॥ ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী ॥
আরাকানের আদি নৃগোষ্ঠীর নাম রোহিঙ্গা। এরা ধর্ম বিশ্বাসে মুসলমান। আরাকান বর্তমান মিয়ানমারের বাংলাদেশসংলগ্ন একটি অঞ্চল। এ হিসাবে মিয়ানমার দক্ষিণ-পূর্বাংশের কক্সবাজার জেলার সীমান্তঘেঁষা আমাদের প্রতিবেশী দেশ। আরাকানে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ইতিহাস অতি প্রাচীন। চট্টগ্রামকে বলা হয়, এই ভূখণ্ডে ইসলামের প্রবেশদ্বার। ঐতিহাসিকেরা বলেছেন, খোলাফায়ে রাশেদিনের যুগে চট্টগ্রাম বন্দরে আরব বণিকদের যাতায়াত সূত্রে এখানে ইসলামের প্রচার ঘটে। তখন থেকে আরাকানও ইসলামের ছায়ায় আশ্রয় নেয়।
সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের আগ্রাসনের আগে আরাকানের রাজসভা ছিল বাংলাভাষার চর্চা ও উৎকর্ষতার প্রাণকেন্দ্র। মহাকবি আলাওল, সৈয়দ সুলতান শাহ মুহাম্মদ ছগীর প্রমুখ আরাকান রাজসভাকে কেন্দ্র করে সাহিত্যচর্চা করেন। পদ্মাবতীসহ মধ্যযুগের পুঁথিসাহিত্যের লালনভূমি ছিল আরাকান।
বার্মা ও উপমহাদেশ যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশদের দখলমুক্ত হয়, তখন আরাকান বার্মার সাথে যুক্ত হয়। আরাকান সীমান্তের নাফ নদীর এপারের কক্সবাজার ও টেকনাফ অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত হয় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও বর্তমান বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে। আইয়ুব আমলে পাকিস্তানি শাসকদের ভুল নীতির কারণে বার্মা ও পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তে সব সময় গোলযোগ লেগে থাকত। ফলে অবিশ্বাস ও অশান্তি বলবৎ থাকত দুই দেশের সীমান্তজুড়ে। এর প্রভাব পড়তে থাকে আরাকানের মুসলিম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর।
রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি আরাকানের সংখ্যালঘু বৌদ্ধদের সাধারণ পরিচয় মগ। স্থানীয় ভাষায় রাখাইন, বার্মা সরকার আরাকানকে রোহিঙ্গামুক্ত করার পলিসি নেয়। রাখাইনেরা সেই পলিসির কারণে মুসলমানদের ওপর যখন-তখন হামলা চালায়। যখন ইচ্ছা ধান-চাল, গরু-ছাগল ছিনিয়ে নেয়। পান থেকে চুন খসলে মারধর করে। বাড়িতে আগুন দেয়। ক্রমেই তাদের নাগরিক অধিকার কেড়ে নেয়া হয়। হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী নৃগোষ্ঠীকে এভাবে অবাঞ্ছিত একটি জনগোষ্ঠীতে পরিণত করা হয়। এমনকি আরাকানের ঐতিহাসিক নামটিও বদলে দিয়ে রাখাইন অঞ্চল রাখা হয়। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার হয়ে টেকনাফগামী মহাসড়কটির নাম আরাকান রোড। জাপান-ব্রিটিশ যুদ্ধের সময় ব্রিটিশেরা বার্মার রণাঙ্গনে যাওয়ার জন্য এটি নির্মাণ করেছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ-বার্মা সীমান্তে বৈরিতা বা অশান্তির অবসান হলেও রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়নের মাত্রা বিন্দুমাত্র কমেনি; বরং বেড়েছে। আশির দশকের শুরুতে রাখাইনদের অত্যাচারে নিপীড়িত মুসলমানেরা বাংলাদেশে শরণার্থী হয়েছিল। তাদের অসহায়ত্বের প্রতি সহানুভূতিশীল সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো দেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়। কিংবা বাংলাদেশি পরিচয়ে চোরাইপথে তারা বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমায়।
১৯৯২ সালে আরেকবার নিপীড়নের শিকার হয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। তখন জাতিসঙ্ঘ শরণার্থী কমিশনসহ অনেক দেশ ত্রাণ তৎপরতা নিয়ে এগিয়ে আসে। কিন্তু তাতে রোহিঙ্গাদের দুর্দশার এতটুকুন সুরাহা হয়নি। সরকারি হিসাব মতে এখনো ৩০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশ ভূখণ্ডে রয়ে গেছে। বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা দুইলাখের ওপর।
২০১২ সালের জুন মাসের শুরুতে একটি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাখাইনরা রোহিঙ্গাদের ওপর দলবদ্ধ হামলা, লুটপাট ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ চালাতে থাকে। ফলে প্রাণভয়ে রোহিঙ্গারা নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করে। কিন্তু বাংলাদেশে সীমান্তরক্ষীরা তাদেরকে ঢুকতে বাধা দেয় এবং অনেককে পুশব্যাক করে। এ ঘটনার প্রেক্ষাপটে জাতিসঙ্ঘ আর জাতিসঙ্ঘের মুরব্বি আমেরিকা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি জোরালো অনুরোধ করে, যাতে রোহিঙ্গাদের আসার জন্য বাংলাদেশের সীমান্ত খুলে দেয়া হয়।
আমাদের প্রশ্নÑ আরাকানে বা রাখাইন অঞ্চলে রোহিঙ্গা নৃগোষ্ঠীর ওপর যুগ যুগ ধরে যে বৈষম্য, বর্ণবাদ ও নির্যাতন চলছে, জাতিসঙ্ঘ তার প্রতিকারের জন্য কী পদক্ষেপ নিয়েছে? বিগত দিনগুলোতে যে ৩০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে এবং জাতিসঙ্ঘ রিলিফ দিয়ে যাচ্ছে, তাদেরকে নিজের ভিটেমাটিতে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য কী ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে? জবাব হলোÑ তেমন কিছুই করেনি। তা হলে আরাকানে নতুন করে সঙ্কট শুরু হওয়ার সাথে সাথে যেখানে মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা যৌক্তিক ছিল, সে কাজটি না করে বাংলাদেশের দুয়ার খুলে শরণার্থীদের গ্রহণ করার জন্য চাপ সৃষ্টির পেছনে কী মতলব থাকতে পারে?
জাতিসঙ্ঘ ও আমেরিকা আফগানিস্তান, ইরাক, ফিলিস্তিন ও বিশ্বের দিকে দিকে মজলুম মুসলমানদের সাথে কী ধরনের আচরণ করেছে ও করছে, তা দুনিয়ার সবাই জানে। এমতাবস্থায় অত্যাচার বন্ধ করতে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির পরিবর্তে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে নিয়ে আসার জন্য তাদের এত দরদ দেখে মনে সন্দেহ সৃষ্টি হওয়া একান্তই স্বাভাবিক।
আমরা দিব্য দেখতে পাচ্ছি, রাখাইনরা এবং মিয়ানমারের শাসকগোষ্ঠী যেমন অত্যাচার-নিপীড়নের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দিয়ে বা হত্যা করে আরাকানকে মুসলিমশূন্য করতে চায়, তেমনি জাতিসঙ্ঘ ও পশ্চিমা দরদি দেশগুলোও রোহিঙ্গাদের নিজেদের পৈতৃক ভিটামাটি থেকে বের করে আনার কৌশল অবলম্বন করেছে। সেই কৌশল হচ্ছেÑ জনসংখ্যার ভারে জর্জরিত বাংলাদেশের ওপর শরণার্থী গ্রহণের জন্য চাপ সৃষ্টি আর রোহিঙ্গাদের অন্তত জাতিসঙ্ঘের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় লাভ এবং পরবর্তী সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের সোনার হরিণ ও অন্যান্য দেশে আশ্রয় নেয়ার প্রলোভন দেয়া। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ দেখে যে কেউ এই বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারবেন।
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের সর্বোত্তম ও একমাত্র পথ হচ্ছেÑ রোহিঙ্গাদের তাদের পৈতৃক ভিটেমাটিতে নাগরিক মর্যাদা নিয়ে শান্তিতে থাকার ব্যবস্থা করা। এই ব্যবস্থার জন্য এ পর্যন্ত প্রমাণিত হয়েছে যে, বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়া মোটেও নিরাপদ নয়। কারণ, যারা শরণার্থী হয়ে আসে তাদেরকে আর ফেরত নেয়া হয় না, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সে ব্যবস্থা করে না। ফল দাঁড়ায়, এরা নিজের ভিটেমাটি থেকে চিরতরে উৎখাত হয়ে যায়। এখানে বাংলাদেশেও চলতে থাকে শরণার্থীদের নিগৃহীত জীবন। তা ছাড়া বাংলাদেশের আশ্রয় দেয়ার মতো অতিরিক্ত ভূমি ও সামর্থ্য নেই। আরো অধিক শরণার্থীর অনুপ্রবেশ ঘটলে যখন অভাব-অনটন ও চুরি-ডাকাতি বেড়ে যাওয়ার মতো সামাজিক সমস্যা দেখা দেবে, তখন তা সামাল দেয়া কারো পক্ষে সম্ভব হবে না। যদি সৌদি আরব বা অন্য দেশে তাদের পুনর্বাসন করা হয়, তাহলে তো সেই লোভে আরাকান মুসলিমশূন্য হয়ে যাবে, যা মিয়ানমার সরকার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একান্তভাবেই কামনা করে।
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের আরেকটি পথ চিন্তা করা যেতে পারে আরাকানকে স্বাধীন করে স্বাধীন মুসলিম দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। আমাদের মধ্যে যারা যুক্তি ও বাস্তবতার চেয়ে ভাবাবেগেতাড়িত, তারা এমন স্লোগান শুনলে প্রীত হন, মনে আনন্দ পান। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছেÑ আরাকানকে অদূর ভবিষ্যতে স্বাধীন করা সম্ভব নয়। এর মূল কারণ, স্বয়ং আরাকানের ভেতরকার রোহিঙ্গা মুসলমানেরা স্বাধীনতা চায় না। যাদের স্বাধীনতা দরকার; তারাই যদি না চায় তাহলে বাইরে থেকে জিহাদ করে অন্যদের দিয়ে স্বাধীনতা কায়েম করে দেয়া অসম্ভব। বাইরের ইসলামি জজবাধারী নেতারা এ বাস্তবতাটি বুঝতে না পারার কারণে আরাকানে মুসলমানদের যথেষ্ট ক্ষতি হয়ে গেছে। পাকিস্তান আমলে জাফর কাওয়ালের নেতৃত্বাধীন আরাকানি গেরিলাদের কোন উদ্দেশ্যে প্রশ্রয় দেয়া হয়েছিল, চিন্তা করলে কারণ খুঁজে পাই না। কারণ আমার মনে হয়, এ যাবৎকাল যারা আরাকানকে স্বাধীন করার কথা বলেছেন, তারা দাবি করে বলতে পারবেন না যে, আরাকানের ভেতরকার মুসলিম নেতা বা প্রভাবশালী মহলের এরা কখনো সমর্থন ও সহযোগিতা পেয়েছেন। দ্বিতীয় কারণ ঐতিহাসিক ও খানিকটা তিক্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যে মুহূর্তে মিয়ানমার ও ভারতবর্ষ ছেড়ে ব্রিটিশরা চলে যাবে, তখন বার্মায় প্রচণ্ড সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধে। যেমনটি উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার রূপ নিয়েছিল। বার্মার দাঙ্গা ছিল মগ ও মুসলমানদের মধ্যে। তখন আরাকানের স্থায়ী বাসিন্দা বা রোহিঙ্গারা মগদের দ্বারা প্রতারিত হয়ে বহিরাগতদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। বহিরাগত বলতে চট্টগ্রাম ও পুরো বাংলাদেশ থেকে যাওয়া মুসলমানদের বোঝানো হতো। কারণ চট্টগ্রাম ও বাংলাদেশের মুসলমানরা তখন ভাগ্য বদলের জন্য বার্মায় যেত। সেখানকার ব্যবসায়, বাণিজ্য, সাহিত্য, সংস্কৃতি, মসজিদ, খানকা প্রভৃতি সব কিছুর ওপর বাংলাদেশের বিশেষ করে চট্টগ্রামের লোকদের প্রভাব ছিল।
সে সময়কার বহিরাগত খেদাও আন্দোলনের এসব রূঢ় বাস্তবতা যাচাইয়ের জন্য ইতিহাসের বই পুস্তক খোঁজার দরকার নেই। চট্টগ্রামের ঘরে ঘরে বয়স্ক লোকদের জিজ্ঞাসাবাদ করলেই এর সত্যতা পাওয়া যাবে।
এই রূঢ় বাস্তবতাকে বিবেচনায় না নিয়ে যারা আরাকানের স্বাধীনতার স্লোগান দেয়, তারা প্রকারান্তরে রোহিঙ্গা মুসলমান ভাইদের ক্ষতিই করে। কারণ, তাতে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন চালানোর অজুহাত খুঁজে পায়।
সবচেয়ে বড় কারণটি হলো, আরাকানকে সাহায্য করার শক্তি আপাতত কারো নেই। এক সাংবাদিক বন্ধু বললেন, ১৯৯২ সালে রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা নিয়ে আমি অনেক ঘোরাঘুরি করেছি। একপর্যায়ে ডা: ইউনুচের ও জনাব শাব্বিরের নেতৃত্বাধীন দু’টি পৃথক রোহিঙ্গা সংহতি আন্দোলনের নেতাদের সাক্ষাৎকার নেয়ার সুযোগ পাই। তাদের বলিষ্ঠ কণ্ঠের দাবি ছিল, আমরা আরাকানকে স্বাধীন করতে চাই। বলেছিলেন তাদের হাতে নাকি সশস্ত্র যোদ্ধা আছে। পরিসংখ্যান জিজ্ঞাসা করলে একপর্যায়ে জানা গেল ডা: ইউনুচের সশস্ত্র যোদ্ধার সংখ্যা দুই হাজার আর শাব্বির সাহেবের দাবি তাদের ৪০০ যোদ্ধা আছে। দুই হাজার বা ৪০০ যোদ্ধার বিশাল বাহিনী নিয়ে মিয়ানমারের নাসাকা বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে কিভাবে জয়ী হবে তার কোনো সদুত্তর তাদের কাছে ছিল না। বিদেশ থেকে কিভাবে অস্ত্রের জোগান আসবে এবং বাংলাদেশ সরকারের সমর্থন না থাকলে কক্সবাজার বা টেকনাফে অস্ত্রের সেই চালান কিভাবে খালাস করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশের ভূমি কিভাবে ব্যবহার করবে সেসব প্রশ্নেরও কোনো জবাব দিতে পারেননি রোহিঙ্গা নেতারা। এর পরও তাদের কাছে যুদ্ধ মহড়া বা অভিযান পরিচালনার ভঙ্গিতে রঙিন ছবি ছিল। জানা যায়, এসব ছবি কোনো গহিন বনে মহড়া দিয়ে তোলা হয়েছে, আর আরাকানের স্বাধীনতার প্রতি সহানুভূতিশীল মধ্যপ্রাচ্যের অর্থশালীদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহে ব্যবহার করা হচ্ছে। এই ছবিগুলো মিয়ানমার সরকারের হাতে গিয়ে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন বাড়ানোর কারণ ঘটাচ্ছে কি না, সে জবাব অপরিণামদর্শী নেতাদের কাছে থাকতে পারে না।
তাহলে রোহিঙ্গাদের বেলায় আমাদের দায়িত্ব কী বা করণীয় কী থাকতে পারে? এর জন্য বিনয়ের সাথে অনুরোধ করব, মুসলমান ভাই হিসেবে রোহিঙ্গাদের জন্য যাদের মন কাঁদে, বিশেষ করে যেসব রোহিঙ্গা মুসলমান ইতোমধ্যে বাংলাদেশ, মধ্যপ্রাচ্য বা বহির্বিশ্বে রয়েছেন তাদেরকে নির্মোহ ও আবেগবর্জিত হয়ে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। আন্তর্জাতিক চক্রান্তের কলাকৌশল বোঝার চেষ্টা করতে হবে। প্রথমে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে যে, আপাতত আরাকানকে বা রোহিঙ্গাদের স্বাধীন করা সম্ভব নয়। তাদেরকে যেভাবেই হোক আরাকানের মাটি কাঁমড়ে থাকতে হবে বা সেখানেই তাদেরকে প্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য নানাভাবে চেষ্টা ও সহায়তা দিতে হবে।
এই সহায়তার প্রথমটি হতে পারে শিক্ষা, রোহিঙ্গাদের স্বতন্ত্র জাতীয় চেতনা ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের স্বার্থে অবশ্যই তাদেরকে ইসলামিয়াত বা ধর্মীয় শিক্ষা দিতে হবে। এর জন্য ব্যাপক আকারে বড় বড় মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন নেই। মসজিদভিত্তিক কুরআন ও মাসয়ালা শিক্ষাই যথেষ্ট। সীমিতসংখ্যক উচ্চতর ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে এগুলোর তত্ত্বাবধান ও শিক্ষক জোগান দেয়া সম্ভব। ঈমান, আমল বা ধর্মকর্ম সম্পর্কে এই প্রাথমিক জ্ঞানই বৈরী পরিবেশে তাদের ধর্মীয় চেতনা উজ্জীবিত রাখার জন্য যথেষ্ট হবে।
ধর্মীয় শিক্ষার মতোই গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সাধারণ শিক্ষা, অর্থাৎ মিয়ানমার সরকার জনসাধারণের জন্য যে শিক্ষাব্যবস্থা চালু রেখেছে, তা আয়ত্ত করার জন্য ছেলেমেয়েদের উৎসাহী করতে হবে। কেননা, সে দেশে প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য এটি প্রধান অবলম্বন। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা বর্জন করে কোনো সমাজের নাগরিকেরা প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে না। এই শিক্ষা হাসিলের ক্ষেত্রে বাধা থাকলে সেটি অতিক্রম করার জন্য দেশের ভেতরে ও বাইরে থেকে আন্দোলন চালাতে হবে।
মসজিদ, মাদরাসাভিত্তিক ধর্মীয় শিক্ষা এবং স্কুল-কলেজের সাধারণ শিক্ষার মতোই গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কারিগরি শিক্ষা। কোনো দেশে সংখ্যালঘু হয়ে মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে হলে তরুণ সমাজকে যতখানি সম্ভব কারিগরি বা হাতের কাজ শেখানোর বিকল্প নেই।
বাংলাদেশে একটি এলাকা আছে, ছোটবেলা থেকে তরুণেরা বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। ফলে যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা থাকতেও তারা লেখাপড়া করতে পারে না। কী কাজ করেন, জিজ্ঞাসা করলে জবাব দেয় বিদেশ যাওয়ার চিন্তায় আছি। তার মানে বেকার। অথচ বিদেশে গিয়ে যেভাবে গতর খাটে, তার অর্ধেক শ্রম, মেধা ও চেষ্টা কাজে লাগালে দেশে সোনা ফলানো সম্ভব হতো। এর মাধ্যমে যে কথাটি বোঝানোর উদ্দেশ্য তা হচ্ছেÑ যতক্ষণ কোনো একটি লক্ষ্যকে জাতীয় জাগরণের মাধ্যমে সহজ করা না হয়, ততক্ষণ সে লক্ষ্য অর্জিত হয় না। রোহিঙ্গা ভাইদেরও আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য নিজের সাধ ও সাধ্যের মধ্যে লক্ষ্য ঠিক করতে হবে। যেভাবেই হোক, নিজের মাটিতে নিজের পায়ে দাঁড়ানোই হবে সেই লক্ষ্য।
কোনো ইসলামি ভূখণ্ডে শত্রুর আক্রমণ হলে বা শত্রুর কোনো ভূখণ্ড জয় করার জন্য জিহাদ করার সওয়াব ও গুরুত্ব সবাই স্বীকার করেন। এ পথে লড়াই করে প্রাণ ত্যাগ করলে শহীদ হবে এবং তা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ হিসেবে গণ্য হবে। যারা আরাকানকে স্বাধীন করার জিহাদে উজ্জীবিত তাদেরকেও ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করার পরামর্শ দিতে চাই যে, যুদ্ধ করে আরাকান জয় করার চিন্তার চেয়ে যারা আরাকানের ভেতরে হাজার বছর ধরে বসবাস করছেন, তাদেরকে সেখানে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ করে দেয়া কী কম জিহাদ। নিজের ভিটেমাটি রক্ষার জন্য যদি নির্যাতন সইতে হয়, এমনকি নিহতও হতে হয়, তা তো আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ ও শাহাদাত হিসেবে গণ্য হবে। এর পরিবর্তে নিজের অবস্থান শত্রুর জন্য ছেড়ে দিয়ে আত্মরক্ষা করার মধ্যে তো কোনো কৃতিত্ব নেই এবং ভবিষ্যৎও তো সম্পূর্ণ অন্ধকার।
এই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধে অন্য যে বিষয়টির দিকে রোহিঙ্গা মুসলিম ভাইদের সাথে সংহতি প্রকাশকারী সচেতন মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই তা হলোÑ একটি রোহিঙ্গা সংহতি তথ্য ব্যাংক প্রতিষ্ঠা। আরাকানের ভেতরে কী চলছে, মুসলমানদের প্রকৃত অবস্থা কীÑ তা আমরা বলতে গেলে সঠিক জানি না। ফলে এই লেখাও লিখছি কিছু তথ্য ও কিছু অনুমানের ওপর নির্ভর করে। ইন্টারনেটের যুগে এ জাতীয় একটি তথ্য ব্যাংক প্রতিষ্ঠা হলে সেটিই হবে রোহিঙ্গা মুসলমানদের প্রতি সংহতি প্রকাশের সর্বোত্তম পন্থা। কারণ, বর্তমান যুগের যুদ্ধাস্ত্রের চেয়ে প্রচার বা মিডিয়াই অধিক কার্যকর। রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর কী ধরনের বৈষম্য, নিগ্রহ ও অত্যাচার চলছে, তা মিডিয়ার সাহায্যে দুনিয়ার মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে। তখন বাইরে থেকে কিভাবে তাদেরকে মিয়ানমারে নাগরিক অধিকার নিয়ে থাকার ব্যবস্থা করা যায়, সে পথ বেরিয়ে আসবে। সচেতন লোকেরা তখন তাদের প্রতি সংহতি জানিয়ে মিছিল, মিটিং, আলোচনা সভা ও লেখালেখির মাধ্যমে বিশ্বজনমত গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারবে। ইসলামি দেশগুলো ওআইসি ও জাতিসঙ্ঘকেও এ ব্যাপারে কার্যকর ভূমিকা রাখতে চাপ দেয়া সহজ হবে। আমার মতে, বর্তমান সময়ে রোহিঙ্গা মজলুম মুসলমান ভাইদের প্রতি সংহতি প্রকাশ ও সাহায্য পৌঁছানোর এটিই কার্যকর পথ। এর পরিবর্তে এমন কোনো ফাঁদে পা দেয়া উচিত হবে না, যা মিয়ানমার সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের স্বদেশ ভূমি থেকে উচ্ছেদ ও সাম্রাজ্যবাদীদের পরিকল্পনা মাফিক তাদের শরণার্থীতে পরিণত করাকে উৎসাহিত করবে।
২৬-০৬-২০১২
isashahedi@gmail.com
আরাকানের আদি নৃগোষ্ঠীর নাম রোহিঙ্গা। এরা ধর্ম বিশ্বাসে মুসলমান। আরাকান বর্তমান মিয়ানমারের বাংলাদেশসংলগ্ন একটি অঞ্চল। এ হিসাবে মিয়ানমার দক্ষিণ-পূর্বাংশের কক্সবাজার জেলার সীমান্তঘেঁষা আমাদের প্রতিবেশী দেশ। আরাকানে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ইতিহাস অতি প্রাচীন। চট্টগ্রামকে বলা হয়, এই ভূখণ্ডে ইসলামের প্রবেশদ্বার। ঐতিহাসিকেরা বলেছেন, খোলাফায়ে রাশেদিনের যুগে চট্টগ্রাম বন্দরে আরব বণিকদের যাতায়াত সূত্রে এখানে ইসলামের প্রচার ঘটে। তখন থেকে আরাকানও ইসলামের ছায়ায় আশ্রয় নেয়।
সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের আগ্রাসনের আগে আরাকানের রাজসভা ছিল বাংলাভাষার চর্চা ও উৎকর্ষতার প্রাণকেন্দ্র। মহাকবি আলাওল, সৈয়দ সুলতান শাহ মুহাম্মদ ছগীর প্রমুখ আরাকান রাজসভাকে কেন্দ্র করে সাহিত্যচর্চা করেন। পদ্মাবতীসহ মধ্যযুগের পুঁথিসাহিত্যের লালনভূমি ছিল আরাকান।
বার্মা ও উপমহাদেশ যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশদের দখলমুক্ত হয়, তখন আরাকান বার্মার সাথে যুক্ত হয়। আরাকান সীমান্তের নাফ নদীর এপারের কক্সবাজার ও টেকনাফ অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত হয় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও বর্তমান বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে। আইয়ুব আমলে পাকিস্তানি শাসকদের ভুল নীতির কারণে বার্মা ও পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তে সব সময় গোলযোগ লেগে থাকত। ফলে অবিশ্বাস ও অশান্তি বলবৎ থাকত দুই দেশের সীমান্তজুড়ে। এর প্রভাব পড়তে থাকে আরাকানের মুসলিম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর।
রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি আরাকানের সংখ্যালঘু বৌদ্ধদের সাধারণ পরিচয় মগ। স্থানীয় ভাষায় রাখাইন, বার্মা সরকার আরাকানকে রোহিঙ্গামুক্ত করার পলিসি নেয়। রাখাইনেরা সেই পলিসির কারণে মুসলমানদের ওপর যখন-তখন হামলা চালায়। যখন ইচ্ছা ধান-চাল, গরু-ছাগল ছিনিয়ে নেয়। পান থেকে চুন খসলে মারধর করে। বাড়িতে আগুন দেয়। ক্রমেই তাদের নাগরিক অধিকার কেড়ে নেয়া হয়। হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী নৃগোষ্ঠীকে এভাবে অবাঞ্ছিত একটি জনগোষ্ঠীতে পরিণত করা হয়। এমনকি আরাকানের ঐতিহাসিক নামটিও বদলে দিয়ে রাখাইন অঞ্চল রাখা হয়। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার হয়ে টেকনাফগামী মহাসড়কটির নাম আরাকান রোড। জাপান-ব্রিটিশ যুদ্ধের সময় ব্রিটিশেরা বার্মার রণাঙ্গনে যাওয়ার জন্য এটি নির্মাণ করেছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ-বার্মা সীমান্তে বৈরিতা বা অশান্তির অবসান হলেও রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়নের মাত্রা বিন্দুমাত্র কমেনি; বরং বেড়েছে। আশির দশকের শুরুতে রাখাইনদের অত্যাচারে নিপীড়িত মুসলমানেরা বাংলাদেশে শরণার্থী হয়েছিল। তাদের অসহায়ত্বের প্রতি সহানুভূতিশীল সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো দেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়। কিংবা বাংলাদেশি পরিচয়ে চোরাইপথে তারা বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমায়।
১৯৯২ সালে আরেকবার নিপীড়নের শিকার হয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। তখন জাতিসঙ্ঘ শরণার্থী কমিশনসহ অনেক দেশ ত্রাণ তৎপরতা নিয়ে এগিয়ে আসে। কিন্তু তাতে রোহিঙ্গাদের দুর্দশার এতটুকুন সুরাহা হয়নি। সরকারি হিসাব মতে এখনো ৩০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশ ভূখণ্ডে রয়ে গেছে। বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা দুইলাখের ওপর।
২০১২ সালের জুন মাসের শুরুতে একটি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাখাইনরা রোহিঙ্গাদের ওপর দলবদ্ধ হামলা, লুটপাট ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ চালাতে থাকে। ফলে প্রাণভয়ে রোহিঙ্গারা নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করে। কিন্তু বাংলাদেশে সীমান্তরক্ষীরা তাদেরকে ঢুকতে বাধা দেয় এবং অনেককে পুশব্যাক করে। এ ঘটনার প্রেক্ষাপটে জাতিসঙ্ঘ আর জাতিসঙ্ঘের মুরব্বি আমেরিকা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি জোরালো অনুরোধ করে, যাতে রোহিঙ্গাদের আসার জন্য বাংলাদেশের সীমান্ত খুলে দেয়া হয়।
আমাদের প্রশ্নÑ আরাকানে বা রাখাইন অঞ্চলে রোহিঙ্গা নৃগোষ্ঠীর ওপর যুগ যুগ ধরে যে বৈষম্য, বর্ণবাদ ও নির্যাতন চলছে, জাতিসঙ্ঘ তার প্রতিকারের জন্য কী পদক্ষেপ নিয়েছে? বিগত দিনগুলোতে যে ৩০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে এবং জাতিসঙ্ঘ রিলিফ দিয়ে যাচ্ছে, তাদেরকে নিজের ভিটেমাটিতে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য কী ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে? জবাব হলোÑ তেমন কিছুই করেনি। তা হলে আরাকানে নতুন করে সঙ্কট শুরু হওয়ার সাথে সাথে যেখানে মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা যৌক্তিক ছিল, সে কাজটি না করে বাংলাদেশের দুয়ার খুলে শরণার্থীদের গ্রহণ করার জন্য চাপ সৃষ্টির পেছনে কী মতলব থাকতে পারে?
জাতিসঙ্ঘ ও আমেরিকা আফগানিস্তান, ইরাক, ফিলিস্তিন ও বিশ্বের দিকে দিকে মজলুম মুসলমানদের সাথে কী ধরনের আচরণ করেছে ও করছে, তা দুনিয়ার সবাই জানে। এমতাবস্থায় অত্যাচার বন্ধ করতে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির পরিবর্তে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে নিয়ে আসার জন্য তাদের এত দরদ দেখে মনে সন্দেহ সৃষ্টি হওয়া একান্তই স্বাভাবিক।
আমরা দিব্য দেখতে পাচ্ছি, রাখাইনরা এবং মিয়ানমারের শাসকগোষ্ঠী যেমন অত্যাচার-নিপীড়নের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দিয়ে বা হত্যা করে আরাকানকে মুসলিমশূন্য করতে চায়, তেমনি জাতিসঙ্ঘ ও পশ্চিমা দরদি দেশগুলোও রোহিঙ্গাদের নিজেদের পৈতৃক ভিটামাটি থেকে বের করে আনার কৌশল অবলম্বন করেছে। সেই কৌশল হচ্ছেÑ জনসংখ্যার ভারে জর্জরিত বাংলাদেশের ওপর শরণার্থী গ্রহণের জন্য চাপ সৃষ্টি আর রোহিঙ্গাদের অন্তত জাতিসঙ্ঘের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় লাভ এবং পরবর্তী সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের সোনার হরিণ ও অন্যান্য দেশে আশ্রয় নেয়ার প্রলোভন দেয়া। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ দেখে যে কেউ এই বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারবেন।
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের সর্বোত্তম ও একমাত্র পথ হচ্ছেÑ রোহিঙ্গাদের তাদের পৈতৃক ভিটেমাটিতে নাগরিক মর্যাদা নিয়ে শান্তিতে থাকার ব্যবস্থা করা। এই ব্যবস্থার জন্য এ পর্যন্ত প্রমাণিত হয়েছে যে, বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়া মোটেও নিরাপদ নয়। কারণ, যারা শরণার্থী হয়ে আসে তাদেরকে আর ফেরত নেয়া হয় না, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সে ব্যবস্থা করে না। ফল দাঁড়ায়, এরা নিজের ভিটেমাটি থেকে চিরতরে উৎখাত হয়ে যায়। এখানে বাংলাদেশেও চলতে থাকে শরণার্থীদের নিগৃহীত জীবন। তা ছাড়া বাংলাদেশের আশ্রয় দেয়ার মতো অতিরিক্ত ভূমি ও সামর্থ্য নেই। আরো অধিক শরণার্থীর অনুপ্রবেশ ঘটলে যখন অভাব-অনটন ও চুরি-ডাকাতি বেড়ে যাওয়ার মতো সামাজিক সমস্যা দেখা দেবে, তখন তা সামাল দেয়া কারো পক্ষে সম্ভব হবে না। যদি সৌদি আরব বা অন্য দেশে তাদের পুনর্বাসন করা হয়, তাহলে তো সেই লোভে আরাকান মুসলিমশূন্য হয়ে যাবে, যা মিয়ানমার সরকার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একান্তভাবেই কামনা করে।
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের আরেকটি পথ চিন্তা করা যেতে পারে আরাকানকে স্বাধীন করে স্বাধীন মুসলিম দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। আমাদের মধ্যে যারা যুক্তি ও বাস্তবতার চেয়ে ভাবাবেগেতাড়িত, তারা এমন স্লোগান শুনলে প্রীত হন, মনে আনন্দ পান। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছেÑ আরাকানকে অদূর ভবিষ্যতে স্বাধীন করা সম্ভব নয়। এর মূল কারণ, স্বয়ং আরাকানের ভেতরকার রোহিঙ্গা মুসলমানেরা স্বাধীনতা চায় না। যাদের স্বাধীনতা দরকার; তারাই যদি না চায় তাহলে বাইরে থেকে জিহাদ করে অন্যদের দিয়ে স্বাধীনতা কায়েম করে দেয়া অসম্ভব। বাইরের ইসলামি জজবাধারী নেতারা এ বাস্তবতাটি বুঝতে না পারার কারণে আরাকানে মুসলমানদের যথেষ্ট ক্ষতি হয়ে গেছে। পাকিস্তান আমলে জাফর কাওয়ালের নেতৃত্বাধীন আরাকানি গেরিলাদের কোন উদ্দেশ্যে প্রশ্রয় দেয়া হয়েছিল, চিন্তা করলে কারণ খুঁজে পাই না। কারণ আমার মনে হয়, এ যাবৎকাল যারা আরাকানকে স্বাধীন করার কথা বলেছেন, তারা দাবি করে বলতে পারবেন না যে, আরাকানের ভেতরকার মুসলিম নেতা বা প্রভাবশালী মহলের এরা কখনো সমর্থন ও সহযোগিতা পেয়েছেন। দ্বিতীয় কারণ ঐতিহাসিক ও খানিকটা তিক্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যে মুহূর্তে মিয়ানমার ও ভারতবর্ষ ছেড়ে ব্রিটিশরা চলে যাবে, তখন বার্মায় প্রচণ্ড সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধে। যেমনটি উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার রূপ নিয়েছিল। বার্মার দাঙ্গা ছিল মগ ও মুসলমানদের মধ্যে। তখন আরাকানের স্থায়ী বাসিন্দা বা রোহিঙ্গারা মগদের দ্বারা প্রতারিত হয়ে বহিরাগতদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। বহিরাগত বলতে চট্টগ্রাম ও পুরো বাংলাদেশ থেকে যাওয়া মুসলমানদের বোঝানো হতো। কারণ চট্টগ্রাম ও বাংলাদেশের মুসলমানরা তখন ভাগ্য বদলের জন্য বার্মায় যেত। সেখানকার ব্যবসায়, বাণিজ্য, সাহিত্য, সংস্কৃতি, মসজিদ, খানকা প্রভৃতি সব কিছুর ওপর বাংলাদেশের বিশেষ করে চট্টগ্রামের লোকদের প্রভাব ছিল।
সে সময়কার বহিরাগত খেদাও আন্দোলনের এসব রূঢ় বাস্তবতা যাচাইয়ের জন্য ইতিহাসের বই পুস্তক খোঁজার দরকার নেই। চট্টগ্রামের ঘরে ঘরে বয়স্ক লোকদের জিজ্ঞাসাবাদ করলেই এর সত্যতা পাওয়া যাবে।
এই রূঢ় বাস্তবতাকে বিবেচনায় না নিয়ে যারা আরাকানের স্বাধীনতার স্লোগান দেয়, তারা প্রকারান্তরে রোহিঙ্গা মুসলমান ভাইদের ক্ষতিই করে। কারণ, তাতে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন চালানোর অজুহাত খুঁজে পায়।
সবচেয়ে বড় কারণটি হলো, আরাকানকে সাহায্য করার শক্তি আপাতত কারো নেই। এক সাংবাদিক বন্ধু বললেন, ১৯৯২ সালে রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা নিয়ে আমি অনেক ঘোরাঘুরি করেছি। একপর্যায়ে ডা: ইউনুচের ও জনাব শাব্বিরের নেতৃত্বাধীন দু’টি পৃথক রোহিঙ্গা সংহতি আন্দোলনের নেতাদের সাক্ষাৎকার নেয়ার সুযোগ পাই। তাদের বলিষ্ঠ কণ্ঠের দাবি ছিল, আমরা আরাকানকে স্বাধীন করতে চাই। বলেছিলেন তাদের হাতে নাকি সশস্ত্র যোদ্ধা আছে। পরিসংখ্যান জিজ্ঞাসা করলে একপর্যায়ে জানা গেল ডা: ইউনুচের সশস্ত্র যোদ্ধার সংখ্যা দুই হাজার আর শাব্বির সাহেবের দাবি তাদের ৪০০ যোদ্ধা আছে। দুই হাজার বা ৪০০ যোদ্ধার বিশাল বাহিনী নিয়ে মিয়ানমারের নাসাকা বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে কিভাবে জয়ী হবে তার কোনো সদুত্তর তাদের কাছে ছিল না। বিদেশ থেকে কিভাবে অস্ত্রের জোগান আসবে এবং বাংলাদেশ সরকারের সমর্থন না থাকলে কক্সবাজার বা টেকনাফে অস্ত্রের সেই চালান কিভাবে খালাস করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশের ভূমি কিভাবে ব্যবহার করবে সেসব প্রশ্নেরও কোনো জবাব দিতে পারেননি রোহিঙ্গা নেতারা। এর পরও তাদের কাছে যুদ্ধ মহড়া বা অভিযান পরিচালনার ভঙ্গিতে রঙিন ছবি ছিল। জানা যায়, এসব ছবি কোনো গহিন বনে মহড়া দিয়ে তোলা হয়েছে, আর আরাকানের স্বাধীনতার প্রতি সহানুভূতিশীল মধ্যপ্রাচ্যের অর্থশালীদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহে ব্যবহার করা হচ্ছে। এই ছবিগুলো মিয়ানমার সরকারের হাতে গিয়ে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন বাড়ানোর কারণ ঘটাচ্ছে কি না, সে জবাব অপরিণামদর্শী নেতাদের কাছে থাকতে পারে না।
তাহলে রোহিঙ্গাদের বেলায় আমাদের দায়িত্ব কী বা করণীয় কী থাকতে পারে? এর জন্য বিনয়ের সাথে অনুরোধ করব, মুসলমান ভাই হিসেবে রোহিঙ্গাদের জন্য যাদের মন কাঁদে, বিশেষ করে যেসব রোহিঙ্গা মুসলমান ইতোমধ্যে বাংলাদেশ, মধ্যপ্রাচ্য বা বহির্বিশ্বে রয়েছেন তাদেরকে নির্মোহ ও আবেগবর্জিত হয়ে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। আন্তর্জাতিক চক্রান্তের কলাকৌশল বোঝার চেষ্টা করতে হবে। প্রথমে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে যে, আপাতত আরাকানকে বা রোহিঙ্গাদের স্বাধীন করা সম্ভব নয়। তাদেরকে যেভাবেই হোক আরাকানের মাটি কাঁমড়ে থাকতে হবে বা সেখানেই তাদেরকে প্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য নানাভাবে চেষ্টা ও সহায়তা দিতে হবে।
এই সহায়তার প্রথমটি হতে পারে শিক্ষা, রোহিঙ্গাদের স্বতন্ত্র জাতীয় চেতনা ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের স্বার্থে অবশ্যই তাদেরকে ইসলামিয়াত বা ধর্মীয় শিক্ষা দিতে হবে। এর জন্য ব্যাপক আকারে বড় বড় মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন নেই। মসজিদভিত্তিক কুরআন ও মাসয়ালা শিক্ষাই যথেষ্ট। সীমিতসংখ্যক উচ্চতর ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে এগুলোর তত্ত্বাবধান ও শিক্ষক জোগান দেয়া সম্ভব। ঈমান, আমল বা ধর্মকর্ম সম্পর্কে এই প্রাথমিক জ্ঞানই বৈরী পরিবেশে তাদের ধর্মীয় চেতনা উজ্জীবিত রাখার জন্য যথেষ্ট হবে।
ধর্মীয় শিক্ষার মতোই গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সাধারণ শিক্ষা, অর্থাৎ মিয়ানমার সরকার জনসাধারণের জন্য যে শিক্ষাব্যবস্থা চালু রেখেছে, তা আয়ত্ত করার জন্য ছেলেমেয়েদের উৎসাহী করতে হবে। কেননা, সে দেশে প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য এটি প্রধান অবলম্বন। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা বর্জন করে কোনো সমাজের নাগরিকেরা প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে না। এই শিক্ষা হাসিলের ক্ষেত্রে বাধা থাকলে সেটি অতিক্রম করার জন্য দেশের ভেতরে ও বাইরে থেকে আন্দোলন চালাতে হবে।
মসজিদ, মাদরাসাভিত্তিক ধর্মীয় শিক্ষা এবং স্কুল-কলেজের সাধারণ শিক্ষার মতোই গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কারিগরি শিক্ষা। কোনো দেশে সংখ্যালঘু হয়ে মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে হলে তরুণ সমাজকে যতখানি সম্ভব কারিগরি বা হাতের কাজ শেখানোর বিকল্প নেই।
বাংলাদেশে একটি এলাকা আছে, ছোটবেলা থেকে তরুণেরা বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। ফলে যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা থাকতেও তারা লেখাপড়া করতে পারে না। কী কাজ করেন, জিজ্ঞাসা করলে জবাব দেয় বিদেশ যাওয়ার চিন্তায় আছি। তার মানে বেকার। অথচ বিদেশে গিয়ে যেভাবে গতর খাটে, তার অর্ধেক শ্রম, মেধা ও চেষ্টা কাজে লাগালে দেশে সোনা ফলানো সম্ভব হতো। এর মাধ্যমে যে কথাটি বোঝানোর উদ্দেশ্য তা হচ্ছেÑ যতক্ষণ কোনো একটি লক্ষ্যকে জাতীয় জাগরণের মাধ্যমে সহজ করা না হয়, ততক্ষণ সে লক্ষ্য অর্জিত হয় না। রোহিঙ্গা ভাইদেরও আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য নিজের সাধ ও সাধ্যের মধ্যে লক্ষ্য ঠিক করতে হবে। যেভাবেই হোক, নিজের মাটিতে নিজের পায়ে দাঁড়ানোই হবে সেই লক্ষ্য।
কোনো ইসলামি ভূখণ্ডে শত্রুর আক্রমণ হলে বা শত্রুর কোনো ভূখণ্ড জয় করার জন্য জিহাদ করার সওয়াব ও গুরুত্ব সবাই স্বীকার করেন। এ পথে লড়াই করে প্রাণ ত্যাগ করলে শহীদ হবে এবং তা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ হিসেবে গণ্য হবে। যারা আরাকানকে স্বাধীন করার জিহাদে উজ্জীবিত তাদেরকেও ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করার পরামর্শ দিতে চাই যে, যুদ্ধ করে আরাকান জয় করার চিন্তার চেয়ে যারা আরাকানের ভেতরে হাজার বছর ধরে বসবাস করছেন, তাদেরকে সেখানে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ করে দেয়া কী কম জিহাদ। নিজের ভিটেমাটি রক্ষার জন্য যদি নির্যাতন সইতে হয়, এমনকি নিহতও হতে হয়, তা তো আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ ও শাহাদাত হিসেবে গণ্য হবে। এর পরিবর্তে নিজের অবস্থান শত্রুর জন্য ছেড়ে দিয়ে আত্মরক্ষা করার মধ্যে তো কোনো কৃতিত্ব নেই এবং ভবিষ্যৎও তো সম্পূর্ণ অন্ধকার।
এই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধে অন্য যে বিষয়টির দিকে রোহিঙ্গা মুসলিম ভাইদের সাথে সংহতি প্রকাশকারী সচেতন মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই তা হলোÑ একটি রোহিঙ্গা সংহতি তথ্য ব্যাংক প্রতিষ্ঠা। আরাকানের ভেতরে কী চলছে, মুসলমানদের প্রকৃত অবস্থা কীÑ তা আমরা বলতে গেলে সঠিক জানি না। ফলে এই লেখাও লিখছি কিছু তথ্য ও কিছু অনুমানের ওপর নির্ভর করে। ইন্টারনেটের যুগে এ জাতীয় একটি তথ্য ব্যাংক প্রতিষ্ঠা হলে সেটিই হবে রোহিঙ্গা মুসলমানদের প্রতি সংহতি প্রকাশের সর্বোত্তম পন্থা। কারণ, বর্তমান যুগের যুদ্ধাস্ত্রের চেয়ে প্রচার বা মিডিয়াই অধিক কার্যকর। রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর কী ধরনের বৈষম্য, নিগ্রহ ও অত্যাচার চলছে, তা মিডিয়ার সাহায্যে দুনিয়ার মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে। তখন বাইরে থেকে কিভাবে তাদেরকে মিয়ানমারে নাগরিক অধিকার নিয়ে থাকার ব্যবস্থা করা যায়, সে পথ বেরিয়ে আসবে। সচেতন লোকেরা তখন তাদের প্রতি সংহতি জানিয়ে মিছিল, মিটিং, আলোচনা সভা ও লেখালেখির মাধ্যমে বিশ্বজনমত গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারবে। ইসলামি দেশগুলো ওআইসি ও জাতিসঙ্ঘকেও এ ব্যাপারে কার্যকর ভূমিকা রাখতে চাপ দেয়া সহজ হবে। আমার মতে, বর্তমান সময়ে রোহিঙ্গা মজলুম মুসলমান ভাইদের প্রতি সংহতি প্রকাশ ও সাহায্য পৌঁছানোর এটিই কার্যকর পথ। এর পরিবর্তে এমন কোনো ফাঁদে পা দেয়া উচিত হবে না, যা মিয়ানমার সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের স্বদেশ ভূমি থেকে উচ্ছেদ ও সাম্রাজ্যবাদীদের পরিকল্পনা মাফিক তাদের শরণার্থীতে পরিণত করাকে উৎসাহিত করবে।
২৬-০৬-২০১২
isashahedi@gmail.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন