শনিবার, ৩০ জুন, ২০১২

সিরিয়ায় বহিঃশক্তির হস্তক্ষেপ বিষয়ে কফি আনানের স্বীকৃতি


ব দ র“ দ্দী ন উ ম র
যে কথা কফি আনানের অনেক আগেই বলা দরকার বা উচিত ছিল সে কথা তিনি অবশেষে বললেন। কথাটি হল, বাইরের শক্তিগুলোই সিরিয়ায় সহিংসতা ছড়িয়ে দি”েছ (উধরষু ঝঃধৎ ৩০.৬.২০১২)। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, তার পক্ষে এ কথা বলার অসুবিধা ছিল এবং এখনও আছে। আমেরিকা কর্তৃক ইরাক আক্রমণের সময় জাতিসংঘের মহাসচিব হিসেবে তিনি যেসব তথ্য জানতেন, সেগুলো কি আজ পর্যন্ত তার পক্ষে প্রকাশ করা সম্ভব হয়েছে? সাম্রাজ্যবাদের হাতিয়ার জাতিসংঘের সর্বো”চ কর্মকর্তা হিসেবে তাকে যেসব কাজ করতে হতো, তাতে তার বিবেক কি কালিমামুক্ত আছে? এসব কথা এক হিসেবে অবান্তর, কারণ জাতিসংঘের মহাসচিবের পদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার সহযোগী সাম্রাজ্যবাদীরা এমন লোককে দেয় না বা দিতে পারে না, যিনি সাম্রাজ্যবাদের পরিবর্তে বিশ্বের অনুন্নত ও পশ্চাৎপদ দেশ এবং নিপীড়িত জনগণের স্বার্থের পক্ষে দাঁড়াবেন।
লিবিয়ায় মোয়াম্মার গাদ্দাফির শাসন উৎখাত করে সে দেশটিকে পদানত করার পর এখন সাম্রাজ্যবাদীরা সিরিয়াকে ধ্বংস করার চক্রান্ত বেশ খোলাখুলিভাবেই ঘোষণা ও কার্যকর করছে। এর জন্য তারা মধ্যপ্রাচ্যে তাদের গোলাম রাষ্ট্রগুলোকে বেশ ভালোভাবেই ব্যবহার করছে। এই গোলাম রাষ্ট্রগুলোর সংগঠন আরব লীগ লিবিয়ায় সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের সময় তাদের স্বার্থেই ছিল সক্রিয় সহযোগী হিসেবে। কিš‘ সিরিয়ায় লিবিয়ার মতো জাতিসংঘের বেপরোয়া হস্তক্ষেপের পরি¯ি’তি না থাকায় আরব লীগ এখন জাতিসংঘের লেজুড় হিসেবে সরাসরি কাজ করছে। এই কার্য সুসম্পন্ন করার উদ্দেশ্যেই জাতিসংঘ এবং আরব লীগ যৌথভাবে সাবেক জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনানকে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে সিরিয়ার পরি¯ি’তি সামাল দেয়ার কাজে নিযুক্ত করেছে।
লিবিয়ায় হড় ভষু ুড়হব প্রস্তাবে রাশিয়া ও চীন ভেটো না দেয়ায় সাম্রাজ্যবাদীরা যেভাবে অবাধে সে দেশের ওপর বোমাবর্ষণ করে শুধু বিমানবাহিনী নয়, ¯’লবাহিনীকেও শেষ পর্যন্ত ধ্বংস করেছিলÑ সেরকম সুযোগ এখনও পর্যন্ত সিরিয়ার ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয়নি। কারণ লিবিয়ার ক্ষেত্রে নিজেদের ভেটো ব্যবহার না করে রাশিয়া ও চীন যে বোকামি করেছিল, তার খেসারত তারা দিয়েছে। লিবিয়ায় ন্যাটো শক্তিগুলো তাদের তেলসহ সেখানকার কোন কিছুতে ভাগ না দিয়ে তাড়িয়ে দেয়ার পর এখন তাদের হুঁশ হয়েছে। কাজেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো সিরিয়ায়ও লিবিয়ার মতো হড় ভষু ুড়হব কার্যকর করার চেষ্টা করলেও রাশিয়া ও চীন এখন তার বিরোধী। তা ছাড়া লিবিয়া থেকে সিরিয়া স্ট্র্যাটেজির দিক দিয়ে রাশিয়ার কাছে অনেক বেশি গুর“ত্বপূর্ণ। সেদিক দিয়েও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সিরিয়ার ব্যাপারে হাত মেলানোতে রাশিয়া ও সেই সঙ্গে চীনের অসুবিধা আছে। সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের এই দ্বন্দ্ব সিরিয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছে। এ কারণেই এখনও পর্যন্ত সিরিয়া একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে টিকে আছে, যদিও শেষ পর্যন্ত অব¯’া কী দাঁড়াবে, সেটা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়।
লিবিয়ার মতো সিরিয়ায়ও সাম্রাজ্যবাদীরা প্রতিষ্ঠিত সরকারের বির“দ্ধেই বিদ্রোহের সূত্রপাত করেছে। এদিক দিয়ে ‘আরব বসন্ত’-খ্যাত তিউনিসিয়া ও মিসরের অব¯’া অন্যরকম। এই দুই দেশে বিদ্রোহ ও প্রতিরোধের ক্ষেত্রে জনগণের যে স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল, সিরিয়ার ক্ষেত্রে তা একেবারেই নেই। প্রেসিডেন্ট আসাদ প্রথম থেকেই বলে আসছেন যে, বাইরের শক্তি সিরিয়ার বিদ্রোহীদের গ্র“প খাড়া করে তাদের অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহ করছে। প্রথমে ছোট আকারে এটা করলেও এখন খুব বড় ও বিশাল আকারে তারা এটা করছে। এর অন্য একটি দিক হ”েছ, এ কাজ যে তারা করছে এটা গোপন করা এখন তাদের পক্ষে সম্ভব হ”েছ না। শুধু তাই নয়, তারা এবং মধ্যপ্রাচ্যে তাদের গোলাম রাষ্ট্রগুলোও এ নিয়ে কোন গোপনীয়তার প্রয়োজন বোধ করছে না। কয়েক দিন আগে সৌদি আরব সরকারিভাবে ঘোষণা করেছে যে, আসাদের বির“দ্ধে যে বিদ্রোহী বাহিনী গঠিত হয়েছে তার সদস্যদের বেতন তারা দেবে! অর্থাৎ এই ‘বিদ্রোহী’ বাহিনীকে তারা আগে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করলেও এখন সেই বাহিনীর সদস্যদের চাকরি রক্ষার দায়িত্বও সৌদি আরব নিয়েছে! তাদের অর্থের কোন অভাব নেই। হাজার হাজার কোটি ডলার ব্যয় করে যারা নিয়মিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিনা প্র্রয়োজনে সামরিক বিমান, ট্যাংক, যুদ্ধজাহাজসহ সবরকম যুদ্ধ-সরঞ্জাম কেনে, তাদের পক্ষে সিরিয়ার বিদ্রোহী বাহিনী প্রতিপালন এমন কোন বড় ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার নয়। এ কাজ যে তারা শুধু নিজেদের প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্রীয় অব¯’ান থেকেই করছে তা নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হুকুম অনুযায়ীই এটা হ”েছ। 
সিরিয়ায় এখন প্রতিদিনই দুই পক্ষের আক্রমণে মানুষের জীবন যা”েছ। এর মধ্যে যেমন সেনাবাহিনীর লোক আছে, তেমনি আছে নিরীহ লোক, নারী, শিশু, বৃদ্ধÑ সব ধরনের লোক। কাতারভিত্তিক আলজাজিরা টেলিভিশন চ্যানেল থেকে নিয়ে সিএনএন, বিবিসিসহ দেশে দেশে সাম্রাজ্যবাদীদের সহযোগী এবং আশ্রিত ও অনুগত দেশটির টিভি চ্যানেলগুলোতে ও সেই সঙ্গে সংবাদপত্রে এ খবর এমনভাবে প্রচারিত হ”েছ, যাতে মনে হবে শুধু সরকার পক্ষের আক্রমণেই এভাবে এ পর্যন্ত পনের হাজার লোক সিরিয়ায় নিহত হয়েছে। কিš‘ বাস্তব ঘটনা এই যে, তথাকথিত বিদ্রোহী বাহিনীর আক্রমণেই এসব হত্যাকাণ্ড বেশি হ”েছ। এর একটা বড় প্রমাণ এই যে, এ হত্যাকাণ্ডের শিকার হ”েছ সিরীয় সামরিক বাহিনীর সদস্যরাই। যদি সরকারবিরোধীদের শক্তিশালী আক্রমণ না হতো তাহলে এভাবে সামরিক বাহিনীর লোকেরা নিহত হতো না। এ কারণে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার প্রথম থেকেই বলে আসছেন, যেহেতু সরকারি বাহিনীর ওপর বিদেশী সহায়তাপ্রাপ্ত তথাকথিত বিদ্রোহী বাহিনীর সন্ত্রাসীরা আক্রমণ চালা”েছ, কাজেই তাদের প্রতিহত করা ছাড়া কোন উপায় নেই। কফি আনান সিরিয়ার ‘শান্তির দূত’ হিসেবে জাতিসংঘ এবং আরব লীগের দ্বারা নিযুক্ত হওয়ার পর তার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় প্রেসিডেন্ট আসাদ তাকে বারবার এ কথা বলেছেন। কিš‘ তিনি এ কথায় বিশেষ কান না দিয়ে প্রায় একতরফাভাবেই আসাদকে এর জন্য দায়ী করে এসেছেন। কিš‘ এখন সিরিয়ায় বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর হস্তক্ষেপ এত খোলাখুলিভাবে শুর“ হয়েছে যে, কফি আনান এটা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন, সিরিয়ায় বিদেশী শক্তিগুলো সেখানে সহিংসতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কাজ করছে!
সিরিয়ার সীমানা লংঘন করে তুর্কি বিমান ঢুকে পড়লে তাতে দোষ নেই। দোষ হ”েছ সেই অনুপ্রবেশকারী বিমান গুলি করে ভূপাতিত করায়! আরব দেশগুলোর বাইরে তুর্কি ন্যাটোর ল্যাংড়া সদস্য হিসেবে এখন সিরিয়াবিরোধিতায় খুব সক্রিয়। তারা বলছে, প্রতিবেশী দেশ সিরিয়া আক্রমণের কোন ই”ছা তাদের নেই। কিš‘ তা সত্ত্বেও সিরিয়া সীমান্তে তারা বড় আকারে সৈন্য সমাবেশ করছে। তুর্কির কথায় বিশ্বাসের কারণ যে নেই, এটা বলার দরকার হয় না। কাজেই তুর্কি তাদের সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ শুর“ করার পাল্টা হিসেবে সিরিয়াও এখন তাদের তুর্কি সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করছে। এভাবেই এ অঞ্চল এখন উত্তপ্ত হ”েছ এবং এক যুদ্ধাব¯’া সেখানে তৈরি হ”েছ।
সাম্রাজ্যবাদীদের প্রতিনিধি হিসেবে কফি আনান সিরিয়ায় একটি ‘জাতীয় ঐক্যের সরকার’ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেছেন। তবে ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, অনেক বাইরের শক্তি সিরিয়ার ব্যাপারে গভীরভাবে জড়িত আছে। তার ছয় দফা ঐক্য প্রস্তাবে তাদের আনুষ্ঠানিক সম্মতি থাকলেও তাদের মধ্যে এক্ষেত্রে বিভেদ খুব স্পষ্ট। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট আসাদ ২৮ জুন ইরানি টেলিভিশনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, যারা তার সরকারের বির“দ্ধে সন্ত্রাসী আক্রমণ চালা”েছ তাদের নির্মূল করতে তারা বদ্ধপরিকর। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, সিরিয়ার সমস্যা সিরিয়াই মোকাবেলা করবে। কোন বাইরের শক্তিকেই এখানে নাক গলাতে দেয়া হবে না। কিš‘ প্রেসিডেন্ট আসাদ যা-ই বলুন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদীরা নিজেরা তো বটেই, এমনকি মধ্যপ্রাচ্যে তাদের অনুগত রাষ্ট্রগুলোকেও তারা এখন সিরিয়ার বির“দ্ধে ব্যবহার করছে। সিরিয়ার পরিণতি শেষ পর্যন্ত কি দাঁড়াবে বলা যায় না। তবে সিরিয়া যদি সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা ধ্বংস হয়, তাহলে তারপর তাদের দৃষ্টি পড়বে লেবাননের ওপর। সেখানে তারা হিজবুল্লাহকে ধ্বংস করে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের অখণ্ড আধিপত্য নতুনভাবে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আর এক পা এগিয়ে যাবে। সিরিয়ায় যেমন, লেবাননেও তেমনি সৌদি আরব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে গুর“ত্বপূর্ণ মধ্যপ্রাচ্য এজেন্ট হিসেবে কাজ করবে। যে পর্যন্ত না সৌদি আরবে ‘আরব বসন্তের’ তুফান উঠবে, সে পর্যন্ত এই দেশটি ইসরাইলের মতোই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের এক শক্তিশালী ঘাঁটি এবং সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যের জনগণের জন্য এক বিপজ্জনক রাষ্ট্র হিসেবে তাদের এই ভূমিকা পালন করে যাবে।
৩০.৬.২০১২

বুধবার, ২৭ জুন, ২০১২

মুরসি—মিসরের প্রথম নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি


মোহাম্মদ মুরসি
মোহাম্মদ মুরসি
ফারুক চৌধুরী

২০১২ সালের ২৪ জুন মিসরের সুপ্রাচীন এবং সুদীর্ঘ ইতিহাসের একটি বিশেষ দিন হয়ে রইবে। এই দিনে মিসরের জনগণ তাদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ‘মুসলিম ব্রাদারহুডের’ রাজনৈতিক বাহু ‘ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির’ মোহাম্মদ মুরসিকে ৫১ দশমিক ৭৩ শতাংশ ভোটে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচন করল। মিসরের ইতিহাসে তিনিই প্রথম নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী আহমেদ শফিক পেয়েছেন ৪৮ দশমিক ২৭ শতাংশ ভোট। আহমেদ শফিক অপসারিত রাষ্ট্রপতি হোসনি মোবারকের সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। মিসরে দুই কিস্তিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। ২০১২ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রথম রাউন্ডে ১০ জন প্রার্থী ছিলেন। নির্বাচনের নিয়ম অনুযায়ী তাঁদের মধ্যে অধিকতর ভোট পাওয়া দুজন প্রার্থী মোহাম্মদ মুরসি আর আহমেদ শফিক জুন ২০১২ সালের প্রথম সপ্তাহের নির্বাচনের দ্বিতীয় রাউন্ড লড়লেন। তাতে বিজয়ী হলেন মোহাম্মদ মুরসি।
মিসরের অনেক ভোটদাতাই এই দুজন প্রার্থী নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিলেন। আহমেদ শফিক অতীতে হোসনি মোবারকের বেসামরিক বিমান চলাচলমন্ত্রী হিসেবে যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু অসাম্প্রদায়িক ও উদারপন্থী হিসেবে পরিচিত এই সাবেক সামরিক কর্মকর্তাকে অনেকেই সামরিক শাসকের ঘরানার বলে মনে করেছিলেন। তাই দ্বিধা সত্ত্বেও তাঁরা মোহাম্মদ মুরসিকে সমর্থন জানিয়েছেন। অন্যদিকে ‘ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি’ তথা মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রার্থী মোহাম্মদ মুরসি রাষ্ট্রপতি হিসেবে মিসরের সংখ্যালঘু কপটিক খ্রিষ্টান সম্প্রদায় (মিসরের জনসংখ্যার ১০ শতাংশ), নারীসমাজ ও অসাম্প্রদায়িক জনগোষ্ঠীর মধ্যে কতটুকু গ্রহণযোগ্য হবেন, তা নিয়ে সন্দেহ ছিল। সেই কারণে সামরিক ঘরানার বিরোধী অনেক উদারপন্থীই আহমেদ শফিককে ভোট দিয়েছেন। তবে শেষ কথা হলো এই যে, বিপুল সংখ্যাধিক্যে না হলেও ভোটের ফলাফল মোহাম্মদ মুরসির অনুকূলে গিয়েছে।
তাঁর বিজয় ঘোষিত হওয়ার অব্যবহিত পরই মোহাম্মদ মুরসি ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’ এবং ‘ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি’র সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক ছেদ করেছেন এবং বলেছেন যে জাতমত ভেদে তিনি মিসরীয় সব নাগরিকের রাষ্ট্রপতি। মিসরে আরব বসন্তের এমনই নির্মম পরিহাস, যখন তাহরির স্কয়ারে গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল তখন মুসরি ছিলেন মোবারকের জেলে, আর তিনি যখন রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন তখন সেই মোবারকই যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করছেন। 
কায়রোর তাহরির স্কয়ারেই মিসরের মোবারকবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছিল মাত্র দেড় বছরেরও সামান্য বেশি সময় আগে। ২০১২ সালের ২৪ জুন মোহাম্মদ মুরসির বিজয় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে তাহরির স্কয়ার আবার ফেটে পড়ল আনন্দের বিস্ফোরণে। নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে ‘আন্তরিক অভিনন্দন’ জানালেন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী আহমেদ শফিক। মিসরের সামরিক জান্তার নেতা জেনারেল তানতাওয়িও সেই অভিনন্দন জানানোর পালায় যোগ দিলেন। প্রেসিডেন্ট ওবামা টেলিফোনে নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি মুরসিকে জানালেন যে তিনি তাঁর সঙ্গে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু নির্বাচনের ফলাফলকে সম্মান (Respect) জানালেন। মিসরের খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের বিশপ পাচোমিনও তাঁর রাষ্ট্রপতিকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। এককথায়, দেশে-বিদেশে নির্বাচন-উত্তর আনুষ্ঠানিকতা নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতির জন্য সম্পন্নই হয়েছে, নির্বাচনের ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই। আরব বিশ্বে এই নির্বাচনের বিশেষ প্রভাব পড়বে, প্রধানত এই কারণে যে প্রায় প্রতিটি আরব দেশেই মিসরে ১৯২৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ইসলামিক ব্রাদারহুডের শাখা গত শতাব্দীর বিভিন্ন বছরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তিউনিসিয়ায় যে আরব-বসন্তের সূচনা হয়েছিল, সেখানে আজ ক্ষমতায় রয়েছে অতীতে নিষিদ্ধ, উদারপন্থী ইসলামিক পার্টি ইন্নাহদা। সেই ‘ইন্নাহদা’ দলের মুনসেফ মারজুকি আজ তিউনিসিয়ার রাষ্ট্রপতি। তবে মিসর হচ্ছে আরব বিশ্বের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ। অতএব, মিসরের বিবর্তন আরব বিশ্বকে নাড়া দেবেই। মোদ্দা কথা হলো, আরব বিশ্বে এখন সাধারণ জনগণের কণ্ঠধ্বনি সেই অঞ্চলের শাসকদের মধ্যে আগের চেয়েও অনেক জোরে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হবে।
তবে মিসরে একটি সুষ্ঠু রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেই কথা যেমন সত্যি, তেমনি সত্যি এই কথাটিও যে সেই দেশ এখনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে অনেক দূরেই রয়েছে। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি মুরসির সামনে রয়েছে বিরাট দুটি চ্যালেঞ্জ। তার প্রথমটি অবশ্যই হলো মিসরের সব সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীর কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করা। দ্বিতীয় এবং বোধ করি তার চেয়েও দুরূহ কাজ হবে সামরিক জান্তা, যা SCAF (Supreme Command of the Armed Forces) বলে পরিচিত, তাদের ক্ষমতা খর্ব করে দেশকে গণতন্ত্রের পথে পরিচালনা করা। বর্তমানে দেশের সংবিধান রচনা এবং সংসদ নির্বাচন থেকে শুরু করে বেসামরিক প্রশাসনের অনেক কিছুই SCAF-এর হাতে রয়েছে। তার জন্য প্রয়োজন হবে অপরিসীম ধৈর্য আর সুদীর্ঘ আলোচনার প্রক্রিয়া। তবে এই ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট মুরসিকে দেশের জনগণের সমর্থন সুচিন্তিতভাবে আদায় করে নিতে হবে। মিসরে যে সংবিধান রচিত হতে যাচ্ছে, একমাত্র তা-ই জনগণের সার্বভৌমত্বের নিশ্চয়তা দিতে পারে। প্রতিটি প্রশ্নে তাহরির স্কয়ারের গণ-আন্দোলন তার বিকল্প ব্যবস্থা হতে পারে না। ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক মোহাম্মদ মুরসির জন্য বিরাট একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে রইবে। প্রেসিডেন্ট মুরসি অবশ্য ঘোষণা করেছেন যে তাঁর সরকার সব আন্তর্জাতিক ঘোষণা মেনে চলবে, যার মধ্যে ১৯৭৯ সালের ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত।
এটা বলা যায় যে মিসরে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন আমাদের সমসাময়িক ইতিহাসে বার্লিন দেয়াল ভাঙা অথবা নেলসন ম্যান্ডেলার মুক্তির মতোই তাৎপর্যপূর্ণ একটি ঘোষণা। যদি মিসর নিজেকে মূলত একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে, তাহলে তা একদিন স্বৈরশাসিত আরব দেশগুলোর আদল বদলে দেবেই। নানাভাবে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে সেই সব দেশের আর্থসামাজিক আর রাজনৈতিক অবস্থার ওপর। তা নাড়িয়ে তুলতে পারে সেই সব সমাজের ঘুণে ধরা সব ভিত্তি। আর এই আরব সুনামির পরিণতিও হতে পারে কল্পনাতীত ও সুদূরপ্রসারী। হয়তো বা তা ফিলিস্তিন সমস্যার স্থায়ী সমাধানে সহায়ক হবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৩০ সালে জুইস স্ট্যান্ডার্ড নামের একটি পত্রিকার সাংবাদিকদের কাছে অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানে তাঁর চিন্তা ব্যক্ত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘ফিলিস্তিন সমস্যার স্থায়ী সমাধান লন্ডনে বসে হবে না, তা ফিলিস্তিনেই অর্জন করতে হবে।’ রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘আরব ইহুদি সহযোগিতা ও সহমর্মিতা ছাড়া ইহুদিদের আবাসভূমি (শান্তিপূর্ণ) প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। ফিলিস্তিনে এই উদ্যোগের সাফল্য আসতে পারে শুধু আরব ও ইহুদিদের মধ্যে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ও সহযোগিতার ভিত্তিতে।’ কয়েকটি দশক ধরে সাম্রাজ্যবাদসৃষ্ট স্বৈরাচারী আরব সরকারগুলো পাশ্চাত্যের আজ্ঞাবাহী রয়েছে। একটি গণতান্ত্রিক আরব বিশ্ব এবং ইসরায়েল তাদের পারস্পরিক স্বার্থেই ভবিষ্যতে সেই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হতে পারে। তা অবশ্যই সময়সাপেক্ষ। তবে একটি গণতান্ত্রিক মিসর তার সনাতন ঐতিহ্য নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে একটি ইতিবাচক ভূমিকা অবশ্যই পালন করতে পারবে; সেই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় রাখতে পারবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। 
ফারুক চৌধুরী: সাবেক পররাষ্ট্রসচিব। কলাম লেখক। 
zaaf@bdmail.net

সোনিয়া গান্ধীর স্বাস্থ্যরহস্য দোদুল্যমান ভারতীয় নেতৃত্ব


 ব্রুস রিডেল  

ভারতীয় অর্থনীতির গতিপ্রবাহ এখন নিম্নমুখী। এই মন্থরতার প্রভাব বিশ্ব অর্থনীতিতেও পড়বে। গত এক দশক ধরে ভারতীয় অর্থনীতি ছিল দ্রুত বর্ধনশীল। কিন্তু এখন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রায় ৯ ভাগের জায়গায় নেমে এসেছে ৬ ভাগের কাছাকাছি। কারণ বহুবিধ। তবে শীর্ষ নেতৃত্ব নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে সেটাই বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। গত এক দশকের অধিকাংশ সময় ধরে পৃথিবীর সর্ববৃহত্ গণতান্ত্রিক দেশ ভারতকে যিনি নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন তাঁর নাম সোনিয়া গান্ধী। বর্তমানে তার স্বাস্থ্য ভঙুর। তাই ভারতের রাজনৈতিক প্রভাবালয়ে পরিবর্তনের আলামত বেশ স্পষ্ট।
সোনিয়া গান্ধী আজকের বিশ্বে সবচে’ ক্ষমতাবান নারী নিঃসন্দেহে। এমনকি সম্ভবত বিশ্ব ইতিহাসেও তিনি একজন অধিক প্রভাবশালী নারী। তিনি পৃথিবীর সর্ববৃহত্ গণতান্ত্রিক দেশের রাজনৈতিক নেতা, যে দেশটি জনসংখ্যার দিক থেকে অচিরেই বৃহত্তম দেশের তালিকায় নাম লিখাতে যাচ্ছে। কিন্তু গত বছর আগস্টে ভারতের কংগ্রেস পার্টি একটি ঘোষণা দেয়। এই পার্টি ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন অবসানের পর অধিকাংশ সময় ভারত শাসন করেছে। তাদের সেই ঘোষণায় বলা হয়, দলনেতা সোনিয়া গান্ধী স্বাস্থ্যগত কারণে বিদেশ যাচ্ছেন। তার কী অসুখ, তা ফাঁস করা হয়নি। এক মাস পর তিনি দেশে ফিরে আসেন। কিন্তু তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি-অবনতি বা তিনি কেন বিদেশে চিকিত্সা নিতে গেলেন সে ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু বলা হয়নি। এরপর গত ফেব্রুয়ারিতে তিনি চেকআপের জন্য আবার বিদেশ যাত্রা করলেন। ফিরে এসে তিনি পুনরায় পার্টির হাল ধরলেন। প্রকৃতপক্ষে তিনিই আজকের ভারতের বস।  তাকে জনসম্মক্ষে কয়েকবার দেখা গেছে। কিন্তু যখনই তার ছবি তোলা হয়েছে, তখনই তাকে চনমনে ও কর্মক্ষম মনে হয়েছে।
নেত্রী সোনিয়া গান্ধীকে কোন্ অসুখে পেয়েছে সে সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং অবশ্যই অবগত আছেন। অন্তত আমাদেরকে তাই বলা হয়েছে। কিন্তু অন্য ভারতীয় কর্মকর্তারা সে ব্যাপারে কিছু জানেন না বললেই চলে। কেননা সোনিয়া গান্ধী খুব সতর্কভাবে তার ব্যক্তিগত বিষয়-আশয় আড়াল করে চলেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি নিজ সম্পর্কে ও নিজের নীতিগত চিন্তাধারার বিষয়ে সর্বদা রহস্যের জাল তৈরি করেন। এ পর্যন্ত তার জীবনীর যতটুকু প্রকাশিত হয়েছে তা খুবই মামুলি বিষয়। কিভাবে তিনি এত ক্ষমতাধর হয়ে উঠলেন সে ব্যাপারে বলতে গেলে গভীরভাবে তেমন কিছু বলা হয়নি কোথাও। সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার হল, ভারতীয় গণমাধ্যম পৃথিবীর সবচেয়ে স্পন্দমান গণমাধ্যমের অন্যতম। তারাও এ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেননি। তারা সোনিয়া গান্ধীর বিষয়ে সম্মিলিতভাবে নীরব থেকেছেন।
সিংহাসনের নেপথ্যে তার ক্ষমতার প্রয়োগ নিয়ে কারও কোন প্রশ্ন নেই। তিনি ১৯৯৮ সাল থেকে কংগ্রেসের প্রেডিডেন্ট হিসেবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ২০০৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে তার নেতৃত্বে এই দলটি বিস্ময়করভাবে জয়লাভ করে। এমনকি ২০০৮ সালের বিজয়ও সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়। কংগ্রেসের ১২৫ বছরের ইতিহাসে এখন তিনিই সবচেয়ে দীর্ঘদিনের প্রেসিডেন্ট। তিনি ক্ষমতাসীন জোট ইউপিএ’র (ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স) চেয়ারম্যানও বটে। ভারতীয় অর্থনীতি তার হাত ধরেই উন্নতি লাভ করেছে। লাখ লাখ মানুষ দারিদ্রের কশাঘাত থেকে মুক্তি পেয়েছে। তার সময়ে সংস্কার কর্মসূচির সূচনা হয়েছে। আমেরিকার সাথে বেসামরিক পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। ২০০৮ সালের নভেম্বরে মুম্বাইয়ে সন্ত্রাসী হামলার পরও চির প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের সাথে ভারতের সম্পর্কের অবনতির বদলে উন্নতি হয়েছে। অথচ নাইন ইলেভেনের ঘটনার (টুইন টাওয়ারে হামলা) পর মুম্বাই হামলাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী কর্মকান্ড। মুম্বাই হামলার জবাবে সামরিক পদক্ষেপের পরিবর্তে কূটনৈতিক তত্পরতাকেই অগ্রাধিকার দেয়া হয়। এই ক্রেডিট সোনিয়া গান্ধীকেই দিতে হয়।
সোনিয়া গান্ধী ১৯৪৬ সালের ৯ ডিসেম্বর ইতালির ভেনেটো প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একটি আদর্শ গ্রামে বেড়ে ওঠেন। তার পিতা ছিলেন মুসোলিনির সমর্থক। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পূর্বাঞ্চলীয় রণাঙ্গনে হিটলারের নািস বাহিনী ও ইতালীয় সেনাবাহিনীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেন। সোনিয়া গান্ধী এখনও ক্যাথলিক খ্রিস্টানই রয়ে গেছেন। তবে তিনি হিন্দু উত্সব ও ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করে থাকেন। ১৯৬৫ সালে ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজে রাজীব গান্ধীর সাথে তার দেখা হয়। সোনিয়া তখন ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংলিশের ছাত্রী। আর রাজিব গান্ধী সবে মাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন। সোনিয়া সে সময় সেখানকার একটি গ্রীক রেস্টুরেন্টে পরিচারিকারও কাজ করতেন। সেখানেই দেখা হয় দু’জনের। এরপর মধুর প্রণয় বা ভালবাসার সূত্রপাত হয়। সব বিচারেই এটা একটি নিরেট প্রেম কাহিনী । পরবর্তীতে রাজিব ও সোনিয়া গান্ধীর এক ছেলে ও এক মেয়ে জন্ম নেয়। তারা হলেন রাহুল গান্ধী ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। ১৯৮৪ সালে মা ইন্দিরা গান্ধী আততায়ী শিখ দেহরক্ষীর ব্রাশ ফায়ারে নিহত হন। এরপর প্রধানমন্ত্রী হন রাজীব গান্ধী। রাজীব গান্ধীও ১৯৯১ সালে একজন তামিল নারী সন্ত্রাসীর বোমা হামলায় নিহত হন।
শাশুড়ী ইন্দিরা গান্ধী ও স্বামী রাজীব গান্ধীর হত্যাকান্ড সোনিয়া গান্ধীকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে। তিনি ইন্দিরা গান্ধীর খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন। কেউ কেউ বলে থাকেন যে, সোনিয়া গান্ধীর রোল মডেল হচ্ছেন ইন্দিরা গান্ধী এবং তিনি প্রতিটি ক্ষেত্রে তাকে অনুসরণ করার চেষ্টা করেন। রাজীব গান্ধীর মৃত্যুর পর সোনিয়া গান্ধীর নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়। আমার মনে আছে, ১৯৯৮ সালে নয়াদিল্লীতে তার বাসভবনে যাওয়ার সময় দুইবার গাড়ি বদল করা হয়। উভয় গাড়ি বহর ছিল তার নিজস্ব নিরাপত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ। তারপরও তা যথেষ্ট মনে হচ্ছিল না। প্রথমদিকে তিনি ক্ষমতা গ্রহণে অনিচ্ছুক ছিলেন। কিন্তু পরিশেষে তাকে সম্মতি জ্ঞাপন করতে হয়। বর্তমানে এই মহীয়সী নারীর কাছে ক্ষমতা যেন প্রকৃতির ন্যায় স্বাভাবিক।
গণমাধ্যমের অনুমান হল, সোনিয়া গান্ধী গত আগস্টে নিউইয়র্কে ক্যান্সারের চিকিত্সা নিয়েছেন। কিন্তু এটা এখনও সুনিশ্চিত নয়। সোনিয়া গান্ধীর পরবর্তীতে ছেলে রাহুল গান্ধী ক্ষমতা গ্রহণ করবেন বলে ব্যাপক জনশ্রুতি আছে। কিন্তু তিনি প্রস্তুত কি না তা ভারতীয়দের এখনও সত্যিকার অর্থে নিশ্চিত করতে পারেননি। স্বাধীন ভারতের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জওহার লাল নেহরু ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি ভারত শাসন করেন ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত। একটানা ১৭ বছর। ফলে ভারতের রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা আসে। তার মেয়ে ইন্দিরা গান্ধী ১৯৬৬-১৯৭৭ পর্যন্ত ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তারপর আবার দায়িত্ব পালন করেন ১৯৮০ থেকে ১৯৮৪ সালের মৃত্যু অবধি। তার পুত্র রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন পাঁচ বছর। সম্মিলিতভাবে একই পরিবারের এই তিনজন নেতা ভারতীয় স্বাধীনতা লাভের প্রথম ৪২ বছরের মধ্যে ৩৯ বছরই ভারত শাসন করার গৌরব লাভ করেন।
একদিকে সোনিয়া গান্ধীর ভবিষ্যত্ নিয়ে অন্ধকারে ভারতবাসী। অন্যদিকে মনমোহন সিং আবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন না বলে আশা করা হচ্ছে। এ প্রেক্ষিতে ভারতের রাজনীতি কিছুটা ভাসমান ও দোদুল্যমান অবস্থায় রয়েছে। অর্থনৈতিক সংস্কার ও বিনিয়োগ নীতিমালা প্রণয়নে কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণের পথ বন্ধ হয়ে পড়েছে। ফলে অর্থনীতির প্রবাহ নিম্নগামী হচ্ছে। তবে পরাশক্তি হিসেবে ভারতের উত্থানের পেছনে যে মৌলিক কারণগুলো বিরাজমান তা অপরিবর্তিত রয়েছে। একুশ শতকে পৃথিবীর বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ভারতই হবে, এটা এখনও নিশ্চিত। বাণিজ্যিক মেধার গুণে ভারত বিশ্ব নেতার আসন গ্রহণ করবে। কিন্তু সোনিয়া গান্ধীর অনুপস্থিতিতে এটা কিছুটা বিলম্ব হবে মাত্র। অতীতে মাঝেমধ্যে তাকে নিয়ে অনেক ভুল বোঝাবুঝিরও সৃষ্টি হয়েছে।
লেখক : ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের সিনিয়র ফেলো, সাবেক সিআইএ অফিসার ও ওবামা প্রশাসনের পাকিস্তান ও আফগানিস্তান নীতি সংক্রান্ত রিভিউ কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান।
 দ্য ডেইলি বিস্ট থেকে ভাষান্তর :ফাইজুল ইসলাম

আফগান যুদ্ধ কি ভারতের দিকে মোড় নেবে


সাজ্জাদ শওকত

ওসামা-পরবর্তী সংঘটিত সন্ত্রাসমূলক কার্যক্রম যথা পাকিস্তানি নৌ বন্দরে বিদ্রোহীদের (Militant) আক্রমণ, আফগান সীমানা পার করে পাকিস্তানে প্রবেশ করে ৫০০ বিদ্রোহী দ্বারা ২২ মে পাকিস্তানের ওপর আক্রমণ এবং পরবর্তী সময়ে ১৬ জুন বাজাউর এজেন্সির ওপর বিধ্বংসী তত্পরতা পরিচালনা এবং পাইলটবিহীন বিমান (ড্রোন) দ্বারা পাকিস্তানের ওপর আক্রমণ পরিচালনা—এসব বিষয় বিবেচনা করে বিশিষ্ট রাজনীতিবিদরা একমত হয়েছেন যে, আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার আগে মার্কিনিরা আফগান যুদ্ধকে পাকিস্তানে নিয়ে আসবে।
লক্ষণীয় যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা নিশ্চিত করেছেন আমেরিকান সেনাবাহিনী আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহার শুরু হবে এই জুলাই মাস থেকে এবং ২০১৪ সালে এ কাজ সম্পন্ন হবে। ইসলামাবাদ প্রসঙ্গে বলার সময় ওবামা বলেন, ‘আমরা পাকিস্তানি সরকারের সঙ্গে একযোগে কাজ করব, যাতে মৌলবাদী সন্ত্রাসীদের মূল কোথায় তা বেরিয়ে আসে। উগ্রবাদী এসব সন্ত্রাসীর সন্ত্রাস থেকে কোনো দেশ নিরাপদ নয়।’ সংসদে সমস্যা সমাধানের বিষয়ে আলোচনার সময়, পাকিস্তান একটি স্বাধীন রাষ্ট্র এটা জেনেও ‘তিনি সন্ত্রাসীদের আশ্রয়স্থলে আরও আক্রমণ চালানোর কথা ব্যক্ত করেন’ যেসব আশ্রয়স্থল কিনা তাদের মতে পাকিস্তানে অবস্থিত।
প্রকৃত অর্থে তালেবানরা পাকিস্তানে অরাজকতা সৃষ্টি, আত্মঘাতী বোমা হামলা, বোমা বিস্ফোরণ, নিরাপত্তারক্ষীদের চেকপোস্টে হামলা, বাজোর বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাহায্য এবং বিভিন্ন ধরনের সুনির্দিষ্ট হত্যার পেছনে আসলে আছে আমেরিকার সিআইএ, ভারতের ‘র’ এবং ইসরাইলের মোশাদ। আমেরিকা পাকিস্তানবিরোধী বিভিন্ন শক্তি, যেমন ভারত এবং ইসরাইলকে সাহায্য করছে পাকিস্তানকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র বানানোর জন্য। এসবের মাধ্যমে আমেরিকা পাকিস্তানের কাছ থেকে পারমাণবিক অস্ত্র তুলে নেয়ার মঞ্চ তৈরি করছে। আমেরিকা বিশ্বের কাছে প্রজ্ঞাপন করবে যে পাকিস্তানের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র নিরাপদ নয়। এসব করার জন্যই প্রস্তুতি নিচ্ছে আমেরিকা।
পাকিস্তানবিরোধী এসব তত্পরতা চলাকালীন, ইরানের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদ ৭ জুন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পান—‘সঠিক এসব তথ্যের মধ্যে উল্লেখ্য যে আমেরিকা পাকিস্তানি পারমাণবিক শক্তিকে নষ্ট করে পাকিস্তানের ওপর আধিপত্য পেতে চায়।’ তিনি আরও উল্লেখ করেন, ইহুদি রাষ্ট্রপন্থীরাও এসব চক্রান্তের পেছনে রয়েছে। তিনি বলেন, এসব চক্রান্তে সফল হওয়ার জন্য আমেরিকা ‘জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকেও পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টিকারী হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। পাকিস্তানকে অসম্মানিত এবং দুর্বল করাই তাদের লক্ষ্য।’
এ অবস্থায় সাধারণ মানুষের ওপর যেসব নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে তা চিন্তা না করেই আমেরিকান ক্ষমতাসীনরা ইসলামাবাদের ওপর চাপ দিচ্ছে বিদ্রোহীদের বিপক্ষে আরও কিছু করার জন্য এবং তারা বলছে যেন উত্তর ওয়াজিরিস্তানের হাক্কানি নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালানো হয়।
বর্তমান জটিল এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীপ্রধান জেনারেল আশফাক কায়ানি ৯ জুন বলেন, ‘একটি পরিকল্পিত ও সুষ্ঠু সামরিক অভিযান জোরপূর্বক নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে হতে পারে না... ভবিষ্যতেও পারবে না। যখন সামরিক অভিযান চালানো হবে তা রাজনৈতিকভাবে বিবেচনা করেই চালানো হবে।’ জাতীয় একতার ওপর জোর দিয়ে কায়ানি আরও বলেন, ‘গুরুত্বপূর্ণ কোনো প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিচ্ছেদ সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা জাতীয় স্বার্থের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত নয়। পাকিস্তানে জনগণ সব সময়ই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার মনে করেছে।’ বর্তমানে ইসলামাবাদ ও ওয়াশিংটনের মধ্যে সম্পর্কের অবনতির কথা চিন্তা করে অতীতের দিকে লক্ষ করলে দেখা যায়, সামরিক ও বেসামরিক শাসনামলে পাকিস্তান সবসময় আমেরিকার অযৌক্তিক দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে। আমেরিকার দ্বিমুখী চালের কথা জানার পর এবং আফগান যুদ্ধকে পাকিস্তানে নিয়ে আসার পরিকল্পনার কথা মাথায় রেখে, ইসলামাবাদ যুক্তরাষ্ট্রের ১২০ সামরিক প্রশিক্ষককে ফেরত পাঠিয়ে দেয়।
সত্য এই যে, আফগান যুদ্ধ পাকিস্তানে ঠেলে নিয়ে এলে এর সঙ্গে ভারতও জড়িয়ে যাবে। যাদের সঙ্গে কিনা যুক্তরাষ্ট্র ২০০৮ সালে একটি অসামরিক পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষর করে চীনের বিরুদ্ধে পাল্টা শক্তি দাঁড় করানোর জন্য। ভারতকে এশিয়ার সুপার পাওয়ার বানানো হলো তাদের লক্ষ্য। এছাড়াও আমেরিকা এবং কিছু পাশ্চাত্য দেশ নয়াদিল্লিকে তাদের ব্যবসায়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশ মনে করে। যেখানে পাকিস্তানই হলো তাদের দুষ্ট চক্রান্তের পথের একমাত্র বাধা।
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কথাই চিন্তা করা যাক। যারা কিনা তাদের সামরিক শক্তি দ্বারা তাদের মতবাদ প্রচার করত এবং তাদের সামরিক শক্তি বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে দিয়েছিল। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ে। তাদের পারমাণবিক অস্ত্র পর্যন্ত এই পতন থামাতে পারেনি। এটা ভেঙে পড়ার আরেকটা মূল কারণ এই ছিল যে, দেশটির সর্বোচ্চ প্রতিরক্ষা ক্ষমতাসীমা পার হয়ে গিয়েছিল, যার ফলে দেশের ভেতর আর্থিক সঙ্কট দেখা দিয়েছিল। আফগানিস্তানের সঙ্গে দীর্ঘ যুদ্ধের কথা মাথায় রেখে সাবেক সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট গর্বাচেভ এটিকে একটি ‘রক্তক্ষরিত ক্ষত’ হিসেবে ঘোষণা দেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক বাহিনী বিভিন্ন রাষ্ট্রের স্বাধীনতা সংগ্রামকে থামাতে ব্যর্থ হয়। অন্যদিকে তাদের আগের এই বন্ধুরাষ্ট্রের ভুল থেকে ভারত কোনো শিক্ষাই গ্রহণ করেনি। ভরত একদিক থেকে না হলেও অন্যদিক থেকে সোভিয়েত নীতিমালাই অনুসরণ করছে।
এটা ব্যক্ত করা জরুরি যে, ভারত গণতন্ত্রের মুখোশ পরিধান করে হিন্দু জাতীয়তাবাদকে হৃদয়ে রেখে পাশবিকভাবে দমন করে চলেছে আসাম, খালিস্তান, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, তামিলনাড়ু এবং ত্রিপুরার জনগণ পরিচালিত বিভিন্ন ধরনের স্বাধীনতা সংগ্রাম। নিকট অতীতে মাওবাদীরা আরও সংগ্রামী হয়ে উঠেছিল। সরকারি বিভিন্ন স্থানে তারা হামলা চালিয়েছিল। এসব বিবেচনায় ভারতীয় মিডিয়াও স্বীকার করেছে, মাওবাদীরা অন্ধ্রপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, বিহার, ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড় এবং উড়িষ্যার মতো বিভিন্ন রাজ্যে ঢুকে পড়েছে এবং ভারতবিরোধী বিভিন্ন কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি করেছে।
ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের ক্ষেত্রেও ভারতীয় সেনাবাহিনী সেখানকার স্বাধীনতা সংগ্রামকে বিপর্যস্ত করতে সক্ষম হয়নি। যদিও তারা সেনাবাহিনী পরিচালিত কোনো ধরনের সন্ত্রাসমূলক কাজ থেকেই বিরত থাকেনি, কারফিউ, ম্যাসাকার, ক্র্যাকডাউন, হত্যা সবই তারা প্রয়োগ করেছে তাদের শাসন বজায় রাখার জন্য।
নেপোলিয়ন-পরবর্তী ইউরোপ প্রমাণ করে যে সেনাবাহিনী দিয়ে জোরপূর্বক স্বাধীনতা সংগ্রাম দমিয়ে রাখা যায় না। এরই মতো রাজপুত্র মেটারনিক, যিনি কিনা অষ্ট্রো-হাঙ্গেরির সম্রাট ছিলেন, তিনি ভিনদেশিদের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সব রকম সন্ত্রাসমূলক কর্মই করেছিলেন। ভারতীয় একজন ইতিহাসবিদ, মাহাজীন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘মেটারনিক স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন, তিনি একটি অনর্থক কারণের জন্য যুদ্ধ করছিলেন। তার সাম্রাজ্য ভেঙে গিয়েছিল। যার ফলে স্বাধীন হয়েছিল ইটালি, বুলগেরিয়া এবং অন্য দেশগুলো, যাদের মধ্যে গোপনে স্বাধীনতা উদ্ধারের কার্যক্রম পরিচারিত হচ্ছিল।’
সাম্প্রতিক অতীতে যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মিলোসিভিচের চেষ্টা ও সীমাহীন নৃশংসতার পরেও যুগোস্লাভিয়ার পতন ঘটে।
এটা বলা জরুরি যে, দক্ষিণ এশিয়া এ ব্যাপারে সচেতন, যদিও ভারতের বর্তমান সরকার কংগ্রেস নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ একটি দল হিসেবে দাবি করে, তবু বিভিন্ন মৌলবাদী দল যেমন বিজেপি, আরএসএস, ভিএইচপি, শিবসেনা এবং বজরং দল জাতীয় রাজনীতির মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা প্রকাশের কোনো সুযোগই হাতছাড়া করেনি।
যদিও অন্যান্য সমাজের মানুষের বিরুদ্ধে উত্পীড়ন, দেশ ভাগের পর হিন্দু মৌলবাদীদের জন্য খুবই স্বাভাবিক, কিন্তু বিগত সময়ে মুসলিম ও খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে তাদের অত্যাচার ও রক্তপাত আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়াও বিগত মুসলিম গণহত্যা, বাবরি মসজিদ ধ্বংস, আড়াই হাজারেরও বেশি মুসলমানের বেপরোয়া হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় বিজেপি শাসিত ভারতের রাজ্যগুলোতে। ২০০৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বরের রায়টে উত্তর প্রদেশে ২শ’র বেশি মুসলমানকে হত্যা করা হয়। তাদের পরিচালিত সবচেয়ে বর্বরতার ঘটনার মধ্যে রয়েছে ৬ সদস্যের একটি মুসলিম পরিবারের সবাইকে জীবন্ত জ্বালিয়ে মেরে ফেলা। অনুরূপ খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী এবং তাদের সম্পত্তির ওপরও হিন্দু দাঙ্গাবাজরা আক্রমণ চালায় উড়িষ্যা, আসাম, কেরালা এবং অন্ধ্রপ্রদেশে। যার ফলে কিছু নিরীহ খ্রিস্টানকে প্রাণ দিতে হয়। এরকম অন্য সংখ্যালঘুরাও হিন্দু সন্ত্রাসীদের টার্গেট।
এসব ছাড়াও বিভিন্ন প্রদেশ এবং অঞ্চলের অসমতা বেড়েই চলেছে এবং ভারতের অধিকসংখ্যক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে এবং তারা বেঁচে থাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা যেমন পরিষ্কার কাপড় ও খাবার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এসবের মধ্যেও পাকিস্তানকে দুর্বল করার তত্পরতা চালিয়েই যাচ্ছে তাদের অপরিপূরণকৃত এজেন্ডা হিসেবে। যুক্তরাষ্ট্রের অনুসরণকারী দিল্লির বোঝা উচিত, রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে শক্তিশালী দলগুলো যাদের সংগ্রামী বলে আখ্যা দেয়া হয় তারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ বজায় রাখছে—আফগানিস্তান থেকে ভারত ও ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর এবং সেখান থেকে প্রজাতান্ত্রিক মধ্য এশিয়ার মধ্যে।
ইতিহাস প্রমাণ করে, কোনো অঞ্চলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলে তার প্রভাব আশপাশের দেশগুলোর ওপর পড়ে। বলকানের অতীত এবং বর্তমান ইতিহাসের দিকে লক্ষ করলে দেখা যায়, একটি রাষ্ট্রের মধ্যে রাষ্ট্রদ্রোহিতা এবং রাষ্ট্রের মধ্যে ভাগ সৃষ্টি করলে আশপাশের প্রতিবেশী দেশগুলো এর দ্বারা প্রভাবিত হয়। উদাহরণস্বরূপ আমরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দিকেই তাকাতে পারি। প্রথমে এটি ছোট দুটি দেশের স্থানীয় সমস্যা ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এটি ইউরোপসহ আমেরিকা, জাপান এবং তুরস্কে ছড়িয়ে পড়ে। একইভাবে সুদান এবং সোমালিয়ার মধ্যে গৃহযুদ্ধ ও অশান্তি-অরাজকতা আশপাশের অঞ্চলের দেশগুলোকে প্রভাবিত করেছে, যার সহিংসতার শিকার তিউনিস, মিসর, সিরিয়া, লিবিয়া ইত্যাদি দেশ। মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশও এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে।
তবু আমেরিকার বোঝা উচিত, তারা যদি তালেবান এবং আল কায়দার বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ শক্তি নিয়ে যুদ্ধে নেমে পড়ে এবং পাকিস্তানকেও এর মধ্যে জড়িয়ে ফেলে, তাহলে আফগান যুদ্ধ ভারতে চলে আসবে, যা কিনা আমেরিকার আঞ্চলিক এবং বিশ্বব্যাপী স্বার্থে আঘাত হানবে। সুতরাং একটি স্থিতিশীল পাকিস্তান ভারত, আমেরিকা এবং ইউরোপের জন্যই ভালো।
লেখক : দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ, কলামিস্ট
অনুবাদ : পরম ওয়াজেদ শিকদার

রবিবার, ২৪ জুন, ২০১২

রোহিঙ্গা সমস্যা ও সু চির ইউরোপ সফর



 আবু তাহের খান  
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার শিকার হয়ে মায়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশের অনুমতিদানের জন্য পশ্চিমের অধিকাংশ প্রভাবশালী দেশ ও মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশের প্রতি উপর্যুপরি যে আহ্বান জানিয়ে আসছিল, তা ইতোমধ্যে কিছুটা ম্রিয়মাণ হয়ে আসলেও একেবারে থিতিয়ে যায়নি। আর লক্ষণীয় যে, জাতিসংঘও এ আহ্বান জানানো থেকে বাদ থাকেনি।
সে যাই হোক, পশ্চিমের বিভিন্ন দেশ, সংগঠন  ও জাতিসংঘ এবং বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর ভাষ্যমতে উপরোক্ত আহ্বানের মূল ভিত্তি হচ্ছে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার রক্ষায় তাদের পাশে দাঁড়ানো। আপাতদৃষ্টে এ আহ্বান জানানোর মধ্যে মোটেও দোষের কিছু নেই, বরং তা উচ্চতর মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন সর্বজনীন মৌলিক মানবাধিকার নীতির বহিঃপ্রকাশ বলেই মনে হয়। আর সে অনুযায়ী দুর্ভাগ্যজনক ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার শিকার অসহায় রোহিঙ্গাদের প্রতি সর্বোচ্চ সহানুভূতিশীল আচরণ করা অবশ্যই মৌলিক মানবাধিকার নীতির আওতায় পড়ে এবং তাদের মানবাধিকার রক্ষায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অবশ্যই এগিয়ে আসা উচিত বলেও মনে করি। কিন্তু কথা হচ্ছে, মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ন্যূনতম মৌলিক মানবাধিকার রক্ষার প্রথম দায়িত্বটি কার ? অবশ্যই মিয়ানমার সরকারের নয় কি ?
তাহলে স্বভাবতঃই প্রশ্ন আসে: রোহিঙ্গাদের মৌলিক মানবাধিকার রক্ষার প্রথম দায়িত্বটি যদি মিয়ানমার সরকারেরই হয়ে থাকে, তাহলে ঐ বিপন্ন রোহিঙ্গাদেরকে এ মানবিক সংকটাপন্ন পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করে স্বাভাবিক নাগরিক মর্যাদায় সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য সর্বপ্রথম ও সর্বোচ্চ কণ্ঠের আহ্বানটি ওই মিয়ানমার সরকারের প্রতিই জানানো হলো না কেন ? রোহিঙ্গাদেরকে আশ্রয়দানের জন্য পশ্চিমাদেশ ও তথাকথিত  মানবাধিকার  সংগঠনগুলো  বাংলাদেশের  প্রতি  উপর্যুপরি  যতবার ও  যত  বিভিন্ন  ভাষায় আহ্বান জানিয়েছে, তাদেরতো উচিত ছিল তারচেয়েও বেশিবার ও এর চেয়েও কঠোর ভাষায় মিয়ানমার সরকারকে বলা যে, নিজ দেশের নাগরিককে তারা কিছুতেই এভাবে বিপর্যস্ত অমানবিক অবস্থার মুখে ঠেলে দিতে পারে না। আর তারা যদি তা দেয়ই, তাহলে সেটি প্রতিরোধ করাও বিশ্বসম্প্রদায়ের মৌলিক মানবাধিকার নীতির আওতার মধ্যে পড়ে।  কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব সেটি না করে রোহিঙ্গাদেরকে আশ্রয়দানের জন্য বাংলাদেশের প্রতি যে আহ্বান জানিয়েছে, সেটি  আসলে এক ধরনের লোক দেখানো মায়াকান্না এবং প্রকারান্তরে বাংলাদেশকে চাপে রাখার সামিল।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রাখাইন বৌদ্ধ ও রোহিঙ্গা মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের পুরনো। তবে বর্তমান পর্যায়ে এ সংঘাতের শুরু গত ৩ জুন (২০১২)। তারপর থেকে এ পর্যন্ত তিন সপ্তাহেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। কিন্তু উক্ত দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিরসনে আজ পর্যন্ত মিয়ানমারের সামরিক সরকার জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা ছাড়া সেখানে আর কঠোর কোনো ব্যবস্থা বা উদ্যোগ কি গ্রহণ করেছে? যদি না করে থাকে, তাহলে পশ্চিমা বিশ্বের যে সব দেশ ও সংগঠন রোহিঙ্গাদেরকে আশ্রয়দানের জন্য বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, এ বিষয়ে তাদের জবাবটি কী ? রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার রক্ষার জন্য যে আহ্বান তারা বাংলাদেশের প্রতি জানালেন, সেই একই অধিকার রক্ষায় গত ৩ সপ্তাহেও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করার কারণে মিয়ানমার সরকারের প্রতি তারা চাপ প্রয়োগ করলেন না কেন ? মানবাধিকার রক্ষার দাবিটি তাহলে এ ক্ষেত্রে খুবই একপেশে হয়ে গেল না কি ?
গত ১৬ জুন নরওয়েতে নোবেল শান্তি পুরস্কার (১৯৯১ সালের জন্য দেয়া) গ্রহণকালে প্রদত্ত বক্তৃতায় অং সান সু চি রোহিঙ্গা সমস্যা তথা রাখাইন রাজ্যের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কথা উল্লেখ করলেও তা বন্ধে সরকারের প্রতি কঠোর কোনো আহ্বান জানাননি। আর গত ২১ জুন যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে দেয়া ভাষণে মিয়ানমারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় পশ্চিমা শক্তির সাহায্য চাইলেও দেশে বিরাজমান সাম্প্রদায়িক সংঘাতমূলক পরিস্থিতির বিষয়ে তিনি সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলেননি।
আসলে প্রাচ্যের ব্যাপারে পশ্চিমা বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গির প্রায় পুরোটাই নিজেদের কৌশলগত স্বার্থের হিসাব-নিকাশের ঘেরা টোপে বন্দি, যেখানে মানবাধিকারের প্রসঙ্গটি অনেকটাই লোক দেখানো প্রসাধন মাত্র। আর সু চি হচ্ছেন পশ্চিমা স্বার্থের প্রতিভূ এমন এক নেত্রী, যিনি মাঝে মাঝে নিজেই সে প্রসাধনের উপকরণ হয়ে উঠেন বৈকি ! এটা তাঁর কাছ থেকে খুবই প্রত্যাশিত ছিল যে, ‘শান্তি’তে নোবেল পুরস্কার গ্রহণকে মর্যাদাবান করে তোলার জন্য হলেও এ উপলক্ষে  প্রদত্ত বক্তৃতায় তিনি রোহিঙ্গা সমস্যার প্রসঙ্গটি উত্থাপন করবেন। কিন্তু তিনি তা করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন।
বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে এবং এখনো কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বৈধ ও অবৈধভাবে এ দেশে বসবাস করছে। আর এখানে বসবাসকারী রোহিঙ্গারা অতি জনঘনত্বপূর্ণ এ দেশের অর্থনীতির উপরই শুধু চাপ ফেলেনি, এখানকার জঙ্গিবাদ নির্ভর মৌলবাদী ধারার রাজনৈতিক কর্মী হিসেবেও যুক্ত হয়ে পড়ছে। ফলে রোহিঙ্গারদের আশ্রয়দানের বিষয়টির সাথে মানবাধিকারের বিষয়টি যুক্ত থাকলেও এর সাথে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক বিষয়টিকেও কিন্তু উপেক্ষা করা সম্ভব নয়।
অন্যদিকে মিয়ানমারের পরোক্ষ রাষ্ট্রীয় ইন্ধনে আরাকান রাজ্যে বৌদ্ধ ও মুসলমানদের মধ্যে দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে চলে আসা ধর্মীয় সংঘাত নিরসনে বিশ্বসম্প্রদায়ের কিছু করতে না পারার দায় এককভাবে বাংলাদেশ বহন করবে কেন ? রোহিঙ্গাদের আশ্রায়দানের জন্য যারা বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, গত ৩৫ বছরে তারা এ ব্যাপারে কী করেছেন, সে প্রশ্ন করা যায় না কি ?
পরিশেষে বলবো, রোহিঙ্গাদের মানবাধিকারের প্রতি আমরা পরিপূর্ণভাবে শ্রদ্ধাশীল। তাদের কষ্ট আমরা বুঝি, যেমনটি আমরা বুঝি পশ্চিমা লবির কারসাজির কারণে এখনো মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে শরণার্থী হয়ে থাকা  লাখ লাখ প্যালেস্টাইনীর  কষ্টের কথা। কিন্তু সে প্যালেস্টাইনী শরণার্থীদের ব্যাপারে পশ্চিমের কোনো আগ্রহ না থাকলেও রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে তাদের উদ্বেগের  গূঢ় রহস্য আমরা বুঝতে পারি। কারণ ভারত মহাসাগর ও এর সন্নিহিত এলাকায় তাদের পছন্দসই এমন কিছু ঘটনা বরাবরই থাকা দরকার, যেগুলোকে উপলক্ষ করে তারা এ অঞ্চলে তাদের পদচারণা ক্রমশঃই বাড়াতে পারবে। রোহিঙ্গাদের বিষয়টি তেমনি একটি ঘটনা বৈকি ! এরপরও আমরা রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতিশীল। নয় মাসের  সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভকারী একটি গৌরবদীপ্ত জাতির সদস্য হিসেবে পৃথিবীর একটি মাত্র মানুষের মানবাধিকার লঙ্ঘনকেও আমরা সমর্থন করতে পারি না। রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আমরা মিয়ানমার সরকারের প্রতি জোর দাবি জানাচ্ছি এবং সেটি করতে তাদেরকে বাধ্য করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি বিশ্বসম্প্রদায়ের প্রতি।
[ লেখক :পরিচালক, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)
ই-মেইল :atkhan56@ gmail.com

স্বার্থরক্ষার আত্মঘাতী থিওরি বাংলাদেশকে একঘরে করে ফেলছে



মো হা ম্ম দ জ য় না ল আ বে দী ন
ভাগ্যবিড়ম্বিত রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয়দানের প্রশ্নে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির এখন দেশের স্বার্থরক্ষার কথা মনে পড়েছে। তিনি বলছেন, দেশের সুদূরপ্রসারী স্বার্থের কথা বিবেচনা করেই রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়া হচ্ছে না। কিন্তু এ পররাষ্ট্রমন্ত্রীই বাংলাদেশের অস্তিত্বের সঙ্গে সরাসরি জড়িত কৌশলগত চাবিগুলো, তথা সার্বিক স্বার্থ ভারতের হাতে তুলে দিয়েছেন কিংবা দিতে সাহায্য করেছেন। তখন তাদের দেশের স্বার্থের কথা একবারও মনে পড়েনি। কারণ যে কোনো বিষয়ের সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা তারা মানেন না। তারা তাদের মতো করে সবকিছুর সংজ্ঞা নির্ধারণ করেন। ‘বন্ধুত্ব’ ‘গণতন্ত্র’ ‘মানবাধিকার’ ‘স্বার্থ’ ‘স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব’ এমনকি ‘মুক্তিযোদ্ধা’ এবং ‘স্বাধীনতার স্বপক্ষ’ ও ‘বিপক্ষ শক্তি’ ইত্যাদি প্রায় প্রতিটি বিষয়কে তারা ভিন্নভাবে তাদের মতো করে সংজ্ঞায়িত করছেন। দুর্মুখ মনে করে এটা তাদের উদ্ভাবিত ডিজিটালি কায়দার বহির্প্রকাশ।
সে ধারাবাহিকতায় জীবন রক্ষার জন্য আশ্রয়প্রার্থী রোহিঙ্গাদের মৃত্যুপুরীতে ঠেলে দেয়ার মধ্যে দেশের স্বার্থ আবিষ্কার করছেন। অথচ ভারতকে বিনা পয়সায় রাস্তাঘাট, নৌপথ, রেলপথ, বন্দর, শিল্প-বাণিজ্য, জায়গা-জমি দিয়ে দেয়া কিংবা বাংলাদেশে ভারতীয় সৈন্যদের আসতে দেয়ার চুক্তি করা বাংলাদেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে হলেও তাদের দৃষ্টিতে নয়। কারণ ভারত তাদের বন্ধু—এমন বন্ধু যে, ভারত প্রকাশ্যে ধমক দিয়েছে দীপু মনিরা বাংলাদেশে সঙ্কটে পড়লে ভারত চুপচাপ বসে থাকবে না। তাদের উদ্ধার করবে। ভারত হতে প্রায়ই খবর আসে দীপু মনি গংদের উদ্ধারের জন্য কলকাতা-আগরতলায় ভারতীয় হেলিকপ্টার তথা বিমানবাহিনী প্রস্তুত রয়েছে। দীপু মনিরা এ ধরনের আগ্রাসী ও আপত্তিকর বক্তব্যের কোনো প্রতিবাদ করেননি। অনেকেই মনে করেন, এভাবে নগ্ন অভয়দান তো দেশের স্বার্থ অকাতরে বিলিয়ে দেয়ার প্রতিদান। আর এরাই বলছেন, দেশের স্বার্থে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া হচ্ছে না। দীপু মনিদের কাছে যে দেশের স্বার্থ সুরক্ষিত নয়, তার বহু উদাহরণ দেয়া যায়।
কিন্তু মিয়ানমারের মরণাপন্ন মুসলমানদের আশ্রয় দিলেও কোনোখান থেকে কোনো প্রতিদান পাওয়া যাবে না। সুতরাং তাদের আশ্রয় দেয়ার প্রয়োজন নেই। তাছাড়া অনেক বিশ্লেষকের (যারা দীপু মনিদের উদ্ধারকর্তার চানক্য নীতি সম্পর্কে ধারণা রাখেন) মতে, আমেরিকার নব্য এবং মরহুম কমিউনিজম ও ভেঙে যাওয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের সাবেক বরকন্দাজ গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী দীপু মনিদের বান্ধব এ দেশটি তার ঘরের দরজায় রোহিঙ্গা মুসলিমবিরোধী গণহত্যা প্রসঙ্গে কোনো মন্তব্য করেনি। যেন কিছুই হচ্ছে না। তাদের মতে, মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের অহেতুক বিরোধ সৃষ্টি ও তা জিইয়ে রেখে বাংলাদেশকে চারদিক থেকে শত্রুবেষ্টিত করার লক্ষ্যেই এ দাঙ্গাকে ব্যবহার করা হচ্ছে। তাদের আশঙ্কা বাংলাদেশে তীব্র রাজনৈতিক গোলযোগ সৃষ্টি (দীপু মনিদের না মুসলিম না হিন্দু সম্পাদক এরই মধ্যে আরেকটি যুদ্ধের ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন) হলে তা দমন কিংবা দীপু মনিদের উদ্ধারের নামে ভারতীয় সৈন্যদের সম্ভাব্য হামলা থেকে বাংলাদেশের মানুষ যাতে সীমান্তবর্তী আরাকানে তথা মিয়ানমারে কোনো স্থান না পায় সে উদ্দেশ্যেই রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করানো হয়েছে।
আরাকানে মুসলমানদের সামান্যতম নিরাপত্তা নেই— এটা জেনেও সরকার তাদের অন্তত শিশু ও মহিলাদের বাংলাদেশে ঢুকতে না দিয়ে মানবতাবিরোধী অবস্থান নিয়েছে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বিপদগ্রস্ত মানুষকে আশ্রয় দেয়া প্রত্যেক মানুষেরই মানবিক ও নৈতিক দায়িত্ব। আজকে বিপন্ন মানুষের প্রতি অমানবিক আচরণের যে নজির সরকার স্থাপন করেছে, আগামী দিন আমরা তেমন সমস্যায় পড়লে বিশ্বের কেউই আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে না। যেভাবে জাতিসংঘ, আমেরিকা, কানাডার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে, তার প্রতিফল একদিন এ দেশের সাধারণ মানুষকে ভোগ করতে হয় কিনা—এখন তা-ই দুশ্চিন্তার কারণ
হয়ে দাঁড়াবে।
জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার কর্মকর্তাদের বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে গমনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে খোদ জাতিসংঘকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানোর প্রতিক্রিয়া কেমন হবে তা কেবল ভবিষ্যত্ই বলে দেবে। যে জাতিসংঘের অধীনে বিশ্বের ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ এলাকায় আমরা আমাদের সেনাবাহিনীকে পাঠাচ্ছি শান্তি রক্ষার জন্য, মানুষের জীবনহানি বন্ধ করার জন্য, তেমনি বিপন্ন মানুষই আমাদের দরজায় জীবন রক্ষার জন্য হাতজোড় করে আশ্রয় চায়, আর আমরা তাদের রক্ষায় সামান্যতম ভূমিকা রাখতে পারছি না। তাদের নৌকায় কিছু খাবার আর জ্বালানি তেল দিয়ে সহায়তা করার নামে আমরা তাদের সঙ্গে নির্মম কৌতুক করছি।
প্রবাসী বুদ্ধিজীবী ও বিশ্লেষকরা মনে করেন, বর্তমান সরকারের একমাত্র বন্ধু এই ভুয়া পরাশক্তি তার প্রতিবেশী দেশগুলোর ব্যাপারেই প্রায়ই অহেতুক নাক গলায়। শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ এমনকি আফগানিস্তানে সৈন্য পাঠায়, কিন্তু মিয়ানমারে মুসলিম নিধন প্রসঙ্গে দেশটি একটি কথাও বলছে না। কারণ সে দেশেই এমন নারকীয় কাণ্ড অহরহ ঘটে। তারা (প্রবাসী বুদ্ধিজীবী ও বিশ্লেষক) মনে করেন, বাংলাদেশ সরকারের এ ভূমিকার পেছনে বন্ধু দেশটির পরামর্শ কাজ করছে। এ কারণেই দীপু মনিরা আমেরিকা, কানাডা এমনকি জাতিসংঘের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে সাহস দেখাচ্ছেন। তাদের মতে, ওই দেশটিই মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক স্থাপনের পথে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে। এ কারণেই বারবার ঘোষণা এমনকি চুক্তি স্বাক্ষরের পরও মিয়ানমার হয়ে চীন তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে সড়ক-সংযোগ হচ্ছে না। মিয়ানমারকে বোঝানো হচ্ছে, তেমন সড়ক হলে মিয়ানমারের স্বার্থ এমনকি আঞ্চলিক অখণ্ডতা বিপন্ন হবে। আসল কারণ হলো—এই ভুয়া পরাশক্তির আশঙ্কা, তেমন সড়ক হলে বাংলাদেশকে আর তার ‘রাডার’-এর আওতায় আটকে রাখা যাবে না।
বাদবাকি বিশ্ব থেকে আমাদের বিচ্ছিন্ন করতেই ওই ভুয়া পরাশক্তি চীনকে কোণঠাসা করার উদ্দেশ্যে আমেরিকার সঙ্গে দহরম মহরম করলেও আমেরিকাকে এ অঞ্চলে সামান্যতম খবরদারিও করার সুযোগ দিতে রাজি নয়। সে আমেরিকার কাছেও এ বার্তা পাঠাতে চায় যে, আমেরিকাকে এ অঞ্চলে নাক গলাতে দেয়া হবে না। আমেরিকার প্রভাব ও মোড়লিপনা এখানে অকার্যকর।
দীপু মনিদের অভিযোগ : আগে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কোনো ভূমিকা রাখছে না। সুতরাং আবার রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ এ সমস্যাকে আরও ভারি করতে চায় না। এ ধরনের যুক্তি মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। ‘আগে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়া হয়নি’—এ যুক্তি দেখিয়ে আমরা একটি জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারি না। ফিরিয়ে না নেয়ার জন্য আমাদের ব্যর্থতা কোথায় তা কি আমরা কখনও ভেবে দেখেছি? এ সমস্যা নিয়ে কখন কোনো দেশের সঙ্গে আমরা অর্থবহ দেন-দরবার করেছি? ক’বার আমরা বিষয়টি জাতিসংঘ, ওআইসি এমনকি সার্কে উত্থাপন করেছি? এটা আমাদের পররাষ্ট্রনীতি ভারতীয়করণের পরিণতি। সারাবিশ্বে আমাদের পাশে সত্যিকার অর্থে দাঁড়ানোর মতো এখন আর কোনো বন্ধু নেই। বাদবাকি বিশ্ব থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখে আমরা কি আমাদের একক প্রচেষ্টায় আগে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের তাদের স্বদেশে ফেরত পাঠাতে পারব? পারলে এতদিন পারিনি কেন? আমাদের ভূখণ্ড থেকে রোহিঙ্গাদের সরিয়ে নিতে যে প্রভাব ও লবিং দরকার, সেটা আমাদের নেই। তেমন শক্তি ও প্রভাব থাকলে আমরা এমন আচরণ করতে পারতাম। বরং উচিত ছিল জাতিসংঘসহ বিশ্বনেতৃত্ব দানকারী দেশগুলোর সঙ্গে বসা। তাদের অনুরোধ পূরণে শর্ত জুড়ে দেয়া। তাতে আমাদের সব কূলই রক্ষা পেত। আমরা বন্ধুহীন ও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তাম না। কেউ বলতে পারত না আমরা অন্যের পরামর্শে চলি। আমাদের অভ্যন্তরীণ ও বিদেশনীতি অন্যের ইঙ্গিতে চলে।
সর্বোপরি দেশের অভ্যন্তরে যা ঘটছে, তা দেখে গণতান্ত্রিক বিশ্ব বিস্ময়ে হতবাক, মুসলিম বিশ্ব হতাশ। এটা কোন গণতন্ত্র? গণতন্ত্রের লেবাস পরে ‘ক্ষমতাতন্ত্র’ ও ‘ইচ্ছেতন্ত্র’ ‘লাঠিতন্ত্র’ ‘ডাণ্ডাবেড়ি’ ‘গুম-অপহরণ’ ‘রিমান্ড’ ‘মিথ্যে মামলা’র সংস্কৃতি, সংসদ ও বিচার বিভাগকে মুখোমুখি হওয়ার ডিজিটালি তেলেসমাতি দেখে বিশ্ববিবেক আমাদের নিন্দার চোখে দেখে। তাদের উপসংহার : গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত যে সরকার গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে তার প্রতিপক্ষকে বঞ্চিত রাখে, তাদের পুলিশ বুটের নিচে চেপে ধরে, নানা অজুহাতে গরু-ছাগলের মতো ধরে নিয়ে যায়, ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে কোর্টে আনে, সাজানো ও মিথ্যে মামলা দিয়ে তাদের কারারুদ্ধ কিংবা রিমান্ডের নামে লাঠিপেটা করে, রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে আর ফেরত দেয় না—তাদের স্বজনরা জানে না অপহৃত ব্যক্তি বেঁচে আছে না মরে গেছে। যে দেশে বেডরুম থেকে রাস্তাঘাট কোথাও মানুষ নিরাপদ নয়, সে দেশের সরকারের কাছে ভিন্নদেশী রোহিঙ্গাদের নিশ্চিত মৃত্যু কোনো ব্যাপারই নয়।
এসব কারণে সর্বোপরি ভ্রান্ত পররাষ্ট্রনীতির ফলে আমরা দিন দিন সারাবিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে হয়ে এখন একঘরে হয়ে পড়ছি। পররাষ্ট্রনীতিকে একটি বিশেষ বন্ধুর খোয়াড়ে বন্দি করছি। আমরা চীনেরও বন্ধু নই, আমেরিকারও নই। জাপান কিংবা মুসলিমবিশ্ব আমাদের সন্দেহের চোখে দেখে। আমরা জাতিসংঘকে পাত্তা দিচ্ছি না। আমরা যাচ্ছি কোন দিকে? আমাদের বহু পরীক্ষিত বন্ধু এখন আর আমাদের পক্ষে নেই। যারা বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলবে, তারা এখন আমাদের ওপর বিরক্ত। আমরাই আমাদের সারাবিশ্ব থেকে গুটিয়ে ফেলে মনে হয় ভুটান ও সাবেক সিকিমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। সিকিম তো প্রায় চার যুগ আগেই বিশ্ব মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে। আর ভুটানের রাজা কিংবা প্রধানমন্ত্রীকে তেমন বিদেশ সফর করতে হয় না, তাদের তেমন কেউ ডাকেও না, ডাকার প্রয়োজনও বোধ করে না। কারণ সারাবিশ্ব জানে তাদের কাজটি অন্য কেউ করে দিচ্ছে। বাংলাদেশ ধীরে ধীরে তেমন অবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছে বলে অনেকেই আশঙ্কা করছেন।
একটা দেশের প্রকৃত স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতীক হলো স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি। দেশি-বিদেশি অনেক পর্যবেক্ষকের অভিযোগ, আমাদের পররাষ্ট্রনীতি দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভারতীয় গণ্ডিতে বন্দি হয়ে গেছে। তাদের মতে, মুখে না বললেও সারাবিশ্ব অনুভব করে বাংলাদেশ এখন কার নির্দেশ চলে। বিশ্ব সম্প্রদায়ের এ ধারণা পাল্টে দেয়ার দায়িত্ব আমাদের। কারণ কারও নির্দেশে চললে কোনো দেশ আর প্রকৃত অর্থে সার্বভৌম থাকে না। তখন দেশটি সরকার ও পতাকা-সর্বস্ব হয়ে যায়। এ ধরনের দেশের সরকারও বদল হয় নিয়ন্ত্রক মুরব্বি দেশের ইচ্ছায় ও ইঙ্গিতে। এসব দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, অভ্যন্তরীণ প্রশাসন এমনকি শিল্প-সংস্কৃতি মুরব্বি দেশটি নিয়ন্ত্রণ করে। মুরব্বি যা যা চাইবে, ক্ষমতাসীনরা তা-ই দিতে অনুগত থাকে। ক্ষমতাসীনরা বেয়াড়া আচরণ করলে নতুন কাউকে আনা হবে। নতুন যারা আসবে, তারাও হবে মুরব্বি’র আশীর্বাদপুষ্ট ও অনুগত। মুরব্বি তাদের দাবার ঘুঁটির মতো তার স্বার্থ ও ইচ্ছে অনুযায়ী চালাবে। তাদের বর্তমানে দাবার ঘুঁটি না বলে ‘রোবট’ বলা যেতে পারে। আমরা তেমনটি হতে চাই না। আমরা আমাদের প্রতিভা ও দূরদর্শিতা দিয়েই আমাদের নীতি নির্ধারণ করব। আমাদের প্রমাণ করতে হবে যে জাতি এত ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করতে পারে, সে জাতি বাইরের হস্তক্ষেপমুক্ত বিদেশ নীতিও অনুসরণ করতে পারে। আমাদের রোবট মনে করা হলে ভুল হবে।
পৃথিবীতে বহুদেশে যুগে যুগে এমন রোবট-সদস্য মানুষ এসেছে। রোবটের নিজস্ব কোনো বিচার-বুদ্ধি নেই। সে একটা যন্ত্রবিশেষ, তার ভেতর যা যা প্রতিস্থাপন করা হয়, সে শুধু তাই করতে পারে। পাখিদের সঙ্গে তুলনা করলে এরা ‘তোতা পাখি’ বিশেষ। তোতা পাখিকে যা শেখানো হয় সে কেবল তা-ই বলতে পারে। আর মানুষরূপী ‘তোতা পাখি’দের যা করতে বলা হবে, তার বাইরে তারা কিছু্ বলতে বা করতে পারে না। তাদের এক ধরনের প্রতিবন্ধী হয়ে যেতে হয়। যেমনটি বলা উচিত, তারা তেমনি বলতে পারে না। এসব বিদেশি চর ও স্বার্থান্ধ প্রতিবন্ধীদের কারণে কোনো কোনো স্বাধীন দেশ এক সময় কাশ্মীর-সিকিমের ভাগ্যবরণ করে এবং প্রতিবন্ধীরা হয় মীর জাফর, শেখ আবদুল্লাহ, নূর মোহাম্মদ, তারাকি, হাফিজুল্লা আমিন, লেন্দ্রুপ দর্জিদের মতো গণনিন্দিত দেশদ্রোহী। ইতিহাস যেন আমাদের সেভাবে চিত্রিত না করে সে ব্যাপারে সবারই সচেষ্ট ও সতর্ক থাকা উচিত।
লেখক : আমেরিকা প্রবাসী সাংবাদিক ও গবেষক
noa@agni.com

রোহিঙ্গা সমস্যা আন্তর্জাতিক দৃষ্টি ভঙ্গি এবং আমাদের করণীয়



মুহাম্মদ রুহুল আমীন নগরী : 
রোহিঙ্গা সমস্যা চেচনিয়া, বসনিয়া, ফিলিস্তিন, কাশ্মির প্রভৃতি সমস্যার মতই একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। আমাদের প্রতিবেশী মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ও স্থায়ী মুসলিম জনগোষ্ঠির নাম রোহিঙ্গা। খ্রিস্টপূর্ব ২৬৬৬ অব্দ থেকে ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর যাবত আরাকান মোটামুটি একটি স্বাধীন রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল।  {বিস্তারিত জানতে-ইফা কর্তৃক প্রকাশিত রোহিঙ্গা সমস্যা : বাংলাদেশের দৃষ্টি ভঙ্গি গ্রন্থটি পড়ুন}
অঝোর ধারায় রক্ত ঝরছে রোহিঙ্গাদের, খুনের ধারা আর লেলিহান অগ্নিশিখায় একাকার রাখাইন রাজ্য। সেখানকার আকাশ-বাতাসে লাশের গন্ধ। নাফ নদীর তীরে আরেক কারবালার পটভূমি। ফুরাত নদীতে পানি ছিল, কিন্তু সে পানি ইমাম হোসাইন (রা.)-এর কাফেলার জন্য ছিল আকাশ কুসুম। কিন্তু নাফ নদীরপানি রক্ত আর লাশের দুর্গন্ধে ক্রমেই অপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
পৃথিবীতে আজ মানবতা বড়ই অসহায়। ফিলিস্তিনিদের ভাগ্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কল্যাণে যেমন  জায়োনিস্ট ইসরাইলীদের করুণার উপর নির্ভরশীল করে দেয়া হয়েছে, তেমনি রোহিঙ্গা মুসলমানদের ভাগ্যও  তেমন উগ্র জঙ্গি রাখাইনদের মর্জির উপরই নির্ভরশীল করে রাখা হয়েছে। অহিংসার ভেক ধরা বৌদ্ধরা মুসলমান যুবক-নারী-শিশুদের রক্তে সাঁতার কেটে উল্লাস করছে।  বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইনদের সহায়তায় মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী নাসাকা, পুলিশ ও ‘লুন্টিন' বাহিনী নির্মম হত্যাকান্ড ও লুটতরাজের ঘটনা ঘটিয়ে রোহিঙ্গা মুসলিমদের মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি করে তুলেছে। সংবাদ পত্রে রোহিঙ্গাদের মানবেতর জীবনযাপন চিত্র দেখে এক সন্তানের জননি উম্মে তায়্যিবা অশ্রুসিক্ত হয়ে মহানবীর (সা.)-এর একটি হাদীসের এবারত স্মরণ করিয়ে দিলেন। আজকের এই লেখাটি সহধর্মীনীর অনুপ্রেরণারই ফসল। ঐ হাদিসে রাসুল (সা.) বলে গিয়েছেন, মুসলমান উম্মাহ একটিমাত্র দেহের মত। যার যেকোন অঙ্গে আঘাত লাগলে পুরো শরীর বেদনা অনুভব করবে। কিন্তু মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিম গণহত্যা ও বেপরোয়া লুটতরাজ চলছে। এই অবস্থায় বিশ্ব মুসলিমের নীরব দর্শকের ভূমিকায় প্রশ্ন উঠাই স্বাভাবিক যে , আমরা হোসাইনী মুসলমান না ইয়াজিদী মুসলিম?
রোহিঙ্গাদের হাজার হাজার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। বিরাণভূমিতে পরিণত হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। ওদের অপরাধ একটাই আর তা হলো ওরা মুসলমান! এই পরিচয়টাই তাদের অকল্যাণ ডেকে আনছে বলে আমরা মনে করি। আর না হয় (অমুসলিম) জাতি সংঘসহ বিশ্ব সংস্থাগুলো এ ব্যাপারে কেন কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না। সামান্য অযুহাতে যারা ইরাক আফগানিস্তানে আক্রমণ করে হাজার বছরের সভ্যতাকে ধ্বংস করে দিতে পারে, যারা লাখো নিরীহ নারী শিশুদের হত্যা করে মুসলিম অধ্যুষিত প্রাচীন জনপদকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করতে পারে। তাদের চোখের সামনেই তো মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন পৃথিবীর সবচেয়ে নিপীড়িত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় রোহিঙ্গারা। কিন্তু সেই সব বিশ্ব মোড়লরা আজ কোথায়? 
সরকারি সূত্রের বরাত দিয়ে রাখাইন রাজ্যের রাজধানীর সিত্তুই থেকে রয়টার্স ও এএফপির খবরে বলা হয়, চলমান সহিংসতায় কমপক্ষে ৩০ হাজার লোক উদ্বাস্তু হয়েছে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, উদ্বাস্তুদের বেশিরভাগই রোহিঙ্গা এবং প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি। এসব উদ্বাস্তু খাদ্য ও নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য মরিয়া হয়ে দিগ্বিদিক ছুটে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু কোথাও নিরাপদ আশ্রয় মিলছে না রোহিঙ্গাদের।
রাখাইন রাজ্যে স্থাপিত ৩৭ টি আশ্রয় শিবিরে অন্তত ৩১,৯০০ জন আশ্রয় নিয়েছে। এ যেন নাফ নদীর তীরে আরেক কারবালা ! বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইনদের সহায়তায় মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী নাসাকা, পুলিশ ও ‘লুন্টিন' বাহিনী এই হত্যাকান্ড ও লুটতরাজের ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছে। গত এক সপ্তাহে শুধু মংডুতেই নিহত হয়েছে ৪ শতাধিক। এদের অধিকাংশই রোহিঙ্গা। এদিকে রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশে প্রবেশের পথও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য পরিবার-পরিজন নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হচ্ছেন তারা। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে অসংখ্য আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার বুকফাটা কান্না যেন কারো কানে যাচ্ছে না। জাতিসংঘ নামক আড্ডা খানায় বসে বসে যারা মানবতার স্লোগান দেয়, তাদের চোখ-কান যেন আজ নিস্তেজ হয়ে গেছে। অচেতন এই জাতিসংঘের মতেই, বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নিগৃহীত সংখ্যালঘু হচ্ছে রোহিঙ্গা মুসলিমরা। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রতি আহবান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যদিও এই আহবান অনেকটা সতীনের আদর তুল্য নয় কী?
 এ ব্যাপারে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড বলেছেন, ‘আমরা এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন, বাংলাদেশ সরকার মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আসতে বাধা দিচ্ছে এবং তাদের পুশব্যাক করছে।' গতবুধবার ওয়াশিংটন ডিসিতে আয়োজিত নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এ কথা বলেন। এর আগে জাতিসংঘ ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বাংলাদেশকে একই আহবান জানায়। এক প্রশ্নে জবাবে নুল্যান্ড বলেন, ‘জাতিসংঘ শরণার্থী সনদের প্রতি আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতাকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য আমরা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহবান জানাচ্ছি।' তিনি বলেন, ‘আমরা বারবার এ বিষয়টি বলার চেষ্টা করছি, মিয়ানমারের সব পক্ষকে এ সমস্যার সমাধান করতে হবে আলোচনার মাধ্যমে, সহিংসতার মাধ্যমে নয়। আমরা তাদের অস্ত্র রেখে পরস্পরের সঙ্গে আলোচনা শুরুর আহবান জানাচ্ছি।' ( সূত্র : দৈনিক আমার দেশ-১৫ জুন ২০১২)
মংডু ও আকিয়াবের কোনো মুসলমান যুবতি ঘরে থাকতে পারছে না। রাখাইন যুবকরা ‘লুন্টিন বাহিনী'র প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় মুসলমান যুবতিদের ঘর থেকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। কয়েকদিনে এরকম ৫ হাজারের অধিক মুসলমান তরুণী নিখোঁজ হয়ে গেছেন। তাদের আদৌ ফিরে পাওয়া যাবে না বলেই বিশ্বাস করছেন মিয়ানমারের ওইসব এলাকার বাসিন্দারা। রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওয়েবসাইট কালাদান প্রেস ডটকম জানিয়েছে, মংডুতে পুলিশের একজন উগ্রপন্থী পুলিশ কর্মকর্তার উস্কানিতে রাখাইন, দাঙ্গা পুলিশ ও পুলিশ মুসলমানদের বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছেন। ‘থান' নামের ওই পুলিশ কর্মকর্তা নিজেই আগুন দেয়ার কাজে জড়িত বলে ওয়েবসাইটটি দাবি করেছে। এতে বলা হয়, ১৪৪ ধারা মংডুতে কেবল রোহিঙ্গাদের ওপর প্রযোজ্য কিন্তু রাখাইনরা এটি মান্য করছে না এবং তারা সব জায়গায় চলাফেরা করছে। রাখাইনরা পুলিশের সাহায্যে রোহিঙ্গাদের ঘর থেকে খাদ্যশস্য ও জিনিসপত্র লুণ্ঠন করছে। রোহিঙ্গারা এখন খাদ্য সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।'
মিয়ানমারের রাখাইন ও সরকারি বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞ ও লুটতরাজ থেকে বাঁচতে শত শত রোহিঙ্গা মুসলমান বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে বাংলাদেশ সীমান্তে বিজিবি কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। তারা কোনো রোহিঙ্গাকেই বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে দিচ্ছেন না। গত ৩ দিনে দেড় হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশুকে ‘পুশব্যাক' করা হয়েছে। কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার জালিয়াপাড়া পয়েন্ট দিয়ে গতকাল ২৫ জন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়েছে বিজিবি। বিজিবি ৪২ ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল জাহিদ হাসান জানিয়েছেন, বুধবার রাত ১২টার দিকে একটি নৌকায় করে ২৫ জন রোহিঙ্গার এ দলটি নাফনদী পার হয়ে জালিয়াপাড়া পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশের জলসীমায় ঢুকলে বিজিবি তাদের আটক করে। এ সময় রোহিঙ্গাদের মধ্যে অনেকে অভুক্ত এবং অসুস্থ ছিল। তাদের শুকনো খাবার ও প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার পর মিয়ানমারের দিকে ফেরত পাঠানো হয়। অপরদিকে গত ১৩ জুন বুধবার টেকনাফ শাহপরীর দ্বীপ ও সেন্টমার্টিনে প্রবেশের চেষ্টাকালে বিজিবি ও কোস্টগার্ড রোহিঙ্গা বোঝাই ৩টি ট্রলার গভীর সাগরের দিকে চলে যেতে বাধ্য করে। সকালে সেন্টমার্টিন দ্বীপের দক্ষিণ উপকূল দিয়ে ৩৯ জন রোহিঙ্গা নিয়ে একটি ট্রলার কূলে ভিড়তে চাইলে কোস্টগার্ডের টহলদল তাদের আটক করে। একই দিন সকালে শাহপরীর দ্বীপের অদূরে নাফনদীর ঘোলারচর মোহনা দিয়ে ৪৪ জন রোহিঙ্গা নিয়ে একটি এবং ৩০ জন রোহিঙ্গা নিয়ে আরও একটি ট্রলার কূলে ভিড়তে চেষ্টা করে। বিজিবি ও কোস্টগার্ড ৩টি ট্রলার আটক করে। এ সময় ট্রলারে থাকা রোহিঙ্গাদের অনেকেই অভুক্ত এবং আহত ছিল বলে জানান বিজিবি সদস্যরা। স্থানীয়দের সহয়তায় এসব রোহিঙ্গার কিছু শুকনো খাবার, খাবার সেলাইন ও পানি দেয়া হয়। দুপুর ১টার দিকে ৩টি ট্রলারকেই গভীর সাগরের দিকে চলে যেতে বাধ্য করে বিজিবি ও কোস্টগার্ড। এ সময় সাগরে প্রচন্ড বৃষ্টিপাত হচ্ছিল। সেন্টমার্টিনের অদূরে রোহিঙ্গা বোঝাই অনেক ট্রলার সাগরে ভাসছে বলে জানা গেছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ঢুকতে দেয়ার জন্য অব্যাহত বিদেশি চাপে বাংলাদেশ দারুণভাবে অসন্তুষ্ট। গত ১৪ জুন বিদেশি পক্ষগুলোকে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, রাখাইন রাজ্যে উদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্যে বিদেশিরা যেন মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে। রোহিঙ্গাদের নতুন করে গ্রহণ করা বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয়। ইতোমধ্যে যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে  রয়েছে, তাদের ফেরত পাঠানোর ইস্যুতে আলোচনা ছাড়া নতুন করে আসতে দেয়ার কোনো বিষয়ে আলোচনায় রাজি নয় বাংলাদেশ। বাংলাদেশে বর্তমানে দুটি শরণার্থী শিবিরে ২৮ হাজার এবং তার বাইরে অনিবন্ধিত প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। গত বৃহস্পতিবার ১৪ জুন ঢাকায় জাতিসংঘ উদ্বাস্তুসংস্থা ইউএনএইচসিআরের প্রতিনিধি ক্রেইগ স্যান্ডার্স পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গিয়ে পররাষ্ট্র সচিব মিজারুল কায়েসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির উদ্দেশে লেখা একটি চিঠি হস্তান্তর করেন। তিন পৃষ্ঠার এই চিঠিতে গত ৮ জুন থেকে রাখাইন রাজ্যে সৃষ্ট পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে মানবিক কারণে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঢুকতে দেয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়, পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অনেকেই আহত। তাদের মধ্যে নারী এবং শিশুও রয়েছে। তারা অর্থনৈতিক কারণে নয়, বরং পরিস্থিতির শিকার হয়ে পালিয়ে এসেছে।
ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের শার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) নিকোলাস ডিন পৃথকভাবে পররাষ্ট্র সচিব মিজারুল কায়েসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন। এর আগে ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড বলেছেন, মিয়ানমারে জাতিগত দাঙ্গার ফলে পালিয়ে আসা ব্যক্তিদের বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ ফিরিয়ে দেয়ার ঘটনায় তারা উদ্বিগ্ন। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকারের কাছে তারা আহবান জানিয়েছেন যে, আন্তর্জাতিক শরণার্থী কনভেনশনের বাধ্যবাধকতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে তাদের ফিরিয়ে না দেয়ার নীতি মেনে চলার জন্য। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, শরণার্থী বিষয়ক ১৯৫১ সালের কনভেনশনে বাংলাদেশ সই করেনি। তাই এই কনভেশন মেনে চলা বাংলাদেশের জন্য বাধ্যতামূলক নয়। এদিকে জাতীয় সংসদে আমাদের বহুদর্শী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরেন। রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশের সীমান্ত খুলে দেয়ার আহবান আবার প্রত্যাখ্যান করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি। দাঙ্গার কারণে মিয়ানমার ছেড়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ও রোহিঙ্গাদের দেশে ঢুকতে দিয়ে আরও সমস্যা বাড়ানোর পক্ষে নই আমরা। তিনি বলেন, বাংলাদেশকে নয় বরং মিয়ানমারকে অনুরোধ করে তাদের দেশে গিয়ে সেবা করার সুযোগ নিতে পারে এসব দেশ ও সংস্থা। এ সময় ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের উদাহরণ টেনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের তখনকার পরিস্থিতি আর বর্তমানে মিয়ানমারের পরিস্থিতি এক নয়। '৭১-এ বাংলাদেশের ওপর একটি যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। আর মিয়ানমারে বর্তমানে যা চলছে তা জাতিগত সংঘাত। এটি কোনো যুদ্ধাবস্থা নয়। এমন নয় যে, সে দেশের সরকার রোহিঙ্গাদের বিতাড়ন করছে। আমরা মনে করি এটি সমাধানের জন্য সে দেশের সরকার কাজ করছে।
অপরদিকে, মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের অস্থায়ীভাবে হলেও বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়ার আহবান জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য রফিকুল ইসলাম মিয়া। ১৫ জুন শুক্রবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এক মানববন্ধনে আন্তর্জাতিক আইন ও মানবতার বিচারে তাদের আশ্রয় দেয়ার আহবান জানান তিনি। এব্যাপারে মানবিক বিবেচনায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে মুক্ত চিন্তা ফোরাম আয়োজিত ‘মিট দ্য প্রেস' অনুষ্ঠানে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক আইনে সরকার তাদের ঢুকতে দিতে পারে না। কিন্তু মানবিকভাবে বিবেচনা করলে তাদের আশ্রয় দেয়া উচিত। সেই সঙ্গে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান কূটনৈতিকভাবে করার জন্য তিনি সরকারের প্রতি আহবান জানান। মওদুদ আহমদ বলেন, সরকার চাইলে সমস্যার শুরুতেই মিয়ানমারের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি সমাধানে উদ্যোগ নিতে পারতো। আমি মনে করি, এ বিষয়ে সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত না নেয়ায় বিষয়টি ক্রমেই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। বিজিবিকে যদি শক্তি প্রয়োগ করতে হয়, সেটা কখনই সুন্দর দেখাবে না। ব্যারিস্টার মওদুদ বলেন, সরকার দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে ব্যর্থ হয়েছে।
এক সময়ের স্বাধীন মুসলিম আরাকান রাজ্য আজ মুশরিক বৌদ্ধ মিয়ানমারের শিকারভূমিতে পরিণত হয়েছে। ‘মানুষে মানুষে  অহিংসা ও মৈত্রীর নীতিতে বিশ্বাসী' এমন স্লোগানের বাহক বৌদ্ধরাই আজ নিজেরাই হিংসার আগুণে জ্বলছে। রোহিঙ্গা মুসলমানরা আজ অসহায় হয়ে প্রাণ রক্ষায় প্রতিবেশী হিসেবে অথবা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের আবাস ভূমি হিসেবেই হোক তারা নাফ নদী পাড়ী দিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে চাইলে ও জীবন বাঁচানোর অনুমতি দিচ্ছে না আমাদের সরকার। নৌকা ভর্তি অসহায় নারী শিশুকে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। একদিকে আন্তর্জাতিক আইন অন্যদিকে আন্তর্জাতিক আহবান, অপরদিকে মানবিক দৃষ্টিকোন, আমাদের সরকার কোনটি মানবে। মুসলমান হিসেবে ইসলাম ধর্মের অনুসারী অসহায় রোহিঙ্গাদের বিপদে এগিয়ে আসা আমাদের ঈমানী দায়িত্বের আওতাভুক্ত কী না এটা বুঝাতে হবে। ইসলামের ইতিহাসে আনসার ও মুহাজির সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-এর জীবন থেকে আমাদেরকে শিক্ষা নিতে হবে।    
লেখক সম্পাদক : আস সিরাজ, সিলেট

নয়াদিলি্লকেই বন্ধুত্বের হাত বাড়াতে হবে


কৃষ্ণন শ্রীনিবাসন
উপমহাদেশের মনস্তাত্তি্বক ব্যবধান ঘুচতে সময় লাগবে। দেশ বিভক্তির অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে এবং অর্থনৈতিক আত্মবিশ্বাস অর্জনের মাধ্যমে উপমহাদেশের এ সমস্যা আপনাআপনি সুরাহা হবে। নয়াদিলি্ল ও ঢাকার মধ্যে বিদ্যমান সমস্যার সমাধান অনেকটা নির্ভর করছে ভারতের রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এবং বাংলাদেশ সনি্নহিত রাজ্যগুলোকে বিদ্যমান সুযোগ উপলব্ধি করতে হবে এবং বাংলাদেশের প্রতি উদারতা ও বন্ধুত্বের মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে

ভারতের কতিপয় রাজ্যের নেতৃবৃন্দ ফেডারেল নিয়মনীতিকে সংকীর্ণ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেন। এর মাধ্যমে তারা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গত বছর প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে ঢাকা সফরে যেতে অস্বীকৃতি জানান, তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির ওপর ভেটো দেন এবং এখন বাংলাদেশের সঙ্গে ১৯৭৪ সাল থেকে ঝুলে থাকা স্থল সীমান্ত চুক্তিকে বিপদগ্রস্ত করছেন। দু'দেশের মধ্যে ৪ হাজার কিলোমিটারের ওপর স্থল সীমান্ত নির্ধারণ ও ৫ হাজার একর অপদখলীয় ভূমি বিনিময়ই শুধু নয়, উভয় দেশের সীমানার মধ্যে অবস্থিত ১৫০টি ছিটমহল বিনিময়ও রয়েছে। উভয় দেশের জরিপ ও গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ছিটমহলের বাসিন্দারা চুক্তি সংশোধনের মাধ্যমে তাদের দীর্ঘকালের দুর্দশার অবসান চান। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখন বলছেন, এই চুক্তি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশি শরণার্থীদের ব্যাপক সংখ্যায় ভারতে আগমন ঘটবে।
স্থল সীমান্ত চুক্তির জন্য সাংবিধানিক সংশোধনীর প্রয়োজন পড়ে। সংসদ ও রাজ্যগুলোকে তা অনুমোদন করতে হয়। এর অর্থ হলো মমতার এ ব্যাপারে আপত্তিটা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ এবং এটা বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে আরেকটি প্রতিবন্ধক।
ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ এক জাতি নিয়ে গঠিত, দেশের মানুষের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ একই ধর্মাবলম্বী ও দেশের প্রায় সবাই একই ভাষায় কথা বলে। প্রায় ভারতীয় ভূখণ্ড পরিবেষ্টিত দেশটি সনি্নহিত ভারতীয় অঞ্চলের সঙ্গে তার নৃতাত্তি্বক বা জাতিগত, ধর্মীয় ও ভাষাগত পরিচয়েই পরিচিত এবং এটা তাকে ভারতের নিরপেক্ষ বন্ধুতে পরিণত করেছে। জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দুঃখজনক ইতিহাস এবং যাতে ভারতের জনগণ ও সশস্ত্র বাহিনী ভূমিকা পালন করেছিল, তা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা বহুবিধ কারণে, ভারতের দিক থেকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে বাংলাদেশের প্রতি বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করা হবে, এটা ঢাকা প্রত্যাশা করতে পারে।
ঢাকায় শেখ হাসিনার বন্ধুপ্রতিম সরকার ভারতের প্রতি হুমকিস্বরূপ সন্ত্রাসবাদীদের কর্মকাণ্ড হ্রাস করার ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তারা উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় উগ্রবাদীদের সঙ্গে শান্তি প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করে। কিন্তু দু'দেশের মধ্যে বিরাজমান দ্বিপক্ষীয় সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে অগ্রগতি না ঘটায় সম্পূর্ণরূপে হতবুদ্ধিকর ও হতাশাজনক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে। অথচ এসব সমস্যা সমাধানে উভয় দেশের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ একমত হয়েছিলেন। ভারতেরই একটি রাজ্য সরকারের কারণে সমস্যা সমাধানে এহেন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হলো।
বাংলাদেশ রাজনীতি, শ্রেণী ও পরিচিতি প্রশ্নে বিভক্ত। বাংলাদেশ এবং ভারত উভয় দেশই মনে করে, ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে যখন প্রকৃত বা গুরুত্বপূর্ণ শত্রুতার সম্পর্ক রয়েছে তখন নয়াদিলি্ল ও ঢাকার মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজমান বা সামান্য কিছু উত্তাপ দূর করা গেলে সেটা পুরোপুরি সম্ভব। দু'দেশের মধ্যে অন্তঃস্থায়ী দ্বন্দ্বটা আন্তঃসরকারি ও ট্রাক-২ কর্মকাণ্ডকেও ছাপিয়ে যায়। আসলে এটা দেশ বিভাগ-পরবর্তী মানুষের মধ্যে বিরাজমান প্রতিদ্বন্দ্বিতার মানসিকতার ফলশ্রুতি। পূর্ব বাংলার মানসিকতায় বিদ্যমান এই উভয় সংকটের সুরাহা করতে পারেনি ১৯৪৭ অথবা ১৯৭১ সালের ঘটনাও। এর একদিকে রয়েছে ভারতীয় ধরনের ধর্মনিরপেক্ষতা এবং আরেক দিকে রয়েছে পাকিস্তানি ধরনের ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি।
একদিকে রয়েছেন উদারনীতিকরা, যারা বিশ্বাস করেন, তাদের ধর্ম পরিচয়ের চেয়েও জাতিগতভাবে বাঙালি পরিচয়টাই মুখ্য। অন্যদিকে রয়েছে বিচ্ছিন্নতাবাদী মৌলবাদীরা, যাদের কাছে এখনও ইসলামী উম্মাহর ঐক্যই গুরুত্বপূর্ণ। শেষোক্তদের কাছে ১৯৪৭ সালে সংখ্যাগুরু হিন্দুদের সঙ্গে বিভক্তিটা ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা অর্জনের চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
দেশ বিভক্তি ও স্বাধীনতা যুদ্ধের ক্ষত মিলিয়ে যেতে এবং একটি আত্মবিশ্বাসী বাংলাদেশি পরিচিতি গড়ে উঠতে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেগে যেতে পারে। তবে একটি ইতিবাচক ফললাভের জন্য ভারতকে তার প্রভাবকে অবশ্যই কাজে লাগাতে হবে। ভারতের, বিশেষ করে আমাদের অবহেলিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা ও অগ্রগতি আবশ্যক। বাংলাদেশের দুঃখ-দুর্দশার প্রতিকারের জন্য নদীর পানি বণ্টন, বাণিজ্য সহজ করা, ভিসা কার্যপ্রণালি ও স্থল সীমান্ত সমস্যা সমাধান ভারতীয় স্বার্থের অনুকূলে। কারণ এসব ইস্যু ভারতের জন্য মারাত্মক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি সৃষ্টি করবে না।
হাসিনা সরকারের স্থিতিশীলতার জন্য যখন বাংলাদেশের দুঃখ-দুর্দশার কারণগুলো দূর করার জন্য ভারতের যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা প্রয়োজন, তখন তথাকথিত 'রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা' দেখিয়ে নয়াদিলি্ল অদূরদর্শী কট্টরপন্থি, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী ও আঞ্চলিক রাজনীতিবিদদের (যারা ঢাকায় একটি বৈরী সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে কী অবস্থা হবে সে সম্পর্কে দৃশ্যত তেমন অবগত নয়) বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের এজেন্ডা নির্ধারণে এলাউ করছে। আর এটা ঘটছে এমন এক সময়ে যখন বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বিনিময় শক্তিশালী করা প্রয়োজন এবং এতে আমাদের সাংস্কৃতিক বন্ধন বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের হাতকে দৃঢ় করবে বলে মনে করা হয়। মানুষের সৃষ্ট ও বাস্তব সব প্রতিবন্ধকতা দূর করার মাধ্যমে উভয় দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক ও পরিবহন সংযোগ অবশ্যম্ভাবীরূপে সীমান্তের উভয় অংশে উন্নয়ন ও অগ্রগতি সাধন করবে।
উপমহাদেশের মনস্তাত্তি্বক ব্যবধান ঘুচতে সময় লাগবে। দেশ বিভক্তির অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে এবং অর্থনৈতিক আত্মবিশ্বাস অর্জনের মাধ্যমে উপমহাদেশের এ সমস্যা আপনাআপনি সুরাহা হবে। নয়াদিলি্ল ও ঢাকার মধ্যে বিদ্যমান সমস্যার সমাধান অনেকটা নির্ভর করছে ভারতের রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এবং বাংলাদেশ সনি্নহিত রাজ্যগুলোকে বিদ্যমান সুযোগ উপলব্ধি করতে হবে এবং বাংলাদেশের প্রতি উদারতা ও বন্ধুত্বের মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।

কৃষ্ণন শ্রীনিবাসন : ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব। দ্য স্টেটসম্যান থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর সুভাষ সাহা

শনিবার, ২৩ জুন, ২০১২

মিসরে আবার স্বৈরতন্ত্রের পদধ্বনি!


