মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার, পিএসসি (অব.)
ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায়। শক্তিশালী প্রতিবেশী ভারতের স্থল সীমান্ত রয়েছে বাংলাদেশের চতুর্দিক ঘিরে। ভারত ব্যতীত অন্য যে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের স্থল সীমান্ত আছে সেটি হলো মিয়ানমার। মিয়ানমার আমাদের পূর্বদিকের প্রতিবেশী, যে দেশের সঙ্গে আমাদের স্থল সীমানার দৈর্ঘ্য প্রায় ২৪৩ কি. মি.। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক সূত্রে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের যত বেশি যোগাযোগ রয়েছে, মিয়ানমারের সঙ্গে সঙ্গত কারণেই ততটা নেই। তবে ভৌগোলিক অবস্থান এবং মিয়ানমারের উদার ও বহুমুখী বৈদেশিক সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহ প্রকাশের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ বাংলাদেশের জন্য নতুন অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করেছে। মিয়ানমারের সঙ্গে স্থলপথে সংযোগ স্থাপিত হলে বিশ্বের উদীয়মান শক্তি চীন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্য প্রায় সব দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক লেনদেন বাংলাদেশ স্বল্প সময়ে ও খরচে করতে সক্ষম হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সেতু বা ব্রিজ হিসেবে কাজ করতে পারে মিয়ানমার। ১৯৬২ সালে সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে বন্ধ হয়ে যাওয়া দরজা মিয়ানমার ধীরে ধীরে খুলে দিচ্ছে। ফলে বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর দেশটির প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তিসমূহের ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে। ছয় লাখ ৭৬ হাজার ৫৫২ বর্গকিলোমিটার আয়তনের মিয়ানমার বাংলাদেশ থেকে প্রায় চার গুণ বড়। তবে মিয়ানমারের লোকসংখ্যা আমাদের এক-তৃতীয়াংশ, প্রায় ছয় কোটি। অথচ দেশটিতে রয়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ সদস্যের শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনী, যা আকারের দিক থেকে পৃথিবীর নবম বৃহত্তম। ১৯৪৮ সালে তৎকালীন নাম বার্মা, বর্তমানের মিয়ানমার ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতার পর এক যুগেরও কিছু বেশি সময় মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ছিল। কিন্তু ১৯৬২ সালের ২ মার্চ এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে নেয় সে দেশের সামরিক বাহিনী। তারপর থেকে মিয়ানমার সামরিক শাসনের গ্যাঁড়াকলে পড়ে আছে, যেখান থেকে এখনো সম্পূর্ণভাবে বের হতে পারেনি। ১৯৯০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) কাছে শাসনক্ষমতা হস্তান্তর না করে সে দলের নেতা অং সান সু চিকে বন্দী করা হয় এবং গণতন্ত্রকামীদের ওপর শুরু হয় জেল-জুলুম, অত্যাচার ও নির্যাতন। ফলে মিয়ানমারের সামরিক সরকার যুক্তরাষ্ট্রসহ সব পশ্চিমা বিশ্বের সর্বাত্দক নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে। ফলে এক বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্রে পরিণত হয় দেশটি। আমেরিকার অবরোধ ও অবহেলার কারণে মিয়ানমারের সামরিক সরকার চীনকে বিনিয়োগের আমন্ত্রণ জানায়। চীনও তার সুদূরপ্রসারী গ্র্যান্ড স্ট্র্যাটেজির অংশ হিসেবে দক্ষিণ চীন সাগরের বিকল্প পথের সন্ধানে বঙ্গোপসাগর হয়ে ভারত মহাসাগরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের জন্য মিয়ানমারের উপকূলে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ থেকে শুরু করে সড়ক ও রেলপথ উন্নয়নে বড় আকারের বিনিয়োগ করে। সামরিক বাহিনীর সব শাখায় অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ এবং প্রশিক্ষণ প্রদানে অংশ নেয়। তেল, গ্যাস ও খনি শিল্প, বলা যায় একচেটিয়া বিনিয়োগ আধিপত্য বিস্তার করে চীনা কোম্পানিগুলো। কিন্তু ২০০৮ সালে সীমিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচিত অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলদের কর্তৃত্বাধীন বর্তমান মিয়ানমার সরকার চীনের ওপর নজিরবিহীন নির্ভরতার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সজাগ হয়। ফলে ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে মিয়ানমার আন্তর্জাতিক সম্পর্কে একটা ভারসাম্য আনার জন্য ওপেন নীতি গ্রহণ করে এবং এনএলডি নেত্রী অং সান সু চিকে মুক্ত করে নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ করে দেয়। এতদিন মিয়ানমার বিশ্বের দুটি জনবহুল রাষ্ট্র চীন ও ভারতের 'বাফার স্টেটের ভূমিকা পালন করে আসছিল। কিন্তু এখন থেকে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নতুন সামরিক কৌশলের অংশ হিসেবে চীনের প্রভাবকে সীমিত করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও যে মিয়ানমারকে এক ধরনের বাফার স্টেট হিসেবে ব্যবহার করতে চাইবে তা সহজেই অনুমান করা যায়। সাম্প্রতিক সময়ে সমুদ্র সীমানার মতবিরোধ নিষ্পত্তিতে উইন উইন পরিস্থিতি এবং জুন মাসের প্রথমদিকে সৃষ্ট রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ সরকারের সঠিক স্ট্যান্ডের কারণে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নতুন মাত্রায় ওঠার উজ্জ্বল সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শক্তিশালী অর্থনৈতিক জোট আসিয়ানের (অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথ-ইস্ট এশিয়ান নেশন্স) সদস্য সংখ্যা মিয়ানমারসহ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১০টি রাষ্ট্র। অন্য সদস্য হলো_ ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ব্রুনাই, ভিয়েতনাম, লাওস এবং কম্বোডিয়া। এসব দেশের সঙ্গে স্থলপথে সংযোগ স্থাপনকল্পে বাংলাদেশের জন্য একমাত্র গেটওয়ে রাষ্ট্র মিয়ানমার। ৫৫ কোটি মানুষের আসিয়ান এখন বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী অঞ্চল। ফলে তাবৎ বিশ্বের আকর্ষণ ও দৃষ্টি এখন এই দেশগুলোর দিকে। পশ্চিমা বিশ্ব এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আসিয়ানের বাড়তি গুরুত্বের কারণ হলো বিশ্বশক্তি হওয়ার পথে দ্রুত ধাবমান চীন ও ভারতের অবস্থান এ অঞ্চলে। সঙ্গত কারণেই ভারত ও চীন উভয়েই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তাদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা বহু আগে থেকেই অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। আসিয়ান দেশগুলোর অভ্যন্তরে এবং উপকূলীয় অঞ্চলে তেল-গ্যাসের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। দ্রুত প্রবৃদ্ধির ফলে জনশক্তি এবং ভোগ্যপণ্যের চাহিদাও এসব দেশে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তা ছাড়া কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম এবং মিয়ানমারে কৃষি উপযোগী জমির তুলনায় জনসংখ্যা কম হওয়ায় এ দেশগুলোতে বিপুল পরিমাণ জমি অনাবাদি পড়ে থাকে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা যেভাবে বাড়ছে এবং কৃষি জমি দিন দিন যে হারে কমে যাচ্ছে তাতে ওইসব দেশে যদি বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি উদ্যোক্তারা কৃষি ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে পারে, তাহলে একদিকে যেমন বাংলাদেশের অদক্ষ জনশক্তির জন্য ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে, তেমনি আগামীতে আমাদের বাড়তি জনসংখ্যার জন্য খাদ্যশস্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিকল্প সম্ভাবনার পথ খুলে যাবে। মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া এবং লাওস ব্যাপকভাবে বনজসম্পদে সমৃদ্ধিশালী দেশ। অধিক জনসংখ্যা ও স্বল্প আয়তনের দেশ হিসেবে বাংলাদেশে বনজসম্পদের সীমাবদ্ধতা ও ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। ভবিষ্যতে ঘাটতি আরও বৃদ্ধি পাবে। এ ঘাটতি পূরণে স্থলপথে কম খরচে এসব দেশ থেকে টিম্বার ও কাঠ আমদানি করার সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের। আসিয়ান জোটের দেশগুলোর সঙ্গে বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরও সুসংহত করে অপার সম্ভাবনাময় সুযোগের সদ্ব্যবহার করার জন্য বাংলাদেশ যদি মিয়ানমারকে গেটওয়ে হিসেবে কাজে লাগাতে পারে তাহলে সেটি হবে আমাদের জন্য সহজ এবং অর্থনৈতিকভাবে অধিকতর লাভজনক। উদীয়মান বিশ্বশক্তি চীনের সঙ্গে আমাদের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক এখন বহুমুখী। স্থলপথে চীনের সঙ্গে সংযোগ সৃষ্টি করার জন্য ভায়া মিয়ানমারই সবচেয়ে সহজতর পন্থা। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের বিদ্যমান সম্পর্ককে কূটনৈতিক ভাষায় ওয়ার্কিং রিলেশন বলা যায়। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আশানুরূপ পর্যায় না থাকার বহুবিধ কারণ রয়েছে। প্রথমত. ১৯৬২ সাল থেকে মিয়ানমারে সামরিক শাসন থাকায় তারা নিজেরাই কিছুটা অন্তর্মুখী নীতি গ্রহণ করে এবং বহির্বিশ্ব থেকে মোটামুটি বিচ্ছিন্ন থাকে। শুধু চীনের সঙ্গে সামরিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং চীন অত্যন্ত দূরদৃষ্টির মাধ্যমে এ সম্পদশালী দেশটির সব ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। ১৯৬৭ সালে আসিয়ান জোট গঠিত হলেও মিয়ানমার এর সদস্য হয় অনেক পরে, ১৯৯৭ সালে। ভারত অনেক পরে মিয়ানমারের দিকে নজর দেয়। সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং মিয়ানমার সফর করেছেন। বঙ্গোপসাগরে ভারতের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের ঠিক বিপরীতে, অর্থাৎ পূর্বদিকে মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের দক্ষিণদিকে সমান্তরালভাবে প্রসারিত লম্বা লেজের মতো দেখতে ভূখণ্ডে অবস্থিত মিয়ানমারের 'দাউই' বন্দর নির্মাণ করার জন্য ভারত মিয়ানমার একমত হয়েছে। এ বন্দরের মাধ্যমে ভারত আসিয়ান জোটের অন্যান্য দেশের সঙ্গে স্থলপথে যোগাযোগ স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে। একইসঙ্গে মিয়ানমারের আকিয়াব বন্দর ব্যবহার করে ভারত তার উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের সাত প্রদেশের সঙ্গে বিকল্প পথে যোগাযোগ স্থাপনের চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। আগামী চার বছরের মধ্যে উলি্লখিত বন্দরগুলোর নির্মাণ এবং সড়ক ও রেলপথ উন্নয়নের কাজ শেষে ভারত তার পূর্বাঞ্চলের প্রদেশ এবং আসিয়ান দেশগুলোর সঙ্গে স্বল্প দূরত্বের কানেক্টিভিটি সম্পন্ন করতে চায়। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ যদি সঠিক কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে সম্ভাবনাময় কানেক্টিভিটির সঙ্গে সংযোজিত না হতে পারে তাহলে এতদাঞ্চলে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। সুতরাং এতদাঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে একটা ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা এবং আঞ্চলিক সম্ভাবনাকে নিজেদের অনুকূলে কাজে লাগানোর লক্ষ্যে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের উন্নত সম্পর্ক থাকা বাঞ্ছনীয়। এ মুহূর্তে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের পথে অন্যতম বাধা হিসেবে দাঁড়িয়েছে বহুদিন যাবৎ চলে আসা রোহিঙ্গা সমস্যা। রোহিঙ্গা হচ্ছে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে বসবাসকারী মুসলমান জনগোষ্ঠী। এই রাখাইন প্রদেশের সঙ্গে বাংলাদেশের কঙ্বাজারের স্থলসীমান্ত রয়েছে। রাখাইন রাজ্যে রাখাইন সম্প্রদায় সংখ্যাগরিষ্ঠ, যারা মূলত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। মাঝখানে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মিটার উঁচু ভিক্টোরিয়া পাহাড় দ্বারা লম্বালম্বিভাবে দাঁড়িয়ে থাকার কারণে বাদবাকি মিয়ানমারের সঙ্গে রাখাইন রাজ্যের যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনো অনেক কষ্টসাধ্য ও বিপদসংকুল। রোহিঙ্গাদের আদি নিবাস এবং তারা কোন কালে কোথা থেকে এসে এই পাহাড়ি অঞ্চলে বসতি গেড়েছে তা নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতভেদ আছে। তবে কয়েকশ বছর আগে থেকেই রোহিঙ্গারা যে এ অঞ্চলে বসবাস করছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ১৯৪৮ সালে মিয়ানমার স্বাধীন হওয়ার পরপরই এ সমস্যার উদ্ভব হয়। ভাষা, ধর্ম ও সাংস্কৃতিকভাবে বাংলাদেশের বৃহত্তম চট্টগ্রামের লোকজনের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের একটি সাদৃশ্য রয়েছে। ফলে শুরু থেকে মিয়ানমারের সব সরকার, বিশেষ করে ১৯৬২ সালের পর থেকে সামরিক সরকারগুলোর একটা সন্দেহ যে, এ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বৃহত্তর চট্টগ্রামের অধিবাসীদের সহযোগিতায় সুযোগমতো মিয়ানমার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার চেষ্টা করতে পারে। সেখান থেকেই মিয়ানমারের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ও সরকারের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের অবিশ্বাস ও সন্দেহ শুরু হয়। সরকারের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে রোহিঙ্গারা সংগঠিত হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে সীমিত আকারের সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করে। ১৯৮২ সালে সামরিক সরকার আইন করে রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। ফলে সংঘর্ষ বেড়ে যায়, বাড়ে সরকারি বাহিনীর অত্যাচার ও নির্যাতন। একটা সময় পর্যন্ত রোহিঙ্গা মিয়ানমারের আভ্যন্তরীণ সমস্যা ছিল। কিন্তু প্রথমবার ১৯৭৮ এবং দ্বিতীয়বার ১৯৯১ সালে মিয়ানমারের আধা সামরিক বাহিনী নাসাকা এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকজনের সম্মিলিত আক্রমণের ফলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ব্যাপকভাবে রোহিঙ্গাদের আগমন ঘটে। দুই দফায় প্রায় ৩-৪ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসেবে কঙ্বাজার ও টেকনাফ এলাকায় আশ্রয় নেয়। পরবর্তীতে এক থেকে দেড় লাখ শরণার্থী মিয়ানমারে ফেরত যায়। বাংলাদেশে থেকে যাওয়া রোহিঙ্গারা স্বল্পসংখ্যক নির্ধারিত শরণার্থী শিবিরে অবস্থান করলেও, বেশিরভাগই কঙ্বাজার, টেকনাফ এবং চট্টগ্রামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে নিজেদের বলয় সৃষ্টি করে নিজস্ব স্টাইলে বসবাস করতে থাকে। সত্তর দশকের শেষদিকে পাকিস্তানভিত্তিক ধর্মান্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ (হুজি) বাংলাদেশের ধর্মান্ধ গোষ্ঠী জামায়াত ও এর অঙ্গ সংগঠনের সহযোগিতায় বাংলাদেশস্থ রোহিঙ্গাদের মধ্যপ্রাচ্যের অর্থায়নে আফগানিস্তানে সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধে নিয়োজিত করে। আফগানফেরত রোহিঙ্গা যোদ্ধারা গড়ে তোলে একাধিক জঙ্গি সংগঠন, যারা রাখাইন অঞ্চলে নিজেদের দাবি আদায়ে সশস্ত্র সংগ্রামের সূচনা করে। সশস্ত্র সংগঠনের মধ্যে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (RSO); আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (ARNO) এবং আরাকান লিবারেশন ফ্রন্ট (ALF) জাতীয় বেশ কয়েকটি সংগঠন আরাকানের অভ্যন্তরে সশস্ত্র আন্দোলন চালাতে থাকে। তাদের বেশিরভাগ কার্যক্রম পরিচালিত হতো বাংলাদেশ সীমান্ত অঞ্চল থেকে। মিয়ানমারের পক্ষ থেকে অভিযোগ আছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের বেনামি জঙ্গি সংগঠন জেএমবি, জেএমজেবি, হুজি এবং পাকিস্তানভিত্তিক লস্কর-ই-তৈয়বা ও জইসী মুহাম্মদের মতো জঙ্গি সংগঠনগুলো রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্রশস্ত্র দ্বারা সক্রিয়ভাবে আরাকানের ভেতরে অপারেশন পরিচালনায় সহযোগিতা করছে। অভিযোগ আছে, 'রাবেতা আল আলম ইসলামী' নামে একটি এনজিও মধ্যপ্রাচ্যের টাকায় নানা ছদ্মবেশে রোহিঙ্গাদের মধ্যে জঙ্গি প্রশিক্ষণ ও সশস্ত্র তৎপরতায় জড়িত। এ 'রাবেতা আল ইসলামী'র বাংলাদেশি এজেন্ট বা মালিক হচ্ছেন জামায়াতে ইসলামীর একজন নেতা, যিনি সম্প্রতি একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন। অন্যদিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও আইন-শৃঙ্খলার অবনতি হচ্ছে রোহিঙ্গাদের নানারকম দুষ্কর্মের কারণে। অস্ত্র বেচাকেনা, মাদক পাচার, ডাকাতি, ছিনতাইসহ এমন কোনো অপরাধ নেই যার সঙ্গে রোহিঙ্গারা জড়িত নয়। বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে যাচ্ছে এবং সেখানে অপরাধ সংগঠনের কারণে বাংলাদেশের বদনাম হচ্ছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির বা বসতিকেন্দ্রিক জঙ্গি তৎপরতার ফলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে, অন্যদিকে একই সময়ে তা মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের পথে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে অবস্থান করলে তা মিয়ানমার ও বাংলাদেশ উভয় দেশের নিরাপত্তার জন্য বাড়তি হুমকির সৃষ্টি করবে। গত মাসে রাখাইন প্রদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় নতুনভাবে উদ্ভূত রোহিঙ্গা সমস্যা এবং তার রেশ ধরে দুদেশের সরকারের স্ট্যান্ড দেখে বোঝা যায় উভয় সরকারই উপরোক্ত সত্যটি অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছেন। মিয়ানমারের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ সপ্তাহের শুরুতে বাংলাদেশ সফর করে গেলেন।
তিনি আমাদের পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে রোহিঙ্গা ইস্যু সমাধানকল্পে ঘনিষ্ঠভাবে আলোচনা করেছেন। দু-এক মাসের মধ্যে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট জেনারেল থেইন সেইনের বাংলাদেশে আসার কথা রয়েছে। এ সুযোগে রোহিঙ্গা সমস্যাটির একটি স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করা উভয় দেশের জন্য হবে জরুরি এবং মঙ্গলজনক।
লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক।
ই-মেইল : sikder52@gmail.com
ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায়। শক্তিশালী প্রতিবেশী ভারতের স্থল সীমান্ত রয়েছে বাংলাদেশের চতুর্দিক ঘিরে। ভারত ব্যতীত অন্য যে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের স্থল সীমান্ত আছে সেটি হলো মিয়ানমার। মিয়ানমার আমাদের পূর্বদিকের প্রতিবেশী, যে দেশের সঙ্গে আমাদের স্থল সীমানার দৈর্ঘ্য প্রায় ২৪৩ কি. মি.। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক সূত্রে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের যত বেশি যোগাযোগ রয়েছে, মিয়ানমারের সঙ্গে সঙ্গত কারণেই ততটা নেই। তবে ভৌগোলিক অবস্থান এবং মিয়ানমারের উদার ও বহুমুখী বৈদেশিক সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহ প্রকাশের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ বাংলাদেশের জন্য নতুন অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করেছে। মিয়ানমারের সঙ্গে স্থলপথে সংযোগ স্থাপিত হলে বিশ্বের উদীয়মান শক্তি চীন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্য প্রায় সব দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক লেনদেন বাংলাদেশ স্বল্প সময়ে ও খরচে করতে সক্ষম হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সেতু বা ব্রিজ হিসেবে কাজ করতে পারে মিয়ানমার। ১৯৬২ সালে সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে বন্ধ হয়ে যাওয়া দরজা মিয়ানমার ধীরে ধীরে খুলে দিচ্ছে। ফলে বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর দেশটির প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তিসমূহের ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে। ছয় লাখ ৭৬ হাজার ৫৫২ বর্গকিলোমিটার আয়তনের মিয়ানমার বাংলাদেশ থেকে প্রায় চার গুণ বড়। তবে মিয়ানমারের লোকসংখ্যা আমাদের এক-তৃতীয়াংশ, প্রায় ছয় কোটি। অথচ দেশটিতে রয়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ সদস্যের শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনী, যা আকারের দিক থেকে পৃথিবীর নবম বৃহত্তম। ১৯৪৮ সালে তৎকালীন নাম বার্মা, বর্তমানের মিয়ানমার ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতার পর এক যুগেরও কিছু বেশি সময় মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ছিল। কিন্তু ১৯৬২ সালের ২ মার্চ এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে নেয় সে দেশের সামরিক বাহিনী। তারপর থেকে মিয়ানমার সামরিক শাসনের গ্যাঁড়াকলে পড়ে আছে, যেখান থেকে এখনো সম্পূর্ণভাবে বের হতে পারেনি। ১৯৯০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) কাছে শাসনক্ষমতা হস্তান্তর না করে সে দলের নেতা অং সান সু চিকে বন্দী করা হয় এবং গণতন্ত্রকামীদের ওপর শুরু হয় জেল-জুলুম, অত্যাচার ও নির্যাতন। ফলে মিয়ানমারের সামরিক সরকার যুক্তরাষ্ট্রসহ সব পশ্চিমা বিশ্বের সর্বাত্দক নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে। ফলে এক বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্রে পরিণত হয় দেশটি। আমেরিকার অবরোধ ও অবহেলার কারণে মিয়ানমারের সামরিক সরকার চীনকে বিনিয়োগের আমন্ত্রণ জানায়। চীনও তার সুদূরপ্রসারী গ্র্যান্ড স্ট্র্যাটেজির অংশ হিসেবে দক্ষিণ চীন সাগরের বিকল্প পথের সন্ধানে বঙ্গোপসাগর হয়ে ভারত মহাসাগরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের জন্য মিয়ানমারের উপকূলে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ থেকে শুরু করে সড়ক ও রেলপথ উন্নয়নে বড় আকারের বিনিয়োগ করে। সামরিক বাহিনীর সব শাখায় অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ এবং প্রশিক্ষণ প্রদানে অংশ নেয়। তেল, গ্যাস ও খনি শিল্প, বলা যায় একচেটিয়া বিনিয়োগ আধিপত্য বিস্তার করে চীনা কোম্পানিগুলো। কিন্তু ২০০৮ সালে সীমিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচিত অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলদের কর্তৃত্বাধীন বর্তমান মিয়ানমার সরকার চীনের ওপর নজিরবিহীন নির্ভরতার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সজাগ হয়। ফলে ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে মিয়ানমার আন্তর্জাতিক সম্পর্কে একটা ভারসাম্য আনার জন্য ওপেন নীতি গ্রহণ করে এবং এনএলডি নেত্রী অং সান সু চিকে মুক্ত করে নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ করে দেয়। এতদিন মিয়ানমার বিশ্বের দুটি জনবহুল রাষ্ট্র চীন ও ভারতের 'বাফার স্টেটের ভূমিকা পালন করে আসছিল। কিন্তু এখন থেকে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নতুন সামরিক কৌশলের অংশ হিসেবে চীনের প্রভাবকে সীমিত করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও যে মিয়ানমারকে এক ধরনের বাফার স্টেট হিসেবে ব্যবহার করতে চাইবে তা সহজেই অনুমান করা যায়। সাম্প্রতিক সময়ে সমুদ্র সীমানার মতবিরোধ নিষ্পত্তিতে উইন উইন পরিস্থিতি এবং জুন মাসের প্রথমদিকে সৃষ্ট রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ সরকারের সঠিক স্ট্যান্ডের কারণে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নতুন মাত্রায় ওঠার উজ্জ্বল সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শক্তিশালী অর্থনৈতিক জোট আসিয়ানের (অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথ-ইস্ট এশিয়ান নেশন্স) সদস্য সংখ্যা মিয়ানমারসহ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১০টি রাষ্ট্র। অন্য সদস্য হলো_ ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ব্রুনাই, ভিয়েতনাম, লাওস এবং কম্বোডিয়া। এসব দেশের সঙ্গে স্থলপথে সংযোগ স্থাপনকল্পে বাংলাদেশের জন্য একমাত্র গেটওয়ে রাষ্ট্র মিয়ানমার। ৫৫ কোটি মানুষের আসিয়ান এখন বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী অঞ্চল। ফলে তাবৎ বিশ্বের আকর্ষণ ও দৃষ্টি এখন এই দেশগুলোর দিকে। পশ্চিমা বিশ্ব এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আসিয়ানের বাড়তি গুরুত্বের কারণ হলো বিশ্বশক্তি হওয়ার পথে দ্রুত ধাবমান চীন ও ভারতের অবস্থান এ অঞ্চলে। সঙ্গত কারণেই ভারত ও চীন উভয়েই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তাদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা বহু আগে থেকেই অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। আসিয়ান দেশগুলোর অভ্যন্তরে এবং উপকূলীয় অঞ্চলে তেল-গ্যাসের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। দ্রুত প্রবৃদ্ধির ফলে জনশক্তি এবং ভোগ্যপণ্যের চাহিদাও এসব দেশে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তা ছাড়া কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম এবং মিয়ানমারে কৃষি উপযোগী জমির তুলনায় জনসংখ্যা কম হওয়ায় এ দেশগুলোতে বিপুল পরিমাণ জমি অনাবাদি পড়ে থাকে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা যেভাবে বাড়ছে এবং কৃষি জমি দিন দিন যে হারে কমে যাচ্ছে তাতে ওইসব দেশে যদি বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি উদ্যোক্তারা কৃষি ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে পারে, তাহলে একদিকে যেমন বাংলাদেশের অদক্ষ জনশক্তির জন্য ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে, তেমনি আগামীতে আমাদের বাড়তি জনসংখ্যার জন্য খাদ্যশস্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিকল্প সম্ভাবনার পথ খুলে যাবে। মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া এবং লাওস ব্যাপকভাবে বনজসম্পদে সমৃদ্ধিশালী দেশ। অধিক জনসংখ্যা ও স্বল্প আয়তনের দেশ হিসেবে বাংলাদেশে বনজসম্পদের সীমাবদ্ধতা ও ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। ভবিষ্যতে ঘাটতি আরও বৃদ্ধি পাবে। এ ঘাটতি পূরণে স্থলপথে কম খরচে এসব দেশ থেকে টিম্বার ও কাঠ আমদানি করার সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের। আসিয়ান জোটের দেশগুলোর সঙ্গে বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরও সুসংহত করে অপার সম্ভাবনাময় সুযোগের সদ্ব্যবহার করার জন্য বাংলাদেশ যদি মিয়ানমারকে গেটওয়ে হিসেবে কাজে লাগাতে পারে তাহলে সেটি হবে আমাদের জন্য সহজ এবং অর্থনৈতিকভাবে অধিকতর লাভজনক। উদীয়মান বিশ্বশক্তি চীনের সঙ্গে আমাদের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক এখন বহুমুখী। স্থলপথে চীনের সঙ্গে সংযোগ সৃষ্টি করার জন্য ভায়া মিয়ানমারই সবচেয়ে সহজতর পন্থা। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের বিদ্যমান সম্পর্ককে কূটনৈতিক ভাষায় ওয়ার্কিং রিলেশন বলা যায়। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আশানুরূপ পর্যায় না থাকার বহুবিধ কারণ রয়েছে। প্রথমত. ১৯৬২ সাল থেকে মিয়ানমারে সামরিক শাসন থাকায় তারা নিজেরাই কিছুটা অন্তর্মুখী নীতি গ্রহণ করে এবং বহির্বিশ্ব থেকে মোটামুটি বিচ্ছিন্ন থাকে। শুধু চীনের সঙ্গে সামরিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং চীন অত্যন্ত দূরদৃষ্টির মাধ্যমে এ সম্পদশালী দেশটির সব ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। ১৯৬৭ সালে আসিয়ান জোট গঠিত হলেও মিয়ানমার এর সদস্য হয় অনেক পরে, ১৯৯৭ সালে। ভারত অনেক পরে মিয়ানমারের দিকে নজর দেয়। সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং মিয়ানমার সফর করেছেন। বঙ্গোপসাগরে ভারতের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের ঠিক বিপরীতে, অর্থাৎ পূর্বদিকে মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের দক্ষিণদিকে সমান্তরালভাবে প্রসারিত লম্বা লেজের মতো দেখতে ভূখণ্ডে অবস্থিত মিয়ানমারের 'দাউই' বন্দর নির্মাণ করার জন্য ভারত মিয়ানমার একমত হয়েছে। এ বন্দরের মাধ্যমে ভারত আসিয়ান জোটের অন্যান্য দেশের সঙ্গে স্থলপথে যোগাযোগ স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে। একইসঙ্গে মিয়ানমারের আকিয়াব বন্দর ব্যবহার করে ভারত তার উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের সাত প্রদেশের সঙ্গে বিকল্প পথে যোগাযোগ স্থাপনের চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। আগামী চার বছরের মধ্যে উলি্লখিত বন্দরগুলোর নির্মাণ এবং সড়ক ও রেলপথ উন্নয়নের কাজ শেষে ভারত তার পূর্বাঞ্চলের প্রদেশ এবং আসিয়ান দেশগুলোর সঙ্গে স্বল্প দূরত্বের কানেক্টিভিটি সম্পন্ন করতে চায়। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ যদি সঠিক কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে সম্ভাবনাময় কানেক্টিভিটির সঙ্গে সংযোজিত না হতে পারে তাহলে এতদাঞ্চলে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। সুতরাং এতদাঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে একটা ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা এবং আঞ্চলিক সম্ভাবনাকে নিজেদের অনুকূলে কাজে লাগানোর লক্ষ্যে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের উন্নত সম্পর্ক থাকা বাঞ্ছনীয়। এ মুহূর্তে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের পথে অন্যতম বাধা হিসেবে দাঁড়িয়েছে বহুদিন যাবৎ চলে আসা রোহিঙ্গা সমস্যা। রোহিঙ্গা হচ্ছে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে বসবাসকারী মুসলমান জনগোষ্ঠী। এই রাখাইন প্রদেশের সঙ্গে বাংলাদেশের কঙ্বাজারের স্থলসীমান্ত রয়েছে। রাখাইন রাজ্যে রাখাইন সম্প্রদায় সংখ্যাগরিষ্ঠ, যারা মূলত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। মাঝখানে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মিটার উঁচু ভিক্টোরিয়া পাহাড় দ্বারা লম্বালম্বিভাবে দাঁড়িয়ে থাকার কারণে বাদবাকি মিয়ানমারের সঙ্গে রাখাইন রাজ্যের যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনো অনেক কষ্টসাধ্য ও বিপদসংকুল। রোহিঙ্গাদের আদি নিবাস এবং তারা কোন কালে কোথা থেকে এসে এই পাহাড়ি অঞ্চলে বসতি গেড়েছে তা নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতভেদ আছে। তবে কয়েকশ বছর আগে থেকেই রোহিঙ্গারা যে এ অঞ্চলে বসবাস করছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ১৯৪৮ সালে মিয়ানমার স্বাধীন হওয়ার পরপরই এ সমস্যার উদ্ভব হয়। ভাষা, ধর্ম ও সাংস্কৃতিকভাবে বাংলাদেশের বৃহত্তম চট্টগ্রামের লোকজনের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের একটি সাদৃশ্য রয়েছে। ফলে শুরু থেকে মিয়ানমারের সব সরকার, বিশেষ করে ১৯৬২ সালের পর থেকে সামরিক সরকারগুলোর একটা সন্দেহ যে, এ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বৃহত্তর চট্টগ্রামের অধিবাসীদের সহযোগিতায় সুযোগমতো মিয়ানমার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার চেষ্টা করতে পারে। সেখান থেকেই মিয়ানমারের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ও সরকারের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের অবিশ্বাস ও সন্দেহ শুরু হয়। সরকারের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে রোহিঙ্গারা সংগঠিত হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে সীমিত আকারের সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করে। ১৯৮২ সালে সামরিক সরকার আইন করে রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। ফলে সংঘর্ষ বেড়ে যায়, বাড়ে সরকারি বাহিনীর অত্যাচার ও নির্যাতন। একটা সময় পর্যন্ত রোহিঙ্গা মিয়ানমারের আভ্যন্তরীণ সমস্যা ছিল। কিন্তু প্রথমবার ১৯৭৮ এবং দ্বিতীয়বার ১৯৯১ সালে মিয়ানমারের আধা সামরিক বাহিনী নাসাকা এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকজনের সম্মিলিত আক্রমণের ফলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ব্যাপকভাবে রোহিঙ্গাদের আগমন ঘটে। দুই দফায় প্রায় ৩-৪ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসেবে কঙ্বাজার ও টেকনাফ এলাকায় আশ্রয় নেয়। পরবর্তীতে এক থেকে দেড় লাখ শরণার্থী মিয়ানমারে ফেরত যায়। বাংলাদেশে থেকে যাওয়া রোহিঙ্গারা স্বল্পসংখ্যক নির্ধারিত শরণার্থী শিবিরে অবস্থান করলেও, বেশিরভাগই কঙ্বাজার, টেকনাফ এবং চট্টগ্রামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে নিজেদের বলয় সৃষ্টি করে নিজস্ব স্টাইলে বসবাস করতে থাকে। সত্তর দশকের শেষদিকে পাকিস্তানভিত্তিক ধর্মান্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ (হুজি) বাংলাদেশের ধর্মান্ধ গোষ্ঠী জামায়াত ও এর অঙ্গ সংগঠনের সহযোগিতায় বাংলাদেশস্থ রোহিঙ্গাদের মধ্যপ্রাচ্যের অর্থায়নে আফগানিস্তানে সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধে নিয়োজিত করে। আফগানফেরত রোহিঙ্গা যোদ্ধারা গড়ে তোলে একাধিক জঙ্গি সংগঠন, যারা রাখাইন অঞ্চলে নিজেদের দাবি আদায়ে সশস্ত্র সংগ্রামের সূচনা করে। সশস্ত্র সংগঠনের মধ্যে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (RSO); আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (ARNO) এবং আরাকান লিবারেশন ফ্রন্ট (ALF) জাতীয় বেশ কয়েকটি সংগঠন আরাকানের অভ্যন্তরে সশস্ত্র আন্দোলন চালাতে থাকে। তাদের বেশিরভাগ কার্যক্রম পরিচালিত হতো বাংলাদেশ সীমান্ত অঞ্চল থেকে। মিয়ানমারের পক্ষ থেকে অভিযোগ আছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের বেনামি জঙ্গি সংগঠন জেএমবি, জেএমজেবি, হুজি এবং পাকিস্তানভিত্তিক লস্কর-ই-তৈয়বা ও জইসী মুহাম্মদের মতো জঙ্গি সংগঠনগুলো রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্রশস্ত্র দ্বারা সক্রিয়ভাবে আরাকানের ভেতরে অপারেশন পরিচালনায় সহযোগিতা করছে। অভিযোগ আছে, 'রাবেতা আল আলম ইসলামী' নামে একটি এনজিও মধ্যপ্রাচ্যের টাকায় নানা ছদ্মবেশে রোহিঙ্গাদের মধ্যে জঙ্গি প্রশিক্ষণ ও সশস্ত্র তৎপরতায় জড়িত। এ 'রাবেতা আল ইসলামী'র বাংলাদেশি এজেন্ট বা মালিক হচ্ছেন জামায়াতে ইসলামীর একজন নেতা, যিনি সম্প্রতি একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন। অন্যদিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও আইন-শৃঙ্খলার অবনতি হচ্ছে রোহিঙ্গাদের নানারকম দুষ্কর্মের কারণে। অস্ত্র বেচাকেনা, মাদক পাচার, ডাকাতি, ছিনতাইসহ এমন কোনো অপরাধ নেই যার সঙ্গে রোহিঙ্গারা জড়িত নয়। বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে যাচ্ছে এবং সেখানে অপরাধ সংগঠনের কারণে বাংলাদেশের বদনাম হচ্ছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির বা বসতিকেন্দ্রিক জঙ্গি তৎপরতার ফলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে, অন্যদিকে একই সময়ে তা মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের পথে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে অবস্থান করলে তা মিয়ানমার ও বাংলাদেশ উভয় দেশের নিরাপত্তার জন্য বাড়তি হুমকির সৃষ্টি করবে। গত মাসে রাখাইন প্রদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় নতুনভাবে উদ্ভূত রোহিঙ্গা সমস্যা এবং তার রেশ ধরে দুদেশের সরকারের স্ট্যান্ড দেখে বোঝা যায় উভয় সরকারই উপরোক্ত সত্যটি অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছেন। মিয়ানমারের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ সপ্তাহের শুরুতে বাংলাদেশ সফর করে গেলেন।
তিনি আমাদের পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে রোহিঙ্গা ইস্যু সমাধানকল্পে ঘনিষ্ঠভাবে আলোচনা করেছেন। দু-এক মাসের মধ্যে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট জেনারেল থেইন সেইনের বাংলাদেশে আসার কথা রয়েছে। এ সুযোগে রোহিঙ্গা সমস্যাটির একটি স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করা উভয় দেশের জন্য হবে জরুরি এবং মঙ্গলজনক।
লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক।
ই-মেইল : sikder52@gmail.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন