শুক্রবার, ৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

আরব গণজাগরণে অনুপ্রাণিত যুক্তরাষ্ট্র

আরব গণজাগরণে অনুপ্রাণিত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে একটি নীরব বসন্ত বা গণআন্দোলন গড়ে উঠছে। আরব বসন্তের ফলে ইতোমধ্যেই মিসর, তিউনিসিয়া ও লিবিয়ায স্বৈরশাসকের পতন ঘটেছে এবং আরো কয়েকটি দেশে আন্দোলন চলছে। যুক্তরাষ্ট্রে এই নীরব বসন্ত এমন একসময় শুরু হয়েছে যখন দেশটির অর্থনীতি ক্রমশ বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এবং জনমনে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হচ্ছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাখায় ভর করে এবং মিসরীয় বিপ্লব ও আরব বসন্তের মতো করেই ছোট আকারে কিন্তু চোখে পড়ার মত করে গ্রাউন্ড জিরোর সন্নিকটে এই নেটওয়ার্কে গড়া আন্দোলন দানা বেঁধে উঠছে।
নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে বিশ্বের অর্থনৈতিক রাজধানীতে জনগণের এ আন্দোলন গড়ে উঠছে। ম্যানহাটনে রয়েছে ওয়াল স্ট্রিট এবং মার্কিন ও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের অফিসসমূহ। গত তিন সপ্তাহ ধরে বৃষ্টি ও শীত উপেক্ষা করে বিক্ষোভকারীরা ওয়াল স্ট্রিটের কাদের একটি পার্কে অবস্থান করছে।
১৭ সেপ্টেম্বর থেকে ওয়াল স্ট্রিট বিরোধী নামে তাদের এই প্রতিবাদ বিক্ষোভ শুরু হয়। ম্যানহাটনের কাছে তাঁবু গেড়ে বসা এই প্রতিবাদকারীদের বিক্ষোভ মূলত অসাধু ব্যাংকারদের বিরুদ্ধে বলে মনে হয়। ম্যানহাটনেই রয়েছে অধিকাংশ ব্যাংকের প্রধান অফিস। অসাধু ব্যাংকারদের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে এবং এজন্য সমাজে বৈষম্যের সৃষ্টি হচ্ছে। এই অর্থনৈতিক মন্দার কারণে হাজার হাজার মানুষ বেকার ও গৃহহীন হয়ে পড়ছে। এসব কিছুর জন্য দায়ী অসাধু ব্যাংকারদের কারসাজি বলে মনে করে বিক্ষোভকারীরা।
একজন বিক্ষোভকারী বলেন, আমেরিকা তার পথ হারিয়েছে আমি সত্যিকার গণতন্ত্র দেখতে পাচ্ছি না। আমি জনগণের কণ্ঠস্বর শুনতে পাই। এখানে আছে শুধু পুরানো ব্যাধি পুঁজিবাদ এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। ১৩৫টি দেশে ৭শ’ সামরিক ঘাঁটি গেড়ে বসে আছে এই সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। আমি এখানে দেখতে পাচ্ছি যুদ্ধপ্রিয় একটি রাষ্ট্র যা সারাবিশ্বের স্বৈরাচারী শাসকদের সামরিক বাহিনীকে অস্ত্র সজ্জিত করার জন্য হাজার হাজার কোটি ডলার প্রদান করে থাকে। এ ব্যাপারে রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটরা মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। তাদের মধ্যে তেমন পার্থক্য নেই।
ম্যানহাটনের রাস্তায় নেমে যারা বিক্ষোভ করছে তারা বলছে, তারা তাহরির স্কোয়ারের গণজাগরণের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে গণজাগরণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আরব বসন্তের মতো এখানে একটি বসন্ত সৃষ্টি করতে চান।
এদিকে রেডিও তেহরান জানায়, যুক্তরাষ্ট্রে ওয়াল স্ট্রিটে বিক্ষোভকারীরা বলেছে, তাদের এ আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। যুক্তরাষ্ট্রে দারিদ্র্য, বেকারত্ব, কর্পোরেট আগ্রাসন ও সামাজিক বৈষম্য বন্ধের দাবিতে ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ বা ‘ওয়াল স্ট্রিট দখল কর’ গ্রুপের আহবানে এ আন্দোলন চলছে। ওয়াল স্ট্রিট বিরোধী আন্দোলনের সমর্থনে গোটা যুক্তরাষ্ট্রে বিক্ষোভ হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অভিমুখে বিক্ষোভ মিছিল করেছে এবং লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে শুরু করে মেইনের পোর্টল্যান্ড পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকার পার্কগুলোতে তাঁবু গেড়েছেন।
নানা গোষ্ঠী এরই মধ্যে ওয়াল স্ট্রিট বিরোধী আন্দোলনের সমর্থনে সাংগঠনিক বৈঠক করেছে এবং ওয়েব সাইটগুলোতে স্ট্রিমিং ভিডিও ফুটেজ প্রেরণ করে এ আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছে।
ম্যানহাটনে গত রোববারের বিক্ষোভে হাজার হাজার মানুষ অংশ নিয়েছে। বিক্ষোভকারীদের পরণে করপোরেট দানবের মতো পোশাক পরিহিত ছিল এবং মুখে শাদা রঙ মাখানো ছিল। এ ছাড়া তাদের হাতে ছিল নকল ডলার। তারা নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জের সামনে বিক্ষোভ করেছে। শিকাগোর বাণিজ্যিক এলাকায় বিক্ষোভকারীরা ড্রাম বাজিয়ে বিক্ষোভ করেছে।
বোস্টন, সেইন্ট লুইস, ক্যানসাস সিটি, মিসরি এবং লস অ্যাঞ্জলেসসহ অন্যান্য স্থানে বিক্ষোভ হয়েছে। কোথাও কোথাও বিক্ষোভকারীরা তাঁবু গেড়ে অবস্থান করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের মন্দা ও চাকরি নিয়ে অনিশ্চয়তা এ আন্দোলনে ইন্ধন যুগিয়েছে। এছাড়া সপ্তাহান্তে ব্রুকলিন ব্রিজে সাতশ’ বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতার করার ঘটনা এ আন্দোলনকে আরো উস্কে দিয়েছে।
আন্দোলনকারীদের কেউ কেউ নিজেদেরকে টি পার্টি আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত বলে দাবি করছে। তবে অনেক বিক্ষোভকারী নিজেদেরকে আরব বসন্ত বা আরব বিশ্বের চলমান স্বৈরচার বিরোধী আন্দোলনের দ্বারা প্রভাবিত বলে দাবি করছেন।
সেইন্ট লুইসের বিক্ষোভকারীদের অন্যতম এবং পেশায় কম্পিউটার সিস্টেম এনালিস্ট জ্যাসন কাউন্টস বলেন, আন্দোলনকারীরা বুঝতে পেরেছেন যে ওয়াশিংটনের ক্ষমতার পেছনে কল-কাঠি নাড়ছে ওয়াল স্ট্রিট। এর বিরুদ্ধে মার্কিন জনগণের প্রতিবাদ জানানো উচিত বলে জানান তিনি।
’অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ বা ‘ওয়াল স্ট্রিট দখল কর’ বিক্ষোভের সূচনা হয় গত মাসের ১৭ তারিখে। সে সময় স্বল্প সংখ্যক বিক্ষোভকারী নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জের সামনে তাঁবু গেড়ে অবস্থান ধর্মঘটের চেষ্টা করেছিল। অবশ্য তারপর থেকে এ আন্দোলন আরো দানা বেধে উঠতে থাকে। নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জের কাছে একটি পার্কে শত শত বিক্ষোভকারী তাঁবু গাড়েন। অবস্থান ধর্মঘটকারীদের চিকিৎসা ও আইনগত সেবার ব্যবস্থা করা হয়। বিক্ষোভকারীরা ‘অকুপাইড ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’ নামে একটি দৈনিক প্রকাশ করতে থাকে।
গত মাসের ২৪ তারিখে প্রায় একশ’ বিক্ষোভকারীকে আটক করা হয় এবং তাদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য পানি কামান ছোঁড়া হয়। ব্রুকলিন ব্রিজে বিক্ষোভ মিছিলের চেষ্টা করার সময় গত শনিবারে সাতশ’ বিক্ষোভাকারীকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে আইন ভঙ্গ ও রাস্তা অবরোধের অভিযোগ আনা হয়েছে। এছাড়া, পুলিশ রোববারও পাঁচজনকে আটক করেছে। অবশ্য তাদের বিরুদ্ধে কি অভিযোগ আনা হয়েছে তা এখনো জানা যায়নি।
বড়-সড় বিক্ষোভ মোকাবেলার জন্য এফবিআই ও নিউ ইয়র্ক পুলিশকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন নিউ ইয়র্কের পুলিশের মুখপাত্র টিম ফ্যানলি। তবে গত গ্রীষ্মে ব্রিটেনের সরকার বিরোধী বিক্ষোভ যে রকম সহিংস হয়ে উঠেছিল নিউ ইয়র্কে তেমনটা ঘটবে বলে মনে করছেন না ফ্যানলি। তাই বলে নজরদারি ঢিলে করা হয়নি এবং পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে এফবিআই।
অবশ্য বিক্ষোভাকারীদের প্রতি পুলিশের নিষ্ঠুরতা এরই মধ্যে অনেক আন্দোলনকারীকে হতবাক করে দিয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়ার অকল্যান্ডের উইলজাগো কুক প্রথম দিন থেকেই নিউ ইয়র্কের বিক্ষোভে যোগ দিয়েছেন। তিনি বলেন, পুলিশ যে নিষ্ঠুর আচরণ করবে তা একবারও আন্দোলনকারীদের মনে আসেনি। কিন্তু এ ধরনের আচরণ তাদের চোখ খুলে দিয়েছে এবং আন্দোলনের স্বার্থে যতদিন প্রয়োজন ততদিন নিউ ইয়র্কে থাকবেন বলে দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করেন তিনি।
ব্রুকলিন ব্রিজ থেকে আটক বিক্ষোভকারীদের নিয়ে যাওয়ার জন্য নিউইয়র্কের পুলিশ সেখানকার সিটি বাস চালকদের বাধ্য করেছে। বাস চালকরা পুলিশের এ জবরদস্তির বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট জন স্যামুলসেন বলেছেন, তারা আন্দোলনকারীদের সমর্থন করছেন এবং তারাও মনে করেন মার্কিন ধনীরা জনগণকে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করছেন। বাস চালকদের জোর-জবরদস্তি করে বা হুমকির মুখে বন্দিদের নিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছে তা মোটেও ঠিক করা হয়নি। মার্কিন সরকারের ওপর দেশটির করপোরেটগুলোর বেআইনি প্রভাবের অবসান ঘটনোর দাবিতে কেবল নিউ ইয়র্ক নয়, অন্যান্য স্থানেও আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছে। অ্যাপোলিনা চিল্ডস নামের এক বিক্ষোভাকারী বলেছেন, ডলার কথা বলে, ডলারই শক্তির একমাত্র উৎস হয়ে উঠেছে মার্কিন সমাজে। কিন্তু মার্কিন জনগণ আর ছিন্নমুল মানুষ দেখতে চায়না, চায়না কোনো বুড়ো বা অবসর প্রাপ্ত মানুষ জীবন যুদ্ধে ক্লান্ত হয়ে উঠুক; জনগণ এখন তাদের ন্যায্য অধিকার চাচ্ছে; জনগণ ভোট দেয় ট্যাক্স দেয় কিন্তু এবার ধনীদের কাছ থেকে ট্যাক্স আদায় করা হোক।
মুহম্মদ আলতাফ হোসেন : কলাম লেখক।

ইতিহাসের নির্মম পরিহাস, ‘ওয়াল স্ট্রিট দখল করো’ নামের তৃণমূল আন্দোলনে খোদ যুক্তরাষ্ট্র এখন উত্তাল

পুঁজিবাদের সঙ্কট



নিউইয়র্কের ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলন গত ২৬ নভেম্বর ৬৯ দিন পার করেছে। একই সঙ্গে ওয়াশিংটনের ফ্রিডম প্লাজায় সমবেত হওয়া জনতা পার করেছে ৫২ দিন। এই আন্দোলনের সঙ্গে ইউরোপে যে আন্দোলন হচ্ছে কিংবা তাহরির স্কয়ারের (কায়রো) আন্দোলনের সঙ্গে হয়তো পুরো মিল নেই। কিন্তু মিল আছে এক জায়গায়-তরুণ সমাজ সামাজিক নেটওয়ার্কগুলো ব্যবহার করে এই আন্দোলন গড়ে তুলেছে। প্রশাসনের বিরুদ্ধে তাদের আন্দোলন যত বেশি না, অসমতা, দরিদ্রতা, কিছু ব্যক্তির হাতে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হওয়ার বিরুদ্ধে ক্ষোভটা তাদের বেশি।

নিউইর্য়কের জুকোট্টি পার্কের বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে কায়রোর তাহরির স্কয়ারের বিক্ষোভকারীদের মিলটা এখানেই। জুকোট্টি পার্কের অবস্থান পুলিশ ভেঙে দিলেও বিক্ষোভ সেখানে অব্যাহত রয়েছে। জুকোট্টি পার্কে সমবেত হওয়া অনেককে বলতে শুনেছি তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারছে না টিউশন ফি বেড়ে যাওয়ার কারণে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ৩০ বছর আগে ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যে উচ্চশিক্ষা খাতে যেখানে রাজ্য সরকারের বরাদ্দ ছিল ১০ ভাগ, আজ তার পরিমাণ মাত্র ৭ দশমিক ৫ ভাগ। অথচ ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ছাত্র বেতন বৃদ্ধি করেছে ৯ ভাগ, আর স্টেট ইউনিভার্সিটি বৃদ্ধি করেছে ১২ ভাগ। পরিসংখ্যান আরও বলছে, উচ্চশিক্ষায় বরাদ্দ কমলেও, শুধু জেলখানাগুলোতে বরাদ্দ বৃদ্ধি পেয়েছে, যার পরিমাণ ১১ ভাগ। এই পরিসংখ্যানই বলে দেয় যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে উচ্চশিক্ষা যেখানে সীমিত হয়ে আসছে, সেখানে মানুষের মাঝে অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে, যাদের আশ্রয়স্থল জেলখানাগুলোতে। আমি এর আগে অপর একটি লেখায় (১৪ নভেম্বর) বলেছিলাম যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি বড় ধরনের একটি সঙ্কটকাল অতিক্রম করছে। পৃথিবীর মাঝে সর্বোচ্চ ঋণগ্রস্ত দেশ হচ্ছে এখন যুক্তরাষ্ট্র, যার ঋণের পরিমাণ ১৪ ট্রিলিয়ন ডলার। এর মাঝে ১ দশমিক ১৪ ট্রিলিয়ন ডলার ঋণ রয়েছে চীনের কাছে। অথচ মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার যুক্তরাষ্ট্র খরচ করছে ‘তৃতীয় যুদ্ধ’-এর পেছনে (আফগানিস্তান, ইরাক ও লিবিয়া)। এই চিত্র যে আজ শুধু যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তা নয়। এই সঙ্কট পুঁজিবাদী বিশ্বের সর্বত্র দেখা যাচ্ছে। ইউরোপের অর্থনৈতিক সঙ্কট এক মুদ্রা ‘ইউরো’ ও একই সঙ্গে ইউরোপের ঐক্যকে একটি প্রশ্নের মাঝে ঠেলে দিয়েছে। গ্রিসে সরকারের পতন ঘটেছে। পতন ঘটেছে ইতালিতে বার্লুসকোনি সরকারেরও। এর আগে পর্তুগালেও সরকারের পতন ঘটেছে। আরব বিশ্ব জুড়ে যে গণজাগরণের (আরব বসন্ত) সৃষ্টি হয়েছে, তার পেছনে ক্ষমতাসীন সরকারের একনায়কতান্ত্রিক মনোভাব অনেক অংশে কাজ করেছে এটা সত্য। সেই সঙ্গে তরুণ সমাজের মাঝে বেকারত্ব, অর্থনৈতিক মন্দা, বিশ্বায়ন প্রভৃতিও অনেক অংশে দায়ী।

এ সঙ্কট মূলত পুঁজিবাদের। পুঁজিবাদ, সমাজের মাঝে যে অসমতা, তা দূর করতে পারেনি। পুঁজিবাদী সমাজে অর্থনীতির যে বিকাশ ঘটেছে, তাকে বলা হচ্ছে চষঁঃড়হড়সু; অর্থাত্ সম্পদশালী ধনীশ্রেণীনির্ভর একটি সমাজ। যুক্তরাষ্ট্রের মতো সমাজে ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে, সম্পদ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তির হাতে, যারা করপোরেট হাউস গঠন করে সব ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করছেন। ধনীরাই কংগ্রেস সদস্য হচ্ছেন। সিনেটর হচ্ছেন। আর ধনীদের স্বার্থেই তারা আইন করছেন। যে কারণে দেখা যায় ধনীদের ট্যাক্স কমানো হচ্ছে, আর সাধারণ মানুষের ‘নিরাপত্তা বলয়’ (শিক্ষা ও স্বাস্থ্য) সঙ্কুচিত করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে যে ‘অকুপাই ম্যুভমেন্ট’ হচ্ছে, তার পেছনে কাজ করছে এই চিন্তাধারা। এটা এক ধরনের প্রতিবাদ। ‘বিপ্লবের’ মূল স্পিরিটের সঙ্গে এর মিল আছে। দিনের পর দিন অবস্থান ধর্মঘট করে যে প্রতিবাদ, এই প্রতিবাদ তো এক ধরনের বিপ্লবই। এই বিপ্লব সারা ইউরোপে ছড়িয়ে গেছে। এই বিপ্লব পুঁজিবাদের সঙ্কটকেই উসকে দিল। যদি পরিসংখ্যান নেওয়া যায়, তা হলে দেখা যাবে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজের সঙ্গে (যেখানে ধনী ১ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে যুক্তরাষ্ট্রের মোট সম্পদের ৪০ ভাগ) জার্মানি, ইতালি কিংবা ব্রিটেনের সমাজের কোনো পার্থক্য নেই। পুঁজিবাদ মুষ্টিমেয় কিছু লোককে আরও ধনী হতে সাহায্য করছে। ধনীদের ক্লাব হিসেবে পরিচিত জি-২০-এর দেশগুলো এখন বিশ্ব অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে। মাঝেমধ্যে জি-২০-এর দেশগুলো একত্রিত হয়ে গল্প-গুজব করে, ‘ফটোসেশন’ করে সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কিন্তু বিশ্ব অর্থনীতির উত্থান-পতনে তাদের কোনো সুস্পষ্ট নীতি নেই। তারা কোনো সমাধানও দিতে পারেনি। গ্রিস যখন গেল নভেম্বর মাসে বড় ধরনের সঙ্কটের মাঝে পড়েছিল এবং রাষ্ট্রটি এক রকম দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম হয়েছিল, তখন জি-২০-এর নেতারা ফ্রান্সের কান শহরে (৪ নভেম্বর) ফটোসেশনের জন্য মিলিত হয়েছিলেন। কিন্তু ফলাফল শূন্য। যারা নিউইয়র্ক স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক নওরিল রউবিনির (ঘড়ঁত্রবষ জড়ঁনরহর) লেখনির সঙ্গে পরিচিত, তারা জানেন বিশ্ব অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণকারী এই জি-২০-এর তিনি প্রচণ্ড বিরোধী। তার মতে, জি-২০ পরিপূর্ণভাবে ব্যর্থ। জি-২০ কোনো সমাধান দিতে পারছে না, হাল ধরতে পারছে না বিশ্ব অর্থনীতির। ইউরোপের কোনো কোনো রাষ্ট্র এখন দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম। আরও ঋণ দিয়েও সঙ্কট মোকাবেলা করা যাচ্ছে না। গ্রিস ও ইতালি কঠোর কৃচ্ছ্র সাধনের কথা ঘোষণা করলেও, সাধারণ জনগণ এটা মেনে নেয়নি। তারা এখনও দিনের পর দিন বিক্ষোভ মিছিল করছে। গ্রিসের পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) গ্রিসকে ‘উদ্ধারের’ জন্য যে ঋণ দিয়েছে, তা ছিল শর্তযুক্ত। ওই শর্ত মেনেই আবাসন করের ওপর একটি বিল পাস করেছে গ্রিসের সংসদ। পাশাপাশি কমানো হয়েছে পেনশন, কমানো হয়েছে স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা। গ্রিসের রাস্তায় বিক্ষোভ তাই নিত্যদিনের চিত্র। এ চিত্র আজ ইতালিতেও লক্ষ করা যায়। অর্থনৈতিক সংস্কারের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। ইতালি ও গ্রিসের বাইরে আয়ারল্যান্ড ও পর্তুগালের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বেশ নাজুক। গ্রিসে ২০১০ সালে ঘাটতি ছিল জিডিপির ১৩ ভাগ। আর দেশটির ঋণ পরিস্থিতি জিডিপির একশ’ ভাগকেও ছাড়িয়ে গেছে। ফলে গ্রিসের পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হয়েছিল যে সরকারি কর্মচারীদের বেতন পর্যন্ত দিতে পারছিল না সরকার। এমনি এক পরিস্থিতিতে আইএমএফ ও ইউরো জোনের দেশগুলো ৩ বছরের জন্য ১১০ বিলিয়ন ইউরো ঋণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিল। কিন্তু শর্ত হিসেবে ঘাটতি কমানোর কথা বলা হলে তা মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। আয়ারল্যান্ডে ২০০৯ সালে যেখানে ঘাটতি ছিল জিডিপির ১১ ভাগ, ২০১০ সালে তা উন্নীত হয় ৩১ ভাগে। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য ৮৫ বিলিয়ন ইউরোর একটি ‘উদ্ধার কর্মসূচি’ ঘোষণা করা হয়েছে। পর্তুগালের পরিস্থিতি আরও খারাপ। ২০০৯ সালে ঋণের পরিমাণ ছিল জিডিপির ৭৬ ভাগ। আর ২০১১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১১৫ ভাগে। ফলে ২০১১ সালের মার্চে সেখানে সমাজতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটে এবং পর্তুগালকে ঋণ পরিস্থিতি থেকে উদ্ধারের জন্য ৭৮ মিলিয়ন ইউরো ঋণ গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়। খুব সূক্ষ্মভাবে লক্ষ করলে দেখা যাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত স্বল্পোন্নত দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। বড় অর্থনীতির দেশ হিসেবে পরিচিত জার্মানি কিংবা ফ্রান্স ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কম। এ কারণেই একক মুদ্রা হিসেবে চালু হওয়া ইউরোর ভবিষ্যত্ এখন প্রশ্নের মুখে। ইতোমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে জাতীয় মুদ্রায় পুনরায় ফিরে যেতে। বলা হচ্ছে জাতীয় মুদ্রায় ফিরলে সমস্যার সমাধান হবে। ইউরোপের স্বল্পোন্নত বা গরিব দেশগুলোর ধারণা, ইউরো চালু হওয়ার পর ইউরোপের শক্তিশালী (অর্থনৈতিক দিক থেকে) ও দুর্বল দেশগুলোর মধ্যে একটা ব্যবধান তৈরি হয়ে গেছে। তাদের ধারণা, ইউরো তাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে শক্তিশালী দেশগুলো তাদের অর্থনীতি ধ্বংস করে দিয়েছে। প্যাকেজ ভর্তুকি ও ঋণ দিয়েও সমস্যার সমাধান করা যাচ্ছে না। ফলে নিজ মুদ্রায় ফিরে যাওয়ার দাবি কোনো কোনো মহলে উচ্চারিত হচ্ছে।

‘ইউরো জোন’-এর এই অর্থনৈতিক সঙ্কট, ইউরোপের ঐক্যকে বড় প্রশ্নের মাঝে ঠেলে দিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন টিকবে কি না সেটা একটা বড় প্রশ্ন এখন। অথচ এক সময় ইউরোপীয় ইউনিয়নকে একটা মডেল হিসেবে ধরা হতো। ইতোমধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় আমরা ‘দক্ষিণ এশীয় ইউনিয়ন’ গঠনের কথা শুনেছি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর সমন্বয়ে অদূর ভবিষ্যতে একটি ‘এশীয় ইউনিয়ন’ গঠিত হতে পারে, এমন ধারণাও করেছিলেন কেউ কেউ। এখন ‘ইউরো জোন’-এর সঙ্কটের ফলে নতুন করে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে।

অসমতা আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে আজ বিশ্বব্যাপীই চলছে আন্দোলন। চিলিতে (সান্তিয়াগো শহরে) আন্দোলনকারীরা স্কুলগুলো দখল করে বিনা বেতনে শিক্ষার দাবিতে আন্দোলন করছে। ইসরায়েলে আন্দোলন হচ্ছে জীবনযাত্রার মানের ঊর্ধ্বগতি আর অতিরিক্ত বাড়ি ভাড়ার কারণে। স্পেনে যেখানে শতকরা ৫০ যুবক বেকার, সেখানে আন্দোলন হচ্ছে বেকারত্বের বিরুদ্ধে। যুক্তরাজ্যে, বিশেষ করে লন্ডন শহরে আন্দোলন হচ্ছে শিক্ষায় বাজেট কমানোর প্রতিবাদে। জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে আন্দোলন হচ্ছে অর্থনৈতিক সঙ্কটের প্রতিবাদে। অকল্যান্ড, তাইপে আর সিউলের বিক্ষোভের ধরনও অনেকটা তেমনি। মূল সুরটা এক জায়গায় বাঁধা-তা হচ্ছে বৈষম্য আর অসমতা। বর্তমান অর্থনেতিক ব্যবস্থা মানুষের মাঝে অসমতা দূর করতে পারেনি। বরং কোথাও কোথাও মানুষ আরও গরিব হয়েছে। তাই একুশ শতকে এসে একটি নয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি হয়ে পড়েছে।

বিশ্ব নেতৃবৃন্দ যত তাড়াতাড়ি এ দিকটার দিকে নজর দেবেন, ততই আমাদের জন্য মঙ্গল। আমাদের মতো দেশ বিশ্ব মন্দায় এসব অবধি আক্রান্ত হয়নি। তবে অচিরেই আমরা উপলব্ধি করতে শুরু করব। মন্দার কারণে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের তৈরি পোশাকের বাজার সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। বিদেশ থেকে রেমিট্যান্সের প্রবাহ কমে আসছে। দেশে মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে। সরকার যদি কৃচ্ছ্র সাধন না করে তা হলে এক বড় ধরনের সঙ্কটের মুখে পড়বে দেশ। নিউইয়র্কের ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলন আমাদের দেখিয়ে দিল পুঁজিবাদ ব্যর্থ। আর সে কারণেই একটি নয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন।

tsrahmanbd(a)yahoo.com
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[সূত্রঃ সকালের খবর, ০৫/১২/১১]

বৈশ্বিক শ্রেণীযুদ্ধের নতুন রূপ ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলন


ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলন সব ধর্মের, সব বর্ণের, সব লিঙ্গের, সব মতাদর্শের মানুষের। ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-রাজনীতির ভেদ থাকলেও একটি জায়গায় সবাই ৯৯ শতাংশ। লড়াইয়ের ময়দান চিনতে ভুল করেনি আমেরিকানরা। অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড ওয়াল স্ট্রিটেই একাট্টা হয়েছে শোষিত, দলিত আর বঞ্চিতরা। ­োগান দিচ্ছে বৈষম্য, দারিদ্র্য, দুর্নীতি, যুদ্ধ, পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। আর দেখতে দেখতে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের অনেক দেশে। এ আন্দোলন নিয়ে বিশিষ্ট
অর্থনীতিবিদ ও  জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন,  এটা শুধু ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলন না, এটা একদিকে আন্দোলনের ইতিহাসে একটা নতুন পরিচয় দাঁড়িয়েছে ৯৯%। এটাকে আমরা শ্রমিক, ছাত্র, পেশাজীবী এরকম আন্দোলন দেখছি। ৯৯% মানে জনগণের প্রধান অংশ। সকল শ্রেণী পেশার মানুষের ঐক্যের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে ১%। এরকম একটা মেরুকরণ এই আন্দোলনের  বৈশিষ্ট্য। যেটা আন্দোলনের নতুন একটা গতিমুখ দিচ্ছে। এটা শ্রেণীযুদ্ধের নতুন একটা ধরণ এবং এই ­োগানটা শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের জন্য না এটা হলো বৈশ্বিকভাবে এটা প্রাসঙ্গিক, প্রযোজ্য। এজন্যই এটা যুক্তরাষ্ট্র শহর থেকে শহরে ছড়াচ্ছে। ইতোমধ্যে সারা পৃথিবীতে এক হাজারের বেশি শহরে এর সমর্থনে প্রোগ্রাম হয়েছে। এটার একটা আন্তর্জাতিক ঐক্যসূত্র আছে। সমস্ত দেশের সম্পদ এবং ক্ষমতা কেন্দ্রিভূত হয়ে আছে ১% মানুষের হাতে। যার জন্য সেই শক্তিকে এক পাশে ৯৯%।  সেই মেরুকরণ এই আন্দোলনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। দুই নম্বর হলো, আঘাতের  লক্ষ্যটা হচ্ছে নিছক সরকার নাÑ ওয়াল স্ট্রিট হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতার কেন্দ্র। মানে এক চেটিয়া কর্তৃত্ব।
এই আন্দোলন রাজনীতির মধ্যে অনেক ধরনের পরিবর্তন আনবে।  যুক্তরাষ্ট্রের এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তারা যে বক্তব্যটি নিয়ে আসছে তা হলো রিপাবলিকান এবং ডেমোক্রেট; দুজনেই ক্ষমতার কেন্দ্রের সাথে বাঁধা। ক্ষমতার কেন্দ্র হচ্ছে ওয়াল স্ট্রিট। আরেকটা হচ্ছে পেন্টাগণ। একচেটিয়া চুক্তি, অস্ত্র কোম্পানী বা সমরাস্ত্র বিভাগ। এই দুটা একটি আরেকটির সাথে বাঁধা- এ দুটার সাথে ক্ষমতার কেন্দ্র অটুট রেখে সরকার পরিবর্তন করা। এটা হলো আন্দোলনের একটা মূল বক্তব্য। এর তাৎপর্য- আগে একদল বাদ দিয়ে আরেকদল গ্রহণ করে, আবার সেই দল ব্যর্থ হলে আরেকদল গ্রহণ করা; এভাবে পেন্ডোলামের মতো ঘুরছিল বাংলাদেশের মতো যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ। সেটা থেকে মানুষ বের হবার চেষ্টা করছে, ক্ষমতার কেন্দ্র যদি অটুট থাকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এটা সত্য। ক্ষমতার কেন্দ্র যেটা- যারা লুটেরা, কমিশনভোগী, দুর্নিতীবাজ, দখলদার এদের ক্ষমতা যদি অটুক থাকে আওয়ামী লীগ আসুক বিএনপি আসুকÑ একই কথা। মার্কিন জনগণের মাথায় এ জিনিসটা এখনও আসেনি। সুতরা এটা রাজনীতির একটা নতুন গতিমুখের ভিত তৈরি করছে। যেখানে দ্বিদলীয় বা দ্বি-জোটীয় যে বিভাজনের মধ্যে এতদিন  বিভিন্ন দেশে আমাদের জনগণকে মোহগ্রস্থ করে রাখা হয়েছে। সেখান থেকে মানুষ বের হয়ে তার নিজের স্বার্থ, নিজের জায়গায় আনার জন্য নতুন রাজনীতিতে যুক্ত হচ্ছে। এটাতে ভবিষ্যতের রাজনীতির ধারাটা পরিবর্তন ঘটবেÑ আমরা দেখতে পাবো।  এটা ডেমোক্রেট বা রিপাবলিকানরা তাদের পকেটের মধ্যে নিয়ে আসতে পারবে না।
বাংলাদেশের মতো দেশগুলিতে এই ধরনের আন্দোলন বিভিন্নভাবে আসে। যেমন বাংলাদেশে আমরা যখন বলি যে জাতীয় সম্পদের ওপর জনগণের একটা অংশ মালিকানা আছে কিংবা দেশের ওপর। একথাটা কিন্তু বহুজাতিক পুঁজি বা লুটেরা ধনিগোষ্ঠির হাত থেকে জনগণের হাতে তার সম্পদ তুলে দেওয়া। এখন যুক্তরাষ্ট্রের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যেটা হলো, এই আন্দোলনটা আসলে বৈশ্বিক একটা যোগসূত্র। বহুজাতিক কোম্পানি, মার্কিন কোম্পানি বাংলাদেশে এসে যুক্ত। সেই বহুজাতিক কোম্পানির বিরুদ্ধে আমরা আন্দোলন করছি, যুক্তরাষ্ট্রও আন্দোলন করছে। যে কমিশন ভোগী- তার কাছ থেকে কমিশন খেয়ে চুক্তি করছে। সেই কমিশন ভুগি ভাবছে যে, এখান থেকে কমিশন খেয়ে ভবিষ্যতটা চলবে।  এই ভবিষ্যতটা চলবে না আর। কারণ এই আন্দোলনটা বিকশিত হলো যুক্তরাষ্ট্রে। যুক্তরাষ্ট্রেও বহুজাতিক কোম্পানী এবং তার সাথে সম্পর্ক রেখে কারা কারা আছে তার বিরুদ্ধে নজর রাখছে। সুতরাং গোটা বিশ্বব্যাপি তার যুগসূত্রটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। যেটা বাংলাদেশের জন্য, যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও। মানেÑ সারা পৃথিবীর মানুষের জন্য।
আমাদের শেয়ারবাজারের বিক্ষোভটা এ আন্দোলনের সাথে যুক্ত হবে। শেয়ার বাজারের বিক্ষোভকারীরা তো আলাদা একটা শক্তি হিসেবে দাঁড়াতে পারবে না। তবে শুধু শেয়ারবাজার না। বিগত ক‘য়েক বছরে শেয়ারবাজার ছাড়াও, অর্থকড়ি খাতে আরও বেশকিছু দুর্বৃত্তের তৎপরতা আমরা দেখতে পাচ্ছি। মানে মানুষকে প্রতারণা করে, লক্ষ লক্ষ মানুষকে পথে বসানোর বিভিন্ন রকম তৎপরতা। শেয়ারবাজারও তার মধ্যে একটা বড় ক্ষেত্র। এই শেয়ারে যারা লক্ষ লক্ষ মানুষের বিনিয়োগ, লক্ষ লক্ষ টাকা বিদেশে পাচার করছে। এ ধরনের যারা দুর্বৃত্তগোষ্ঠী তাদের সংখ্যা খুব একটা বেশি না। তদন্ত কমিটি এটা বের করছে। এরা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে যারা ওয়াল স্ট্রিট আছে তাদের জুনিয়র পার্টনার। ওয়াল স্ট্্িরটে যারা যুক্তরাষ্ট্রে অর্থনীতির ধ্বস নামাতো এবং আবার ধস নামানোর পরেও যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের আশির্বাদ পেয়ে এখনও এরা বহাল তবিয়তে আছে। যাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন হচ্ছে। তাদেরই বাংলাদেশী সংস্করণ হলো এরা। শেয়ারবাজারের মধ্য দিয়ে এত লোকজন, এত বিশাল সম্পদ পাচার করছে, শুধুমাত্র শেয়ারমার্কেটের বিনিয়োগকারীরা। পুরা বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন বিপন্ন অবস্থায়। সেই কারণে এই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলন তো একটা বড় আন্দোলনের সাথেই যুক্ত। শেয়ার বাজারে যারা বিনিয়োগকারী  তারা তো আন্দোলন করার জন্য এখানে আসেনি। তারা এসেছিল তাদের কর্মসংস্থানের অভাবে। এখানে বিনিয়োগ করে কিছু একটা তৎবির করার জন্য। তাদের এখন নিশ্চয় একটা উপলব্ধি হয়েছে যে, তারা একটা বড় ধরনের জালের মধ্যে পড়ে গেছে। এ জাল থেকে বের হতে সরকার তাদের কোন ভরসা দিতে পারছে না। বিরোধী দল বা অন্য রাজনৈতিক দল কোন ভরসা দিতে পারবে না। তাদের নিজেদেরই জায়গা তৈরি করতে হবে সেই ক্ষেত্র তৈরি করার জন্য। আর যে অন্যান্য যেসমস্ত আন্দোলন আছে সেগুলোর সাথে সম্পর্ক করতে হবে নইলে তার কোন উপায় নেই। এটা অনিবার্য একটা গতি।

ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলনের নেপথ্যে

  • নিউইয়র্কের ওয়াল স্ট্রিটের কাছে জুকটি পার্কে ১৮ অক্টোবর বিক্ষোভকারীদের অবস্থান নিউইয়র্কের ওয়াল স্ট্রিটের কাছে জুকটি পার্কে ১৮ অক্টোবর বিক্ষোভকারীদের অবস্থান
    ছবি: এএফপি
  • নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জের কাছ থেকে ওয়াল স্ট্রিট নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জের কাছ থেকে ওয়াল স্ট্রিট
এক মাস পার হয়েছে ‘ওয়াল স্ট্রিট দখল করো’ আন্দোলনের। পুঁজিবাদবিরোধী এ আন্দোলন এখন কেবল যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে সীমাবদ্ধ নেই, ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বজুড়ে। গত ১৫ অক্টোবর পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী বিশ্বজুড়ে শত শত শহরে হয়েছে নিউ ইয়র্ক কায়দার বিক্ষোভ। পুঁজিবাদী সংস্কৃতির একতরফা স্বার্থ হাসিল, ধনী ও গরিবের ব্যবধান দিন দিন বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের দায় এড়াতে সরকারি ব্যয়-সংকোচন নীতির বিরুদ্ধেই এই প্রতিবাদ।
আন্দোলনকারীদের কথায়, ওয়াল স্ট্রিট বিক্ষোভের মূল লক্ষ্য পুঁজিবাদী সমাজের লালসার জিভ কেটে দেওয়া। বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ, পুঁজিবাদের দৌরাত্ম্যে ক্ষুদ্রসংখ্যক ধনী দিন দিন অঢেল সম্পদের অধিকারী হচ্ছে, অন্যদিকে সাধারণ মানুষ নিষ্পেষিত হচ্ছে দুর্ভোগের জাঁতাকলে। জীবনযাপনের ন্যূনতম চাহিদা পূরণে হিমশিম খেতে হচ্ছে নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের। ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে এ ব্যবধান ঘোচাতেই তাদের আন্দোলন।
তবে গুঞ্জন উঠেছে এ আন্দোলনের মূলেও রয়েছে এক ধরনের বিনিয়োগ। আর তা করেছেন বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের কাতারে থাকা একজন। এই বিনিয়োগকারী হিসেবে যাঁর নাম শোনা যাচ্ছে, তিনি জর্জ সরোস। গত সেপ্টেম্বরে এক জরিপে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ ১০ জন ধনী ব্যক্তির তালিকায় স্থান করে নেন তিনি। রক্ষণশীল সমালোচকেরা এ আন্দোলনকে ‘ট্রয়ের ঘোড়া’ হিসেবে দেখছেন, যার পেছনে রয়েছে সরোসের গোপন কোনো লক্ষ্য।
সরোস ও বিক্ষোভকারীরা তাঁদের পারস্পরিক যোগাযোগ থাকার কথা অস্বীকার করেছেন। তবে কিছু সাংবাদিকের দাবি, অনুসন্ধানে সরোসের সঙ্গে কানাডার পুঁজিবাদবিরোধী প্রতিষ্ঠান অ্যাডবাস্টার্স-এর অর্থনৈতিক যোগসূত্র পাওয়া গেছে। ওয়াল স্ট্রিটে ‘আরব বসন্ত’ ধাঁচের আন্দোলন গড়ে তুলতে এক ধরনের উদ্ভাবনী বিপণন প্রচারণা শুরু করে তারা। এ ক্ষেত্রে সরোস ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে নীতিগত কিছু ব্যাপারে মিল লক্ষণীয়।
বিশ্বজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার সপ্তাহ খানেক আগে জাতিসংঘে সাংবাদিকদের সরোস বলেন, ‘আমি তাঁদের (বিক্ষোভকারী) অনুভূতিটা বুঝি।’ আন্দোলন ও বিক্ষোভকারীদের সম্পর্কে আরও কিছু বলার জন্য সাংবাদিকেরা অনুরোধ করলেও সরোস মুখ খোলেননি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের রক্ষণশীল বেতার উপস্থাপক রাশ লিমবাউ বলেন, ‘জর্জ সরোসের বিনিয়োগ করা অর্থ রয়েছে এই আন্দোলনের পেছনে।’
বিখ্যাত ফর্বস সাময়িকী সম্প্রতি বিশ্বের শীর্ষ ধনী ৪০০ জন ব্যক্তির যে তালিকা প্রকাশ করে, এর মধ্যে সপ্তম স্থানে রয়েছেন সরোস। দুই হাজার ২০০ কোটি ডলারের সম্পদের মালিক তিনি। অস্থিতিশীল বিনিয়োগ বাজারে চাতুর্যের সঙ্গে পুঁজি খাটিয়ে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিত্তবৈভবে ফুলেফেঁপে ওঠেন তিনি। নিজের সব সম্পদ বিলিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকারও করেছেন তিনি। অঙ্গীকার অনুযায়ী সম্পদের অর্ধেক দান করবেন জীবদ্দশায়, বাকি অর্ধেক দানের খাতে যাবে তাঁর মৃত্যুর পর।
২০০৮ সালে ওয়াল স্ট্রিটের ব্যাংকগুলো অর্থনৈতিক দুরবস্থা থেকে জনগণকে উদ্ধারে যে ঋণ বা পুঁজি সরবরাহের প্রকল্পের কথা ঘোষণা করে, বিক্ষোভকারীদের মতো সরোসও তার সমর্থক নন। পরবর্তী সময়ে সরকারের ব্যাংকে আটকে থাকা ‘বিষাক্ত সম্পদ’ (বন্ধকভিত্তিক পরিত্যক্ত বন্ড) কেনার প্রকল্পেও একাত্ম হতে পারেননি এ ধনকুবের।
মার্কিন বিক্ষোভকারীদের ভাষ্য, ২০০৮ সালে সাধারণ মানুষকে অর্থনৈতিক দুরবস্থা থেকে উদ্ধারে ওয়াল স্ট্রিট ব্যাংকের প্রকল্প বিপুল মুনাফা নিয়ে এলেও সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের যেন সীমা নেই। বেকারত্ব তো বেড়েছেই, বেড়েছে চাকরি নিয়ে অনিশ্চয়তা। সে ক্ষেত্রে ওয়াশিংটন থেকে সহায়তা যা পাওয়া যাচ্ছে, তা না পাওয়ার মতো। তাঁদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ধনী যে এক শতাংশ নাগরিক, তাঁরা বিপুল সম্পদের মালিক হয়েও বেশির ভাগ মানুষের চেয়ে কম হারে কর দিচ্ছেন।
২০০৯ সালে সংবাদপত্রের কলামে সরোস লিখেছিলেন, ‘বিষাক্ত সম্পদ’ বলে পরিচিত ব্যাংকে আটকে পড়া যেসব পরিত্যক্ত সম্পদ সরকার কিনছে, বাস্তবে তা ব্যাংকগুলোর জন্য নিঃশ্বাস চালিয়ে রাখা কৃত্রিম যন্ত্রের মতো কাজ করবে। স্বাভাবিক ফল বয়ে আনবে না। প্রেসিডেন্ট ওবামাকে তিনি বরং আরও জোরালো পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দেন। বলেন, ব্যাংকগুলোকে হয় নতুন করে পুঁজি দিয়ে আর্থিকভাবে সবল করা হোক, নয় তো এসব প্রতিষ্ঠানের জাতীয়করণ হোক। কিন্তু তাঁর এ পরামর্শ গ্রহণ করা হয়নি।
হাঙ্গেরীয়-মার্কিন বংশোদ্ভূত সরোস ২০০৮ সালের নির্বাচনে শুরুর দিকে বর্তমান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সমর্থক ছিলেন। তিনি যেসব বড় প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাকে সমর্থন করেন, তার মধ্যে রয়েছে ওপেন সোসাইটি ইনস্টিটিউট, পররাষ্ট্রবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ওপেন সোসাইটির সঙ্গে সরোস সরাসরি যুক্ত। ফাঁস হওয়া ২০০৭ থেকে ২০০৯ সালের নথির তথ্য অনুযায়ী সরোসের ওপেন সোসাইটি অলাভজনক মার্কিন সংস্থা টাইডস সেন্টারকে ৩৫ লাখ ডলার মঞ্জুরি হিসেবে দিয়েছে। সানফ্রান্সিসকোভিত্তিক এ সংস্থা অন্যান্য দাতাদের জন্যও নিকাশ ঘর (ক্লিয়ারিং হাউস) হিসেবে কাজ করে থাকে। দাতাদের অনুদানের অর্থ উদারপন্থী অলাভজনক সংস্থা বা গোষ্ঠীকে দিয়ে থাকে। ফোর্ড ফাউন্ডেশন ও বিল গেটস ফাউন্ডেশনের সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে তাদের।
ফাঁস হওয়া নথির তথ্যে দেখা গেছে, ২০০১ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে অ্যাডবাস্টার্সকে এক লাখ ৮৫ হাজার ডলার অনুদান দিয়েছে টাইডস। এর মধ্যে ২০০৭ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে অ্যাডবাস্টার্সকে তারা দিয়েছে ২৬ হাজার ডলার। এসব তথ্যের ব্যাপারে টাইডস কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানায়।
সরোসের সহযোগীদের দাবি, অ্যাডবাস্টার্স-এর নামই কখনো শোনেননি তিনি। এ ব্যাপারে সরোস কোনো মন্তব্য করতে চাননি। ভ্যাঙ্কুভারভিত্তিক অ্যাডবাস্টার্স এ নামেই একটি সাময়িকী প্রকাশ করে থাকে। এ প্রতিষ্ঠানের ভাষ্য, তারা বিনিয়োগ বাজারে বিভিন্ন সংস্থার কুক্ষিগত থাকা ক্ষমতার পরিবর্তন চায়। বিদ্যমান ক্ষমতাগত কাঠামোর পরিবর্তনও তাদের কাম্য।
অ্যাডবাস্টার্স সাময়িকীর প্রচারসংখ্যা এক লাখ ২০ হাজার। বিজ্ঞাপনের চমকের জন্য এর বিশেষ পরিচিতি রয়েছে। ‘ডিজিটাল ডিটক্স ডে’, ‘বাই নাথিং ডে’ এসব শিরোনামে বিভিন্ন প্রচারণা চালিয়ে সাময়িকীটি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এ ধারায় নতুন সংযোজন ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’, অর্থাৎ ‘ওয়াল স্ট্রিট দখল করো’।
অ্যাডবাস্টার্স-এর যুগ্ম প্রতিষ্ঠাতা ক্যাল লাসন (৬৯) বলেন, ‘আরব বসন্ত’ বিপ্লবের জোয়ারে মিসর, লিবিয়া ও তিউনিসিয়ায় একে একে সরকার পতনের পর ওয়াল স্ট্রিটবিষয়ক বুদ্ধিটা মাথায় খেলে তাঁদের। তাঁরা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াল স্ট্রিট আরব বিশ্বের তাহরির স্কয়ারের মতো হতে পারে।
ক্যাল লাসন বলেন, ‘আমরা অনুভব করি যে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সত্যিকারের ক্ষোভ দানা বেঁধেছে যুক্তরাষ্ট্রে। এখন এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে প্রয়োজন কেবল একটি স্ফুলিঙ্গ।’
এ স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টির কথা স্বীকার করলেও সরোস কোনো অর্থ দিয়েছেন বলে স্বীকার করেননি লাসন। তিনি বলেন, অ্যাডবাস্টার্স-এর ৯৫ শতাংশ অর্থই আসে গ্রাহকের কাছ থেকে। সরোস কখনো এক পয়সাও দেননি। তবে তাঁর কিছু মতাদর্শ খুব ভালো বলে মন্তব্য করেন লাসন। একই সঙ্গে সরোস অ্যাডবাস্টার্সকে কিছু টাকা-পয়সা দেবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলনের আরেক বড় সমর্থক হচ্ছে অনলাইন তহবিল জোগানদাতা ওয়েবসাইট কিকস্টার্টার। তারা এ আন্দোলনে ৭৫ হাজার ডলারের বেশি আর্থিক সহায়তা দেওয়ার অঙ্গীকার করে। উদারপন্থী চলচ্চিত্র নির্মাতা মাইকেল মুরও এ আন্দোলনে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর জোরেশোরে শুরু হয় ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলন। এতে ভূমিকা রাখে অ্যাডবাস্টার্স-এর একটি প্রচারণামূলক পোস্টার। এতে দেখা যায়, নিউইয়র্কের বিখ্যাত ব্রোঞ্জের ষাঁড়ের ভাস্কর্যের ওপর নাচছেন এক ব্যালেশিল্পী। পেছনে ধোঁয়াশাময় পটভূমিতে গ্যাস-মুখোশ পরে দাঁড়িয়ে আছে একদল বিক্ষোভকারী। পোস্টারে একই সঙ্গে যৌনতা, সহিংসতা, উত্তেজনা ও অভিযানের আভাস। এটি চাকরি খোয়ানো অনেক বেকার তরুণকে আন্দোলনে নামতে প্ররোচিত করে।
ফ্লোরিডার যুবক রবার্ট ড্যারস একটি রেস্তোরাঁয় এ পোস্টার দেখেন। কাঠমিস্ত্রির কাজ ছেড়ে একটি বারে ওয়েটার হিসেবে কাজ করছিলেন তিনি। পোস্টার দেখে উজ্জীবিত হয়ে আন্দোলন করতে নিউইয়র্ক চলে আসেন। ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলনে প্রথমদিকে যাঁরা যোগ দেন, ড্যারস তাঁদের একজন। তিনি জানান, কাঠমিস্ত্রি হিসেবে ভালোই ছিলেন।কিন্তু তাঁর প্রকল্পের বিনিয়োগকারী করপোরেট জালিয়াতির অভিযোগে গ্রেপ্তার হন। এতে চাকরি হারিয়ে বেকার হয়ে যান তিনি।
শুরুতে ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলন সংবাদ মাধ্যমের দৃষ্টি কাড়লেও এটি জোরালো হয়ে উঠবে কি না তা নিয়ে সংশয় ছিল। দ্য টাইমস অব লন্ডন-এর মন্তব্য ছিল, ‘ এ আন্দোলনে আবেগ আছে, তবে তা লক্ষ্যহীন।’ কিন্তু সাম্প্রতিক বিশ্বব্যাপী বিক্ষোভ সে সংশয় দূর করেছে।

ওয়াল স্ট্রিট
ওয়াল স্ট্রিট বলতে নিউইয়র্কসিটির অর্থবাজার এলাকাকে বোঝানো হয়। দক্ষিণ ম্যানহাটানে ব্রডওয়েথেকে সাউথ স্ট্রিট পর্যন্ত বিস্তৃত সড়ক ওয়াল স্ট্রিটের নামে এর নাম। কালক্রমে এটি সার্বিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থবাজার বা নিউইয়র্কভিত্তিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সমার্থক হয়ে উঠেছে। বিশ্বের বৃহত্তম স্টক এক্সচেঞ্জ নিউইয়র্কস্টক এক্সচেঞ্জ ওয়াল স্ট্রিটেই। সড়কটির আদি ডাচ নাম ‘ওয়াল স্ত্রাত’-এর উৎস কীতা নিয়ে নানা ধরনের বিবরণ আছে। মোটামুটি সর্বজনস্বীকৃত একটি ব্যাখ্যা হচ্ছে, এলাকার প্রাচীন ডাচ বসতি ‘নিউ আমস্টারডাম’-এর উত্তর প্রান্তের একটি মাটির দেয়াল এ নামের উৎস। সম্ভবত ইংরেজ উপনিবেশের সম্প্রসারণ ঠেকানো বা আদিবাসী আমেরিকানদের হাত থেকে সুরক্ষার উদ্দেশ্যেই ওই প্রাচীর নির্মিত হয়েছিল।
শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া | তারিখ: ২১-১০-২০১১

ওয়াল স্ট্রিট দখল করো

এবনে গোলাম সামাদ


মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির মূল কেন্দ্র হলো নিউ ইয়র্ক শহরের ওয়াল স্ট্রিট। ওয়াল স্ট্রিট একটি রাস্তার নাম। যে রাস্তার ধারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানির শেয়ার কেনাবেচার সচেয়ে বড় কেন্দ্র অবস্থিত [New York Stock Exchange]। ওয়াল স্ট্রিট বলতে কেবল শেয়ার কেনাবেচার কেন্দ্রই বোঝায় না, বোঝায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ছয়টি বড় ব্যাংকের কেন্দ্রীয় কার্যালয়কেও। ওয়াল স্ট্রিট এখন মার্কিন অর্থনীতির প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের জীবন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হয়েছে ওয়াল স্ট্রিট দখলের আন্দোলন [Occupy Wall Street = OWS]। লাখখানেক লোক জড়ো হয়েছে নিউইয়র্ক শহরের Zuccotti Park--এ। এরা আওয়াজ তুলছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির ব্যবস্থা নিয়ে। বলছে মার্কিন ধনতন্ত্র অচল হয়ে পড়েছে। একে বাতিল করতে হবে। কিন্তু এরা বলছে না মার্কিন ধনতন্ত্রকে বাতিল করে ঠিক কী ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তারা সেই দেশে প্রতিষ্ঠিত দেখতে চান। এদের মধ্যে অনেকে বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ছয়টি বড় ব্যাংকে টাকা না রাখতে। বড় ব্যাংকে টাকা না রেখে ছোট ছোট ব্যাংকে টাকা রাখলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রিত হতে পারবে না বড় ব্যাংক ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের দ্বারা। মানুষ চাচ্ছে ছোট ব্যাংক ও ছোট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। চাচ্ছে অর্থনৈতিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ চাচ্ছে আয়-বৈষম্য কমাতে। চাচ্ছে কর্মসংস্থান বাড়াতে। চাচ্ছে মানুষের অর্থনৈতিক নিরাপত্তাকে সুনিশ্চিত করতে।

ওয়াল স্ট্রিট দখল করো আন্দোলন এ দিক থেকে সারা পৃথিবীর আলোচ্য হয়ে উঠেছে। এই আন্দোলনে কোনো নেতা নেই। কোনো দলের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে না এই আন্দোলন। এই আন্দোলনকারীরা বলছেন- দেশবাসীর সাধারণ ভাবনার মাধ্যমে আসবে সমাধান। তারা বিশ্বাস করেন, প্রকৃত গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজন নেই কোনো রাজনৈতিক দলের। গণতন্ত্রকে হতে হবে সাধারণ মানুষের কাণ্ডজ্ঞানভিত্তিক। রাষ্ট্রকে চলতে হবে সাধারণ মানুষের ইচ্ছায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্র হয়ে উঠেছে টাকার গণতন্ত্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দু’টি বড় দল পরিচালিত হচ্ছে মার্কিন বড় ব্যাংক ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের টাকায়। তারা কিনে ফেলে এই দুই দলের নেতাদের। তাদের টাকা ছাড়া নির্বাচন হতে পারে না। মার্কিন গণতন্ত্র শেষ পর্যন্ত হয়ে দাঁড়ায় গুটিকয়েক ধনকুবেরের গণতন্ত্র। আর এক কথায় এই গণতন্ত্র হলো কুবেরতন্ত্র [Plutocracy]।

মার্কিন গণতন্ত্র সম্পর্কে এই অভিযোগ অবশ্য নতুন নয়। কিন্তু কথাটা আবার উঠছে নতুন করে। সমকালীন বিশ্বে আমরা দেখছি মানুষ পথে নামছে, করছে আন্দোলন। হাজার হাজার মানুষ পথে নামছে নিজেদের আপন ইচ্ছায়। কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের ডাকে যে তারা পথে সমবেত হচ্ছে তা নয়। আন্দোলন হচ্ছে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই। সর্বত্র নিত্যপ্রয়োজনীয় দব্যের মূল্য বাড়ছে। চলে যাচ্ছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। মানুষ পথে নামছে তাদের ক্রয়ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার লক্ষ্যে। অর্থনীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে খুবই জটিল। মানুষ চাচ্ছে, রাষ্ট্র কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করুক। কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করতে হলে প্রয়োজন হয় অর্থের। এই অর্থের জন্য রাষ্ট্রকে করতে হয় কর বৃদ্ধি। রাষ্ট্রের টাকা শেষ পর্যন্ত হলো মানুষের করের টাকা। কর বৃদ্ধি না করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যায় না। আর কর বৃদ্ধির বোঝা শেষ পর্যন্ত এসে পড়ে সাধারণ মানুষেরই ওপর। যেটা বহন করা তাদের জন্য হয়ে ওঠে খুবই কষ্টসাধ্য। রাজনৈতিক নেতারা অনেক সময় সরাসরি কর বৃদ্ধি করতে চান না। তারা গ্রহণ করেন ঘাটতি ব্যয়ের পদ্ধতি। ঘাটতি ব্যয় বলতে সাধারণভাবে বোঝায়, নোট ছাপিয়ে রাষ্ট্রের ব্যয় নির্বাহ। শেষ পর্যন্ত যা হয়ে দাঁড়ায় পরোক্ষ কর। যার বোঝা বহন করতে হয় প্রধানত সাধারণ মানুষকেই। তাই আজকের দিনে অর্থনৈতিক সমস্যা হয়ে উঠেছে খুবই জটিল। মানুষ এক সময় বাস করেছে বনে-জঙ্গলে। বাস করেছে বন্য ফলমূল ও জীবজন্তু শিকার করে। আজকের দিনের অর্থনৈতিক সমস্যা তখন ছিল না। প্রত্যেক মানুষকেই করতে হতো তার নিজের কর্মসংস্থান।

কিন্তু এখন কর্মসংস্থান বৃদ্ধি হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রের সমস্যা। সেটা সমাধান করতে গিয়ে পৃথিবীর নানা দেশেই রাজনৈতিক নেতাদের পড়তে হচ্ছে যথেষ্ট জটিলতার মধ্যে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এখন চলছে ব্যবসায় মন্দা। ১০-১২ বছর পর পর মুক্তবাজার অর্থনীতিতে ব্যবসায় সঙ্কট দেখা দেয়। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। কেন এ রকম সঙ্কট দেখা দেয় তা নিয়ে আছে অনেক মত। একটি মত হলো, ব্যবসায় সঙ্কট দেখা দেয় অতি উৎপাদনের জন্য। মুক্তবাজার অর্থনীতি কোনো পরিকল্পনা অনুসারে চলে না। ফলে দেখা দেয় অতি উৎপাদনে সমস্যা। যেহেতু উৎপাদিত পণ্য বাজারে অবিক্রীত পড়ে থাকে। তাই দেখা দেয়, উৎপাদন বন্ধের প্রয়োজন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এখন বেকারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে সে দেশের কর্মক্ষম জনসমষ্টির ১০ শতাংশ। যা নিকট ভবিষ্যতে আরো বৃদ্ধি পেতেই পারে। যতগুলো কারণে ওয়াল স্ট্রিট দখলের আন্দোলন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এ সময় দানা বাঁধতে পারছে, তার একটা বড় কারণই হলো সে দেশে কর্মসংস্থানের অভাব। ওবামা প্রেসিডেন্ট হওয়ার সময় বলেছিলেন, তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় আনবেন বড় রকমের পরিবর্তন। কিন্তু তেমন কোনো পরিবর্তন আনতে তিনি সক্ষম হননি। তিনি নিজেকে প্রমাণ করেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন খুবই দুর্বল প্রেসিডেন্ট বলে। তাই তার সময় শুরু হতে পেরেছে ওয়াল স্ট্রিট দখলের আন্দোলন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রিপাবলিকান দলের নেতারা এ আন্দোলনের করছেন বিশেষ সমালোচনা। তারা বলছেন, এর ফলে মার্কিন ধনতন্ত্র ভেঙে পড়বে। কিন্তু তার জায়গায় আসবে না কোনো উন্নত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। মার্কিন জনগণ এর ফলে পড়বে আরো দারিদ্র্যের মধ্যে। কোনো দারিদ্র্য মোচন সম্ভবপর হয়ে উঠবে না।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাটরা বলছেন, এই আন্দোলনের উদ্দেশ্যকে তারা ভাবছেন না খুব মন্দ বলে। তবে এই আন্দোলন বিশৃঙ্খল হয়ে উঠলে তাকে দমনের জন্য তারা ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবেন। ওয়াল স্ট্রিট দখল করো আগামীতে ঠিক কী রূপ নেবে তা বলা যাচ্ছে না। তাদের এই আন্দোলনকে নানা দেশের মানুষ দিতে শুরু করেছে সমর্থন। আমরা দূর থেকে দেখে এই আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি থেকে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারছি না। আমাদের দেশে আগে শেয়ারবাজার বলে কিছু ছিল না। সমপ্রতি শেয়ারবাজার চালু হয়েছে। কিন্তু সেখানে মানুষ অর্থলগ্নি করে হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত। আমরা চাচ্ছি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ধনতন্ত্রের পথে নিয়ে যেতে। কিন্তু বিশ্ব ধনতন্ত্রে এখন শুরু হয়েছে সঙ্কট। বিশ্বে সবচেয়ে বড় ধনতান্ত্রিক দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মানুষ এখন করতে শুরু করেছে এই ব্যবস্থার সমালোচনা। আমাদের তাই এ ক্ষেত্রে আসছে সচেতন হওয়ার প্রশ্ন।
সমপ্রতি চীনের বিখ্যাত সংবাদসংস্থা জিংহুয়া [Xinhua] বলেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অন্য দেশের অর্থনীতিতে সমালোচনা করে, কিন্তু এখন খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে দেখা দিয়েছে গুরুতর প্রশ্ন। অন্য দেশের সমালোচনা না করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচিত হবে নিজের ঘর সামলানো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াল স্ট্রিট দখল করো আন্দোলন সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী মিখাইল গর্বাচেভ [Mikhail Gorbachev] বলেছেন, এর ফলে মার্কিন ধনতন্ত্র ভেঙে পড়তেই পারে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার আগ দিয়ে যে ধরনের অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পড়েছে কিছুটা সে রকম অবস্থারই মধ্যে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ হয়ে উঠেছে অনিশ্চিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশ। কিন্তু সে দেশের ১৩ শতাংশ মানুষ এখনো বাস করে দারিদ্র্যসীমার নিচে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগ থেকে প্রতি বছর হিসাব করা হয়, একটি কর্মক্ষম মানুষকে উপযুক্তভাবে খেয়ে বাঁচতে হলে তার বছরে কত ডলার আয় করা প্রয়োজন। তারপর এই আয়কে তিন দিয়ে গুণ করা হয়। তিন দিয়ে গুণ করার কারণ হলো, ধরে নেয়া হয়, একজন মানুষের খেয়ে বাঁচতে যা লাগবে, তার তিন গুণ লাগবে বছরে বাড়িভাড়া, বস্ত্র ও চিকিৎসার ব্যয় হিসেবে। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসার জন্য ব্যয়কে একত্র যোগ করে ধরা হয় একজন মানুষের ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম আয় কত হওয়া উচিত তার হিসাব। এই আয়ের নিচে যারা আয় করেন, তাদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ধরা হয় দরিদ্র। দরিদ্রের এই হিসাব সব দেশেই গ্রাহ্য নয়। অনেক দেশে গরিব বলতে বোঝায় যাদের আয়ের ৮০ শতাংশ খরচ হয় কেবল খাদ্য কিনতে গিয়ে। আমাদের দেশে গরিবরা বেশির ভাগই এই পর্যায়ে পড়ে। আমাদের দেশের গরিবদের চেয়ে মার্কিন গরিবেরা আছেন অনেক ভালো অবস্থায়। আমাদের দেশের গরিবেরা মনে করেন দারিদ্র্য তাদের বিধিলিপি।

কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গরিবেরা দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে হয়ে উঠেছেন সরব। করছেন আন্দোলন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দারিদ্র্য সৃষ্টি হতে পারে কেবল ব্যক্তিগত কারণে নয়, সমাজের ধন বণ্টনের অব্যবস্থার কারণেও। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গরিবেরা তাই মনে করছেন, সমাজের ধন বণ্টনব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব। জাতিসঙ্ঘ কোনো একটি দেশের দরিদ্র লোকের সংখ্যা কত, তার হিসাব করে অনেক ভিন্নভাবে। জাতিসঙ্ঘের পক্ষ থেকে প্রথমে একটি জাতির মোট বার্ষিক আয়ের হিসাব করা হয়। তারপর নির্ণয় করা হয়, এই আয়ের মধ্যমমান Median]। একটি জাতির যেসব লোকের বার্ষিক আয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় এই মধ্যমমানের নিচে, তাদের ধরা হয় গরিব হিসেবে। এখনকার হিসাব আমার জানা নেই। ১৯৯০ সালে জাতিসঙ্ঘ ১৬টি উন্নত জাতির বার্ষিক জাতীয় আয়ের মধ্যমমান নির্ণয় করেছিল। এতে যুক্তরাষ্ট্রের ১৯ শতাংশ লোক পড়েছিল গরিবের দলে। নরওয়ে, সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের মতো দেশের ক্ষেত্রে গরিব মানুষের সংখ্যা হলো মোট জনসংখ্যার ৫ থেকে ৮ শতাংশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান এসব দেশের ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান থেকে অনেক বেশি। নরওয়ে, সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের মতো দেশ অনুসরণ করে চলেছে বিশেষ ধরনের পরিকল্পনামূলক অর্থনীতি, যা বাড়িয়ে চলেছে এসব দেশের নাগরিকদের ক্রয়ক্ষমতা। দিতে পারছে প্রয়োজনীয় আর্থিক নিরাপত্তা। পৃথিবীর অর্থনীতি আগামীতে কী রকম দাঁড়াবে তা বলা যাচ্ছে না। তবে সাধারণভাবে মনে করা হচ্ছে এই অর্থনীতি হবে মিশ্র অর্থনীতি। যার ওপর থাকবে প্রত্যেকটি দেশের কিছু না কিছু রাষ্ট্রিক নিয়ন্ত্রণ। মুক্তবাজার অর্থনীতির যুক্তি আর টিকে থাকবে না।

লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
[সূত্রঃ নয়া দিগন্ত, ২৪/১০/১১]

জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন এবং ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলন


গত ৪ নভেম্বর কানের জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন শেষ হয়েছে কোনো রকম সিদ্ধান্ত ছাড়াই। বিশ্বের ধনী ২০টি দেশের সরকার তথা রাষ্ট্রপ্রধানরা এই শীর্ষ সম্মেলনে মিলিত হয়েছিলেন এমন একটি সময় যখন সারা বিশ্বজুড়ে অর্থনীতিতে এক রকম অস্থিরতা বজায় রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি বড় বড় শহরে অসমতা, বেকারত্ব আর একশ্রেণীর হাতে অর্থনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত হওয়ার প্রবণতার বিরুদ্ধে যখন জনমত শক্তিশালী, ঠিক তখনই প্রেসিডেন্ট ওবামা ছুটে গেলেন আটলান্টিক মহাসাগরের ওপারে বিনোদন নগরী হিসেবে পরিচিত ফ্রান্সের কান শহরে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে। জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে গ্রিসের ঋণসঙ্কট নিয়েও আলোচনা হয়েছে। সেটাও ছিল আলোচনার অন্যতম বিষয়। ঋণ এখন অনেকটা অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হতে যাচ্ছে। ইউরোপের ধনী রাষ্ট্রগুলো গ্রিসকে ১১ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েও গ্রিসের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। গ্রিসের মোট ঋণের পরিমাণ এখন ২ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ান ডলার। এই ঋণ গ্রিস শোধ করতে পারছে না। অনেকটা দেউলিয়া হয়ে গেছে রাষ্ট্রটি। গ্রিস 'ইউরো জোনে' থাকবে কী, থাকবে না, এটা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী পাপান্দ্রু একটি গণভোট করতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত তিনি বাতিল করতে বাধ্য হন। এখন সর্বশেষ আস্থা ভোটে পাপান্দ্রু টিকে গেলেও তিনি পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু তা গ্রিসের ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়ে গেছে। গ্রিসের পরিস্থিতি যখন অবনতিশীল তখন ধারণা করা হয়েছিল জি-২০ নেতারা একটি উদ্ধার অভিযানে এগিয়ে আসবেন। কিন্তু 'ফটো সেশন' এর মধ্য দিয়ে দুদিনব্যাপী জি-২০ এর শীর্ষ সম্মেলন শেষ হলো। এমনকি অসমতা, বেকারত্ব আর দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সারা বিশ্বজুড়ে যে আন্দোলন চলছে সে ব্যাপারেও কোনো সিদ্ধান্ত নিল না জি-২০ এর নেতারা।
এই মুহূর্তে গ্রিসের ঋণ পরিস্থিতি যেমনি আলোচনার অন্যতম বিষয়, ঠিক তেমনি আলোচনার বিষয় আমেরিকার অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও। যে দেশ শিশুদের নূ্যনতম অধিকার (২১ ভাগ সন্তান নির্ধারিত দরিদ্রসীমার নিচে বসবাস করে) নিশ্চিত করতে পারেনি, সেই দেশ বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে শুধু অন্য দেশের (আফগানিস্তান, ৬ বিলিয়ন ডলার বছরে) সেনা প্রশিক্ষণের জন্য। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ৬ জনের মধ্যে ১ জন গরিব। ৪ কোটি ৬২ লাখ মানুষ বাস করে দারিদ্র্যসীমার নিচে, শতকরা হার যা ১৫ দশমিক ১ ভাগ। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে আবার আফ্রো-আমেরিকানদের এবং হিস্পানিকদের সংখ্যা বেশি। এই হার যথাক্রমে ২৭ দশমিক ৪ ও ২৬ দশমিক ৬ ভাগ। যুক্তরাষ্ট্রের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য চাকরির সংস্থান না করে, তাদের নূ্যনতম স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত না করে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হচ্ছে যুদ্ধের পেছনে। যুক্তরাষ্ট্রের জনগোষ্ঠীর একটা অংশ রয়েছে, যাদের হেলথ ইনস্যুরেন্স নেই। স্বাস্থ্যসেবার বাইরে রয়েছে এমন জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১৬ দশমিক ৩ ভাগ। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ যুদ্ধের খরচ মেটাতে কর দেন। ওবামা প্রশাসনের যুদ্ধের জন্য বাজেট প্রায় ৬ ট্রিলিয়ন ডলার (যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী যুদ্ধের পেছনে খরচ ৩ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার) , স্বাস্থ্য বীমা নিশ্চিত করা যায়। কিন্তু ওবামা প্রশাসনের নজর এদিকে নেই। যুদ্ধ তাদের দরকার। যুদ্ধ প্রলম্বিত করে করপোরেট হাউজগুলো মুনাফা লুটছে। যুদ্ধ মানেই তো ব্যবসা। সুতরাং আজ যে অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলন গড়ে উঠছে, এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক।
যুক্তরাষ্ট্রেই গবেষণা হচ্ছে যুদ্ধের খরচ যদি কমানো যায়, তাহলে ওই অর্থ দিয়ে সামাজিক খাতে কী কী পরিবর্তন আনা সম্ভব। পেটাগনের হিসাব মতে প্রতিমাসে আফগানিস্তান ও ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের খরচ হয় ৯ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলার, যার তিন ভাগের ২ ভাগ খরচ হয় আফগানিস্তানে। পেন্টাগন ইরাক ও আফগানিস্তানে গত ৪০ মাসে খরচ করেছে ৩৮৫ বিলিয়ন ডলার, যা কি না বয়োজ্যেষ্ঠদের স্বাস্থ্যবীমা খাতে যুক্তরাষ্ট্র খরচ করেছে গত ১০ বছরে। গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু সেনাদের ব্যবহৃত গাড়ির জ্বালানি তেল (আফগানিস্তানে) বাবদ (অক্টোবর ২০১০ থেকে মে ২০১১ পর্যন্ত) যুক্তরাষ্ট্র খরচ করেছে ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। যদি যুদ্ধক্ষেত্রে তেল সরবরাহ ও জনশক্তির খরচ হিসাব করা হতো, তাহলে প্রতি গ্যালন তেলের মূল্য গিয়ে দাঁড়াতো ১০০ ডলারে। প্রতি বছর আফগানিস্তানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বজায় রাখতে (সেনা সদস্যদের জন্য) যুক্তরাষ্ট্রের খরচ হয় বছরে ২০ বিলিয়ন ডলার। ২০০৯ সালে আফগানিস্তানে প্রতি মার্কিন সেনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের খরচ ছিল ৫ লাখ ৭ হাজার ডলার (বছরে)। ২০১০ সালে এটা বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৬ লাখ ৬৭ হাজার ডলারে। আর ২০১১ সালের হিসাব ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৯৪ হাজার ডলারে। এটা কংগ্রেশনাল রিপোর্ট। এই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে ইরাকে ২০০৭ সালে প্রতি মার্কিন সেনার জন্য বছরে খরচ ছিল ৫ লাখ ১০ হাজার ডলার, ২০১১ সালে তা বেড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ২ হাজার ডলারে। ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস আফগানিস্তানে যুদ্ধের খরচের জন্য বরাদ্দ দিয়েছে ১১৩ বিলিয়ন ডলার। ইরাকের জন্য বরাদ্দ ৪৬ বিলিয়ন। এখন ওবামা প্রশানকে যুদ্ধের জন্য যদি অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ করতে না হতো, তাহলে এই পরিমাণ অর্থ দিয়ে (১) ৫৭ দশমিক ৫ মিলিয়ন শিশুর (নিম্ন আয়ের পরিবারের) স্বাস্থ্যসেবা, (২) ২৩ মিলিয়ন নিম্ন আয়ের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা (৩) ২০২ মিলিয়ন ছাত্রের বৃত্তি, (৪) ১৪ দশমিক ৩৫ মিলিয়ন বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবা ও (৫) বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ১৪ দশমিক ২৬ মিলিয়ন আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করা সম্ভব। সুতরাং আজকে ওয়াশিংটনে কিংবা নিউ ইয়র্কে যে আন্দোলন হচ্ছে, তার পেছনে কারণগুলো কি, তা সহজেই অনুমেয়। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হলেও, ওবামা প্রশাসন যুদ্ধ বন্ধের কোনো উদ্যোগ নেননি। বরং তিনি লিবিয়ায় নতুন একটি ফ্রন্ট ওপেন করেছেন। লিবিয়ায় যে যুদ্ধের সূচনা তিনি করেছিলেন তাকে চিহ্নিত করা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় যুদ্ধ হিসেবে। লিবিয়ায় গাদ্দাফির মৃত্যুর পর এখন সম্ভাব্য টার্গেট হচ্ছে সিরিয়া ও ইরান। সুতরাং আগামীতে যুদ্ধ বন্ধের কোনো সম্ভাবনাই নেই। আর সঙ্গতকারণেই যুদ্ধের জন্য অর্থ বরাদ্দ বাড়াতে হলে সামাজিক খাতে আরো কাটছাঁট করতে হবে। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বয়োজ্যেষ্ঠরা আর শিশুরা। 
তাদের স্বাস্থ্য সুবিধা আরো সীমিত হবে। যুদ্ধের কারণে সমাজের একটা অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও, সুবিধাভোগী একটি অংশ বরং এতে উপকৃতই হচ্ছে। ব্যবসার প্রসার ঘটিয়ে করপোরেট হাউজগুলো আরো ধনী হচ্ছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যুক্তরাষ্ট্রের ধনিক শ্রেণী, যাদের সংখ্যা মোট জনগোষ্ঠীর মাত্র ১ শতাংশ, তারা দেশটির মোট সম্পদের ৩৩ শতাংশের মালিক। সুতরাং করপোরেট হাউজগুলোর বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ যে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।
আজ নিউ ইয়র্কের জুকোটি পার্কে (অকুপাই ও ওয়াল স্ট্রিট) শত শত তরুণ সমবেত হয়ে যে আন্দোলনের সূচনা করলেন, তার সঙ্গে কায়রোর তাহরির স্কোয়ারের আন্দোলনের বেশ মিল পাওয়া যায়। সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটগুলো ব্যবহার করে মিসরের তরুণ সমাজ একটি বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন। পতন ঘটেছিল হোসনি মোবারকের। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কেও তরুণরা এই সামাজিক নেটওয়ার্কগুলো ব্যবহার করছে। তবে পার্থক্যটা এখানেই যে এতে করে ওবামা প্রশাসনের পতন ঘটবে না। তবে ওবামা প্রশাসন নিশ্চয়ই এটা থেকে কিছু শিখবে। ২০১২ সালে সেখানে নির্বাচন। ওই নির্বাচনে অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলন কোনো প্রভাব ফেলবে না, তা বলা যাবে না। আরো একটা কথা। সারা বিশ্বব্যাপীই পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। বিক্ষোভ হয়েছে, রোমে, লন্ডনে, অকল্যান্ডে। গ্রিসের অর্থনৈতিক সঙ্কট রাষ্ট্রটিকে একটি 'ব্যর্থ রাষ্ট্র' এ পরিণত করেছে। ইউরোপে এক মুদ্রা ইউরো এখন অনেকটা অকার্যকর। বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই এখন বড় ধরনের হুমকির মুখে। এখন বিশ্ব নেতারা সমস্যার সমাধানে কি উদ্যোগ নেন, সেটাই দেখার বিষয়। তবে একটি বিপ্লব সেখানে আসন্ন। এই বিপ্লবকে মার্কস বেঁচে থাকলে হয়তো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হিসেবে আখ্যা দিতেন। এটা একটা সামাজিক বিপ্লব। এই সামাজিক বিপ্লব সেখানে একটি পরিবর্তন আনবে। ধনী ও গরিবের মধ্যে পার্থক্য ঘোচাতেই হবে। শ্রেণীবৈষম্য কমিয়ে আনতেই হবে। না হলে বড় ধরনের বিস্ফোরণ ঘটবে। হোয়াইট হাউজ প্রশাসন এটা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করবে যে এভাবে চলতে দেয়া যায় না। এভাবে বৈষম্য বজায় রেখে উন্নয়ন সম্ভব নয়। এই পরিবর্তনটুকু যত দ্রুত আনা যায়, ততই মঙ্গল। সমাজতন্ত্র যেমনি ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছিল, ঠিক তেমনি পুঁজিবাদও এখন ব্যর্থ প্রমাণিত হলো। নতুন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করা জরুরি, যেখানে কোনো বৈমষ্য থাকবে না, সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন হবে, আর রাষ্ট্র জনগণের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।
কিন্তু এই প্রত্যাশা পুরণে জি-২০ সম্মেলন কোনো আশার বাণী শোনাল না। প্রতিবারের মতো এবারোও তারা ফটো-সেশন করলেন। ওবামা অনেক আশ্বাসের বাণী শোনালেন। ইতোমধ্যে অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলন ৫০ দিন পার করেছে। প্রচ- শীতেও বিক্ষোভকারীদের মাঝে এতটুকু হতাশা আসেনি। বরং তা ছড়িয়ে গেছে ক্যালিফোর্নিয়াতেও। সেখানে অকল্যান্ড সমুদ্রবন্দর বন্ধ করে দিয়েছে বিক্ষোভকারীরা। একই সঙ্গে খোদ ওয়াশিংটনের ফ্রিডম প্লাজাতেও ড়পঃড়নবৎ-২০১১ সড়াবসবহঃ, যা যুদ্ধের বিরুদ্ধে পরিচালিত, তা পার করেছে ৩০ দিন। এই যে পরিস্থিতি, এই পরিস্থিতি কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। এই পরিস্থিতি আমাদের মনে কমিয়ে দেয় বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে বাধ্য।

ড. তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়,
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক সদস্য,
tsrahmanbd@yahoo.com 

সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ আর বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদবিরোধী আন্দোলন

গেল সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্র যখন 'সন্ত্রাসের রিরুদ্ধে যুদ্ধ' এর দশ বছর পালন করছে, তখন যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ জনগণ প্রত্যক্ষ করছে এক নতুন ধরনের আন্দোলন। অতীতে এমনটা কখনোই হয়নি। হাজার হাজার মানুষ একত্রিত হয়ে নিউইয়র্কে আন্দোলন করছে অসমতা আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে। তারা এর নামকরণ করেছে 'অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট' আন্দোলন। অর্থাৎ 'ওয়াল স্ট্রিট' দখল কর। কেননা ওয়াল স্ট্রিট হচ্ছে পুঁজিবাদের একটি প্রতীক। এখানে রয়েছে স্টক একচেঞ্জ ভবন, সেই সঙ্গে অনেকগুলো কর্পোরেট হাউসের সদর দফতর। কর্পোরেট হাউসগুলো ব্যবসা বোঝে। যুক্তরাষ্ট্রে দরিদ্রতা তাদের কাছে কখনও বড় হয়ে দেখা দেয়নি। তাদের কাছে মুনাফাটা প্রাধান্য পেয়েছে বেশি। তারা চায় যুদ্ধ। যুদ্ধ প্রলম্বিত হলেই তাদের ব্যবসা বাড়ে। যুক্তরাষ্ট্রে ৯/১১-এর ঘটনার পর তাদের জন্য একটা দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের প্রয়োজন ছিল। তাই তথাকথিত 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' প্রলম্বিত হয়েছে। ৯/১১-এর ঘটনার সূত্র ধরে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান দখল করে নেয়। তারপর দখল করে ইরাক। এই 'যুদ্ধ' এর দশ বছর পার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ইতিমধ্যে সেই যুদ্ধে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। কিন্তু যুদ্ধ বন্ধ হয়নি। এরই মাঝে যুক্তরাষ্ট্র লিবিয়ায় 'তৃতীয় যুদ্ধ' শুরু করেছে। গাদ্দাফিকে হত্যা করার মধ্যে দিয়ে 'তৃতীয় যুদ্ধ' এর একটা পর্যায়ের সমাপ্তি ঘটেছে বটে; কিন্তু লিবিয়ায় 'যুদ্ধ' দীর্ঘায়িত হবে। এরপর 'যুদ্ধ' শুরু হবে সিরিয়া আর ইয়েমেনে। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের যে স্ট্র্যাটেজি, তাতে করে এ অঞ্চলে উত্তেজনা থাকবে এবং নতুন নতুন 'যুদ্ধ' এর ক্ষেত্র তৈরি হবে। এতে করে উপকৃত হবে কর্পোরেট হাউসগুলো, যারা পুনর্গঠনের নামে ব্যবসা বাগিয়ে নেবে, যেমনটি তারা নিয়েছিল ইরাকে। ইরাক অতিরিক্ত তেল উত্তোলন করে পুনর্গঠনের বিল পরিশোধ করেছিল। লিবিয়ায় ঠিক এমনটিই ঘটবে। কিন্তু নিউইয়র্কের জুকোটি পার্কে যারা দিনের পর দিন বিক্ষোভ করছে, তাদের জন্য এটা কোনো সুসংবাদ নয়। কর্পোরেট হাউসগুলোর মুনাফা বৃদ্ধি ঘটলেও, তাদের জন্য চাকরির কোনো নিশ্চয়তা নেই। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ৬ জনের মাঝে ১ জন দরিদ্র। ৫টি শিশুর মাঝে ১টি শিশু দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। কৃষ্ণাঙ্গদের মাঝে শতকরা ৫৪ জনই দরিদ্র। এশিয়ান-আমেরিকানদের মাঝে দরিদ্রতার হার ১২ দশমিক ১ ভাগ। 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তথাকথিত যুদ্ধ' তাই তাদের জন্য কোনো আবেদন সৃষ্টি করতে পারেনি। কর্পোরেট হাউসগুলোর স্বার্থেই যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান আক্রমণ করেছিল ২০০১ সালে, টুইন টাওয়ার ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরপরই।
আফগানিস্তানের পাশাপাশি ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র দখল করে নিয়েছিল ইরাক। অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র (ডগউ) রয়েছে এই অভিযোগ তুলে দেশটি দখল করে নিয়েছিল। ২০১০ সালে এসে সেখান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে সত্য (৫০ হাজার সৈন্য রয়ে গেছে প্রশিক্ষণের জন্য); কিন্তু ইরাকি সম্পদ (তেল) চলে গেছে মার্কিন কোম্পানিগুলোর হাতে। ইরাকি তেলের পয়সায় এখন মার্কিন কোম্পানিগুলো বিধ্বস্ত ইরাকের পুনর্গঠনের কাজে নিয়াজিত। ২০১০ সালে এসে সারা আরব বিশ্ব প্রত্যক্ষ করছে এক ধরনের গণআন্দোলন, যাকে বলা হচ্ছে 'আরব বসন্ত'। এই 'আরব বসন্ত' কার জন্য, কিসের জন্য, এটা নিয়েও প্রশ্ন আছে। দীর্ঘদিনের ক্ষমতায় থাকা শাসকরা (বেন আলী, হোসনি মুবারক, মুয়াম্মার গাদ্দাফি) উৎখাত হয়েছেন বটে; কিন্তু ক্ষমতা সাধারণ মানুষের কাছে ফিরে আসেনি। সর্বশেষ গাদ্দাফিরও পতন হয়েছে। লিবিয়াকে বলা হয় উত্তর আফ্রিকায় যাওয়ার দরজা বা এধঃবধিু। লিবিয়া যদি নিয়ন্ত্রিত থাকে, তাহলে প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর (নাইজার, সাদ, গিনি, বিসাউ) দেশগুলোকেও নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে। আফ্রিকায় ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে অভৎরপড়স, আফ্রিকান কমান্ড। বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব করার যে মানসিকতা, তাকে সামনে রেখেই পতন ঘটানো হল গাদ্দাফি সরকারের।
সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তথাকথিত 'যুদ্ধ' শুরু করেছিল বুশ প্রশাসন। শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়ে ওবামা সেই 'যুদ্ধ' বন্ধ করেননি। মার্কিন সমরাস্ত্র কারখানাগুলোতে উৎপাদন বেড়েছে। বিশ্বের সর্বত্র, বিশেষ করে আফগানিস্তান থেকে শুরু করে ইরান_ সর্বত্রই আমেরিকার কোম্পানিগুলোর রমরমা ব্যবসা। নাইন-ইলেভেন এই ব্যবসার একটি ক্ষেত্র তৈরি করেছে। ফিনিয়ান কানিংহামের প্রবন্ধ '৯/১১ চধাবফ ঃযব ধিু ভড়ৎ অসবৎরপধ্থং চবৎসধহবহঃ ধিৎ ড়ভ অমমাবংংড়হ_ এ কথাই বলা আছে। আর মিসেল চসুডোভস্ক্রি তো স্পষ্ট করেই বলেছেন, ্তুধষষবমবফ লরযধফর ঢ়ষড়ঃঃবৎং বিৎব ঃযব ঢ়ৎড়ফঁপঃ ড়ভ ঁং ংঃধঃব ঃবৎৎড়ৎরংস্থ। অনলাইনে চমস্ক্রির এই ৯/১১ : ডধং ঃযবৎব ধহ অষঃবৎহধঃরাব (ংবাবহ ঝঃড়ৎরবং ঢ়ৎবংং) কেউ পড়ে দেখতে পারেন। তাই 'নাইন-ইলেভেন' নিয়ে যে অসংখ্য প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসা, দশ বছর পার হয়ে যাওয়ার পরও আমরা এর পূর্ণ জবাব খুঁজে পেলাম না। জবাব পেলাম না লাদেনের উত্থান ও মৃত্যু নিয়েও। লাদেনের মৃত্যু নিয়েও নানা কথা আছে। ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যু হয়েছে সত্য; কিন্তু আল-কায়েদা ধ্বংস হয়ে যায়নি। তারা তাদের স্ট্র্যাটেজিতে পরিবর্তন এনেছে। অঞ্চল ভিত্তিতে আল-কায়েদা এখন সংগঠিত ও পরিচালিত হচ্ছে। যেমন সৌদি আরবভিত্তিক অষ-ছধবফধ রহ অৎধনরধহ চবহরহংঁষধ (অছঅচ), রিয়াদে ২০০৩ সালে হামলার জন্য যাদের অভিযুক্ত করা হয়েছে। ২০০৪ সালে ইরাকে সংগঠিত হয়েছে অছও বা অষ-ছধবফধ রহ ওৎধয়। ২০০৭ সালে জন্ম হয়েছে অষ-ছধবফধ রহ ওংষধসরপ গধমৎবন (অছওগ)। ছোট ছোট সেলে বিভক্ত হয়ে তারা এখন সন্ত্রাসী কর্মকা- পরিচালনা করছে, যাকে বলা হচ্ছে ্তুঝঢ়রফবৎ ডবন্থ। মাকড়সার জালের মত সংগঠিত হচ্ছে, আবার তারা ধ্বংসও হচ্ছে। এরপর অন্য এক জায়গায় নিয়ে তারা সন্ত্রাসের জাল বুনছে, মাকড়সারা যেমনটি করে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে একরকম যোগাযোগ ছাড়াই এই জিহাদি কর্মকা- পরিচালনার তত্ত্ব দিয়েছেন আল-কায়েদার একজন তাত্তি্বক আবু মুসাব আল সুরি (ঞযব এষড়নধষ ওংষধসরপ জবংরংঃধহপব)। নোয়াম চমস্ক্রি তাই লিখেছেন, ঞযব ঔরযধফর সড়াবসবহঃ পড়ঁষফ যধাব নববহ ংঢ়ষরঃ ধহফ ঁহফবৎসরহবফ ধভঃবৎ ৯/১১ রভ ঃযব ্তুপৎরসব ধমধরহংঃ যঁসধহরঃু্থ যধফ নববহ ধঢ়ঢ়ৎড়ধপযবফ ধং ধ পৎরসব (ধিং ধিৎ ড়হষু ধহংবিৎ ঃড় ৯/১১? ঘধঃরড়হ ড়ভ পযধহমব, ৫ ঝবঢ়ঃবসনবৎ, ২০১১)। এটাই হচ্ছে মোদ্দাকথা। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কর্মকা-কে সত্যিকার অর্থেই মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়নি। 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ'কে ব্যবহার করা হয়েছে গোষ্ঠীস্বার্থে তথা ব্যবসায়িক স্বার্থে। ইরাক তার বড় প্রমাণ (ইরাকের তেলের পয়সায় এখন সেখানে পুনর্গঠনের কাজ চলছে। আর এককভাবে কাজ পেয়েছে মার্কিন কোম্পানিগুলো)। একই ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে এখন লিবিয়ায়। 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' একটি জনগোষ্ঠীকে টার্গেট করা হয়েছিল। বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের বিভিন্ন চোখে দেখা হত। এখন পরিস্থিতি কিছুটা উন্নত হয়েছে, এটা সত্য। কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের 'নাইন-ইলেভেন' এর পূর্বকার অবস্থায় আর ফিরে যায়নি। 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' একটি কালো অধ্যায়। দীর্ঘ দশ বছর ধরে চলা এই 'যুদ্ধ' প্রকারন্তরে বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব করার প্রয়াসেই রচিত। 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' এর মধ্যে দিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকা- বন্ধ করা যায়নি। বরং তা আরও বেড়েছে। সারাবিশ্ব যখন টুইন-টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার দশম বর্ষ পালন করছে, তখন কাবুলের কূটনৈতিক পাড়ায় তালেবানদের হামলা (১৩ সেপ্টেম্বর) এ কথাটাই প্রমাণ করল আবার। কিন্তু যে প্রশ্নটি এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি আলোচিত তা হচ্ছে, এই দশ বছরে কোটি কোটি ডলার যুদ্ধের পেছনে ব্যয় না করে যুক্তরাষ্ট্র যদি নিজ দেশের সামাজিক উন্নয়নের খাতে ব্যয় করত, তাহলে 'অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট' আন্দোলনের জন্ম হত না। মার্কিন অন-লাইন সংবাদপত্রগুলো যুক্তরাষ্ট্রের যে সামাজিক অবস্থা তুলে ধরেছে, তা দেখে রীতিমত অাঁতকে উঠতে হয়। ৯ দশমিক ১ ভাগ লোকের কোনো চাকরি নেই। যুক্তরাষ্ট্রের মোট সম্পদের ৫ ভাগের ১ ভাগ মালিক হচ্ছে জনগোষ্ঠীর মাত্র ১ ভাগ মানুষ। ১৯৭০ সালে ধনী হিসেবে পরিচিতদের হাতে মোট আয়ের ৮ থেকে ৯ ভাগ অর্থ সঞ্চিত হত। ২০১১ সালে এই পরিমাণ এসে দাঁড়িয়েছে ২৩ দশমিক ৫ ভাগে। আমেরিকান ধনীদের মোট সম্পদের পরিমাণ ১ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার, যা কি না যুক্তরাষ্ট্রের গরিব জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের মোট সম্পদের চেয়েও বেশি। অর্থাৎ ১৫৫ মিলিয়ন জনগোষ্ঠীর চেয়েও বেশি। এই যে পরিসংখ্যান, এই পরিসংখ্যানই বলে দেয় সেখানে কী বড় ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি করেছে। আর এই বৈষম্যের কারণেই 'অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট' আন্দোলনের জন্ম। এই আন্দোলন ছড়িয়ে গেছে এক শহর থেকে আরেক শহরে। এমনকি এর ঢেউ গিয়ে লেগেছে আটলান্টিকের ওপারেও, লন্ডন থেকে ফ্রাংকফুটে। প্রশান্ত মহাসাগরের ওপারের দেশগুলোও এই আন্দোলন থেকে পিছিয়ে নেই। যুক্তরাষ্ট্রে একটি পরিবর্তন তাই আসন্ন। এই পরিবর্তনটুকু কীভাবে হবে, কেমনভাবে হবে, সেটা এক ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু একুশ শতকের শুরুতে সারাবিশ্ব যে গণজাগরণ প্রত্যক্ষ করল, ইতিহাসে তা লালকালির আখরে লেখা থাকবে।
২০১২ সালে সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ওবামা আবারও প্রার্থী হয়েছেন। তবে তাঁকে এবার অনেক প্রশ্নেরই জবাব দিতে হবে। সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি হচ্ছে যুদ্ধ বন্ধ, আর সামাজিক খাতে অর্থ বাড়াও। ইরাক থেকে সৈন্য প্রত্যাহার আর ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে সব সেনা প্রত্যাহারের কথা বললেও, লিবিয়ায় নতুন করে যুদ্ধের আরেকটি ফ্রন্ট 'ওপেন' করেছেন তিনি। তাই তার বিজয়টা খুব সহজ হবে না এবার। 'অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট' আন্দোলন সত্যিকার অর্থেই একটি বড় ধরনের ধাক্কা দিয়েছে মার্কিন সমাজে।
লেখক : অধ্যাপক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
দৈনিক ডেসটিনি ১ নভেম্বর,  ২০১১ 
ড. তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়,
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক সদস্য,
tsrahmanbd@yahoo.com 

যুক্তরাষ্ট্রে গণঅভ্যুত্থানের আশঙ্কা


বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরেই আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষকদের মাঝে আলোচিত হচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্রে একটি গণঅভ্যুত্থান কী আসন্ন? গত ৩১ জানুয়ারি নিউইয়র্কের 'অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট' আন্দোলন যখন তার ১৩৫ দিন অতিক্রম করে, তখন সঙ্গত কারণেই এই ধারণাটা বদ্ধমূল হয়, যুক্তরাষ্ট্র একটি বড় ধরনের পরিবর্তনের মুখোমুখি এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে গবেষণা হচ্ছে বিশেষ বিশেষ প্রবন্ধ প্রকাশিত হচ্ছে এই 'অকুপাই ম্যুভমেন্ট'কে কেন্দ্র করে জন্ম হয়েছে অনলাইন সংবাদপত্রের, যারা প্রতিদিনের কর্মসূচি পেঁৗছে দিচ্ছে বিশ্ববাসীর কাছে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের বাসিন্দারা, বিশেষ করে আরব বিশ্বের বাসিন্দারা এই ম্যুভমেন্ট থেকে অনুপ্রাণিত হচ্ছেন আমেরিকার মতো একটি পুঁজিবাদী সমাজে যখন এ ধরনের একটি আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ী হয়, তখন এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, কেন এই 'অকুপাই ম্যুভমেন্ট'? এই ম্যুভমেন্ট কী যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে আদৌ কোনো পরিবর্তন ডেকে আনতে পারবে? কিংবা ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় যে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল এবং যা বিশ্বের অন্যান্য দেশের শোষিত মানুষকে আকৃষ্ট করেছিল, যুক্তরাষ্ট্রের এই 'অকুপাই ম্যুভমেন্ট' কী ঠিক তেমনি অন্যান্য দেশের, বিশেষ করে পুঁজিবাদী বিশ্বের সমাজ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে পারবে? এই প্রশ্ন বড় বেশি করে আলোচিত হবে ২০১২ সালে বলা ভালো, যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে অসমতা, দরিদ্রতা, আর বৈষম্যই সেখানে 'অকুপাই ম্যুভমেন্ট' এর জন্ম দিয়েছে নিউইয়র্কে এই আন্দোলনের জন্ম হলেও, তা ছড়িয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় শহরে একই সঙ্গে এই আন্দোলনে অনুপ্রাণিত হয়েছে ইউরোপের তরুণ সমাজ ইতিহাস সাক্ষী দেয়, এই অসমতা আর বৈষম্যের কারণেই ফরাসি বিপ্লবের জন্ম হয়েছিল রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লবের সৃষ্টি হয়েছিল যদিও চরিত্রগত দিক থেকে ফরাসি বিপ্লব আর রুশ বিপ্লব এক ছিল না
১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়নে ভাঙন ও সমাজতন্ত্রের পতনের পর বিশ্বব্যাপী একটি ধারণার জন্ম হয়েছিল, পুঁজিবাদী সমাজের মঙ্গল আনতে পারে (?) যুক্তরাষ্ট্রের অনেক কনজারভেটিভ তাত্তি্বক (ফুকিয়ামা) এই ধারণার স্বপক্ষে তাদের লেখনি অব্যাহত রাখেন। কিন্তু মাত্র ২০ বছরের মধ্যেই প্রমাণিত হল, পুঁজিবাদও সমাজ বিকাশে কোন অবদান রাখতে পারছে না। পুঁজিবাদী সমাজেই একটি বড় বৈষম্য তৈরি হয়েছে। যেমন বলা যেতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের কথা। শতকরা ১৫ ভাগ মানুষ সে কারণে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদের ৫ ভাগের ১ ভাগের মালিক হচ্ছে জনগোষ্ঠীর মাত্র ১ ভাগ। ১৯৭০ সালে ধনী শ্রেণীর হাতে মোট আয়ের ৯৮ থেকে ৯ ভাগ অর্থ সঞ্চিত হতো। আজ ২০১১ সালে তারা ভাগ করে মোট সম্পদের ২৩ দশমিক ৫ ভাগ। ১০ ভাগ আমেরিকান দেশটির মোট বেতনের ৪৯ দশমিক ৭ ভাগ বহন করে। শীর্ষে থাকা ১ ভাগ ধনী যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ৭০ ভাগের মালিক। আর জোসেফ স্ট্রিগলিৎনের মতে, শীর্ষে থাকা এই ৯ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে যুক্তরাষ্ট্রের মোট সম্পদের ৪০ ভাগ। এই ধনীরা এক রাতে জুয়া খেলায় হেরে যান লাখ লাখ ডলার। যুক্তরাষ্ট্রে এমন এক সমাজের সৃষ্টি হয়েছে, যাকে বলা হচ্ছে পধংড়সঢ় পধঢ়রঃধষরংস। অথচ পরিসংখ্যান বলে, সেখানে ১৬ দশমিক ৪ মিলিয়ন, অর্থাৎ ১ কোটি ৬৪ লাখ শিশু অত্যন্ত গরিব। পার্কে জমায়েত হওয়া অনেক তরুণ জানিয়েছেন তারা গ্রাজুয়েশন করার পর চাকরি পাচ্ছেন না। অথচ ২০১০ সালে কর্পোরেট হাউসগুলোর প্রধান নির্বাহীর বেতন বেড়েছে শতকরা ১৩ ভাগ। যুক্তরাষ্ট্রের সামনে এই যে বৈষম্য, একই ধরনের বৈষম্য লক্ষ্য করা যায় পশ্চিম ইউরোপের অনেক দেশেই। এক ধরনের ্তুপষধহ ধিংঃধমব্থ বা শ্রেণী যুদ্ধের সূচনা হয়েছে পুঁজিবাদী সমাজে। 'অকুপাই ম্যুভমেন্ট'গুলো তার বড় প্রমাণ। এই শ্রেণীযুদ্ধের কথা বলেছিলেন মার্কস। মার্কসের বিশ্লেষণ এই শ্রেণীদ্বন্দ্ব কোনো সমাজে বিপ্লবের সূচনা করতে পারে। মার্কস এবং এঙ্গেলস বিখ্যাত ঞযব পড়সসঁহরংঃ সধহরভবংঃড় গ্রন্থে এই শ্রেণীদ্বন্দ্বের কথা উল্লেখ করে লিখেছিলেন ্তু...ধ ভরমযঃ ঃযধঃ বধপয ঃরসব বহপষড়ফ, বরঃযবৎ রং ধ ৎবাড়ষঁঃরড়হধৎু ৎবপড়হংঃরঃঁঃরড়হ ড়ভ ংড়পরবঃু ধঃ ষধৎমব, ড়ৎ রহ ধ পড়সসড়হ ৎঁরহ ড়ভ ঃযব পড়হঃবহফরহম পষধংংবং। অর্থাৎ দ্বন্দ্বের ফলশ্রুতিতে সমাজে বিপ্লবী পরিবর্তন আসবে অথবা উভয় শ্রেণীর বিলুপ্তি ঘটবে। মার্কস চূড়ান্ত বিচারে শোষিত শ্রেণীর ক্ষমতা গ্রহণের কথা বলেছিলেন। সমাজে শ্রেণীদ্বন্দ্ব সনাতন। আজ এত বছর পরও শ্রেণীদ্বন্দ্বের প্রকাশ ঘটছে 'অকুপাই ম্যুভমেন্ট' আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। মার্কস আজো বেঁচে থাকলে যুক্তরাষ্ট্রের এই শ্রেণীদ্বন্দ্বকে কীভাবে নিষ্পেষণ করতেন, বলতে পারবো না। তবে নোয়াম চমস্কির লেখনিতে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ ব্যবস্থার চমৎকার বিশ্লেষণ পাওয়া যায়। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সমাজকে আখ্যায়িত করেছেন চষঁঃড়পৎধপু হিসেবে, অর্থাৎ সম্পদশালী ধনী শ্রেণীনির্ভর একটি সমাজ। নোয়াম চমস্কি লিখছেন, Increasingly, wealth concentrated in the financial sector। Politicians faced with the rising cast of campaigns, were driven एवर deeper into the pockets of wealthy backers. এটাই হচ্ছে আসল কথা। সম্পদ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে কিছু ধনিক শ্রেণীর হাতে। রাজনীতি, অর্থনীতি এরাই পরিচালনা করে। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসকে বলা হয় ্তুইরষষরড়হধরৎব ভৎরবহফষু্থ। ধনিক শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে কংগ্রেস। ধনীদের টাকায় কংগ্রেস সদস্যরা নির্বাচিত হন। এরপর কংগ্রেস সদস্যরা ধনীদের আরো সুযোগ-সুবিধা দেন। নোয়াম চমস্কি তাই আমেরিকার এই 'অকুপাই ম্যুভমেন্টে' এতটুকুও অবাক হননি! তিনি লিখেছেন, The most exciting aspect of the occupy movement is the construction of the linkage that are taking place all over. If they can be sustained and expanded, occupy can lead to dedicated efforts to set society on a moral human course ।মার্কস যেখানে বিপ্লবের কথা বলেছেন, সেখানে চমস্কি বলছেন Moral human course| এর কথা। বিশ্বজুড়ে যে 'অকুপাই ম্যুভমেন্ট' পরিচালিত হচ্ছে, সেখানে একটা সমন্বয় থাকা দরকার_ এটাও চমস্কির অভিমত। স্পষ্টতই যুক্তরাষ্ট্র তথা পুঁজিবাদী সমাজে একটি পরিবর্তন আসন্ন। কেননা দেখা যাচ্ছে পুঁজিবাদী সমাজে অসমতা ও বৈষম্য বাড়ছে। পশ্চিম ইউরোপ এক সময় ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিয়ে গর্ব করত। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ইউরোপীয় ঐক্যে একটি বড় ধরনের ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে। গ্রিস ও ইতালির পরিস্থিতির রেশ ধরেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভক্তির কথা প্রকাশ্যেই বলা হচ্ছে। ফ্রান্স ও জার্মানি এই বিভক্তির পক্ষে। কেননা ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত গরিব দেশগুলো দেউলিয়া হয়ে পড়েছে। এরা ঋণ গ্রহণ করে ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। বেকার সমস্যা বাড়ছে। শ্রেণীবৈষম্য তৈরি হচ্ছে। জার্মানি ইউরোপে একটি ধনী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত হলেও, দেশটিতে দরিদ্রতার হার ৬ ভাগ, আর বেকারত্বের হার ৬ দশমিক ৬ ভাগ। সুইজারল্যান্ড ইইউর সদস্য নয়। এখানে বেকারত্বের হার ২ দশমিক ৮, আর ৭ ভাগ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। বেলজিয়ামে এই হার যথাক্রমে ৬ দশমিক ৮ ও ১৫ ভাগ। পর্তুগাল ঋণ সমস্যায় জর্জরিত। এখানে বেকারত্ব ও দরিদ্রতার নিচে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১২ দশমিক ৩ ও ১৮ ভাগ। শুধু ইউরোপের কথা কেন বলি। অস্ট্রেলিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া কিংবা তাইওয়ানের মতো শিল্পোন্নত দেশেও 'অকুপাই ম্যুভমেন্ট' এর খবর আমরা জানি। কেননা এসব দেশেও বেকারত্ব বাড়ছে। দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ফলশ্রুতিতে ওইসব দেশেও 'অকুপাই ম্যুভমেন্ট' এর জন্ম হয়েছে।
বলতে দ্বিধা নেই, এই 'অকুপাই ম্যুভমেন্ট' এর জন্ম দিয়েছে তরুণ প্রজন্ম। মানবিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে এরা আন্দোলন গড়ে তুলছেন। যেমনটি হয়েছিল কায়রোতে। তাহরির স্কয়ারের ঘটনা নিঃসন্দেহে 'অকুপাই ম্যুভমেন্ট'কে অনুপ্রাণিত করেছে। মার্কস বলেছিলেন, শোষিত শ্রেণী হচ্ছে বিপ্লবের অন্যতম হাতিয়ার। শ্রমিক শ্রেণী বিপ্লবকে সংঘটিত করবে ও রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করবে। তৎকালীন সময়ে জার্মান ছিল শিল্পোন্নত দেশ। কিন্তু সেখানে বিপ্লব হয়নি। বিপ্লব হয়েছিল সামন্ততান্ত্রিক দেশ রাশিয়ায়। মাও জেডং কৃষকদের সংগঠিত করে দীর্ঘ লংমার্চ করে বিপ্লব সম্পন্ন করেছিলেন। একুশ শতকের এক তরুণ প্রজন্ম, যারা বৈষম্য আর অক্ষমতার শিকার, তারা সামাজিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে বিশ্বব্যাপী একটি পরিবর্তন আনছেন। এই পরিবর্তনকে 'বিপ্লব' বলা যাবে কি না, জানি না; কিন্তু একুশ শতকে বিশ্ব যে একটি পরিবর্তন লক্ষ্য করবে তা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
এই পরিবর্তন সমাজকে কতটুকু বদলে দেবে বলা মুশকিল। রাশিয়ায় বিপ্লবের পর সমাজ বদলে গিয়েছিল। কিন্তু দীর্ঘ ৭০ বছর দেখা গেল সেখানে একটি শ্রেণী তৈরি হয়েছে, যারা সমাজতন্ত্রের নামে ক্ষমতা ও অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। সেখানেও বৈষম্য তৈরি হয়েছিল। আশির দশকের শেষের দিকে আমি পূর্ব ইউরোপে এই বৈষম্য দেখেছি। রাশিয়ায়ও এই বৈষম্য আমার চোখে পড়েছিল। মাওজে ডং একবার বলেছিলেন, পার্টি অফিস গুঁড়িয়ে দাও। তেং সিয়াও পিং পার্টি অফিস গুঁড়িয়ে দেননি। কিন্তু অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছিলেন। চীন এখন আর ধ্রুপদী মার্কসবাদ অনুসরণ করে না। পবিরর্তন সেখানে এসেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে কী পরিবর্তন আসছে? যেভাবে আমেরিকার সমাজ বিকশিত হচ্ছে, সেভাবে আর বিকশিত হবে না। পরিবর্তন সেখানে আসবেই। একসময় মার্কসবাদীরা বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতেন। এখন তারা সশস্ত্র পথ পরিত্যাগ করে (নেপালি মাওবাদীরা) সমাজে পরিবর্তন আনতে চাচ্ছেন। এটা একটা নতুন দিক। বিপ্লবের ধরন বদলে গেছে। একুশ শতকে বিশ্ব প্রত্যক্ষ করবে এক নতুন ধরনের বিপ্লব। আর যুক্তরাষ্ট্রে একটি গণঅভ্যুত্থান এই বিপ্লবের নতুন একটি মাত্রা দেবে। 
ড. তারেক শামসুর রেহমান
প্রফেসর, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

আরব বসন্ত থেকে ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলন

অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান
 
২০১১ সাল শেষ হয়ে গেল আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অনেক ঘটনার মধ্যে দিয়ে। বিদায়ী বছরটি শুরু হয়েছিল আরব বিশ্বে গণজাগরণের মধ্যে দিয়ে। আর শেষ হল উত্তর কোরিয়ার ‘মহান নেতা’ কিম জং ইলের মৃত্যু ও তার ছোট সন্তান কিম জং উনের ক্ষমতা গ্রহণের মধ্যে দিয়ে। কোন সমাজতান্ত্রিক দেশ যে পারিবারিকভাবে শাসিত হতে পারে উত্তর কোরিয়া তার বড় প্রমাণ। একসময় উত্তর কোরিয়া শাসন করতেন ‘লৌহমানব’ কিম উল সুং। তার মৃত্যুর পর (১৯৯৪) ক্ষমতা নেন তার সন্তান কিম জং ইল। আর এখন ক্ষমতা নিলেন কিম জং উন। ২০১১ সালের অনেক ঘটনার মধ্যে এই ঘটনাটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, কিম জং উন উত্তর কোরিয়ায় এক ধরনের সংস্কার আনতে পারেন, দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে ‘যুদ্ধে’ জড়িয়ে পড়তে পারেন কিংবা তার শাসনামলে দুই কোরিয়া একত্রিত হতে পারে। এমনকি পারিবারিক দ্বন্দ্বেও জড়িয়ে পড়তে পারেন কিম জং উন। অনেক প্রশ্নকে সামনে রেখে এখন কোরিয়ার রাজনীতি আবর্তিত হবে। মনে রাখতে হবে, উত্তর কোরিয়া অষ্টম পারমাণবিক শক্তিধর দেশ। একদিকে উত্তর কোরিয়ায় চরম খাদ্য সংকট, অন্যদিকে উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচি, সব মিলিয়ে কোরীয় উপদ্বীপের রাজনীতি যে আগামী দিনগুলোতে আলোচিত হতে থাকবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

২০১১ সালে বেশক’টি বিষয় আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ঝড় তুলেছিল। ১৯৬৮ সালে সাবেক চেকোস্লাভিয়ার রাজধানী প্রাগে সমাজতন্ত্রবিরোধী যে আন্দোলনের জš§ হয়েছিল এবং সোভিয়েত সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে যা নস্যাৎ হয়ে গিয়েছিল, ইতিহাসে ওই আন্দোলন চিহ্নিত হয়ে আছে ‘প্রাগ বসন্ত’ হিসেবে। ২০১১ সালের পুরোটা সময় আরব বিশ্বে একটা গণআন্দোলনের জš§ হয়েছিল, যা চিহ্নিত হয়েছে ‘আরব বসন্ত’ হিসেবে। যুক্তরাষ্ট্রে পুঁজিবাদবিরোধী যে ‘অকুপাই মুভমেন্ট’-এর জš§ হয়েছে, তার রেশ এখনও রয়ে গেছে। ওই মুভমেন্টের সঙ্গে ‘আরব বসন্ত’-এর সরাসরি কোন মিল নেই সত্য, কিন্তু অসমতা আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে ‘অকুপাই মুভমেন্ট’-এর স্পিরিট এর সঙ্গে ‘আরব বসন্ত’-এর স্পিরিটের একটা মিল আছে। কেননা আরব বিশ্বে একটা শ্রেণী দীর্ঘদিন ধরে সব ধরনের ক্ষমতা ভোগ করে আসছিলেন। সেখানেও একটা অসমতা ও বৈষম্য তৈরি হয়েছিল। তিউনেসিয়ার তরুণ ফল বিক্রেতা (সনি ছিলেন বেকার এক কম্পিউটার গ্রাজুয়েট) বুয়াজিজি ছিলেন সেই অসমতা আর বৈষমের প্রতীক। বুয়াজিজির আÍহত্যা তিউনেসিয়ায় ‘আরব বসন্ত’র সূচনা করেছিল, যা ছড়িয়ে গিয়েছিল মিসর, মরক্কো, বাহরাইন, লিবিয়া ও সিরিয়াতে। সিরিয়া বা বাহরাইনে এখন অবদি সরকার পরিবর্তন না হলেও, এক নায়কতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটেছে তিউনেসিয়ায় জয়নাল আবেদিন বেন আলীর, মিসরের হোসনি মোবারকের, লিবিয়ার গাদ্দাফির, আর ইয়েমেনের আলী আবদুল্লাহ সালেহের। সঙ্গত কারণেই টাইমস সাময়িকী যখন এই গণঅভ্যুত্থানকে বছরের সেরা ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করে, এর পেছনে যুক্তি রয়েছে বৈকি! কিন্তু শুধু ওই গণঅভ্যুত্থানকে সেরা ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না। আমার বিবেচনায় মে মাসে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদ শহরে আল কায়দার শীর্ষ নেতা ওসামা বিন লাদেনের হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও বিশ্ব রাজনীতিতে ২০১১ সালের অন্যতম সেরা ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হতে বাধ্য। এর পেছনে যুক্তিও রয়েছে।

বিশ্ব রাজনীতিতে আল কায়দার উত্থান ও ইসলামী সন্ত্রাসবাদের জš§ বিশ্ব রাজনীতিকে পরিপূর্ণভাবে বদলে দিয়েছিল। একসময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বব্যাপী আগ্রাসী মনোভাবের কারণে বিশ্ব রাজনীতিতে জš§ হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একমাত্র চ্যালেঞ্জকারী শক্তি। কিন্তু ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী মনোভাবকে চ্যালেঞ্জ করার কেউ থাকল না। কিন্তু ২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে টুইন টাওয়ারে হামলা ও তা ধ্বংস করা, পেন্টাগনের ব্যর্থ বিমান হামলা চালানোর মধ্যে দিয়ে সারা বিশ্ব জানলো আল-কায়দা নামের একটি সংগঠনের নাম, যারা ইসলাম ধর্মকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করেছিল। যদিও এটা আজো অস্পষ্ট রয়ে গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একসঙ্গে একই সময়ে চারটি বিমান হাইজ্যাক করে আÍঘাতী হামলা চালানোর সঙ্গে ইসলামী জঙ্গিরা কতটুকু জড়িত ছিল। যদিও আল-কায়দা ওই হামলার সঙ্গে তার দায় স্বীকার করে নিয়েছিল, কিন্তু আরেক প্রশ্নের জবাব আজও মেলেনি। টুইন টাওয়ার হামলাকে কেন্দ্র করে আফগানিস্তান আক্রমণ করা ও দেশটি দখল করে নেয়া, পাকিস্তানে লাদেনের আশ্রয় ও পাকিস্তান গোয়েন্দা সংস্থার তা না জানার কথা, ইত্যাদি গত দশ বছরে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে, যেসব প্রশ্নের জবাব এই মুহূর্তে হয়তো পাওয়া যাবে না, কিন্তু ইতিহাস হয়তো একদিন বলবে কী ঘটেছিল লাদেনকে ঘিরে। লাদেন অ্যাবোটাবাদে বসবাস করতেন পাঁচ বছর ধরে এবং দুই স্ত্রীসহ কোন রকম নিরাপত্তা ব্যুহ ছাড়াই। যাকে সারা বিশ্বের গোয়েন্দারা হন্যে হয়ে খুঁজছিল, তিনি কিনা একাকী বসবাস করতেন একটি বাড়িতে! পাকিস্তানের কোন গোয়েন্দা সংস্থাই তা জানবে নাÑ এটা কী বিশ্বাসযোগ্য? লাদেনকে হত্যার পর ‘ফরেন পলিসি’ ম্যাগাজিনের অনেকগুলো ছবি ছাপা হয়েছিল অ্যাবোটাবাদের ওই বাড়িকে নিয়ে। একটি ছবি ছিল পাঁচ বছর আগের তোলা। সূত্র সিআইএ। স্যাটেলাইট থেকে তোলা ওই বাড়িটি দেখানো হয়েছিল। প্রশ্ন এসে যায়, পাঁচ বছর আগে যদি সিআইএ ওই বাড়িটি চিহ্নিত করে থাকে (যেখানে লাদেন লুকিয়ে থাকতে পারেন এমন আশংকা করা হয়েছিল), তাহলে সিআইএ এত সময় নিল কেন লাদেনকে হত্যা করার? আরও একটা প্রশ্ন মৃত লাদেনের ছবি সিআইএ ‘রিলিজ’ করল না কেন? নাকি লাদেনের নামে যাকে হত্যা করা হয়েছিল, সে অন্য কেউ! এসব প্রশ্নের কোন জবাব নেই। তবে লাদেনকে নিয়ে একটা ‘মিথ’ তৈরি হয়েছিল। এই ‘মিথ’কে উসকে দিয়ে বিশ্বব্যাপী ইসলামের বিরুদ্ধে একটা প্রচারণা চালানো হয়েছিল। আর এর মধ্যে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার স্বার্থ আদায় করে নিয়েছে। বিশ্বব্যাপী তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইরাক দখল করে নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। আর সর্বশেষ ঘটনায় গাদ্দাফিও উৎখাত হলেন।

যুদ্ধ মানেই ব্যবসা। যুদ্ধের নামে কোটি কোটি ডলারের ব্যবসা করেছে মার্কিন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো। ইরাক ও আফগানিস্তানে যুদ্ধের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের মতো ৩ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার। প্রতি মাসে এই দুটো দেশে যুক্তরাষ্ট্রের খরচ ৯ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলার। চিন্তা করা যায় কী বিপুল পরিমাণ অর্থ যুক্তরাষ্ট্র ব্যয় করেছে এই ‘যুদ্ধ’ এর পেছনে। সুতরাং অবিশ্বাস্য লাদেনের মৃত্যু আমার কাছে ২০১১ সালের অন্যতম একটি ঘটনা। এর গুরুত্ব এ কারণে বেশি যে লাদেনের মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড আদৌ বন্ধ হয়ে যাবে কিনা? যদিও লাদেনের মৃত্যুর ছ’মাস পার হয়ে গেছে এবং আল কায়দার কোন বড় ধরনের আক্রমণ আমরা বিশ্বের কোথাও লক্ষ্য করছি না। যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ এর যে ধারণা উসকে দিয়েছিল, তাতে কোটি কোটি ডলার খরচ করেও ওই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আদৌ বন্ধ করা যায়নি। ইরাকে ও আফগানিস্তানে আÍঘাতী বোমা সংস্কৃতির জš§ হয়েছে। পাকিস্তান আজ ভেঙে যাওয়ার উপক্রম। আগামী ২০ বছরে এ অঞ্চলের মানচিত্র যদি বদলে যায়, আমি অবাক হব না। ২০১১ সালের আরও বেশ কয়েকটি ঘটনা গুরুত্বের দাবি রাখে। যেমন বলা যেতে পারে ইউরোপের অর্থনৈতিক সংকট। ইউরোপের এই অর্থনৈতিক সংকটে পর্তুগাল, চীন ও ইটালির সরকারের পতন ঘটেছে। গ্রিসের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। রাষ্ট্রটি দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম। কৃচ্ছ্র সাধন করেও অর্থনীতিকে বাগে আনা যাচ্ছে না। ইউরোপের ওই অর্থনৈতিক সংকট দু’টো বিষয়কে সামনে নিয়ে এসেছে। এক. একক মুদ্রা হিসেবে ইউরো টিকে থাকবে কিনা? দুই. ইউরোপীয় ইউনিয়ন তার ঐক্যকে ধরে রাখতে পারবে কিনা? ২৭টি দেশ নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এর মাঝে ১৭টি দেশে ইউরো চালু রয়েছে। একটা প্রশ্ন ইতিমধ্যে উঠেছে যে ইউরোপের ধনী দেশগুলো ইউরোপের অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যেই ধনী ও গরিব রাষ্ট্রের জš§ হয়েছে। ইউরোপের এই সংকট ২০১২ সালেও অব্যাহত থাকবে, যা নতুন নতুন সংকটের জš§ দেবে।

ফুকুসিমায় পারমাণবিক বিস্ফোরণ, ডারবানে ব্যর্থ জলবায়ু সম্মেলন, ইরানের পারমাণবিক সংকট, ইত্যাদি বিষয়গুলোকেও হালকাভাবে দেখার কোন সুযোগ নেই। ফুকুসিমায় পারমাণবিক বিস্ফোরণের পর এখন পারমাণবিক বিদ্যুতের ভবিষ্যৎ একটা প্রশ্নের মুখে থাকল। খোদ জাপানের মতো দেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন যেখানে ঝুঁকির মুখে, সেখানে বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে একটা প্রশ্ন থাকবেই। বাংলাদেশ এরই মাঝে রাশিয়ার সঙ্গে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের ব্যাপারে একটি চুক্তি করেছে। ডারবানে কপ-১৭ সম্মেলনে বিশ্বের উষ্ণতা হ্রাসকল্পে একটি চুক্তিতে উপনীত হতে ব্যর্থ হওয়ায় ধনী ও গরিব দেশগুলোর মধ্যে ‘জলবায়ু বৈষম্য’ আরও বাড়লো। গত বেশকয়েক বছর ধরে ‘কপ’ সম্মেলন হয়ে আসছে। কিন্তু কোন ঐকমত্যে পৌঁছান সম্ভব হচ্ছে না। ইতিমধ্যে বিশ্বের দেশগুলোয় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রশ্নে নানা ধরনের প্রশ্নের জš§ হয়েছে। ডারবানে কিয়োটো চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে সত্য, কিন্তু কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ যদি হ্রাস করা না যায়, তাহলে বিশ্ববাসীর জন্য তা কোন ভালো সংবাদ নয়।

গেল বছর পাকিস্তান ও রাশিয়ার জন্যও কোন ভালো সংবাদ ছিল না। পাকিস্তানে একাধিকবার সামরিক অভ্যুত্থানের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। সর্বশেষ ঘটনায় সেনাবাহিনীর সঙ্গে প্রেসিডেন্ট জারদারির সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। এমনকি রাজনৈতিক নেতৃত্বের মাঝেও বিভক্তি লক্ষ্য করা গেছে। পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কেরও অবনতি ঘটেছে। পাকিস্তান আফগান শান্তি আলোচনা থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে। ফলে আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ একটি অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। পাকিস্তানের অংশগ্রহণ ছাড়া আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে না। রাশিয়ার রাজনীতিতে অস্থিরতা বাড়ছে। ডিসেম্বরে ‘ডুমা’র নির্বাচন নিয়ে যা হল, তা নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বে ইতিমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। রাশিয়া এক ভিন্ন আঙ্গিকে গণতন্ত্র চর্চা করছেÑ সেখানে ব্যক্তি ও দলীয় কর্তৃত্ব বাড়ছে। পুতিনকে ঘিরে তৈরি হয়েছে একটি ‘রাজনৈতিক বলয়’, যারা যেভাবে হোক ক্ষমতা ধরে রাখতে চাইছে, অনেকটা সাবেক সোভিয়েত শাসনামলে কমিউনিস্ট পার্টির মতো। পুতিন আবার মার্চে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ক্ষমতায় তিনি থাকতে চান। ১৯৯৯ সালের পর থেকেই তিনি ক্ষমতায় আছেন। প্রথমে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত, পরে পর পর দু’বার প্রেসিডেন্ট, এর পর আবার প্রধানমন্ত্রী। ইতিমধ্যে সেখানে যে গণবিক্ষোভের জš§ হয়েছে, তার নামকরণ করা হয়েছে ‘স্লাভিক বসন্ত’ হিসেবে। রাশিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট মেদভেদেভ রাশিয়ায় একটি সংস্কারের আহ্বান জানালেও, সেখানে আদৌ কোন সংস্কার আনা হবে কিনা, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। মূলত একদিকে গণতন্ত্রের লড়াই অন্যদিকে অসমতা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ২০১১ সালের বিশ্ব রাজনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছিল। এর প্রভাব চলতি বছরেও অনুভূত হবে।
দৈনিক যুগান্তর, ১ জানুয়ারি ২০১২
ড. তারেক শামসুর রেহমান