শুক্রবার, ৯ আগস্ট, ২০১৩

জার্মানি ও মুসলিম ব্রাদারহুড


বুধবার, ০৭ অগাস্ট ২০১৩, ০২:৪৭ অপরাহ্ন


মূল : গুইদো স্টেইনবার্গ হ অনুবাদ : মাসুম বিল্লাহ

[মিসরের গণতান্ত্রিক নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হওয়ার মাত্র এক বছরের মাথায় দৃশ্যত সেনাবাহিনীর হাতে ক্ষমতাচ্যুত হন মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতা মুহাম্মদ মুরসি। একবিংশ শতাব্দীতে আরব বিশ্বে ইসলামি দলগুলোর উত্থান নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার পাশাপাশি কৌতূহলেরও শেষ নেই। মুরসির ক্ষমতাচ্যুতিকে আমেরিকা বিভিন্নভাবে সমর্থন দেয়ার চেষ্টা করলেও ইউরোপের দেশগুলো এর বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে। এর অন্যতম যুক্তরাষ্ট্রের বড় মিত্র ও ন্যাটোর সদস্য জার্মানি। কেন দেশটির এই অবস্থান? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন পররাষ্ট্র বিষয়ে প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান ফরেন পলিসি ইনস্টিটিউটের গবেষক গুইদো স্টেইনবার্গ। আজ এর দ্বিতীয় পর্ব] জার্মান সরকারের প্রতিক্রিয়া মধ্যপ্রাচ্যের সরকারগুলো জার্মানির মাটিতে ব্রাদারহুডের উপস্থিতিকে সংগঠনটির প্রতি বার্লিন সরকারের নীরব সমর্থন হিসেবে গণ্য করলেও ১৯৮০-এর দশকের প্রথম দিক পর্যন্ত জার্মানি এ ব্যাপারে কখনোই তেমন মনোযোগ দেয়নি। এর মূল কারণ ছিল সম্ভবত ইসলামি সংগঠনগুলোর তাৎপর্য অনুধাবনের অভাব। মুসলিম ব্রাদারহুডের ব্যাপারে জার্মানির নীতি পর্যবেক্ষণকারী একজন প্রবীণ কূটনীতিকের মতে : সেখানে এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি ছিল যে, ব্রাদারহুড এবং তাদের সরকারগুলোর মধ্যে সঙ্ঘাতে জার্মানির কিছু করার নেই এবং এগুলো ‘অভ্যন্তরীণ বিরোধ’। সেখানকার নীতি নির্ধারকেরা ইসলামি আন্দোলনগুলোর তাৎপর্য অনুধাবনে ব্যর্থ হন। কারণ ধর্মকে অনুন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হতো এবং ইসলামপন্থীদের মনে করা হতো পশ্চাৎপদ। অন্য দিকে মধ্যপ্রাচ্যের স্বৈরাচারী সরকারগুলোকে আধুনিকায়নের উপাদান হিসেবে তারা বিবেচনা করত। জার্মানি ও মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামপন্থীদের তৎপরতার প্রতি কোনো আগ্রহ জন্ম নিলে তা জন্ম নিয়েছিল কেবল স্œায়ুযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে। জার্মান গোয়েন্দা বিভাগ সে দেশের কয়েকজন ব্রাদারহুড সদস্যকে সিরিয়া পরিস্থিতি সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়ার সম্ভাব্য সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করত। জার্মানি ও তাদের মিত্ররা ইস্টার্ন ব্লকের বাইরে সিরিয়া থেকে ইস্টার্ন ব্লকের দেশগুলোর ওপর নজরদারি করতে পারত। সর্বাধুনিক সোভিয়েত সমরাস্ত্র কেমন কাজ করছে, তারা তা পর্যবেক্ষণ করতে পারত। তাই জার্মান গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে সিরিয়া সম্পর্কে আগ্রহ জন্মায় এবং এরই পথ ধরে জার্মানির মাটিতে সিরিয়ান বিরোধী দল সম্পর্কেও আগ্রহের সৃষ্টি হয়। পূর্ব-পশ্চিম সঙ্ঘাতে মুসলিম ব্রাদারহুডকে নিয়ে জার্মান কর্মকর্তাদের মনে যে ধরনের ভাবনা কাজ করে, ১৯৫০-এর শেষ দিক ও ১৯৬০-এর প্রথম দিকে আমেরিকানদের মাথায় কাজ করে একই ধরনের চিন্তাধারা। তাই সাংবাদিক আয়ন জনসন লিখেন, সাইদ রামাদান তার তৎপরতা চালিয়ে যাওয়ার জন্য সম্ভবত সিআইএর কাছ থেকে সহযোগিতা পেয়েছিলেন। আমেরিকানরা কমিউনিস্ট-বিরোধী রামাদান ও তার অনুসারীদের সহযোগিতাকে তৃতীয় বিশ্বে সোভিয়েত প্রভাব মোকাবেলার হাতিয়ার হিসেবে গণ্য করত। তখনো তারা ভবিষ্যৎ আরব বিশ্বে ইসলামি আন্দোলনের তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারেনি। তারা রামাদানকে খাটো করে দেখে এবং শেষ পর্যন্ত তার অনুসারীদের ওপর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়। তবে আরব দেশগুলোর ইসলামপন্থীদের উপস্থিতিকে জার্মান সরকার মেনে নিয়েছিল এর কোনো প্রমাণ নেই। কারণ তারা ওই সব দেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চেয়েছিল। যেটা করা হয়েছে সেটা হলো, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির প্রতি আগ্রহী ছিল তাদের দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়ার জন্য। প্রথম দিকে জার্মান কর্তৃপক্ষ মসজিদগুলোর কার্যক্রমের ওপর নজরদারি চালালেও পরে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। ১৯৬০-এর দশকে জার্মানিতে মুসলিম ব্রাদারহুডের উপস্থিতির ব্যাপারে দেশটির কর্তৃপক্ষের জ্ঞান ছিল ভাসা ভাসা। এরপরও তারা সংগঠনটি এবং এর আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ব্যাপারে তেমন একটা মনোযোগ দেয়নি। কেবল ২০১১ সালে এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। এ সময় ইসলামি সংগঠনগুলোর সদস্য ও তাদের আন্তর্জাতিক যোগাযোগের বিষয়টি ঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণের মধ্যে আসে। ব্রাদারহুডের সাথে কাজ করেছেন জার্মানির এমন একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা স্বীকার করেন যে, ৯/১১-এর পরেই কেবল তারা সচেতন হয়েছেন। এর পর থেকে জার্মানির মুসলিম ব্রাদারহুডকে আর একপাশে ঠেলে দেয়া হয়নি। তাদের নিয়ে মিডিয়াতে লেখালেখির কারণেও রাজনীতিবিদদের মধ্যে ব্রাদারহুড সম্পর্কে আগ্রহ ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। শুধু তাই নয়, জার্মান ইসলামিক কনফারেন্সে, সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগে ব্রাদারহুডকে সম্ভাব্য অংশীদার হিসেবে নেয়া হবে কি-না এ বিষয়ে বিতর্ক যথেষ্ট গুরুত্ব পায়। ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরে জার্মান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই সম্মেলনের আয়োজন করে। এর উদ্দেশ্য ছিল জার্মানির মুসলমান ও অমুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে আন্তঃযোগাযোগের ক্ষেত্রে একটি নীতিমালা সম্পর্কিত বাধ্যতামূলক চুক্তি প্রণয়নের লক্ষ্যে কাজ করা। সম্মেলনে, জার্মানির সেন্ট্রাল কাউন্সিল অব মুসলিমের পাঁচটি অঙ্গসংগঠনের মধ্যে একটি ছিল ব্রাদারহুড এবং তারা সম্মেলনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে সরকারের স্বীকৃতি লাভ করে। যদিও জার্মান সরকারের এই নীতি ছিল সীমিত পর্যায়ে যোগাযোগ এবং কেবল অভ্যন্তরীণ দৃশ্যপটের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা। তবে সেন্ট্রাল কাউন্সিলকে সরকার একটি অনিবার্য খেলোয়াড় মনে করে, যাকে উপেক্ষা করার উপায় নেই। অবশ্য মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম ব্রাদারহুডের ব্যাপারে ‘প্রত্যাখ্যানের নীতি’ ২০১১ সাল পর্যন্ত বহাল থাকে। ২০১০ সাল পর্যন্ত জার্মানি ও মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম ব্রাদারহুডের মধ্যে সম্পর্ক আরব বিশ্বে মুসলিম ব্রাদারহুডের ব্যাপারে জার্মান নীতির কিছুটা প্রতিফলন ঘটে দেশটির অভ্যন্তরীণ নীতিতে। ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত সেখানে সাধারণভাবে ইসলাম এবং বিশেষভাবে ব্রাদারহুড নিয়ে সরকারের কোনো ধারণা ছিল না। উপলব্ধির এই অভাব সেখানে ‘প্রত্যাখ্যানে’র মনোভাব সৃষ্টি করে। এমন নেতিবাচক মনোভাবের একটি কারণ, ব্রাদারহুড ছিল ‘অ্যান্টি-সেমিটিক’ ভাবাপন্ন। বিশেষ করে মিসরীয় ও ফিলিস্তিনি অনুসারীদের মধ্যে এই মনোভাব কাজ করত। ২০০১ সালের পর মুসলিম ব্রাদারহুড এবং এর আন্তর্জাতিক পরিকাঠামোর গুরুত্ব সম্পর্কে নতুন করে সচেতনতা সৃষ্টি হয়। সেই সাথে সংগঠনটির সাথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন রয়েছে কি না তা নিয়ে বিতর্ক জোরদার হয়। নাইন-ইলেভেনের পর পশ্চিমারা মধ্যপ্রাচ্যের একনায়ক শাসকদেরকে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নির্ভরযোগ্য মিত্র হিসেবে দেখতে পায়। ফলে মিসর, আলজেরিয়া, জর্ডান, সিরিয়া ও কুয়েতের মতো দেশগুলোর সাথে সন্ত্রাসবিরোধী তৎপরতা জোরদার করে জার্মান সরকার। তখনো ব্রাদারহুডকে উপেক্ষা করার নীতি অব্যাহত থাকে। বিভিন্ন দেশে ইসলামপন্থী বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন সরকাগুলোকে সর্বাত্মক সহায়তা দিতে থাকে জার্মান সরকার। জার্মানির মধ্যপ্রাচ্য নীতি বিগত কয়েক দশকে জার্মানির মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে তিনটি বিষয়ে মনোযোগ দেয়া হয় : ইসরাইল-ফিলিস্তিনি সঙ্ঘাত, ইরানের সাথে সম্পর্ক এবং তুরস্ককে মধ্যপ্রাচ্যের অংশ হিসেবে ধরা হলেÑ তুরস্কের সাথে সম্পর্ক। এই বৃহত্তর কাঠামোর আওতায় বিভিন্ন সময়ে আরব দেশগুলো, বিশেষ করে মিসরের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলে জার্মানি। উপরিউক্ত সম্পর্কগুলোর যদি কোনো রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে থাকে তবে তা ইসরাইল-ফিলিস্তিন সঙ্ঘাতকে ঘিরে আবর্তিত হয় এবং সেখানে মিসরের ব্যাপারে (অথবা সাধারণভাবে আরব বিশ্বের ব্যাপারে) গভীর কোনো আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়নি। ফলে জার্মানির কাছে মুসলিম ব্রাদারহুডের সাথে সম্পর্ক তৈরির প্রশ্নটি তেমন প্রাসঙ্গিক ছিল না। ইসরাইলের টিকে থাকা এবং ব্রাদারহুডের ইসরাইলবিরোধী নীতি বিবেচনায় সহজেই অনুমান করা যায় জার্মান সরকার কেন তার কর্মকর্তাদের ব্রাদারহুডের সাথে নিচু পর্যায়ের সম্পর্ক সৃষ্টিরও অনুমতি দেয়নি। ১৯৯০-এর দশকে মিসরে দায়িত্ব পালনকারী একজন কূটনীতিকের বক্তব্য ছিল এ রকম : ১৯৯০-এর দশকে আমি যখন কায়রোর জার্মান দূতাবাসে কর্মরত, আমাকে ব্রাদারহুডের সাথে যোগাযোগের অনুমতি দেয়া হয়নি। সরকারিভাবে কোনো নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও এটা যে করা যাবে না তা সবার কাছে পরিষ্কার ছিল। কূটনীতিক ও গোয়েন্দাদের কাজ ছিল আলাদা। কায়রো দূতাবাসে জার্মান বৈদেশিক গোয়েন্দা বিএনডির কেউ ব্রাদারহুডের সাথে কথা বলত না। কেবল ২০১১ সালে এসে সংগঠনটি সম্পর্কে ওই মনোভাবের পরিবর্তন ঘটে। ২০০১ সালের পর জার্মানি আরব উপসাগরীয় দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক জোরদারের মাধ্যমে তার মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে নতুনত্ব আনে। চ্যান্সেলর গেরাহর্ড শ্রেয়েডার ২০০৩ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে এই নতুন নীতি চালু করেন। এ সময় তিনি দু’বার উপসাগরীয় দেশগুলো সফর করেন। তার উত্তরসূরি অ্যাঞ্জেলা মার্কেল এবং তার মন্ত্রিসভার বেশ কয়েকজন সদস্যও একই পথ অনুসরণ করেন। প্রাথমিকভাবে এসব সফরের উদ্দেশ্য বাণিজ্যিক হলেও এর সমান্তরালে আরব দেশগুলোর গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। উপসাগরীয় দেশগুলোর ব্যাপারে জার্মানির নতুন নীতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের নীতিতে পরিবর্তনের দ্বারাও প্রভাবিত হয়। জার্মানি সর্বদা ইউরোপিয়ান কমন সিকিউরিটি অ্যান্ড ফরেন পলিসির (সিএসএফপি) ঘোর সমর্থক। তাই জার্মান পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষণের জন্য এর ইউরোপীয় প্রেক্ষাপট অনুধাবন সর্বদা গুরুত্বপূর্ণ। এর কারণ মূলত পররাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে বহুপক্ষীয়তাকে পছন্দসই ধারণা হিসেবে বেছে নেয় জার্মানি। ১৯৪৯ সালের পর দেশটির কাছে বহুপক্ষীয়তার অর্থ ছিল সার্বভৌমত্ব ফিরে পাওয়া। অন্য দিকে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের কাছে এর অর্থ ছিল সার্বভৌম ক্ষমতা হাতছাড়া হয়ে যাওয়া। এমনকি ১৯৯০ সালে দুই জার্মানি একত্রীকরণ এবং ১৯৯২ সালে পূর্ণ সার্বভৌমত্ব ফিরে পাওয়ার পরও জার্মানি তার আগের দৃষ্টিভঙ্গিতে অটল থাকে। যদিও চ্যান্সেলর শ্রয়েডার ইঙ্গিত দেন যে, ১৯৯০-এর দশকের তুলনায় অধিকতর সক্রিয় অংশীদারের ভূমিকা পালন করবে জার্মানি। ওই বছরগুলোতে উত্তর আফ্রিকার ব্যাপারে জার্মানির আগ্রহ তীব্রতর হয়। ১৯৯০ দশক পর্যন্ত একটি অপ্রকাশ্য শ্রমিকবিনিময় চুক্তি কার্যকর ছিল। যাতে স্পেন ও ইতালির সাথে মিলে ফ্রান্স ভূমধ্যসাগরের উত্তরভাগের দেশগুলোর সাথে ইইউর সম্পর্কে নেতৃত্ব দেয়। একই সময়ে জার্মানির মনোযোগ ছিল পূর্ব ইউরোপে ইইউর সম্প্রসারণের দিকে। ১৯৯০-এর দশকের শেষ দিকে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের ব্যাপারে জার্মানির আগ্রহ বৃদ্ধি পেলে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। এটা হয়েছিল মূলত ১৯৯৫ সালে শেনজেন চুক্তি এবং ১৯৯৯ সালে কার্যকর হওয়া আমস্ট্রার্ডাম চুক্তির কারণে। এসব চুক্তির ফলে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর মধ্যে আন্তঃইউরোপীয় সীমান্ত বিলুপ্ত হয়ে যায়। সব সীমান্ত উন্মুক্ত না হলেও জার্মানি, ইতালি ও স্পেন চুক্তি পক্ষ হওয়ায় জার্মান সীমান্ত কার্যত ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। তাই এবং যেহেতু উত্তর আফ্রিকা থেকে অভিবাসন জার্মানির জন্য একটি বড় মাথাব্যথার কারণ ছিল, তাই দক্ষিণ ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার ব্যাপারে নিজস্ব স্বার্থ এবং দৃষ্টিভঙ্গি সুনির্দিষ্ট করতে বাধ্য হয় বার্লিন এবং ওই অঞ্চলের দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক জোরদার করে। এই নীতিতে নিরাপত্তার দিকগুলো সবচেয়ে গুরুত্ব পায়। সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা নাইন-ইলেভেনের ঘটনার পর জিহাদি সন্ত্রাসবাদীদের মোকাবেলা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়। এই হুমকির সৃষ্টি আরব বিশ্ব থেকে, এমন একটি মনোভাব ছিল জার্মান নীতিনির্ধারকদের মধ্যে। যার ফলে ২০০১ সালের পর বার্লিন সরকারের নীতি ছিল মূলত ওই অঞ্চলে সহিংসতা সামাল দেয়াকে ঘিরে। ২০০৩ সালে ইরাকে হামলার পর ইউরোপে সন্ত্রাসী হামলার সংখ্যা বেড়ে গেলে তা জরুরি হয়ে পড়ে। ২০০৭ সাল থেকে ইউরোপীয় নিরাপত্তা এজেন্সিগুলো আশঙ্কা করতে থাকে যে, উত্তর আফ্রিকান দেশগুলো থেকে সন্ত্রাসবাদ ইউরোপে বিস্তৃত হতে পারে। তাই সার্বিক বিবেচনায় জার্মান সরকার সন্ত্রাসী দলগুলোকে নিয়ন্ত্রণের জন্য আরব সরকারগুলোকে সহায়তা করার সিদ্ধান্ত নেয়। পরিবর্তনের চেয়ে স্থিতিশীলতা রক্ষাÑ মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকান দেশগুলোর সাথে জার্মানির সম্পর্কের মূল বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়। জার্মান সরকার অনেক আরব দেশের সাথে নিরাপত্তা সহযোগিতা জোরদার করে। জার্মান নিরাপত্তা সংস্থাগুলো, বিশেষ করে ফেডারেল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির (বিএনডি) বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের অভাব থাকায় এই সহযোগিতা জোরদার করা হয়। দশকের পর দশক এই সংস্থাটি কেবল সেভিয়েত ইউনিয়ন ও ওয়ারশো চুক্তির দিকে মনোযোগ দিয়ে আসছিল। ফলে মধ্যপ্রাচ্য ও আরব ভাষাভাষীদের ব্যাপারে এর দক্ষতায় ঘাটতি ছিল ব্যাপক। তাই যেসব দেশ থেকে আল কায়েদার সদস্যরা এসেছে সেসব দেশের সাথে সহযোগিতা বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দেয় সংস্থাটি। মিসর, সৌদি আরব, আলজেরিয়া, জর্ডান, কুয়েত ও সিরিয়ার সাথে সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতা জোরদার করে। কিছু কিছু জার্মান পর্যবেক্ষক অবশ্য এই সহযোগিতার ঘোরবিরোধী। কারণ পশ্চিমাদের এই সহযোগিতা স্বৈরাচারী সরকারগুলো কেবল আল কায়েদা ধরনের শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে লড়তে সহায়তা করছে না; ওই সব সরকার অন্যান্য ইসলামপন্থী বিরোধী দলকে দমন এবং ক্ষমতা সুসংহত করার কাজেও তা ব্যবহার করছে। জার্মান সরকার ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মধ্যপ্রাচ্য নীতির লক্ষ্য হিসেবে রাজনৈতিক সংস্কার ও গণতন্ত্রায়নকে ঘোষণা করলেও বাস্তবতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। যাই হোক, লক্ষ্যের সঙ্ঘাত নিয়ে জার্মানিতে কখনোই নিয়মতান্ত্রিকভাবে বিতর্ক হয়নি। এটা স্পষ্ট হয় ২০০৭-০৮ সালের শীতকালে বিএনডির কর্মকাণ্ড তদন্তে নিয়োজিত একটি কমিশন যখন জার্মান সরকার ও সিরিয়ার মধ্যে ২০০২ সালের একটি সহযোগিতা পর্যালোচনা করে। এতে জার্মান সরকার জিহাদি নেটওয়ার্ক সম্পর্কে তথ্য লাভের আশা করলেও সিরিয়ার আগ্রহ ছিল জার্মানিতে আশ্রয় নেয়া সিরিয়ান ভিন্ন মতাবলম্বী, বিশেষ করে মুসলিম ব্রাদারহুডের ওপর নজরদারির ব্যাপারে। অবশ্য সহযোগিতা তেমন ফলোদয় হচ্ছে না দেখে বিএনডি বেশি দিন তা অব্যাহত রাখেনি। সমালোচকদের মতে, জার্মান সরকার এমন এক রাষ্ট্রকে সহাযোগিতা করেছে, যেখানে বন্দীদের ওপর নিত্য নির্যাতন চালানো হয়। এ ছাড়া অন্য আরব দেশের সাথে সহযোগিতার বিষয়টি তেমন আলোচনায় আসেনি। নাইন-ইলেভেন-উত্তর সময়ে জার্মানিতে কিছু আমলাতান্ত্রিক পরিবর্তন আসে, যা দেশটির মধ্যপ্রাচ্য নীতি এবং পরোক্ষভাবে ব্রাদারহুড সম্পর্কিত নীতিকে প্রভাবিত করে। এই অঞ্চলের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সন্ত্রাসবাদের হুমকি যেহেতু ছিল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তাই গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হিসেবে আবির্ভূত হয় জার্মান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বস্তুত জার্মান সরকার ওই অঞ্চলের অংশীদারদের সাথে সন্ত্রাসবিরোধী তৎপরতা চালায় অনেকটা অভ্যন্তরীণ স্বরাষ্ট্রনীতি এবং সন্ত্রাস প্রতিরোধ প্রচেষ্টার সম্প্রসারিত অংশ হিসেবে। মধ্যপ্রাচ্যের সাথে সহযোগিতার ব্যাপারে কেবল ওই সব দেশের প্রতি মনোযোগ দেয়া হয় যেখান থেকে জার্মানির প্রতি হুমকি সৃষ্টি হতে পারে বলে মনে করে নিরাপত্তা সংস্থাগুলো। তবে পররাষ্ট্্রনীতি চেতনা দ্বারা প্রভাবিত ছিল এই নীতি। ফলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয় পশ্চিমাপন্থী সরকারগুলো। ২০০৮ ও ২০০৯ সালে সহযোগিতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র ছিল উত্তর আফ্রিকা, প্রধানত আলজেরিয়া। কিন্তু পরবর্তী সময়ে মরক্কো ও মিসরকেও সহযোগিতা দেয়া হয়। আফ্রিকার দেশগুলো থেকে আল কায়েদার সন্ত্রাসীরা ইউরোপে হামলা চালাতে পারে, এমন আশঙ্কা কাজ করে ওই নীতির পেছনে। অধিকন্তু, জর্ডান ও কুয়েতের সাথে নিরাপত্তা সম্পর্ক জোরদার করে জার্মান সরকার। এ ছাড়াও দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সৌদি আরব, ইয়েমেন, সিরিয়া এবং অন্যান্য দেশের সাথে কাজ করার ব্যাপারে সুস্পষ্ট আগ্রহ ব্যক্ত করে। ২০১১ ও পরবর্তী সময়ে জার্মানি ও মুসলিম ব্রাদারহুড নিরাপত্তা ও সন্ত্রাসবিরোধী মনোভাবের আধিপত্য ২০১১ সালের আগে জার্মান সরকারকে মুসলিম ব্রাদারহুডের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে দেয়নি। এমনকি ২০০১ সালের পরও যখন দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মুসলিম ব্রাদারহুডের সাথে যেকোনো ধরনের রাজনৈতিক যোগাযোগ প্রত্যাখ্যানের নীতিতে অটল থাকে, তখন আরব ও মুসলিম বিশ্বের ঘটনাবলি সম্পর্কে আরো বেশি করে জানার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন দেশটির অনেক কূটনীতিক। যার ফলে ২০০২ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ‘মুসলিম বিশ্বের সাথে আলোচনা’ শীর্ষক একটি কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়। এর প্রধান হিসেবে একজন বিশেষ প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়া হয় এবং বার্লিনে ছোট পরিসরে কয়েকজন বিশেষজ্ঞ নিয়ে একটি দল গঠন করা হয়। তাদের জন্য বিভিন্ন দূতাবাসে পদ সৃষ্টি করা হয়। এই বিশেষ প্রতিনিধিদের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো মুসলিম ব্রাদারহুড প্রতিনিধি এবং মুসলিম বিশ্বের আরো অনেকের সাথে সরকারি যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়। এটা সরকারি নীতি না হলেও তা আরব বসন্তের পর অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা এবং মুসলিম বিশ্বের সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্ঞান বৃদ্ধির পথ প্রশস্ত করে। এই কর্মসূচির সাথে সংশ্লিষ্ট একজন সাবেক কূটনীতিক বলেন : এসব ব্যক্তিকে যেসব কাজ করার অনুমতি দেয়া হয়, তা অন্যরা করতে পারত না। এর লক্ষ্য ছিল আমাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা। এই কর্মসূচির কিছু সমালোচনা থাকলেও তা ২০১১ সালের পরবর্তী সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনাবলির ব্যাপারে প্রস্তুতি নিতে জার্মানিকে সহায়তা করে। ফলে কেবল মুসলমানদের সাথেই নয়, ইসলামপন্থী রাজনীতিকদের সাথেও প্রথম যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে পররাষ্ট্র দফতরকে কোনো বেগ পেতে হয়নি। ২০০৯ সাল থেকে সরকারি কর্মকর্তা ও পালার্মেন্ট সদস্যরা ইউরোপীয় সরকার এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের মুসলিম ব্রাদারহুড সদস্যদের নিয়ে বেশ কিছু বহুপক্ষীয় আলোচনায় অংশ নেয়। এমন আস্থাসৃষ্টিকারী পদক্ষেপগুলো ২০১১ সাল-পরবর্তী সময়ে নতুন জার্মান নীতি তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

বৃহস্পতিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৩

ফিলিস্তিনের নন্দিত রাজনীতিক মেশালকে হত্যায় মোসাদের শ্বাসরুদ্ধকর অভিযান






ফিলিস্তিনের মুকুটহীন সম্রাট, নন্দিত রাজনীতিক ও গাজা শাসনকারী হামাসের প্রধান খালেদ মেশালকে হত্যায় ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানের কাহিনী ফাঁস হয়ে গেছে।
আজীবন দেশান্তরিত এই স্বাধীনতা সংগ্রামীকে অভূতপূূর্ব পৈশাচিকতায় হত্যা করতে চেয়েছিল ইহুদিবাদী ইসরাইল। তবে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসেন তিনি। ইসলামপন্থী এই রাজনীতিককেই সম্ভবত ইসরাইল নামক হায়েনা রাষ্ট্রটি সবচেয়ে বেশি ভয় পায়। মেশালকে হত্যা পরিকল্পনার কাহিনী নিয়ে নির্মিত তথ্যচিত্রে উঠে এসেছে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য। তথ্যচিত্রটি তৈরি করেছেন পরিচালক ইয়াসের আবু হিলালাহ। ১৯৯৭ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ইসরাইলি বর্বর গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ মেশালকে হত্যার চেষ্টা করে। তখন থেকে তিনি জর্ডানে নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেন। তাকে হত্যার জন্য আম্মানে উপস্থিত হয় ছয় সদস্যের মোসাদ টিম। ভুয়া পাসপোর্ট ব্যবহার করে আমস্টারডাম, টরোন্টো ও প্যারিস থেকে একযোগে জর্ডানের রানী আলিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে আম্মান প্রবেশ করেন তারা। এ প্রসঙ্গে ‘কিল হিম সাইলেন্টলি’ তথ্যচিত্রের সঙ্গে সাক্ষাত্কারে মেশাল বলেন, ‘ওই বছর গ্রীষ্মেই ইসরাইলি হুমকি শুরু হয়। ফিলিস্তিনি অভিযান বন্ধ করার জন্য চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় ইসরাইল। কাজেই তারা নির্বাসিত হামাস নেতাদের হুমকি দিতে লাগল। এসব হামলার নেপথ্যেই লুকিয়ে ছিল ইসরাইলি পরিকল্পনা। তবে ইসরাইল যেহেতু কোনোদিনই জর্ডানে কোনো অভিযান চালায়নি, তাই আমরা অনেকটা নির্ভার ছিলাম।’ জেরুজালেম ও তেলআবিবে হামাসের সিরিজ আত্মঘাতী হামলার পরিপ্রেক্ষিতে মোসাদ মেশালকে হত্যার পরিকল্পনা করে। এসব হামলায় অন্তত ২০ ইসরাইলি নিহত ও শ’ শ’ লোক আহত হয়। এ অবস্থায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে ইসরাইল। তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু মোসাদসহ নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সঙ্গে জরুরি বৈঠকে বসেন। তিনি হামাসের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন। উদ্দেশ্য ছিল চরম প্রতিশোধ নেয়া। সে সময় জর্ডান ও ইসরাইলের সম্পর্কও ভালো যাচ্ছিল না। এ অবস্থায় গোপন অভিযান চালিয়ে মেশালকে হত্যার সবুজ সঙ্কেত দেন নেতানিয়াহু। সিদ্ধান্ত হয়, মেশালকে এমন বিষ প্রয়োগ করা হবে, যাতে ধীরে ধীরে তার মস্তিষ্ক অচল হয়ে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বেন। পরিকল্পনা করা হয়, মেশালের কানে বিষ ছিটিয়ে দেয়া হবে। এতে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তার মৃত্যু হবে। ফলে কোনো অস্ত্র ছাড়াই মেশালকে হত্যা করা সম্ভব হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী মেশালের কানে বিষ প্রয়োগ করে দু’জন মোসাদ এজেন্ট। তবে তাদের ধাওয়া করেন মেশালের একজন দেহরক্ষী মুহাম্মদ আবু সাইফ। পরে প্যালেস্টাইন লিবারেশন আর্মির একজন কর্মকর্তার সহায়তায় এজেন্টদের ধরে ফেলা হয়। এটি ছিল ইতিহাসের একটি চরম ব্যর্থ বিশেষ অভিযান। এরপরই বিস্ময়কর উত্থান ঘটে হামাসের। দুই পর্বের এই তথ্যচিত্রে খালেদ মেশালের পাশাপাশি তত্কালীন মোসাদের প্রধান ড্যানি ইয়াটমের সাক্ষাত্কার নেয়া হয়েছে। ড্যানিই এই পরিকল্পনার প্রধান হোতা ছিলেন। কিন্তু মোসাদ এজেন্টরা ধরা পড়ার পর মেশালকে বাঁচাতে প্রতিষেধক নিয়ে আম্মানে উপস্থিত হন ড্যানি। তথ্যচিত্রের দ্বিতীয় পর্বে দেখানো হবে মেশালকে হত্যার পর পর্দার আড়ালে যুক্তরাষ্ট্র, জর্ডান ও ইসরাইলের মধ্যকার কূটনৈতিক প্রচেষ্টার নাটকীয় ঘটনাবলী। জর্ডানের রাজার অফিসের কর্মকর্তা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আলী শুকরি সে সময় পালন করেছিলেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তিনি বলেন, ‘জর্ডানের রাজা হুসেন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনকে ফোন করে ঘটনা অবহিত করেন। এ ঘটনা শুনে বিস্মিত হন ক্লিনটন। তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, জর্ডানে এ ঘটনা ঘটতে পারে। আলাপচারিতা শেষে ক্লিনটন নেতানিয়াহুর ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, ওই লোকটা অসম্ভব মানুষ।’ ক্লিনটনকে রাজা বলেন, ‘মেশালকে বাঁচাতে প্রতিষেধক ইসরাইলকেই দিতে হবে। মেশাল মারা গেলে ইসরাইল-জর্ডান শান্তিচুক্তি বাতিল করা হবে।’ এ সময় ইসরাইল থেকে প্রতিষেধক নিয়ে আম্মানে হাজির হন মোসাদ প্রধান ড্যানি। রাজা তার ওপর চরম ক্ষুব্ধ হন। দু’দেশের মধ্যে এ সময় তীব্র উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। রাজা আম্মানের ইসরাইলি দূতাবাস ঘেরাও করে রাখার জন্য নিরাপত্তা বাহিনীকে নির্দেশ দেন। মোসাদের ডেথ স্কয়াডের সদস্যরা দূতাবাসে পালিয়েছিল। এ সময় মেশালকে বাঁচাতে প্রাণপণ চেষ্টা করছিলেন হুসেন মেডিকেল সিটি হাসপাতালের চিকিত্করা। মেশাল সে সময় কোমায় চলে যান। বিশেষজ্ঞরা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানান, মেশালকে মরফিন জাতীয় মাদক প্রয়োগ করে মোসাদ, যার ফলে দেহ অসাড় হয়ে মৃত্যু অনিবার্য হয়ে পড়ে। ২৭ সেপ্টেম্বর মেশাল মৃত্যুর কাছাকাছি অবস্থা কোমা থেকে ফিরে আসেন। এতদিন এই শ্বাসরুদ্ধকর কাহিনী অনেকেরই ছিল অজানা। বিশেষ করে গণমাধ্যম অতিসম্প্রতি এ সম্পর্কে জানতে পেরেছে।
আল জাজিরা অবলম্বনে ইলিয়াস হোসেন

বুধবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১২

মন্তব্য প্রতিবেদন : মুসলমানের মানবাধিকার থাকতে নেই


মাহমুদুর রহমান




বাড়ির পাশে মিয়ানমারে গত পঞ্চাশ বছর ধরে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে জাতিগত শুদ্ধি অভিযান (Ethnic Cleansing) চলছে। দেশটিতে সামরিক জান্তা এবং শান্তিতে নোবেল জয়ী, গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামরত অং সাং সুচি’র মধ্যে তীব্র রাজনৈতিক বিরোধ থাকলেও মুসলমান নিধনে তারা একাট্টা। মহামতি গৌতম বুদ্ধের মহান বাণী ‘প্রাণী হত্যা মহাপাপ’ এবং ‘জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক’ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের বাইরেও বিশ্বের তাবত্ শান্তিবাদীদের আবেগাপ্লুত করে থাকে। অথচ মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ কট্টর সাম্প্রদায়িক বৌদ্ধ সম্প্রদায় সে দেশের রোহিঙ্গা মুসলমানদের মানুষ তো দূরের কথা গৌতম বুদ্ধ বর্ণিত জগতের যে কোনো প্রাণীর মর্যাদা দিতেও নারাজ। সংখ্যালঘু মুসলমানদের বিরুদ্ধে পরিচালিত শুদ্ধি অভিযানকে ন্যায্যতা দিতে অং সাং সুচিসহ মিয়ানমারের শাসক-গোষ্ঠী তাদের নাগরিকত্ব থাকা না থাকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।
আরব বণিকদের মাধ্যমে মিয়ানমারের জনগণ ১২শ’ বছর আগে ইসলাম ধর্মের সংস্পর্শে আসে। গত সহস্রাব্দের প্রথমার্ধে আরাকানের বৌদ্ধ রাজা বিদ্রোহীদের দ্বারা ক্ষমতাচ্যুত হলে তার অনুরোধে গৌড়ের সুলতান কয়েক দফায় সেখানে সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন।
১৪৩২ সালে গৌড়ের সেনাপতি সিন্দি খান আরাকানের প্রাচীন রাজধানী ম্রোহংয়ে মসজিদ নির্মাণ করেন। ওই সময় থেকেই বৃহত্তর চট্টগ্রাম এবং স্বাধীন আরাকান রাজ্যের জনগণের মধ্যে ভ্রাতৃত্বমূলক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। আরাকানে মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং রাজসভায় বাংলাভাষা বিশেষ স্থান লাভ করে। মহাকবি আলাওল, শাহ ছগির, মাগন ঠাকুরের মতো মধ্যযুগের বিখ্যাত কবিরা আরাকান রাজ্যের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। আরাকান রাজারা বৌদ্ধ ধর্ম চর্চা করলেও মুসলমান পোশাকি নাম গ্রহণ করেন। অর্থাত্ মিয়ানমারের আরাকান অংশে ইসলাম ধর্ম এবং বাংলা ভাষার বিস্তার লাভ ৬শ’ বছরেরও অধিককাল আগের ঘটনা। সে তুলনায় পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমাদের আগমন সেদিন ঘটেছে। অথচ মিয়ানমারে ওইসব মুসলমানের নাগরিকত্ব নিয়ে এই শতাব্দীতে এসে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। এদিকে সীমান্তের এ পারে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মদতে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী একদল চিহ্নিত দালাল শ্রেণীর নাগরিক চাকমা জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী সাব্যস্ত করে এদেশের প্রকৃত ভূমিপুত্রদের অধিকার হরণের ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। মিয়ানমারে মুসলমানদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চললেও তথাকথিত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় (International Community) নিশ্চুপ রয়েছে। জাতিসংঘ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের পরিবর্তে অধিক সংখ্যায় উদ্বাস্তু গ্রহণের জন্য বাংলাদেশের ওপর অন্যায় চাপ সৃষ্টি করে তাদের দায়িত্ব সেরেছে। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকারি মহল নিরাশ্রয় রোহিঙ্গা নারী-শিশুদের প্রতি যে চরম অমানবিকতার পরিচয় দিয়েছে তার নিন্দা জানালেও এ কথা মানতে হবে, মিয়ানমারের মুসলমান শরণার্থীদের বাংলাদেশে আশ্রয় দিলেই মূল সমস্যার সমাধান হচ্ছে না।
কয়েক লাখ রোহিঙ্গা দুই যুগেরও অধিককাল টেকনাফ অঞ্চলে শরণার্থী শিবিরে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ রাষ্ট্র। অর্থনৈতিকভাবে আমরা এখনও একটি পশ্চাদপদ দেশের নাগরিক। যৌক্তিক কারণেই আমাদের পক্ষে দীর্ঘস্থায়ীভাবে কোনো অতিরিক্ত জনগোষ্ঠীর ভার বহন করা সম্ভব নয়। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশ বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর বিষয়ে সচরাচর যে উত্কণ্ঠা, উত্সাহ দেখিয়ে থাকে তার কিয়দাংশ রোহিঙ্গাদের প্রতি প্রদর্শন করলে সমস্যাটির দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে সহায়ক হতো। এসব রাষ্ট্র বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর আদিবাসী নামকরণে বাংলাদেশকে অব্যাহত অন্যায় চাপ দিলেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে তাদের নীরবতা বিস্ময়কর। এমন ধারণা পোষণ করা অমূলক হবে না, মিয়ানমারের সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী যদি মুসলমান ধর্মাবলম্বী হয়ে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গারা ভিন্নধর্মের হতো তাহলে দ্বিমুখী চরিত্রের (Double Standard) পশ্চিমাদের সুর পাল্টে যেত। অবশ্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা কিছুদিন আগে মিয়ানমার সফরে এসে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে অন্তত উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তার প্রকাশ্য প্রতিক্রিয়ার ফলে মিয়ানমার সরকার সাময়িকভাবে হলেও মুসলমান নির্যাতনে বিরতি দিয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে গঠিত সংগঠন ওআইসি (OIC) তার দায়িত্ব পালনে ধারাবাহিক ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলেছে। রোহিঙ্গাদের পাশে এসে দাঁড়ানো তো দূরের কথা, জতিগত শুদ্ধি অভিযান পরিচালনার জন্য মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে একটা নিন্দা প্রস্তাবও এ নির্বিষ সংগঠনটি আনতে পারেনি। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে মুসলমানদের ওপর নিপীড়ন চললেও ওআইসির যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে অমার্জনীয় ব্যর্থতা সংগঠনটির কার্যকারিতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
এবার ফিলিস্তিনের নির্যাতিত জনগণের দিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক। এক সময়ের ঔপনিবেশিক শক্তি ব্রিটেনের পররাষ্ট্র সচিব আর্থার জেম্স্ বালফুর (Arthur James Balfour) ১৯১৭ সালে তার দেশের ইহুদি (British Jewish Community) নেতা ব্যারন রথচাইল্ডকে (ইধত্ড়হ জড়ঃযংপযরষফ) লিখিত এক পত্রের মাধ্যমে প্যালেস্টাইনের আরব ভূমিতে একটি ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের প্রতিশ্রুতি দেন। ১৯৩৯ সালে যুদ্ধের ডামাডোল বাজার প্রাক্কালে ব্রিটেন ওই প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসার প্রচেষ্টা নিলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বিশ্ব ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। ওই যুদ্ধে নাত্সী জার্মানি ও তার ফ্যাসিস্ট মিত্ররা পরাজিত হলে ইউরোপব্যাপী খ্রিস্টানদের মধ্যে ইহুদিদের প্রতি হলোকস্টজনিত (Holocaust) এক প্রকার যৌথ অপরাধবোধ (Collective Guilt) জন্ম নেয়। জার্মানি, পূর্ব ইউরোপ ও রাশিয়ার অধিকৃত অঞ্চলের ইহুদিদের প্রতি হিটলারের পৈশাচিক আচরণের সঙ্গে আরবের মুসলমানদের কোনোরকম সম্পৃক্ততা না থাকলেও যুদ্ধে বিজয়ী ইঙ্গ-মার্কিন জোট অসহায় ফিলিস্তিনিদের তাদেরই ভূখণ্ড থেকে উত্খাত করে সেখানে ইহুদিবাদী রাষ্ট্র (Zionist State) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বালফুর ডিক্লারেশন বাস্তবায়ন করে। অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জর্জরিত আরবরা সামরিক দুর্বলতা ও ইঙ্গ-মার্কিন ষড়যন্ত্রের ফলে ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। শুরু হয় ফিলিস্তিনিদের উদ্বাস্তু জীবন। তারপর ৬৪ বছর পেরিয়ে গেছে। ফিলিস্তিনিরা তাদের আপন আবাসে আজও ফিরতে পারেনি, পূর্বপুুরুষের ভূমিতে তাদের ন্যায্য অধিকারও ফিরে পায়নি। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের অন্ধ সমর্থনে মৌলবাদী ইসরাইল এক দুর্বিনীত রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। আন্তর্জাতিক আইনের কোনোরকম তোয়াক্কা না করে রাষ্ট্রটি ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে একের পর এক ভয়াবহ সব মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে চলেছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল পারমাণবিক এবং অন্যান্য গণবিধ্বংসী অস্ত্রের সর্ববৃহত্ ভাণ্ডার গড়ে তুলেছে। অথচ সেদিকে দৃষ্টি না দিয়ে গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগে ইরাককে ধ্বংস করা হয়েছে। দীর্ঘদিনের অন্যায় অবরোধ ও নির্বিচারে বোমাবর্ষণে সে দেশের লাখ লাখ শিশু, নারী, পুরুষ নিহত হয়েছে। পশ্চিমাদের দ্বিমুখী নীতির এখানেই শেষ নয়। ইসলামিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের পারমাণবিক বোমাকে পশ্চিমা মিডিয়ায় ‘ইসলামিক বোমা’ নামে উল্লেখ করা হলেও ইসরাইলের বোমাকে ‘ইহুদি বোমা’ কিংবা ভারতের বোমাকে ‘হিন্দু বোমা’ কখনও বলতে শুনিনি।
ফিলিস্তিনিদের প্রতি অর্ধ শতাব্দীরও অধিককাল ধরে এত নির্যাতন, এত অবিচার অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও আরব রাষ্ট্রগুলো ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পরিবর্তে একে অপরের বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের দ্বারা সোত্সাহে ব্যবহৃত হচ্ছে। ইরাক, লিবিয়া এবং সিরিয়ার বিরুদ্ধে হামলায় মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন আরব রাষ্ট্রও যোগদান করেছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কুখ্যাত Divide and rule (বিভক্তি ও শাসন) কৌশল আজও নির্বোধ, ভ্রাতৃঘাতী মুসলমানদের বিরুদ্ধে সফলভাবে প্রয়োগ চলছে। ইরাক আক্রমণের প্রাক্কালে তত্কালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ (জুনিয়র) এবং যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার মুসলিম বিশ্বকে প্রতারিত করার জন্য যুদ্ধ শেষে ফিলিস্তিনি সমস্যার আশু সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ইরাক- ধ্বংসযজ্ঞের প্রায় দশ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। রাজনীতিতে কপটতার জন্য বহুল পরিচিত টনি ব্লেয়ার অসংখ্য মুসলমানের রক্তমাখা হাত নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে জাতিসংঘের বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। তার বেতন কত কিংবা তাকে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রদানে বছরে জাতিসংঘের কত লাখ ডলার ব্যয় হয় সে সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই। তবে অর্থের অংকটি বিশাল না হলে টনি ব্লেয়ার তার ‘মূল্যবান’ সময় নষ্ট করে মুসলমানদের প্রতি বদান্যতা দেখাচ্ছেন এটা বিশ্বাস করা কঠিন। ইরাকের লাখো শিশু হত্যাকারী টনি ব্লেয়ারকে মধ্যপ্রাচ্যে এ দায়িত্ব প্রদান করাটাই বিশ্বের সব মুসলমানের জন্য চরম অবমাননাকর। আশ্চর্যের বিষয় হলো আজ পর্যন্ত জাতিসংঘের সদস্য কোনো ইসলামিক রাষ্ট্রই টনি ব্লেয়ারের পদ প্রাপ্তি নিয়ে আপত্তি জানায়নি। যাই হোক, টনি ব্লেয়ার এখন পর্যন্ত ফিলিস্তিনি সমস্যার সমাধানে কোনোরকম অবদান রাখতে পারেননি। সমস্যা সমাধানে তার আদৌ কোনো আগ্রহ আছে সেটাও প্রতিভাত হয়নি। বরঞ্চ, এ সময়ের মধ্যে ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে ইসরাইলের আগ্রাসন আরও তীব্র হয়েছে। প্রায় প্রতিদিন ফিলিস্তিনি নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ, শিশু নিহত হচ্ছে। এই একতরফা গণহত্যাকে পশ্চিমাবিশ্ব জায়নবাদী ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকার বলে বর্ণনা করে বৈধতা দিচ্ছে। সুতরাং, আরব বিশ্বের একতা ব্যতীত সে অঞ্চলের মুসলমানদের সাম্রাজ্যবাদের নির্যাতন থেকে মুক্তির কোনো সম্ভাবনা নেই।
কাশ্মীর নিয়ে আলোচনা ছাড়া আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মুসলমানের বঞ্চনার কাহিনী সমাপ্ত হতে পারে না। ১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশ বিভক্ত হয়েছিল সংখ্যা-সাম্যের ভিত্তিতে। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান এবং হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে ভারত গঠিত হয়। কিন্তু, কাশ্মীর এবং হায়দরাবাদের মতো কয়েকটি রাজাশাসিত অঞ্চলের (Princely state) ভাগ্য অসত্ উদ্দেশে অনির্ধারিত রেখেই ব্রিটিশরা ভারত ত্যাগ করে। কাশ্মীরের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মুসলমান হলেও ডোগরা রাজা ছিলেন হিন্দু। অপরদিকে হায়দরাবাদের পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ উল্টো। ভারত সরকার হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতার যুক্তিতে সেনা অভিযান চালিয়ে মুসলমান শাসক নিজামকে ক্ষমতাচ্যুত করে হায়দরাবাদ দখল করে। একই যুক্তিতে কাশ্মীর পাকিস্তানের অংশভুক্ত কিংবা স্বাধীন হওয়ার কথা থাকলেও হিন্দু রাজা অন্যায়ভাবে ভারতভুক্তির ঘোষণা দেন। ১৯৪৮ সালের ২১ এপ্রিল জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ৩৯-৫ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ৪৭ নম্বর প্রস্তাব (Resolution 47) গৃহীত হয়। কাশ্মীরের ভবিষ্যত্ নির্ধারণে সেখানকার জনগণের অধিকার মেনে নিয়ে ওই প্রস্তাবে গণভোটের (Plebiscite) সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তবে জাতিসংঘের প্রস্তাবে একটা ফাঁক থেকে যায়। জাতিসংঘ চ্যাপ্টারের ৭ (Chapter VII)-এর পরিবর্তে নিরাপত্তা পরিষদ চ্যাপটার ৬ (Chapter VI)-এর অধীনে প্রস্তাব গ্রহণ করে। চ্যাপ্টার ৭-এর প্রয়োগ হলে ওই সিদ্ধান্ত ভারতের ওপর বাধ্যতামূলক (Binding and enforceable) হতো। সে সময় ভারত সরকার নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিলেও আন্তর্জাতিক আইনের ওই ফাঁকফোকরের সুযোগ নিয়ে সম্পূর্ণ গায়ের জোরে কাশ্মীরের জনগণকে আজ পর্যন্ত ভবিষ্যত্ নির্ধারণের অধিকার প্রয়োগ করতে দেয়নি। ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদের বুটের তলায় নিষ্পেষিত হচ্ছে সেখানকার নারীর সম্ভ্রম, তরুণের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। ৬৫ বছরের সংগ্রামে কাশ্মীরের লাখ লাখ স্বাধীনতাকামী নারী-পুরুষ ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে নির্যাতিত হয়েছে, নিহত হয়েছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আমাদের ওপর যে আচরণ করেছে তার সঙ্গে কাশ্মীরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর আচরণের কোনো ফারাক নেই। ৯০-এর দশকে কাশ্মীরের তত্কালীন গভর্নর জগমোহন বিক্ষোভকারীদের দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দিয়ে এক সময়ের ভূস্বর্গকে মৃত্যুপুরিতে পরিণত করেছিলেন। সেখানে পাঁচ লক্ষাধিক ভারতীয় সেনা শতাধিক নির্যাতন কেন্দ্র পরিচালনা করে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে সংগ্রামরত মুক্তিযোদ্ধাদের নির্যাতন করে চলেছে। ১ কোটি ২৫ লাখ জনসংখ্যার একটি অঞ্চলে ৫ লাখ সেনা মোতায়েন থেকেই ভারত সরকারের শক্তি প্রদর্শনের আন্দাজ পাওয়া সম্ভব। উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে সাড়ে সাত কোটি বাংলাদেশীকে দমন করতে পাকিস্তান সরকার ১ লাখ সেনা পাঠিয়েছিল। ফিলিস্তিনের নিপীড়িত মানুষের মতো কাশ্মীরের জনগণেরও মুক্তি কবে আসবে সেই ভবিষ্যদ্বাণী আমার পক্ষে করা সম্ভব না হলেও স্বাধীনতার অদম্য আকাঙ্ক্ষা যে কোনোদিন নির্বাপিত করা যায় না সেটা ইতিহাসেরই শিক্ষা।
এবার মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এক রাষ্ট্রে মুসলমানদেরই অসহায়ত্বের কথা বলি। সেক্যুলারত্বের আবরণে এক ইসলাম বিদ্বেষী সরকারের আমলের বাংলাদেশে সংখ্যাগুরু নাগরিকদের মানবাধিকার পরিস্থিতির চিত্র সংক্ষেপে তুলে ধরে লেখার ইতি টানব। তিনটি ঘটনার উল্লেখ করলেই আশা করি, পাঠক দেশের সার্বিক অবস্থা বুঝতে পারবেন। বিশ্বজিত্ নামে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক খেটে খাওয়া নিরীহ তরুণ প্রকাশ্য দিবালোকে মুজিববাদী ছাত্রলীগের চাপাতি বাহিনীর নৃশংসতার শিকার হয়ে এই বিজয়ের মাসেই নিহত হয়েছে। ছেলেটিকে লাঠি দিয়ে প্রহার এবং চাপাতি দিয়ে কোপানোর দৃশ্য টেলিভিশনের পর্দায় শেষ পর্যন্ত দেখা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। এই লেখার সময়ও তার উদভ্রান্ত, রক্তাক্ত চেহারা চোখের সামনে ভাসছে। প্রধানমন্ত্রী এবং তার মন্ত্রিসভার চাটুকার বাহিনী ব্যতীত দলমত নির্বিশেষে দেশবাসী সরকারের খুনি বাহিনীর বর্বর, নৃশংস আচরণে ঘৃণা প্রকাশ করেছেন। বিশ্বজিতের হত্যাকাণ্ডের দৃশ্য দেখতে গিয়ে আমার ২০০৭ সালের ২৮ অক্টোবরে ঢাকার রাস্তায় লগি-বৈঠার তাণ্ডবের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। সেদিন জামায়াত-শিবিরের একাধিক তরুণ আজকের বিশ্বজিতের মতোই অগুনতি টেলিভিশন ক্যামেরা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অসংখ্য সদস্যের চোখের সামনে নিহত হয়েছিলেন। দেশবাসী লাশের উপর আওয়ামী সন্ত্রাসীদের তাণ্ডব নৃত্যের একটি অতি লোমহর্ষক দৃশ্য দেখে শিউরে উঠেছিলেন। হত্যাকারীরা একই দলভুক্ত ছিল। আজকে তাদের মাঠে নামার হুকুম দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর আর সেদিন হুকুম দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। ঘটনার প্রকৃতি এবং হুকুমদাতার পরিচয়ে তফাত্ সামান্যই। কিন্তু, বড় তফাত্ হলো ২৮ অক্টোবর যারা নিহত হয়েছিলেন তারা সবাই ধর্মে মুসলমান ছিলেন। মুসলমান প্রধান দেশে সেই নৃশংসতায় বিস্ময়করভাবে বিবেক জাগ্রত না হলেও আজ বিশ্বজিতের জন্য সবাই আহাজারি করছেন। বিদেশি কূটনীতিকরাও দেশবাসীর উদ্বেগে শামিল হয়েছেন। আচ্ছা, ২৮ অক্টোবর লগি-বৈঠার তাণ্ডবে যারা নিহত হয়েছিলেন তাদের নামগুলোও কি স্মরণে আছে আপনাদের? এ সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় টকশো স্টার মাহমুদুর রহমান মান্না ক’দিন আগে টেলিভিশনে বললেন বিশ্বজিতের ঘটনা নাকি বেশি নির্মম। হতেও পারে। তবে আমার কাছে হিন্দু ও মুসলমানের রক্তের রঙ, তাদের মৃত্যুযন্ত্রণা একই রকম মনে হয়। প্রসঙ্গক্রমে আরও একটি তথ্যের উল্লেখ করছি। যেদিন ঢাকায় বিশ্বজিত্ নিহত হয়েছে সেই একইদিনে সিরাজগঞ্জে, জামায়াতে ইসলামীর কর্মী ওয়ারেস আলীকেও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা গণপিটুনিতে হত্যা করেছে। সেই খুনের ঘটনাতেও নৃশংসভাবে লাঠি এবং ছুরি ব্যবহৃত হয়েছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো বিশ্বজিত্ হত্যা নিয়ে মিডিয়াতে মাতামাতি হলেও ওয়ারেস আলীর খবর ছাপাতে পত্রিকায় সিঙ্গেল কলামের বেশি জায়গা হয়নি। তাও আবার হাতে গোনা দু-একটি পত্রিকায়। অধিকাংশ পত্রিকা এবং টেলিভিশন ওয়ারেস আলীকে সংবাদের মর্যাদা দিতেও কুণ্ঠিত হয়েছে।
পরাগ নামে এক নিষ্পাপ শিশু কিছুদিন আগে স্কুলে যাওয়ার পথে অপহৃত হয়েছিল। শিশুটির বাবা কেরানীগঞ্জের একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। কয়েকদিন নিখোঁজ থাকার পর বিশাল অংকের মুক্তিপণের বিনিময়ে পরাগকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়। পরাগের পরিবার সংখ্যালঘু এবং আওয়ামী লীগ সমর্থক। অপহরণকারীরাও সরকারি দলের চিহ্নিত সন্ত্রাসী। পরাগের অপহরণে সারা দেশে শোকের বন্যা বয়ে গিয়েছিল। আমার পরিচিত অনেক পরিবারে শিশুটির মুক্তির জন্য নামাজ পড়ে দোয়া করার কাহিনী শুনেছি। ক’দিন অন্তত টেলিভিশনে প্রায় ২৪ ঘণ্টাই কেবল পরাগকে নিয়ে সংবাদ প্রচার এবং টক শো’তে আলোচনা চলেছে। অপহরণকারীরা তাকে মুক্তি দিলে দেশের মানুষ আন্তরিকভাবেই স্বস্তি প্রকাশ করেছে। ধনবানদের জন্য নির্মিত স্কয়ার হাসপাতালে চিকিত্সা শেষে পরাগ নিজ বাসায় মায়ের কোলে ফিরে গেলে এলাকায় আনন্দের বন্যা বয়ে গিয়েছিল। উলুধ্বনি, ফুল ছিটানো, মিষ্টি বিতরণ, ইত্যাদি টেলিভিশনে দেখেছি। পরাগের মতোই এবার আর এক শিশুর গল্প বলি। সে এতই দরিদ্র পরিবারের যে তার নাম জানার আপনাদের কারও আগ্রহ হবে না। পঞ্চগড়ে এক অনুষ্ঠানে গিয়ে তার হত্যার নির্মম কাহিনী শুনেছিলাম। শিশুটির বাবা কলা ফেরি করে সংসার চালান। দু’বেলা আহার জোটা মুশকিল। অপহরণকারীরা শিশুটিকে তুলে নিয়ে এক লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেছিল। হাজার টাকা দেয়ার যার সামর্থ্য নেই সে লাখ টাকা কোথায় পাবে? ক্লাস থ্রিতে পড়া মাসুম বাচ্চাটিকে নরপিশাচরা বড় নির্মমভাবে হত্যা করে রাস্তার পাশে ডোবায় লাশ ফেলে গিয়েছিল। আমি যে অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম সেটা আমার সংবর্ধনা সভা ছিল। কিন্তু, সংবর্ধনা সভা পরিণত হয় শোক সভায়। সভাস্থলে উপস্থিত গ্রামের মহিলাদের বুকফাঁটা কান্নায় পরিবেশ ভারি হয়ে উঠেছিল; আমার মতো পাষাণ হৃদয়ও চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। এই হতদরিদ্র, মুসলমান পরিবারের অভাগা সেই শিশুর করুণ কাহিনী কোনো টেলিভিশন চ্যানেলে সবিস্তারে বর্ণনা হতে কি কেউ দেখেছেন? পঞ্চগড়ের দরিদ্র বাবা-মা প্রাণের চেয়ে প্রিয় শিশুটিকে হারিয়ে কেমন করে শোকাতুর জীবন কাটাচ্ছেন আমিও তার খবর রাখিনি। তারা বেঁচে আছেন কিনা তাও জানি না।
ক’দিন আগে ২১ জন নারীকে কয়েকশ’ বীরপুঙ্গব পুরুষ পুলিশ কয়েক ঘণ্টা ‘অপারেশন’ চালিয়ে মগবাজারের এক বাসা থেকে গ্রেফতার করে রমনা থানায় নিয়ে যায়। তাদের কাছ থেকে ‘ভয়ঙ্কর’ সব ইসলামী বইপত্র উদ্ধার করা হয়েছে যা কিনা আওয়ামী পুলিশের দৃষ্টিতে বন্দুক বোমার চেয়েও প্রাণঘাতী। একরাত থানা হাজতে রেখে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত সেই তরুণীদের সিএমএম আদালতে নেয়া হয়। ম্যাজিস্ট্রেট ২০ জনের জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে দু’দিনের রিমান্ড প্রেরণ করেন। মামলা কিন্তু দায়ের হয়েছিল ৫৪ ধারায় যাতে রিমান্ড তো দূরের কথা তত্ক্ষণাত্ জামিন মঞ্জুর হওয়া উচিত ছিল। পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ২০ বছরের কান্তাকে অবশ্য ম্যাজিস্ট্রেট দয়া দেখিয়ে রিমান্ডের পরিবর্তে জেলহাজতে পাঠিয়ে দেন। তবে কান্তাকে ম্যাজিস্ট্রেটের আট তলার এজলাসে সিঁড়ি দিয়ে হাঁটিয়ে, টেনে-হিঁচড়ে ওঠানো এবং নামানো হয়। সিএমএম আদালতে লিফ্ট থাকলেও কান্তাকে সেটা ব্যবহার করতে দেয়া হয়নি। আমি যে বিশেষ ধরনের ক্ষ্যাপাটে কিসিমের মানুষ সে তথ্য তো দেশবাসী শেখ হাসিনার আমলে জেনে গেছেন। এতগুলো নিরপরাধ নারীকে রিমান্ডে পাঠানোর বিষয়টি জানার পর থেকে একটা প্রশ্ন মাথার ভেতরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যে পুলিশ কর্মকর্তা রিমান্ড চেয়েছেন এবং সিএমএম আদালতের যে ম্যাজিস্ট্রেট তা মঞ্জুর করেছেন তাদের এসব দুষ্কর্ম করার সময় কখনও কি নিজ স্ত্রী, বোন অথবা কন্যার কথা মনে পড়ে? চাকরি বাঁচানোর দোহাই দিয়ে বিবেককে কি এভাবে কবর দেয়া সম্ভব? অফিস শেষে নিজগৃহে ফিরে স্ত্রী কিংবা বোন কিংবা কন্যার দিকে তাকানোর সময় তাদের দৃষ্টি কি লজ্জায় নত হয়ে আসে না?
যাই হোক, দু’দিন রিমান্ড শেষে পর্দানশীন ২০ নারীকে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। এদের মধ্যে অনেকের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা চলছে। প্রস্তুতি নেয়ার জন্য তাদের পাঠ্যবই পাঠানো হলেও জেল কর্তৃপক্ষ সেগুলো আটকে দিয়েছে। বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী উভয়ই নারী। সেক্যুলার সরকারের সর্বত্র প্রগতিশীল নারীবাদীরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারপার্সন সুলতানা কামাল অন্য সব ব্যাপারে সরব হলেও এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত মুখ খোলেননি। আর এক মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খানের কাছে মন্তব্যের জন্য আমার দেশ থেকে ফোন করা হলে কথা বলতে শুরু করেও বন্দী নারীরা সবাই জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রী সংগঠনের সদস্য জানা মাত্রই রূঢ় কণ্ঠে বলে উঠেছেন, আমার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। ক্যামেরার সামনে বিচিত্র অঙ্গভঙ্গিতে নাটক করতে পারঙ্গম, মানবাধিকার কমিশনের আওয়ামী চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান লিমনকে নিয়ে কান্নাকাটি করলেও এক্ষেত্রে নীরব। অবশ্য কথা বলেননি, ভালোই হয়েছে। বন্দিনীদের রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে হয়তো নির্লজ্জের মতো বলে বসতেন, মাত্র দু’দিনের রিমান্ড অনেক কম হয়ে গেছে, এখনও ডাণ্ডাবেড়ি কেন পরানো হয়নি, বিনাবিচারে ফাঁসি দেয়া হচ্ছে না কেন, ইত্যাদি, ইত্যাদি। সমাজের এই ভয়াবহ চিত্র চরম ফ্যাসিবাদের লক্ষণ। জার্মানির হিটলার তার নাত্সীবাদী শাসনকালে ইহুদিদের বসবাসের জন্য বস্তির (Ghetto) ব্যবস্থা করেছিলেন, সহজে চেনার জন্য সব ইহুদি নাগরিকের বাহু বন্ধনী (Arm band) লাগানো বাধ্যতামূলক করেছিলেন। সেক্যুলারিজমের নামে বাংলাদেশের নব্য ফ্যাসিস্টরা প্রায় সেদিকেই ধাবিত হচ্ছেন বলেই মনে হচ্ছে।
বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক নাকি মুসলমান ধর্মাবলম্বী! অবস্থাদৃষ্টে এই তথ্যে বিশ্বাস করা ক্রমেই কষ্টকর হয়ে উঠছে। আরবি নামে কেউ পরিচিত হলেই তাকে কি মুসলমান বলা যাবে? আরবে নাম শুনে কারও ধর্ম বিশ্বাস সম্পর্কে ধারণা করা কঠিন। খ্রিস্টান, ইহুদি, মুসলমানদের প্রায় কাছাকাছি নাম। লেবাননের প্রখ্যাত দার্শনিক, লেখক, কবি, চিত্রকর কাহলিল জিবরানকে দীর্ঘদিন আমি মুসলমান বলেই জানতাম। প্রায় বুড়ো বয়সে আমার সেই ভুল ভেঙেছে। বাংলাদেশেও প্রকৃত মুসলমানরা নীরবে সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছেন কিনা সেটা জানার জন্য বোধহয় সমীক্ষার সময় এসেছে। ফেরদৌস, নুর, শরীফ, কবীর, আলী, আহমেদ, হক, রহমান ইত্যাদি নামের আড়ালে কারা লুকিয়ে আছেন কে জানে?
ইমেইল : admahmudrahman@gmail.com

মঙ্গলবার, ২৭ নভেম্বর, ২০১২

গাজায় আগ্রাসন : ফিলিস্তিনের বোঝা ও সমঝোতার ওঝা


মীযানুল করীম
তারিখ: ২৮ নভেম্বর, ২০১২
গাজায় আগ্রাসন
হাজার হাজার ফিলিস্তিনি গাজার রাস্তায় আনন্দ উৎসবে মেতে উঠেছে। শিশু-কিশোর-যুবকেরা উল্লাসে হর্ষধ্বনি দিচ্ছে। কেউ কেউ দেখাচ্ছে বিজয়চিহ্ন ‘ভি’। এই দৃশ্য গাজা ভূখণ্ডের, যেখানে এবার ইসরাইল আবার ব্যাপক হামলা চালিয়ে হত্যা ও ধ্বংসের মহোৎসবে মেতে উঠেছিল। তার অবসানেই ফিলিস্তিনিদের এই স্বস্তি ও আনন্দ। টিভিতে ও পত্রপত্রিকায় তাদের বিষাদ-বেদনার ছবিও তুলে ধরা হয়েছে। বিবিসি টিভিতে দেখা যায়, বয়স্ক গাজাবাসী কোলাকুলি করছেন। তবে মুখে ঈদের হাসি নয়, দুঃখ ও উদ্বেগ। পাশেই ইহুদিবাদী আগ্রাসনে বিধ্বস্ত বড় বড় ভবন। এএফপি হামাস সদর দফতরের ছবি দিয়েছে। দেখা যাচ্ছে, সেখানে বিরাট দেয়ালজুড়ে রণাঙ্গনের ছবি আঁকা। পাশেই রাস্তা থেকে সরানো হচ্ছে এই সদর দফতর ভবনের ধ্বংসস্তূপ। ইসরাইল এখানেও ভয়াবহ হামলা চালিয়েছে। তাদের নৃশংসতায় চিরতরে হারিয়ে গেছে বহু শিশু-কিশোর। একটি ছবিতে গাজার এক শিশুর হাতে ফিলিস্তিনের প্রিয় পতাকা, চোখে অপার বেদনার অরোধ্য অশ্রু। স্বজন হারানো কচি মেয়েটির বুকের ওপর একটি পোস্টারে রয়েছে তার আপনজনের ছবি। এর ওপর কিছু কথা আরবিতে লেখা। সম্ভবত কুরআন শরিফের বাণীও আছে এর মধ্যে।
এ সব কিছুই গাজায় আট দিনের সর্বাত্মক হামলা থেমে যাওয়ার পরবর্তী দৃশ্য। ২১ নভেম্বর পর্যন্ত ইসরাইলি হামলায় ১৬৭ জন নিহত হয়েছে। হানাদার ইহুদি বাহিনীর পৈশাচিকতার বলি হয়েছে প্রধানত শিশু ও নারীসহ নিরীহ মানুষ। এতে মাত্র পাঁচ ইসরাইলি প্রাণ হারিয়েছে। বাকিরা সবাই ফিলিস্তিনি। ফিলিস্তিনিদের ভবন ও স্থাপনা মিলিয়ে সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি বিপুল। ২১ তারিখ রাত ১টায় যুদ্ধবিরতির সমঝোতার ঘোষণা দেয়া হয়। মিসরীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ কামাল আমর সংবাদ সম্মেলনে বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তার পাশে ছিলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি কিনটন।
স্মর্তব্য, ফিলিস্তিনের বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ড গাজার ১৫ লাখ মানুষের ওপর ইসরাইল ছয় বছর ধরে বেআইনি অবরোধ চাপিয়ে রেখেছে। ফলে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে গাজাবাসী। এর মধ্যে ২০০৮ সালে ইসরাইল ভয়াবহ হামলা চালিয়ে গাজাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল। তখন প্রাণ ও সম্পদের ক্ষতি হয় অপরিমেয়। এমনকি রাসায়নিক অস্ত্রও ব্যবহার করেছে ইসরাইল। তাই আজো গাজায় জন্ম নিচ্ছে পঙ্গু শিশু।
গাজার ব্যাপারে ইসরাইল ও ফিলিস্তিন শর্তসাপেক্ষে সমঝোতায় এসেছে। চারটি শর্ত ইসরাইল আর দু’টি শর্ত ফিলিস্তিনের বেলায় প্রযোজ্য। শর্ত হলো, ইসরাইল (১) নৌ, স্থল বা আকাশপথে গাজা উপত্যকায় কোনো প্রকার আগ্রাসন চালাবে না। (২) সীমান্তে কোনো গুলিবর্ষণ করবে না। (৩) ফিলিস্তিনি নেতাদের ‘পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড’ ঘটাবে না। (৪) যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই এই উপত্যকার সব ক্রসিং খুলে দেবে। গাজায় লোকজনের যাতায়াত কিংবা পণ্য আনা-নেয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা সৃষ্টি করতে পারবে না। অন্য দিকে ফিলিস্তিনিরা (১) ইসরাইলের দিকে মিসাইল ও রকেট ছুড়বে না। (২) সীমান্তে ইসরাইলি নাগরিকদের ওপর হামাস সরকার হামলা চালাবে না।
সম্প্রতি হামাস সামরিক বিভাগ প্রধান আহমদ জাবারিকে এমন একসময়ে হত্যা করা হয়, যখন গাজায় উত্তেজনা ছিল না। বরং ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীর ভূমিকায় মনে হচ্ছিল, তারা গাজায় নয়, গৃহযুদ্ধ-জর্জরিত সিরিয়া সীমান্তে হামলা চালাবেন। তাই গাজায় তখন স্বস্তিপূর্ণ স্বাভাবিক পরিস্থিতি। জাবারি সামরিক তৎপরতায় নিয়োজিত থাকাকালে নিহত হননি। এবার যুদ্ধবিরতি চুক্তির যে চারটি শর্ত ইসরাইলের ওপর প্রযোজ্য, এর তৃতীয় শর্ত হলোÑ তারা ফিলিস্তিনি নেতাদের ‘পরিকল্পিতভাবে’ হত্যা করবে না। বিশেষত জাবারির হত্যাকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে এটা উল্লেখ করা হয়েছে। ইসরাইলি কলামিস্ট উরি আভনারির ভাষায়, পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের ইসরাইলি নাম ‘টার্গেট করা প্রতিরোধ’ অথবা ‘উচ্ছেদ’। এই আইটেম অলিম্পিকে থাকলে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, মোসাদ শিনবেত সোনার মেডেল পেত বলে আভনারি লিখেছেন। জাবারির ‘অপরাধ’ ইসরাইলি সৈন্য গিদ শালিতকে পাঁচ বছর লুকিয়ে রাখার পেছনে তিনিই। অথচ শালিতের মুক্তির মধ্যস্থতাকারী গেরশন বাসকিন জাবারি হত্যার পরদিনই জানালেন, এই হামাস নেতা দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধবিরতি চেয়েছেন। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তার সাথে বাসকিনের যোগাযোগও ছিল।
মার্কিন মতলব ও মিসরের মুরসি
মাত্র কয়েক মাস আগে নির্বাচিত মিসরীয় প্রেসিডেন্ট ড. মোহাম্মদ মুরসি গাজায় যুদ্ধবিরতির নায়ক হিসেবে আখ্যা পেয়েছেন। তিনিই সবার আগে উদ্যোগ নেন, যাতে ইসরাইল ও হামাস অবিলম্বে সমঝোতায় উপনীত হয়ে অস্ত্রসংবরণ করে। মুরসি কয়েক দফা বৈঠক করেন উভয় পক্ষের সাথে। তবে প্রত্যাশিত সময়ের এক দিন পরে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়েছে। তবুও তিনি সন্তুষ্ট এবং দুই পক্ষের কাছে এ জন্য কৃতজ্ঞ বলে জানান। গাজায় হামলা বন্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব তার সহায়ক ভূমিকা রেখেছেন। বড়জোর কিছুটা ত্বরান্বিত করেছেন যুদ্ধবিরতিকে। মিসরের এ অবস্থানে ব্যক্তি হিসেবে মুরসির গ্রহণযোগ্যতা এবং দেশ হিসেবে মিসরের মর্যাদা বেড়েছে। তা ছাড়া ব্রাদারহুডকে যারা ইসরাইলের চরম বিরোধী ‘কট্টরপন্থী’ মনে করেন, তাদের ধারণা বদলানোর মতো অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। গাজায় শান্তি স্থাপনে মিসর ভবিষ্যতেও কাণ্ডারির ভূমিকা নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এবারকার যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে বিবদমান দুই পক্ষের পালনীয় মোট ছয়টি শর্তের উল্লেখ আছে।
কিন্তু ইসরাইল চুক্তি স্বাক্ষর করার পর দুই দিন না যেতেই গাজা সীমান্তে গুলি চালিয়ে একজন ফিলিস্তিনিকে হত্যা এবং নয়জনকে আহত করে। এমন একটা ঘটনা সত্ত্বেও ইসরাইলের দাবি, এর মাধ্যমে অস্ত্রবিরতি চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করা হয়নি। তবে এ ঘটনায় চুক্তির স্থায়িত্ব ও বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
গাজায় ইসরাইলি ধ্বংসযজ্ঞের ঘটনায় মার্কিন ডাবল স্ট্যান্ডার্ড বা দুই মুখো নীতি আবার প্রকটভাবে উন্মোচিত হয়েছে। ওবামা নিজেকে শান্তিকামী ও অনাগ্রাসী হিসেবে তুলে ধরেছেন এবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারাভিযানে। ইরানে হামলার ব্যাপারে ইসরাইলসহ ইহুদি লবির সাথে ভিন্ন মত পোষণ করে ওবামা নিজের ইতিবাচক ইমেজ গড়ে তুলেছিলেন, বিশেষ করে মুসলিম ভোটারদের মাঝে। অপর দিকে, তার প্রতিদ্বন্দ্বী মিট রমনি ইহুদিদের দরদি হিসেবে অভিযোগ আনলেন, ‘ওবামা আমাদের বিশ্বস্ত মিত্র ইসরাইলের পাশে দাঁড়াচ্ছেন না।’ সেই ওবামা নির্বাচনে জিতে দ্বিতীয়বার কর্ণধার হলেন বৃহত্তম বৃহৎ শক্তির। এরপরই কালো মানুষটির মুখে ভালো ভালো কথাগুলো আর শোনা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত একটা কথা, ‘গাঙ পার হলে নাইয়া শালা’। নির্বাচনের কয়েক দিন পর এবং ইসরাইল যখন গাজায় আবার আগ্রাসনের প্রস্তুতি শেষ করে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, তখন বারাক ওবামা বললেন, ‘ইসরাইলেরও বাঁচার অধিকার আছে।’
আজ যদি ইসরাইল এমন কোনো রাষ্ট্রের নাম হতো যে নিরীহ, শান্তিপ্রিয়, দুর্বল ও বিপন্ন; বলদর্পী আগ্রাসী শক্তি যাকে আক্রমণ করছে, তাহলে ওবামার এ কথাটি যুক্তিযুক্ত হতো। ইসরাইল পারমাণবিক শক্তিধর দেশ, যে শক্তি কোনো আরব দেশের নেই। এমনকি ইরানেরও নেই এই বোমা। অথচ সেটা ইহুদি রাষ্ট্রটি অনেক আগেই বানিয়েছে এবং তা সম্ভব করেছে ওবামার দেশ যুক্তরাষ্ট্রই। ইসরাইলের অন্যায় প্রতিষ্ঠা ফিলিস্তিনিদের সহিংসভাবে উচ্ছেদ করে। তার নারকীয় আগ্রাসনের শিকার হয়েছে লেবানন। এখনো তার দখলে জর্ডানের একাংশ। ইসরাইলি হামলায় ধ্বংস হয়েছে ইরাক-সিরিয়ার পরমাণু স্থাপনা। তার মিসাইল হাজার মাইল দূরের মুসলিম রাষ্ট্রেও ধ্বংস ঘটাতে সক্ষম। ইসরাইল চরম বর্ণবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা এবং সম্প্রসারণবাদ ও আধিপত্যবাদের প্রতীক ও প্রতিভু। এমন একটি অপরাষ্ট্রশক্তিকে ওবামা মূলত মদদ দিলেন গাজায় আবার ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যা ঘটাতে। ওবামা তো জানেন, ১৯৮২ সালে লেবাননে ফিলিস্তিনিদের সাবরা ও শাতিলা শিবিরে ইসরাইলের গণহত্যাযজ্ঞ আধুনিক বিশ্বের নজিরবিহীন কলঙ্ক।
আর ওবামার পররাষ্ট্রমন্ত্রী অর্থাৎ মার্কিন সরকারে ওবামার পরই যার অবস্থান, সেই হিলারি গাজা ইস্যুতে অবতীর্ণ হলেন ‘হিলার’ (Healer) বা নিরাময়কারিণীরূপে। শান্তিদূতীর সে কী দৌড়ঝাঁপ! তিনি ইসরাইল গেলেন কয়েক দিনের ভয়াবহ হামলায় গাজা বিধ্বস্ত হওয়ার পর, এর আগে নয়। মিডিয়ায় ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট আব্বাসের আশাবাদ দেখা গেল, ‘হিলারির এই সফরকালেই গাজায় হামলা বন্ধ হবে।’ অর্থাৎ ‘শান্তির দেবী’ ছাড়া কেউ ইসরাইলকে শান্ত করতে পারবে না। আমেরিকা ফিলিস্তিনিসহ আরব বিশ্ব এবং অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রকেও বোঝাতে চেয়েছে যে, “ফিলিস্তিনে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং এই ইস্যুর ‘সুরাহা’র জন্য ওয়াশিংটনের দ্বারস্থ না হয়ে উপায় নেই। অতএব, স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের খায়েশ ছেড়ে আমেরিকার কথা মতো ইসরাইলের আবদারগুলো মেনে নাও।” ফিলিস্তিন প্রশ্নে আমরা বারবার দেখছি, যুক্তরাষ্ট্র ‘সর্প হইয়া দংশন করে, ওঝা হইয়া ঝাড়ে।’

আমেরিকা শান্তিপ্রয়াসের নামে বহু দিন ধরে ইসরাইলকে সুযোগ দিচ্ছে অশান্তি জিইয়ে রাখার। এবার গাজায় (আপাত) শান্তি আনার কৃতিত্ব নিতে চেয়ে ওবামা-হিলারি ধাক্কা খেলেন মিসরের মুরসির কারণে। বিশ্ব দেখেছে, মিসর এবার সত্যিকার আঞ্চলিক মুরব্বির ভূমিকা সাফল্যের সাথে পালন করেছে। মার্কিন বশংবদ মোবারকের আমলে যা সম্ভব হয়নি, তা হলো ইসলামপন্থী ব্রাদারহুড নেতার এই আমলে। মিসরের এই প্রশংসনীয় ভূমিকায় তুরস্ক ও মালয়েশিয়ার মতো প্রভাবশালী মুসলিম রাষ্ট্র আঞ্চলিক সঙ্কটে মধ্যস্থতা করার আরো প্রেরণা পাবে আশা করা যায়।
আজকের হামাস : অতীতের প্রেক্ষাপট
গাজার নিয়ন্ত্রণ হামাসের হাতে। তারা এটা জবরদখল করেনি। সেখানকার শুধু নয়, ‘ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ’-এর আওতাধীন পশ্চিম তীরসহ গোটা এলাকায় হামাস নির্বাচনে গণরায় পেয়েছিল দেশ শাসনের। কিন্তু বাইরের ইহুদি মার্কিন চক্রান্ত আর ভেতরে মাহমুদ আব্বাসদের বিদ্বেষ-বৈরিতার দরুন হামাস ফিলিস্তিনিদের সরকার পরিচালনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলো। গণতন্ত্রের প্রবক্তা আমেরিকা এবং তার নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দুনিয়ার কাছে অসৎ, অযোগ্য, দুর্নীতিবাজ, আপসকামী আল ফাতাহ তথা পিএলও নেতারা হামাসের সৎ, যোগ্য, জনসেবক, আদর্শবাদী নেতৃত্বের চেয়ে অনেক বেশি প্রিয়। কারণ, মাহমুদ আব্বাস গং সেক্যুলার এবং ইসরাইল-আমেরিকাকে তোয়াজ করে চলে। অপরদিকে ইসমাইল হানিয়ারা ইসলামি জীবনব্যবস্থায় একনিষ্ঠ আস্থাবান এবং সে কারণে ইহুদিবাদ ও এর মুরব্বিদের কাছে নতজানু হতে নারাজ। তাই ইসরাইল হামাসকে ফিলিস্তিন মুক্তি সংগ্রামের অনমনীয় শক্তি মনে করে তাদের টার্গেট করেছে হত্যা, ধ্বংস ও নির্যাতনের। হামাসের তুলনায় আব্বাস ও তার পিএলও ইসরাইলের কাছে অনেক কম বিপজ্জনক এবং আমেরিকার কাছে অনেক বেশি পছন্দের। ইসরাইলের উপলব্ধি, ইহুদিবাদের সর্বপ্রধান দুশমন ইসলাম, আর হামাস এর চেতনায় উজ্জীবিত। যুক্তরাষ্ট্রের যুক্তি, হামাস মৌলবাদী আর পিএলও সেক্যুলার। তাই হামাস যাতে কোনো দিন ফিলিস্তিন জনগণের মূল নেতৃত্বরূপে প্রতিষ্ঠিত ও স্বীকৃত হতে না পারে, সেজন্য ওয়াশিংটন-তেল আবিব চেষ্টার ত্রুটি করছে না।
হামাস নিয়ে আমার স্মৃতি থেকে কিছু কথা বলছি। সম্ভবত ১৯৮৭ সালের শেষ দিকে হামাস গঠিত হয়। তবে এর নাম প্রথম দু-এক বছর বাংলাদেশে প্রায় অজানা ছিল। কারণ তখনো এর সংগঠন গড়ে তোলার প্রক্রিয়া চলছিল এবং বাইরের প্রকাশ্য তৎপরতা তেমন শুরু হয়নি। ১৯৮৮ সালে একজন সিনিয়র সাংবাদিক জানান, ইয়াসির আরাফাতের আল ফাতাহর পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের আরেকটি মুক্তিসংগ্রামী সংগঠন যাত্রা করেছে। তারা ইসলামি আদর্শে আস্থাবান এবং আপসকামিতার বিরোধী। হামাসের সমর্থক ছিলেন বাংলাদেশে অধ্যয়নরত ফিলিস্তিনি ছাত্রদের মাঝেও। তাদের একজন সংগঠক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। তার সাথে আলাপে হামাস তথা ফিলিস্তিনের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারি। অন্যদের মতো আমার কাছেও ‘হামাস’ নামটি ছিল একেবারে নতুন। ওই ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থী জানিয়েছিলেন, আসলে এটা হলো সংগঠনটির পুরো নামের সব ক’টি শব্দের আদ্যাক্ষরের সমষ্টি। তখন ঢাকায় হামাসের বাংলা লিফলেট বিভিন্ন স্থানে মসজিদে জুমার নামাজ শেষ হওয়ার পর বিলি হয়েছিল প্রচারকাজের অংশ হিসেবে। হামাস কিন্তু ইয়াসির আরাফাত এবং তার সংগঠনবিরোধী বক্তব্য তখন দিত না। বরং শুধু ইহুদিবাদী আগ্রাসন প্রতিরোধ এবং বায়তুল মুকাদ্দাস উদ্ধারে ইসলামি চেতনার ওপর জোর দেয়া হতো। ১৯৮৮ সালে ফিলিস্তিনে হামাসের তৎপরতা শুরুর কিছু দিনের মধ্যেই ঐতিহাসিক ইনতিফাদার সূচনা হওয়া খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
এর আগের এক দশকে ফিলিস্তিনি মুক্তিসংগ্রামের মূল ধারা অর্থাৎ আরাফাতের ‘ফাতাহ’সহ পিএলও কিছুটা আপসকামী হয়ে পড়েছিল। এর পেছনে বিশেষ ভূমিকা ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। এ দিকে ইসরাইলি দখলদারি ও দমননীতি ছিল অব্যাহত। ফলে ফিলিস্তিনিদের মাঝে ক্ষোভ বাড়ছিল এবং অবিসংবাদিত নেতা ইয়াসির আরাফাতের প্রতি আস্থা হ্রাস পাচ্ছিল। যে কারণেই হোক, পিএলওর মূল সংগঠন ফাতাহর আগের সেই লড়াকু মনোভাব আর ছিল না। আরাফাত রণনীতির বদলে কূটনীতি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। মার্কিন উদ্যোগে ‘শান্তিপ্রয়াস’-এর পরিকল্পিত প্রহসন মঞ্চস্থ হচ্ছিল মাঝে মধ্যে। এই প্রেক্ষাপটে রেডিক্যাল হামাসের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ফিলিস্তিনি জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার এবং ইসরাইলি আগ্রাসন মোকাবেলার প্রশ্নে হামাসের বক্তব্য ছিল একই সাথে বলিষ্ঠ ও ঝুঁকিপূর্ণ। তাদের আবির্ভাবে এই ইঙ্গিত ছিল যে, ভবিষ্যতে ফাতাহ বা পিএলও যেমন ফিলিস্তিনিদের একক প্রতিনিধিত্ব করতে পারবে না, তেমনি আরাফাতের পরবর্তী বা বিকল্প নেতৃত্বও গড়ে উঠতে পারে। কৌশলী আরাফাত হামাসের সাথে প্রত্যক্ষ দ্বন্দ্বে লিপ্ত না হয়ে মোটামুটি সহাবস্থান বজায় রেখেছিলেন।
ফিলিস্তিনের সংগ্রাম : জানা-অজানা কথা
১৯৪৮ সালে ইঙ্গ-মার্কিন ষড়যন্ত্র ও সোভিয়েত মদদে অবৈধ ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্ম ‘মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া’ হিসেবে। এর পরপরই ফিলিস্তিনি তথা আরবদের সাথে ইহুদিদের যুদ্ধ বেধে যায়। এটা ফিলিস্তিনিদের কাছে ‘নাকবা’ নামে পরিচিত। পাশ্চাত্যের চক্রান্তে ইসরাইল এই বিরোধিতা কাটিয়ে উঠে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে থাকে। লাখ লাখ ফিলিস্তিনি হাজার বছরের ভিটেমাটি হারিয়ে আশপাশের দেশে উদ্বাস্তু হতে বাধ্য হয়। পরে ১৯৬৫ সালে গঠিত হয় ফিলিস্তিনি মুক্তি সংস্থা (পিএলও)। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ৩২ বছরের এক প্রকৌশলী, যার ছদ্মনাম আবু ইয়াম্মার। কিছুটা শ্মশ্রুশোভিত, ‘কাফিয়া’ দিয়ে মস্তকাবৃত, ছোটখাটো মানুষটির প্রকৃত নাম ইয়াসির আরাফাত। পিএলও মোর্চায় তার আল ফাতাহর সাথে বামপন্থী একাধিক সংগঠন ছিল। ফাতাহ তখন কিছুটা ইসলামি মনোভাবাপন্ন জাতীয়তাবাদী সংগঠন। পিএলওর গেরিলা তৎপরতার মাঝে ১৯৬৭ সালের জুন মাসে আরব-ইসরাইল যুদ্ধ বাধে। এতে মিসর, জর্ডান ও সিরিয়ার বিশাল ভূখণ্ড ইসরাইল দখল করে নেয়। এমনকি মুসলিম উম্মাহর পয়লা কিবলা বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত ইহুদিদের কুক্ষিগত হয়ে যায়। আরবদের শোচনীয় পরাজয়ের একটা বড় কারণ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের শঠতা। বহুলালোচিত নাসেরের শাসিত মিসর আর বাথ পার্টির শাসিত সিরিয়া তখন সমাজতন্ত্রের নেশায় সোভিয়েত প্রেমে বুঁদ হয়ে ছিল। এসব দেশকে মস্কোর দেয়া সমরাস্ত্র ওই যুদ্ধে অকার্যকর প্রমাণিত হওয়ায় ফিলিস্তিনিসহ আরবদের অনেকের মোহভঙ্গ ঘটে। তারা উপলব্ধি করেন, পুঁজিবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের প্রত্যক্ষ মদদগার, আর সমাজবাদী সোভিয়েত মহারাষ্ট্র ওদের পরোক্ষ দোসর। যুদ্ধের পরাজয় মিসরের প্রেসিডেন্ট নাসেরের আমৃত্যু হতাশা এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদুল হাকিম আমরের আশু আত্মহত্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তখন আরাফাতের আল ফাতাহ সোভিয়েত সমর্থক মহল, তথা বামপন্থীদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখত। ১৯৬৯ সালে ফাতাহ নেতা আবু মুনিরের তদানীন্তন পাকিস্তান সফরকালে সমাজতন্ত্রীদের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কথা অনেকের স্মরণে থাকার কথা। অবশ্য, পরবর্তী দুই দশকে সেই ফাতাহ ও এর নেতা আরাফাত বেশ কিছুটা সেকুলার হয়ে পড়ায় ইসলামপন্থীদের মনে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়। তা ছাড়া, আরাফাতকে ‘উদার’ এবং ইসলামপন্থীদের ‘উগ্রপন্থী’ হিসেবে চিত্রিত করার প্রয়াস দীর্ঘ দিন চলেছিল।
যে ইসরাইল ’৬৭ সালের যুদ্ধে সম্মিলিত আরব সমর শক্তিকে নাস্তানাবুদ করে পশ্চিম তীর, গাজা, সিনাই, গোলান দখল করে নিয়েছিল, ’৮৯ সালের ইনতিফাদা তার মহাউদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ‘ইনতিফাদা’ মানে গণজাগরণ বা গণ-অভ্যুত্থান। নবগঠিত হামাস এর নেপথ্যে বিরাট ভূমিকা রেখেছিল। এটা ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র ভালো করেই জানত। ইনতিফাদা চলতে থাকে বছরের পর বছর। এ অবস্থায় হামাসকে ইসরাইল টার্গেট করে নিধন ও নির্মূল করার জন্য। মোসাদ ও সিআইএ বুঝতে পেরেছিল, অবিলম্বে প্রচণ্ড আঘাত না হানলে উদীয়মান হামাস ভবিষ্যতে অপ্রতিরোধ্য হয়ে দাঁড়াবে। তাই নীলনকশা মোতাবেক এর প্রধান নেতা এবং আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব শায়খ আহমদ ইয়াসিনকে ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে হত্যা করা হয়। আশীতিপর ইয়াসিন ছিলেন চলচ্ছক্তিরহিত। ফজরের নামাজের সময় মসজিদের কাছে তিনি নিহত হন। তার উত্তরসূরি আবদুল আজিজ রানতিসিকে একই বর্বরোচিত পন্থায় হত্যা করা হলো মাত্র এক মাসের ব্যবধানে। এই পটভূমিতে হামাসের জনপ্রিয়তা বেড়ে গেল ফিলিস্তিনিদের মাঝে। অপর দিকে ‘বৃদ্ধ সিংহ’ আরাফাত ক্রমশ নিস্তেজ হওয়া ছাড়াও ‘পাশ্চাত্যপন্থী’ হিসেবে অভিহিত হতে থাকেন। এমনতরো পটভূমিতেই ফিলিস্তিনিদের প্রথমে স্থানীয় সরকার, পরে জাতীয় সরকার নির্বাচনে হামাসের অভাবনীয় সাফল্য এবং এর কিছু পরে হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজায় ইসরাইলের নারকীয় হামলা ও হত্যাযজ্ঞের ঘটনা মূল্যায়ন করতে হবে।
যুদ্ধবিরতি শান্তির গ্যারান্টি নয়
গাজায় তো যুদ্ধবিরতি হলো। সে জন্য সমঝোতা চুক্তি হয়েছে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে। সবাই জানে, গাজায় এবার যেভাবে যুদ্ধ শুরু হলো, তা কোনো বিচ্ছিন্ন বা আকস্মিক কিংবা নতুন ঘটনা নয়। বহু বছরের সঙ্কট ও সঙ্ঘাতের একটি ুদ্র অংশ মাত্র। গোলাগুলি, মিসাইল-মারণাস্ত্রের মহাতাণ্ডব থেমে যাওয়ায় সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। কিন্তু এবারের হামলা-পাল্টাহামলাই কি গাজার শেষ লড়াই কিংবা ইসরাইলের সর্বশেষ আগ্রাসী আক্রমণ? কেউ তা মনে করে না। অতীত অভিজ্ঞতা ইহুদিবাদী শক্তিকে মহাষড়যন্ত্রকারী, শান্তির শত্রু ও ধ্বংসের প্রতীক হিসেবেই চিনতে শেখায়। সেই ইসরাইলের যদি সুমতি হয়, সবার মঙ্গল। আর যদি পালন নয়, লঙ্ঘনের মতলবে যুদ্ধবিরতি চুক্তি করে থাকে, তাহলে গাজাবাসীই শুধু বিপন্ন হবে না, নিজেদেরও বিপদ ডেকে আনবে। এবার একটি আরব ও মুসলিম রাষ্ট্রের ইসলামপন্থী রাষ্ট্রপ্রধানের সমঝোতা-উদ্যোগে সাড়া দেয়ায় ইসরাইলের ব্যাপারে শান্তিকামীদের যতটুকু আশা জেগেছে, তারা এটাকে ধুলায় মিশিয়ে না দিক, সর্বান্তকরণে এটাই আমাদের কামনা।
এ তো গেল আশাবাদের কথা। এর বিপরীতে হতাশার হেতুও কম নয়। গাজায় রসায়নশাস্ত্রের Chain Reaction- এর মতো ধারাবাহিকভাবে (যদিও মাঝে বিরতি থাকে) ‘ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া-পাল্টা প্রতিক্রিয়াÑ আবার প্রতিক্রিয়া-পুনরায় প্রতিক্রিয়া’, এসব ঘটতে থাকে দুই পক্ষের মাঝে। বছরের পর বছর এভাবে চলে আসছে। ইসরাইলের প্রখ্যাত শান্তিবাদী পার্লামেন্টারিয়ান ও আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত কলামিস্ট উরি আভনারি ওই বিষয়টি তুলে ধরে এবার তার কলাম শুরু করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, এবার যে বড় ঘটনার পর গাজা সীমান্ত বেশি তপ্ত হয়েছে, হামাস কমান্ডার আহমদ জাবারির সেই হত্যাকাণ্ড হঠাৎ ঘটেনি। ইসরাইল তাকে টার্গেট করেছিল আগেই। তার মতো দক্ষ ও চৌকস সেনানায়ককে খুনের জন্য যাবতীয় গোয়েন্দা তথ্য জোগাড় করে হত্যার সুযোগের অপেক্ষায় ছিল ইসরাইল।
একজন ইহুদি হয়েও উরি আভনারি তীব্র সমালোচনা করলেন গাজায় ইসরাইলি অপারেশন পিলার অব কাউড (মেঘের স্তম্ভ)-এর। হামাস প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘The real remedy is peace. Peace with the Palestinian people. Hamas has already solemnly declared that it would respect a peace agreement concluded by the PLO¾ i.e. Mahmud Abbas¾ that would establish a Palestinian state along with 1967 borders, provided this agreement were confirmed in a Palestinian referendum. Without it, the bloodletting will just go on, round after round forever.’ (এ সঙ্কটের প্রকৃত প্রতিকার শান্তির মাঝে নিহিত। সে শান্তি ফিলিস্তিনি জনগণের ক্ষেত্রে। হামাস ইতোমধ্যেই গুরুত্বের সাথে ঘোষণা করেছে, তারা পিএলওÑ উদাহরণস্বরূপ মাহমুদ আব্বাস কর্তৃক সম্পাদিত শান্তিচুক্তির প্রতি সম্মান জানাবে, যার মাধ্যমে ১৯৬৭ সালের সীমান্ত বরাবর ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে। শর্ত হলো, ফিলিস্তিনিরা গণভোটে এর অনুমোদন দেবে। এটা ছাড়া শুধু রক্তপাতই অব্যাহত থাকবে, এক পালার পর অন্য পালা। এভাবে চিরদিন।
সবই শান্তি চায় ফিলিস্তিনে। এই ইস্যু শুধু মধ্যপ্রাচ্যে নয়, আধুনিক বিশ্বে অশান্তির সবচেয়ে বড় কারণ এবং বিদ্যমান আন্তর্জাতিক সঙ্কটগুলোর মধ্যে সর্বাধিক দীর্ঘস্থায়ী। বাস্তবতা হলো, ইসরাইল না চাইলে শান্তি আসবে না। গাজায় একের পর এক খোঁড়া অজুহাতে সর্বাত্মক আগ্রাসন এবং নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসতাণ্ডব চালিয়ে কি শান্তি কামনার প্রমাণ দেয়া যায়? ইসরাইলের মানবাধিকার সংগ্রামী উরি আভনারির প্রশ্ন : শান্তিই সঙ্কটের সমাধান। কিন্তু ‘মেঘের স্তম্ভ’ অপারেশনের মেঘ দৃষ্টিশক্তি ঢেকে দিলে কেউ কি শান্তির পথটি দেখতে পাবে?

দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানেই শান্তি নিহিত



ইসরায়েল-ফিলিস্তিন
 হারলেম ব্রান্ডল্যান্ড জিমি কার্টার
সম্প্রতি ইসরায়েলে পরিচালিত রকেট হামলা ও গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলার ঘটনায় পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, মধ্যপ্রাচ্যে বিরাজমান পরিস্থিতি ইসরায়েল বা ফিলিস্তিন কারও জন্যই মঙ্গল বয়ে আনবে না। বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে আলোচনা শুরু হওয়ার সম্ভাবনাও তেমন নেই বললেই চলে। বর্তমান পরিস্থিতির মোড় ঘোরানোর জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করার প্রয়োজন পড়বে। আমরা প্রবীণরা মনে করি, জাতিসংঘে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতির উদ্যোগের মুহূর্তটি সে ধরনের একটি সুযোগ। ২৯ নভেম্বর জাতিসংঘে ফিলিস্তিনকে 'অসদস্য পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র মর্যাদা'দানের ওপর ভোটাভুটি হবে। এতে ফিলিস্তিনের সত্তার পর্যায় থেকে মর্যাদা উচ্চমাত্রায় লক্ষণীয়ভাবে উন্নীত হবে। আমরা এর পক্ষে ভোট দেওয়ার জন্য প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানাই।
জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে গিয়ে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস নিশ্চয়ই কোনো প্ররোচনামূলক বক্তব্য দেবেন না। তিনি বিশ্বাস বা আস্থা নষ্ট হওয়ার মতো কিছু করা থেকে যেমন বিরত থাকবেন, তেমনি প্রত্যাশা অনুযায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা থেকে সরে আসবেন না।
এই ভোট অবশ্যই আইনের শাসন ও মানবাধিকারের পক্ষে। টেকসই ও ইসরায়েলের প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতির পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও বাদবাকি বিশ্বের যে দশকের পর দশক ধরে অঙ্গীকার তার সঙ্গে এটা পুরোপুরি সাযুজ্যপূর্ণ। এটা জাতিসংঘের অতীতে নেওয়া প্রস্তাবগুলো ও আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ একটি আইনসম্মত, শান্তিপূর্ণ ও কূটনৈতিক উদ্যোগ। যদিও এটা স্পর্শকাতর ভোট, তবুও অনেক রাষ্ট্র এ সময় হয় অনুপস্থিত থাকতে পারে অথবা বিরুদ্ধে ভোট প্রদান করতে পারে। আর এই প্রস্তাব যদি ভোটে হেরে যায়, তাহলে দুই রাষ্ট্র তত্ত্বের মৃত্যু হবে এবং তখন আমরা এক রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের দিকে ধাবিত হবো। আর এটা হবে একটা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত পরিস্থিতি এবং এর ফলে ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি উভয়ের জন্যই বিপর্যয়কর পরিণতি বয়ে আনবে।
এক রাষ্ট্র ফলাফলের পরিণতি কেমন হতে পারে তা আমরা অনুমান করে নিতে পারি। এর একটা অর্থ হতে পারে, ইসরায়েল পুরো পশ্চিম তীর দখল করে ফিলিস্তিনিদের ইসরায়েলিদের সমান ভোটাধিকার প্রদান করবে। তখন তো ইসরায়েলিরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হবে। অথবা এমন হতে পারে যে, ইসরায়েলিরা ফিলিস্তিনিদের সমানাধিকার দিল না। এ ধরনের একটা পরিস্থিতি ফিলিস্তিন বা ইহুদি জনগোষ্ঠী কারও কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে না এবং বিশেষ করে ফিলিস্তিনিদের জন্য মর্যাদাকরও হবে না। এতে কোনো পক্ষেরই নিরাপদ নিজ আবাসভূমির স্বপ্ন পূরণ হবে না। বিশেষ করে ইহুদি জনগোষ্ঠীর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে না।
অন্যদিকে, জাতিসংঘে ফিলিস্তিনিকে রাষ্ট্র মর্যাদাদানের পক্ষে ভোট দিয়ে একে জয়যুক্ত করলে বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ এবং এমনকি সাধারণ ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিরাও সমস্বরে একে স্বাগত জানাবে। দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানই হলো মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার নিশ্চিত পথ। মাস দুই আগে আমরা একত্রে পূর্ব জেরুজালেমের জলপাই পাহাড়ে ওগস্তা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হাসপাতালের মাঠে দাঁড়িয়েছিলাম। এই মেডিকেলটি ফিলিস্তিনিদের একটি চমৎকার ক্যান্সার চিকিৎসা কেন্দ্র এবং এটি পশ্চিম তীর থেকে কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত। তবে এই হাসপাতালে ফিলিস্তিনিদের চিকিৎসা সেবা নিতে হলে ইসরায়েলিদের কাছ থেকে ছাড়পত্র নিতে হয়।
আমরা হাসপাতালের ওই এলাকা থেকে পশ্চিম তীরজুড়ে ইহুদি বসতি ও ইসরায়েলের স্থাপিত তারের বেড়া দেখতে পেলাম। এখানে-ওখানে উঁচু উঁচু দেয়াল ও সড়ক বসতিগুলোকে ফিলিস্তিনিদের থেকে পৃথক করে রেখেছে। এভাইে আরব-ইসরায়েলিদের মধ্যে পার্থক্য রেখা টানা ক্রমবর্ধমানভাবেই চলছে। পূর্ব জেরুজালেম ও পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি বিস্তারের হার হতবুদ্ধিকর। ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে ৫ লাখের মতো ইহুদি ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে বসতি গড়ে তুলেছে। ১৯৯৩ সালে অসলো শান্তি চুক্তি হওয়ার পর এ ধরনের ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। আরও হাজার হাজার বসতবাড়ি নির্মাণ করা হচ্ছে বা নির্মাণ পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে। অসলো শান্তি প্রক্রিয়া শুধু স্থবিরই হয়ে পড়েনি, এর পশ্চাৎমুখী যাত্রা দ্রুততর হচ্ছে। প্রতিটি ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীর আবাস গড়ার জন্য এক একটি ফিলিস্তিনি পরিবারকে তাদের নিজেদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ ও ওই বাড়িঘর বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিতে হয়েছে। এভাবে ফিলিস্তিনিদের যে ভূখণ্ড দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল বা যে অংশ নিয়ে ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা ছিল সেটা এখন আর একই অবস্থায় নেই।
জাতিসংঘ প্রস্তাবের পক্ষে ২৯ নভেম্বর ভোট প্রদান করার মাধ্যমে দুই রাষ্ট্র ব্যবস্থার পক্ষে একটা রক্ষাকবচ তৈরি হতে পারে এবং এর ফলে আলোচনার দরজাও খুলবে। আমরা আরও আশা করি, ফিলিস্তিনের ওপর অর্থনৈতিক শাস্তিমূলক যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে সেগুলো তুলে নেওয়া হবে এই পদক্ষেপকে ফলপ্রসূ করার স্বার্থেই। কেউ কেউ ভোট বিলম্বিত করার কথা বলেছেন। কিন্তু এতে কোনো সুফল অর্জিত হবে না।
ফিলিস্তিনিদের মধ্যে বিরাজমান হতাশা ও ইসরায়েলদের মধ্যে ক্লান্তির যে ছায়া রয়েছে তাকে দূর করতে হলে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেই এগিয়ে আসতে হবে। আমরা জানি, অনেক ইসরায়েলি আমাদের মতো একই মনোভাব পোষণ করেন। তারাও চান দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান। এর মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে বলে আমাদের মতো তারাও মনে করেন। আর এটা ইসরায়েলের মৌলিক স্বার্থের পক্ষেও বটে। আমরা যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, আরব রাষ্ট্রগুলোকে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানকে কার্যকর করার জন্য একযোগে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাই।

লেখকদ্বয় : হারলেম ব্রান্ডল্যান্ড অসলো শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের সময় নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং জিমি কার্টার ১৯৭৮ সালে ক্যাম্পডেভিড চুক্তি ও ১৯৭৯ সালে মিসর-ইসরায়েল শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। খালিজ টাইমস থেকে ভাষান্তর সুভাষ সাহা

শুক্রবার, ৬ জুলাই, ২০১২

রোহিঙ্গা সমস্যা : বাস্তবতা ও করণীয়



॥ ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী ॥

আরাকানের আদি নৃগোষ্ঠীর নাম রোহিঙ্গা। এরা ধর্ম বিশ্বাসে মুসলমান। আরাকান বর্তমান মিয়ানমারের বাংলাদেশসংলগ্ন একটি অঞ্চল। এ হিসাবে মিয়ানমার দক্ষিণ-পূর্বাংশের কক্সবাজার জেলার সীমান্তঘেঁষা আমাদের প্রতিবেশী দেশ। আরাকানে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ইতিহাস অতি প্রাচীন। চট্টগ্রামকে বলা হয়, এই ভূখণ্ডে ইসলামের প্রবেশদ্বার। ঐতিহাসিকেরা বলেছেন, খোলাফায়ে রাশেদিনের যুগে চট্টগ্রাম বন্দরে আরব বণিকদের যাতায়াত সূত্রে এখানে ইসলামের প্রচার ঘটে। তখন থেকে আরাকানও ইসলামের ছায়ায় আশ্রয় নেয়।
সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের আগ্রাসনের আগে আরাকানের রাজসভা ছিল বাংলাভাষার চর্চা ও উৎকর্ষতার প্রাণকেন্দ্র। মহাকবি আলাওল, সৈয়দ সুলতান শাহ মুহাম্মদ ছগীর প্রমুখ আরাকান রাজসভাকে কেন্দ্র করে সাহিত্যচর্চা করেন। পদ্মাবতীসহ মধ্যযুগের পুঁথিসাহিত্যের লালনভূমি ছিল আরাকান।
বার্মা ও উপমহাদেশ যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশদের দখলমুক্ত হয়, তখন আরাকান বার্মার সাথে যুক্ত হয়। আরাকান সীমান্তের নাফ নদীর এপারের কক্সবাজার ও টেকনাফ অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত হয় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও বর্তমান বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে। আইয়ুব আমলে পাকিস্তানি শাসকদের ভুল নীতির কারণে বার্মা ও পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তে সব সময় গোলযোগ লেগে থাকত। ফলে অবিশ্বাস ও অশান্তি বলবৎ থাকত দুই দেশের সীমান্তজুড়ে। এর প্রভাব পড়তে থাকে আরাকানের মুসলিম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর। 
রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি আরাকানের সংখ্যালঘু বৌদ্ধদের সাধারণ পরিচয় মগ। স্থানীয় ভাষায় রাখাইন, বার্মা সরকার আরাকানকে রোহিঙ্গামুক্ত করার পলিসি নেয়। রাখাইনেরা সেই পলিসির কারণে মুসলমানদের ওপর যখন-তখন হামলা চালায়। যখন ইচ্ছা ধান-চাল, গরু-ছাগল ছিনিয়ে নেয়। পান থেকে চুন খসলে মারধর করে। বাড়িতে আগুন দেয়। ক্রমেই তাদের নাগরিক অধিকার কেড়ে নেয়া হয়। হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী নৃগোষ্ঠীকে এভাবে অবাঞ্ছিত একটি জনগোষ্ঠীতে পরিণত করা হয়। এমনকি আরাকানের ঐতিহাসিক নামটিও বদলে দিয়ে রাখাইন অঞ্চল রাখা হয়। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার হয়ে টেকনাফগামী মহাসড়কটির নাম আরাকান রোড। জাপান-ব্রিটিশ যুদ্ধের সময় ব্রিটিশেরা বার্মার রণাঙ্গনে যাওয়ার জন্য এটি নির্মাণ করেছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ-বার্মা সীমান্তে বৈরিতা বা অশান্তির অবসান হলেও রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়নের মাত্রা বিন্দুমাত্র কমেনি; বরং বেড়েছে। আশির দশকের শুরুতে রাখাইনদের অত্যাচারে নিপীড়িত মুসলমানেরা বাংলাদেশে শরণার্থী হয়েছিল। তাদের অসহায়ত্বের প্রতি সহানুভূতিশীল সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো দেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়। কিংবা বাংলাদেশি পরিচয়ে চোরাইপথে তারা বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমায়।
১৯৯২ সালে আরেকবার নিপীড়নের শিকার হয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। তখন জাতিসঙ্ঘ শরণার্থী কমিশনসহ অনেক দেশ ত্রাণ তৎপরতা নিয়ে এগিয়ে আসে। কিন্তু তাতে রোহিঙ্গাদের দুর্দশার এতটুকুন সুরাহা হয়নি। সরকারি হিসাব মতে এখনো ৩০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশ ভূখণ্ডে রয়ে গেছে। বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা দুইলাখের ওপর।
২০১২ সালের জুন মাসের শুরুতে একটি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাখাইনরা রোহিঙ্গাদের ওপর দলবদ্ধ হামলা, লুটপাট ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ চালাতে থাকে। ফলে প্রাণভয়ে রোহিঙ্গারা নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করে। কিন্তু বাংলাদেশে সীমান্তরক্ষীরা তাদেরকে ঢুকতে বাধা দেয় এবং অনেককে পুশব্যাক করে। এ ঘটনার প্রেক্ষাপটে জাতিসঙ্ঘ আর জাতিসঙ্ঘের মুরব্বি আমেরিকা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি জোরালো অনুরোধ করে, যাতে রোহিঙ্গাদের আসার জন্য বাংলাদেশের সীমান্ত খুলে দেয়া হয়।
আমাদের প্রশ্নÑ আরাকানে বা রাখাইন অঞ্চলে রোহিঙ্গা নৃগোষ্ঠীর ওপর যুগ যুগ ধরে যে বৈষম্য, বর্ণবাদ ও নির্যাতন চলছে, জাতিসঙ্ঘ তার প্রতিকারের জন্য কী পদক্ষেপ নিয়েছে? বিগত দিনগুলোতে যে ৩০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে এবং জাতিসঙ্ঘ রিলিফ দিয়ে যাচ্ছে, তাদেরকে নিজের ভিটেমাটিতে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য কী ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে? জবাব হলোÑ তেমন কিছুই করেনি। তা হলে আরাকানে নতুন করে সঙ্কট শুরু হওয়ার সাথে সাথে যেখানে মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা যৌক্তিক ছিল, সে কাজটি না করে বাংলাদেশের দুয়ার খুলে শরণার্থীদের গ্রহণ করার জন্য চাপ সৃষ্টির পেছনে কী মতলব থাকতে পারে?
জাতিসঙ্ঘ ও আমেরিকা আফগানিস্তান, ইরাক, ফিলিস্তিন ও বিশ্বের দিকে দিকে মজলুম মুসলমানদের সাথে কী ধরনের আচরণ করেছে ও করছে, তা দুনিয়ার সবাই জানে। এমতাবস্থায় অত্যাচার বন্ধ করতে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির পরিবর্তে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে নিয়ে আসার জন্য তাদের এত দরদ দেখে মনে সন্দেহ সৃষ্টি হওয়া একান্তই স্বাভাবিক।
আমরা দিব্য দেখতে পাচ্ছি, রাখাইনরা এবং মিয়ানমারের শাসকগোষ্ঠী যেমন অত্যাচার-নিপীড়নের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দিয়ে বা হত্যা করে আরাকানকে মুসলিমশূন্য করতে চায়, তেমনি জাতিসঙ্ঘ ও পশ্চিমা দরদি দেশগুলোও রোহিঙ্গাদের নিজেদের পৈতৃক ভিটামাটি থেকে বের করে আনার কৌশল অবলম্বন করেছে। সেই কৌশল হচ্ছেÑ জনসংখ্যার ভারে জর্জরিত বাংলাদেশের ওপর শরণার্থী গ্রহণের জন্য চাপ সৃষ্টি আর রোহিঙ্গাদের অন্তত জাতিসঙ্ঘের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় লাভ এবং পরবর্তী সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের সোনার হরিণ ও অন্যান্য দেশে আশ্রয় নেয়ার প্রলোভন দেয়া। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ দেখে যে কেউ এই বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারবেন। 
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের সর্বোত্তম ও একমাত্র পথ হচ্ছেÑ রোহিঙ্গাদের তাদের পৈতৃক ভিটেমাটিতে নাগরিক মর্যাদা নিয়ে শান্তিতে থাকার ব্যবস্থা করা। এই ব্যবস্থার জন্য এ পর্যন্ত প্রমাণিত হয়েছে যে, বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়া মোটেও নিরাপদ নয়। কারণ, যারা শরণার্থী হয়ে আসে তাদেরকে আর ফেরত নেয়া হয় না, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সে ব্যবস্থা করে না। ফল দাঁড়ায়, এরা নিজের ভিটেমাটি থেকে চিরতরে উৎখাত হয়ে যায়। এখানে বাংলাদেশেও চলতে থাকে শরণার্থীদের নিগৃহীত জীবন। তা ছাড়া বাংলাদেশের আশ্রয় দেয়ার মতো অতিরিক্ত ভূমি ও সামর্থ্য নেই। আরো অধিক শরণার্থীর অনুপ্রবেশ ঘটলে যখন অভাব-অনটন ও চুরি-ডাকাতি বেড়ে যাওয়ার মতো সামাজিক সমস্যা দেখা দেবে, তখন তা সামাল দেয়া কারো পক্ষে সম্ভব হবে না। যদি সৌদি আরব বা অন্য দেশে তাদের পুনর্বাসন করা হয়, তাহলে তো সেই লোভে আরাকান মুসলিমশূন্য হয়ে যাবে, যা মিয়ানমার সরকার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একান্তভাবেই কামনা করে। 
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের আরেকটি পথ চিন্তা করা যেতে পারে আরাকানকে স্বাধীন করে স্বাধীন মুসলিম দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। আমাদের মধ্যে যারা যুক্তি ও বাস্তবতার চেয়ে ভাবাবেগেতাড়িত, তারা এমন স্লোগান শুনলে প্রীত হন, মনে আনন্দ পান। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছেÑ আরাকানকে অদূর ভবিষ্যতে স্বাধীন করা সম্ভব নয়। এর মূল কারণ, স্বয়ং আরাকানের ভেতরকার রোহিঙ্গা মুসলমানেরা স্বাধীনতা চায় না। যাদের স্বাধীনতা দরকার; তারাই যদি না চায় তাহলে বাইরে থেকে জিহাদ করে অন্যদের দিয়ে স্বাধীনতা কায়েম করে দেয়া অসম্ভব। বাইরের ইসলামি জজবাধারী নেতারা এ বাস্তবতাটি বুঝতে না পারার কারণে আরাকানে মুসলমানদের যথেষ্ট ক্ষতি হয়ে গেছে। পাকিস্তান আমলে জাফর কাওয়ালের নেতৃত্বাধীন আরাকানি গেরিলাদের কোন উদ্দেশ্যে প্রশ্রয় দেয়া হয়েছিল, চিন্তা করলে কারণ খুঁজে পাই না। কারণ আমার মনে হয়, এ যাবৎকাল যারা আরাকানকে স্বাধীন করার কথা বলেছেন, তারা দাবি করে বলতে পারবেন না যে, আরাকানের ভেতরকার মুসলিম নেতা বা প্রভাবশালী মহলের এরা কখনো সমর্থন ও সহযোগিতা পেয়েছেন। দ্বিতীয় কারণ ঐতিহাসিক ও খানিকটা তিক্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যে মুহূর্তে মিয়ানমার ও ভারতবর্ষ ছেড়ে ব্রিটিশরা চলে যাবে, তখন বার্মায় প্রচণ্ড সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধে। যেমনটি উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার রূপ নিয়েছিল। বার্মার দাঙ্গা ছিল মগ ও মুসলমানদের মধ্যে। তখন আরাকানের স্থায়ী বাসিন্দা বা রোহিঙ্গারা মগদের দ্বারা প্রতারিত হয়ে বহিরাগতদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। বহিরাগত বলতে চট্টগ্রাম ও পুরো বাংলাদেশ থেকে যাওয়া মুসলমানদের বোঝানো হতো। কারণ চট্টগ্রাম ও বাংলাদেশের মুসলমানরা তখন ভাগ্য বদলের জন্য বার্মায় যেত। সেখানকার ব্যবসায়, বাণিজ্য, সাহিত্য, সংস্কৃতি, মসজিদ, খানকা প্রভৃতি সব কিছুর ওপর বাংলাদেশের বিশেষ করে চট্টগ্রামের লোকদের প্রভাব ছিল। 
সে সময়কার বহিরাগত খেদাও আন্দোলনের এসব রূঢ় বাস্তবতা যাচাইয়ের জন্য ইতিহাসের বই পুস্তক খোঁজার দরকার নেই। চট্টগ্রামের ঘরে ঘরে বয়স্ক লোকদের জিজ্ঞাসাবাদ করলেই এর সত্যতা পাওয়া যাবে।
এই রূঢ় বাস্তবতাকে বিবেচনায় না নিয়ে যারা আরাকানের স্বাধীনতার স্লোগান দেয়, তারা প্রকারান্তরে রোহিঙ্গা মুসলমান ভাইদের ক্ষতিই করে। কারণ, তাতে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন চালানোর অজুহাত খুঁজে পায়।
সবচেয়ে বড় কারণটি হলো, আরাকানকে সাহায্য করার শক্তি আপাতত কারো নেই। এক সাংবাদিক বন্ধু বললেন, ১৯৯২ সালে রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা নিয়ে আমি অনেক ঘোরাঘুরি করেছি। একপর্যায়ে ডা: ইউনুচের ও জনাব শাব্বিরের নেতৃত্বাধীন দু’টি পৃথক রোহিঙ্গা সংহতি আন্দোলনের নেতাদের সাক্ষাৎকার নেয়ার সুযোগ পাই। তাদের বলিষ্ঠ কণ্ঠের দাবি ছিল, আমরা আরাকানকে স্বাধীন করতে চাই। বলেছিলেন তাদের হাতে নাকি সশস্ত্র যোদ্ধা আছে। পরিসংখ্যান জিজ্ঞাসা করলে একপর্যায়ে জানা গেল ডা: ইউনুচের সশস্ত্র যোদ্ধার সংখ্যা দুই হাজার আর শাব্বির সাহেবের দাবি তাদের ৪০০ যোদ্ধা আছে। দুই হাজার বা ৪০০ যোদ্ধার বিশাল বাহিনী নিয়ে মিয়ানমারের নাসাকা বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে কিভাবে জয়ী হবে তার কোনো সদুত্তর তাদের কাছে ছিল না। বিদেশ থেকে কিভাবে অস্ত্রের জোগান আসবে এবং বাংলাদেশ সরকারের সমর্থন না থাকলে কক্সবাজার বা টেকনাফে অস্ত্রের সেই চালান কিভাবে খালাস করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশের ভূমি কিভাবে ব্যবহার করবে সেসব প্রশ্নেরও কোনো জবাব দিতে পারেননি রোহিঙ্গা নেতারা। এর পরও তাদের কাছে যুদ্ধ মহড়া বা অভিযান পরিচালনার ভঙ্গিতে রঙিন ছবি ছিল। জানা যায়, এসব ছবি কোনো গহিন বনে মহড়া দিয়ে তোলা হয়েছে, আর আরাকানের স্বাধীনতার প্রতি সহানুভূতিশীল মধ্যপ্রাচ্যের অর্থশালীদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহে ব্যবহার করা হচ্ছে। এই ছবিগুলো মিয়ানমার সরকারের হাতে গিয়ে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন বাড়ানোর কারণ ঘটাচ্ছে কি না, সে জবাব অপরিণামদর্শী নেতাদের কাছে থাকতে পারে না।
তাহলে রোহিঙ্গাদের বেলায় আমাদের দায়িত্ব কী বা করণীয় কী থাকতে পারে? এর জন্য বিনয়ের সাথে অনুরোধ করব, মুসলমান ভাই হিসেবে রোহিঙ্গাদের জন্য যাদের মন কাঁদে, বিশেষ করে যেসব রোহিঙ্গা মুসলমান ইতোমধ্যে বাংলাদেশ, মধ্যপ্রাচ্য বা বহির্বিশ্বে রয়েছেন তাদেরকে নির্মোহ ও আবেগবর্জিত হয়ে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। আন্তর্জাতিক চক্রান্তের কলাকৌশল বোঝার চেষ্টা করতে হবে। প্রথমে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে যে, আপাতত আরাকানকে বা রোহিঙ্গাদের স্বাধীন করা সম্ভব নয়। তাদেরকে যেভাবেই হোক আরাকানের মাটি কাঁমড়ে থাকতে হবে বা সেখানেই তাদেরকে প্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য নানাভাবে চেষ্টা ও সহায়তা দিতে হবে।
এই সহায়তার প্রথমটি হতে পারে শিক্ষা, রোহিঙ্গাদের স্বতন্ত্র জাতীয় চেতনা ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের স্বার্থে অবশ্যই তাদেরকে ইসলামিয়াত বা ধর্মীয় শিক্ষা দিতে হবে। এর জন্য ব্যাপক আকারে বড় বড় মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন নেই। মসজিদভিত্তিক কুরআন ও মাসয়ালা শিক্ষাই যথেষ্ট। সীমিতসংখ্যক উচ্চতর ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে এগুলোর তত্ত্বাবধান ও শিক্ষক জোগান দেয়া সম্ভব। ঈমান, আমল বা ধর্মকর্ম সম্পর্কে এই প্রাথমিক জ্ঞানই বৈরী পরিবেশে তাদের ধর্মীয় চেতনা উজ্জীবিত রাখার জন্য যথেষ্ট হবে।
ধর্মীয় শিক্ষার মতোই গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সাধারণ শিক্ষা, অর্থাৎ মিয়ানমার সরকার জনসাধারণের জন্য যে শিক্ষাব্যবস্থা চালু রেখেছে, তা আয়ত্ত করার জন্য ছেলেমেয়েদের উৎসাহী করতে হবে। কেননা, সে দেশে প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য এটি প্রধান অবলম্বন। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা বর্জন করে কোনো সমাজের নাগরিকেরা প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে না। এই শিক্ষা হাসিলের ক্ষেত্রে বাধা থাকলে সেটি অতিক্রম করার জন্য দেশের ভেতরে ও বাইরে থেকে আন্দোলন চালাতে হবে।
মসজিদ, মাদরাসাভিত্তিক ধর্মীয় শিক্ষা এবং স্কুল-কলেজের সাধারণ শিক্ষার মতোই গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কারিগরি শিক্ষা। কোনো দেশে সংখ্যালঘু হয়ে মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে হলে তরুণ সমাজকে যতখানি সম্ভব কারিগরি বা হাতের কাজ শেখানোর বিকল্প নেই।
বাংলাদেশে একটি এলাকা আছে, ছোটবেলা থেকে তরুণেরা বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। ফলে যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা থাকতেও তারা লেখাপড়া করতে পারে না। কী কাজ করেন, জিজ্ঞাসা করলে জবাব দেয় বিদেশ যাওয়ার চিন্তায় আছি। তার মানে বেকার। অথচ বিদেশে গিয়ে যেভাবে গতর খাটে, তার অর্ধেক শ্রম, মেধা ও চেষ্টা কাজে লাগালে দেশে সোনা ফলানো সম্ভব হতো। এর মাধ্যমে যে কথাটি বোঝানোর উদ্দেশ্য তা হচ্ছেÑ যতক্ষণ কোনো একটি লক্ষ্যকে জাতীয় জাগরণের মাধ্যমে সহজ করা না হয়, ততক্ষণ সে লক্ষ্য অর্জিত হয় না। রোহিঙ্গা ভাইদেরও আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য নিজের সাধ ও সাধ্যের মধ্যে লক্ষ্য ঠিক করতে হবে। যেভাবেই হোক, নিজের মাটিতে নিজের পায়ে দাঁড়ানোই হবে সেই লক্ষ্য।
কোনো ইসলামি ভূখণ্ডে শত্রুর আক্রমণ হলে বা শত্রুর কোনো ভূখণ্ড জয় করার জন্য জিহাদ করার সওয়াব ও গুরুত্ব সবাই স্বীকার করেন। এ পথে লড়াই করে প্রাণ ত্যাগ করলে শহীদ হবে এবং তা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ হিসেবে গণ্য হবে। যারা আরাকানকে স্বাধীন করার জিহাদে উজ্জীবিত তাদেরকেও ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করার পরামর্শ দিতে চাই যে, যুদ্ধ করে আরাকান জয় করার চিন্তার চেয়ে যারা আরাকানের ভেতরে হাজার বছর ধরে বসবাস করছেন, তাদেরকে সেখানে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ করে দেয়া কী কম জিহাদ। নিজের ভিটেমাটি রক্ষার জন্য যদি নির্যাতন সইতে হয়, এমনকি নিহতও হতে হয়, তা তো আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ ও শাহাদাত হিসেবে গণ্য হবে। এর পরিবর্তে নিজের অবস্থান শত্রুর জন্য ছেড়ে দিয়ে আত্মরক্ষা করার মধ্যে তো কোনো কৃতিত্ব নেই এবং ভবিষ্যৎও তো সম্পূর্ণ অন্ধকার।
এই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধে অন্য যে বিষয়টির দিকে রোহিঙ্গা মুসলিম ভাইদের সাথে সংহতি প্রকাশকারী সচেতন মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই তা হলোÑ একটি রোহিঙ্গা সংহতি তথ্য ব্যাংক প্রতিষ্ঠা। আরাকানের ভেতরে কী চলছে, মুসলমানদের প্রকৃত অবস্থা কীÑ তা আমরা বলতে গেলে সঠিক জানি না। ফলে এই লেখাও লিখছি কিছু তথ্য ও কিছু অনুমানের ওপর নির্ভর করে। ইন্টারনেটের যুগে এ জাতীয় একটি তথ্য ব্যাংক প্রতিষ্ঠা হলে সেটিই হবে রোহিঙ্গা মুসলমানদের প্রতি সংহতি প্রকাশের সর্বোত্তম পন্থা। কারণ, বর্তমান যুগের যুদ্ধাস্ত্রের চেয়ে প্রচার বা মিডিয়াই অধিক কার্যকর। রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর কী ধরনের বৈষম্য, নিগ্রহ ও অত্যাচার চলছে, তা মিডিয়ার সাহায্যে দুনিয়ার মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে। তখন বাইরে থেকে কিভাবে তাদেরকে মিয়ানমারে নাগরিক অধিকার নিয়ে থাকার ব্যবস্থা করা যায়, সে পথ বেরিয়ে আসবে। সচেতন লোকেরা তখন তাদের প্রতি সংহতি জানিয়ে মিছিল, মিটিং, আলোচনা সভা ও লেখালেখির মাধ্যমে বিশ্বজনমত গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারবে। ইসলামি দেশগুলো ওআইসি ও জাতিসঙ্ঘকেও এ ব্যাপারে কার্যকর ভূমিকা রাখতে চাপ দেয়া সহজ হবে। আমার মতে, বর্তমান সময়ে রোহিঙ্গা মজলুম মুসলমান ভাইদের প্রতি সংহতি প্রকাশ ও সাহায্য পৌঁছানোর এটিই কার্যকর পথ। এর পরিবর্তে এমন কোনো ফাঁদে পা দেয়া উচিত হবে না, যা মিয়ানমার সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের স্বদেশ ভূমি থেকে উচ্ছেদ ও সাম্রাজ্যবাদীদের পরিকল্পনা মাফিক তাদের শরণার্থীতে পরিণত করাকে উৎসাহিত করবে। 
২৬-০৬-২০১২
isashahedi@gmail.com

সেই ফাঁসি, সেই ব্রাদারহুড ও আজকের প্রেসিডেন্ট মুরসি



 এমএ বার্ণিক  
বি শ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ মিসরে ড. মুহম্মদ মুরসি প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। গণ-আন্দোলনের মুখে স্বৈরশাসক হোসনি মোবারককে উত্খাতের ১৮ মাসের মাথায় মুসলিম ব্রাদারহুডের এই নেতা সেদেশে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্ট। কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ১৯৭৫ সালে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইডি ডিগ্রি অর্জন করেন। নির্বাচিত হয়েই তিনি ঘোষণা দেন, ‘আমি মিসরের মুসলিম, খ্রিস্টান, নারী, পুরুষ, তরুণদের প্রেসিডেন্ট। মর্যাদার সঙ্গে বসবাস, স্বাধীনতা ও সামাজিক বিচারের জন্য আজ মিসরে ঐক্যের বড় প্রয়োজন।’ ড. মুহম্মদ মুরসি’র এ ভাষণে ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-নির্বিশেষে নিরপেক্ষ থাকার মানসিকতা ফুটে উঠেছে। মুসলিম ব্রাদারহুড ইসলাম ধর্মের যে মর্মবাণী ধারণ করে গড়ে উঠেছে, মুরসি’র ঘোষণার মধ্যে তারই প্রতিফলন ঘটেছে।
ড. মুহম্মদ মুরসি’র বিজয়ের মধ্য দিয়ে তদসম্পর্ক এবং মুসলিম ব্রাদারহুড সম্পর্কে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। প্রথমে ব্যক্তি-মুরসি সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। মিসরের নাইল ডেল্টা (নীল ব-দ্বীপ) প্রদেশের এক গ্রামে মুহম্মদ মুরসি জন্মগ্রহণ করেন। মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতৃত্বে ব্যাপক জনসমর্থনে হোসনি মোবারকের পতনের পর গঠিত দল ‘ফ্রিডম এন্ড জাস্টিস’ পার্টির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি। গত ১৬ ও ১৭ জুন ২০১২ তারিখে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দ্বিতীয় দফা ভোটে ৫৭ দশমিক ৭৩ শতাংশ ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন  তিনি। তদপূর্বে মে মাসে অনুষ্ঠিত প্রথম দফা ভোটে ২৪ শতাংশ ভোট পান তিনি। বর্তমানে ৬০ বছর বয়সী ড. মুহম্মদ মুরসি ৪ সন্তানের জনক। ইতোপূর্বে তিনি মিসরের জাগজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল বিভাগের প্রধান ছিলেন। ২০০০ সালে প্রথম পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। গত বছর হোসনি মোবারকের পতনের পর তিনি মুসলিম ব্রাদারহুডের মুখপাত্র নির্বাচিত হন। ২০১২ সালের ৩০ জুন ড. মুহম্মদ মুরসি মিসরের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।
ইংরেজি ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’ (Muslim Brotherhood) নামটি মিসরবাসী আরবিতে ‘ইখওয়ানুল মুসলিমিন’ হিসেবেই উচ্চারণ করেন। এ সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ হাসানুল বান্না। ১৯২৯ সালের ১১ এপ্রিল তিনি এ সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন। আল-আজহারের এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন শহীদ হাসানুল বান্না। ১৯৪৮ সালে মিসরের বাদশাহ ফারুক প্রথমবার ইখওয়ানুল মুসলিমিনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তারও আগে ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৯ সালে জালেম বাদশাহ ফারুকের আদেশে একদিন মসজিদে যাওয়ার সময় হাসানুল বান্নাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তাঁর মতো একজন আদর্শবাদী ঘাঁটি মানুষ, বাগ্মী ও সত্যপথের সংগঠক বর্তমান দুনিয়ার বুকে বিরল। ১৯৫৪ সালের পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, মিসরে মুসলিম ব্রাদাদারহুডের সদস্যসংখ্যা ছিলো ৫০ লাখ। সে সময় ফিলিস্তিন, সিরিয়া ইরাক ও লেবাননে ব্রাদারহুডের ৩৫০টি শাখা ছিলো।
ইসলামের মৌলিক আদর্শকে সমাজে প্রতিষ্ঠার জন্য মুসলিম ব্রাদারহুড আজীবন লড়াই করেছে। ১৯৪৫ সালের ৮ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত মুসলিম ব্রাদারহুডের মৌলিক সূত্র (Radical Aphorism) নামক এক গ্রন্থে তাদের আদর্শ সম্পর্কে যে সব তথ্য রয়েছে সেগুলোর মধ্যে ছিলো ১। কোরআনের বিশ্লেষণ ও আজকের বৈজ্ঞানিক জগতে তার প্রয়োগ, ২। ঘনিষ্ঠতর সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার  উদ্দেশ্যে ইসলামি আইন-কানুনসমূহের সঠিক ব্যাখ্যা নিরূপণের জন্য ইসলামি রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সহযোগিতা, ৩। সামাজিক ইনসাফ প্রতিষ্ঠার জন্য অর্থনৈতিক সম্পদের সঠিক ব্যবহার ও সামাজিক শ্রেণিসমূহের পুনর্বিন্যাস, ৪। বিশ্ব মুসলিম জীবনমান উন্নত করার জন্য দারিদ্র্য, অস্বাস্থ্য ও অজ্ঞতার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা এবং ৫। বিদেশি প্রভুত্ব বা শোষণ থেকে মুসলিম দেশগুলোকে মুক্ত করা এবং পৃথিবীর সর্বত্র মুসলমান সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষা করা।
১৯৫৪ সালে মিসরের ডিক্টেটর প্রধানমন্ত্রী কর্নেল জামাল আবদুন নাসের মুসলিম ব্রাদারহুডকে পুনরায় বেআইনি ঘোষণা করেন। সেবছর ৮ অক্টোবর ব্রাদারহুডের শীর্ষনেতা ড. হাসানুল হোদায়বীকে গ্রেফতার করা হয়। হোদায়বী ছিলেন ড. হাসানুল বান্নার যোগ্য উত্তরসুরি। কর্নেল নাসের ব্রাদারহুডের কেন্দ্রীয় অফিসসহ ৪০০ শাখা অফিসে তালা ঝুলিয়ে দেন। ব্রাদারহুড কর্তৃক পরিচালিত স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, হাসপাতাল ও কোঅপারেটিভ প্রতিষ্ঠানগুলোও বন্ধ করে দেয়া হয়।
শুধু হোদায়বী নয়, তার সাথে মুসলিম ব্রাদারহুডের আরও ৬ জন বিপ্লবী নেতা মাহমুদ আবদুল লতিফ, ইউসুফ তালাত, আবদুল কাদের ওদা, হিন্দওয়ে দিওয়ার, ইব্রাহিম আল তৈয়ব ও মুহম্মদ ফারাগ আলীকে গ্রেফতার করে তথাকথিত সামরিক  আইনে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। কর্নেল জামাল আবদুন নাসেরের সরকার উচ্ছেদের চেষ্টার অভিযোগ এনে এসব নেতৃবৃন্দকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছিলো।
কর্নেল নাসেরের এহেন অপতত্পরতায় সমগ্র মুসলিম জাহান কেঁপে ওঠে। মুসলিম বিশ্বের চাপের মুখে ড. হাসানুল হোদায়বীকে মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকর করতে বিরত থাকলেও বাকি ৬ জনকে ৭ ডিসেম্বর ১৯৫৪ তারিখ সকাল ৮টা থেকে ১১টার মধ্যে আধাঘণ্টা পরপর ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারা হয়। সে সময় সিরিয়া, লেবানন, জর্দান, সৌদি আরব, ইরাক, ইরান, সুদান পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়াসহ প্রায় সব মুসলিম রাষ্ট্র ব্রাদারহুড নেতাদের মুক্তির দাবিতে মিসরের সরকারের কাছে তারবার্তা পাঠিয়েছিলো। কিন্তু কোন অনুরোধই নাসেরের মন গলাতে পারেনি।
ড. হাসানুল হোদায়বী ব্রাদারহুডে যোগদানের আগে মিসর হাইকোর্টের একজন বিচারপতি ছিলেন। ১৯৫১ সালে তিনি বিচারপতি পদে ইস্তফা দিয়ে মুসলিম ব্রাদারহুডে যোগদান করেন। শহীদ আবদুল কাদের ওদা শুধু মিসরের নয়, সমগ্র মুসলিম জাহানের শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদদের একজন ছিলেন। তিনি ছিলেন মিসরের সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি। ১৯৫০ সালে তিনি বিচারপতি পদে  ইস্তাফা দিয়ে ব্রাদারহুডে যোগদান করেন। শহীদ ইউসুফ তালাত একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ছিলেন। আল  কোরআনের আলোতে আলোকিত এই সিংহপুরুষকে বর্বর নাসের সরকার জেলখানার ভেতরে নির্যাতন করে তার একটি চক্ষু নষ্ট করে দিয়েছিলো। তারপরও ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে দু’হাত তুলে তিনি আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করেছিলেন, “ইহা আল্লাহ, যারা আমার প্রতি অন্যায় করলো, তাদেরকে তুমি ক্ষমা করে দিও।”
শহীদ মুহাম্মদ ফারাগ আলী ছিলেন শহীদ হাসানুল বান্নার ঘনিষ্ঠ সহযোগী। তিনি ব্রাদারহুডের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন। ইতোপূর্বে প্রথম যখন ব্রাদারহুডকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছিলো, তখনও তিনি ‘শান্তি ভঙ্গকারী’ হিসেবে অভিযুক্ত হন এবং পরে বেকসুর খালাস পান। ১৯৫০ সালে মিসরে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময় ফারাগ আলী গেরিলা বাহিনীর সর্বাধিনায়ক মনোনীত হয়েছিলেন। সেই ব্যাঘ্রপুরুষকে নাসের সরকার যখন ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারতে উদ্যত হলো তখন ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন, “বড় সুখের বিষয় যে, আমি আজ শাহাদাত্ লাভ করতে যাচ্ছি।”
শহীদ ইব্রাহিম আল-তৈয়ব ছিলেন মুসলিম ব্রাদারহুডের এক তরুণ নেতা। শাহাদাত্ বরণকালে তাঁর বয়স হয়েছিলো মাত্র ৩২ বছর। তিনি আইন বিষয়ে পাস করেছিলেন এবং ব্রাদারহুডের হেড অফিসে আইন বিভাগে কাজ করতেন। আধুনিক সমাজকাঠামোতে ইসলামি আইনের প্রয়োগ সম্পর্কে গবেষণারত ছিলেন এই যুবনেতা। রাজা ফারুকের শাসনামলে তিনি ১৯৪৯ সালে ৯ মাস কারাবরণ করেন এবং ১৯৫৪ সালে কর্নেল নাসের তাকে ২ মাস কারাগারে অবরুদ্ধ রেখে নির্যাতন করেছিল। ফাঁসির মঞ্চে ইব্রাহিম আল-দৈয়বের শেষবাণী ছিলো, “আল্লাহর অশেষ শুকরিয়া যে, আমি শাহাদাত্ বরণ করছি।” অপরদিকে শহীদ মাহমুদ আবদুল লতিফ ও হিন্দওয়ে দিওয়ার শাহাদাতের সময় অম্লান বদনে বলে গেছেন, “আমরা আল্লাহর নিকট থেকে এসেছি এবং আল্লাহর নিকট ফিরে যাচ্ছি।”
ব্রাদারহুডের নেতৃবর্গের ফাঁসির পেছনে সুয়েজ খালে ইংরেজদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সম্পর্ক জড়িত ছিলো। কারণ ব্রাদারহুড সুয়েজ খাল সম্পর্কে ইংরেজ ও মিসরের সংলাপের ঘোর বিরোধী ছিলো। তারা সুয়েজ খাল থেকে ইংরেজদের শর্তহীন প্রস্থানের দাবিদার ছিলো এবং এ খালকে আন্তর্জাতিক নৌপথ হিসেবে স্বীকৃতি এবং সেটিকে ইংরেজদের হাতে সমর্পণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। ২৮ মার্চ ১৯৫৪ তারিখে জামাল আবদুন নাসের মিসরের সামরিক সরকার হিসেবে ক্ষমতায় বসে সুয়েজ পরিত্যাগ সংক্রান্ত চুক্তিতে ইংরেজদের সাথে স্বাক্ষর করেন (১ সেপ্টেম্বর ১৯৫৪)। মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি এ চুক্তি স্বাক্ষর করেন। চুক্তি স্বাক্ষরের এক মাসের মাথায় জামাল আবদুন নাসেরের প্রাণনাশের চেষ্টা হয় এবং এ জন্য মুসলিম ব্রাদারহুডকে দায়ী করে তাদের আন্দোলনকে বে-আইনি ঘোষণা করা হয়। ৬ জনকে ফাঁসি দেয়া হলেও ৩০০ জন ব্রাদারহুড নেতাকে দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ড এবং ১০ হাজারেরও অধিক ব্যক্তিকে বিভিন্ন প্রকারের শাস্তি দেয়া হয়। এভাবে ইংরেজদের পদলেহনকারী নাসের সরকার ব্রাদারহুডকে নিঃশেষ করে দেয়ার সকল আয়োজন সম্পন্ন করে। কিন্তু আদর্শবাদী সংগঠনের মৃত্যু এতো সহজ নয়। সেই ঘটনার ৫৮ বছর পর ২০১২ সালে ব্রাদারহুড মিসরের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এলো।
মিসরের রাজা ফারুক আর কর্নেল নাসেরের মধ্যে আদর্শগত কোন পার্থক্য ছিলো না। তারা ব্রাদারহুডের নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করে যে নির্যাতন করেছিলো, সভ্য জগতে তার দৃষ্টান্ত বিরল। কারারুদ্ধ এসব খাঁটি মুসলমানকে মাসের পর মাস অনাহারে, অর্ধাহারে রেখে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় মারতে মারতে নাকমুখে রক্ত বের করে দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বেহুঁশ অবস্থায় রাখার পর চোখ খুললেই বলা হতো, “এবার বল, তোমরা ব্রাদারহুডে আর কাজ করবে কি-না?” গরম লোহার চিমটা দিয়ে হাতের আঙ্গুল থেকে একেকটি নখ টেনে টেনে বের করা হতো আর একেকটি টানের পর কিছুক্ষণ থেকে আবার জিজ্ঞাসা করা হতো, “এবার বল, তোমরা ব্রাদারহুড ছাড়তে রাজি আছে কি-না?” শরীর আর অন্তরের সমস্ত জ্বালা দু’ঠোটে চেপে শান্ত অথচ দৃঢ়কণ্ঠে তারা সকলেই জবাব দিতেন, “আল্লাহু আকবার, লিল্লাহিল হামদ” অর্থাত্ আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ, সব প্রশংসা আল্লাহর জন্য। এ হ’ল ব্রাদারহুডের মূল আওয়াজ। এভাবে বাদ্রারহুডের নেতারা জীবনত্যাগ করলেও আদর্শচ্যুত হননি। যাদেরকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিলো তারা ব্যতীত হাজার হাজার ব্রাদারহুডের নেতা-কর্মীকে বছরের পর বছর কারাগারে আটক রেখে নির্যাতন করা হয়েছে।
সর্বশেষে ২০১১ সালে ব্রাদারহুড মিসরের সাধারণ মানুষের নেতৃত্বের সামনে চলে আসে। ফলশ্রুতিতে গণবিক্ষোভের মুখে স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের বিদায়ের পর মিসরের সশস্ত্র বাহিনীর সর্বোচ্চ পরিষদ (স্কাপ) ১৮ মাস সে দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য নানামুখী কাজ করে। এসব কাজের মধ্যে ছিলো হোসনি মোবারক ও তার সহযোগীদের বিচার, বিভিন্ন অনিয়ম ও অবিচার সম্পর্কে তদন্ত পরিচালনা এবং সর্বোপরি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন পরিচালনা। গণতান্ত্রিক পদ্ধতির নির্বাচনে ব্রাদারহুড নেতা উ. মুহম্মদ মুরসি ক্ষমতায় এলেও তিনি এমন এক পরিস্থিতিতে হাল ধরেছেন যখন দেশে কোন পার্লামেন্ট নেই, স্থায়ী কোন সংবিধান নেই, বিধিসংগত ব্যবস্থা নেই। এমতাবস্থায় স্কাপের নিয়মনীতি অনুসরণ করে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে  তাকে এগোতে হবে। ড. মুরসি যে আদর্শে বিশ্বাসী সেই আদর্শকে রাষ্ট্রীয় জীবনে কতটা পরস্ফুিট করতে পারবেন সে ব্যাপারেও রয়েছে নানা মত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মুসলিম ব্রাদারহুডকে কোনদিনই ভলো চোখে দেখেনি, তাই মার্কিন প্রশাসনের নিকট মুরসি’র গ্রহণযোগ্যতা কতটা হবে সে ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে।
তবে মুরসি পন্ডিত ও বিদগ্ধ ব্যক্তিত্ব। সামরিক পরিষদের বেড়াজাল ডিঙ্গিয়ে লাখো জনতার সমর্থন নিয়ে তিনি এগিয়ে যেতে সমর্থ হবেন বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেছেন। মন্ত্রিসভা গঠনের আগে সমাজের সর্ব অংশের সাথে পরামর্শ করার মধ্যে তার দূরদর্শিতার ছাপ ফুটে উঠেছে। তার স্ত্রী নাগলা আলী মাহমুদের বয়স ৫০ বছর। তার বড় ছেলের নাম আহমদ। তাই ‘উম আহমদ’ বা আহমদের মা হিসেবে তিনি পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। বোরকা পরিহিত এই রমণী ‘ফাস্ট লেডি’ হিসেবে পরিচয় দেয়ার ঘোর বিরোধী।
এখানে প্রসঙ্গত আর একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, মানবতার সেবায় মুসলিম ব্রাদারহুড সর্বমহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়। মানবতার সেবার জন্য ব্রাদারহুডের একটি আলাদা বিভাগ রয়েছে। এ বিভাগ থেকে গরীব ও অভাবী লোকদের সাহায্য প্রদান, স্বল্পমূল্যে খাদ্য সরবরাহ, বেকারদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, রোগীদের জন্য বিনামূল্যে চিকিত্সার ব্যবস্থা এবং স্বাস্থ্য রক্ষার পদ্ধতিসমূহ  প্রচার করা হয়। তাছাড়া ব্রাদারহুডের প্রতিটি পেশার বিশেষজ্ঞ শ্রেণী রয়েছেন যারা নিজ নিজ পেশায় কর্মরত পেশাজীবীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির জন্য পরামর্শ প্রদান করে থাকে। এতকিছু সত্ত্বেও ক্ষমতায় আসার পর সামরিক বাহিনীর প্রভাববলয় থেকে ব্রাদারহুড মুক্ত হওয়া এবং ড. মুহম্মদ মুরসিকে সামরিক শাসনের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে দেশ পরিচালনার পাশাপাশি তীব্রভাবে দ্বিধাবিভক্ত, আতংকিত ও ক্ষুব্ধ মিসরীয়দের নেতৃত্ব দেয়া দুরূহ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
n লেখক:সভাপতি, ইতিহাস গবেষণা সংসদ