মঙ্গলবার, ২৭ নভেম্বর, ২০১২

গাজায় আগ্রাসন : ফিলিস্তিনের বোঝা ও সমঝোতার ওঝা


মীযানুল করীম
তারিখ: ২৮ নভেম্বর, ২০১২
গাজায় আগ্রাসন
হাজার হাজার ফিলিস্তিনি গাজার রাস্তায় আনন্দ উৎসবে মেতে উঠেছে। শিশু-কিশোর-যুবকেরা উল্লাসে হর্ষধ্বনি দিচ্ছে। কেউ কেউ দেখাচ্ছে বিজয়চিহ্ন ‘ভি’। এই দৃশ্য গাজা ভূখণ্ডের, যেখানে এবার ইসরাইল আবার ব্যাপক হামলা চালিয়ে হত্যা ও ধ্বংসের মহোৎসবে মেতে উঠেছিল। তার অবসানেই ফিলিস্তিনিদের এই স্বস্তি ও আনন্দ। টিভিতে ও পত্রপত্রিকায় তাদের বিষাদ-বেদনার ছবিও তুলে ধরা হয়েছে। বিবিসি টিভিতে দেখা যায়, বয়স্ক গাজাবাসী কোলাকুলি করছেন। তবে মুখে ঈদের হাসি নয়, দুঃখ ও উদ্বেগ। পাশেই ইহুদিবাদী আগ্রাসনে বিধ্বস্ত বড় বড় ভবন। এএফপি হামাস সদর দফতরের ছবি দিয়েছে। দেখা যাচ্ছে, সেখানে বিরাট দেয়ালজুড়ে রণাঙ্গনের ছবি আঁকা। পাশেই রাস্তা থেকে সরানো হচ্ছে এই সদর দফতর ভবনের ধ্বংসস্তূপ। ইসরাইল এখানেও ভয়াবহ হামলা চালিয়েছে। তাদের নৃশংসতায় চিরতরে হারিয়ে গেছে বহু শিশু-কিশোর। একটি ছবিতে গাজার এক শিশুর হাতে ফিলিস্তিনের প্রিয় পতাকা, চোখে অপার বেদনার অরোধ্য অশ্রু। স্বজন হারানো কচি মেয়েটির বুকের ওপর একটি পোস্টারে রয়েছে তার আপনজনের ছবি। এর ওপর কিছু কথা আরবিতে লেখা। সম্ভবত কুরআন শরিফের বাণীও আছে এর মধ্যে।
এ সব কিছুই গাজায় আট দিনের সর্বাত্মক হামলা থেমে যাওয়ার পরবর্তী দৃশ্য। ২১ নভেম্বর পর্যন্ত ইসরাইলি হামলায় ১৬৭ জন নিহত হয়েছে। হানাদার ইহুদি বাহিনীর পৈশাচিকতার বলি হয়েছে প্রধানত শিশু ও নারীসহ নিরীহ মানুষ। এতে মাত্র পাঁচ ইসরাইলি প্রাণ হারিয়েছে। বাকিরা সবাই ফিলিস্তিনি। ফিলিস্তিনিদের ভবন ও স্থাপনা মিলিয়ে সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি বিপুল। ২১ তারিখ রাত ১টায় যুদ্ধবিরতির সমঝোতার ঘোষণা দেয়া হয়। মিসরীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ কামাল আমর সংবাদ সম্মেলনে বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তার পাশে ছিলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি কিনটন।
স্মর্তব্য, ফিলিস্তিনের বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ড গাজার ১৫ লাখ মানুষের ওপর ইসরাইল ছয় বছর ধরে বেআইনি অবরোধ চাপিয়ে রেখেছে। ফলে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে গাজাবাসী। এর মধ্যে ২০০৮ সালে ইসরাইল ভয়াবহ হামলা চালিয়ে গাজাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল। তখন প্রাণ ও সম্পদের ক্ষতি হয় অপরিমেয়। এমনকি রাসায়নিক অস্ত্রও ব্যবহার করেছে ইসরাইল। তাই আজো গাজায় জন্ম নিচ্ছে পঙ্গু শিশু।
গাজার ব্যাপারে ইসরাইল ও ফিলিস্তিন শর্তসাপেক্ষে সমঝোতায় এসেছে। চারটি শর্ত ইসরাইল আর দু’টি শর্ত ফিলিস্তিনের বেলায় প্রযোজ্য। শর্ত হলো, ইসরাইল (১) নৌ, স্থল বা আকাশপথে গাজা উপত্যকায় কোনো প্রকার আগ্রাসন চালাবে না। (২) সীমান্তে কোনো গুলিবর্ষণ করবে না। (৩) ফিলিস্তিনি নেতাদের ‘পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড’ ঘটাবে না। (৪) যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই এই উপত্যকার সব ক্রসিং খুলে দেবে। গাজায় লোকজনের যাতায়াত কিংবা পণ্য আনা-নেয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা সৃষ্টি করতে পারবে না। অন্য দিকে ফিলিস্তিনিরা (১) ইসরাইলের দিকে মিসাইল ও রকেট ছুড়বে না। (২) সীমান্তে ইসরাইলি নাগরিকদের ওপর হামাস সরকার হামলা চালাবে না।
সম্প্রতি হামাস সামরিক বিভাগ প্রধান আহমদ জাবারিকে এমন একসময়ে হত্যা করা হয়, যখন গাজায় উত্তেজনা ছিল না। বরং ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীর ভূমিকায় মনে হচ্ছিল, তারা গাজায় নয়, গৃহযুদ্ধ-জর্জরিত সিরিয়া সীমান্তে হামলা চালাবেন। তাই গাজায় তখন স্বস্তিপূর্ণ স্বাভাবিক পরিস্থিতি। জাবারি সামরিক তৎপরতায় নিয়োজিত থাকাকালে নিহত হননি। এবার যুদ্ধবিরতি চুক্তির যে চারটি শর্ত ইসরাইলের ওপর প্রযোজ্য, এর তৃতীয় শর্ত হলোÑ তারা ফিলিস্তিনি নেতাদের ‘পরিকল্পিতভাবে’ হত্যা করবে না। বিশেষত জাবারির হত্যাকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে এটা উল্লেখ করা হয়েছে। ইসরাইলি কলামিস্ট উরি আভনারির ভাষায়, পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের ইসরাইলি নাম ‘টার্গেট করা প্রতিরোধ’ অথবা ‘উচ্ছেদ’। এই আইটেম অলিম্পিকে থাকলে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, মোসাদ শিনবেত সোনার মেডেল পেত বলে আভনারি লিখেছেন। জাবারির ‘অপরাধ’ ইসরাইলি সৈন্য গিদ শালিতকে পাঁচ বছর লুকিয়ে রাখার পেছনে তিনিই। অথচ শালিতের মুক্তির মধ্যস্থতাকারী গেরশন বাসকিন জাবারি হত্যার পরদিনই জানালেন, এই হামাস নেতা দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধবিরতি চেয়েছেন। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তার সাথে বাসকিনের যোগাযোগও ছিল।
মার্কিন মতলব ও মিসরের মুরসি
মাত্র কয়েক মাস আগে নির্বাচিত মিসরীয় প্রেসিডেন্ট ড. মোহাম্মদ মুরসি গাজায় যুদ্ধবিরতির নায়ক হিসেবে আখ্যা পেয়েছেন। তিনিই সবার আগে উদ্যোগ নেন, যাতে ইসরাইল ও হামাস অবিলম্বে সমঝোতায় উপনীত হয়ে অস্ত্রসংবরণ করে। মুরসি কয়েক দফা বৈঠক করেন উভয় পক্ষের সাথে। তবে প্রত্যাশিত সময়ের এক দিন পরে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়েছে। তবুও তিনি সন্তুষ্ট এবং দুই পক্ষের কাছে এ জন্য কৃতজ্ঞ বলে জানান। গাজায় হামলা বন্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব তার সহায়ক ভূমিকা রেখেছেন। বড়জোর কিছুটা ত্বরান্বিত করেছেন যুদ্ধবিরতিকে। মিসরের এ অবস্থানে ব্যক্তি হিসেবে মুরসির গ্রহণযোগ্যতা এবং দেশ হিসেবে মিসরের মর্যাদা বেড়েছে। তা ছাড়া ব্রাদারহুডকে যারা ইসরাইলের চরম বিরোধী ‘কট্টরপন্থী’ মনে করেন, তাদের ধারণা বদলানোর মতো অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। গাজায় শান্তি স্থাপনে মিসর ভবিষ্যতেও কাণ্ডারির ভূমিকা নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এবারকার যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে বিবদমান দুই পক্ষের পালনীয় মোট ছয়টি শর্তের উল্লেখ আছে।
কিন্তু ইসরাইল চুক্তি স্বাক্ষর করার পর দুই দিন না যেতেই গাজা সীমান্তে গুলি চালিয়ে একজন ফিলিস্তিনিকে হত্যা এবং নয়জনকে আহত করে। এমন একটা ঘটনা সত্ত্বেও ইসরাইলের দাবি, এর মাধ্যমে অস্ত্রবিরতি চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করা হয়নি। তবে এ ঘটনায় চুক্তির স্থায়িত্ব ও বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
গাজায় ইসরাইলি ধ্বংসযজ্ঞের ঘটনায় মার্কিন ডাবল স্ট্যান্ডার্ড বা দুই মুখো নীতি আবার প্রকটভাবে উন্মোচিত হয়েছে। ওবামা নিজেকে শান্তিকামী ও অনাগ্রাসী হিসেবে তুলে ধরেছেন এবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারাভিযানে। ইরানে হামলার ব্যাপারে ইসরাইলসহ ইহুদি লবির সাথে ভিন্ন মত পোষণ করে ওবামা নিজের ইতিবাচক ইমেজ গড়ে তুলেছিলেন, বিশেষ করে মুসলিম ভোটারদের মাঝে। অপর দিকে, তার প্রতিদ্বন্দ্বী মিট রমনি ইহুদিদের দরদি হিসেবে অভিযোগ আনলেন, ‘ওবামা আমাদের বিশ্বস্ত মিত্র ইসরাইলের পাশে দাঁড়াচ্ছেন না।’ সেই ওবামা নির্বাচনে জিতে দ্বিতীয়বার কর্ণধার হলেন বৃহত্তম বৃহৎ শক্তির। এরপরই কালো মানুষটির মুখে ভালো ভালো কথাগুলো আর শোনা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত একটা কথা, ‘গাঙ পার হলে নাইয়া শালা’। নির্বাচনের কয়েক দিন পর এবং ইসরাইল যখন গাজায় আবার আগ্রাসনের প্রস্তুতি শেষ করে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, তখন বারাক ওবামা বললেন, ‘ইসরাইলেরও বাঁচার অধিকার আছে।’
আজ যদি ইসরাইল এমন কোনো রাষ্ট্রের নাম হতো যে নিরীহ, শান্তিপ্রিয়, দুর্বল ও বিপন্ন; বলদর্পী আগ্রাসী শক্তি যাকে আক্রমণ করছে, তাহলে ওবামার এ কথাটি যুক্তিযুক্ত হতো। ইসরাইল পারমাণবিক শক্তিধর দেশ, যে শক্তি কোনো আরব দেশের নেই। এমনকি ইরানেরও নেই এই বোমা। অথচ সেটা ইহুদি রাষ্ট্রটি অনেক আগেই বানিয়েছে এবং তা সম্ভব করেছে ওবামার দেশ যুক্তরাষ্ট্রই। ইসরাইলের অন্যায় প্রতিষ্ঠা ফিলিস্তিনিদের সহিংসভাবে উচ্ছেদ করে। তার নারকীয় আগ্রাসনের শিকার হয়েছে লেবানন। এখনো তার দখলে জর্ডানের একাংশ। ইসরাইলি হামলায় ধ্বংস হয়েছে ইরাক-সিরিয়ার পরমাণু স্থাপনা। তার মিসাইল হাজার মাইল দূরের মুসলিম রাষ্ট্রেও ধ্বংস ঘটাতে সক্ষম। ইসরাইল চরম বর্ণবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা এবং সম্প্রসারণবাদ ও আধিপত্যবাদের প্রতীক ও প্রতিভু। এমন একটি অপরাষ্ট্রশক্তিকে ওবামা মূলত মদদ দিলেন গাজায় আবার ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যা ঘটাতে। ওবামা তো জানেন, ১৯৮২ সালে লেবাননে ফিলিস্তিনিদের সাবরা ও শাতিলা শিবিরে ইসরাইলের গণহত্যাযজ্ঞ আধুনিক বিশ্বের নজিরবিহীন কলঙ্ক।
আর ওবামার পররাষ্ট্রমন্ত্রী অর্থাৎ মার্কিন সরকারে ওবামার পরই যার অবস্থান, সেই হিলারি গাজা ইস্যুতে অবতীর্ণ হলেন ‘হিলার’ (Healer) বা নিরাময়কারিণীরূপে। শান্তিদূতীর সে কী দৌড়ঝাঁপ! তিনি ইসরাইল গেলেন কয়েক দিনের ভয়াবহ হামলায় গাজা বিধ্বস্ত হওয়ার পর, এর আগে নয়। মিডিয়ায় ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট আব্বাসের আশাবাদ দেখা গেল, ‘হিলারির এই সফরকালেই গাজায় হামলা বন্ধ হবে।’ অর্থাৎ ‘শান্তির দেবী’ ছাড়া কেউ ইসরাইলকে শান্ত করতে পারবে না। আমেরিকা ফিলিস্তিনিসহ আরব বিশ্ব এবং অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রকেও বোঝাতে চেয়েছে যে, “ফিলিস্তিনে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং এই ইস্যুর ‘সুরাহা’র জন্য ওয়াশিংটনের দ্বারস্থ না হয়ে উপায় নেই। অতএব, স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের খায়েশ ছেড়ে আমেরিকার কথা মতো ইসরাইলের আবদারগুলো মেনে নাও।” ফিলিস্তিন প্রশ্নে আমরা বারবার দেখছি, যুক্তরাষ্ট্র ‘সর্প হইয়া দংশন করে, ওঝা হইয়া ঝাড়ে।’

আমেরিকা শান্তিপ্রয়াসের নামে বহু দিন ধরে ইসরাইলকে সুযোগ দিচ্ছে অশান্তি জিইয়ে রাখার। এবার গাজায় (আপাত) শান্তি আনার কৃতিত্ব নিতে চেয়ে ওবামা-হিলারি ধাক্কা খেলেন মিসরের মুরসির কারণে। বিশ্ব দেখেছে, মিসর এবার সত্যিকার আঞ্চলিক মুরব্বির ভূমিকা সাফল্যের সাথে পালন করেছে। মার্কিন বশংবদ মোবারকের আমলে যা সম্ভব হয়নি, তা হলো ইসলামপন্থী ব্রাদারহুড নেতার এই আমলে। মিসরের এই প্রশংসনীয় ভূমিকায় তুরস্ক ও মালয়েশিয়ার মতো প্রভাবশালী মুসলিম রাষ্ট্র আঞ্চলিক সঙ্কটে মধ্যস্থতা করার আরো প্রেরণা পাবে আশা করা যায়।
আজকের হামাস : অতীতের প্রেক্ষাপট
গাজার নিয়ন্ত্রণ হামাসের হাতে। তারা এটা জবরদখল করেনি। সেখানকার শুধু নয়, ‘ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ’-এর আওতাধীন পশ্চিম তীরসহ গোটা এলাকায় হামাস নির্বাচনে গণরায় পেয়েছিল দেশ শাসনের। কিন্তু বাইরের ইহুদি মার্কিন চক্রান্ত আর ভেতরে মাহমুদ আব্বাসদের বিদ্বেষ-বৈরিতার দরুন হামাস ফিলিস্তিনিদের সরকার পরিচালনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলো। গণতন্ত্রের প্রবক্তা আমেরিকা এবং তার নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দুনিয়ার কাছে অসৎ, অযোগ্য, দুর্নীতিবাজ, আপসকামী আল ফাতাহ তথা পিএলও নেতারা হামাসের সৎ, যোগ্য, জনসেবক, আদর্শবাদী নেতৃত্বের চেয়ে অনেক বেশি প্রিয়। কারণ, মাহমুদ আব্বাস গং সেক্যুলার এবং ইসরাইল-আমেরিকাকে তোয়াজ করে চলে। অপরদিকে ইসমাইল হানিয়ারা ইসলামি জীবনব্যবস্থায় একনিষ্ঠ আস্থাবান এবং সে কারণে ইহুদিবাদ ও এর মুরব্বিদের কাছে নতজানু হতে নারাজ। তাই ইসরাইল হামাসকে ফিলিস্তিন মুক্তি সংগ্রামের অনমনীয় শক্তি মনে করে তাদের টার্গেট করেছে হত্যা, ধ্বংস ও নির্যাতনের। হামাসের তুলনায় আব্বাস ও তার পিএলও ইসরাইলের কাছে অনেক কম বিপজ্জনক এবং আমেরিকার কাছে অনেক বেশি পছন্দের। ইসরাইলের উপলব্ধি, ইহুদিবাদের সর্বপ্রধান দুশমন ইসলাম, আর হামাস এর চেতনায় উজ্জীবিত। যুক্তরাষ্ট্রের যুক্তি, হামাস মৌলবাদী আর পিএলও সেক্যুলার। তাই হামাস যাতে কোনো দিন ফিলিস্তিন জনগণের মূল নেতৃত্বরূপে প্রতিষ্ঠিত ও স্বীকৃত হতে না পারে, সেজন্য ওয়াশিংটন-তেল আবিব চেষ্টার ত্রুটি করছে না।
হামাস নিয়ে আমার স্মৃতি থেকে কিছু কথা বলছি। সম্ভবত ১৯৮৭ সালের শেষ দিকে হামাস গঠিত হয়। তবে এর নাম প্রথম দু-এক বছর বাংলাদেশে প্রায় অজানা ছিল। কারণ তখনো এর সংগঠন গড়ে তোলার প্রক্রিয়া চলছিল এবং বাইরের প্রকাশ্য তৎপরতা তেমন শুরু হয়নি। ১৯৮৮ সালে একজন সিনিয়র সাংবাদিক জানান, ইয়াসির আরাফাতের আল ফাতাহর পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের আরেকটি মুক্তিসংগ্রামী সংগঠন যাত্রা করেছে। তারা ইসলামি আদর্শে আস্থাবান এবং আপসকামিতার বিরোধী। হামাসের সমর্থক ছিলেন বাংলাদেশে অধ্যয়নরত ফিলিস্তিনি ছাত্রদের মাঝেও। তাদের একজন সংগঠক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। তার সাথে আলাপে হামাস তথা ফিলিস্তিনের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারি। অন্যদের মতো আমার কাছেও ‘হামাস’ নামটি ছিল একেবারে নতুন। ওই ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থী জানিয়েছিলেন, আসলে এটা হলো সংগঠনটির পুরো নামের সব ক’টি শব্দের আদ্যাক্ষরের সমষ্টি। তখন ঢাকায় হামাসের বাংলা লিফলেট বিভিন্ন স্থানে মসজিদে জুমার নামাজ শেষ হওয়ার পর বিলি হয়েছিল প্রচারকাজের অংশ হিসেবে। হামাস কিন্তু ইয়াসির আরাফাত এবং তার সংগঠনবিরোধী বক্তব্য তখন দিত না। বরং শুধু ইহুদিবাদী আগ্রাসন প্রতিরোধ এবং বায়তুল মুকাদ্দাস উদ্ধারে ইসলামি চেতনার ওপর জোর দেয়া হতো। ১৯৮৮ সালে ফিলিস্তিনে হামাসের তৎপরতা শুরুর কিছু দিনের মধ্যেই ঐতিহাসিক ইনতিফাদার সূচনা হওয়া খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
এর আগের এক দশকে ফিলিস্তিনি মুক্তিসংগ্রামের মূল ধারা অর্থাৎ আরাফাতের ‘ফাতাহ’সহ পিএলও কিছুটা আপসকামী হয়ে পড়েছিল। এর পেছনে বিশেষ ভূমিকা ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। এ দিকে ইসরাইলি দখলদারি ও দমননীতি ছিল অব্যাহত। ফলে ফিলিস্তিনিদের মাঝে ক্ষোভ বাড়ছিল এবং অবিসংবাদিত নেতা ইয়াসির আরাফাতের প্রতি আস্থা হ্রাস পাচ্ছিল। যে কারণেই হোক, পিএলওর মূল সংগঠন ফাতাহর আগের সেই লড়াকু মনোভাব আর ছিল না। আরাফাত রণনীতির বদলে কূটনীতি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। মার্কিন উদ্যোগে ‘শান্তিপ্রয়াস’-এর পরিকল্পিত প্রহসন মঞ্চস্থ হচ্ছিল মাঝে মধ্যে। এই প্রেক্ষাপটে রেডিক্যাল হামাসের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ফিলিস্তিনি জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার এবং ইসরাইলি আগ্রাসন মোকাবেলার প্রশ্নে হামাসের বক্তব্য ছিল একই সাথে বলিষ্ঠ ও ঝুঁকিপূর্ণ। তাদের আবির্ভাবে এই ইঙ্গিত ছিল যে, ভবিষ্যতে ফাতাহ বা পিএলও যেমন ফিলিস্তিনিদের একক প্রতিনিধিত্ব করতে পারবে না, তেমনি আরাফাতের পরবর্তী বা বিকল্প নেতৃত্বও গড়ে উঠতে পারে। কৌশলী আরাফাত হামাসের সাথে প্রত্যক্ষ দ্বন্দ্বে লিপ্ত না হয়ে মোটামুটি সহাবস্থান বজায় রেখেছিলেন।
ফিলিস্তিনের সংগ্রাম : জানা-অজানা কথা
১৯৪৮ সালে ইঙ্গ-মার্কিন ষড়যন্ত্র ও সোভিয়েত মদদে অবৈধ ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্ম ‘মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া’ হিসেবে। এর পরপরই ফিলিস্তিনি তথা আরবদের সাথে ইহুদিদের যুদ্ধ বেধে যায়। এটা ফিলিস্তিনিদের কাছে ‘নাকবা’ নামে পরিচিত। পাশ্চাত্যের চক্রান্তে ইসরাইল এই বিরোধিতা কাটিয়ে উঠে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে থাকে। লাখ লাখ ফিলিস্তিনি হাজার বছরের ভিটেমাটি হারিয়ে আশপাশের দেশে উদ্বাস্তু হতে বাধ্য হয়। পরে ১৯৬৫ সালে গঠিত হয় ফিলিস্তিনি মুক্তি সংস্থা (পিএলও)। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ৩২ বছরের এক প্রকৌশলী, যার ছদ্মনাম আবু ইয়াম্মার। কিছুটা শ্মশ্রুশোভিত, ‘কাফিয়া’ দিয়ে মস্তকাবৃত, ছোটখাটো মানুষটির প্রকৃত নাম ইয়াসির আরাফাত। পিএলও মোর্চায় তার আল ফাতাহর সাথে বামপন্থী একাধিক সংগঠন ছিল। ফাতাহ তখন কিছুটা ইসলামি মনোভাবাপন্ন জাতীয়তাবাদী সংগঠন। পিএলওর গেরিলা তৎপরতার মাঝে ১৯৬৭ সালের জুন মাসে আরব-ইসরাইল যুদ্ধ বাধে। এতে মিসর, জর্ডান ও সিরিয়ার বিশাল ভূখণ্ড ইসরাইল দখল করে নেয়। এমনকি মুসলিম উম্মাহর পয়লা কিবলা বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত ইহুদিদের কুক্ষিগত হয়ে যায়। আরবদের শোচনীয় পরাজয়ের একটা বড় কারণ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের শঠতা। বহুলালোচিত নাসেরের শাসিত মিসর আর বাথ পার্টির শাসিত সিরিয়া তখন সমাজতন্ত্রের নেশায় সোভিয়েত প্রেমে বুঁদ হয়ে ছিল। এসব দেশকে মস্কোর দেয়া সমরাস্ত্র ওই যুদ্ধে অকার্যকর প্রমাণিত হওয়ায় ফিলিস্তিনিসহ আরবদের অনেকের মোহভঙ্গ ঘটে। তারা উপলব্ধি করেন, পুঁজিবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের প্রত্যক্ষ মদদগার, আর সমাজবাদী সোভিয়েত মহারাষ্ট্র ওদের পরোক্ষ দোসর। যুদ্ধের পরাজয় মিসরের প্রেসিডেন্ট নাসেরের আমৃত্যু হতাশা এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদুল হাকিম আমরের আশু আত্মহত্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তখন আরাফাতের আল ফাতাহ সোভিয়েত সমর্থক মহল, তথা বামপন্থীদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখত। ১৯৬৯ সালে ফাতাহ নেতা আবু মুনিরের তদানীন্তন পাকিস্তান সফরকালে সমাজতন্ত্রীদের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কথা অনেকের স্মরণে থাকার কথা। অবশ্য, পরবর্তী দুই দশকে সেই ফাতাহ ও এর নেতা আরাফাত বেশ কিছুটা সেকুলার হয়ে পড়ায় ইসলামপন্থীদের মনে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়। তা ছাড়া, আরাফাতকে ‘উদার’ এবং ইসলামপন্থীদের ‘উগ্রপন্থী’ হিসেবে চিত্রিত করার প্রয়াস দীর্ঘ দিন চলেছিল।
যে ইসরাইল ’৬৭ সালের যুদ্ধে সম্মিলিত আরব সমর শক্তিকে নাস্তানাবুদ করে পশ্চিম তীর, গাজা, সিনাই, গোলান দখল করে নিয়েছিল, ’৮৯ সালের ইনতিফাদা তার মহাউদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ‘ইনতিফাদা’ মানে গণজাগরণ বা গণ-অভ্যুত্থান। নবগঠিত হামাস এর নেপথ্যে বিরাট ভূমিকা রেখেছিল। এটা ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র ভালো করেই জানত। ইনতিফাদা চলতে থাকে বছরের পর বছর। এ অবস্থায় হামাসকে ইসরাইল টার্গেট করে নিধন ও নির্মূল করার জন্য। মোসাদ ও সিআইএ বুঝতে পেরেছিল, অবিলম্বে প্রচণ্ড আঘাত না হানলে উদীয়মান হামাস ভবিষ্যতে অপ্রতিরোধ্য হয়ে দাঁড়াবে। তাই নীলনকশা মোতাবেক এর প্রধান নেতা এবং আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব শায়খ আহমদ ইয়াসিনকে ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে হত্যা করা হয়। আশীতিপর ইয়াসিন ছিলেন চলচ্ছক্তিরহিত। ফজরের নামাজের সময় মসজিদের কাছে তিনি নিহত হন। তার উত্তরসূরি আবদুল আজিজ রানতিসিকে একই বর্বরোচিত পন্থায় হত্যা করা হলো মাত্র এক মাসের ব্যবধানে। এই পটভূমিতে হামাসের জনপ্রিয়তা বেড়ে গেল ফিলিস্তিনিদের মাঝে। অপর দিকে ‘বৃদ্ধ সিংহ’ আরাফাত ক্রমশ নিস্তেজ হওয়া ছাড়াও ‘পাশ্চাত্যপন্থী’ হিসেবে অভিহিত হতে থাকেন। এমনতরো পটভূমিতেই ফিলিস্তিনিদের প্রথমে স্থানীয় সরকার, পরে জাতীয় সরকার নির্বাচনে হামাসের অভাবনীয় সাফল্য এবং এর কিছু পরে হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজায় ইসরাইলের নারকীয় হামলা ও হত্যাযজ্ঞের ঘটনা মূল্যায়ন করতে হবে।
যুদ্ধবিরতি শান্তির গ্যারান্টি নয়
গাজায় তো যুদ্ধবিরতি হলো। সে জন্য সমঝোতা চুক্তি হয়েছে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে। সবাই জানে, গাজায় এবার যেভাবে যুদ্ধ শুরু হলো, তা কোনো বিচ্ছিন্ন বা আকস্মিক কিংবা নতুন ঘটনা নয়। বহু বছরের সঙ্কট ও সঙ্ঘাতের একটি ুদ্র অংশ মাত্র। গোলাগুলি, মিসাইল-মারণাস্ত্রের মহাতাণ্ডব থেমে যাওয়ায় সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। কিন্তু এবারের হামলা-পাল্টাহামলাই কি গাজার শেষ লড়াই কিংবা ইসরাইলের সর্বশেষ আগ্রাসী আক্রমণ? কেউ তা মনে করে না। অতীত অভিজ্ঞতা ইহুদিবাদী শক্তিকে মহাষড়যন্ত্রকারী, শান্তির শত্রু ও ধ্বংসের প্রতীক হিসেবেই চিনতে শেখায়। সেই ইসরাইলের যদি সুমতি হয়, সবার মঙ্গল। আর যদি পালন নয়, লঙ্ঘনের মতলবে যুদ্ধবিরতি চুক্তি করে থাকে, তাহলে গাজাবাসীই শুধু বিপন্ন হবে না, নিজেদেরও বিপদ ডেকে আনবে। এবার একটি আরব ও মুসলিম রাষ্ট্রের ইসলামপন্থী রাষ্ট্রপ্রধানের সমঝোতা-উদ্যোগে সাড়া দেয়ায় ইসরাইলের ব্যাপারে শান্তিকামীদের যতটুকু আশা জেগেছে, তারা এটাকে ধুলায় মিশিয়ে না দিক, সর্বান্তকরণে এটাই আমাদের কামনা।
এ তো গেল আশাবাদের কথা। এর বিপরীতে হতাশার হেতুও কম নয়। গাজায় রসায়নশাস্ত্রের Chain Reaction- এর মতো ধারাবাহিকভাবে (যদিও মাঝে বিরতি থাকে) ‘ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া-পাল্টা প্রতিক্রিয়াÑ আবার প্রতিক্রিয়া-পুনরায় প্রতিক্রিয়া’, এসব ঘটতে থাকে দুই পক্ষের মাঝে। বছরের পর বছর এভাবে চলে আসছে। ইসরাইলের প্রখ্যাত শান্তিবাদী পার্লামেন্টারিয়ান ও আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত কলামিস্ট উরি আভনারি ওই বিষয়টি তুলে ধরে এবার তার কলাম শুরু করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, এবার যে বড় ঘটনার পর গাজা সীমান্ত বেশি তপ্ত হয়েছে, হামাস কমান্ডার আহমদ জাবারির সেই হত্যাকাণ্ড হঠাৎ ঘটেনি। ইসরাইল তাকে টার্গেট করেছিল আগেই। তার মতো দক্ষ ও চৌকস সেনানায়ককে খুনের জন্য যাবতীয় গোয়েন্দা তথ্য জোগাড় করে হত্যার সুযোগের অপেক্ষায় ছিল ইসরাইল।
একজন ইহুদি হয়েও উরি আভনারি তীব্র সমালোচনা করলেন গাজায় ইসরাইলি অপারেশন পিলার অব কাউড (মেঘের স্তম্ভ)-এর। হামাস প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘The real remedy is peace. Peace with the Palestinian people. Hamas has already solemnly declared that it would respect a peace agreement concluded by the PLO¾ i.e. Mahmud Abbas¾ that would establish a Palestinian state along with 1967 borders, provided this agreement were confirmed in a Palestinian referendum. Without it, the bloodletting will just go on, round after round forever.’ (এ সঙ্কটের প্রকৃত প্রতিকার শান্তির মাঝে নিহিত। সে শান্তি ফিলিস্তিনি জনগণের ক্ষেত্রে। হামাস ইতোমধ্যেই গুরুত্বের সাথে ঘোষণা করেছে, তারা পিএলওÑ উদাহরণস্বরূপ মাহমুদ আব্বাস কর্তৃক সম্পাদিত শান্তিচুক্তির প্রতি সম্মান জানাবে, যার মাধ্যমে ১৯৬৭ সালের সীমান্ত বরাবর ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে। শর্ত হলো, ফিলিস্তিনিরা গণভোটে এর অনুমোদন দেবে। এটা ছাড়া শুধু রক্তপাতই অব্যাহত থাকবে, এক পালার পর অন্য পালা। এভাবে চিরদিন।
সবই শান্তি চায় ফিলিস্তিনে। এই ইস্যু শুধু মধ্যপ্রাচ্যে নয়, আধুনিক বিশ্বে অশান্তির সবচেয়ে বড় কারণ এবং বিদ্যমান আন্তর্জাতিক সঙ্কটগুলোর মধ্যে সর্বাধিক দীর্ঘস্থায়ী। বাস্তবতা হলো, ইসরাইল না চাইলে শান্তি আসবে না। গাজায় একের পর এক খোঁড়া অজুহাতে সর্বাত্মক আগ্রাসন এবং নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসতাণ্ডব চালিয়ে কি শান্তি কামনার প্রমাণ দেয়া যায়? ইসরাইলের মানবাধিকার সংগ্রামী উরি আভনারির প্রশ্ন : শান্তিই সঙ্কটের সমাধান। কিন্তু ‘মেঘের স্তম্ভ’ অপারেশনের মেঘ দৃষ্টিশক্তি ঢেকে দিলে কেউ কি শান্তির পথটি দেখতে পাবে?

দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানেই শান্তি নিহিত



ইসরায়েল-ফিলিস্তিন
 হারলেম ব্রান্ডল্যান্ড জিমি কার্টার
সম্প্রতি ইসরায়েলে পরিচালিত রকেট হামলা ও গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলার ঘটনায় পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, মধ্যপ্রাচ্যে বিরাজমান পরিস্থিতি ইসরায়েল বা ফিলিস্তিন কারও জন্যই মঙ্গল বয়ে আনবে না। বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে আলোচনা শুরু হওয়ার সম্ভাবনাও তেমন নেই বললেই চলে। বর্তমান পরিস্থিতির মোড় ঘোরানোর জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করার প্রয়োজন পড়বে। আমরা প্রবীণরা মনে করি, জাতিসংঘে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতির উদ্যোগের মুহূর্তটি সে ধরনের একটি সুযোগ। ২৯ নভেম্বর জাতিসংঘে ফিলিস্তিনকে 'অসদস্য পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র মর্যাদা'দানের ওপর ভোটাভুটি হবে। এতে ফিলিস্তিনের সত্তার পর্যায় থেকে মর্যাদা উচ্চমাত্রায় লক্ষণীয়ভাবে উন্নীত হবে। আমরা এর পক্ষে ভোট দেওয়ার জন্য প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানাই।
জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে গিয়ে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস নিশ্চয়ই কোনো প্ররোচনামূলক বক্তব্য দেবেন না। তিনি বিশ্বাস বা আস্থা নষ্ট হওয়ার মতো কিছু করা থেকে যেমন বিরত থাকবেন, তেমনি প্রত্যাশা অনুযায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা থেকে সরে আসবেন না।
এই ভোট অবশ্যই আইনের শাসন ও মানবাধিকারের পক্ষে। টেকসই ও ইসরায়েলের প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতির পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও বাদবাকি বিশ্বের যে দশকের পর দশক ধরে অঙ্গীকার তার সঙ্গে এটা পুরোপুরি সাযুজ্যপূর্ণ। এটা জাতিসংঘের অতীতে নেওয়া প্রস্তাবগুলো ও আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ একটি আইনসম্মত, শান্তিপূর্ণ ও কূটনৈতিক উদ্যোগ। যদিও এটা স্পর্শকাতর ভোট, তবুও অনেক রাষ্ট্র এ সময় হয় অনুপস্থিত থাকতে পারে অথবা বিরুদ্ধে ভোট প্রদান করতে পারে। আর এই প্রস্তাব যদি ভোটে হেরে যায়, তাহলে দুই রাষ্ট্র তত্ত্বের মৃত্যু হবে এবং তখন আমরা এক রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের দিকে ধাবিত হবো। আর এটা হবে একটা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত পরিস্থিতি এবং এর ফলে ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি উভয়ের জন্যই বিপর্যয়কর পরিণতি বয়ে আনবে।
এক রাষ্ট্র ফলাফলের পরিণতি কেমন হতে পারে তা আমরা অনুমান করে নিতে পারি। এর একটা অর্থ হতে পারে, ইসরায়েল পুরো পশ্চিম তীর দখল করে ফিলিস্তিনিদের ইসরায়েলিদের সমান ভোটাধিকার প্রদান করবে। তখন তো ইসরায়েলিরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হবে। অথবা এমন হতে পারে যে, ইসরায়েলিরা ফিলিস্তিনিদের সমানাধিকার দিল না। এ ধরনের একটা পরিস্থিতি ফিলিস্তিন বা ইহুদি জনগোষ্ঠী কারও কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে না এবং বিশেষ করে ফিলিস্তিনিদের জন্য মর্যাদাকরও হবে না। এতে কোনো পক্ষেরই নিরাপদ নিজ আবাসভূমির স্বপ্ন পূরণ হবে না। বিশেষ করে ইহুদি জনগোষ্ঠীর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে না।
অন্যদিকে, জাতিসংঘে ফিলিস্তিনিকে রাষ্ট্র মর্যাদাদানের পক্ষে ভোট দিয়ে একে জয়যুক্ত করলে বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ এবং এমনকি সাধারণ ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিরাও সমস্বরে একে স্বাগত জানাবে। দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানই হলো মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার নিশ্চিত পথ। মাস দুই আগে আমরা একত্রে পূর্ব জেরুজালেমের জলপাই পাহাড়ে ওগস্তা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হাসপাতালের মাঠে দাঁড়িয়েছিলাম। এই মেডিকেলটি ফিলিস্তিনিদের একটি চমৎকার ক্যান্সার চিকিৎসা কেন্দ্র এবং এটি পশ্চিম তীর থেকে কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত। তবে এই হাসপাতালে ফিলিস্তিনিদের চিকিৎসা সেবা নিতে হলে ইসরায়েলিদের কাছ থেকে ছাড়পত্র নিতে হয়।
আমরা হাসপাতালের ওই এলাকা থেকে পশ্চিম তীরজুড়ে ইহুদি বসতি ও ইসরায়েলের স্থাপিত তারের বেড়া দেখতে পেলাম। এখানে-ওখানে উঁচু উঁচু দেয়াল ও সড়ক বসতিগুলোকে ফিলিস্তিনিদের থেকে পৃথক করে রেখেছে। এভাইে আরব-ইসরায়েলিদের মধ্যে পার্থক্য রেখা টানা ক্রমবর্ধমানভাবেই চলছে। পূর্ব জেরুজালেম ও পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি বিস্তারের হার হতবুদ্ধিকর। ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে ৫ লাখের মতো ইহুদি ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে বসতি গড়ে তুলেছে। ১৯৯৩ সালে অসলো শান্তি চুক্তি হওয়ার পর এ ধরনের ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। আরও হাজার হাজার বসতবাড়ি নির্মাণ করা হচ্ছে বা নির্মাণ পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে। অসলো শান্তি প্রক্রিয়া শুধু স্থবিরই হয়ে পড়েনি, এর পশ্চাৎমুখী যাত্রা দ্রুততর হচ্ছে। প্রতিটি ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীর আবাস গড়ার জন্য এক একটি ফিলিস্তিনি পরিবারকে তাদের নিজেদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ ও ওই বাড়িঘর বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিতে হয়েছে। এভাবে ফিলিস্তিনিদের যে ভূখণ্ড দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল বা যে অংশ নিয়ে ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা ছিল সেটা এখন আর একই অবস্থায় নেই।
জাতিসংঘ প্রস্তাবের পক্ষে ২৯ নভেম্বর ভোট প্রদান করার মাধ্যমে দুই রাষ্ট্র ব্যবস্থার পক্ষে একটা রক্ষাকবচ তৈরি হতে পারে এবং এর ফলে আলোচনার দরজাও খুলবে। আমরা আরও আশা করি, ফিলিস্তিনের ওপর অর্থনৈতিক শাস্তিমূলক যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে সেগুলো তুলে নেওয়া হবে এই পদক্ষেপকে ফলপ্রসূ করার স্বার্থেই। কেউ কেউ ভোট বিলম্বিত করার কথা বলেছেন। কিন্তু এতে কোনো সুফল অর্জিত হবে না।
ফিলিস্তিনিদের মধ্যে বিরাজমান হতাশা ও ইসরায়েলদের মধ্যে ক্লান্তির যে ছায়া রয়েছে তাকে দূর করতে হলে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেই এগিয়ে আসতে হবে। আমরা জানি, অনেক ইসরায়েলি আমাদের মতো একই মনোভাব পোষণ করেন। তারাও চান দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান। এর মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে বলে আমাদের মতো তারাও মনে করেন। আর এটা ইসরায়েলের মৌলিক স্বার্থের পক্ষেও বটে। আমরা যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, আরব রাষ্ট্রগুলোকে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানকে কার্যকর করার জন্য একযোগে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাই।

লেখকদ্বয় : হারলেম ব্রান্ডল্যান্ড অসলো শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের সময় নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং জিমি কার্টার ১৯৭৮ সালে ক্যাম্পডেভিড চুক্তি ও ১৯৭৯ সালে মিসর-ইসরায়েল শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। খালিজ টাইমস থেকে ভাষান্তর সুভাষ সাহা