বুধবার, ১৮ এপ্রিল, ২০১২

মুসলিম ব্রাদারহুডের জোয়ার


সারোয়ার কবীর
প্রায় ৬০ বছর আগে মিসরীয় সেনাবাহিনী এখনকার মতোই রাজনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছিল। ১৯৫২ সালের ২৯ ডিসেম্বর মেজর গামাল আবদুল নাসের সেনা অফিসার ও মুসলিম ব্রাদার হুড নেতাদের সঙ্গে এক বৈঠকে বলেছিলেন, 'আজকে নির্বাচন দিলে আল-নাহান জিতবে, আমরা নয়। তখন আমাদের সাফল্য বলে কিছু থাকবে না।' নাসের ছিলেন জুলাই অভ্যুত্থানে সে দেশের বাদশাহ ফারুককে উৎখাতকারী ফ্রি অফিসার্স মুভমেন্টের নেতা। ওই বৈঠকে তিনি মিসরের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। তাকেই তখন দেশের প্রেসিডেন্টের মতো ভূমিকা নিতে হয়েছিল। দেশটির পরবর্তী ইতিহাস সবারই ভালো করে জানা। পার্লামেন্ট বিলোপ, রাজনৈতিক দলগুলো নিষিদ্ধ এবং নাগরিকদের মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়েছিল। সেনাবাহিনী রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করত। মোট কথায় মিসর স্বাধীনতা হারিয়েছিল।
১৯৫২ সালে নির্বাচন হলে যে ব্যক্তি বিজয়ী হতেন, তিনি ছিলেন মোস্তফা আল-নাহান। ধর্মনিরপেক্ষ ও উদারনৈতিক ওয়াফদ পার্টির প্রধান ছিলেন। এক সময় মিসরের সবচেয়ে জনপ্রিয় দল ছিল সেটি। উদারনৈতিকদের বিজয়ের সম্ভাবনা দেখেই মুসলিম ব্রাদার হুড নাসের এবং তার বিপ্লবী কমান্ড কাউন্সিলের নেওয়া রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তকে সমর্থন দিয়েছিল। ওই সিদ্ধান্তের কারণ আদর্শগত নয়, স্বার্থসিদ্ধির ছিল। ব্রাদার হুড নেতারা ভেবেছিলেন সেনাবাহিনীর ঘাড়ে চেপে তারা রাজনৈতিক ফায়দা আদায় করবেন। কিন্তু তাদের সেই হিসাব ভুল বলে প্রমাণিত হয়। ১৯৫৪ সালে নাসের ও তার সহযোগীরা সেনাবাহিনীতে প্রাধান্য বিস্তার করেন এবং গণতন্ত্রপন্থি অফিসারদের বের করে দেন। উদারনীতিকদের তো বটেই, তাদের পুরনো মিত্র মুসলিম ব্রাদার হুডকে দমন করে কঠিন হাতে। ৭০ দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত দলটিকে তৃণমূল থেকে উৎখাতের প্রচেষ্টা চললেও তাদের একেবারে ধ্বংস করা সম্ভব হয়নি।
বর্তমানে বিপ্লবী কমান্ড কাউন্সিল নেই। তবে মিসরের ক্ষমতায় আছে সেনাবাহিনীর সুপ্রিম কমান্ড কাউন্সিল। তরুণ বিপ্লবী আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব মেজর নাসেরের জায়গায় এখন রয়েছেন ৭৫ বছর বয়সী ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ হোসেইন তানতাবি। তার নেতৃত্বেই কাউন্সিল এখন দেশে গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের কথা বলছে। তবে তারা প্রতিষ্ঠান এবং স্বার্থের ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর আলাদা একটি মর্যাদা রাখতে চায়। প্রায় ৬০ বছর আগে পরিস্থিতি সঠিকভাবে মোকাবেলা করা হয়নি। তখন সেনাবাহিনীর কিছু ভূমিকা সংরক্ষিত রাখা হয়েছিল। কিন্তু তখনকার উদারনৈতিক ওয়াফদ পার্টির জায়গা এখন দখল করে নিয়েছে মুসলিম ব্রাদার হুড। কিছুদিন আগে, ১৯ মার্চ মিসরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো অবাধ ও গণতান্ত্রিক ভোট অনুষ্ঠিত হয়। ৭৭ দশমিক ২৭ শতাংশ ভোটার সংসদীয় নির্বাচনসহ সংবিধান সংশোধনের পক্ষে রায় দিয়েছে। নির্বাচিত ১০০ পার্লামেন্ট সদস্যকে নিয়ে সাংবিধানিক পরিষদ গঠিত হবে। ওই পরিষদ ছয় মাসের ভেতর নতুন সংবিধান প্রণয়ন করবে। তার পর তা অনুমোদন অথবা বাতিলের জন্য আরেক দফা গণভোট হবে। গত মার্চে গণভোটে 'হ্যাঁ' ভোটের পক্ষে ছিল মুসলিম ব্রাদার হুড। 'হ্যাঁ' ভোটের হার বলে দেয় ওই দলটি এখন মিসরের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক সংগঠন। তারা সেপ্টেম্বরে নির্বাচনের পক্ষে। মিসরের অন্য ইসলামী দলগুলোর একই মত। কিন্তু অনেক বামপন্থি ও উদারনীতিকসহ বেশিরভাগ ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা গণভোট দিল 'না' ভোটের পক্ষে। বর্তমানে মিসরের ধর্মনিরপেক্ষ ও উদারনৈতিক শক্তি বড়ই দুর্বল। সাংগঠনিকভাবে তারা অপরিণত এবং বৃহত্তর জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন। ওই অবস্থায় আগামী সেপ্টেম্বর কিংবা আরও এক বছর পর অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে তাদের পরাজয় অবধারিত। এ কারণেই ধরে নেওয়া হচ্ছে, সেপ্টেম্বরের নির্বাচন বিজয়ী হবে মুসলিম ব্রাদার হুড। সাংবিধানিক পরিষদে তাদের থাকবে প্রচণ্ড প্রভাব-প্রতিপত্তি। মিসর পাবে একটি ইসলামী সংবিধান। এ কারণেই সে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ ও উদারনৈতিক দলগুলোর নির্বাচন নিয়ে যত ভয় আর আশঙ্কা। তারা বিকল্প কিছু একটা চায়। কিন্তু গণভোটের ফল বা ৭৭ শতাংশ 'হ্যাঁ' ভোটের উপেক্ষা করে মিসরের ক্ষমতা যদি সেনাবাহিনীর সুপ্রিম কমান্ড কাউন্সিল আঁকড়ে থাকতে চায় কিংবা জোর করে ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান দিতে চায়, তাহলে সেটা হিতে বিপরীত হতে পারে। অনেকেই মনে করে, সেপ্টেম্বরের অবাধ নির্বাচনকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। মুসলিম ব্রাদার হুড কিংবা ইসলামী দলগুলো ক্ষমতায় গেলে তাদের পক্ষে জনপ্রিয়তা ধরে রাখা কঠিন হওয়াটাই স্বাভাবিক। যেহেতু চার বছর মেয়াদের ভেতর জনগণের চড়া আকাঙ্ক্ষা পূরণ, দুর্বল অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন, বেকারত্ব নিরসন, উন্নয়ন শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা এবং দ্রুত সামাজিক পরিবর্তন আনাটা যে কোনো সরকারের জন্য বিরাট বড় চ্যালেঞ্জ। কাজেই ধর্মনিরপেক্ষ ও উদারনৈতিক শক্তির পক্ষে নির্বাচনে ভীত না হয়ে নিজেদের সংগঠিত করাটাই উত্তম। যদিও তাদের জন্য একটি বড় সমস্যা হলো মিসরের ৫ কোটি ৫০ লাখ বয়স্ক মানুষের ৪৪ শতাংশই অশিক্ষিত এবং যাদের সবার ভোটাধিকার রয়েছে।
আরব বিশ্বে মুসলিম ব্রাদারহুডের জোয়ার : মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্রের সুবাতাস_ বিশেষ করে আরব গণজোয়ারের সুযোগ নিয়ে মুসলিম ব্রাদারহুডের ব্যাপক উত্থান ঘটেছে। ওই অঞ্চলের বেশিরভাগ দেশে তারাই এখন মূল রাজনৈতিক সংগঠন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে সব দেশের নির্বাচনে তাদের রয়েছে বিজয়ী হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা। বিশেষ করে মিসর ও তিউনিসিয়ায় তাদের ক্ষমতায় ভাগ বসানো নিশ্চিত। ইসলামী রাজনীতির বিষয়ে পাশ্চাত্যের বিশিষ্ট বিশেষজ্ঞ ফ্রানকোয়িস বারগাত বলেছেন, 'যদিও বিক্ষোভ আন্দোলনের সময় মুসলিম ব্রাদার হুড মধ্য মঞ্চে ছিল না, কিন্তু তারা এখন মিসর, তিউনিসিয়া, লিবিয়া এবং অন্যান্য দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ।' রাজনৈতিকভাবে মুসলিম ব্রাদার হুডের জন্ম মিসরে ১৯২৮ সালে। দলটির প্রতিষ্ঠাতা হলেন হাসান আল বান্না। মুসলিম ব্রাদার হুডের মূল রাজনৈতিক মন্ত্র হলো, 'আল্লাহ আমাদের লক্ষ্য, নবী মোহাম্মদ আমাদের নেতা এবং কোরআন আমাদের আইন।' যদিও দলটি এখনও গণতন্ত্রের প্রতি সমর্থন দিয়ে থাকে। 

সূত্র :বিবিসি ও এএফপি

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন