বুধবার, ৪ এপ্রিল, ২০১২

আবার উত্তপ্ত কোরীয় উপদ্বীপ



দাউদ ইসলাম
সাগর থেকে তোলা হচ্ছে দুই ভাগ হয়ে যাওয়া চোওনানকে ষ এএফপিদক্ষিণ কোরিয়ার যুদ্ধজাহাজ চোওনান ডুবির ঘটনা নিয়ে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে উত্তেজনার পারদ ঊর্ধ্বমুখী। দুই দেশের মধ্যকার এমনিতেই দোদুল্যমান সম্পর্ককে আরও নাজুক অবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে ওই ঘটনা। তারা একে অন্যের বিরুদ্ধে নিচ্ছে পাল্টাপাল্টি ব্যবস্থা। 
পিয়ংইয়ংয়ের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক স্থগিত করেছে সিউল। জবাবে সিউলের সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে পিয়ংইয়ং। 
ঘটনার সূত্রপাত গত ২৬ মার্চ সন্ধ্যায়। বিতর্কিত আন্তকোরিয়া জলসীমার কাছে সাগরতলে এক বিস্ফোরণে দুই টুকরো হয়ে ডুবে যায় দক্ষিণ কোরিয়ার যুদ্ধজাহাজ চোওনান। প্রাণ হারান জাহাজের ৪৬ জন নাবিক। এ ঘটনা দক্ষিণ কোরিয়ার জন্য এক বড় সামরিক বিপর্যয়। 
কোরিয়া যুদ্ধের সময়কার পরিত্যক্ত মাইন বিস্ফোরণে চোওনান ডুবে যায়, নাকি জাহাজের অভ্যন্তরীণ যান্ত্রিক ত্রুটিই এ বিস্ফোরণের কারণ—তা পরীক্ষা করে দেখেন তদন্তকারীরা। শেষ পর্যন্ত তাঁরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, বৈরী প্রতিবেশী উত্তর কোরিয়ার সাবমেরিন থেকে সুকৌশলে ছোড়া টর্পেডোর আঘাতেই জাহাজটি ডুবে গেছে। তাঁদের দাবি, সাগরের তলদেশে তাঁরা টর্পেডোর যে অংশবিশেষ খুঁজে পেয়েছেন তার নির্মাণশৈলী উত্তর কোরিয়ার ব্যবহূত টর্পেডোর নকশার সঙ্গে হুবহু মেলে।
উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ার জন্য দেশবাসীর দিক থেকে প্রচণ্ড চাপের মধ্যে রয়েছে সিউল। কিন্তু উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা নেওয়াকে দুরূহ ব্যাপার হিসেবেই বিবেচনা করা হয়ে থাকে। কারণ, যেকোনো ধরনের সামরিক পদক্ষেপ পরমাণু শক্তিধর উত্তর কোরিয়াকে খেপিয়ে দিতে পারে। এতে দেশটির জবাবও আসবে সামরিক কায়দায়, যা চলমান সংঘাতকে তীব্রতর করে তুলতে পারে।
মজার ব্যাপার হলো, গত শতাব্দীর পঞ্চম দশকে কোরীয় যুদ্ধের সমাপ্তি হয়েছিল অস্ত্রবিরতির মধ্য দিয়ে। স্থায়ীভাবে ওই যুদ্ধের শেষ হয়নি। তাই কাগজে-কলমে এখনো দুই কোরিয়া যুদ্ধে লিপ্ত। শীতল যুদ্ধের সময় থেকে দুই পরস্পরবিরোধী পরাশক্তির পক্ষপুটে থাকা দুই কোরিয়ার সীমান্ত বিশ্বের সবচেয়ে অস্ত্রসজ্জিত সীমান্ত। দুই দেশের মধ্যে পর্যটক বিনিময়সহ নানাভাবে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা হয়েছে। আছে ভবিষ্যতে এক হওয়ার লক্ষ্যে গঠিত একত্রী করণ মন্ত্রণালয়ও। কিন্তু মূলত উত্তর কোরিয়ার পরমাণু অস্ত্র কর্মসূচি নিয়ে প্রায়ই বাকযুদ্ধ ও উত্তেজনার সঞ্চার হয় কোরীয় উপদ্বীপে। 
সামরিক ব্যবস্থার কথা বাদ দিলে দক্ষিণ কোরিয়ার সামনে যে কয়েকটি পথ অবশিষ্ট থাকে, তার অন্যতম হলো অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নেওয়া। ইতিমধ্যেই ওই পথে পা বাড়িয়েছে সিউল। পিয়ংইয়ংয়ের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েছে দেশটি। পাশাপাশি উত্তর কোরিয়ার জনমত প্রভাবিত করারও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়া। এ লক্ষ্যে সীমান্ত এলাকায় রেডিও এবং লাউড স্পিকারের মাধ্যমে আবারও প্রচারণা চালানো শুরু করেছে দেশটি।
দক্ষিণ কোরিয়ার হাতে সবচেয়ে বড় যে অস্ত্র তা হলো জাতিসংঘে যাওয়া। দেশটি ইতিমধ্যেই চোওনান ডুবিয়ে দেওয়ার বিষয়টি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে তুলেছে। কিন্তু সামনে কী ঘটবে, তা অনেকাংশেই নির্ভর করছে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য দেশগুলো, বিশেষ করে চীনের ওপর।
নিভৃতচারী কমিউনিস্ট দেশ উত্তর কোরিয়া বরাবরই চোওনান ডুবিয়ে দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। সিউলের বিরুদ্ধে ‘মিথ্যা কাহিনি’ ফাঁদার অভিযোগ তুলেছে পিয়ংইয়ং। দেশটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কথিত তথ্যপ্রমাণের যথার্থতা যাচাই করার জন্য তারা নিজস্ব বিশেষজ্ঞ দল পাঠাতে চায়। 
পিয়ংইয়ং সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, লাউড স্পিকারের মাধ্যমে উত্তর কোরিয়াবিরোধী প্রচারণা চালানো অব্যাহত থাকলে দক্ষিণের লাউড স্পিকার পোস্টে গুলি চালানো হবে। উত্তরের জলসীমায় প্রবেশ করলে দক্ষিণ কোরিয়ার জাহাজে গুলি চালানোর হুমকিও দিয়ে রেখেছে দেশটি।
চলমান পরিস্থিতিতে সোচ্চার উত্তর কোরিয়ার জনগণও। চোওনান ডুবিয়ে দেওয়ার সঙ্গে উত্তর কোরিয়াকে ‘জড়ানোর’ প্রতিবাদে উত্তর কোরিয়ার রাজধানী পিয়ংইয়ংয়ে প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছে। সমাবেশগুলোতে যুদ্ধের সম্ভাবনার ব্যাপারে দক্ষিণ কোরিয়াকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন বক্তারা। 
ঠিক কী কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটল—এ বিষয়ে নানা মুনি নানা মত দিচ্ছেন। কারও কারও মতে, উত্তর কোরীয় সামরিক বাহিনীকে উজ্জীবিত করার চেষ্টায় এ ধরনের হামলা চালানো হয়ে থাকতে পারে। অনেক বিশ্লেষক বলছেন, দক্ষিণ কোরিয়াকে তার আগের সাহায্য ও বাণিজ্যনীতি আবার চালু করতে বাধ্য করাও এর লক্ষ্য হতে পারে। উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়ার আগের সাহায্য ও বাণিজ্যনীতি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখছেন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট লি মিউং বাক।
ঘটনাপ্রবাহ কোন দিকে যাবে তা অনেকাংশেই নির্ভর করছে ছয় জাতি পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ আলোচনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো কী করে তার ওপর। দেশগুলো চায়, উত্তর কোরিয়ার পরমাণু কর্মসূচির অবসানে ছয়পক্ষীয় আলোচনা আবার শুরু হোক। 
উত্তর কোরিয়ার ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ কিংবা বর্তমান নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর করার জন্য দক্ষিণ কোরিয়া যদি জাতিসংঘের দ্বারস্থ হয়, তাহলে তারা যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের সমর্থন আশা করতেই পারে। হোয়াইট হাউস বলেছে, দক্ষিণ কোরিয়া নিরাপত্তা পরিষদে কোনো অভিযোগ নিয়ে গেলে তার প্রতি সমর্থন জানাবে যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান। যুক্তরাষ্ট্র কঠোর ভাষায় চোওনান ডুবিয়ে দেওয়ার ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছে। এরই মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক বাহিনীর সঙ্গে দুটি নৌ মহড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে দেশটি।
উত্তর কোরিয়াকে কড়া জবাব দেওয়ার পক্ষে জাপান। কিন্তু জাপান জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য দেশ নয়। এদিকে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য দেশ রাশিয়া সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছে।
উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে যেকোনো ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে দেশটির আদর্শিক মিত্র চীনের ভূমিকাকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই পিয়ংইয়ংয়ের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানকে সমর্থন জানাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে চীন। 
চোওনান ডুবির ঘটনার সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার সম্পৃক্ততা নিয়ে এখনই কোনো মন্তব্য করতে রাজি নয় চীন। দেশটি বলেছে, নিজস্ব অনুসন্ধানের ভিত্তিতে তারা এ বিষয়ে নিজেদের মত জানাবে। তাই আপাতত মনে হচ্ছে, চীন উত্তর কোরিয়াবিরোধী কোনো কিছু করবে না। তবে ‘যারা দক্ষিণ কোরিয়ার জাহাজ ডুবিয়েছে’ তাদের রক্ষা করাও চীনের উদ্দেশ্য নয় বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন ওয়েন জিয়াবাও।
গত রোববার সিউলে এক শীর্ষ সম্মেলনের পর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার নেতারা এ ব্যাপারে একমত প্রকাশ করেন যে যুদ্ধজাহাজ চোওনান ডুবিয়ে দেওয়ার ঘটনা ওই অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রতি গুরুতর হুমকি।
দক্ষিণ কোরিয়া ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র আর জাপানের সমর্থন নিয়ে চোওনান ডুবিয়ে দেওয়ার সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার জড়িত থাকার অভিযোগের বিষয়টি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপন করেছে। এখানে চীনের সমর্থন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, স্নায়ুযুদ্ধের সময় থেকেই যে উত্তর কোরিয়া চীনের পুরোনো মিত্র, তাকে খেপিয়ে তুলতে চাইছে না চীন। 
অতীতেও উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার বিরুদ্ধে ছিল চীন। বেইজিং চায় না, পিয়ংইয়ংয়ের কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থার পতন হোক। চীনের আশঙ্কা, উত্তর কোরিয়ায় এ ধরনের ঘটনা ঘটলে তার সীমান্তে শরণার্থীর ঢল নামতে পারে। সৃষ্টি হতে পারে বিপজ্জনক অস্থিতিশীলতার।
বেইজিং বলছে, চোওনান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ‘একত্রে কাজ করতে’ তারা প্রস্তুত। কোরীয় উপদ্বীপে স্থিতিশীলতা বজায় রাখাকে অগ্রাধিকার দেবে বলে মন্তব্য করেছে তারা। 

উত্তর কোরিয়া
আয়তন: ৪৭,৩৯৯ বর্গমাইল
জনসংখ্যা: দুই কোটি ৩৯ লাখ
মাথাপিছু আয়: তথ্য নেই
প্রধান ভাষা: কোরীয়
প্রধান ধর্ম: মূলত ধর্মে অবিশ্বাসী বা ধর্মমুখী নয়। এ ছাড়া অনেকে ঐতিহ্যবাহী কিছু ধর্মে বিশ্বাসী।
প্রধান রপ্তানি পণ্য: খনিজ পদার্থ, ধাতু, সিমেন্ট, কৃষিপণ্য
সামরিক শক্তি: যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া হিসাবমতে, বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম সেনাবাহিনী। সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য ১২ লাখ ১০ হাজার। মাথাপিছু সেনাসংখ্যা বিশ্বে সর্বোচ্চ।

দক্ষিণ কোরিয়া
আয়তন : ৩৮,৩৪৫ বর্গমাইল।
জনসংখ্যা : চার কোটি ৮৩ লাখ (২০০৯ জাতিসংঘ)
মাথাপিছু আয়: ২১,৫৩০ ডলার (বিশ্বব্যাংক ২০০৮)
প্রধান রপ্তানি পণ্য: বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, পরিবহন সরঞ্জাম ও ভারী যন্ত্রপাতি
প্রধান ভাষা: কোরীয়
প্রধান ধর্ম: বৌদ্ধ, খ্রিষ্ট
সামরিক শক্তি: সক্রিয় সেনাসংখ্যায় বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম সশস্ত্র বাহিনী। নিয়মিত সৈনিক ৩৭ লাখ। মাথাপিছু সেনাসংখ্যা বিশ্বে দ্বিতীয় (প্রথম উত্তর কোরিয়া)। 
সূত্র: বিবিসি ও উইকিপিডিয়া

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন