বুধবার, ১৮ এপ্রিল, ২০১২

যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরায়েল কেউই ইরানে হামলা চালাবে না

ইউরি আভনেরি | তারিখ: ১৮-০৪-২০১২
যুক্তরাষ্ট্র ইরানে হামলা করবে না। এ বছর তো নয়ই, আসন্ন বছরগুলোতেও নয়। নির্বাচনী বিবেচনা কিংবা সামরিক সীমাবদ্ধতার চেয়েও এই হামলা না করার পেছনে একটি গূঢ় কারণ লুকিয়ে রয়েছে। এ কারণটি হলো, যুক্তরাষ্ট্র যদি তা করে তবে সেটি হবে দেশটির নিজের পায়ে কুড়াল মারার শামিল। সেই সঙ্গে সারা বিশ্বের জন্যও তা বয়ে আনবে বড় ধরনের বিপর্যয়। 
নেপোলিয়ন বলেছেন, ‘তুমি যদি কোনো দেশের পররাষ্ট্র ও অভ্যন্তরীণ নীতি বুঝতে চাও, তবে তার মানচিত্রের দিকে নজর দাও।’ হামলার শিকার হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে ইরান হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেবে। এ প্রণালির মধ্য দিয়ে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, ইরাক ও ইরান থেকে বিশ্বের মোট ৪০ শতাংশ তেল রপ্তানি হয়ে থাকে। প্রণালিটি বন্ধ করে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বে তেলের দাম দ্বিগুণ, তিন গুণ, চার গুণ বেড়ে যাবে। ফলে মার্কিন ও বিশ্ব অর্থনীতিতেও নামবে ধস। 
এসব ছোটখাটো বিষয়ও জেনারেল, সেনা বিশেষজ্ঞসহ বিশ্বকে সংকীর্ণ ‘নিরাপত্তা’র ঘেরাটোপ থেকে পর্যবেক্ষণকারী বিজ্ঞ লোকজনের মনোযোগ এড়ায় না। 
এই প্রণালি বন্ধ করে দেওয়াটা হবে ইরানে সামরিক অভিযানের বিরুদ্ধে সবচেয়ে সহজ একটি পদক্ষেপ। কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপই এ জন্য যথেষ্ট হবে। তবে এটি পুনরায় খুলে দিতে হলে সেখানে মার্কিন নৌবাহিনীর রণতরীতে করে যুদ্ধবিমান পাঠানোই যথেষ্ট হবে না। এই জলসীমাকে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের আওতামুক্ত রাখতে দেশটির বিশাল অংশ দখল করতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে। এ ক্ষেত্রে ইরানের বিশাল আকৃতির কথা বিবেচনা করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, এই দেশটি জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন ও ইতালির যৌথ আকৃতির চেয়েও বিশাল। কাজেই ইরান দখল করা সহজ হবে না। ইরানে হামলা করা হলে তা হবে অত্যন্ত দীর্ঘ একটি যুদ্ধ। হয়তো বা তা ভিয়েতনাম যুদ্ধের চেয়েও দীর্ঘতর হতে পারে। 
এদিকে ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্র যে-ই ইরানে হামলা চালাক, মুসলিম দেশটির জন্য এর অর্থ একই হবে। ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্রকে ইরান এক ও অভিন্ন হিসেবেই বিবেচনা করে। দুই ক্ষেত্রেই হামলার পরিণতি হবে হরমুজ প্রণালি বন্ধ ও দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ। এসব বিবেচনা থেকেই যুক্তরাষ্ট্র নিজেও যেমন ইরানে হামলা চালাবে না, দোসর ইসরায়েলকেও হামলা করা থেকে বিরত রাখবে। 
যুক্তরাষ্ট্রকে কোনো রকম অবগত না করে ১৯৫৬ সালে সেই যে ইসরায়েল যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল, এর পরও তো ৫৬ বছর পেরিয়ে গেছে। সেই যুদ্ধে বিজয়ের সব অর্জনই নিজের ঝুলিতে পুরেছিলেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ার। এরপর আর কখনোই এ ধরনের ভুল করেনি ইসরায়েল। সিক্স ডে ওয়ার ও প্রথম লেবানন যুদ্ধের আগে ওয়াশিংটনের পূর্ণ সমর্থন পেতে সেখানে বিশেষ দূত পাঠায় ইসরায়েল। অনুমতি পাওয়ার পরই কেবল এসব যুদ্ধে নিজেকে জড়িয়েছিল ইসরায়েল। এবার যদি যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছার বাইরে ইসরায়েল কোনো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, তবে কে আইডিএফকে (ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী) নতুন করে যুদ্ধ সরঞ্জামে সাজিয়ে দেবে? ইসরায়েলের নগরগুলোকে লক্ষ্য করে ইরান ও তার বন্ধুদের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রের হামলা থেকেই বা কে রক্ষা করবে? তা ছাড়া মার্কিনদের ওপর এ রকম বিপর্যয় চাপিয়ে দেওয়ায় তাদের মধ্যে যে ইহুদি-বিদ্বেষ মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে না, সে ব্যাপারেই বা কে নিশ্চয়তা দিতে পারে?
এদিকে মার্কিন কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপই হয়তো ইরানকে যুদ্ধ থেকে দূরে রাখার জন্য যথেষ্ট হবে। লিবিয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের এ নীতি কাজে লেগেছে। এখন উত্তর কোরিয়ার বেলায় তা কাজে লাগানো হচ্ছে। পারস্যের অধিবাসীরা জাতিগতভাবেই ব্যবসায়ী। তারা হয়তো নিজেদের জন্য লাভজনক কোনো চুক্তি স্বাক্ষরে ঠিকই সক্ষম হবে। 
কয়েক বছর আগেও ওয়াশিংটনের নব্য রক্ষণশীলরা ইরান দখল করাটা কতটা সহজ হবে, তা নিয়ে আলোচনায় মেতে উঠেছিল। এ আলোচনা থেকে ইরানিরা বুঝে গেছে, তারা মার্কিন হামলার শিকার হচ্ছে না। অপর দিকে, দুই পক্ষের মধ্যে যদি কোনো চুক্তি না হয়, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি চালিয়ে যাবে। তবে অপেক্ষাকৃত সাহসী সেনা কর্মকর্তারা হিসাব করে দেখিয়েছেন, এটা বাকি বিশ্বের জন্য তেমন কোনো হুমকি সৃষ্টি করবে না। আমরা সহিংস কিন্তু ভারসাম্যপূর্ণ একটি জগতেই থাকব। শীতল যুদ্ধের সময় রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র যেমন ভারসাম্যপূর্ণ একটি অবস্থানে ছিল, ঠিক তেমন। বর্তমানে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সম্পর্কটা যেমন, তেমন। খুব বন্ধুত্বপূর্ণও না, আবার খুব ভয়ংকর সহিংসও না—এমনই থাকবে ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল-বলয়ের সম্পর্ক। 
ইতিহাস বলে, ইরান গত হাজার বছরের মধ্যে কোনো দেশকে আক্রমণ করেনি। দেশটির প্রেসিডেন্ট আহমাদিনেজাদ অবশ্য বন্য আবেগ নিয়ে কথা বলেন। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে ইরানি নেতৃত্ব বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে খুবই সতর্কতার সঙ্গে পা ফেলে। এদিকে ইসরায়েলও ইরানের লেজে সহজে পা দেবে না। ইসরায়েলের শিক্ষামন্ত্রী গিদিওন সা’আর যথার্থই বলেছেন, আসলে নেতানিয়াহু ফিলিস্তিন সমস্যা থেকে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি সরিয়ে নিতেই ইরানের সঙ্গে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় করছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি চমৎকার সাফল্যও দেখিয়েছেন। ওবামা হয়তো তাঁকে চুপি চুপি ডেকে বলে দিয়েছেন: ঠিক আছে, ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে তুমি যত ইচ্ছা বসতি স্থাপন করো কিংবা অশান্তির খেলা খেলে যাও। কিন্তু ইরানকে তোমার গুরুজনের হাতেই ছেড়ে দাও। 
(বৈরুত যুদ্ধ চলাকালে ১৯৮২ সালের ৩ জুলাই ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাতের সঙ্গে দেখা করেন ইসরায়েলি সাংবাদিক ও শান্তিকর্মী ইউরি আভনেরি সারা বিশ্বে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেন। আরাফাতের পক্ষ থেকেও সেটা ছিল প্রথম কোনো ইসরায়েলি সাংবাদিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ। 
১৯২৩ সালে জার্মানির একটি ঐতিহ্যবাহী ধনাঢ্য ইহুদি পরিবারে এই আভনেরির জন্ম। হিটলারের উত্থানের পরপরই তাঁর বাবা ফিলিস্তিনে পাড়ি জমান। ১৯৪৭ সালে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণের আগ পর্যন্ত তিনি জীবিকার তাগিদে নানা পেশায় নিজেকে জড়িয়েছেন, জড়িয়েছেন নানা আন্দোলনে। তিনি বারবার হামলার শিকার হয়েছেন, স্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছে তাঁর লেখনী, নিষিদ্ধ করা হয়েছে তাঁর গড়ে তোলা সংগঠন। ১৯৯৩ সালে বামপন্থী ও উদার ইহুদি এবং আরব বংশোদ্ভূত ইসরায়েলিদের নিয়ে তিনি গড়ে তোলেন ‘গুশ শালোম’ নামের সংগঠন। এ সংগঠন গাজা ও পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, ইসরায়েলি কারাগারে আটক সব ফিলিস্তিনির মুক্তি, সব ইহুদি বসতি উচ্ছেদ ও জেরুজালেমকে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন দুই পক্ষেরই রাজধানী হিসেবে ঘোষণার দাবি করে। আভনেরি ২০০১ সালে ‘রাইট লিভিংহুড অ্যাওয়ার্ড’ (নোবেল পুরস্কারের বিকল্প হিসেবে বিবেচিত) লাভ করেন। সংবাদভিত্তিক ইসরায়েলি ওয়েবসাইট ওয়াই নেট-এর চালানো এক জরিপে ২০০৫ সালে আভনেরি সর্বকালের সেরা ১২৮ ইসরায়েলির মধ্যে অন্যতম নির্বাচিত হন।) 

সূত্র: আউটলুক

আকুপাই ওয়াল স্ট্রিট : নতুন পথ-সন্ধান কি অনিবার্য?


হাবিবুর রহমান তাফাদার

সভ্য পৃথিবীর মানুষ এ যাবৎ অর্থনীতি-রাজনীতি সম্মিলিত দুটি ভিন্নধর্মী পথপরিক্রমার অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়েছে। একটিকে বলা চলে সমাজতান্ত্রিক পথ এবং দ্বিতীয়টি ধনতান্ত্রিক। মাত্র ছ’-দশক সময়কালে সমাজতান্ত্রিক পথটি গণ-মানুষের আকাঙক্ষাকে তুঙ্গস্পর্শী করতে পারলেও, অনেকটা যেন নিজেই নিজের ব্যর্থতা-সীমাবদ্ধতার দিকগুলোকে প্রকট করে তোলে, বছর কুড়ি আগে, মানুষ পথ হারাবার আগেই পথটি নিজেই হারিয়ে গেছে। অনেকে বললেন, দ্বি-কেন্দ্রিক বিশ্বে শামিত্ম-স্বসিত্ম-অগ্রগতির প্রতিযোগিতামূলক ভারসাম্য রক্ষার অপরিহার্য সমীকরণটি না থাকায়, এককেন্দ্রিক বিশ্বে উন্নয়নমুখী ছোট ছোট রাষ্ট্রের তথা দুনিয়ার দরিদ্র মানুষের মুক্তির আর কোনো পথ রইলো না। অন্যরা সগর্বেই বললেন, দারিদ্র্য নিজেই আর টিকে থাকবে না, ঠাঁই হবে তার জাদুঘরে। ভালোমন্দ কতোটুকু কি হয়েছে, সে বিতর্ক নিতামত্মই নিরর্থক, জনেজনে মনেমনে সবই তার জানা আছে সকলের। এবং জানেন তারাও, দৈনিক এক ডলারের কম রোজগারে যেসব পরিবারকে চলতে হয়, খাদ্য-পুষ্টির মাথা-পিছু দৈনিক প্রায় ২২৫০ কিলো-ক্যালরি দু-তৃতীয়াংশের অধিক যারা জোটাতে পারেন না। দুনিয়া-জোড়া দরিদ্র মানুষদের দুঃখের কাঁদুনি শোনার বদলে, আমরা বরং ধনী-দেশের ‘সুখ-সমৃদ্ধ’ মানুষদের দিকে তাকাতে পারি। কেমন আছে তারা, কী ঘটছে সেখানে?
‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’- অর্থাৎ ‘ওয়াল স্ট্রিট দখল কর’-নামের একটি ‘নব-ধারা আন্দোলন’ এখন দুনিয়ার সবচেয়ে ধনী আর সুখী মানুষদের দেশ বলে পরিচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি এবং অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। অতি-সাম্প্রতিক আন্দোলনটি এখন চলমান এবং অনস্বীকার্যভাবেই দ্রম্নত প্রসারমান। প্রসঙ্গতই আমরা স্মরণ করবো, যুক্তরাজ্যের আপাত দৃশ্যমান একামত্ম স্থিতিশীল ঐতিহ্যবাহী সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিবেশে গত আগস্ট মাসে সংঘটিত ‘লন্ডন-রায়ট’ নামে পরিচিত ঘটনাটির কথাও। যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের দুটি ঘটনার প্রকাশভঙ্গি বা বহিরঙ্গে আকাশ-পাতাল ফারাক থাকলেও অমত্মরঙ্গের মিলটুকু বহিরঙ্গের অমিলের চেয়ে গভীরতর সত্য বটে। অন্য কথা বলার আগে প্রসঙ্গতই অন্যতর একটি দিকেও নজর ফেরানো যেতে পারে। তরল-সোনার মধ্য-প্রাচ্যের দেশগুলোতেও গণ-অসমেত্মাষের প্রবল ভূমিকম্প শুরম্ন হয়ে গেছে। এর শেষ কোথায়, কেউ নিশ্চিত করে জানে বলেই মনে হয় না। যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য-মধ্যপ্রাচ্য মিলিয়ে যে অবস্থা চলছে, তাতে প্রসঙ্গতই একটি বাংলা লোক-বচনের উলেস্নখ করা যেতে পারে, ‘‘শুনতে সোনার-গাঁ, হাত দিলে মাটি’। সবখানেই ‘কিছু মানুষ’ খুব সুখে আছে আর অধিকাংশ মানুষ দুঃখ-ক্ষোভের আগুনে পুড়ছে নিরমত্মর। রাষ্ট্রে-রাষ্ট্রে ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রবল ভেদ-ভিন্নতা সত্ত্বেও, যে অভিন্ন সত্যটি আর গোপন থাকছে না, তা’ হচ্ছে, সর্বত্রই সুখী আর দুঃখী মানুষেরা অনিবার্য বাসত্মবতার দুটি পৃথক পরিচয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলনটির কথাই প্রথমে বলা যাক। ‘ওয়াল স্ট্রিট’ কথাটি এখানে বাসত্মব এবং প্রতীকী-উভয়ার্থে ব্যবহৃত হয়েছে। দুনিয়ার অন্যতম প্রধান ‘ধনী-দেশ’ যুক্তরাষ্ট্রের প্রভূত সম্পদের কার্যকর মালিকানা প্রকৃতপক্ষেই বড় বড় ব্যাংকগুলোর হাতে, সকলেরই সদর-দপ্তর নিউইয়র্ক শহরের ওয়াল স্ট্রিট এলাকায়। প্রসঙ্গতই স্মরণ করছি, ১৯৯১ইং (সেভিয়েত রাষ্ট্র-ব্যবস্থার পতনের সময়টাতে) একটা প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের জন্য ওয়াশিংটনের পার্শ্ববর্তী ভার্জিনিয়াতে ছিলাম। তখন একদিন চায়ের টেবিলে আমাদের একজন প্রশিক্ষক কথায় কথায় বলেছিলেন, ‘‘অ্যাপারেন্টলি হোয়াইট হাউস অর ইউ ক্যান সে, ওয়াশিংটন রম্নলস দ্য ওয়ার্ল্ড বাট নিউইয়র্ক ওয়াল স্ট্রিট প্র্যাক্টিক্যালি রম্নলস দ্য হোয়াইট হাউস’। তখন যতোটুকু যা’ বোঝার বুঝেছিলাম, এখন তার কথার গূঢ়ার্থ বুঝতে পারছি বলেই মনে হয়। বাংলার লোকজ ধাঁধাঁ, ‘পৃথিবীটা কার বশ’? উত্তর হিসেবে একথাগুলোকেই পুনর্বিন্যসত্ম করে বলা হয়, ‘পৃথিবী টাকার বশ’। আদৌ মিথ্যে নয়। দুনিয়ার বাসত্মবতার দিকে তাকালেই দেখা যাচ্ছে, সম্পদ থাকা না-থাকাটা বড় কথা নয়, সম্পদের সুষম বণ্টন, অর্থাৎ সম্পদের ওপর জনসাধারণের সুষম অধিকার কায়েম করাটাই বড় বিবেচ্য, এদিকটাকে বাসত্মবসম্মত বিবেচনার বাইরে রেখে ‘‘অন্ধ হলেও প্রলয় বন্ধ হবে না’’।
‘‘যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অসাম্য ও কর্পোরেশনগুলোর অর্থ-লিপ্সার বিরম্নদ্ধে চলমান ওয়াল স্ট্রিট-বিরোধী বিক্ষোভ …দেশের ৭০টি বড় শহর এবং ৬শরও বেশি বসতি এ ভিন্নমতাবলম্বী আন্দোলনে যোগ দিয়েছে।…আমেরিকান পুঁজিবাদের প্রাণকেন্দ্রকেই…সমালোচনার লক্ষ্যস্থল হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে’’। এক্ষেত্রে আন্দোলনকারীদের মূল বক্তব্যটি বিশেষভাবেই উলেস্নখ্য যে, যুক্তরাষ্ট্রের ‘‘শতকরা ৪০ ভাগ সম্পদের মালিক একভাগ মার্কিন নাগরিক অর্থনৈতিক সংকটের চাপ বহন করে সাধারণ মানুষ’’ (জনকণ্ঠ, ১০-১০-১১)। এর মাত্র দুদিন আগে প্রেসিডেন্ট ওবামা নিজেই স্বীকার করেছিলেন, ‘‘বিক্ষোভকারীরা আমেরিকান জনসাধারণের হতাশারই বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে’’ (জনকণ্ঠ, ৮-১০-১১)। প্রসঙ্গত আন্দোলনকারীদের মূল বক্তব্যটি সবিশেষ উলেস্নখযোগ্য, যুক্তরাষ্ট্রের ‘‘শতকরা ৪০ ভাগ সম্পদের মালেক একভাগ মার্কিন নাগরিক অর্থনৈতিক সংকটের চাপ বহন করে সাধারণ মানুষ’’। আন্দোলন সংগঠনকারী শক্তিসমূহের অন্যতম ‘গ্রিন পার্টি’র কর্মী ম্যানস্কি বলেন, ‘‘দরিদ্ররা আর ধৈর্য ধরতে রাজি নয়’’। আন্দোলনকারীদের অন্যতম মুখপাত্র টাইলার কোমবেলিক বলছেন, ‘‘রাজনীতিকদের উচিত আমাদের কথা শোনা’’।
মার্কিন রাজনীতিক এবং অর্থ-প্রশাসকদের মধ্যেও আন্দোলনকারীদের বক্তব্য প্রসঙ্গে প্রকটভাবেই মতভিন্নতার প্রকাশ ঘটছে। ‘‘ওবামা বিক্ষোভের অনুভূতি উপলব্ধি করলেও…বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে এর অবশ্যই এক শক্তিশালী ও কার্যকর অর্থ-খাত থাকতে হবে’’। প্রশ্ন তো উঠতেই পারে, শক্তিশালী অর্থ-খাত রক্ষা করাটা বড় নাকি বৃহত্তর জনকল্যাণে পুঞ্জীভূত অর্থের সুষম বণ্টন-ব্যবহার করাটা রাজনীতির বড় বিবেচ্য বিষয়? নিউইয়র্কের গভর্নর বুমবার্গ বলছেন, বিক্ষোভকারীরা দেশের অর্থ খাতকেই আক্রমণ করছেন এবং নিউইয়র্ক সিটির শ্রমজীবী মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ বিনষ্ট করার চেষ্টা করছেন’’। আজ না হয় আগামীতে, বুমবার্গকেও হয়তো একটি অনিবার্য প্রশ্নে উত্তর দিতেই হবে, বছর-কয়েক আগে সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক মন্দা শুরম্নর পর একদিকে বড় বড় ব্যাংক ও কর্পোরেশনগুলোকে টিকিয়ে রাখার জন্য কোটি-কোটি ডলার ‘বল-আউট’ সহায়তা দেয়া হয়েছে, অথচ প্রতিষ্ঠানগুলো দরিদ্র শ্রমজীবীদেরকে অব্যাহতভাবেই ছাঁটাই করে চলেছে। সরকার বা পুঁজিপতিদের কারো পক্ষ থেকে এর প্রতিকারের কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে কি?
ডালাস ফেডারেল রিজার্ভের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড ফিসার বলছেন, বিক্ষোভকারীদের প্রতি ‘‘আমি কিছুটা সহানুভূতিশীল,…বহু মানুষের দীর্ঘদিন ধরে কাজ নেই। আমাদের আয়ের বণ্টনে খুবই অসমতা রয়েছে। মানুষজন খুবই হতাশ। আমি তাদের হতাশা অনুভব করতে পারি’’। অপরদিকে, মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট বাইডেন, চলমান ‘‘প্রতিবাদ আন্দোলনকে ‘পি-পার্টি’র সঙ্গে তুলনা করেন’’। উলেস্নখ্য যে, ডেমোক্রেটিক দলীয় ওবামা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরে, রিপাবলিকান দলীয় তৃণমূল শক্তির একটি সংগঠিত সংস্করণ হিসেবে ‘টি-পার্টি’র আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। অর্থাৎ বাইডেন বর্তমান আন্দোলনের মর্মার্থ এবং চারিত্র্য অনুধাবনের বদলে, বিষয়টিকে দ্বি-দলীয় মার্কিন রাজনীতির মোড়কে বেঁধে সম্পূর্ণ এড়িয়ে যেতে চাইছেন। বাংলাদেশে অবশ্য আমরা এমন একদেশদর্শী বক্তব্য হামেশাই শুনে থাকি।
‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলনের কিছু পোস্টারের কথা এবং প্রেসিডেন্ট ওবামার বক্তব্য উলেস্নখ করেই আজকের মতো মার্কিন-প্রসঙ্গের ইতি টানছি। প্রতিবাদীরা ‘‘কর্পোরেশনগুলোর অর্থ-লিপ্সা নয়, মানুষের চাহিদা পূরণ কর’’ এবং ‘‘শ্রমিকের বিরম্নদ্ধে লড়াই বন্ধ কর’’ ইত্যাদি লেখা পোস্টার বহন করে। প্রসঙ্গত, প্রেসিডেন্ট ওবামা স্বীকার করেছেন, ‘‘দেশের অর্থ-ব্যবস্থা যেভাবে কাজ করছে, তা’ নিয়ে জনগণের…উদ্বেগ তিনি বুঝতে পারছেন। সবসময়ই নিয়মকানুন মেনে চলেনি এমন অঙ্গ-শিল্পের দৃষ্টামত্ম হিসেবেই ওয়াল স্ট্রিটকে আমেরিকানরা দেখছে।…সবাই যে নিয়মকানুন মানেন না তা’ আমেরিকান জনগণ বুঝতে পারেন।…যারা অর্থসংকট সৃষ্টিতে সহায়তা করেছিল, তারা ক্ষমতার অপব্যবহার রোধের চেষ্টা রম্নখতে চাচ্ছে বলে জনসাধারণ ক্ষুব্ধ’’ । সবমিলিয়ে, আমার মনে একটি প্রশ্ন জেগেছে, পুঁজিবাদী দেশসমূহের প্রধান, মার্কিন-মুলুকের বড় বড় পুঁজিপতিরা কি, রাজনীতির ময়দানে বিষয়টাকে ডেমোক্রেট-রিপাবলিকান দ্বৈরথের দিকে ঠেলে দিয়েই বর্তমান অবস্থার ‘স্ট্যাটাস-কো’ বজায় রাখতে পারবেন?
এবার সদ্য-অতীত ‘লন্ডন-রায়ট’ প্রসঙ্গ। প্রকৃতপক্ষে ‘লন্ডন-রায়ট’ ঘটনাটি ছিল আকস্মিক অবাধ লুটপাটের ঘটনা। লুটপাটকারীদের মধ্যে কালো-সাদা, পুরম্নষ-মহিলা সকলেই ছিল এবং সংখ্যাধিক্য ছিল কালো তরম্নণদের। সরকারের দিক থেকে ‘সোশ্যাল বেনিফিট’ অর্থাৎ ‘সামাজিক উপকার-ভাতা’ বিপুল মাত্রায় কমিয়ে দেয়া হয়েছে, অপরদিকে তরম্নণদের পড়াশোনার ব্যয় বহুলাংশে বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বার্ষিক ৩,০০০ পাউন্ডের ‘সেশন-ফি’ ১০,০০০ পাউন্ডের ওপরে নির্ধারণ করা হয়েছে। চাকরি-ছাঁটাই ঘটছে বিপুল মাত্রায়। ছোটখাটো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, বাড়ছে ‘কর্পোরেট বিজনেস’ প্রতিষ্ঠান। তরম্নণদের সামনে লেখাপড়া চালানোর সুযোগ ভীষণভাবে সংকুচিত, চাকরির সম্ভাবনা ক্রমশ তিরোহিত। এ অবস্থাতেই আচমকা শুরম্ন হয়েছিল লুটপাটের ঘটনাটি।
অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ‘সামাজিক উপকার-ভাতা’র ওপর নির্ভরশীল পরিবারগুলো যে, অধিকতর মাত্রায় সংকটের মুখে পড়েছে, এটা সহজেই বোধগম্য। এমন পরিবারগুলোর মধ্যে যে কালোদের সংখ্যা সমধিক এ-সত্যও কারো অজানা নয়। অথচ কারণ-ঘটনা-ফলাফল বিশেস্নষণ করতে গিয়ে কেউ বললেন পিতৃ-অভিভাকত্বহীন ভগ্ন-পরিবারের কথা, ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাবের কথা, এমনকি ‘মেটাল-রক মিউজিক’-এর উচ্ছৃঙ্খল প্রভাবের কথাও। কিন্তু ভবিষ্যতের স্বপ্নহীন, কর্মহীন তরম্নণদের পরিবারগুলোর আর্থ-সামাজিক প্রকট অবক্ষয়ের কথা যেন অনেকেরই নজর-মনোযোগ এড়িয়ে গেছে। শুনেছি, মার্কিন-সম্পদের অসম বণ্টনের চেয়েও তীব্রতর সংকটপূর্ণ যুক্তরাজ্যের অবস্থা। দেশটির সম্পদের সিংহভাগ, কেউ কেউ বলেছেন অর্ধেকের বেশি পুঞ্জীভূত হয়েছে, হাতেগোনা কয়েকটি কর্পোরেট-পরিবারের দখলে। অবশ্যই স্বীকার করতে হবে, গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য এবং সামাজিক শামিত্মপ্রিয়তার ঐতিহ্যের কারণে যুক্তরাজ্য সরকার তিন-চারদিনের মধ্যেই সংকট সামাল দিতে পেরেছে। কিন্তু এটা একান্তই সাময়িক সাফল্য। আজ এ পর্যন্তই।

অকুপাই ওয়ালষ্ট্রিট-আরব বসন্ত :: পরিবর্তনের পূর্বাভাস


45.jpgওলীউর রহমান ::  বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষ বিশেষ করে মজলুম জনতা দাম্ভিক অহংকারী শক্তির জুলুম অত্যাচার থেকে মুক্তি চায়। যুদ্ধোন্মাদ ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি একের পর এক মুসলিমদেশ ধ্বংস করে চলেছে এবং সে সব দেশে ব্যাপক লুটতরাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এইসব জালেমদের হাত থেকে মুক্তি চায় মজলুম মানবতা।
এ মুক্তির মিছিল শুরু হয়েছে খোদ আমেরিকা এবং ইউরোপ থেকেই অকুপাই আন্দোলনের নামে। পুঁজিবাদী আমেরিকা, ব্রিটেন এবং ইউরোপ জুড়ে পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের আন্দোলন হলো ‘অকুপাই ওয়ালষ্ট্রিট আন্দোলন’। অকুপাই আন্দোলন হলো ১% পুঁজিপতির বিরুদ্ধে ৯৯% পুঁজিহীন মানুষের আন্দোলন। পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদী ব্যবস্থাপনার বদৌলতে বিশ্বের কেবল একভাগ সুবিধাবাদী মানুষ লাগামহীন ভাবে বিশ্বের ৯৯ ভাগ সম্পদ কুক্ষিগত করে রেখেছে এবং বিশ্বের ৯৯% সাধারণ মানুষের উপর অর্থনৈতিক নীপিড়ন চালিয়ে যাচ্ছে। আর এই এক ভাগ পুঁজিপতি হলো শাসক এবং শোষক শ্রেণী। এটা হলো অকুপাই আন্দোলন কারীদের ধারণা। এ কারণে সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার অকাল মৃত্যুর পর নিজ জন্মভূমিতেই পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক তথা পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার পতনের ডাক উঠেছে। পুঁজিপতিদের অর্থনৈতিক শোষণ এবং পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার চরম ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের জানুয়ারী থেকে আমেরিকার নিউইয়র্ক শহর থেকে শুরু হয়েছে পুঁজিবাদ বিরোধী অকুপাই আন্দোলন। এপর্যন্ত এআন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে গোটা যুক্তরাষ্ট্র সহ ব্রিটেন, ইটালী, অস্টেলিয়া, জার্মানী, স্পেন, আয়ারল্যন্ড, পর্তুগাল ইত্যাদি দেশে। অকুপাই আন্দোলন পুঁজিবাদের পতন ঘন্টা বাজিয়ে তুলেছে। পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার পিঠ এখন দেয়ালে ঠেকেগেছে। অকুপাই সহ আরো বেশ কিছু ইস্যু যেকোন সময় যুক্তরাষ্ট্রে টালমাটাল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেদিতে পারে। অর্থনৈতিক মন্দা মুকাবেলায় গত নভেম্বর মাসে গ্রীসের পাপান্দ্রেয় সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। একই পরিণতির সম্মুখীন হয়েছেন ইটালীর প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বার্লুস্কুনীর সরকার। চতুর্থ বারেরমত নির্বাচিত হওয়ার মাত্র ২৬ সপ্তাহ পর জনগণের আন্দোলনের মুখে ইটালীর মত একটি দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ এবং গ্রীসের পাপান্দ্রেয় সরকারের পদত্যাগ থেকে ইউরোপজুড়ে পুঁজিবাদের ব্যর্থতা কোন পর্যায়ে রয়েছে তা কিছুটা অনুধাবন করা যায়।

আমেরিকা ও ব্রিটেনে চলছে এখন অর্থনৈতিক সংকট। আর এই সংকট মোকাবেলা করার জন্য নতুন একটি যুদ্ধক্ষেত্রের খুব প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। এজন্য হন্য হয়ে খুঁজা হচ্ছে একটি যুদ্ধক্ষেত্র। এক্ষেত্রে ইরান ও পাকিস্থান রয়েছে তালিকার প্রথম পর্যায়ে। অভিজ্ঞ মহলের ধারণা ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যেভাবে অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন অনুরূপ তাদের ধ্বংসাতœক যুদ্ধের খেলাও এক পর্যায়ের পরিসমাপ্তির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ইঙ্গ-মার্কিনীরা আফগানিস্থানে পর্যুদস্তু হয়ে এখন রাশিয়ার মত পরিণতি বরণ করার পর্যায়ে রয়েছে। তালেবান নেতাদের সঙ্গে চলছে এখন আমেরিকার গোপন আলোচনা। ইরানের পারমানবিক কর্মসূচীর উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকা গায়েপড়ে ইরানের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছিল ইরান তার দাতভাঙ্গা জবাব দিতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেনি। আমেকিার শ্বাসনালী হরমুজ প্রণালী থেকে ইরান আমেরিকার যুদ্ধজাহাজ বিদায় করে দিয়ে হরমুজ প্রণালীকে চেপে ধরার হুমকি দিয়েছিলো। চীন ও রাশিয়া কঠোর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। পরিস্থিতি সামাল দিতে স্বয়ং বারাক উবামা ইরানরে সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার কাছে চিঠি লিখেন। বারাক উবামা ভালকরে আঁচ করতে পেরেছিলেন যে, ইরানের সাথে যুদ্ধ বাঁধালে তাকে চরম মূল্য দিতে হবে। মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির কারণে ইসরাঈল ও এখন বেকায়দায়। সিরিয়ার সর্বশেষ পরিস্থিতি ইসরাঈলী নেতাদের ঘুম হারাম করে দিয়েছে। কারণ সিরিয়ার আসাদের বিদায় হলে মুসলিম ব্রাদার হুডের সমমনা কোন দল ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা রয়েছে। আর এধরনের কোন দল সিরিয়ার ক্ষমতায় আসলে এটা ইসরাঈলের জন্য অবশ্যই চিন্তার বিষয়। এভাবে ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর ক্ষমতার বলয় সংকুচিত হয়ে আসছে। গ্রীস, ইটালী থেকে পরিবর্তনের যে ধারা শুরু হয়েছে তা হয়ত একসময় ইউরোপ বিপবে রূপ নেবে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন পুঁজিবাদের ব্যর্থতা এবং ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী বলয়ের যুদ্ধন্মাদনার পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্ট ইউরোপ জুড়ে গণমানুষের অসন্তুস এবং মধ্যপ্রাচ্যের চলমান পরিস্থিতি বিশ্ব রাজনীতিতে এক গুণগত পরিবর্তন সৃষ্টি করবে। বিশ্বরাজনীতিতে নেতৃত্বের ভারসাম্য সৃষ্টি হবে। আগমন ঘটবে নতুন নেতৃত্বের। ইঙ্গ-মার্কিন যুদ্ধোন্মাদ শক্তির দম্ভচুর্ণ করে শক্তির ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের চলমান পরিস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান পরিস্থিতি পরাশক্তি আমেরিকা এবং তার দোসরদের সম্পূর্ণ প্রতিকুলে। মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান পরিস্থিতির কারণে সাম্রাজ্যবাদীরা রীতিমত শংকিত। ‘আরব বসন্ত’ অর্থ হলো আরবের সুদিন। আরব জনগণের কাছে ‘ইতিফাদাই’ পরিচিত শব্দ। ইনতিফাদা অর্থ গণজাগরণ বা গণ অভ্যূত্থান। তিউনিশিয়া, মিশর, লিবিয়া ও সিরিয়ার গণ অভ্যূত্থানকে ইনতিফাদা বলাই ছিল অধিক সামঞ্জস্য পূর্ণ। আরব বসন্ত শব্দটি পশ্চিমা মিডিয়াই তৈরী করেছিল। কোন কোন দেশে তারা সরাসরি সহযোগিতা ও করেছিল। লিবিয়ায় সরাসরি ন্যাটো বাহিনী সামরিক হস্তক্ষেপ করেছিল। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের চিরাচরিত নিয়ম হলো যতদিন স্বার্থ উদ্যার করা যাবে ততদিনই তাদের সেবাদাসদের প্রতি সম্পর্ক থাকবে আর স্বার্থ ফুরালে শুধু কেটে পড়বেনা বরং বংশবদদের বুকে বন্দুক তাক করতেও দ্বিধাবোধ করবেনা। পশ্চিমারা মনে করেছিলযে, আরব জনগণ তাদের তাবেদার একনায়কদের তাড়িয়ে পশ্চিমা গনতন্ত্রের দিকেই এগিয়ে আসবে। কিন্তু পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে এখন অন্য রকম। আরব জনতার কাছে পশ্চিমা গনতন্ত্রের চেয়ে ইসলামী খেলাফত রাষ্ট্রব্যবস্থাই অধিক পছন্দনীয় এবং পরিচিত। আর একারণে খেলাফত রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তন করার ভাসনাই তাদের মধ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছে। যা মরক্কো, তিউনিসিয়া, ও মিশরের নির্বাচনে প্রতিফলিত হয়েছে।

আরব বসন্ত বা মধ্যপ্রাচ্যের একনায়কদের বিরুদ্ধে গণবিষ্ফোরণ ইতিহাসের এক চিরাচরিত সত্যকে আবারো বাস্তবে রূপান্তরিত করে দিয়েছে যে, অত্যাচার নির্যাতন চালিয়ে জনতার প্রতিবাদী কন্ঠকে চিরদিন স্তব্দ করে রাখা যায়না, পেশী শক্তি দিয়ে ক্ষমতার মসনদকে চিরদিন ঠিকিয়ে রাখা যায়না, নিজ দেশের মানুষের বিরুদ্ধের যুদ্ধের পরিণতি কখনো ভাল হয়না, শোষণও বঞ্চনার বিরুদ্ধে জালেম অত্যাচারীর লৌহকপাটে লাথি মেরে মজলুম জনতার স্বতঃ ষ্ফুর্ত আন্দোলন কোনদিন খালিহাতে ফিরে না, বিজয়ও সফলতা জালেমের বিরুদ্ধে মজলুম মানুষের ঐক্যদ্ধ আন্দোলনকে স্বাগত জানায়। মধ্যপ্রাচ্যের একনায়কদের জুলুম অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনতার রক্তাক্ত আন্দোলন একেরপর এক বিজয় মাল্য ছিনিয়ে আনছে।

তিউনিসিয়ার দীর্ঘদিনের শাসক বেন আলীর পতনের পর ২০১১ সালের অক্টোবর মাসে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে রশীদ ঘানুশীর ইসলামী দল আন্নাহদা ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। অথচ সেখানে দীর্ঘদিন যাবত ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল এবং অনেক শীর্ষ নেতা দীর্ঘদিন পর্যন্ত নির্বাসনে ছিলেন। আরব বসন্তের সূচনা হয় তিউনিসিয়া থেকে। পশ্চিমাদের অনেক ষড়যন্ত্র সত্বেও তাদের দালাল মিশরের হোসনে মোবারকও ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। তাহরীর স্কোয়ারের রক্তক্ষয়ী আন্দোলন ও গণ অভ্যূত্থানে হোসনে মোবারকের পতন ঘটে। শহীদের রক্ত বৃথা যায়না, শহীদ হাসান আলবান্না, শহীদ আব্দুলকাদীর আওদাহ, যয়নব আলগাজালী, সৈয়িদ কুতুব শহীদের রক্তে সিক্ত মিশরে আবারো জেগে উঠেছে আল ইখওয়ানুল মুসলিমীন তথা মুসলিম ব্রাদার হুড। তাদের রাজনৈতিক শাখা জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি মিশরের প্রথম দফা নির্বাচনে ৩৬.৬% ভোট পেয়ে সংখ্যা গরিষ্ঠতা লাভ করে। সেখানে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে অন্য একটি ইসলামী দল আন্নুর। অথচ সেখানেও ইসলামী রাজনীতি কয়েক যুগ যাবৎ নিষিদ্ধ ছিল এবং সেখানে ইসলামী আন্দোলনের হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে স্বৈর শাসক কর্ণেল নাসের, আনওয়ার সাদাত ও হোসনে মোবারক হত্যা করেছিল।

লিবিয়ার পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। আফ্রিকার লৌহ মানব ৪২ বছরের রাষ্ট্র নায়ক কর্ণেল গাদ্দাফি ছিলেন আমেরিকা সহ পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের পথের কাটা। তাই লিবিয়ার এনটিসি যোদ্ধাদের সাথে সরাসরি ন্যাটো বাহিনী সামরিক অভিযানে অংশ নেয় এবং আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলী প্রদর্শন করে নির্দয়ভাবে মোয়াম্মার গাদ্দাফিকে হত্যা করা হয়। পশ্চিমারা মনেকরে ছিল যে, লিবিয়ায় গাদ্দাফিকে হত্যাকরে তাদের বংশবদ কাউকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে। কিন্তু তাদের দূরভিসন্ধি সফল হতে দিচ্ছেনা স্বাধিনতাকামী ইসলামী যোদ্ধারা। ন্যাটো নির্ভর নতুন সরকার ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছে যে, ইসলামী শরিয়াহ হবে গণতান্ত্রিক লিবিয়ার আইনের ভিত্তি।

ইয়েমেনের একনায়ক আলী আব্দুলাহ সালেহ ও জনগণের আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা হস্তান্তর চুক্তিতে সই করতে বাধ্য হয়েছেন। সিরিয়ার বাসার আল আসাদের অবস্থাও পতনের দ্বারপ্রান্তে। আরবলীগ সিরিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। সিরিয়ায় আসাদের বিদায় হলে সেখানেও ইসলামপন্থী সরকার আসার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। মরক্কোতে একনায়কতন্ত্র বিলূপ্ত হয়ে সেখানকার নির্বাচনে ইসলামী দল জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে সরকার গঠন করেছে। এদিকে তুরস্কে সেক্যুলার রাষ্ট্রের বিপরীতে প্রয়াত নাজমুদ্দিন আরবাকানের ইসলামী দল একেপি সরকার গঠন করেছে।

আমেরিকার অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলন এবং মধ্যপ্রাচ্যের গণ বিষ্ফোরণের মধ্যে পদ্ধতিগত ভিন্নতা থাকলেও উভয় আন্দোলনের মধ্যে লক্ষ্য উদ্দেশ্যের দিক থেকে অনেক সাযুজ্যতা রয়েছে। উভয়ের উদ্দেশ্য হলো অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তি। একারণে অকুপাই আন্দোলন, গ্রীসের পাপান্দ্রেয় সরকার এবং ইটালীর সিলভিও সরকারের বিদায়, আরব বসন্তের বিষ্ফোরণে মধ্যপ্রাচ্যের একনায়কদের করুন পরিনতি, তাহরীর স্কোয়ার, বেনগাজি ও দামেস্কের ঘটনা সমূহ, তিউনিশিয়া, মিশর ও মরক্কোয় ইসলামপন্থীদের সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন এবং তুরস্কের রাজনৈতিক পরিবর্তন বিশ্বরাজনীতিতে একটি গুণগত পরিবর্তকে সুস্পষ্ট করে দিয়েছে। আর সেই পরিবর্তিত বিশ্ব রাজনৈতিক অঙ্গনে উদিয়মান মুসলিম শক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান নিয়ে আবির্ভূত হবে। একারণে মুসলিম শক্তির অনিবার্য উত্থান এবং উপস্থিতিকে প্রতিহত করার জন্য মার্কিন-ভারত-ইসরাঈলী জোট নানাবিদ ষড়যন্ত্র ও প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে ইসলামী শক্তির সম্ভাব্য উত্থানে চীন ও রাশিয়া আশায় বুক বেধেছে। তারা উদিয়মান ইসলামী শক্তিকে কাছে পেতে চায় আমেরিকার ছড়ি ঘুরানো এবং তাদের ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড থেকে পৃথিবীকে মুক্ত করার জন্য। এখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো গণ-মানুষের ত্যাগ এবং কোরবানী যাতে ব্যর্থ না হয় এবং অর্জিত সফলতা যাতে কেউ নস্যাৎ করেদিতে না পারে এজন্য বিভিন্ন দেশের বিপবোত্তর পরিস্থিতিকে ইসলামী নেতৃবৃন্দ তাদের মেধা দক্ষতা এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দ্বারা সামাল দিতে হবে। বিপবোত্তর ইসলামপন্থী সরকার গুলো তাদের দূরদর্শিতার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ সফলতা ও সমৃদ্ধির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও একটি মজবুত অবস্থান তৈরী করেনিতে হবে। যাতে দেশে দেশে আর মুসলমানদের রক্ত নিয়ে কোন অপশক্তি হোলি খেলা খেলতে না পারে।
- ওলিউর রহমান
লেখক, প্রাবন্ধিক ও গ্রন্থকার, ইসলামপুর, মেজরটিলা, সিলেট।

 

মুসলিম ব্রাদারহুডের জোয়ার


সারোয়ার কবীর
প্রায় ৬০ বছর আগে মিসরীয় সেনাবাহিনী এখনকার মতোই রাজনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছিল। ১৯৫২ সালের ২৯ ডিসেম্বর মেজর গামাল আবদুল নাসের সেনা অফিসার ও মুসলিম ব্রাদার হুড নেতাদের সঙ্গে এক বৈঠকে বলেছিলেন, 'আজকে নির্বাচন দিলে আল-নাহান জিতবে, আমরা নয়। তখন আমাদের সাফল্য বলে কিছু থাকবে না।' নাসের ছিলেন জুলাই অভ্যুত্থানে সে দেশের বাদশাহ ফারুককে উৎখাতকারী ফ্রি অফিসার্স মুভমেন্টের নেতা। ওই বৈঠকে তিনি মিসরের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। তাকেই তখন দেশের প্রেসিডেন্টের মতো ভূমিকা নিতে হয়েছিল। দেশটির পরবর্তী ইতিহাস সবারই ভালো করে জানা। পার্লামেন্ট বিলোপ, রাজনৈতিক দলগুলো নিষিদ্ধ এবং নাগরিকদের মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়েছিল। সেনাবাহিনী রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করত। মোট কথায় মিসর স্বাধীনতা হারিয়েছিল।
১৯৫২ সালে নির্বাচন হলে যে ব্যক্তি বিজয়ী হতেন, তিনি ছিলেন মোস্তফা আল-নাহান। ধর্মনিরপেক্ষ ও উদারনৈতিক ওয়াফদ পার্টির প্রধান ছিলেন। এক সময় মিসরের সবচেয়ে জনপ্রিয় দল ছিল সেটি। উদারনৈতিকদের বিজয়ের সম্ভাবনা দেখেই মুসলিম ব্রাদার হুড নাসের এবং তার বিপ্লবী কমান্ড কাউন্সিলের নেওয়া রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তকে সমর্থন দিয়েছিল। ওই সিদ্ধান্তের কারণ আদর্শগত নয়, স্বার্থসিদ্ধির ছিল। ব্রাদার হুড নেতারা ভেবেছিলেন সেনাবাহিনীর ঘাড়ে চেপে তারা রাজনৈতিক ফায়দা আদায় করবেন। কিন্তু তাদের সেই হিসাব ভুল বলে প্রমাণিত হয়। ১৯৫৪ সালে নাসের ও তার সহযোগীরা সেনাবাহিনীতে প্রাধান্য বিস্তার করেন এবং গণতন্ত্রপন্থি অফিসারদের বের করে দেন। উদারনীতিকদের তো বটেই, তাদের পুরনো মিত্র মুসলিম ব্রাদার হুডকে দমন করে কঠিন হাতে। ৭০ দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত দলটিকে তৃণমূল থেকে উৎখাতের প্রচেষ্টা চললেও তাদের একেবারে ধ্বংস করা সম্ভব হয়নি।
বর্তমানে বিপ্লবী কমান্ড কাউন্সিল নেই। তবে মিসরের ক্ষমতায় আছে সেনাবাহিনীর সুপ্রিম কমান্ড কাউন্সিল। তরুণ বিপ্লবী আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব মেজর নাসেরের জায়গায় এখন রয়েছেন ৭৫ বছর বয়সী ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ হোসেইন তানতাবি। তার নেতৃত্বেই কাউন্সিল এখন দেশে গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের কথা বলছে। তবে তারা প্রতিষ্ঠান এবং স্বার্থের ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর আলাদা একটি মর্যাদা রাখতে চায়। প্রায় ৬০ বছর আগে পরিস্থিতি সঠিকভাবে মোকাবেলা করা হয়নি। তখন সেনাবাহিনীর কিছু ভূমিকা সংরক্ষিত রাখা হয়েছিল। কিন্তু তখনকার উদারনৈতিক ওয়াফদ পার্টির জায়গা এখন দখল করে নিয়েছে মুসলিম ব্রাদার হুড। কিছুদিন আগে, ১৯ মার্চ মিসরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো অবাধ ও গণতান্ত্রিক ভোট অনুষ্ঠিত হয়। ৭৭ দশমিক ২৭ শতাংশ ভোটার সংসদীয় নির্বাচনসহ সংবিধান সংশোধনের পক্ষে রায় দিয়েছে। নির্বাচিত ১০০ পার্লামেন্ট সদস্যকে নিয়ে সাংবিধানিক পরিষদ গঠিত হবে। ওই পরিষদ ছয় মাসের ভেতর নতুন সংবিধান প্রণয়ন করবে। তার পর তা অনুমোদন অথবা বাতিলের জন্য আরেক দফা গণভোট হবে। গত মার্চে গণভোটে 'হ্যাঁ' ভোটের পক্ষে ছিল মুসলিম ব্রাদার হুড। 'হ্যাঁ' ভোটের হার বলে দেয় ওই দলটি এখন মিসরের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক সংগঠন। তারা সেপ্টেম্বরে নির্বাচনের পক্ষে। মিসরের অন্য ইসলামী দলগুলোর একই মত। কিন্তু অনেক বামপন্থি ও উদারনীতিকসহ বেশিরভাগ ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা গণভোট দিল 'না' ভোটের পক্ষে। বর্তমানে মিসরের ধর্মনিরপেক্ষ ও উদারনৈতিক শক্তি বড়ই দুর্বল। সাংগঠনিকভাবে তারা অপরিণত এবং বৃহত্তর জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন। ওই অবস্থায় আগামী সেপ্টেম্বর কিংবা আরও এক বছর পর অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে তাদের পরাজয় অবধারিত। এ কারণেই ধরে নেওয়া হচ্ছে, সেপ্টেম্বরের নির্বাচন বিজয়ী হবে মুসলিম ব্রাদার হুড। সাংবিধানিক পরিষদে তাদের থাকবে প্রচণ্ড প্রভাব-প্রতিপত্তি। মিসর পাবে একটি ইসলামী সংবিধান। এ কারণেই সে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ ও উদারনৈতিক দলগুলোর নির্বাচন নিয়ে যত ভয় আর আশঙ্কা। তারা বিকল্প কিছু একটা চায়। কিন্তু গণভোটের ফল বা ৭৭ শতাংশ 'হ্যাঁ' ভোটের উপেক্ষা করে মিসরের ক্ষমতা যদি সেনাবাহিনীর সুপ্রিম কমান্ড কাউন্সিল আঁকড়ে থাকতে চায় কিংবা জোর করে ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান দিতে চায়, তাহলে সেটা হিতে বিপরীত হতে পারে। অনেকেই মনে করে, সেপ্টেম্বরের অবাধ নির্বাচনকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। মুসলিম ব্রাদার হুড কিংবা ইসলামী দলগুলো ক্ষমতায় গেলে তাদের পক্ষে জনপ্রিয়তা ধরে রাখা কঠিন হওয়াটাই স্বাভাবিক। যেহেতু চার বছর মেয়াদের ভেতর জনগণের চড়া আকাঙ্ক্ষা পূরণ, দুর্বল অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন, বেকারত্ব নিরসন, উন্নয়ন শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা এবং দ্রুত সামাজিক পরিবর্তন আনাটা যে কোনো সরকারের জন্য বিরাট বড় চ্যালেঞ্জ। কাজেই ধর্মনিরপেক্ষ ও উদারনৈতিক শক্তির পক্ষে নির্বাচনে ভীত না হয়ে নিজেদের সংগঠিত করাটাই উত্তম। যদিও তাদের জন্য একটি বড় সমস্যা হলো মিসরের ৫ কোটি ৫০ লাখ বয়স্ক মানুষের ৪৪ শতাংশই অশিক্ষিত এবং যাদের সবার ভোটাধিকার রয়েছে।
আরব বিশ্বে মুসলিম ব্রাদারহুডের জোয়ার : মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্রের সুবাতাস_ বিশেষ করে আরব গণজোয়ারের সুযোগ নিয়ে মুসলিম ব্রাদারহুডের ব্যাপক উত্থান ঘটেছে। ওই অঞ্চলের বেশিরভাগ দেশে তারাই এখন মূল রাজনৈতিক সংগঠন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে সব দেশের নির্বাচনে তাদের রয়েছে বিজয়ী হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা। বিশেষ করে মিসর ও তিউনিসিয়ায় তাদের ক্ষমতায় ভাগ বসানো নিশ্চিত। ইসলামী রাজনীতির বিষয়ে পাশ্চাত্যের বিশিষ্ট বিশেষজ্ঞ ফ্রানকোয়িস বারগাত বলেছেন, 'যদিও বিক্ষোভ আন্দোলনের সময় মুসলিম ব্রাদার হুড মধ্য মঞ্চে ছিল না, কিন্তু তারা এখন মিসর, তিউনিসিয়া, লিবিয়া এবং অন্যান্য দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ।' রাজনৈতিকভাবে মুসলিম ব্রাদার হুডের জন্ম মিসরে ১৯২৮ সালে। দলটির প্রতিষ্ঠাতা হলেন হাসান আল বান্না। মুসলিম ব্রাদার হুডের মূল রাজনৈতিক মন্ত্র হলো, 'আল্লাহ আমাদের লক্ষ্য, নবী মোহাম্মদ আমাদের নেতা এবং কোরআন আমাদের আইন।' যদিও দলটি এখনও গণতন্ত্রের প্রতি সমর্থন দিয়ে থাকে। 

সূত্র :বিবিসি ও এএফপি

পত্রিকা কলাম: ইসরাইল, ইন্ডিয়া ও পারস্যের ধাঁধা

পত্রিকা কলাম: ইসরাইল, ইন্ডিয়া ও পারস্যের ধাঁধা: ॥ এম. আবদুল হাফিজ ॥ বিষয়টা কতকটা পায়রার ঝাঁকে বিড়াল ছেড়ে দেয়ার মতো। ঠিক যখন ইসরাইল বিষয়টা ঘটাচ্ছিল পৃথিবীময় এই চিৎকারে যে, ই...

মঙ্গলবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১২

জার্মান সমরবাদের ভূত এখন ইসরাইলের কাঁধে : গুন্টার গ্রাস



সি রা জু র র হ মা ন
গুন্টার গ্রাস কৈশোরে জার্মানির আর-আর কিশোরদের মতোই হিটলারের কুখ্যাত এসএস বাহিনীর যুব শাখায় যোগ দিয়েছিলেন। নািসবাদের স্বরূপ এবং তার ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া ভেতর থেকে দেখার সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন। যুদ্ধ-পরবর্তীকালে তাঁর কবিতা ও রচনায় সে ফ্যাসিবাদের প্রতি ঘৃণা মূর্ত হয়ে উঠেছে। সেজন্যই তিনি আন্তর্জাতিকভাবে ‘জার্মানির বিবেক’ বলে বর্ণিত।
হিটলার ইউরোপের ওপর এবং তার জের ধরে বিশ্বব্যাপী যে যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিলেন তাতে ১০ কোটি লোক মারা গেছে বলে অনুমান করা হয়। জায়নিস্ট প্রতিষ্ঠানগুলো তখন থেকেই দাবি করে আসছে যে, নািসরা ছয় মিলিয়ন (৬০ লাখ) ইহুদিকে হত্যা করেছিল। তখন থেকে বিশ্বে আধিপত্যবাদী জায়নিস্টরা তাদের ৬০ লাখ নিয়ে এমনই প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে যে, সেই যুদ্ধে নিহত অবশিষ্ট প্রায় সাড়ে নয় কোটির কথা বিশ্ববাসী ভুলেই গেছে বলা চলে।
ইহুদিদের হিটলারের ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে’ পাঠানোর ব্যাপারে ফ্রান্সসহ কোনো কোনো দেশ নািসদের সঙ্গে সহযোগিতা করেছিলো। ব্রিটেনসহ অন্য দেশগুলো নািসবাদের বিবর্তন ও ইহুদি নির্যাতন দেখেও দেখেনি। বস্তুত জার্মানি যখন চেকস্লোভাকিয়া আক্রমণ করে তার আগে পর্যন্ত ব্রিটেনও হিটলারকে তোষণ করেছে। ১৯৩৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বরের আগে ব্রিটেন জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেনি।
যুদ্ধের পর থেকেই বিশ্ব আধিপত্যবাদী জায়নিস্টরা হিটলারের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতার জন্য ইউরোপের দেশগুলোর কাছ থেকে খুবই উচ্চমূল্য আদায় করতে শুরু করে। গোড়াতেই সব ব্যাপারে ইহুদিদের সঙ্গে সহযোগিতা করা এ মহাদেশে যেন রাষ্ট্রধর্ম হয়ে দাঁড়ায়। ইহুদি-বিদ্বেষকে দণ্ডনীয় অপরাধ করা হয় প্রায় সব ইউরোপীয় দেশে। ইউরোপ-আমেরিকার বাধ্যতামূলক সহানুভূতিকে কাজে লাগিয়ে ইহুদিরা ফিলিস্তিনি আরবদের (মুসলিম ও খ্রিস্টান) ভূমিতে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠা করে।
জাতিসংঘের প্রস্তাবে ইহুদি রাষ্ট্রের জন্য যে পরিমাণ ভূমি নির্দিষ্ট করা হয়েছিলো, আজকের ইসরাইল রাষ্ট্রের আয়তন তার প্রায় তিনগুণ। প্রথমেই ইরগুন, স্টার্ন গ্যাং প্রভৃতি মূলত পোলিশ ইহুদি সন্ত্রাসীরা প্রায় আট হাজার বর্ধিত আরব পরিবারকে উচ্ছেদ করে তাদের ভিটেবাড়ি ও আবাদি জমি দখল করে নেয়। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরাইল রাষ্ট্র ফিলিস্তিনের অবশিষ্টাংশও দখল করে। জাতিসংঘ তখন থেকে এই দখল করা আরব ভূমি ছেড়ে যাওয়ার জন্য ইসরাইলকে নির্দেশ দিয়ে বহু প্রস্তাব পাস করেছে, কিন্তু আরবদের ভিটেবাড়ি, আবাদি জমি ও ফলের বাগান উচ্ছেদ করে ইহুদি বসতি নির্মাণ অবিরাম চলছে। জাতিসংঘ অনেক প্রস্তাব পাস করে এসব বসতিকে অবৈধ ঘোষণা করেছে।
এসব প্রস্তাব কার্যকর করা সম্ভব হচ্ছে না এ কারণে যে, ইসরাইলকে বাধ্য করার কোনো প্রস্তাবে সম্মতি দিতে ইউরোপের দেশগুলোকে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে রাজি করানো যাচ্ছে না। জায়নিস্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী ইহুদিরা এসব দেশে সব গুরুত্বপূর্ণ পেশায় ঢুকে পড়েছে। ইউরোপের কোনো দেশে ইহুদিদের সংখ্যা তিন-চার শতাংশের বেশি নয়। কিন্তু সেসব দেশের পার্লামেন্টে এবং সরকারে ইহুদিদের প্রতিনিধিত্ব আনুপাতিকভাবে বেশি। তেমনি এই দেশগুলোর অর্থনীতি এবং মিডিয়াকেও তারা মুঠোর মধ্যে নিয়ে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদি প্রভাব আরও প্রকট। ইহুদি ও ইসরাইলি লবিগুলোর অনুমোদন ছাড়া এখন মার্কিন কংগ্রেসে কোনো আইন পাস করা অথবা কোনো রাজনীতিকের কোনো গুরুত্বত্বপূর্ণ পদে নির্বাচিত হওয়া প্রায় অসম্ভব। ইসরাইলের বিরুদ্ধে কোনো কথা উঠলেই সারাবিশ্বের ইহুদিরা ‘অ্যান্টিসেমিটিজমের’ (ইহুদি-বিদ্বেষের) জিগির শুরু করে দেয়, নািসদের হাতে নিহত ৬০ লাখ ইহুদির কথা তুলে কান্না জুড়ে দেয়। অর্থাত্ ত্রিশের দশকে নািসদের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার দরুন জায়নিস্টরা এখনও পশ্চিমা বিশ্বকে জিম্মি করে রেখেছে, বাকি বিশ্বকেও ব্ল্যাকমেইল করে।
পশ্চিমা সাহায্যে ক্ষুদে হিটলার
ইহুদি-বিদ্বেষ নিষিদ্ধ করার পেছনে আদি যুক্তি ছিল নািসবাদের পুনরাবির্ভাব অসম্ভব করে তোলা। জার্মান ‘মিলিটারিজমের‘ (সামরিক মনোভাবের প্রাবল্য) কারণে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দখলদার শক্তিগুলো (ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েট ইউনিয়ন ও ফ্রান্স) এ জঙ্গিবাদকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য বহু নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা চালু করে। কিন্তু অন্যদিকে ‘শত্রু-পরিবেষ্টিত ইসরাইলের আত্মরক্ষার ‘অজুহাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে সামরিক সাহায্য দান এবং সমরাস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের সাহায্যে ইসরাইল গোপনে পারমাণবিক বোমা তৈরি করেছে। তার অস্ত্রভাণ্ডারে এখন ৪০০টি পারমাণবিক বোমা আছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। কবি গুন্টার গ্রাস এখন ফাঁস করে দিলেন যে, জার্মানিও ইসরাইলকে অস্ত্র সরবরাহ করে আসছে এবং বর্তমানে ইসরাইলের জন্য দুটি পারমাণবিক সাবমেরিন তৈরি করছে।
অবিসংবাদিত সত্য এই যে, ইসরাইল এখন মধ্যপ্রাচ্যে প্রধান সামরিক শক্তি। নিজেরও অত্যন্ত আধুনিক একটা যুদ্ধাস্ত্র তৈরির শিল্প সে গড়ে তুলেছে। ভারতসহ কোনো কোনো দেশ ইসরাইলের কাছ থেকে সমরাস্ত্র আমদানি করে। বস্তুত ভারতেও ইসরাইলের সহযোগিতায় একটা অস্ত্র নির্মাণশিল্প গড়ে উঠেছে। মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক পরাশক্তির অবস্থান স্থায়ী করতে তেলআবিব সর্বদা উদগ্রীব। এ অঞ্চলের অন্য কোন দেশ শক্তিশালী হয়ে ওঠার চেষ্টা করলে ইসরাইল স্বয়ং কিংবা যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যবহার করে সে দেশকে শক্তিহীন করে দেয়া তেলআবিবের পরিচিত কৌশল। ইসরাইল গোড়া থেকেই দাবি করে এসেছে, যে কেউ তার নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ বিবেচনা করলে আগেই তাকে আক্রমণ করার অধিকার ইসরাইলের আছে। অর্থাত্ এক্ষেত্রে সে অভিযোগকারী, জজ ও জুরির ভূমিকা একাই পালন করছে। প্রথমে যুক্তরাষ্ট্র তারপর অন্যান্য পশ্চিমা শক্তি নীরবে তেলআবিবের সে অন্যায় আবদার মেনে নিয়েছে।
ইরানে ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পর সম্ভাবনা দেখা দেয় নতুন আদর্শে উজ্জীবিত ইরান ইসরাইলি আধিপত্যের প্রতি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্ররোচনা ও অস্ত্র সাহায্যে ইরাকের সাদ্দাম হোসেন ইরান আক্রমণ করেন। সেই যুদ্ধ আট বছর ধরে চলে। কিন্তু সে সাদ্দামই যখন বাগদাদের উপকণ্ঠে অসিরাকে একটা পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করেন তখন ১৯৮১ সালে ইসরাইল ভোল-পাল্টানো মার্কিন বোমারু বিমান ব্যবহার করে কেন্দ্রটি উড়িয়ে দেয়।
আট বছরের যুদ্ধের পর ইরান সাময়িকভাবে দুর্বল হয়ে যায়। অন্যদিকে সাদ্দাম হোসেনের নেতৃত্বে ইরাক শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে। তখন থেকে ইসরাইলি গোয়েন্দা বাহিনী মোসাদ প্রচার চালাতে থাকে, সাদ্দাম হোসেন গোপনে গণবিধ্বংসী (পারমাণবিক ও রাসায়নিক) অস্ত্র তৈরি করছেন। গোড়ায় ওয়াশিংটন কিংবা লন্ডন এসব প্রচারণায় বিশেষ কান দেয়নি। কিন্তু ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর (নাইন-ইলেভেন) নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটনে আল কায়েদা সন্ত্রাসের পর মার্কিন জনমত ভয়ঙ্কর রকম ইসলামবিদ্বেষী হয়ে দাঁড়ায়। সে বছরের ৭ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন আফগানিস্তান আক্রমণ করে। ইসরাইল সাদ্দামের কল্পিত গণবিধ্বংসী অস্ত্রের স্তূপের প্রচারণা বাড়িয়ে দেয়। একই সঙ্গে মোসাদ এ মর্মে ভুয়া প্রমাণ দাঁড় করায় যে, সাদ্দাম হোসেন আল কায়েদাকে সাহায্য দিচ্ছেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ আর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টোনি ব্লেয়ার ২০০৩ সালের ২০ মার্চ ইরাকের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ ঘোষণা করেন।
ইরান ওদের লক্ষ্য কেন?
সাদ্দাম ও তার ছেলেদের হত্যা করা হয়েছে। ইরাক দেশটির ধ্বংস এতো ব্যাপক ও সাংঘাতিক হয়েছে যে, আগামী ৫০ বছরে এ দেশটির আবার মাথা তুলে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা নেই। কিন্তু পাশের দেশ ইরানের বৈশিষ্ট্য তার উদ্ভাবনী প্রতিভা ও কঠোর পরিশ্রম। ইসরাইলি উস্কানিতে ইউরোপ-আমেরিকার চাপিয়ে দেয়া অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক অবরোধ সত্ত্বেও দেশটি আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, বিজ্ঞানে-প্রকৌশলে অনেক উন্নতি করেছে। বিশেষ করে পারমাণবিক প্রযুক্তিতে তার অগ্রগতিকে বন্ধুরা প্রশংসার আর শত্রুরা শঙ্কার চোখে দেখছে।
মার্কিন বিশেষজ্ঞরাও বলেছেন, ইরান এখনও পর্যন্ত ইউরেনিয়াম জ্বালানি সমৃদ্ধিকরণের কাজেই অগ্রগতি লাভ করেছে কিন্তু বোমা তৈরির কোনো চেষ্টা সে এখনও করেনি। ইরানের নেতারা বার বার বলছেন—তারা বোমা তৈরি করতে চান না; শুধু পারমাণবিক বিদ্যুত্ উত্পাদনের উন্নত জ্বালানি তৈরি করাই তাদের লক্ষ্য। ইরানের জন্য সমস্যা এই যে, সর্বোচ্চ গ্রেডের ইউরেনিয়াম দিয়ে যেমন সফলভাবে বিদ্যুত্ উত্পাদন করা যায়, তেমনি সে ইউরেনিয়াম আবার বোমা তৈরির কাজেও ব্যবহৃত হতে পারে—যদি সে প্রযুক্তি ইরান আয়ত্ত করতে পারে।
ইসরাইলি গোয়েন্দারা এটা প্রমাণ করার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে যে, বোমা তৈরির প্রযুক্তি ইরান এরই মধ্যে আয়ত্ত করে ফেলেছে এবং আগামী ক’মাসের মধ্যেই তেহরান পারমাণবিক বোমার অধিকারী হবে। মার্কিন সরকারের মূল্যায়ন কিন্তু তেমন নয়। ইচ্ছা করলেও ইরান এত শিগগির বোমা তৈরি করতে পারবে বলে তারা মনে করে না। তা সত্ত্বেও তেলআবিব বোমা ফেলে ইরানের পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্রগুলো ধ্বংস করে দেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে পীড়াপীড়ি, এমনকি ব্ল্যাকমেইল করারও চেষ্টা করছে। ইসরাইলিরা বলছে, ওয়াশিংটন কিছু না করলে তারা নিজেরাই কেন্দ্রগুলোর ওপর আক্রমণ চালাবে। তেমন অবস্থায় ইচ্ছায় হোক কিংবা অনিচ্ছায় হোক, ওয়াশিংটনও সে যুদ্ধে না জড়িয়ে পারবে না। মোসাদের লোকেরা এরই মধ্যে ইরানের একাধিক স্থানে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। এ পর্যন্ত তারা চার ইরানি পারমাণবিক বিজ্ঞানীকে খুনও করিয়েছে।
প্রেসিডেন্ট ওবামার হয়েছে মহাসমস্যা। যদিও তিনি মনে করেন না ইরানের বোমা তৈরির সময় আসন্ন, তবুও ইসরাইলের চাপ এড়িয়ে যাওয়া তার জন্য কঠিন। আর ৭ মাস পরই যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। ওবামা আরও চার বছরের জন্য ক্ষমতা পেতে চান। ইসরাইলি লবিগুলোকে অসন্তুষ্ট করে নির্বাচিত হওয়া তার জন্য সহজ হবে না। অন্যদিকে ইরাক আর আফগানিস্তানে যুগপত্ যুদ্ধে মার্কিন অর্থনীতি কাবু হয়ে পড়েছে। এ দুটি দেশে ওয়াশিংটন যতদিন জড়িত, সেটা দু’দুটি বিশ্বযুদ্ধের মোট মেয়াদের চেয়েও বেশি। মার্কিন ভোটদাতারা এখন যুদ্ধক্লান্ত।
সমরবাদের কথা পশ্চিমারা ভুলে গেছে
আগেই বলেছি, জার্মানিতে অ্যান্টিসেমিটিজম নির্মূল করতে গিয়ে আমেরিকা আর ইউরোপ জার্মান মিলিটারিজমের অভিশাপের কথা ভুলে গেছে। গুন্টার গ্রাস সম্প্রতি একটি জার্মান সাময়িকীতে প্রকাশিত ‘যে কথা বলতেই হবে’ শীর্ষক কবিতায় সে কথাটা আবার বিশ্ববাসীকে মনে করিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন—‘যে যুদ্ধবাজ জার্মানিকে দু’দুটো বিশ্বযুদ্ধে লিপ্ত করেছে, সে ভূত এখন ইসরাইলের ঘাড়ে চেপেছে।’ নাম না করে তিনি বলেছেন, ইরান এখনও পারমাণবিক বোমা তৈরি করেনি, তবুুও তার ‘প্রথম আক্রমণের’ অধিকারের জোরে ইসরাইল ইরান আক্রমণের হুমকি দিচ্ছে; অথচ ইসরাইল নিজেই গোপনে তৈরি করেছে সে বোমা।
গুন্টার গ্রাস ‘যে কথা বলতেই হবে’ কবিতায় লিখেছেন : ‘এতকাল কেন আমি নীরব আর আটকা পড়ে ছিলাম/এমন একটি বিষয়ে যেটা প্রকাশ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলায়/আমরা যারা বেঁচে থাকব সে যুদ্ধের পরে/বড়জোর পাদটীকা হয়েই থাকব আমরা।’
‘প্রথমেই আক্রমণের কথিত অধিকার/ধ্বংস করে দিতে পারে ইরানি জাতিকে/যারা কে গলাবাজ আর সাজানো জলসার পদানত/কেননা তার অধীনে নাকি অ্যাটম বোমা তৈরির কাজ চলছে।’
‘তবু অন্য সে দেশটির নাম নিতে কেন আমার ভরসা হচ্ছে না/বহু বছর ধরে যারা অ্যাটম বোমা গোপন রেখেছে ও বাড়াচ্ছে/আর সবার নজরদারি আর তদারকির বাইরে।’ লিখেছেন গুন্টার গ্রাস।
যে ইহুদিরা একদা নির্যাতিত ছিল, তারা এখন নির্যাতক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইঙ্গিতে গুন্টার গ্রাস বলতে চেয়েছেন, জার্মান সমরবাদ প্রথমে ইউরোপে এবং তার জের ধরে বাকি বিশ্বে সর্বনাশ ডেকে এনেছিল, ইসরাইলি সমরবাদও তেমনি মধ্যপ্রাচ্যে অশান্তি ডেকে আনতে চায় এবং সে অশান্তি খুব সম্ভবত বৃহত্তর বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে।
গুন্টার গ্রাস এতকাল ইসরাইলসহ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত ছিলেন। বহুবার তিনি ইসরাইল সফরও করেছেন। কিন্তু ইসরাইলি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলে দিয়েছেন—তাকে আর ইসরাইলে আসতে দেয়া হবে না। বিশ্বব্যাপী ইসরাইলি লবিগুলো তার সমালোচনার প্রতিযোগিতা শুরু করে দিয়েছে বলেই মনে হয়। এতকাল যিনি ‘হিরো’ ছিলেন, মাত্র একটি কবিতা লিখে তিনি জায়নিস্ট জগতে ‘ভিলেন’ হয়ে গেলেন।
কালো মেঘের রুপালি বর্ণচ্ছটার মতো একটা আশার আলো আছে জার্মান চিন্তানায়ক গুন্টার গ্রাসের এই সাময়িক বিপত্তির মধ্যে। ইসরাইল যে সত্যি সত্যি বিশ্বশান্তির প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে, সে কথা এখন অনেকেই ভাবতে শুরু করবেন। গুন্টারের সাহিত্য অনেকেই পড়েননি কিন্তু তার এই বহু আলোচিত কবিতাটি বহু দেশে, বহু ভাষায় অনূদিত ও প্রকাশিত হয়েছে। (লন্ডন, পহেলা বৈশাখ, ১৪১৯)
serajurrahman@btinternet.com

রবিবার, ৮ এপ্রিল, ২০১২

রিপাবলিকানদের প্রার্থী বাছাইয়ের আবডালে



শান্তনু মজুমদার | তারিখ: ০৭-০২-২০১২
বিপজ্জনক আশ্বাস, জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের সুড়সুড়ি, কায়েমি স্বার্থবাদীদের মনপছন্দ কথাবার্তা, প্রচ্ছন্ন সাম্প্রদায়িকতা, রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার—এসব মিলিয়ে বেশ জম্পেশ হয়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধী দল রিপাবলিকান পার্টির হয়ে প্রেসিডেন্ট পদে লড়াইয়ের প্রার্থীটি বেছে নেওয়ার অঙ্গরাজ্যভিত্তিক প্রাইমারি নির্বাচন-পর্বটি। সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রাইমারিতে জেতা প্রার্থীই হবেন আগামী নভেম্বরে রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী। সবকিছু এখনকার মতো থাকলে এই প্রার্থী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়বেন ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী বারাক ওবামার সঙ্গে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার খোয়াব অনেকেই দেখতে পারেন। 
প্রতিবার দেখা যায়, প্রধান দুই দলের বাইরে কিছু খুচরা প্রার্থীও নির্বাচনে দাঁড়িয়ে যান; তাঁরা কেউ লোক হাসান, কেউ সামান্য সময়ের জন্য কিছু আলোড়ন তুলে হারিয়ে যান। দলের ভেতরেও একই অবস্থা হয়; এবারও তা-ই হয়েছে। শেষাবধি ‘কতজন এল-গেল’—একটা অবস্থাই তৈরি হয়েছে। দৌড়ে সত্যিকার অর্থে টিকে আছেন দুজন—তাঁরা হলেন ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের সাবেক গভর্নর মিট রমনি ও হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভসের সাবেক স্পিকার নিট গিংরিচ। রমনি ধনকুবের যুগের হাওয়া বুঝতে পারা মধ্যপন্থী রিপাবলিকান, যিনি রক্ষণশীলতার ধারক-বাহক হলেও দলের সমর্থকদের বাইরে সাধারণ মধ্যপন্থী ভোটারদের মন জয়ের আশায় প্রতিক্রিয়াশীলতার পক্ষে চিৎকার করা থেকে বিরত থাকেন। অন্যদিকে, গিংরিচ হচ্ছেন ‘ডানপন্থী’ রাজনীতির বলতে গেলে ক্ল্যাসিকাল উদাহরণ। সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্ম-বর্ণের পুরুষ ভোটাররাই তাঁর মূল ভরসা। তবে মনে রাখা দরকার, এই তফাতগুলো অবশ্যই রমনি ও গিংরিচের মধ্যে অর্থপূর্ণ কোনো ভেদ তৈরি করে না। 
এই দুই প্রার্থীর মধ্যে বরং মিল আছে বেশ কিছু। 
রমনি ও গিংরিচ—দুজনই দলীয় প্রাইমারিগুলো জেতার জন্য নানা ধরনের বিপজ্জনক আশ্বাস দিয়ে চলছেন। জানুয়ারির শেষ দিনটিতে অনুষ্ঠিত ফ্লোরিডা প্রাইমারি নির্বাচনে জেতার জন্য মরিয়া গিংরিচ চাঁদের মাটিতে মার্কিনদের জন্য স্থায়ী একটি কলোনি তৈরির প্রতিশ্রুতি দেন। চাঁদ গিংরিচের পারিবারিক সম্পত্তি কি না, চাঁদের মালিকানা নিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে বাকি বিশ্বের কোনো বক্তব্য থাকতে পারে কি না—এসব নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মূলধারায় কেউ কোনো প্রশ্ন তুলেছে বলে জানা যাচ্ছে না। গড় মার্কিনদের জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের অনুভূতিতে এহেন সুড়সুড়ি দেওয়াকে খারাপ চোখেও দেখা হচ্ছে না। ব্যাপারটা এমন যেন, চাঁদ নামের উপগ্রহটি পৃথিবীর নয়, যুক্তরাষ্ট্রের! গিংরিচের চাঁদসংক্রান্ত ভাবনাকে রমনি উদ্ভট মনে করলেও গোটা বিশ্বকে অপ্রাসঙ্গিক বিবেচনা করা গিংরিচের এহেন মার্কিন-মস্তানির সে অর্থে কোনো সমালোচনা করেননি। ধরে নেওয়া যায়, গড় মার্কিনদের জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের অনুভূতিতে ঘা লাগার ভয়ে। বিপজ্জনক আশ্বাসের দিক থেকে রমনিও পিছিয়ে থাকছেন না। মধ্যবিত্তের সমর্থন লুটে নেওয়ায় বেপরোয়া এই অতিধনী প্রার্থী জানিয়েছেন, তিনি দরিদ্রদের নিয়ে উদ্বিগ্ন নন বরং তিনি মধ্যবিত্তকে সাহায্য করতে চান। এই মধ্যবিত্তরাই সমাজের ৯০-৯৫ ভাগ বলে দাবি করেন রমনি। কয়েক বছরব্যাপী মন্দাজনিত দুরবস্থা বিবেচনায় নিলে রমনির এই হিসাব মেনে নেওয়া মুশকিল। তবে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে, সরাসরি দরিদ্রবিরোধী অবস্থান নিলেও রমনির কোনো অসুবিধা হয়নি। ফ্লোরিডা প্রাইমারি বেশ ভালোভাবেই জিতেছেন তিনি। 
কায়েমি স্বার্থবাদীদের মনের মানুষ হয়ে ওঠার বাসনাতাড়িত রমনি ও গিংরিচ এবার লক্ষ্যণীয়ভাবে বেছে নিয়েছেন ফিলিস্তিন প্রসঙ্গটি। বলা হচ্ছে, সমস্যার জন্য ফিলিস্তিনিরাই দায়ী; ইসরায়েলিরা ‘দুই রাষ্ট্র’ভিত্তিক সমাধানে খুশিমনে রাজি থাকলেও ফিলিস্তিনিদের লক্ষ্য হচ্ছে ইসরায়েলকে মানচিত্র থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। অনৈতিহাসিক এই বিষোদগার শুনতে ইসরায়েলের কট্টর ডানপন্থী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বা উগ্র জাতীয়তাবাদী ইসরেইল বেইতেনু পার্টি কিংবা কট্টর ইহুদি ধর্মবাদী শাস পার্টির কথাবার্তা মনে হয়। কিন্তু কথাটা মিট রমনির, যিনি কিনা রিপাবলিকান টিকিট পাওয়ামাত্র যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট তথা বিশ্বের অধীশ্বর হয়ে ওঠার পথে অর্ধেকটা পথ হেঁটে ফেলবেন। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রে অত্যন্ত প্রভাবশালী জায়নবাদীদের একচেটিয়া হাততালি রমনির পক্ষে যাচ্ছে না। কেননা, গিংরিচ তো কম যাচ্ছেন না। গিংরিচ জানিয়েছেন, তিনি প্রেসিডেন্ট হতে পারলে তেলআবিব থেকে মার্কিন দূতাবাস দ্রুততম সময়ের মধ্যে জেরুজালেমে নিয়ে যাবেন। তিনি মনে করেন, ওবামা আমলে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে সমর্থন দিচ্ছে না, বরং দেশটির সঙ্গে ঝগড়া বাধাচ্ছে এবং দেশটিকে পারমাণবিক বোমা-আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। গিংরিচ ইসরায়েল কর্তৃক গাজা অবরুদ্ধ করে রাখারও পক্ষে। এ ধরনের উক্তিতে দুই লাভ—এতে করে জায়নবাদী লবি তুষ্ট থাকছে আর ওবামার পিতৃধর্মের ব্যাপারটা একটুখানি মনে করিয়ে দিয়ে হালকা সাম্প্রদায়িকতার চর্চা করে নেওয়া হচ্ছে, যা মূলধারার রক্ষণশীল ও প্রতিক্রিয়াশীলদের আশ্বস্ত করে এবং মানসিক আরাম দেয়। গিংরিচের কথা এখানেই শেষ নয়। তিনি মনে করেন, ‘ফিলিস্তিনি’ জনগণ ব্যাপারটাই ‘বানানো’, তাদের বলতে হবে ‘আরব’; আর ‘দুই রাষ্ট্র’ সমাধান যদি বাস্তবায়ন করতেই হয়, তাহলে ‘ফিলিস্তিনিদের অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে যে তারা শান্তি ও সমঝোতা চায়’। 
ইতিহাস, বস্তুনিষ্ঠতা, চোখের সামনে ঘটমান বর্তমান—কোনো কিছুই রমনি ও গিংরিচের বিবেচনায় নেই। গাজা থেকে ছোড়া বলতে গেলে অনেকটা প্রতীকী প্রতিবাদমূলক বেশির ভাগ সময় ক্ষতিহীন রকেটগুলো বড় হয়ে যায় রিপাবলিকান প্রার্থীদের কাছে। হাজার হাজার ফিলিস্তিনির জীবনহানি, লাখ লাখ ফিলিস্তিনির উদ্বাস্তু হয়ে যাওয়া, বিশ্বজুড়ে মিলিয়ন মিলিয়ন শান্তিকামী মানুষের প্রত্যাশা—কিছুতেই কিছু এসে যায় না রমনি ও গিংরিচের। 
মার্কিন রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার সাংঘাতিক। প্রার্থীরা বলতে গেলে বাতিকগ্রস্তের মতো এই ইস্যুতে নিজেকে অন্যদের তুলনায় উত্তম প্রমাণে আকুল থাকেন। প্রেসিডেন্ট পদের লড়াইয়ে থাকার সময় নিজেকে অত্যন্ত নিষ্ঠাবান একজন ক্যাথলিক প্রমাণের জন্য ওবামাকে কত চেষ্টাই না করতে হয়েছিল। আর ওবামার খ্রিষ্টানিতে গলদ খুঁজে বের করার জন্য গলদঘর্ম হতে হয়েছিল রিপাবলিকানদের। রাজনীতিতে ধর্ম নিয়ে মূল খেলাটা সারা দুনিয়ায় ডানপন্থীরাই খেলে। মধ্যপন্থী, উদারনীতিক, বামপন্থীরা কোথাও এর পাল্টা জবাব দিতে চায়, অনেক জায়গায় চাপ সামলাতে না পেরে খেলায় ঢুকে পড়ে। সে যা-ই হোক, মূল লড়াই যখন শুরু হবে, অর্থাৎ ডেমোক্র্যাটদের প্রার্থী হিসেবে ওবামা মাঠে নামার পর ধর্মযুক্ত রাজনীতি আরও কুৎসিত করে তুলবেন রিপাবলিকানরা—এটা নিশ্চিত বলা যায়। এখন নিজেদের মধ্যে চলছে। গিংরিচের অভিযোগের মধ্যে আছে ম্যাসাচুসেটসের গভর্নর থাকার সময় রমনি কর্তৃক ক্যাথলিক হাসপাতালগুলোর ‘ইচ্ছার বিরুদ্ধে’ জন্মবিরতিকরণের পিল সরবরাহ চালু করা এবং সরকারি তহবিল থেকে নার্সিং হোমে বয়স্ক ইহুদিদের জন্য ‘ধর্মসম্মত’ কোশার খাবার সরবরাহের জন্য ছয় লাখ ডলার না দেওয়া। ধর্মীয় স্বাধীনতার বিরোধিতার ক্ষেত্রে রমনিকে ওবামার মতোই মনে করছেন গিংরিচ। এ ছাড়া রমনি যে একজন মর্মন (Mormon), এ কথাও নানা কায়দায় গিংরিচ শিবির থেকে প্রচার করে ফায়দা ওঠানোর চেষ্টা হচ্ছে। উল্লেখ্য, মর্মনরা যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেওয়া ক্ষুদ্র একটি খ্রিষ্টানধারা। তারা পুরুষের বহুবিবাহে বিশ্বাসী। বর্তমানে অবশ্য এই বিশ্বাসটির চর্চা সেভাবে হয় না; রমনি নিজেও এটা চর্চা করেন না, কিন্তু তার পরও রেহাই নেই। একই ধর্ম হলে কী হয়েছে? মর্মনরা নিজ ধর্মের ভেতরে সংখ্যালঘু, এমনকি মর্মনরা আদৌ খ্রিষ্টান কি না তা নিয়ে অনেক সময় তর্ক বাধিয়ে দেয় সংখ্যাগুরু ক্যাথলিক ধর্মবাদী বা প্রভাবশালী কট্টরপন্থী ইভানজেলিস্টরা। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারকারীরা সংখ্যালঘুদের শেষ করে দিতে চায়। সংখ্যালঘু ধর্ম না পাওয়া গেলে কিংবা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সাইজ করে ফেলা শেষ হয়ে গেলে, নিজ ধর্মের ভেতর সংখ্যালঘু ধারাকে বেছে নেয় এরা। রমনির ক্ষেত্রে এটা ঘটছে। রমনি নিজেও রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার করছেন। ফিলিস্তিন প্রসঙ্গে জায়নবাদী ব্যাখ্যা-বয়ানের পক্ষ নিয়ে গোঁড়া ক্যাথলিক, গোঁড়া ইহুদি আর জায়নবাদীদের মন রক্ষায় রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার করছেন তিনি। 
এ ছাড়া চলছে ডলারের খেলা। এ ক্ষেত্রে রমনি অনেক এগিয়ে। ধারেকাছে থাকছেন না গিংরিচ। তাঁর সম্বল উগ্র, আক্রমণাত্মক, কড়া রক্ষণশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল কথাবার্তা। সর্বশেষ ফ্লোরিডা প্রাইমারিতে জিতে অবস্থান অনেকটাই মজবুত করে নিয়েছেন রমনি। তবে গিংরিচ লড়ে যাচ্ছেন বেশ ভালোভাবে। নিজের পক্ষে সাফাইটা চমৎকার গাইছেন গিংরিচ। ১৯৯৬ সালে বব ডোল আর ২০০৮ সালে জন ম্যাককেইনের মতো মডারেট লোককে প্রার্থী বানিয়ে কী লাভ হয়েছে? প্রশ্ন গিংরিচের। ইঙ্গিতটা স্পষ্ট—রমনি মডারেট। মডারেটে আর কাজ হবে না রিপাবলিকানদের। সাঁড়াশি লোক চাই হোয়াইট হাউস থেকে ডেমোক্র্যাট হটাতে। তবে রিপাবলিকানরা নতুন একজন জর্জ বুশকে বেছে না-ও নিতে পারে শেষ পর্যন্ত। ওবামা বিজয়ী হওয়ার পর থেকে হতাশা চলছে রিপাবলিকান শিবিরে। দেশটা ‘ইউরোপ হয়ে উঠছে’ মনে করে হাহাকারে আছেন অনেক কট্টর রিপাবলিকান। লোকজনের মধ্যে ধর্মভাব কমতে থাকা, উদারপন্থার দিকে একটু বেশি ঝোঁক দেখা যাওয়া—এ ধরনের কিছু ভয় তাদের মধ্যে কাজ করছে। এসব ভয় ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে গিংরিচের মতো প্রার্থী রিপাবলিকানদের মনের মতোন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, শুধু দলের লোক দিয়ে প্রেসিডেন্ট হওয়া যায় না। সেদিক থেকে ভাবলে রমনির মতো নিয়ন্ত্রিত মাত্রার রক্ষণশীলের গ্রহণযোগ্যতা সাধারণ ভোটারদের মধ্যে বেশি হয়। এহেন ভাবনার প্রতিফলন ঘটিয়ে এখন পর্যন্ত রমনি এগিয়ে। শেষ পর্যন্ত কে হবেন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী, তা জানার জন্য কিছুদিন অপেক্ষা করতে হলেও রমনির সম্ভাবনাই বেশি মনে হচ্ছে।
শান্তনু মজুমদার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক।

জায়নবাদের বিরুদ্ধে কেন মুখ খুললেন গুন্টার গ্রাস?

শান্তনু মজুমদার
বুধবার জার্মানির স্যুডয়েচ জেইটাং পত্রিকায় ইসরায়েলি জায়নবাদের কঠোর সমালোচনাপূর্ণ ‘যে কথা বলতেই হবে’ শিরোনামের একটি কবিতা প্রকাশ করে বৃহস্পতিবার শুরুর আগেই জায়নবাদী ও জায়নবাদের সমর্থক-পৃষ্ঠপোষকদের বাক-আক্রমণের মধ্যে পড়ে গেলেন জার্মানির জীবিত লেখকদের মধ্যে সবচেয়ে খ্যাতিমান মুক্তবুদ্ধির লেখক গুন্টার গ্রাস (৮৪)। 
গুন্টার গ্রাসের কি মতিভ্রম হয়েছে? জীবনসায়াহ্নে এসে নিজেকে এমন ঝামেলায় কেউ ফেলে? প্রধান শক্তিমান দেশ যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকালে কী দেখা যায়? দেখা যায়, বড় দুই দলের বড় নেতারা কে কত বড় ইসরায়েল-বন্ধু সে প্রমাণে সারাক্ষণ হাস্যকরভাবে তৎপর। একজন যদি বলে যে ফিলিস্তিনিদের জেরুজালেমের ওপর থেকে দাবি তুলে নিতে হবে, আরেকজন তখন বলে ওঠে চলমান অশান্তির জন্য ফিলিস্তিনিদের গোঁয়ার্তুমিই দায়ী। পশ্চিমের মূলধারার মিডিয়াতে কী দেখা যায়? দেখা যায় যে ইরান একটা পরমাণু বোমা বানিয়ে ফেলতে যাচ্ছে এবং একবার যদি এই জিনিস ইরানের হাতে আসে, তাহলে আর দেখতে হবে না। কিন্তু ইসরায়েলের হাতে যে একই জিনিস অনেক দিন আগে থেকেই আছে, তা নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য, আশঙ্কা পশ্চিমের মূলধারার মিডিয়াতে দেখা যায় না।
গ্রাসের নিজের দেশ জার্মানিতে কী দেখা যাচ্ছে? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে গণহত্যা পরিচালনার ব্যাপারটি নিয়ে জার্মানরা অপরাধবোধে ভোগে। কিন্তু এই অপরাধবোধ কি ইসরায়েলের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম সাবমেরিন তুলে দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত জার্মানি নিয়েছে, সে সিদ্ধান্তকে বৈধতা দেয়? ‘অপরাধবোধটোধ’ কিছু নয়—আসল কথা হচ্ছে, বিশ্বমঞ্চে জায়নবাদের শক্তিমান উপস্থিতি, যা জার্মানি গ্রাহ্য করে। আর থাকে বাণিজ্য প্রসঙ্গ—ইসরায়েল হোক আর যে-ই হোক, পরমাণু অস্ত্রের হুমকি বাড়ুক কি না বাড়ুক, আসল কথা হচ্ছে অস্ত্র বেচে মুনাফা। এই যখন অবস্থা, তখন গ্রাসের কি এমন দরকার পড়ে গেল যে তিনি নিরুপদ্রব বা কল্পিত কোনো সমস্যা বা শত্রুকে বেছে না নিয়ে একেবারে জায়নবাদী ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কবিতা লিখতে লেগে গেলেন? 
গুন্টার গ্রাস আসলে সত্য-তাড়িত হয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে নিজের মধ্যে চেপে রাখা কথাগুলো নির্ভীকে প্রকাশ করে দিয়ে মুক্ত হয়েছেন। নয়টি পঙিক্ততে বিভক্ত ৬৯ লাইন দীর্ঘ ‘যে কথা বলতেই হবে’ কবিতায় ইসরায়েলের জায়নবাদী নীতির কঠোর সমালোচনা করেছেন গ্রাস। ইরান একটি পরমাণু বোমা বানিয়ে ফেলছে এমত ধরে নিয়ে ইরানের ওপরে সামরিক হামলা চালানোর ইসরায়েলি আস্ফাালন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। গ্রাস কবিতায় লিখেননি কিন্তু আমরা জানি যে মৌলবাদী, উগ্র ডানপন্থী ও উগ্র জাতীয়তাবাদীদের সমর্থনপুষ্ট বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কোয়ালিশন সরকারের ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রাণভোমরাটিই হচ্ছে ফিলিস্তিন ও ইরানবিরোধী উগ্র আস্ফাালন। ধর্মগুরু শাসিত ইরানের মতো দেশের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ইরানি পরমাণু স্থাপনাগুলো পরিদর্শন করতে দেওয়া ও না-দেওয়া নিয়ে পশ্চিম ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে তেহরানের নিয়মিত বিতণ্ডার কথা আমরা জানি। কিন্তু আলোচ্য কবিতায় গ্রাস আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন যে ইসরায়েলের পরমাণু স্থাপনা পরিদর্শনের ব্যাপারটি নিয়ে কখনো একটি কথাও হয় না। 
তো, এত দিন পরে গ্রাসের কলমে কেন এসব কথা? ‘এত দিন কোথায় ছিলেন’ গ্রাস? ‘যে কথা বলতেই হবে’ কবিতাতে এ প্রশ্নটি নিজেকেই ছুড়ে দিয়েছেন গ্রাস। তাঁর ভাষায়, ‘এই বার্ধক্যে, দোয়াতের শেষ কালিটুকু দিয়ে’ কেন বলতে হচ্ছে ‘ইসরায়েলের পরমাণু সামর্থ্য ইতিমধ্যে ভঙ্গুর হয়ে যাওয়া বিশ্বশান্তিকে হুমকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে’। ঠিক পরের লাইনেই উত্তর আছে, ‘কারণ এটা বলতেই হবে। এমনকি এটা বলার জন্য আগামীকালও হয়ে যেতে পারে ভীষণ বিলম্ব।’ ইসরায়েলকে পারমাণবিক অস্ত্রের সামর্থ্যসম্পন্ন নৌযান জোগানের মধ্য দিয়ে জার্মানির ‘একটি অপরাধের মদদদাতা’ হয়ে যাওয়ার ভয়ও গ্রাস করেছে গ্রাসকে। যুক্তির ক্ষেত্রে ভণ্ডামি পশ্চিমা শক্তিমানদের জন্য নতুন কিছু নয়। গুন্টার গ্রাস ‘পশ্চিমের ভণ্ডামিতে ক্লান্ত’ হয়ে ‘আর চুপ না করে থাকার’ কথা বলেছেন। কবির আরও মনে আশা এই যে তাঁর এই সরব হওয়া ‘আরও অনেককেই মূক হয়ে থাকার হাত থেকে মুক্তি দেবে।’ গুন্টার গ্রাস কি তাহলে শুধুই ইসরায়েলের পরমাণু সামর্থ্যের বিরুদ্ধেই সোচ্চার? তা নয়। তিনি চান ‘ইসরায়েলের পরমাণু সামর্থ্য ও ইরানের পরমাণু স্থাপনা উভয়ের ওপরে আন্তর্জাতিক সংস্থা দ্বারা স্বীকৃত বাঁধাহীন ও স্থায়ী নিয়ন্ত্রণ’। এতে করে ‘সকলে, ইসরায়েলিরা ও ফিলিস্তিনিরা’, এমনকি গোটা মধ্যপ্রাচ্যে এমনকি ‘আমাদের সকলের’ তথা বিশ্ববাসীর মঙ্গল নিহিত বলে মনে করেন কবি। 
গ্রাস কি ভুল বলেছেন কিছু? আসলে ভুল-শুদ্ধের প্রশ্ন নয়; জায়নবাদের বিপক্ষে যাওয়া বক্তব্যের জন্য গ্রাসের ওপরে আক্রমণ অবধারিত ছিল এবং তাই চলছে। গ্রাস ব্যাপারটি যে আগে থেকে বুঝতে পারেননি, তা মনে হয় না। মনে হয় যে গ্রাস বুঝেশুনেই কবিতার ছত্রচ্ছায়ায় জায়নবাদের সমালোচনার পথ বেছে নিয়েছেন। এতে কাজ হয়েছে। গ্রাসের বিরুদ্ধে বিষোদ্গারে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। বৃহস্পতিবার তিনি ‘যে কথা বলতেই হবে’ কবিতাটিকে ‘লজ্জাজনক’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং দাবি করেন যে ইসরায়েল নয় বরং ইরান হচ্ছে ‘বিশ্বের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি’। গ্রাসের কবিতায় ইসরায়েলের হামলাতে ‘ইরানি জনগণের নিশ্চিহ্ন’ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছে। এটা মেনে নেননি নেতানিয়াহু। ইরানের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদের নিয়মিত আস্ফাালনের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘এটা হচ্ছে ইরান, ইসরায়েল নয়, যে কি না অন্য রাষ্ট্রকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার হুমকি দেয়।’ স্মর্তব্য, আহমাদিনেজাদ প্রায় প্রায়ই ইসরায়েলকে মানচিত্র থেকে মুছে ফেলার হুমকি দিয়ে থাকেন। দেখা যাচ্ছে যে গ্রাসের কবিতার মধ্যে আহমাদিনেজাদকে খুঁজে বের করার একটা চেষ্টা হচ্ছে। শুক্রবার এক সাক্ষাৎকারে গুন্টার গ্রাস স্পষ্ট করেই বলেন যে তিনি ইসরায়েল নয় বরং নেতানিয়াহুর নীতিগুলোকে সমালোচনা করতে চেয়েছেন। কিন্তু এতে কাজ হচ্ছে না। নেতানিয়াহুদের পরিচালিত জায়নবাদের সমালোচনাকে ইসরায়েল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান হিসেবে দেখানোর ব্যাপক চেষ্টা চলছে। 
এখানেই শেষ নয়। গ্রাসকে নতুন করে ‘ইহুদি বিদ্বেষী’ হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টাও কবিতা প্রকাশিত হওয়ার ৪৮ ঘণ্টার কম সময়ের মধ্যে জোরেশোরে শুরু হয়ে গেছে। ডানপন্থী-রক্ষণশীল বা জায়নবাদের সরাসরি সমর্থক মিডিয়ার কথা বাদ থাক, মধ্যপন্থী হিসেবে বিবেচিত বিলেতের গার্ডিয়ান, আমেরিকার নিউইয়র্ক টাইমস কিংবা ইসরায়েলের হারেৎজ-এর মতো পত্রিকায়ও ‘যে কথা বলতেই হবে’ নিয়ে প্রকাশিত নানামুখী লেখালেখিতে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে গুন্টার গ্রাস দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের নাৎসি বাহিনীর জন্য কাজ করেছিলেন। উল্লেখ্য, ২০০৬ সালে এ ব্যাপারে নিজেই মুখ খোলেন গ্রাস এবং ১৭ বছর বয়সে নিজের মানসিক অবস্থান কেমন ছিল তা স্পষ্ট করেন। কিন্তু গ্রাসকে জায়নবাদীরা তখন থেকেই ‘ইহুদি বিদ্বেষী’ হিসেবে চিহ্নিত করতে থাকে। বলাই বাহুল্য, এবারের কবিতাটির জন্য গ্রাসের ওপরে তারা আরও অধিকমাত্রায় চড়াও হবে। কিন্তু তাতে কিছু এসে-যায় না। গ্রাসের লেখাটি এখন থেকে পশ্চিমের মূলধারার বিরুদ্ধে জোরালো একটি ভিন্নস্বর হিসেবে আলোচিত হতেই থাকবে।
শান্তনু মজুমদার: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক।

বৃহস্পতিবার, ৫ এপ্রিল, ২০১২

চে এক বিপ্লবের অন্তহীন তৃষ্ণা


স্মরণ


আশীষ-উর-রহমান
চে স্মরণ অনুষ্ঠানে মাহমুদুজ্জামান বাবুর নেতৃত্বে সংগীত পরিবেশন করছেন মৃত্তিকার শিল্পীরাযে তাঁকে হত্যা করতে এসেছিল, তিনি তাকে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কি আমাকে হত্যা করতে এসেছ?’ হত্যাকারীর হ্যাঁ-সূচক জবাবের উত্তরে তিনি তাকে এ কথাটাই বলেছিলেন—‘আমাকে মারতে পারো তবে তাতে বিপ্লবের মৃত্যু নেই।’ চে সম্পর্কে এই কথাগুলো সারা বিশ্বে তাঁর অগণিত অনুরাগীর জানা।
১৯৬৭ সালের ৯ অক্টোবর আর্নেস্তো চে গুয়েভারাকে বলিভিয়ার জঙ্গলে হত্যা করা হয়। বিপ্লবী চে গুয়েভারা চোখ বুজলেন, কিন্তু তাঁর সাহস ও আদর্শ ছড়িয়ে গেল আলোর মতো দিকে দিকে। দ্রোহ আর তারুণ্যের প্রতীকে পরিণত হয়ে অক্ষয় পরমায়ু লাভ করলেন অগণিত জনের হূদয়ে। অমর এ বিপ্লবীর ৪৪তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে জন্মভূমি লাতিন আমেরিকা থেকে বহুদূর এই বাংলাদেশে তাঁর অনুরাগীরা গতকাল শনিবার আয়োজন করেছিলেন এক স্মরণ অনুষ্ঠান।
বিকেলে ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবর উন্মুক্ত মঞ্চে ‘চে সংহতি’ এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। চের জীবন ও আদর্শের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আলোচনা, আবৃত্তি ও সংগীতের মধ্য দিয়ে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান জানানো হয় অনুষ্ঠানে।
বিশ্বের সব নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের জন্য নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য অবলীলায় ত্যাগ করেছিলেন চে। তিনি মনে করতেন, একজন বিপ্লবীর কোনো সীমান্ত থাকে না। আলোচক ভাষাসৈনিক আহমদ রফিক এ কথার সঙ্গে আরও বলছিলেন, আদর্শগত দিক থেকে মাও সেতুং বা ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে মিল থাকলেও তাঁদের সঙ্গে চের একটা বড় পার্থক্যও ছিল। মাও বা ফিদেল বিপ্লবের পরে তাঁদের নিজ দেশ গড়ার কাজে আত্মনিবেদন করেছিলেন। কিন্তু চে এক দেশে বিপ্লব সম্পন্ন করে ছুটে গেছেন অন্য দেশে। সে কারণে বিপ্লবী চে-ই একমাত্র বিশ্ববিপ্লবী। তিনি বিশ্বজুড়ে বিপ্লবের ডাক দিয়েছেন। 
আহমদ রফিক আরও বলেন, ‘আমাদের রাজনীতিতেও তরুণদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তবে বিপ্লব বা সংগ্রামের পরে যে কঠিন পরীক্ষা, তাতে আমরা প্রত্যাশিত জয় পাইনি। স্বার্থপরতা, লোভ আমাদের রাজনীতিকে দূষিত করে তুলেছে। এই পরিস্থিতিতে চের বিপ্লবী আদর্শে তরুণসমাজ উদ্দীপ্ত হয়ে জাতিকে তাঁর প্রত্যাশিত বিজয়ের সোপানে নিয়ে যেতে পারে।’ এ জন্য তিনি ‘চে সংহতি’কে একটি জোরদার সাংগঠনিক কাঠামো দিয়ে সারা দেশে তরুণদের সংগঠিত করার আহ্বান জানান।
এর আগে প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক কবি সাজ্জাদ শরিফ চে গুয়েভারার বিপ্লবী জীবনের বিশেষ দিকগুলোর কথা উল্লেখ করে বলেন, যে মার্কিন গোয়েন্দাদের নির্দেশে চেকে হত্যা করা হয়েছিল, আজ সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির কেন্দ্রের প্রতীক ওয়াল স্ট্রিটে পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিরুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভ করছেন। তাঁরা তুলে ধরেছেন চে গুয়েভারার ছবি। চে এক অসমাপ্ত বিপ্লবের নাম, চে এক বিপ্লবের অন্তহীন তৃষ্ণা।
সচ্ছল পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন চে গুয়েভারা। অধ্যয়ন করেছিলেন চিকিৎসাশাস্ত্র। সুখে জীবন কাটিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু ছাত্রাবস্থায় লাতিন আমেরিকা ভ্রমণের সময় তিনি সাধারণ মানুষের যে ভয়ংকর দুর্দশা দেখতে পান, বিশেষ করে গুয়াতেমালায় সিআইএ যেভাবে বামপন্থী সরকারকে উৎখাত করে তা চেকে বিপ্লবীতে পরিণত করে তোলে। স্ত্রী-সন্তান-সংসার ছেড়ে শোষিত, মেহনতি মানুষের মুক্তির সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করেন তিনি। কিউবায় বিপ্লব করে চে চলে যান আফ্রিকার কঙ্গোতে এবং সেখান থেকে ফিরে বলিভিয়ায়। সেখানেই তাঁকে হত্যা করা হয়। বিপ্লবী চের পঠন-পাঠন ছিল প্রচুর। তিনি ছিলেন কবিতার নিবেদিত পাঠক। মৃত্যুর সময় প্রিয় কবিতার যে ডায়েরিটি ছিল তাঁর কাছে, সেখানে থাকা পাবলো নেরুদার একটি কবিতার বাংলা অনুবাদ আবৃত্তি করেন সাজ্জাদ শরিফ।
অনুষ্ঠানের শুরুতে শ্রোতাদের স্বাগত জানান শিল্পী মাহমুদুজ্জামান বাবু। তিনি উল্লেখ করেন, ২০০৮ সাল থেকে চে সংহতি ৯ অক্টোবর চের মৃত্যুদিনে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে। এবার ৯ অক্টোবর এই মঞ্চ অন্য একটি সংগঠনের অনুষ্ঠানের জন্য আগাম বরাদ্দ থাকায় এক দিন আগে চের স্মরণানুষ্ঠান করা হলো। 
কবি নির্মলেন্দু গুণের ‘প্রলেতারিয়েত’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন জাহীদ রেজা নূর। চেকে নিয়ে বিদেশি কবিদের কবিতার অনুবাদ আবৃত্তি করেন পারভেজ চৌধুরী। এরপর ছিল গানের পালা।
উন্মুক্ত মঞ্চের কাঠামোর সঙ্গে বিশাল ডিজিটাল প্রিন্টের পর্দায় ছিল সেই অতিচেনা ছবি—তারকাখচিত টুপি মাথায় দেওয়া ঝাঁকড়া চুলের সুদূরে নিবদ্ধ দৃষ্টির বিপ্লবী চে। পাশেই লেখা তাঁর প্রিয় উক্তি, ‘হাস্তা লা ভিক্তোরিয়া সিওমপ্রে’, পাশেই বাংলায় লেখা তার অর্থ: ‘বিজয় না হওয়া পর্যন্ত লড়াই করো’। সেই উক্তিকে মূলভাব করে চেকে নিয়ে মাহমুদুজ্জামান বাবুর নেতৃত্বে গান করলেন মৃত্তিকার শিল্পীরা—‘বিজয়ের পথে যাও অনাদিকাল’। তাঁদের অন্যান্য গানের মধ্যে ছিল, সংবিধান নিয়ে ‘আমরা শুধু প্রশ্ন করেছিলাম, রাষ্ট্রপক্ষ ভীষণ নাখোশ হলেন’; ‘হারিয়ে যাওয়ার দিন হাত বাড়ায়’—এসব। উদীচীর শিল্পীরা পরিবেশন করেন ‘হে মহামানব, একবার এসো ফিরে, আহ্বান কৃষক মজদুর ভাইসব’। গানগুলো উদ্দীপ্ত করে তুলেছিল শ্রোতাদের।

বুধবার, ৪ এপ্রিল, ২০১২

‘মিত্র’ বাহিনীর বোমায় শহীদদের কথা


লিবিয়া


রবার্ট ফিস্ক
অতীতের জীবন কেমন করে যেন বর্তমান জীবনের নাগাল পেয়ে যায়। ১৯৮৬ সালের ১৫ এপ্রিল রাত দুইটার পর পর রাফাত আল-ঘোসাইনকে হত্যা করেছিল মার্কিনরা। তাঁর মৃত্যুর পরের কয়েক দিন মার্কিন কর্মকর্তারা দাবি করছিলেন, তাঁর বাড়িতে যুদ্ধবিমানরোধী লিবীয় হামলা আঘাত হেনে থাকতে পারে। সে বাড়িটি ত্রিপোলির উপশহরে ফরাসি দূতাবাসের বেশ কাছে। সামনের দিনগুলোতে মার্কিনদের একই ধরনের দাবির দিকে নজর রাখুন।
রাফাতের মৃত্যুর তিন সপ্তাহ পর মার্কিন প্রতিরক্ষা সদর দপ্তর পেন্টাগন স্বীকার করল, কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফির বিরুদ্ধে মার্কিন হামলার অংশ হিসেবে (বার্লিনের এক নাইট ক্লাবে লিবীয় এজেন্টের হামলার প্রত্যাঘাত এই হামলা) এফ-১১১ যুদ্ধবিমান থেকে তিনটি বোমা ফেলা হয়েছিল, যেগুলো পড়েছিল ‘ফরাসি দূতাবাসের কাছে’। ফলে ‘কোলাটেরাল ড্যামেজ’ (বাড়তি লোকসান) হয়েছে।
তখন ঘোসাইনের বয়স ১৮ বছর। লন্ডনের এক ইংলিশ স্কুলে পড়াশোনা করতেন, ছুটি কাটাতে এসেছিলেন। প্রতিশ্রুতিশীল ও সুন্দর শিল্পী। সিকি শতাব্দী আগে সেই ব্যক্তিগত মৃত্যু তাঁর হত্যাকারী রাষ্ট্রের রেকর্ডে ঢুকতে পারেনি। তাঁর মা লেবাননি আর বাবা ফিলিস্তিনি। বাবা তখন লিবীয় তেল কোম্পানিতে কর্মরত। রাফাত আজ বিস্মৃত।
আমরা (পশ্চিমারা) বরাবরের মতো নিজেদের প্রয়াত মানুষদেরই স্মরণ করি। অন্যদের না, সে তা লিবীয় কিংবা লেবাননি, আফগান কিংবা সিরীয় যে-ই হোক না কেন। শুধু নীল চোখের ধবল মানুষেরাই গোনার মধ্যে থাকে। বাকি সব ‘বাড়তি লোকসান’। গতকাল সকালে ঘোসাইনের কথা মনে পড়ে গেল যখন ‘মিত্র’ বাহিনী (টেলিভিশনের কলরবে অচিরে হাজির এই শব্দ) লিবিয়ার বিরুদ্ধে তাদের ‘বিমানবাহিনীর সম্পদ’ নিয়ে, গাদ্দাফির বিরুদ্ধে ‘স্থল’ অভিযান শুরু করল। ১৯৮৬ হামলার সময় ছিলেন রোনাল্ড রিগান। এখন বারাক ওবামা। মনে হচ্ছে, আগেকার চেয়ে এবার ভাগ্য প্রসন্ন। 
২৫ বছর আগে শহীদ বেসামরিক ব্যক্তিদের শেষকৃত্যে কর্নেল গাদ্দাফির লোকেরা গণমাধ্যমকে সমাধিস্থলের সামনে ডেকে নিয়ে যায়। মার্কিন জিঘাংসু হামলা আমরা সশরীরে হাজির থেকে রেকর্ড করেছিলাম। দেখলাম, একটি কফিনে লেবালনি (সাদা ও লাল জমিনের ওপর সিডার গাছ) ও ফিলিস্তিনি পতাকা। লেবাননে আমি আগেও থেকেছি, এখনো থাকি। সেই মেয়েটির হতবিহ্বল, শোকাহত মা সানিয়াকে খুঁজে বের করলাম ভিড় ঠেলে। আমাকে তিনি বললেন, ‘আমরা মুসলমান, কিন্তু আমাদের বিধাতা তো এক। আমরা এক জাত। আশা করি, রিগান সাহেব সেটা বোঝেন।’
ঘোসাইনের বাবা বাশাম বহু বছর ধরে প্রতিকার চেয়েছেন। চোখের সামনে দেখেছেন আরেক মেয়ে কিনদার যন্ত্রণা। অন্তত বৈরুতে কিনদার পড়াশোনার খরচ দিতে বলেছেন তিনি মার্কিন কর্তৃপক্ষকে; যেহেতু তাঁর বোনকে হত্যা করেছে আমেরিকা। মারা যাওয়ার সময় ঘোসাইন নিজ বাড়িতে টেলিভিশন কক্ষে ঘুমাচ্ছিলেন। বাড়িটি ফরাসি দূতাবাসের কাছে। তখন দুই হাজার পাউন্ড ভারী বোমা পড়ল, গুঁড়িয়ে গেল প্রতিবেশীদের বাড়িঘর। যে পাঁচজন ছিলেন তাঁদের সবাই নিহত হলেন।
লিবীয় নিরাপত্তাকর্মীদের একটি দল যখন মেয়েটির শরীরের ওপর থেকে দেয়াল সরিয়ে নিল, তখন তাঁর বাবা যা দেখেছিলেন তা রেকর্ড করেছেন। তাঁর ভাষায়, ‘চিত হয়ে শুয়ে ছিল আমার মেয়ে। ডান দিকে মাথা সামান্য কাত করা। অক্ষত দেহ, বিন্যস্ত চুল আর মাথার উপরিভাগ থেকে বেরোতে থাকা রক্তের দাগ বাঁ কপাল বেয়ে নেমে যাচ্ছিল।’
সে সময় বার্লিন নাইট ক্লাবে এক মার্কিন সেনার মৃত্যুর ফলে এই আক্রমণ করা হয়েছিল। রোববারের হামলার কারণ, কর্নেল গাদ্দাফি যেন ঘোসাইনের মতো বেসামরিক মানুষদের না মারতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে পাস হওয়া জাতিসংঘের প্রস্তাব।
বৈরুতে বিগত বছরগুলোতে ঘোসাইন-পরিবারকে ঘনিষ্ঠভাবে আমি দেখেছি। তাদের নিয়ে লিখেছি, একসঙ্গে খাবার খেয়েছি, তাদের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছি। এখনো তাদের বাড়িতে টাঙানো রয়েছে তাদের মেয়ের আশ্চর্য চিত্রকর্ম। কিনদা বিয়ে করেছেন। গতকাল অনেক উত্তেজনা নিয়ে ফোন করেছিলাম পরিবারটিকে। ফোন ধরলেন ঘোসাইনের মা। তিনি বললেন, ‘আশা করি, এবার তাঁকে বাগে আনবে তারা।’ চকিতে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি গোঁফওয়ালা লোকটাকে বোঝাচ্ছেন কি না। কর্নেল গাদ্দাফির গোঁফ আছে। ওবামা সাহেবের নেই। তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, ঘাজ্জেফিকেই বোঝাচ্ছি।’ লেবাননি আরবি উচ্চারণে লোকটার নাম ‘ঘাজ্জেফি’।
ব্রিটেনের দি ইনডিপেনডেন্ট থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত। 
রবার্ট ফিস্ক: ব্রিটিশ সাংবাদিক।

‘মোবারকের বিদায়ঘণ্টা বাজল’

রবার্ট ফিস্ক | তারিখ: ০৫-০২-২০১১


গত বৃহস্পতিবার ‘কোনার ঘর’ থেকে আপনি দেখতে পেতেন যেসব মিসরীয় ‘প্রেসিডেন্ট’-এর হাত থেকে রেহাই পেতে মরিয়া, তাদের ঔদ্ধত্য ও মূঢ়তা। ‘ভালো মানুষেরা’ নিজেদের আচরণের মাধ্যমে শত্রুপক্ষের সুবিধা করে দেওয়া দুঃখজনক। কিন্তু তাহরির স্কয়ারের নবীন গণতন্ত্রপন্থী বিক্ষোভকারীরা সতর্কতার সঙ্গে কায়রো লড়াই সংগঠিত করেছে। আগেভাগেই তারা বিপুল পরিমাণ পাথরের টুকরো জড়ো করে, ফোন করে আরও পাঠানোর ব্যবস্থা করে আর শেষে মিসরীয় জাদুঘরের পেছনভাগের উড়ালসেতু থেকে মোবারকপন্থী তরুণদের হটিয়ে দেয়। এক দিন পরই মোবারক ক্ষমতা ছাড়বেন—এ ঘটনা হয়তো সেই পূর্বাভাসই দিচ্ছে। হয়তো তা আগের রাতের আগুনে-বোমা ও স্লাইপার গুলির বদলা। কিন্তু মিসরের নতুন ‘বীরদের’ জায়গা থেকে দেখলে সময়টা ভালো যায়নি।
কোনার ঘরটি রেফারির টাচলাইনের মতো। অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগে নির্মিত। দেয়ালের বহির্ভাগে পাথুরে আঙুরলতার সজ্জাসংবলিত কয়েক স্তরের আস্তরণ আর ভেতরটা স্যাঁতসেঁতে, ভগ্নপ্রায়। মার্বেলের ভাঙা সিঁড়ি, দুর্গন্ধময় কাপড়ের দেয়াল-কাগজ ও কাঠের মেঝে। থলের পর থলে ভর্তি পাথরে। এদের চাপে মেঝেতে গোঙানির মতো শব্দ হচ্ছিল। পাথরের টুকরো সব চতুর্ভুজাকৃতি করে ভাঙা। মোবারকপন্থী মানুষদের ওপর ছোড়ার জন্য আনা। মাহমুদ বাসৌনি সড়ক ও শহীদ আবদুল মেনেম রিয়াদ স্কয়ারের কোনায় অবস্থিত এই মার্জিত-বিষণ্ন-পুরোনো বাড়িটির ইতিহাস কেউ বলতে পারছে না। সেটাই স্বাভাবিক। ঘরটির ভঙ্গুর ব্যালকনি থেকে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম সেদিনের পাথরযুদ্ধ। আর এই খুদে গৃহযুদ্ধ নিয়ন্ত্রণে মিসরীয় সেনাবাহিনীর সাহসী ও করুণ প্রচেষ্টা। এ যুদ্ধের পরদিনই জুমাবার; তাই বিক্ষোভকারীরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করছে, স্বৈরাচারের দিন শেষ।
পাথরের ময়দান কৌশলে পেরিয়ে সেনারা মহাসড়কে নেমে আসেন। তাঁরা পাথর নিক্ষেপকারী দুই পক্ষের মধ্যে দুটি অ্যাবরামস ট্যাংক স্থাপন করতে চেষ্টা করতে থাকেন। চার সেনা মাথার ওপর হাত তুলে যুদ্ধবিরতির চিহ্ন দেখান।
কী করুণ পরিস্থিতি! এখানকার যুদ্ধ থামাতে দরকার ছিল চার হাজার সেনা। অথচ ছিলেন মাত্র দুজন ট্যাংকচালক, একজন অফিসার ও চারজন সেনা। আর গণতন্ত্রের সেনানীরা (হ্যাঁ, একটু নৈরাশ্য যোগ করতেই হচ্ছে) সেনাদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টায় থাকলেও এখানে এসে সেনাদের ধৈর্যের দিকটিকে একেবারেই আমলে নেয়নি। মিসরীয় জাদুঘরের বাইরে রাস্তায় তারা ব্যূহ রচনা করে। সবার হাতে ধরা ঢেউ তোলা টিনের ঢাল। হলিউডি ছবিতে রোমান সেনাদের ব্যঙ্গ করছে যেন—তবে বক্ষবর্ম, মুগুরের বদলে তাদের গায়ে টি-শার্ট আর হাতে ধরা তলোয়ারের বদলে লাঠি। কোনার ঘরের বাইরে আমার সামনে এসে দাঁড়াল এক লোক, তার হাতে (বিশ্বাস করুন, পাঠক) সাত ফুট লম্বা লোহার ত্রিশূল। সে জানাল, অনেকের হাতে আছে এমন অস্ত্র। আগের দিনে মোবারকপন্থীদের ঘোড়া, উটের হামলার মতোই এটাও তেমনি খারাপ।
আরেক ইউনিটের পাঁচ সেনা পাশের এক বাড়ি থেকে এক ট্রে মলোটোভ ককটেল উদ্ধার করেছেন। এই কয়েকজনকে নিরস্ত্র করতে পুরো সামরিক অভিযান চালাতে হয়েছে। কানফাটা শব্দে তারা বলছিল, ‘মোবারকের বিদায় কালই।’ আর তারপরই ৪০ ফুট দূরে শত্রুর উদ্দেশে বলছিল, ‘এই বুড়োরা কালই ভাগবে।’ সাধারণ সব খবরও তাদের উজ্জীবিত করছিল—মোবারকের ব্যাপারে ওবামার বক্তব্য কিংবা মিসরীয় সেনাবাহিনী (প্রতিবছর ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার সহায়তা পায় যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে) প্রেসিডেন্টের হাতে অপমানিত হতে হতে ক্লান্ত। ক্ষমতায় থাকার মেয়াদ শেষ হতে বাকি নয় মাস, তবু ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে দেশের ওপর এমন বিপর্যয় নামিয়ে আনার জন্যও মোবারকের ওপর সেনাবাহিনী ক্ষুব্ধ।
হয়তো এ খবর সত্যি। আমার মিসরীয় বন্ধুদের মধ্যে যাঁদের আত্মীয় সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা, তাঁরা আমাকে বললেন, ‘মোবারকের বিদায়ের ব্যাপারে তাঁরা মরিয়া হয়ে পড়েছেন। না হলে হয়তো আবার বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি ছোড়ার নির্দেশ আসবে তাঁদের ওপর।’
কিন্তু বৃহস্পতিবার মোবারকবিরোধীরা ‘হামলা’ করল; পাথর ছুড়ে ও লোহার অস্ত্র দিয়ে। উড়ালসেতুর ওপর অবস্থান নেওয়া মোবারক-সমর্থকদের ওপর। আমি দেখলাম, মোবারকপন্থী কয়েকজন রাস্তায় নেমে এল। তাদের ওপর বৃষ্টির মতো পাথরের টুকরো পড়ছে। তারা মাথার ওপর হাত তুলে শান্তির চিহ্ন দেখাচ্ছে। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হচ্ছে না।
এমন সময় আমি সেই বিপজ্জনক সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলাম। সাদা পাগড়ি মাথায় আর লম্বা লাল কোর্তা পরা, যত্ন করে সাদা দাড়ি আঁচড়ানো, অসাধারণ দেখতে এক ইমাম পাথরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন। তাঁর হাতে চাবুকের মতো কিছু একটা ছিল, সেটা দিয়ে বিক্ষোভকারীদের আঘাত করতে থাকলেন। উভয় পাশ থেকে আসতে থাকা পাথরের মধ্যে তিনি দাঁড়িয়ে। কিছু মানুষ আছে, যারা মোবারকের হাত থেকে রেহাই চায়, কিন্তু এসব হামলা চায় না। এই লোকটা তাদেরই একজন। এক বিক্ষোভকারী মাথায় আঘাত পেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন।
আমি তখন ভোঁ দৌড় দিয়ে দুই ট্যাংকের কাছে চলে গেলাম। একটার আড়ালে আশ্রয় নিলাম। ট্যাংকটির বিশাল গান-ব্যারেলটি ৩৫০ ডিগ্রি ঘুরানো হলো। সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষতা দেখানোর মজার চেষ্টা। ইঞ্জিন থেকে পাথর নিক্ষেপকারীদের চোখে ধুলা ছিটিয়ে দেওয়া হয়। এক সেনা কর্মকর্তা বেরিয়ে এসে ইমামের পাশে দাঁড়ালেন আর মোবারকপন্থীদের পথ করে দিলেন—তাঁর হাতও তখন মাথার ওপর তোলা। তখনো পাথরের শব্দ হচ্ছিল। তবু মধ্যবয়সী কয়েকজন হাত বাড়িয়ে একে অন্যের হাত ধরছিল, সঙ্গীকে সিগারেট সাধছিল।
এমন পরিস্থিতি বেশিক্ষণ থাকেনি। পেছনে তাহরির স্কয়ারে পরিত্যক্ত কংক্রিটের মেট্রো নির্গমন পথের নিচে কিংবা ঘাস বা বন্ধ দোকানের সিঁড়িতে অনেকে ঘুমিয়ে রাত পার করে। অনেকের মাথা ও হাতে ব্যান্ডেজ। আঘাতের চিহ্ন আগামী দিনে তাদের বীরত্বের ব্যাজ; ‘প্রতিরোধ’ লড়াইয়ে, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অংশ নেওয়ার প্রমাণ হয়ে উঠবে। তবু এমন কাউকে পেলাম না, যে বলতে পারে কেন এই স্কয়ার এতটা মূল্যবান।
সত্য যতটা গুরুত্বপূর্ণ, ততটাই প্রতীকী। নামমাত্র উসমানীয় শাসনামলে বাইরে থেকে স্থপতি এনে স্কয়ারটি তৈরি করা হয়েছিল। ‘ইসলামিয়া’ স্কয়ার থেকে নীল নদের দিকে এর অবস্থান। পরবর্তীকালে সেখানে ব্রিটিশরা তৈরি করেছিল বিশালাকার কছর—এল-নীল ব্যারাক। রাস্তার ওপারে এখনো দাঁড়িয়ে আছে ছদ্ম-বারোক দালান, সেখানেই ছিল বাদশাহ ফারুকের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বিশ্বস্ততার সঙ্গে মন্ত্রণালয়টি ব্রিটিশ নির্দেশ মেনে চলত।
পুরো স্কয়ার এককালে সব মিসরীয়র জন্য নিষিদ্ধ ছিল। এই বিরাট ময়দানের পুরো এলাকা নিয়ে গঠিত হয়েছিল নিষিদ্ধ অঞ্চল, দখলদারের ভূমি, কায়রোর কেন্দ্রস্থল; যেখানে মিসরবাসী কখনো পা ফেলতে পারত না। তাই স্বাধীনতার পর ওটা হয়ে উঠল ‘মুক্তি’—‘তাহরীর’— স্কয়ার। এ জন্যই মোবারক এটা রক্ষা করতে চেয়েছেন, আর এ কারণেই যারা তাঁর উচ্ছেদ চায়, তাদেরও এটা হাতছাড়া করা চলবে না।
হেঁটে হেঁটে ফেরার পথে যাদের দেখলাম তারা খুব আশাবাদী, আরও এক রাত আগুনে-বোমা তারা সহ্য করে যেতে পারবে। কেননা, জুমাবারে আসবে প্রত্যাশিত বিজয়। রামি নামের একজনের সঙ্গে কথা হলো, সপ্রতিভভাবে তিনি বললেন, ‘মনে হয় মোবারকের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার জন্য আমাদের এখন একজন জেনারেল দরকার।’ তাঁর আশা হয়তো পূরণ হবে।
ব্রিটেনের দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
রবার্ট ফিস্ক: ব্রিটিশ সাংবাদিক।