দুই দেশের সীমান্তজুড়ে। এর প্রভাব পড়তে থাকে আরাকানের মুসলিম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর। 
রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি আরাকানের সংখ্যালঘু বৌদ্ধদের সাধারণ পরিচয় মগ। স্থানীয় ভাষায় রাখাইন, বার্মা সরকার আরাকানকে রোহিঙ্গামুক্ত করার পলিসি নেয়। রাখাইনেরা সেই পলিসির কারণে মুসলমানদের ওপর যখন-তখন হামলা চালায়। যখন ইচ্ছা ধান-চাল, গরু-ছাগল ছিনিয়ে নেয়। পান থেকে চুন খসলে মারধর করে। বাড়িতে আগুন দেয়। ক্রমেই তাদের নাগরিক অধিকার কেড়ে নেয়া হয়। হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী নৃগোষ্ঠীকে এভাবে অবাঞ্ছিত একটি জনগোষ্ঠীতে পরিণত করা হয়। এমনকি আরাকানের ঐতিহাসিক নামটিও বদলে দিয়ে রাখাইন অঞ্চল রাখা হয়। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার হয়ে টেকনাফগামী মহাসড়কটির নাম আরাকান রোড। জাপান-ব্রিটিশ যুদ্ধের সময় ব্রিটিশেরা বার্মার রণাঙ্গনে যাওয়ার জন্য এটি নির্মাণ করেছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ-বার্মা সীমান্তে বৈরিতা বা অশান্তির অবসান হলেও রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়নের মাত্রা বিন্দুমাত্র কমেনি; বরং বেড়েছে। আশির দশকের শুরুতে রাখাইনদের অত্যাচারে নিপীড়িত মুসলমানেরা বাংলাদেশে শরণার্থী হয়েছিল। তাদের অসহায়ত্বের প্রতি সহানুভূতিশীল সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো দেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়। কিংবা বাংলাদেশি পরিচয়ে চোরাইপথে তারা বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমায়।
১৯৯২ সালে আরেকবার নিপীড়নের শিকার হয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। তখন জাতিসঙ্ঘ শরণার্থী কমিশনসহ অনেক দেশ ত্রাণ তৎপরতা নিয়ে এগিয়ে আসে। কিন্তু তাতে রোহিঙ্গাদের দুর্দশার এতটুকুন সুরাহা হয়নি। সরকারি হিসাব মতে এখনো ৩০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশ ভূখণ্ডে রয়ে গেছে। বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা দুইলাখের ওপর।
২০১২ সালের জুন মাসের শুরুতে একটি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাখাইনরা রোহিঙ্গাদের ওপর দলবদ্ধ হামলা, লুটপাট ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ চালাতে থাকে। ফলে প্রাণভয়ে রোহিঙ্গারা নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করে। কিন্তু বাংলাদেশে সীমান্তরক্ষীরা তাদেরকে ঢুকতে বাধা দেয় এবং অনেককে পুশব্যাক করে। এ ঘটনার প্রেক্ষাপটে জাতিসঙ্ঘ আর জাতিসঙ্ঘের মুরব্বি আমেরিকা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি জোরালো অনুরোধ করে, যাতে রোহিঙ্গাদের আসার জন্য বাংলাদেশের সীমান্ত খুলে দেয়া হয়।
আমাদের প্রশ্নÑ আরাকানে বা রাখাইন অঞ্চলে রোহিঙ্গা নৃগোষ্ঠীর ওপর যুগ যুগ ধরে যে বৈষম্য, বর্ণবাদ ও নির্যাতন চলছে, জাতিসঙ্ঘ তার প্রতিকারের জন্য কী পদক্ষেপ নিয়েছে? বিগত দিনগুলোতে যে ৩০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে এবং জাতিসঙ্ঘ রিলিফ দিয়ে যাচ্ছে, তাদেরকে নিজের ভিটেমাটিতে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য কী ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে? জবাব হলোÑ তেমন কিছুই করেনি। তা হলে আরাকানে নতুন করে সঙ্কট শুরু হওয়ার সাথে সাথে যেখানে মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা যৌক্তিক ছিল, সে কাজটি না করে বাংলাদেশের দুয়ার খুলে শরণার্থীদের গ্রহণ করার জন্য চাপ সৃষ্টির পেছনে কী মতলব থাকতে পারে?
জাতিসঙ্ঘ ও আমেরিকা আফগানিস্তান, ইরাক, ফিলিস্তিন ও বিশ্বের দিকে দিকে মজলুম মুসলমানদের সাথে কী ধরনের আচরণ করেছে ও করছে, তা দুনিয়ার সবাই জানে। এমতাবস্থায় অত্যাচার বন্ধ করতে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির পরিবর্তে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে নিয়ে আসার জন্য তাদের এত দরদ দেখে মনে সন্দেহ সৃষ্টি হওয়া একান্তই স্বাভাবিক।
আমরা দিব্য দেখতে পাচ্ছি, রাখাইনরা এবং মিয়ানমারের শাসকগোষ্ঠী যেমন অত্যাচার-নিপীড়নের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দিয়ে বা হত্যা করে আরাকানকে মুসলিমশূন্য করতে চায়, তেমনি জাতিসঙ্ঘ ও পশ্চিমা দরদি দেশগুলোও রোহিঙ্গাদের নিজেদের পৈতৃক ভিটামাটি থেকে বের করে আনার কৌশল অবলম্বন করেছে। সেই কৌশল হচ্ছেÑ জনসংখ্যার ভারে জর্জরিত বাংলাদেশের ওপর শরণার্থী গ্রহণের জন্য চাপ সৃষ্টি আর রোহিঙ্গাদের অন্তত জাতিসঙ্ঘের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় লাভ এবং পরবর্তী সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের সোনার হরিণ ও অন্যান্য দেশে আশ্রয় নেয়ার প্রলোভন দেয়া। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ দেখে যে কেউ এই বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারবেন। 
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের সর্বোত্তম ও একমাত্র পথ হচ্ছেÑ রোহিঙ্গাদের তাদের পৈতৃক ভিটেমাটিতে নাগরিক মর্যাদা নিয়ে শান্তিতে থাকার ব্যবস্থা করা। এই ব্যবস্থার জন্য এ পর্যন্ত প্রমাণিত হয়েছে যে, বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়া মোটেও নিরাপদ নয়। কারণ, যারা শরণার্থী হয়ে আসে তাদেরকে আর ফেরত নেয়া হয় না, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সে ব্যবস্থা করে না। ফল দাঁড়ায়, এরা নিজের ভিটেমাটি থেকে চিরতরে উৎখাত হয়ে যায়। এখানে বাংলাদেশেও চলতে থাকে শরণার্থীদের নিগৃহীত জীবন। তা ছাড়া বাংলাদেশের আশ্রয় দেয়ার মতো অতিরিক্ত ভূমি ও সামর্থ্য নেই। আরো অধিক শরণার্থীর অনুপ্রবেশ ঘটলে যখন অভাব-অনটন ও চুরি-ডাকাতি বেড়ে যাওয়ার মতো সামাজিক সমস্যা দেখা দেবে, তখন তা সামাল দেয়া কারো পক্ষে সম্ভব হবে না। যদি সৌদি আরব বা অন্য দেশে তাদের পুনর্বাসন করা হয়, তাহলে তো সেই লোভে আরাকান মুসলিমশূন্য হয়ে যাবে, যা মিয়ানমার সরকার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একান্তভাবেই কামনা করে। 
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের আরেকটি পথ চিন্তা করা যেতে পারে আরাকানকে স্বাধীন করে স্বাধীন মুসলিম দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। আমাদের মধ্যে যারা যুক্তি ও বাস্তবতার চেয়ে ভাবাবেগেতাড়িত, তারা এমন স্লোগান শুনলে প্রীত হন, মনে আনন্দ পান। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছেÑ আরাকানকে অদূর ভবিষ্যতে স্বাধীন করা সম্ভব নয়। এর মূল কারণ, স্বয়ং আরাকানের ভেতরকার রোহিঙ্গা মুসলমানেরা স্বাধীনতা চায় না। যাদের স্বাধীনতা দরকার; তারাই যদি না চায় তাহলে বাইরে থেকে জিহাদ করে অন্যদের দিয়ে স্বাধীনতা কায়েম করে দেয়া অসম্ভব। বাইরের ইসলামি জজবাধারী নেতারা এ বাস্তবতাটি বুঝতে না পারার কারণে আরাকানে মুসলমানদের যথেষ্ট ক্ষতি হয়ে গেছে। পাকিস্তান আমলে জাফর কাওয়ালের নেতৃত্বাধীন আরাকানি গেরিলাদের কোন উদ্দেশ্যে প্রশ্রয় দেয়া হয়েছিল, চিন্তা করলে কারণ খুঁজে পাই না। কারণ আমার মনে হয়, এ যাবৎকাল যারা আরাকানকে স্বাধীন করার কথা বলেছেন, তারা দাবি করে বলতে পারবেন না যে, আরাকানের ভেতরকার মুসলিম নেতা বা প্রভাবশালী মহলের এরা কখনো সমর্থন ও সহযোগিতা পেয়েছেন। দ্বিতীয় কারণ ঐতিহাসিক ও খানিকটা তিক্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যে মুহূর্তে মিয়ানমার ও ভারতবর্ষ ছেড়ে ব্রিটিশরা চলে যাবে, তখন বার্মায় প্রচণ্ড সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধে। যেমনটি উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার রূপ নিয়েছিল। বার্মার দাঙ্গা ছিল মগ ও মুসলমানদের মধ্যে। তখন আরাকানের স্থায়ী বাসিন্দা বা রোহিঙ্গারা মগদের দ্বারা প্রতারিত হয়ে বহিরাগতদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। বহিরাগত বলতে চট্টগ্রাম ও পুরো বাংলাদেশ থেকে যাওয়া মুসলমানদের বোঝানো হতো। কারণ চট্টগ্রাম ও বাংলাদেশের মুসলমানরা তখন ভাগ্য বদলের জন্য বার্মায় যেত। সেখানকার ব্যবসায়, বাণিজ্য, সাহিত্য, সংস্কৃতি, মসজিদ, খানকা প্রভৃতি সব কিছুর ওপর বাংলাদেশের বিশেষ করে চট্টগ্রামের লোকদের প্রভাব ছিল। 
সে সময়কার বহিরাগত খেদাও আন্দোলনের এসব রূঢ় বাস্তবতা যাচাইয়ের জন্য ইতিহাসের বই পুস্তক খোঁজার দরকার নেই। চট্টগ্রামের ঘরে ঘরে বয়স্ক লোকদের জিজ্ঞাসাবাদ করলেই এর সত্যতা পাওয়া যাবে।
এই রূঢ় বাস্তবতাকে বিবেচনায় না নিয়ে যারা আরাকানের স্বাধীনতার স্লোগান দেয়, তারা প্রকারান্তরে রোহিঙ্গা মুসলমান ভাইদের ক্ষতিই করে। কারণ, তাতে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন চালানোর অজুহাত খুঁজে পায়।
সবচেয়ে বড় কারণটি হলো, আরাকানকে সাহায্য করার শক্তি আপাতত কারো নেই। এক সাংবাদিক বন্ধু বললেন, ১৯৯২ সালে রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা নিয়ে আমি অনেক ঘোরাঘুরি করেছি। একপর্যায়ে ডা: ইউনুচের ও জনাব শাব্বিরের নেতৃত্বাধীন দু’টি পৃথক রোহিঙ্গা সংহতি আন্দোলনের নেতাদের সাক্ষাৎকার নেয়ার সুযোগ পাই। তাদের বলিষ্ঠ কণ্ঠের দাবি ছিল, আমরা আরাকানকে স্বাধীন করতে চাই। বলেছিলেন তাদের হাতে নাকি সশস্ত্র যোদ্ধা আছে। পরিসংখ্যান জিজ্ঞাসা করলে একপর্যায়ে জানা গেল ডা: ইউনুচের সশস্ত্র যোদ্ধার সংখ্যা দুই হাজার আর শাব্বির সাহেবের দাবি তাদের ৪০০ যোদ্ধা আছে। দুই হাজার বা ৪০০ যোদ্ধার বিশাল বাহিনী নিয়ে মিয়ানমারের নাসাকা বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে কিভাবে জয়ী হবে তার কোনো সদুত্তর তাদের কাছে ছিল না। বিদেশ থেকে কিভাবে অস্ত্রের জোগান আসবে এবং বাংলাদেশ সরকারের সমর্থন না থাকলে কক্সবাজার বা টেকনাফে অস্ত্রের সেই চালান কিভাবে খালাস করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশের ভূমি কিভাবে ব্যবহার করবে সেসব প্রশ্নেরও কোনো জবাব দিতে পারেননি রোহিঙ্গা নেতারা। এর পরও তাদের কাছে যুদ্ধ মহড়া বা অভিযান পরিচালনার ভঙ্গিতে রঙিন ছবি ছিল। জানা যায়, এসব ছবি কোনো গহিন বনে মহড়া দিয়ে তোলা হয়েছে, আর আরাকানের স্বাধীনতার প্রতি সহানুভূতিশীল মধ্যপ্রাচ্যের অর্থশালীদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহে ব্যবহার করা হচ্ছে। এই ছবিগুলো মিয়ানমার সরকারের হাতে গিয়ে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন বাড়ানোর কারণ ঘটাচ্ছে কি না, সে জবাব অপরিণামদর্শী নেতাদের কাছে থাকতে পারে না।
তাহলে রোহিঙ্গাদের বেলায় আমাদের দায়িত্ব কী বা করণীয় কী থাকতে পারে? এর জন্য বিনয়ের সাথে অনুরোধ করব, মুসলমান ভাই হিসেবে রোহিঙ্গাদের জন্য যাদের মন কাঁদে, বিশেষ করে যেসব রোহিঙ্গা মুসলমান ইতোমধ্যে বাংলাদেশ, মধ্যপ্রাচ্য বা বহির্বিশ্বে রয়েছেন তাদেরকে নির্মোহ ও আবেগবর্জিত হয়ে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। আন্তর্জাতিক চক্রান্তের কলাকৌশল বোঝার চেষ্টা করতে হবে। প্রথমে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে যে, আপাতত আরাকানকে বা রোহিঙ্গাদের স্বাধীন করা সম্ভব নয়। তাদেরকে যেভাবেই হোক আরাকানের মাটি কাঁমড়ে থাকতে হবে বা সেখানেই তাদেরকে প্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য নানাভাবে চেষ্টা ও সহায়তা দিতে হবে।
এই সহায়তার প্রথমটি হতে পারে শিক্ষা, রোহিঙ্গাদের স্বতন্ত্র জাতীয় চেতনা ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের স্বার্থে অবশ্যই তাদেরকে ইসলামিয়াত বা ধর্মীয় শিক্ষা দিতে হবে। এর জন্য ব্যাপক আকারে বড় বড় মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন নেই। মসজিদভিত্তিক কুরআন ও মাসয়ালা শিক্ষাই যথেষ্ট। সীমিতসংখ্যক উচ্চতর ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে এগুলোর তত্ত্বাবধান ও শিক্ষক জোগান দেয়া সম্ভব। ঈমান, আমল বা ধর্মকর্ম সম্পর্কে এই প্রাথমিক জ্ঞানই বৈরী পরিবেশে তাদের ধর্মীয় চেতনা উজ্জীবিত রাখার জন্য যথেষ্ট হবে।
ধর্মীয় শিক্ষার মতোই গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সাধারণ শিক্ষা, অর্থাৎ মিয়ানমার সরকার জনসাধারণের জন্য যে শিক্ষাব্যবস্থা চালু রেখেছে, তা আয়ত্ত করার জন্য ছেলেমেয়েদের উৎসাহী করতে হবে। কেননা, সে দেশে প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য এটি প্রধান অবলম্বন। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা বর্জন করে কোনো সমাজের নাগরিকেরা প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে না। এই শিক্ষা হাসিলের ক্ষেত্রে বাধা থাকলে সেটি অতিক্রম করার জন্য দেশের ভেতরে ও বাইরে থেকে আন্দোলন চালাতে হবে।
মসজিদ, মাদরাসাভিত্তিক ধর্মীয় শিক্ষা এবং স্কুল-কলেজের সাধারণ শিক্ষার মতোই গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কারিগরি শিক্ষা। কোনো দেশে সংখ্যালঘু হয়ে মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে হলে তরুণ সমাজকে যতখানি সম্ভব কারিগরি বা হাতের কাজ শেখানোর বিকল্প নেই।
বাংলাদেশে একটি এলাকা আছে, ছোটবেলা থেকে তরুণেরা বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। ফলে যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা থাকতেও তারা লেখাপড়া করতে পারে না। কী কাজ করেন, জিজ্ঞাসা করলে জবাব দেয় বিদেশ যাওয়ার চিন্তায় আছি। তার মানে বেকার। অথচ বিদেশে গিয়ে যেভাবে গতর খাটে, তার অর্ধেক শ্রম, মেধা ও চেষ্টা কাজে লাগালে দেশে সোনা ফলানো সম্ভব হতো। এর মাধ্যমে যে কথাটি বোঝানোর উদ্দেশ্য তা হচ্ছেÑ যতক্ষণ কোনো একটি লক্ষ্যকে জাতীয় জাগরণের মাধ্যমে সহজ করা না হয়, ততক্ষণ সে লক্ষ্য অর্জিত হয় না। রোহিঙ্গা ভাইদেরও আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য নিজের সাধ ও সাধ্যের মধ্যে লক্ষ্য ঠিক করতে হবে। যেভাবেই হোক, নিজের মাটিতে নিজের পায়ে দাঁড়ানোই হবে সেই লক্ষ্য।
কোনো ইসলামি ভূখণ্ডে শত্রুর আক্রমণ হলে বা শত্রুর কোনো ভূখণ্ড জয় করার জন্য জিহাদ করার সওয়াব ও গুরুত্ব সবাই স্বীকার করেন। এ পথে লড়াই করে প্রাণ ত্যাগ করলে শহীদ হবে এবং তা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ হিসেবে গণ্য হবে। যারা আরাকানকে স্বাধীন করার জিহাদে উজ্জীবিত তাদেরকেও ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করার পরামর্শ দিতে চাই যে, যুদ্ধ করে আরাকান জয় করার চিন্তার চেয়ে যারা আরাকানের ভেতরে হাজার বছর ধরে বসবাস করছেন, তাদেরকে সেখানে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ করে দেয়া কী কম জিহাদ। নিজের ভিটেমাটি রক্ষার জন্য যদি নির্যাতন সইতে হয়, এমনকি নিহতও হতে হয়, তা তো আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ ও শাহাদাত হিসেবে গণ্য হবে। এর পরিবর্তে নিজের অবস্থান শত্রুর জন্য ছেড়ে দিয়ে আত্মরক্ষা করার মধ্যে তো কোনো কৃতিত্ব নেই এবং ভবিষ্যৎও তো সম্পূর্ণ অন্ধকার।
এই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধে অন্য যে বিষয়টির দিকে রোহিঙ্গা মুসলিম ভাইদের সাথে সংহতি প্রকাশকারী সচেতন মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই তা হলোÑ একটি রোহিঙ্গা সংহতি তথ্য ব্যাংক প্রতিষ্ঠা। আরাকানের ভেতরে কী চলছে, মুসলমানদের প্রকৃত অবস্থা কীÑ তা আমরা বলতে গেলে সঠিক জানি না। ফলে এই লেখাও লিখছি কিছু তথ্য ও কিছু অনুমানের ওপর নির্ভর করে। ইন্টারনেটের যুগে এ জাতীয় একটি তথ্য ব্যাংক প্রতিষ্ঠা হলে সেটিই হবে রোহিঙ্গা মুসলমানদের প্রতি সংহতি প্রকাশের সর্বোত্তম পন্থা। কারণ, বর্তমান যুগের যুদ্ধাস্ত্রের চেয়ে প্রচার বা মিডিয়াই অধিক কার্যকর। রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর কী ধরনের বৈষম্য, নিগ্রহ ও অত্যাচার চলছে, তা মিডিয়ার সাহায্যে দুনিয়ার মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে। তখন বাইরে থেকে কিভাবে তাদেরকে মিয়ানমারে নাগরিক অধিকার নিয়ে থাকার ব্যবস্থা করা যায়, সে পথ বেরিয়ে আসবে। সচেতন লোকেরা তখন তাদের প্রতি সংহতি জানিয়ে মিছিল, মিটিং, আলোচনা সভা ও লেখালেখির মাধ্যমে বিশ্বজনমত গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারবে। ইসলামি দেশগুলো ওআইসি ও জাতিসঙ্ঘকেও এ ব্যাপারে কার্যকর ভূমিকা রাখতে চাপ দেয়া সহজ হবে। আমার মতে, বর্তমান সময়ে রোহিঙ্গা মজলুম মুসলমান ভাইদের প্রতি সংহতি প্রকাশ ও সাহায্য পৌঁছানোর এটিই কার্যকর পথ। এর পরিবর্তে এমন কোনো ফাঁদে পা দেয়া উচিত হবে না, যা মিয়ানমার সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের স্বদেশ ভূমি থেকে উচ্ছেদ ও সাম্রাজ্যবাদীদের পরিকল্পনা মাফিক তাদের শরণার্থীতে পরিণত করাকে উৎসাহিত করবে। 
২৬-০৬-২০১২
isashahedi@gmail.com

সেই ফাঁসি, সেই ব্রাদারহুড ও আজকের প্রেসিডেন্ট মুরসি



 এমএ বার্ণিক  
বি শ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ মিসরে ড. মুহম্মদ মুরসি প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। গণ-আন্দোলনের মুখে স্বৈরশাসক হোসনি মোবারককে উত্খাতের ১৮ মাসের মাথায় মুসলিম ব্রাদারহুডের এই নেতা সেদেশে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্ট। কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ১৯৭৫ সালে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইডি ডিগ্রি অর্জন করেন। নির্বাচিত হয়েই তিনি ঘোষণা দেন, ‘আমি মিসরের মুসলিম, খ্রিস্টান, নারী, পুরুষ, তরুণদের প্রেসিডেন্ট। মর্যাদার সঙ্গে বসবাস, স্বাধীনতা ও সামাজিক বিচারের জন্য আজ মিসরে ঐক্যের বড় প্রয়োজন।’ ড. মুহম্মদ মুরসি’র এ ভাষণে ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-নির্বিশেষে নিরপেক্ষ থাকার মানসিকতা ফুটে উঠেছে। মুসলিম ব্রাদারহুড ইসলাম ধর্মের যে মর্মবাণী ধারণ করে গড়ে উঠেছে, মুরসি’র ঘোষণার মধ্যে তারই প্রতিফলন ঘটেছে।
ড. মুহম্মদ মুরসি’র বিজয়ের মধ্য দিয়ে তদসম্পর্ক এবং মুসলিম ব্রাদারহুড সম্পর্কে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। প্রথমে ব্যক্তি-মুরসি সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। মিসরের নাইল ডেল্টা (নীল ব-দ্বীপ) প্রদেশের এক গ্রামে মুহম্মদ মুরসি জন্মগ্রহণ করেন। মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতৃত্বে ব্যাপক জনসমর্থনে হোসনি মোবারকের পতনের পর গঠিত দল ‘ফ্রিডম এন্ড জাস্টিস’ পার্টির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি। গত ১৬ ও ১৭ জুন ২০১২ তারিখে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দ্বিতীয় দফা ভোটে ৫৭ দশমিক ৭৩ শতাংশ ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন  তিনি। তদপূর্বে মে মাসে অনুষ্ঠিত প্রথম দফা ভোটে ২৪ শতাংশ ভোট পান তিনি। বর্তমানে ৬০ বছর বয়সী ড. মুহম্মদ মুরসি ৪ সন্তানের জনক। ইতোপূর্বে তিনি মিসরের জাগজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল বিভাগের প্রধান ছিলেন। ২০০০ সালে প্রথম পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। গত বছর হোসনি মোবারকের পতনের পর তিনি মুসলিম ব্রাদারহুডের মুখপাত্র নির্বাচিত হন। ২০১২ সালের ৩০ জুন ড. মুহম্মদ মুরসি মিসরের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।
ইংরেজি ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’ (Muslim Brotherhood) নামটি মিসরবাসী আরবিতে ‘ইখওয়ানুল মুসলিমিন’ হিসেবেই উচ্চারণ করেন। এ সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ হাসানুল বান্না। ১৯২৯ সালের ১১ এপ্রিল তিনি এ সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন। আল-আজহারের এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন শহীদ হাসানুল বান্না। ১৯৪৮ সালে মিসরের বাদশাহ ফারুক প্রথমবার ইখওয়ানুল মুসলিমিনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তারও আগে ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৯ সালে জালেম বাদশাহ ফারুকের আদেশে একদিন মসজিদে যাওয়ার সময় হাসানুল বান্নাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তাঁর মতো একজন আদর্শবাদী ঘাঁটি মানুষ, বাগ্মী ও সত্যপথের সংগঠক বর্তমান দুনিয়ার বুকে বিরল। ১৯৫৪ সালের পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, মিসরে মুসলিম ব্রাদাদারহুডের সদস্যসংখ্যা ছিলো ৫০ লাখ। সে সময় ফিলিস্তিন, সিরিয়া ইরাক ও লেবাননে ব্রাদারহুডের ৩৫০টি শাখা ছিলো।
ইসলামের মৌলিক আদর্শকে সমাজে প্রতিষ্ঠার জন্য মুসলিম ব্রাদারহুড আজীবন লড়াই করেছে। ১৯৪৫ সালের ৮ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত মুসলিম ব্রাদারহুডের মৌলিক সূত্র (Radical Aphorism) নামক এক গ্রন্থে তাদের আদর্শ সম্পর্কে যে সব তথ্য রয়েছে সেগুলোর মধ্যে ছিলো ১। কোরআনের বিশ্লেষণ ও আজকের বৈজ্ঞানিক জগতে তার প্রয়োগ, ২। ঘনিষ্ঠতর সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার  উদ্দেশ্যে ইসলামি আইন-কানুনসমূহের সঠিক ব্যাখ্যা নিরূপণের জন্য ইসলামি রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সহযোগিতা, ৩। সামাজিক ইনসাফ প্রতিষ্ঠার জন্য অর্থনৈতিক সম্পদের সঠিক ব্যবহার ও সামাজিক শ্রেণিসমূহের পুনর্বিন্যাস, ৪। বিশ্ব মুসলিম জীবনমান উন্নত করার জন্য দারিদ্র্য, অস্বাস্থ্য ও অজ্ঞতার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা এবং ৫। বিদেশি প্রভুত্ব বা শোষণ থেকে মুসলিম দেশগুলোকে মুক্ত করা এবং পৃথিবীর সর্বত্র মুসলমান সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষা করা।
১৯৫৪ সালে মিসরের ডিক্টেটর প্রধানমন্ত্রী কর্নেল জামাল আবদুন নাসের মুসলিম ব্রাদারহুডকে পুনরায় বেআইনি ঘোষণা করেন। সেবছর ৮ অক্টোবর ব্রাদারহুডের শীর্ষনেতা ড. হাসানুল হোদায়বীকে গ্রেফতার করা হয়। হোদায়বী ছিলেন ড. হাসানুল বান্নার যোগ্য উত্তরসুরি। কর্নেল নাসের ব্রাদারহুডের কেন্দ্রীয় অফিসসহ ৪০০ শাখা অফিসে তালা ঝুলিয়ে দেন। ব্রাদারহুড কর্তৃক পরিচালিত স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, হাসপাতাল ও কোঅপারেটিভ প্রতিষ্ঠানগুলোও বন্ধ করে দেয়া হয়।
শুধু হোদায়বী নয়, তার সাথে মুসলিম ব্রাদারহুডের আরও ৬ জন বিপ্লবী নেতা মাহমুদ আবদুল লতিফ, ইউসুফ তালাত, আবদুল কাদের ওদা, হিন্দওয়ে দিওয়ার, ইব্রাহিম আল তৈয়ব ও মুহম্মদ ফারাগ আলীকে গ্রেফতার করে তথাকথিত সামরিক  আইনে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। কর্নেল জামাল আবদুন নাসেরের সরকার উচ্ছেদের চেষ্টার অভিযোগ এনে এসব নেতৃবৃন্দকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছিলো।
কর্নেল নাসেরের এহেন অপতত্পরতায় সমগ্র মুসলিম জাহান কেঁপে ওঠে। মুসলিম বিশ্বের চাপের মুখে ড. হাসানুল হোদায়বীকে মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকর করতে বিরত থাকলেও বাকি ৬ জনকে ৭ ডিসেম্বর ১৯৫৪ তারিখ সকাল ৮টা থেকে ১১টার মধ্যে আধাঘণ্টা পরপর ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারা হয়। সে সময় সিরিয়া, লেবানন, জর্দান, সৌদি আরব, ইরাক, ইরান, সুদান পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়াসহ প্রায় সব মুসলিম রাষ্ট্র ব্রাদারহুড নেতাদের মুক্তির দাবিতে মিসরের সরকারের কাছে তারবার্তা পাঠিয়েছিলো। কিন্তু কোন অনুরোধই নাসেরের মন গলাতে পারেনি।
ড. হাসানুল হোদায়বী ব্রাদারহুডে যোগদানের আগে মিসর হাইকোর্টের একজন বিচারপতি ছিলেন। ১৯৫১ সালে তিনি বিচারপতি পদে ইস্তফা দিয়ে মুসলিম ব্রাদারহুডে যোগদান করেন। শহীদ আবদুল কাদের ওদা শুধু মিসরের নয়, সমগ্র মুসলিম জাহানের শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদদের একজন ছিলেন। তিনি ছিলেন মিসরের সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি। ১৯৫০ সালে তিনি বিচারপতি পদে  ইস্তাফা দিয়ে ব্রাদারহুডে যোগদান করেন। শহীদ ইউসুফ তালাত একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ছিলেন। আল  কোরআনের আলোতে আলোকিত এই সিংহপুরুষকে বর্বর নাসের সরকার জেলখানার ভেতরে নির্যাতন করে তার একটি চক্ষু নষ্ট করে দিয়েছিলো। তারপরও ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে দু’হাত তুলে তিনি আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করেছিলেন, “ইহা আল্লাহ, যারা আমার প্রতি অন্যায় করলো, তাদেরকে তুমি ক্ষমা করে দিও।”
শহীদ মুহাম্মদ ফারাগ আলী ছিলেন শহীদ হাসানুল বান্নার ঘনিষ্ঠ সহযোগী। তিনি ব্রাদারহুডের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন। ইতোপূর্বে প্রথম যখন ব্রাদারহুডকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছিলো, তখনও তিনি ‘শান্তি ভঙ্গকারী’ হিসেবে অভিযুক্ত হন এবং পরে বেকসুর খালাস পান। ১৯৫০ সালে মিসরে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময় ফারাগ আলী গেরিলা বাহিনীর সর্বাধিনায়ক মনোনীত হয়েছিলেন। সেই ব্যাঘ্রপুরুষকে নাসের সরকার যখন ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারতে উদ্যত হলো তখন ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন, “বড় সুখের বিষয় যে, আমি আজ শাহাদাত্ লাভ করতে যাচ্ছি।”
শহীদ ইব্রাহিম আল-তৈয়ব ছিলেন মুসলিম ব্রাদারহুডের এক তরুণ নেতা। শাহাদাত্ বরণকালে তাঁর বয়স হয়েছিলো মাত্র ৩২ বছর। তিনি আইন বিষয়ে পাস করেছিলেন এবং ব্রাদারহুডের হেড অফিসে আইন বিভাগে কাজ করতেন। আধুনিক সমাজকাঠামোতে ইসলামি আইনের প্রয়োগ সম্পর্কে গবেষণারত ছিলেন এই যুবনেতা। রাজা ফারুকের শাসনামলে তিনি ১৯৪৯ সালে ৯ মাস কারাবরণ করেন এবং ১৯৫৪ সালে কর্নেল নাসের তাকে ২ মাস কারাগারে অবরুদ্ধ রেখে নির্যাতন করেছিল। ফাঁসির মঞ্চে ইব্রাহিম আল-দৈয়বের শেষবাণী ছিলো, “আল্লাহর অশেষ শুকরিয়া যে, আমি শাহাদাত্ বরণ করছি।” অপরদিকে শহীদ মাহমুদ আবদুল লতিফ ও হিন্দওয়ে দিওয়ার শাহাদাতের সময় অম্লান বদনে বলে গেছেন, “আমরা আল্লাহর নিকট থেকে এসেছি এবং আল্লাহর নিকট ফিরে যাচ্ছি।”
ব্রাদারহুডের নেতৃবর্গের ফাঁসির পেছনে সুয়েজ খালে ইংরেজদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সম্পর্ক জড়িত ছিলো। কারণ ব্রাদারহুড সুয়েজ খাল সম্পর্কে ইংরেজ ও মিসরের সংলাপের ঘোর বিরোধী ছিলো। তারা সুয়েজ খাল থেকে ইংরেজদের শর্তহীন প্রস্থানের দাবিদার ছিলো এবং এ খালকে আন্তর্জাতিক নৌপথ হিসেবে স্বীকৃতি এবং সেটিকে ইংরেজদের হাতে সমর্পণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। ২৮ মার্চ ১৯৫৪ তারিখে জামাল আবদুন নাসের মিসরের সামরিক সরকার হিসেবে ক্ষমতায় বসে সুয়েজ পরিত্যাগ সংক্রান্ত চুক্তিতে ইংরেজদের সাথে স্বাক্ষর করেন (১ সেপ্টেম্বর ১৯৫৪)। মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি এ চুক্তি স্বাক্ষর করেন। চুক্তি স্বাক্ষরের এক মাসের মাথায় জামাল আবদুন নাসেরের প্রাণনাশের চেষ্টা হয় এবং এ জন্য মুসলিম ব্রাদারহুডকে দায়ী করে তাদের আন্দোলনকে বে-আইনি ঘোষণা করা হয়। ৬ জনকে ফাঁসি দেয়া হলেও ৩০০ জন ব্রাদারহুড নেতাকে দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ড এবং ১০ হাজারেরও অধিক ব্যক্তিকে বিভিন্ন প্রকারের শাস্তি দেয়া হয়। এভাবে ইংরেজদের পদলেহনকারী নাসের সরকার ব্রাদারহুডকে নিঃশেষ করে দেয়ার সকল আয়োজন সম্পন্ন করে। কিন্তু আদর্শবাদী সংগঠনের মৃত্যু এতো সহজ নয়। সেই ঘটনার ৫৮ বছর পর ২০১২ সালে ব্রাদারহুড মিসরের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এলো।
মিসরের রাজা ফারুক আর কর্নেল নাসেরের মধ্যে আদর্শগত কোন পার্থক্য ছিলো না। তারা ব্রাদারহুডের নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করে যে নির্যাতন করেছিলো, সভ্য জগতে তার দৃষ্টান্ত বিরল। কারারুদ্ধ এসব খাঁটি মুসলমানকে মাসের পর মাস অনাহারে, অর্ধাহারে রেখে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় মারতে মারতে নাকমুখে রক্ত বের করে দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বেহুঁশ অবস্থায় রাখার পর চোখ খুললেই বলা হতো, “এবার বল, তোমরা ব্রাদারহুডে আর কাজ করবে কি-না?” গরম লোহার চিমটা দিয়ে হাতের আঙ্গুল থেকে একেকটি নখ টেনে টেনে বের করা হতো আর একেকটি টানের পর কিছুক্ষণ থেকে আবার জিজ্ঞাসা করা হতো, “এবার বল, তোমরা ব্রাদারহুড ছাড়তে রাজি আছে কি-না?” শরীর আর অন্তরের সমস্ত জ্বালা দু’ঠোটে চেপে শান্ত অথচ দৃঢ়কণ্ঠে তারা সকলেই জবাব দিতেন, “আল্লাহু আকবার, লিল্লাহিল হামদ” অর্থাত্ আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ, সব প্রশংসা আল্লাহর জন্য। এ হ’ল ব্রাদারহুডের মূল আওয়াজ। এভাবে বাদ্রারহুডের নেতারা জীবনত্যাগ করলেও আদর্শচ্যুত হননি। যাদেরকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিলো তারা ব্যতীত হাজার হাজার ব্রাদারহুডের নেতা-কর্মীকে বছরের পর বছর কারাগারে আটক রেখে নির্যাতন করা হয়েছে।
সর্বশেষে ২০১১ সালে ব্রাদারহুড মিসরের সাধারণ মানুষের নেতৃত্বের সামনে চলে আসে। ফলশ্রুতিতে গণবিক্ষোভের মুখে স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের বিদায়ের পর মিসরের সশস্ত্র বাহিনীর সর্বোচ্চ পরিষদ (স্কাপ) ১৮ মাস সে দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য নানামুখী কাজ করে। এসব কাজের মধ্যে ছিলো হোসনি মোবারক ও তার সহযোগীদের বিচার, বিভিন্ন অনিয়ম ও অবিচার সম্পর্কে তদন্ত পরিচালনা এবং সর্বোপরি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন পরিচালনা। গণতান্ত্রিক পদ্ধতির নির্বাচনে ব্রাদারহুড নেতা উ. মুহম্মদ মুরসি ক্ষমতায় এলেও তিনি এমন এক পরিস্থিতিতে হাল ধরেছেন যখন দেশে কোন পার্লামেন্ট নেই, স্থায়ী কোন সংবিধান নেই, বিধিসংগত ব্যবস্থা নেই। এমতাবস্থায় স্কাপের নিয়মনীতি অনুসরণ করে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে  তাকে এগোতে হবে। ড. মুরসি যে আদর্শে বিশ্বাসী সেই আদর্শকে রাষ্ট্রীয় জীবনে কতটা পরস্ফুিট করতে পারবেন সে ব্যাপারেও রয়েছে নানা মত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মুসলিম ব্রাদারহুডকে কোনদিনই ভলো চোখে দেখেনি, তাই মার্কিন প্রশাসনের নিকট মুরসি’র গ্রহণযোগ্যতা কতটা হবে সে ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে।
তবে মুরসি পন্ডিত ও বিদগ্ধ ব্যক্তিত্ব। সামরিক পরিষদের বেড়াজাল ডিঙ্গিয়ে লাখো জনতার সমর্থন নিয়ে তিনি এগিয়ে যেতে সমর্থ হবেন বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেছেন। মন্ত্রিসভা গঠনের আগে সমাজের সর্ব অংশের সাথে পরামর্শ করার মধ্যে তার দূরদর্শিতার ছাপ ফুটে উঠেছে। তার স্ত্রী নাগলা আলী মাহমুদের বয়স ৫০ বছর। তার বড় ছেলের নাম আহমদ। তাই ‘উম আহমদ’ বা আহমদের মা হিসেবে তিনি পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। বোরকা পরিহিত এই রমণী ‘ফাস্ট লেডি’ হিসেবে পরিচয় দেয়ার ঘোর বিরোধী।
এখানে প্রসঙ্গত আর একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, মানবতার সেবায় মুসলিম ব্রাদারহুড সর্বমহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়। মানবতার সেবার জন্য ব্রাদারহুডের একটি আলাদা বিভাগ রয়েছে। এ বিভাগ থেকে গরীব ও অভাবী লোকদের সাহায্য প্রদান, স্বল্পমূল্যে খাদ্য সরবরাহ, বেকারদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, রোগীদের জন্য বিনামূল্যে চিকিত্সার ব্যবস্থা এবং স্বাস্থ্য রক্ষার পদ্ধতিসমূহ  প্রচার করা হয়। তাছাড়া ব্রাদারহুডের প্রতিটি পেশার বিশেষজ্ঞ শ্রেণী রয়েছেন যারা নিজ নিজ পেশায় কর্মরত পেশাজীবীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির জন্য পরামর্শ প্রদান করে থাকে। এতকিছু সত্ত্বেও ক্ষমতায় আসার পর সামরিক বাহিনীর প্রভাববলয় থেকে ব্রাদারহুড মুক্ত হওয়া এবং ড. মুহম্মদ মুরসিকে সামরিক শাসনের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে দেশ পরিচালনার পাশাপাশি তীব্রভাবে দ্বিধাবিভক্ত, আতংকিত ও ক্ষুব্ধ মিসরীয়দের নেতৃত্ব দেয়া দুরূহ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
n লেখক:সভাপতি, ইতিহাস গবেষণা সংসদ

লিবিয়ায় নির্বাচন: গণতন্ত্রের পথে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ


ম্যাগি মিখাইল
এবার নির্বাচনে সেখানকার ইসলামী দলগুলোর সামনে এক কঠিন চ্যালেঞ্জ উপস্থিত। কারণ গাদ্দাফির সরকার ছিল মূলত ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিতে বিশ্বাসী। মিসরে হোসনি মোবারকও একই পথের পথিক ছিলেন। এসব ইসলামী দলের মধ্যে মডারেট ইসলামী ব্রাদারহুড থেকে শুরু করে উগ্র সালাফি মতবাদে বিশ্বাসী ও সাবেক জিহাদিরা রয়েছে

আবদেল-হাকিম বেলহাজ আফগানিস্তানে সোভিয়েত সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী একজন সাবেক জিহাদি কমান্ডার। অতি সম্প্রতি তিনি তার পুরনো জুব্বা ও যোদ্ধা বেশ ছেড়ে বিজনেস সুট ধরেছেন। এই ব্যক্তিটিই লিবিয়ায় একটি ইসলামী পার্টি গঠন করে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। আজ শনিবার অনুষ্ঠানরত লিবিয়ার সংসদ নির্বাচনে তার দল অন্যদের থেকে এগিয়ে রয়েছে বলে কেউ কেউ ধারণা করছেন। মুয়াম্মার গাদ্দাফির ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে একটানা শাসনের পর সেখানে এটাই গণতন্ত্রের পথে গুরুত্বপূর্ণ প্রথম পদক্ষেপ। রাজধানী ত্রিপোলিতে বিভিন্ন দল ও প্রার্থীর সমর্থনে পোস্টার-ব্যানার দেখে বোঝার উপায় নেই যে, এই দেশটিতেই গাদ্দাফি দীর্ঘকাল সকল রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা নিষিদ্ধ করে রেখেছিলেন। তখন গাদ্দাফির স্বৈরশাসনকেই এক ধরনের গণতান্ত্রিক শাসন নামে অভিহিত করা হতো। নয় মাস আগে গাদ্দাফি উৎখাত ও নিহত হওয়ার পর এই প্রথম গৃহযুদ্ধে দীর্ণ দেশটির ২৮ লাখ ভোটার আজ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে যাচ্ছে। লিবীয়রা মনে করছে, এরপর তাদের ৬০ লাখ লোকের তেলসমৃদ্ধ দেশটির উন্নতি হবে। এখানকার বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ ক্ষমতা বাড়বে।
এদিকে এখনও বেপরোয়া মিলিশিয়া দলগুলো নিজেদের খেয়ালখুশিমতো চলছে। আঞ্চলিক ও গোষ্ঠীগত সংঘাত বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে সহিংসতার বিস্তার ঘটছে। সেখানে বস্তুত কোনো বৈধ তথা নির্বাচিত সরকার না থাকার কারণেই এসব ঘটনা ঘটতে পারছে। আটককৃতদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন, এমনকি হত্যার মতো ঘটনা সেখানে ব্যাপকভাবেই ঘটছে বলে মানবাধিকার সংগঠনগুলো প্রমাণ পেয়েছে।
এবার নির্বাচনে সেখানকার ইসলামী দলগুলোর সামনে এক কঠিন চ্যালেঞ্জ উপস্থিত। কারণ গাদ্দাফির সরকার ছিল মূলত ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিতে বিশ্বাসী। মিসরে হোসনি মোবারকও একই পথের পথিক ছিলেন। এসব ইসলামী দলের মধ্যে মডারেট ইসলামী ব্রাদারহুড থেকে শুরু করে উগ্র সালাফি মতবাদে বিশ্বাসী ও সাবেক জিহাদিরা রয়েছে।
অনেক অর্থ নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় নামা ব্রাদারহুড জাস্টিস ও কনস্ট্রাকশন পার্টি ভালো অবস্থান করে নিতে পেরেছে বলেই মনে হচ্ছে। তরুণ-তরুণীরা ব্রাদারহুডের প্রতীক ধারণ করে ঘরে ঘরে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছে। আর তিনটি দল বেশ আসন জিতে নেবে বলেই মনে হচ্ছে। এই তিনটি দলের মধ্যে রয়েছে_ সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহমুদ জিবরিলের ধর্মনিরপেক্ষ অ্যালায়েন্স ফর ন্যাশনাল ফোর্সেস, বেলহাজ আল-ওয়াতন ও লিবিয়ার প্রাচীন রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল ফ্রন্ট পার্টি। শেষোক্ত এই দলটি গাদ্দাফিকে হত্যা করার জন্য কয়েক দফা চেষ্টা চালিয়েছিল।
২শ' আসনের এই লিবীয় সংসদ নির্বাচিত হওয়ার পর তারা নতুন ট্রানজিশনাল সরকার গঠন করবে এবং নতুন সংবিধান প্রণয়ন ও গণভোটের মাধ্যমে নতুন সংবিধান গ্রহণ না হওয়া পর্যন্ত ওই সরকার দেশ পরিচালনা করবে। নতুন সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২০১৩ সালে। তবে বর্তমান ট্রানজিশনাল সরকার এক ডিক্রিতে বলেছে, ভোটাররা এই প্যানেলের সদস্যদের সরাসরি নির্বাচিত করবে। অর্থাৎ ফেডারেটিভ শাসন প্রতিষ্ঠার একটা প্রচেষ্টা এতে লক্ষণীয়।
মিসর ও তিউনিসিয়াসহ আরব বিশ্বে যে গণবিপ্লব দেখা দেয় এই ফেডারেল ব্যবস্থার মাধ্যমে এর সুফল মিলতে পারে। ওই বিপ্লবের সময় গাদ্দাফিকে উৎখাতের আহ্বানের মধ্য দিয়ে সেখানেও জনগণের প্রতিবাদ-বিক্ষোভ শুরু হয়। কিন্তু তাদের ওপর দমন-পীড়ন চালানো হলে তারা গাদ্দাফি বাহিনীর সঙ্গে যুঝে উঠতে পারে না। তখন প্রয়োজন দেখা দেয় বিদেশি সামরিক ও অন্যান্য সহযোগিতার। ন্যাটো তখন আকাশপথে হামলা চালানোসহ গাদ্দাফি বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে দেওয়ার ব্যবস্থা করে। গাদ্দাফি উৎখাতে নেতৃত্বদানকারী ট্রানজিশনাল কাউন্সিলের সাবেক মুখপাত্র গুমা এল-গামাতি বলেছেন, বিগত ৪৩ বছর ধরে একজন ভাগ্যবিধাতা দেশ শাসন করেছেন, আর এখন হাজারজনের উদ্ভব ঘটেছে। তিনি বলেন, এই নির্বাচন আয়োজনের ফলে মানুষ মনে করছে, অবশেষে ট্রেন চলতে শুরু করেছে অর্থাৎ অচলাবস্থা কাটতে শুরু করেছে। এই নেতাও একটি দল গঠন করে নির্বাচনে অবতীর্ণ হয়েছেন। বিবাদরত লিবিয়ানদের মধ্যে প্রীতি-মৈত্রী প্রতিষ্ঠার মতো কোনো কর্তৃপক্ষ না দেখা যাওয়ায় এতদিন খেয়োখেয়ি চলছিল। এখন নির্বাচনের মাধ্যমে একটি বৈধ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে সে অভাব দূর হতে পারে।
নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে দশকের পর দশক ধরে এক ব্যক্তির শাসনের জন্য বিকশিত হতে না পারা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান-সংস্থাগুলো তাদের বিকাশের সুযোগ পাবে। সরকার অবশ্যই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করবে। নিজেদের খেয়ালখুশিমতো পরিচালিত মিলিশিয়া বাহিনীগুলোকে একটা সামরিক বাহিনীর কমান্ডের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হবে।
নতুন বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হবে। যাতে লিবীয়দের বিবাদগুলো মীমাংসা করা সম্ভব হবে। ধারণা করা হয়, মিলিশিয়া বাহিনীগুলোর হাতে গাদ্দাফি বাহিনীর ৪ হাজারের ওপর সদস্য আটক রয়েছে।
নির্বাচনের জন্য দেশ এখন সম্পূর্ণ উৎসবের মেজাজে রয়েছে। এটা আমাদের জনগণের সংগ্রামের ফসল বলে বেলহাজ উল্লেখ করেন। তিনি বুধবার ত্রিপোলিতে এক নির্বাচনী বক্তব্য দেওয়ার সময় বলেছেন, তারা লিবিয়াকে আধুনিক সমৃদ্ধিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করতে চান। তারা জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনও ঘটাতে চান এবং জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে চান।
কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, নির্বাচনে ধর্মনিরপেক্ষ, স্বতন্ত্র ও ইসলামপন্থিদের একটা মিশ্র অবস্থা লক্ষ্য করা যাবে। তবে অন্যরা মনে করেন, ইসলামপন্থিরা মোট আসনের অর্ধেকের বেশি জিতে নেবে। নেদারল্যান্ডসভিত্তিক আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য সাইফকে তাদের হাতে তুলে দেওয়ার কথা বললেও মিলিশিয়ারা তার বিচার লিবিয়াতেই অনুষ্ঠানের পক্ষপাতী। এক সময় গাদ্দাফির উত্তরসূরি বিবেচিত সাইফের সঙ্গে আঁতাতকারী হিসেবে আইসিসি টিমকে চিহ্নিত করে জিনতান বাহিনী গোটা টিমকে এক মাস আটক করে রেখেছিল।
অন্যদিকে জিবরিলকেও সাবেক গাদ্দাফি সরকারের অংশ মনে করা হয়ে থাকে। কারণ তিনি সে সময় জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান ছিলেন এবং তিনি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়া দেখভাল করতেন।
গত বৃহস্পতিবার অবমুক্ত করা এক রিপোর্টে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্য্যালনাল আইন প্রণেতা ও সরকারকে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করার আহ্বান জানিয়েছে। তারা মানবাধিকার রক্ষার কথাও স্মরণ করিয়ে দেয়।
অ্যামনেস্টির মহিলা মুখপাত্র হাসিবা হাদি এক বিবৃতিতে বলেন, গাদ্দাফি সরকারের বিদায় নেওয়ার পর অনেক মাস পেরিয়ে গেলেও এখনও দেশের নিরাপত্তা মিলিশিয়া বাহিনীগুলোর হাতেই রয়ে গেছে। এর মধ্যে মারাত্মক সব ঘটনা ঘটছে। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা বিঘি্নত হচ্ছে। বিবাদ দেশকে প্রায় বিভক্তির মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে। সারা পূর্বাঞ্চলীয় অংশেই বিভক্তির আওয়াজ বেশ জোরালো। এই অংশটি দশকের পর দশক ধরে গাদ্দাফির শাসনে অনেকটাই পিছিয়ে পড়ে এবং তাদের মধ্যে এক ধরনের বঞ্চনাবোধ জন্ম নেয়। আর এটা গত বছর গাদ্দাফিবিরোধী অভ্যুত্থানের সূতিকাগারও ছিল। তারা দেশের পশ্চিমাংশ থেকে তাদের আসন সংখ্যা অনেক কম হওয়ায় ক্ষুব্ধ। এ জন্য তারা আজকের নির্বাচন বয়কটেরও আহ্বান জানিয়েছিল।
তবে অ্যামনেস্টি বলেছে, দেশের পরিস্থিতি উন্নতির জন্য নির্বাচন হলো প্রথম পদক্ষেপ।

নিউজউইক থেকে ভাষান্তরিত

বৃহস্পতিবার, ৫ জুলাই, ২০১২

যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার সনদ লঙ্ঘন করছে



॥ জিমি কার্টার ॥

বিশ্বজুড়ে মানবাধিকারের জোরালো সমর্থক হিসেবে যে ভূমিকা যুক্তরাষ্ট্র পালন করে এসেছে, তা দেশটি পরিত্যাগ করছে।
এই মর্মে তথ্য উদ্ঘাটিত হয়েছে যে, মার্কিন শীর্ষ কর্মকর্তারা বিদেশে লোকজনকে হত্যার জন্য টার্গেট করছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন মার্কিন নাগরিকও। আমাদের জাতির দ্বারা মানবাধিকার লঙ্ঘন কতটা বিস্তৃত হয়েছে, তার সর্বসাম্প্রতিক ও উদ্বেগজনক প্রমাণ এটা। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সন্ত্রাসবাদী হামলার পর এই প্রবণতার সূচনা। (ডেমোক্র্যাটিক ও রিপাবলিকান) দুই দলেরই প্রশাসনিক ভূমিকা এবং কংগ্রেসের কার্যক্রমের মাধ্যমে এর অনুমোদন দিয়ে এটাকে বাড়িয়ে তোলা হয়েছে। আর সাধারণ জনগণও এ ব্যাপারে ভিন্ন মত প্রকাশ করেনি। এর ফল হলো, এ ধরনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে আমাদের দেশ আর নৈতিক কর্তৃত্বের সাথে জোর দিয়ে কথা বলতে পারছে না।
যুক্তরাষ্ট্র অতীতে ভুল করেছে। তবে অবস্থার নাটকীয় অবনতি ঘটে গত দশকে মানবাধিকারের ব্যাপক লঙ্ঘনের মাধ্যমে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ১৯৪৮ সালে ‘মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা’ গৃহীত হয়েছিল। এটা ছিল ‘স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার ও শান্তির ভিত্তি’। এতে এ মর্মে সাহসী ও সুস্পষ্ট অঙ্গীকার ছিল যে, জনগণকে নির্যাতন-নিপীড়ন করার হাতিয়ার হিসেবে আর ক্ষমতা ব্যবহৃত হবে না। এই ঘোষণা সবার সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিল জীবন, স্বাধীনতা, ব্যক্তির নিরাপত্তা, আইনি সুরক্ষা এবং নির্যাতন কিংবা স্বেচ্ছাচারীভাবে বন্দী করা অথবা বলপূর্বক নির্বাসন থেকে মুক্ত থাকার ক্ষেত্রে।
বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে একনায়কতন্ত্র হটিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আইনের শাসন মজবুত রাখার জন্য মানবাধিকার সংগ্রামীরা ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় প্রেরণা পেয়েছেন এই ঘোষণা থেকে।
এটা উদ্বেগজনক যে, আমাদের (যুক্তরাষ্ট্র) সরকারের সন্ত্রাসবাদবিরোধী নীতিগুলো এসব মূলনীতি জোরদার না করে এখন মানবাধিকার সনদের ৩০টি ধারার অন্তত ১০টি সুস্পষ্টভাবেই লঙ্ঘন করছে। এর মধ্যে ‘নিষ্ঠুর অমানবিক অথবা অমর্যাদাকর আচরণ বা শাস্তি’র ওপর যে নিষেধাজ্ঞা, সে ধারাটিও রয়েছে।
কোনো ব্যক্তি সন্ত্রাসবাদী সংগঠন বা ‘সংশ্লিষ্ট বাহিনী’গুলোর সাথে জড়িত থাকার সন্দেহে তাকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্দী রাখার অধিকার মার্কিন প্রেসিডেন্টকে দেয়া হয়েছে আইন করে। এই ব্যাপক ও অস্বচ্ছ ক্ষমতার অপব্যবহার হতে পারে যদি আদালত কিংবা কংগ্রেস কার্যকর নজরদারি না রাখে। অবশ্য একজন ফেডারেল জজ আইনটি বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধক দাঁড় করিয়েছেন। এই আইন মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার লঙ্ঘন করেছে। তদুপরি অপরাধীরূপে প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত যেকোনো ব্যক্তি নির্দোষ বলে গণ্য হবেন, এই অধিকারেরও পরিপন্থী উপরিউক্ত আইন। এই দুই বিষয়ে দু’টি ধারা আছে মানবাধিকার ঘোষণায়। 
মার্কিন নাগরিকেরা হত্যাকাণ্ড এবং অনির্দিষ্টকালীন অন্তরীণের টার্গেট হচ্ছেন। এর সাথে যোগ হলো সাম্প্রতিক কিছু আইন, যেগুলো বিদেশী গোয়েন্দা নজরদারি আইন, ১৯৭৮-এর নিবৃত্তিমূলক বিধানগুলো বাতিল করে দিয়েছে। এটা করা হয়েছে আমাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকারের নজিরবিহীন লঙ্ঘনের উদ্দেশ্যে। তা হবে, পরোয়ানা ছাড়াই ফোনে আড়ি পেতে এবং ইলেকট্রনিক যোগাযোগব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করে। এমন সব আইন বিদ্যমান, যেগুলো শুধু চেহারা, প্রার্থনার স্থান এবং কারো সাথে সংশ্লিষ্টতার কারণে বন্দী করার অনুমতি দেয়।
চালকবিহীন বিমান বা ড্রোনের হামলায় যে-ই নিহত হোক, তাকেই শত্রু সন্ত্রাসী ঘোষণা করার স্বেচ্ছাচারী বিধান রয়েছে। তদুপরি তার কাছে উপস্থিত থাকা নির্দোষ নারী-শিশুর মৃত্যুকে ধরে নেয়া হয়েছে ‘অনিবার্য’। আফগানিস্তানে এ বছর নিরস্ত্র মানুষের ঘরবাড়িতে ৩০ বারের বেশি বিমান হামলার পর প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই এটা বন্ধ করার দাবি জানালেন। কিন্তু পাকিস্তান, সোমালিয়া ও ইয়েমেনের বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের হামলা চলছেই। অথচ এসব স্থান ‘যুদ্ধ এলাকা’র অন্তর্ভুক্ত নয়। এসব হামলায় কত শত নিরীহ নির্দোষ বেসামরিক লোক মারা পড়েছে, আমরা জানি না। এর প্রতিটি হামলাই ওয়াশিংটনে সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত। অতীতে এটা চিন্তাও করা যেত না। এসব কিছু আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতিকে নিশ্চিতই ক্ষতিগ্রস্ত করছে। উচ্চপর্যায়ের গোয়েন্দা ও সেনাকর্মকর্তারা এবং মানবাধিকার সমর্থকেরা জোর দিয়ে বলেছেন, ড্রোন হামলা অনেক বেড়ে গেছে এবং এতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলোর দিকে ঝুঁকছে। এ হামলা সাধারণ মানুষকে আমাদের বিরুদ্ধে ুব্ধ করে তুলেছে। নির্যাতক সরকারগুলো ড্রোন হামলার দোহাই দিয়ে নিজেদের স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ বৈধ করার প্রয়াস পাচ্ছে।
এ দিকে কিউবার গুয়ান্তানামো বের বন্দিশিবিরে এখনো ১৬৯ জন আছেন। তাদের অর্ধেকই মুক্তি লাভের অনুমতি পেয়েছেন। অথচ তাদের কোনো দিন মুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলা চলে। মার্কিন কর্তৃপক্ষ বলেছে, দোষ স্বীকার করার জন্য বিচারাধীন (তাও শুধু সামরিক আদালতে) কয়েকজনকে নির্যাতন করা হয়েছে। তাদের এক শ’ বারেরও বেশি পানিতে চুবিয়ে অথবা সেমিঅটোমেটিক অস্ত্র ও ড্রিল মেশিনের ভয় দেখিয়ে নতুবা তাদের মায়ের ওপর যৌন হামলার হুমকি দিয়ে এটা করা হয়েছে। বিস্ময়কর হলো, এসব সত্য ঘটনাকে অভিযুক্ত নিজের সমর্থনে ব্যবহার করার উপায় নেই। কারণ মার্কিন সরকার দাবি করছেÑ ‘জাতীয় নিরাপত্তা’র জন্যই এসব করা হয়েছে। অন্যান্য বন্দীর কখনো বিচার হওয়ার কিংবা তাদের ব্যাপারে চার্জশিট দেয়ারও সম্ভাবনা নেই।
যখন জনগণের বিপ্লব দুনিয়া কাঁপিয়ে দিচ্ছে, তখন যুক্তরাষ্ট্র আইনের মৌলিক বিধিবিধান এবং মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের মূলনীতিগুলো দুর্বল না করে শক্তিশালী করা উচিত। কিন্তু পৃথিবীকে নিরাপদ করার বদলে আমেরিকা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। এটা আমাদের শত্রুদের উসকে দিচ্ছে আর দূরে সরিয়ে দিচ্ছে বন্ধুদের।
উদ্বিগ্ন নাগরিক হিসেবে চলার পথ পাল্টে মানবাধিকারের মাপকাঠি মোতাবেক নৈতিক নেতৃত্ব ফিরে পেতে ওয়াশিংটনকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। মানবাধিকারের নীতিমালাকে আমরা নিজেদের বলে গ্রহণ করেছি সরকারিভাবেই। বছরের পর বছর আমরা এগুলোকে লালন করেছি। 
দ্য নিউইয়র্ক টাইমস ২৪ জুন
লেখক : যুক্তরাষ্ট্রের ৩৯তম প্রেসিডন্ট। ২০০২ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী। কার্টার সেন্টার প্রতিষ্ঠাতা।
ভাষান্তরÑ মীযানুল করীম

মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক ও রোহিঙ্গা সমস্যা

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার, পিএসসি (অব.)


ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায়। শক্তিশালী প্রতিবেশী ভারতের স্থল সীমান্ত রয়েছে বাংলাদেশের চতুর্দিক ঘিরে। ভারত ব্যতীত অন্য যে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের স্থল সীমান্ত আছে সেটি হলো মিয়ানমার। মিয়ানমার আমাদের পূর্বদিকের প্রতিবেশী, যে দেশের সঙ্গে আমাদের স্থল সীমানার দৈর্ঘ্য প্রায় ২৪৩ কি. মি.। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক সূত্রে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের যত বেশি যোগাযোগ রয়েছে, মিয়ানমারের সঙ্গে সঙ্গত কারণেই ততটা নেই। তবে ভৌগোলিক অবস্থান এবং মিয়ানমারের উদার ও বহুমুখী বৈদেশিক সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহ প্রকাশের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ বাংলাদেশের জন্য নতুন অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করেছে। মিয়ানমারের সঙ্গে স্থলপথে সংযোগ স্থাপিত হলে বিশ্বের উদীয়মান শক্তি চীন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্য প্রায় সব দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক লেনদেন বাংলাদেশ স্বল্প সময়ে ও খরচে করতে সক্ষম হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সেতু বা ব্রিজ হিসেবে কাজ করতে পারে মিয়ানমার। ১৯৬২ সালে সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে বন্ধ হয়ে যাওয়া দরজা মিয়ানমার ধীরে ধীরে খুলে দিচ্ছে। ফলে বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর দেশটির প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তিসমূহের ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে। ছয় লাখ ৭৬ হাজার ৫৫২ বর্গকিলোমিটার আয়তনের মিয়ানমার বাংলাদেশ থেকে প্রায় চার গুণ বড়। তবে মিয়ানমারের লোকসংখ্যা আমাদের এক-তৃতীয়াংশ, প্রায় ছয় কোটি। অথচ দেশটিতে রয়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ সদস্যের শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনী, যা আকারের দিক থেকে পৃথিবীর নবম বৃহত্তম। ১৯৪৮ সালে তৎকালীন নাম বার্মা, বর্তমানের মিয়ানমার ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতার পর এক যুগেরও কিছু বেশি সময় মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ছিল। কিন্তু ১৯৬২ সালের ২ মার্চ এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে নেয় সে দেশের সামরিক বাহিনী। তারপর থেকে মিয়ানমার সামরিক শাসনের গ্যাঁড়াকলে পড়ে আছে, যেখান থেকে এখনো সম্পূর্ণভাবে বের হতে পারেনি। ১৯৯০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) কাছে শাসনক্ষমতা হস্তান্তর না করে সে দলের নেতা অং সান সু চিকে বন্দী করা হয় এবং গণতন্ত্রকামীদের ওপর শুরু হয় জেল-জুলুম, অত্যাচার ও নির্যাতন। ফলে মিয়ানমারের সামরিক সরকার যুক্তরাষ্ট্রসহ সব পশ্চিমা বিশ্বের সর্বাত্দক নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে। ফলে এক বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্রে পরিণত হয় দেশটি। আমেরিকার অবরোধ ও অবহেলার কারণে মিয়ানমারের সামরিক সরকার চীনকে বিনিয়োগের আমন্ত্রণ জানায়। চীনও তার সুদূরপ্রসারী গ্র্যান্ড স্ট্র্যাটেজির অংশ হিসেবে দক্ষিণ চীন সাগরের বিকল্প পথের সন্ধানে বঙ্গোপসাগর হয়ে ভারত মহাসাগরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের জন্য মিয়ানমারের উপকূলে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ থেকে শুরু করে সড়ক ও রেলপথ উন্নয়নে বড় আকারের বিনিয়োগ করে। সামরিক বাহিনীর সব শাখায় অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ এবং প্রশিক্ষণ প্রদানে অংশ নেয়। তেল, গ্যাস ও খনি শিল্প, বলা যায় একচেটিয়া বিনিয়োগ আধিপত্য বিস্তার করে চীনা কোম্পানিগুলো। কিন্তু ২০০৮ সালে সীমিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচিত অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলদের কর্তৃত্বাধীন বর্তমান মিয়ানমার সরকার চীনের ওপর নজিরবিহীন নির্ভরতার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সজাগ হয়। ফলে ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে মিয়ানমার আন্তর্জাতিক সম্পর্কে একটা ভারসাম্য আনার জন্য ওপেন নীতি গ্রহণ করে এবং এনএলডি নেত্রী অং সান সু চিকে মুক্ত করে নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ করে দেয়। এতদিন মিয়ানমার বিশ্বের দুটি জনবহুল রাষ্ট্র চীন ও ভারতের 'বাফার স্টেটের ভূমিকা পালন করে আসছিল। কিন্তু এখন থেকে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নতুন সামরিক কৌশলের অংশ হিসেবে চীনের প্রভাবকে সীমিত করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও যে মিয়ানমারকে এক ধরনের বাফার স্টেট হিসেবে ব্যবহার করতে চাইবে তা সহজেই অনুমান করা যায়। সাম্প্রতিক সময়ে সমুদ্র সীমানার মতবিরোধ নিষ্পত্তিতে উইন উইন পরিস্থিতি এবং জুন মাসের প্রথমদিকে সৃষ্ট রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ সরকারের সঠিক স্ট্যান্ডের কারণে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নতুন মাত্রায় ওঠার উজ্জ্বল সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শক্তিশালী অর্থনৈতিক জোট আসিয়ানের (অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথ-ইস্ট এশিয়ান নেশন্স) সদস্য সংখ্যা মিয়ানমারসহ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১০টি রাষ্ট্র। অন্য সদস্য হলো_ ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ব্রুনাই, ভিয়েতনাম, লাওস এবং কম্বোডিয়া। এসব দেশের সঙ্গে স্থলপথে সংযোগ স্থাপনকল্পে বাংলাদেশের জন্য একমাত্র গেটওয়ে রাষ্ট্র মিয়ানমার। ৫৫ কোটি মানুষের আসিয়ান এখন বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী অঞ্চল। ফলে তাবৎ বিশ্বের আকর্ষণ ও দৃষ্টি এখন এই দেশগুলোর দিকে। পশ্চিমা বিশ্ব এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আসিয়ানের বাড়তি গুরুত্বের কারণ হলো বিশ্বশক্তি হওয়ার পথে দ্রুত ধাবমান চীন ও ভারতের অবস্থান এ অঞ্চলে। সঙ্গত কারণেই ভারত ও চীন উভয়েই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তাদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা বহু আগে থেকেই অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। আসিয়ান দেশগুলোর অভ্যন্তরে এবং উপকূলীয় অঞ্চলে তেল-গ্যাসের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। দ্রুত প্রবৃদ্ধির ফলে জনশক্তি এবং ভোগ্যপণ্যের চাহিদাও এসব দেশে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তা ছাড়া কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম এবং মিয়ানমারে কৃষি উপযোগী জমির তুলনায় জনসংখ্যা কম হওয়ায় এ দেশগুলোতে বিপুল পরিমাণ জমি অনাবাদি পড়ে থাকে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা যেভাবে বাড়ছে এবং কৃষি জমি দিন দিন যে হারে কমে যাচ্ছে তাতে ওইসব দেশে যদি বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি উদ্যোক্তারা কৃষি ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে পারে, তাহলে একদিকে যেমন বাংলাদেশের অদক্ষ জনশক্তির জন্য ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে, তেমনি আগামীতে আমাদের বাড়তি জনসংখ্যার জন্য খাদ্যশস্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিকল্প সম্ভাবনার পথ খুলে যাবে। মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া এবং লাওস ব্যাপকভাবে বনজসম্পদে সমৃদ্ধিশালী দেশ। অধিক জনসংখ্যা ও স্বল্প আয়তনের দেশ হিসেবে বাংলাদেশে বনজসম্পদের সীমাবদ্ধতা ও ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। ভবিষ্যতে ঘাটতি আরও বৃদ্ধি পাবে। এ ঘাটতি পূরণে স্থলপথে কম খরচে এসব দেশ থেকে টিম্বার ও কাঠ আমদানি করার সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের। আসিয়ান জোটের দেশগুলোর সঙ্গে বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরও সুসংহত করে অপার সম্ভাবনাময় সুযোগের সদ্ব্যবহার করার জন্য বাংলাদেশ যদি মিয়ানমারকে গেটওয়ে হিসেবে কাজে লাগাতে পারে তাহলে সেটি হবে আমাদের জন্য সহজ এবং অর্থনৈতিকভাবে অধিকতর লাভজনক। উদীয়মান বিশ্বশক্তি চীনের সঙ্গে আমাদের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক এখন বহুমুখী। স্থলপথে চীনের সঙ্গে সংযোগ সৃষ্টি করার জন্য ভায়া মিয়ানমারই সবচেয়ে সহজতর পন্থা। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের বিদ্যমান সম্পর্ককে কূটনৈতিক ভাষায় ওয়ার্কিং রিলেশন বলা যায়। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আশানুরূপ পর্যায় না থাকার বহুবিধ কারণ রয়েছে। প্রথমত. ১৯৬২ সাল থেকে মিয়ানমারে সামরিক শাসন থাকায় তারা নিজেরাই কিছুটা অন্তর্মুখী নীতি গ্রহণ করে এবং বহির্বিশ্ব থেকে মোটামুটি বিচ্ছিন্ন থাকে। শুধু চীনের সঙ্গে সামরিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং চীন অত্যন্ত দূরদৃষ্টির মাধ্যমে এ সম্পদশালী দেশটির সব ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। ১৯৬৭ সালে আসিয়ান জোট গঠিত হলেও মিয়ানমার এর সদস্য হয় অনেক পরে, ১৯৯৭ সালে। ভারত অনেক পরে মিয়ানমারের দিকে নজর দেয়। সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং মিয়ানমার সফর করেছেন। বঙ্গোপসাগরে ভারতের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের ঠিক বিপরীতে, অর্থাৎ পূর্বদিকে মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের দক্ষিণদিকে সমান্তরালভাবে প্রসারিত লম্বা লেজের মতো দেখতে ভূখণ্ডে অবস্থিত মিয়ানমারের 'দাউই' বন্দর নির্মাণ করার জন্য ভারত মিয়ানমার একমত হয়েছে। এ বন্দরের মাধ্যমে ভারত আসিয়ান জোটের অন্যান্য দেশের সঙ্গে স্থলপথে যোগাযোগ স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে। একইসঙ্গে মিয়ানমারের আকিয়াব বন্দর ব্যবহার করে ভারত তার উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের সাত প্রদেশের সঙ্গে বিকল্প পথে যোগাযোগ স্থাপনের চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। আগামী চার বছরের মধ্যে উলি্লখিত বন্দরগুলোর নির্মাণ এবং সড়ক ও রেলপথ উন্নয়নের কাজ শেষে ভারত তার পূর্বাঞ্চলের প্রদেশ এবং আসিয়ান দেশগুলোর সঙ্গে স্বল্প দূরত্বের কানেক্টিভিটি সম্পন্ন করতে চায়। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ যদি সঠিক কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে সম্ভাবনাময় কানেক্টিভিটির সঙ্গে সংযোজিত না হতে পারে তাহলে এতদাঞ্চলে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। সুতরাং এতদাঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে একটা ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা এবং আঞ্চলিক সম্ভাবনাকে নিজেদের অনুকূলে কাজে লাগানোর লক্ষ্যে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের উন্নত সম্পর্ক থাকা বাঞ্ছনীয়। এ মুহূর্তে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের পথে অন্যতম বাধা হিসেবে দাঁড়িয়েছে বহুদিন যাবৎ চলে আসা রোহিঙ্গা সমস্যা। রোহিঙ্গা হচ্ছে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে বসবাসকারী মুসলমান জনগোষ্ঠী। এই রাখাইন প্রদেশের সঙ্গে বাংলাদেশের কঙ্বাজারের স্থলসীমান্ত রয়েছে। রাখাইন রাজ্যে রাখাইন সম্প্রদায় সংখ্যাগরিষ্ঠ, যারা মূলত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। মাঝখানে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মিটার উঁচু ভিক্টোরিয়া পাহাড় দ্বারা লম্বালম্বিভাবে দাঁড়িয়ে থাকার কারণে বাদবাকি মিয়ানমারের সঙ্গে রাখাইন রাজ্যের যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনো অনেক কষ্টসাধ্য ও বিপদসংকুল। রোহিঙ্গাদের আদি নিবাস এবং তারা কোন কালে কোথা থেকে এসে এই পাহাড়ি অঞ্চলে বসতি গেড়েছে তা নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতভেদ আছে। তবে কয়েকশ বছর আগে থেকেই রোহিঙ্গারা যে এ অঞ্চলে বসবাস করছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ১৯৪৮ সালে মিয়ানমার স্বাধীন হওয়ার পরপরই এ সমস্যার উদ্ভব হয়। ভাষা, ধর্ম ও সাংস্কৃতিকভাবে বাংলাদেশের বৃহত্তম চট্টগ্রামের লোকজনের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের একটি সাদৃশ্য রয়েছে। ফলে শুরু থেকে মিয়ানমারের সব সরকার, বিশেষ করে ১৯৬২ সালের পর থেকে সামরিক সরকারগুলোর একটা সন্দেহ যে, এ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বৃহত্তর চট্টগ্রামের অধিবাসীদের সহযোগিতায় সুযোগমতো মিয়ানমার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার চেষ্টা করতে পারে। সেখান থেকেই মিয়ানমারের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ও সরকারের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের অবিশ্বাস ও সন্দেহ শুরু হয়। সরকারের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে রোহিঙ্গারা সংগঠিত হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে সীমিত আকারের সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করে। ১৯৮২ সালে সামরিক সরকার আইন করে রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। ফলে সংঘর্ষ বেড়ে যায়, বাড়ে সরকারি বাহিনীর অত্যাচার ও নির্যাতন। একটা সময় পর্যন্ত রোহিঙ্গা মিয়ানমারের আভ্যন্তরীণ সমস্যা ছিল। কিন্তু প্রথমবার ১৯৭৮ এবং দ্বিতীয়বার ১৯৯১ সালে মিয়ানমারের আধা সামরিক বাহিনী নাসাকা এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকজনের সম্মিলিত আক্রমণের ফলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ব্যাপকভাবে রোহিঙ্গাদের আগমন ঘটে। দুই দফায় প্রায় ৩-৪ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসেবে কঙ্বাজার ও টেকনাফ এলাকায় আশ্রয় নেয়। পরবর্তীতে এক থেকে দেড় লাখ শরণার্থী মিয়ানমারে ফেরত যায়। বাংলাদেশে থেকে যাওয়া রোহিঙ্গারা স্বল্পসংখ্যক নির্ধারিত শরণার্থী শিবিরে অবস্থান করলেও, বেশিরভাগই কঙ্বাজার, টেকনাফ এবং চট্টগ্রামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে নিজেদের বলয় সৃষ্টি করে নিজস্ব স্টাইলে বসবাস করতে থাকে। সত্তর দশকের শেষদিকে পাকিস্তানভিত্তিক ধর্মান্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ (হুজি) বাংলাদেশের ধর্মান্ধ গোষ্ঠী জামায়াত ও এর অঙ্গ সংগঠনের সহযোগিতায় বাংলাদেশস্থ রোহিঙ্গাদের মধ্যপ্রাচ্যের অর্থায়নে আফগানিস্তানে সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধে নিয়োজিত করে। আফগানফেরত রোহিঙ্গা যোদ্ধারা গড়ে তোলে একাধিক জঙ্গি সংগঠন, যারা রাখাইন অঞ্চলে নিজেদের দাবি আদায়ে সশস্ত্র সংগ্রামের সূচনা করে। সশস্ত্র সংগঠনের মধ্যে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (RSO); আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (ARNO) এবং আরাকান লিবারেশন ফ্রন্ট (ALF) জাতীয় বেশ কয়েকটি সংগঠন আরাকানের অভ্যন্তরে সশস্ত্র আন্দোলন চালাতে থাকে। তাদের বেশিরভাগ কার্যক্রম পরিচালিত হতো বাংলাদেশ সীমান্ত অঞ্চল থেকে। মিয়ানমারের পক্ষ থেকে অভিযোগ আছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের বেনামি জঙ্গি সংগঠন জেএমবি, জেএমজেবি, হুজি এবং পাকিস্তানভিত্তিক লস্কর-ই-তৈয়বা ও জইসী মুহাম্মদের মতো জঙ্গি সংগঠনগুলো রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্রশস্ত্র দ্বারা সক্রিয়ভাবে আরাকানের ভেতরে অপারেশন পরিচালনায় সহযোগিতা করছে। অভিযোগ আছে, 'রাবেতা আল আলম ইসলামী' নামে একটি এনজিও মধ্যপ্রাচ্যের টাকায় নানা ছদ্মবেশে রোহিঙ্গাদের মধ্যে জঙ্গি প্রশিক্ষণ ও সশস্ত্র তৎপরতায় জড়িত। এ 'রাবেতা আল ইসলামী'র বাংলাদেশি এজেন্ট বা মালিক হচ্ছেন জামায়াতে ইসলামীর একজন নেতা, যিনি সম্প্রতি একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন। অন্যদিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও আইন-শৃঙ্খলার অবনতি হচ্ছে রোহিঙ্গাদের নানারকম দুষ্কর্মের কারণে। অস্ত্র বেচাকেনা, মাদক পাচার, ডাকাতি, ছিনতাইসহ এমন কোনো অপরাধ নেই যার সঙ্গে রোহিঙ্গারা জড়িত নয়। বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে যাচ্ছে এবং সেখানে অপরাধ সংগঠনের কারণে বাংলাদেশের বদনাম হচ্ছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির বা বসতিকেন্দ্রিক জঙ্গি তৎপরতার ফলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে, অন্যদিকে একই সময়ে তা মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের পথে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে অবস্থান করলে তা মিয়ানমার ও বাংলাদেশ উভয় দেশের নিরাপত্তার জন্য বাড়তি হুমকির সৃষ্টি করবে। গত মাসে রাখাইন প্রদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় নতুনভাবে উদ্ভূত রোহিঙ্গা সমস্যা এবং তার রেশ ধরে দুদেশের সরকারের স্ট্যান্ড দেখে বোঝা যায় উভয় সরকারই উপরোক্ত সত্যটি অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছেন। মিয়ানমারের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ সপ্তাহের শুরুতে বাংলাদেশ সফর করে গেলেন।

তিনি আমাদের পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে রোহিঙ্গা ইস্যু সমাধানকল্পে ঘনিষ্ঠভাবে আলোচনা করেছেন। দু-এক মাসের মধ্যে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট জেনারেল থেইন সেইনের বাংলাদেশে আসার কথা রয়েছে। এ সুযোগে রোহিঙ্গা সমস্যাটির একটি স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করা উভয় দেশের জন্য হবে জরুরি এবং মঙ্গলজনক।

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

ই-মেইল : sikder52@gmail.com

আরাফাতের মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না


সুহা আরাফাত
আরাফাতের বিধবা স্ত্রী সুহা আরাফাত আলজাজিরার সঙ্গে এক একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তার স্বামীর মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না। তিনি এটাকে ঘৃণ্য অপরাধ বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি এবং তাদের একমাত্র মেয়ে সুইস একটি প্রতিষ্ঠিত পরীক্ষাগারে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলার সময় এর ফলাফল জানার জন্য কীভাবে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেছেন, তার আনুপূর্বিক বর্ণনা দিয়েছেন। আলজাজিরা থেকে ভাষান্তর করেছেন সুভাষ সাহা

আলজাজিরা :অনুসন্ধানের ফল জানার পর আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
সুহা :আরাফাতের রক্ত, তার পরিধেয় কাপড়-চোপড়, তার টুপি, তার চুল, অন্তর্বাস_ প্রায় সর্বত্র একই তেজস্ক্রিয় পলোনিয়াম পাওয়া গেছে। আসলে তারা উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয় পলোনিয়াম দেখতে পেয়েছেন। তার অর্থ দাঁড়ায়, আরাফাতের মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না।
এখানে আমি অপরাধ সংঘটিত হওয়া দেখতে পাচ্ছি। আর সুইজারল্যান্ডের এই পরীক্ষাগার বিশ্বের সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান। এই ফাইন্ডিংসের সঙ্গে তাদের প্রতিষ্ঠানের সুনাম রক্ষার ব্যাপারটি জড়িয়ে আছে। আর ডাক্তাররা যেটা আবিষ্কার করেছেন, সেটা লুকোছাপার কিছু নেই। এই পর্যায়ে আমরা প্রতিষ্ঠানটির বিশ্বাসযোগ্যতার প্রমাণ পাই।
আরাফাত যখন মৃত্যুবরণ করেন, সেই আট বছর আগে তার শবদেহের কোনোরকম ময়নাতদন্ত হয়নি। তাই আমরা তার মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে কিছুই জানতে পারিনি। তবে এবার যখন তার মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানের অনুরোধ নিয়ে আমার কাছে এলো, তখন আমি তাতে সম্মতি দিই। আমি তখন মনে করি যে, মৃত্যুর পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের আমার কাছে দেওয়া তার পরিধেয় কাপড়চোপড়সহ অন্যান্য জিনিস থেকে এর কিছু আলামত মিলতে পারে। আর এটা জানার পর আলজাজিরা অনেক বড় ঝুঁকি গ্রহণে সম্মত হয়। তখন সুইস পরীক্ষাগারের শরণাপন্ন হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তারা আমার মেয়ের পরীক্ষার জন্য ডিএনএ সংগ্রহ করে। এই তদন্তে মেয়ে আমার সঙ্গেই ছিল। সে প্রকাশ্যে আসতে চায়নি। তবে কীভাবে তার পিতা মৃত্যুবরণ করলেন, কেউ তাকে খুন করেছে কিনা_ সেসব জানার জন্য সে সবসময় উদগ্রীব থাকত। এ কারণেই সে তার ডিএনএ দিয়েছিল। তার ডিএনএ পাওয়ার পর তারা আমার দেওয়া কাপড়চোপড় ও জিনিসপত্র থেকে পাওয়া ডিএনএর সঙ্গে এর মিল খুঁজতে পরীক্ষা চালায়। উভয় ডিএনএর মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তখন তারা নিশ্চিত হয় যে, আমার দেওয়া কাপড়চোপড় ও জিনিসপত্র আরাফাতেরই।
আমরা নয় মাস আগে এই কাজ শুরু করি। আর এতদিন ধরে সঙ্গোপনে একটা অনুসন্ধান কাজ চালানো যে কতটা কঠিন, তা সহজেই অনুমেয়। আমাকে তার প্রতিটা জিনিস খুঁজে বের করতে হয়েছে। তার ওষুধপত্র, তার ঘড়ি_ সবকিছু। এর ফল পেতে আমাদের তিন মাস অপেক্ষা করতে হয়। কারণ, পলোনিয়ামের পরিমাণ কেমন ছিল এবং তা কতটা উচ্চমাত্রার ছিল, সেটা নির্ণয় করা কঠিন কাজ ছিল। এজন্য পরীক্ষাগারটিকে উচ্চ জটিল পরীক্ষা সম্পন্ন করতে হয়।
তারা আরাফাতের কাপড়চোপড় ও জিনিসপত্রে উচ্চমাত্রার যে পলোনিয়ামের সন্ধান পেল, সেটা স্বাভাবিক পলোনিয়াম নয়। এটা ছিল তেজস্ক্রিয় পলোনিয়াম। এ ধরনের তেজস্ক্রিয় পদার্থ সাধারণত অত্যন্ত উন্নত দেশের কাছে থাকে। আমি আসলে এর মাধ্যমে কী বোঝাতে চাইছি, সেটা খোলাসা করে বলার দরকার পড়ে না।
সুতরাং আমরা এখন তার মৃত্যুর ব্যাপারে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, তার মৃত্যুটা স্বাভাবিক ছিল না। ফিলিস্তিনি জনগণ, আরব ও গোটা মুসলিম জাহান এই সত্য জানতে পারবে।
তদন্তের এই ফল পাওয়ার পর আমি অবশ্যই এখন তার দেহাবশেষ কবর থেকে তুলে পরীক্ষার আবেদন জানাব। ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করবে বলে আশা রাখি। আর তারাও তাদের নেতার মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানতে আগ্রহী। চিকিৎসকরা বলেছেন, এতদিন পর কবর থেকে লাশ তুলে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে পলোনিয়ামের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে সেটা যদি উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয়তাসম্পন্ন হয়, তাহলেই কিছুটা পরিমাণে তার অস্তিত্ব মিললেও মিলতে পারে। সুইস চিকিৎসকরা যদিও নিশ্চিত যে, আরাফাতের মৃত্যু এই পলোনিয়াম প্রয়োগেই হয়েছিল, তারপরও বিষয়টি স্পর্শকাতর বিধায় তারা কবর থেকে তার দেহাবশেষ তুলে পরীক্ষা করার মাধ্যমে সব বিতর্কের অবসান ঘটাতে চায়। তবে তাড়াতাড়ি করাটাই ভালো বলে মনে করেন তারা। কারণ বেশি দেরি হয়ে গেলে দেহে পলোনিয়ামের অস্তিত্ব নাও মিলতে পারে।
যদি সত্যি সত্যিই আরাফাতের দেহে পলোনিয়াম প্রয়োগ করা হয়ে থাকে, তবে সব হাড়গোড়েই এর অস্তিত্ব মিলতে পারে। কারণ এটা সারা দেহে ছড়িয়ে যায়।
আমি জানি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে আন্তরিক। কিন্তু তার স্ত্রী হিসেবে আমি আমার কর্তব্য করে যাচ্ছি। আর এ ব্যাপারে চূড়ান্ত দায়টা আমি এবং আমার ১৮ বছরের মেয়ের। সুইস পরীক্ষাগার দিয়ে তদন্তের ব্যাপারে আমাদের অনুমতি ছিল। ফ্রান্স হাসপাতালে যেখানে আরাফাতের চিকিৎসা চলেছে এবং যেখানে তিনি মৃত্যুবরণ করেন, সেখানকার চিকিৎসকদের আমি সব নমুনা সংরক্ষণের জন্য বলেছিলাম। কিন্তু এবার যখন তার রক্ত ও মূত্রের নমুনা চাইতে গেলাম, আমাকে জানানো হলো, তারা সবকিছু ধ্বংস করে ফেলেছে।
আমি তাদের এই জবাবে সন্তুষ্ট হতে পারিনি। সাধারণত ইয়াসির আরাফাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির দেহের বিভিন্ন পরীক্ষার চিহ্ন তারা রাখবেই_ এটাই স্বতঃসিদ্ধ। মনে হয়, তারা এটাকে ঝামেলা মনে করেছে। এতে তারা জড়িত থাকতে চায়নি। যারা তার চিকিৎসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন এমন ৫০ জনের মতো চিকিৎসকের কাছে আমি তথ্য পাওয়ার জন্য চিঠি লিখি। এদের মধ্যে কেউ তথ্য দেন, কেউ অপারগতা প্রকাশ করেন।
আলজাজিরা :আপনার স্বামীর মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করা এবং তার ব্যবহৃত জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করাসহ গোটা অনুসন্ধান প্রক্রিয়াটায় আপনার কেমন বোধ হয়েছে?
সুহা :এটা অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক ছিল। আরও কষ্টের ছিল কারণ, এর সঙ্গে আমার মেয়েও জড়িত ছিল। আমরা তদন্তকাজ চলার সময় দেখেছি, এ নিয়ে অনেকেই আমাদের এড়িয়ে যাচ্ছেন। এ সময় আমার মেয়েকে নিয়ে বারবার হাসপাতালে ছুটে যেতে আমার মনে কষ্টকর অনুভূতি হয়েছে। আর যেহেতু প্রতিরক্ষা গোপনীয়তার সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল পলোনিয়াম, যার অনুসন্ধানে অনেক প্রতিকূলতাকে আমাদের জয় করতে হয়েছে। কারণ, যারা আমাদের তথ্য দেবে তাদের চাকরি হারানোর ভয় ছিল। তবে এটা যন্ত্রণাদায়ক হলেও আমরা আমাদের প্রতিজ্ঞায় ছিলাম অটল। আর যখন এটা পরিষ্কার হচ্ছিল যে, আরাফাতের মত্যুর সঙ্গে একটা গভীর ষড়যন্ত্র রয়েছে, ততই আমাদের চেষ্টা জোরদার হয়। আর তখনকার সময়ে আরাফাত সম্পর্কে ইসরায়েলি নেতৃবৃন্দ ও মার্কিন প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের মন্তব্য মনে করুন। দেখবেন, তারা প্রায় সবাই সমস্বরে আরাফাতকে অপ্রাসঙ্গিক ও শান্তির পথে কাঁটা বলে অভিহিত করছেন। ইসরায়েলের অ্যারিয়েল শ্যারন তো বলেছেন, ঈশ্বর আরাফাতকে তুলে নিয়ে ভালোই করেছেন। না হয় তারাই তাকে খুন করতেন। আর সে সময় আমরা চোখের জলে ভাসছিলাম।
দেখুন, একদিকে আরব বিপ্লবের একনায়কদের শাসনের অবসান ঘটছে, অন্যদিকে এই মানুষরাই দলে দলে আরাফাতের কবরে গিয়ে দোয়া পড়ছে। তাদের কাছে তিনি একজন পীরের মতো। আমরা ফিলিস্তিনের জনগণ হিসেবে এতে গর্ববোধ করি।
আমি ন্যায়বিচারে বিশ্বাস করি। জীবৎকালে বিচার না মিললেও মৃত্যুকালে তা মিলবে। আরব বিপ্লব আসলে এই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম।
আলজাজিরা :তার উত্তরাধিকার বলতে আপনি কী বোঝাতে চান?
সুহা :কোনো ভূমির স্বত্ব ত্যাগ না করা।
আলজাজিরা :আরাফাতের দেহাবশেষ কবর থেকে তুলতে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ও ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের প্রয়োজন হবে। তারা কি আপনাকে অনুমতি দেবে?
সুহা :আমি ইসরায়েলের ব্যাপারে সন্দিহান। তবে চাপ পড়লে তারাও শেষ পর্যন্ত রাজি হতে পারে। তবে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ মৃত্যুরহস্যের কিনারা দেখতে চাইবে। এটাই তো স্বাভাবিক।
আলজাজিরা :পরবর্তী পরীক্ষায়ও যদি একই ফলাফল মেলে, তাহলে ফিলিস্তিনের কোনো পরিবর্তন হবে কি?
সুহা :ফিলিস্তিনে অনেক কিছুই পরিবর্তিত হয়ে যাবে। অনেক সন্দেহ দূরীভূত হবে। কোনো কোনো মানুষ বলেন যে, আরাফাত ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি গ্রহণ করেননি। শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চাননি। তাদের মুখ বন্ধ হবে। আরাফাত আসলে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে শান্তিকে যুক্ত করেছিলেন। জেরুজালেম ছেড়ে দিয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে কোনো আলোচক শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা ভাবতে পারবেন না। তখন ১৯৬৭ সালের সীমান্ত, স্বভূমিতে প্রত্যাবর্তন, বন্দি, পানি_ সব বিষয়ই সামনে চলে আসবে।
আগামী ৫০ বছরেও কোনো আলোচনা আরাফাত যে বিশ্বাসের বীজ আমাদের মধ্যে বপন করে গেছেন, তার থেকে এক চুলও হেলাতে পারবে না। জনগণ আজ জেগে উঠছে।