॥ মীযানুল করীম ॥


গত কয়েক দিনের মধ্যে মিসরের পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল হয়ে ওঠায় মুসলিম বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দেশটির ভাগ্যও নিদারুণ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। তিন দশক স্থায়ী একনায়কত্বের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্রের সূর্যের প্রত্যাশায় যখন জনগণ, প্রত্যুষের সে মুহূর্তে আবার স্বৈরতন্ত্রের মধ্যরজনীর অন্ধকার নেমে আসার আশঙ্কা জেগেছে। বাতিল করা হয়েছে মিসরের ইতিহাসে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম পার্লামেন্ট। এখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিফলিত জনগণের আকাক্সাকেও বানচালের সর্বাত্মক প্রয়াস পরিলক্ষিত হচ্ছে।
মিসরে আবর বসন্তের পুষ্পিত উদ্যান মত্তহস্তীর তাণ্ডবে দলিত-মথিত হওয়ার সমূহ লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়ায় দেশটির রাজনৈতিক অঙ্গনে সৃষ্টি হয়েছে গ্রীষ্মের প্রচণ্ড উত্তাপ। গণতন্ত্র নস্যাতের চক্রান্ত অবিলম্বে যদি বন্ধ না হয়, তাহলে বিুব্ধ জনগণ নব্যস্বৈরাচারের বিরুদ্ধে মরুঝড়ের সূচনা করতে বাধ্য হবে। 
স্বৈরতান্ত্রিক পন্থায় স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের পতন ঘটেছিল ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। এর দীর্ঘ ১৬ মাস পরে গত ১৬ জুন সম্পন্ন হলো গণতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এতে মুসলিম ব্রাদারহুড প্রার্থী মুহাম্মাদ মুরসি পরাজিত করেছেন মোবারক নিযুক্ত শেষ প্রধানমন্ত্রী আহমদ শফিককে। ড. মুরসি প্রায় সাড়ে আট লাখ ভোটের ব্যবধানে ‘আরব বসন্তের প্রথম প্রেসিডেন্ট’ নির্বাচিত হয়েছেন। তার প্রাপ্ত ভোট এক কোটি ২৯ লাখ ১১ হাজার ৩৫০। শুধু মিসর নয়, উম্মাহর বৃহত্তর স্বার্থেই এই বিজয়কে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে ব্রাদারহুড। বিজয়ী মোহাম্মদ মুরসি ঘোষণা করেন, ‘মুসলমানদের মতো খ্রিষ্টানদেরও আমার পরিবারের লোক মনে করব।’ কারো প্রতি প্রতিশোধ না নেয়ার অঙ্গীকার করেছেন তিনি।
মিসরে গত বছর মাত্র দুই সপ্তাহের গণবিপ্লবে তিন দশক স্থায়ী একনায়কের মসনদই উল্টে যায়নি, দেশের ইতিহাসে পার্লামেন্টের প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনের পথও সুগম হয়। ৬০ বছর আগে রাজতন্ত্র উৎখাতের মাধ্যমে কাক্সিত গণতন্ত্র না এসে কায়েম হয়েছিল সামরিক বড় কর্তাদের স্বৈরতন্ত্র। ‘ওয়ান ম্যান শো’ রাষ্ট্রব্যবস্থায় তারা যুগ যুগ ধরে নির্বাচনের নামে মর্মান্তিক প্রহসন করে এসেছে। ক্ষমতাসীন স্বৈরাচারের অপশাসন প্রলম্বিত করার লক্ষ্যে আয়োজিত প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্টের এসব নির্বাচনকে একই সাথে প্রহসন ও মর্মান্তিক বলা স্ববিরোধী মনে হলেও এটাই তিক্ত বাস্তবতা। পূর্বনির্ধারিত ফলাফলসহ এ ধরনের নির্বাচনে জালিয়াতি-কারচুপির যাবতীয় ডকট্রিন ও ইঞ্জিনিয়ারিং করা হতো নির্লজ্জের মতো। এটা বিশ্বকে ধোঁকা দেয়ার ব্যর্থ প্রয়াস হলেও ক্ষমতাসীন চক্রের ভাগ্য খুলে যেত, আর জাতির ভাগ্যাকাশে ঘনাতো আরো কালো মেঘ। ভোট ডাকাতি ও মিডিয়া ক্যুর অপনির্বাচন শাসকগোষ্ঠীর মুখে প্রহসন উপভোগের হাসি জোগাত। অথচ নির্যাতিত-শোষিত জনগণের কাছে তা ছিল ট্র্যাজেডির মতো মর্মান্তিক। যথাক্রমে নাসের, সাদাত, মোবারকের আমলের এই কলঙ্ককালিমা মুছে সম্প্রতি হয়ে গিয়েছে অভূতপূর্ব সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অবাধ সংসদ নির্বাচন। কিন্তু কুচক্রীরা সে সংসদকে ‘অবৈধ’ ঘোষণার স্পর্ধা দেখিয়েছে। 
মোবারক পতনের মাধ্যমে বিশেষ ব্যক্তির বিদায় ঘটলেও সিস্টেম বদলায়নি। একনায়কের স্বৈরতন্ত্র এখন কায়েম রয়েছে কয়েক ব্যক্তির মাধ্যমে। এরাও আগের শাসকদের মতো সামরিক বাহিনীর লোক। তারা সুপ্রিম কাউন্সিল অব আর্মড ফোর্সেস (এসসিএএফ) নামে পরিচিতই শুধু নয়, নিজেদের সুপ্রিম বা সর্বেসর্বা মনে করছে পতিত স্বৈরাচারীর মতো। তা না হলে গণতন্ত্রে উত্তরণের দায়িত্ব পালন না করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তারা সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াত না কিংবা অন্তর্বর্তীকালের জন্য ক্ষমতা পেয়ে তা স্থায়ী করার ফন্দি আঁটত না। পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়ে এমন একপর্যায়ে নেয়া হয়েছে যে, বিগত আমলের বেনিফিশিয়ারি ও বশংবদরা মরণোন্মুখ মোবারকের কালো দিনগুলোকে মোবারকবাদ জানানোর পর্যন্ত সুযোগ পেয়ে গেছে।
মোবারকের পতনের পর যথাশিগগির সম্ভব সুষ্ঠু পার্লামেন্ট নির্বাচনই ছিল সংগ্রামী জনগণের কাম্য। জাতি নিশ্চিত ছিল, স্বৈরাচারীর বিদায়ের সাথে তার চাপিয়ে দেয়া প্রশাসন ও রাষ্ট্রব্যবস্থার অবসান ঘটবে। না, তা আসলে হয়নি। স্বৈরশাসকের হাতিয়ার হয়ে মিসরীয় সশস্ত্র বাহিনী জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ‘জেতা’ এবং শত্রু ইসরাইলের মোকাবেলায় যুদ্ধে হেরে যাওয়ার রেকর্ড গড়েছিল। এর ধারাবাহিকতায় উর্দি ও বন্দুকধারীরা এখনো জনগণের রায়কে পদদলিত করার অপকর্মে লিপ্ত। পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল ঘোষণা না করা এরই সর্বশেষ নজির মাত্র। 
মোবারকের পতনকালীন বিশেষ পরিস্থিতিতে অস্থায়ীভাবে প্রশাসন চালনার দায়িত্ব দেয়া হয় সশস্ত্র বাহিনীকে। জনগণের বিশ্বাস ছিল, তারা জাতির ঐক্যের প্রতীকরূপে গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য নিরপেক্ষভাবে কাজ করে যাবে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথের বাধাগুলো সরানোই ছিল নবগঠিত সামরিক পরিষদের আশু কর্তব্য। এর বিপরীতে, তারা একটার পর একটা প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করেছে গণতন্ত্র কায়েমের পথে।
১. প্রথমেই সংবিধান প্রণয়ন নিয়ে অযৌক্তিক ইস্যুর জন্ম দিয়ে পার্লামেন্ট নির্বাচন বিলম্বিত করা হলো। 
২. জন-আন্দোলনের চাপে যখন দেখল, এ নির্বাচন না দিয়ে উপায় নেই, তখন এমনভাবে নির্বাচনের সময়সীমা এবং ভোটাভুটির কার্যক্রম স্থির করা হলো, যাতে কৌশলে সময়ক্ষেপণ করা যায়। এতে নিজেদের ক্ষমতা যেমন দীর্ঘায়িত হয়, তেমনি রাজনৈতিক অঙ্গনে বিভেদ ও সন্দেহ সৃষ্টির সুযোগ তৈরি হতে পারে।
৩. ক্ষমতাসীন এসসিএএফ অহেতুক সামরিক আদালতে এমন অনেকের বিচার শুরু করে, যাদের জনগণ গণতন্ত্রের সপক্ষের লোক মনে করেছে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনকারীদের মাঝে এতে ক্ষোভ ও উদ্বেগ সঞ্চারিত হয়।
৪. স্মরণকালের সর্বাধিক নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ পার্লামেন্ট নির্বাচনে ইসলামি শক্তি ৬০ ভাগের বেশি আসনে জয় পেল। স্বৈরাচারীদের হাতে দীর্ঘকাল নির্যাতন ও নিষেধাজ্ঞার শিকার, মুসলিম ব্রাদারহুড দল জয়ী হলো সবচেয়ে বেশি আসনে। আর সেই পার্লামেন্টকে এবার আদালতকে দিয়ে ‘অবৈধ’ ঘোষণা করিয়ে জাতির স্বতঃস্ফূর্ত রায়ের চরম অমর্যাদা করা হয়েছে। এখন পার্লামেন্ট ভবন খোদ নির্বাচিত এমপিদের জন্যই নিষিদ্ধ।
৫. প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগ মূহূর্তে পার্লামেন্ট বাতিলের সাথে এটাও জানিয়ে দেয়া হলো, ক্ষমতাসীন সুপ্রিম কাউন্সিল আইন প্রণয়নের ক্ষমতা ভোগ করবেÑ এমনকি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরও। অর্থাৎ নির্বাচিত সংসদ বা রাষ্ট্রপ্রধানের নয়, দেশ শাসনের অধিকার থাকবে অস্ত্রপুষ্ট কয়েক ব্যক্তির হাতে। এভাবেই মিসরের এই পাবলিক সার্ভেন্টরা পাবলিককেই উল্টো সার্ভেন্ট বানিয়ে রাখতে চায়। 
৬. সব শেষে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যানসহ প্রকাশিত হওয়ার পরও তা সরকারিভাবে জানানো হচ্ছে না। অমেরুদণ্ডী নির্বাচন কমিশন শত শত অভিযোগ নিষ্পত্তির অজুহাতে তা স্থগিত রেখেছে। কখন ফল ঘোষণা করা হবে, সেটা না জানানো রহস্যজনক। ক্ষমতাসীনেরা জানে কে বিজয়ী হয়েছেন, জনগণের সামনে তা স্পষ্ট। এ অবস্থায় ফলাফল নিয়ে টালবাহানা ইতোমধ্যেই উত্তাল হয়ে ওঠা পরিস্থিতিকে নিয়ে যাবে চরমে। সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে তেমন অবস্থার জন্ম দিয়ে গণতন্ত্রকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ঠেকিয়ে রাখতে চায় বলে জনমনে সন্দেহ বাড়ছে। কিন্তু এতে তারা নিজেদের শেষ রক্ষা করতে পারবে কি? তাদের গডফাদার মোবারকের পরিণতি থেকে শিক্ষা নেয়াই তাদের এখন করণীয়। 
মুসলিম ব্রাদারহুড বা ইখওয়ানুল মুসলিমুন শুধু ইসলামপন্থীদের মধ্যেই নয়, দেশের গোটা রাজনৈতিক অঙ্গনেই বৃহত্তম দলে পরিণত হয়েছে। ব্রিটিশ আমলে জন্মের পর থেকেই এই সংগঠন সব সরকারের হাতেই ব্যাপকভাবে নির্যাতিত হয়ে এসেছে। নিষিদ্ধ থেকেছে দশকের পর দশক। কিন্তু এর দৃঢ়চেতা নেতৃত্ব, নিবেদিত কর্মী বাহিনী আর বিশাল নেটওয়ার্কের গুণে বহুমুখী তৎপরতা সব সময়েই ছিল অব্যাহত। জনঘনিষ্ঠ হয়ে সমাজসেবাকার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া এবং ফিলিস্তিন প্রশ্নে নিরাপস ভূমিকার কারণে ব্রাদারহুডের গণভিত্তি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এর নেতাকর্মীদের সততা, প্রজ্ঞা ও নিষ্ঠা মানুষের প্রশংসা অর্জন করেছে। মোবারকের আমলে ব্রাদারহুড ‘ওপেন-সিক্রেট’ পার্টি হিসেবে পার্লামেন্টসহ জাতীয় রাজনীতিতে একটা বিরাট ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ায়। তারা এক দিকে সেকুলার ও বামপন্থীদের প্রধান প্রতিপক্ষ, অন্য দিকে ইসলামের নামে জঙ্গিবাদী সহিংসতা কিংবা ধর্মীয় গোঁড়ামির ঘোরবিরোধী। ফলে বরাবরই ব্রাদারহুড প্রবল বৈরী প্রচারণার টার্গেট। মিসরে মিলিটারি, মিডিয়া, বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিসেবীর বড় অংশ ব্রাদারহুডের প্রতি আক্রোশ বা বিদ্বেষ পোষণ করলেও তাদের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা রোধ করা যায়নি। এরই বহিঃপ্রকাশ সাম্প্রতিক নির্বাচনী ফলাফল।
আরব বিশ্বের দেশে দেশে নানা ‘তন্ত্র’ আর তত্ত্বের ছদ্মবেশে স্বৈরাচারের রাজত্ব দীর্ঘ দিন থেকে। অবশ্য কয়েকটি দেশে সাম্প্রতিক গণ-অভ্যুত্থানের অপ্রতিরোধ্য অভিঘাতে জবরদখলদারদের গণবিরোধী শাসনের অবসান ঘটেছে। এর আগে বন্দুকের নলের মুখে ক্ষমতা কুক্ষিগত করা হয়েছে বারবার। বুলেট দমিয়ে রেখেছিল ব্যালট। এর পেছনে সেনাপতিদের রাষ্ট্রপতি হওয়ার উদগ্র কামনাই প্রধান কারণ। আর প্রতিপক্ষ যদি তাদের মতো বহিঃশক্তির তাঁবেদার না হয় এবং বিশেষ করে ইসলামী আদর্শে বিশ্বাসী হয়ে থাকে, তাহলে তো কথাই নেই। এ জন্যই নব্বইয়ের দশকের সূচনালগ্নে আলজেরিয়ায় ইসলামী দল নিরঙ্কুশভাবে নির্বাচিত হলেও তাদের সরকার গঠনের অধিকার দেয়া হয়নি। গণরায়কে হত্যা করে গৃহযুদ্ধ বাঁধিয়ে দেয়া হলো, যা কয়েক বছর ধরে কারণ হয়েছে গণহত্যার। ফিলিস্তিনে ইসলামপন্থী হামাস জয়ী হলেও তাদের সরকারকে টিকতে দেয়া হয়নি। সুদানে ইসলামি দল ও নেতৃত্ব যাতে মাথা তুলতে না পারে, সে জন্য যথাসাধ্য বাধা দেয়া হয়েছে। এমনকি তুরস্কেও ইসলামী শক্তির রাষ্ট্র ক্ষমতায় আরোহণ ঠেকাতে সংবিধানকে হাতিয়ার বানানো হয়েছিল। এখনো নানা ষড়যন্ত্র চলছে সেদেশে ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধাবান একটি সরকারের পতনের উদ্দেশ্যে। এই প্রেক্ষাপটেই মিসরে ব্রাদারহুডের বিজয় নস্যাৎ করার সার্বিক প্রয়াস ও পরিকল্পনা বিবেচনা করতে হবে।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর থেকেই জনতা আবার সমবেত হয়েছে বিখ্যাত তাহরির চত্বরে। তারা গণরায় ছিনতাইয়ের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করে সেখানে অবস্থান নিয়েছে। মিসরীয় জাতি উপলব্ধি করছেÑ মানবাধিকার, সুশাসন ও ন্যায়পরায়ণতায় সমৃদ্ধ একটি গণতান্ত্রিক ও জনকল্যাণকামী রাষ্ট্র গড়ার পথে আরো অনেক সংগ্রাম করতে হবে। তাহরির স্কোয়ার তাই হয়ে উঠেছে সত্যিকার ও সার্বিক তাহরির বা মুক্তির চেতনায় উজ্জীবনের প্রতীক।

রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর নির্যাতন : ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট


॥ আকবর আহমদ ॥


মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক নেত্রী অং সান সু চি সম্প্রতি তার সমর্থকদের কাছ থেকে হাসিমুখে যে ফুলেল শুভেচ্ছা গ্রহণ করেছেন তাতে মিয়ানমারের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের ব্যাপারে আশাবাদের একটি শক্তিশালী বার্তা ও তার নতুন ভাবমূর্তি গড়ে ওঠার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। তিনি কয়েক দশক ধরে স্বৈরাচারী সরকারের নির্যাতন সহ্য করে দেশে গণতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। বর্তমানে মিয়ানমারে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর চরম নির্যাতন চলছে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে তার ভূমিকা কী সেটা অনেকের প্রশ্ন।
বিবিসির ভাষ্য অনুযায়ী, ‘রোহিঙ্গারা হচ্ছে ধর্মীয় কারণে বিশ্বে তীব্র দুঃখযন্ত্রণা ও হয়রানির শিকার হওয়া অন্যতম একটি সংখ্যালঘু গ্রুপ।’ তারা মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় উপকূলীয় রাখাইন রাজ্যের অবহেলিত মুসলিম। রোহিঙ্গারা আন্তর্জাতিকভাবে তেমন একটা প্রচার পায়নি। শত শত বছর ধরে জেলে ও কৃষক হিসেবে সেখানেই বসবাস করে আসছে তারা। গত তিন দশকে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা পরিকল্পিতভাবে তাদের মাতৃভূমি থেকে ক্রমান্বয়ে উচ্ছেদ করে। ফলে ব্যাপক সহিংসতার সৃষ্টি হয়। সামরিক জান্তা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের অভ্যন্তরে অধিকার এবং নাগরিকত্ব প্রদানে অস্বীকৃতি জানায়। তাদেরকে রাষ্ট্রবিহীন মুসলিম সংখ্যালঘুতে পরিণত করা হয়। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি না দিয়ে তাদের দুঃখদুর্দশা অব্যাহত রাখা হয়েছে। সহিংসতা ও গৃহযুদ্ধে জর্জরিত একটি দেশে যখন গণতন্ত্র ও সমৃদ্ধির ব্যাপারে ব্যাপক আশাবাদের সৃষ্টি হয়েছে, তখন এ ধরনের ঘটনা সেখানে গভীরভাবে ছায়াপাত ও হতাশার সৃষ্টি করবে।
মুক্ত মিয়ানমারে অং সান সু চি রোহিঙ্গাসহ সব জাতিগোষ্ঠীর জনগণের মধ্যে গণতান্ত্রিক সংস্কার ছড়িয়ে দেবেনÑ এটাই পর্যবেক্ষক মহল আশা করে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ২০ লাখের কম হলেও আরব বসন্তের সত্যিকারের শিক্ষা হচ্ছে, একটি দেশের সীমান্তের অভ্যন্তরে সব জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করা ব্যতীত গণতন্ত্রের কোনো ভাবনা সফল হবে না। সমাজের সব সদস্যকে ধর্ম, জাতি, গোষ্ঠী নির্বিশেষে অবশ্যই নাগরিক হিসেবে তাদের যথাযথ অধিকার দিতে হবে। মিয়ানমারে যখন অনেক জাতিগোষ্ঠীগত সংখ্যালঘু কেন্দ্রীয় সরকারের অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, তখন রোহিঙ্গাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে।
রোহিঙ্গারা প্রাণে বাঁচার জন্য বাংলাদেশ এবং থাইল্যান্ডের মতো দেশে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে উদ্বাস্তু বা শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু কেন তাদেরকে দেশ ছেড়ে পালাতে হচ্ছে এবং তারা যে নিজের দেশে সহিংসতা ও সাংস্কৃতিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, সে বিষয়টা মিডিয়ায় ভালোভাবে সম্প্রচার হয়নি।
কেবল মুসলমান হওয়ায় এবং জাতি গোষ্ঠীগতভাবে ভিন্ন হওয়ার কারণেই মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের দেশ থেকে জোর করে বের করে দেয়ার নীতি গ্রহণ করেছে। সরকার ভ্রান্তভাবে তাদেরকে অবৈধ বাঙালি অভিবাসী হিসেবে চিত্রিত করে রোহিঙ্গা সংস্কৃতি ধ্বংস বা মুছে দেয়ার অপপ্রয়াস শুরু করে।
রোহিঙ্গা ও রাখাইন রাজ্যের দীর্ঘ ইতিহাস সরকারের দাবির সাথে মেলে না। মধ্যযুগের আরাকান রাজ্যে মুসলমান রোহিঙ্গারাই ছিল প্রধান শক্তি। তারাই একসময় সংস্কৃতি, জ্ঞান এবং বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। আরাকান রাজ্যের রাজপ্রাসাদ ও প্রশাসনে একসময় ইসলাম এবং বৌদ্ধ ধর্মের মধ্যে পরস্পর ঐক্যতান ও বন্ধন ছিল। রাজ্যের কসমোপলিটান এবং আন্তর্জাতিক রাজধানী শহর ম্রাউক উকে ১৭০০ শতাব্দীতে দ্বিতীয় ভেনিস হিসেবে বর্ণনা করা হতো। একজন পর্তুগিজ ধর্মযাজক এই বর্ণনা দিয়েছিলেন। সে সময়ের ভ্রমণকারী এবং লেখকেরা ওটাকে প্রায়ই আমস্টারডাম ও লন্ডনের সাথে তুলনা করতেন। ১৭৮৪ সালে বর্মি রাজা বোদাপায়া আরাকান দখল করে নেয় সামরিক বাহিনী দিয়ে। একসময়কার প্রাণবস্তু রাজ্যটি পরবর্তী সময়ে সীমান্তবর্তী নির্যাতিত অঞ্চলে পরিণত হয়। বর্মি সেনাদের রোমহর্ষক নির্যাতনের বনকাহিনী চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। এমন নৃশংস ঘটনাও শোনা যায় যে, বর্মি সৈন্যরা রোহিঙ্গা মুসলিমদের বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে জীবান্ত পুড়িয়ে মেরেছে এবং হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে কাজ করানোর জন্য আমারাপুরায় নিয়ে যায়। সেখানে তাদেরকে অবকাঠামো প্রকল্পে দাস হিসেবে শ্রম দিতে বাধ্য করে।
জেনারেল নেইনের অধীনে ১৯৬২ সালে সামরিক জান্তার ক্ষমতা গ্রহণের পর বৌদ্ধ ধর্মীয় বিশ্বাসকে ধারণ করে জাতিগত শুদ্ধি অভিযানের ভিত্তিতে মিয়ানমারীকরণ নীতি নামে একটি উগ্র জাতীয়তাবাদী আদর্শ বাস্তবায়ন শুরু হয়। রোহিঙ্গাদের মুসলিম এবং মিয়ানমার-বহির্ভূত হিসেবে মিয়ানমারে আইনগত বৈধতা বাতিল করা হয় এবং নিজেদের আবাসভূমি তথা মাতৃভূমিতে তাদেরকে বিদেশী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সামরিক শাসকেরা ১৯৮২ সালে তথাকথিত সিটিজেনশিপ ল বা নাগরিকত্ব আইনের দোহাই দিয়ে আইনগতভাবে তাদের নাগরিক অধিকার কেড়ে নেয়। নাগরিকত্ব আনুষ্ঠানিকভাবে বাতিল করার পর রোহিঙ্গারা দেখতে পেল, তারা বাস্তবে অত্যন্ত অবহেলিত ও নির্যাতিত জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। তাদের নিজেদের জমি ও সম্পদের অধিকারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। তাদের ওপর গ্রামের বাইরে যাওয়ার ব্যাপারে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। এমনকি মসজিদসহ ধর্মীয় স্থান মেরামতের কাজেও বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে। তারা রোহিঙ্গাদের যেকোনো ভাষায় শিক্ষা গ্রহণ, এমনকি বিয়েশাদি করা এবং সন্তানসন্ততি জন্মদানের ব্যাপারেও তাদের অনুমতি গ্রহণের নির্দেশ জারি করে। রোহিঙ্গাদের আধুনিক যুগের দাসে পরিণত করা হয়। তাদেরকে আদর্শ গ্রাম নির্মাণের জন্য অবকাঠামো প্রকল্পগুলোতে কাজ করতে জোরপূর্বক বাধ্য করা হয়। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে রোহিঙ্গাদের নিজেদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে সেখানেই বসতি স্থাপনকারীদের বাড়িঘর নির্মাণ প্রকল্পে শ্রম দিতে জোরপূর্বক বাধ্য করা হয়। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার থেকে উচ্ছেদ করে বাইরে পাঠিয়ে দেয়ার সামরিক কৌশলের অংশ হিসেবে তাদের বিরুদ্ধে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন শুরু এবং সাথে সাথে তাদের নাগরিক অধিকারদানে অস্বীকৃতি জানানো হয়।
অপারেশন কিং ড্রাগন বা অপারেশন নাগামিনের আওতায় ১৯৭৮ সালে সামরিক জান্তা জাতিগত শুদ্ধি অভিযানের প্রাথমিক ধাপ শুরু করে। ওই অপারেশনের উদ্দেশ্য ছিল, প্রত্যেককে তাদের রাজ্যের মধ্যে হয় একজন নাগরিক অথবা অবৈধ অভিবাসী হিসেবে বাছাই তথা চিহ্নিত করা। এটা করতে গিয়ে ব্যাপক হারে ধর্ষণ, নির্বিচারে গ্রেফতার, মসজিদ গুঁড়িয়ে দেয়া, রোহিঙ্গাদের গ্রাম ধ্বংস ও তাদের ভূমি বা জমিজমা বাজেয়াপ্ত করা হয়। এই সহিংসতার মুখে প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে গিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। তাদের অনেকেই পরে মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তন করে এবং পুনরায় তারা সেখানে নির্যাতন, ধর্ষণ, জেলজুলুম ও মৃত্যুমুখে পড়ে। একই উদ্দেশ্যে ১৯৯১ সালে অপারেশন পি থায়া বা অপারেশন কিন এবং বিউটিফুল ন্যাশন নামে দ্বিতীয় পর্যায়ে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়। ফলে আবার সহিংস পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় এবং আরো দুই লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার এনজিও বা বেসরকারি সংস্থাগুলোর মতে, প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী এখন বাংলাদেশে অবস্থান করছে। মাত্র ৩৫ হাজার শরণার্থী রেজিস্টার্ড উদ্বাস্তু হিসেবে শরণার্থী শিবিরে অবস্থান করছে এবং তারা এনজিওর কাছ থেকে কিছু সাহায্য পাচ্ছে। আড়াই লাখেরও বেশি অবশিষ্ট শরণার্থী খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা ব্যতীত অমানবিক পরিস্থিতিতে বসবাস করছে, যাদের বেশির ভাগই অভাবের তাড়নায় মৃত্যুবরণ করছে।
মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট থিন সিন এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে ২০১১ সালের ডিসেম্বর মাসে উদ্বাস্তু প্রত্যর্পণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু তাতে রোহিঙ্গাদের বাইরে রাখা হয়, তাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব না থাকার অজুহাতে বাইরে রাখা হলো। শেখ হাসিনা দেশ থেকে উচ্ছেদ করা আড়াই হাজার উদ্বাস্তুকে প্রত্যাবর্তনের শর্তে মিয়ানমারে পাঠানোর চেষ্টা করছে। বর্তমান সমীক্ষার অংশ হিসেবে আমরা সম্প্রতি বার্মিজ রোহিঙ্গা অ্যাসোসিয়েশন অব নর্থ আমেরিকার (বিআরএএনএ) চেয়ারম্যান ড. ওয়াকার উদ্দিনের সাক্ষাৎকার নিয়েছি। তিনি তার রোহিঙ্গা জনগণের আঞ্চলিক ইতিহাস উপলব্ধি করেন এবং তাদের একজন শক্তিশালী রাষ্ট্রদূত। তিনি বলেন, সব রোহিঙ্গা তাদের নিজেদের আবাসভূমিতে নাগরিকত্ব ফিরে পেতে চায়। তারা তাদের ভিটেমাটি বাড়িঘর, মর্যাদা ও মানবাধিকার যা সামরিক স্বৈরাচারী জেনারেল নিউ ইন কেড়ে নিয়েছে, তা ফিরে পেতে চায়।
সু চি এবং ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির জন্য রোহিঙ্গা জনগণের পাশে দাঁড়ানোর এবং তাদেরকে নতুন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করে নেয়ার অনন্য সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এনএলডিকে সব জাতিগোষ্ঠীগত সংখ্যালঘুকে মিয়ানমারের পরিপূর্ণ নাগরিক করে নেয়ার ব্যাপারে ভূমিকা পালন করতে হবে এবং অবশ্যই কেন্দ্রীয় সরকারকে এ জন্য কাজ করতে হবে। অধিকার স্বীকার করে সরকার রোহিঙ্গাদের মর্যাদা এবং পারস্পরিক সাংস্কৃতিক বোঝাপড়ার সুবিধা প্রদান এবং হাজার হাজার উদ্বাস্তু যাদেরকে বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে, দেশে ফিরে আসার সুযোগ দিতে হবে। মিয়ানমার সরকার সম্প্রতি খোলামেলা ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা চালু করার জন্য এবং জাতিগোষ্ঠীগত সহিংসতার অবসান ঘটানোর জন্য বড় ধরনের ও সুদৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। অবশ্য এটা সবে শুরু হয়েছে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিলে অং সান সু চি তার পিতা অং সানের স্মৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবেন। অং সান তার অসময়ে মর্মান্তিক মৃত্যুর আগে একটি স্বাধীন মিয়ানমারের অংশীদার হওয়ার জন্য জাতিগোষ্ঠীগত সংখ্যালঘুদের প্রতি হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাদের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। কেবল তখনই একটি গণতান্ত্রিক ও আধুনিক মিয়ানমার নিজের জনগণের চোখে বৈধতা ও সফলতা অর্জন করতে পারবে, যখন প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে রোহিঙ্গাদের অস্তিত্ব তথা তাদের বসবাসের বিষয়টিকে স্বীকার করে নেয়া হবে।
এই নিবন্ধটির তথ্যসূত্র হচ্ছেÑ ওয়াশিংটন ডিসির আমেরিকান ইউনিভার্সিটির ইবনে খালদুন চেয়ার অব ইসলামিক স্টাডিজের প্রফেসর আকবর আহমদ এবং ওই চেয়ারের সাথে সংশ্লিষ্ট রিচার্স ফেলো হ্যারিসন একিনসের গবেষণাকর্ম : জার্নি টু ট্রাইবাল ইসলাম : আমেরিকা অ্যান্ড দ্য কনফিক্ট বিটুইন সেন্টার অ্যান্ড পেরিফেরি ইন দ্য মুসলিম ওয়ার্ল্ড। 
লেখক : যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত পাকিস্তানের সাবেক হাইকমিশনার এবং ওয়াজিরিস্তান ও বেলুচিস্তানের সাবেক প্রশাসক, তিনি ডিসকভারিং ইসলাম এবং জার্নি ইন টু আমেরিকা : দ্য চ্যালেঞ্জ অব ইসলামসহ বহু গ্রন্থের রচয়িতা।
ইংরেজি থেকে ভাষান্তর : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার

রোহিঙ্গাদের নিয়ে সস্তা রাজনীতি না করা ভাল

আবদুল মান্নান


আমাদের একেবারে বাড়ির পাশে বর্মা মুলুকে অনেককাল ধরে সরকারীভাবে একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে জাতিগত দাঙ্গার মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন করার অভিযান চলছে এবং তা দেখে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একেবারে চুপ। বর্মা মুলুকের বর্তমান নাম মিয়ানমার। দেশটি প্রায় অর্ধশতক ধরে সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল। সম্প্রতি সে দেশে আবার গণতান্ত্রিক ধারা ফিরতে শুরু করেছে বলে বিশ্ব সম্প্রদায় মনে করে। তাদের ধারণা, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নির্যাতনের বিষয়ে বেশি চাপাচাপি করলে সে দেশে আবার গণতন্ত্র হুমকির সামনে পড়তে পারে। একটি গণতান্ত্রিক দেশে সকল সম্প্রদায়ের মানুষ মুক্ত মানুষ হিসেবে বাস করতে পারা উচিত। তা যদি না-ই হবে তাহলে সে দেশকে কোনভাবেই গণতান্ত্রিক দেশ বলা যাবে না। অবশ্য পশ্চিমা বিশ্বের একেকটি দেশের গণতন্ত্রের সংজ্ঞা আবার একেক রকম। যে মানুষগুলো সে দেশে নির্যাতিত হচ্ছে তারা জাতে রোহিঙ্গা, ধর্মবিশ্বাসে মুসলমান। বেশিরভাগেরই আবাস উত্তর আরাকান প্রদেশে। তারা সেখানে কিভাবে এলো তা নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতভেদ আছে। কোন কোন ইতিহাসবিদ মনে করেন, রোহিঙ্গারা আরব দেশ থেকে এসে সেখানে বসতি গেঁড়েছিল সেই অষ্টম শতকে। কারও কারও মতে, তারা ভারতবর্ষের গুজরাট অঞ্চল ও আফগানিস্তান হতে সেখানে হিযরত করে চাষবাস শুরু করেছিল। এলাকাটি চট্টগ্রামের সংলগ্ন হওয়াতে তাদের সঙ্গে চট্টগ্রামের মানুষের উঠবস বেশি ছিল। তাদের ভাষার সঙ্গে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার বেশ মিল আছে। যেখান থেকেই তারা আসুক না কেন তারা এখন মিয়ানমারের অধিবাসী। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে পরবর্র্তীকালের মিয়ানমারের কোন সরকারই তা স্বীকার করেনি এবং যুগ যুগ ধরে তারা নির্যাতিত হয়েছে। বর্মার সরকার সব সময় মনে করে, বর্মায় একেবারে স্থানীয় ও বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী ছাড়া সকলেই বহিরাগত। ভারতীয় হলে তো কথাই নেই। বর্তমানে সে দেশে প্রায় ত্রিশ লাখ ভারতীয় বংশদ্ভূত মানুষ দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে বাস করে। চীনা ও মালয়ের মুসলমানদের অবস্থাও একই রকম। তবে তাদের সংখ্যা রোহিঙ্গাদের চাইতে কম। কথায় কথায় সকলে নির্যাতন এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হয়। সে দেশে ১৩৫টি আদিবাসীকে সরকারীভাবে নৃ-তাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী বলে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। বাদ পড়েছে শুধু রোহিঙ্গারা। তাদের অপরাধ তারা ধর্মবিশ্বাসে মুসলমান এবং গায়ের রং কালো। 
এবার আমার বাবার কথা বলি। ত্রিশের দশকে তাঁর যৌবনকাল। ভাগ্য ফেরাতে ছুটলেন বর্মা মুলুকে। তখন অবিভক্ত বাংলার তো বটেই ভারতবর্ষের মানুষ ভাগ্যান্বেষণে ছুটতেন রেঙ্গুন না হয় আকিয়াবে। এই অঞ্চলের একমাত্র সমৃদ্ধশালী দেশ তখন বর্মা। চট্টগ্রামের মানুষ সমুদ্রপথে এক সকালে যাত্রা করে পরদিন আকিয়াব পৌঁছে যেত, কয়েকদিন পর রেঙ্গুন বন্দরে। সে দেশে বিয়েশাদীও করেছেন অনেকে। বাবা ছোটখাটো একটা রেস্টুরেন্ট খুলে বসেছিলেন। তবে তাঁর দোকানের বেশিরভাগ খদ্দের ভারতীয়। কদাচ কোন স্থানীয় মানুষ দোকানে প্রবেশ করত। বাবা-চাচাদের কাছে শুনেছি, বার্মিজ মেয়েদের কাছে ভারতীয় পুরুষদের কদর ছিল বেশ। তাদের বিয়ে করার এক ধরনের আকুতিও নাকি ছিল । অবশ্য তিনি সে খপ্পরে পড়েননি। আয় রোজগার ভাল। ব্যাচেলর মানুষ। কিছু টাকা জমিয়ে একটা গাড়িও নাকি কিনেছিলেন। ট্যাক্সি হিসেবে চলত। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। জাপানীদের হাতে সিঙ্গাপুর পতনের পর ১৯৪২ সালে বর্মার পতন হলো। বাবা বলতেন বার্মিজরা সম্ভবত এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করছিল। প্রথম সুযোগেই জাপানী সৈন্যদের সঙ্গে নিয়ে শুরু করে দিল ভয়াবহ দাঙ্গা। এটি ছিল ভারতীয়দের বর্মা থেকে উৎখাত করার দাঙ্গা। বাবা হাজার হাজার ভারতীয়ের সঙ্গে এককাপড়ে হেঁটে রওনা দিলেন দেশের উদ্দেশ্যে। প্রায় একমাস চলার পর সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত অবস্থায় চট্টগ্রাম পৌঁছেছিলেন। পথে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।
বর্মায় বর্ণ এবং জাতিবিদ্বেষ এখনও প্রকটভাবে বিদ্যমান। অথচ এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সম্পূর্ণ নীরব। বর্মায় বসবাসরত নাগরিকদের দু’ধরনের পরিচয়পত্র দেয়া হয়। একটি লাল রং-এর অন্যটি সাদা। লালটি মূলত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বার্মিজদের। অন্যটি সাদা, পেছনে লেখা থাকে এই কার্ডধারী বর্মার নাগরিক নয়। রোহিঙ্গাদের কার্ডের পেছনে লেখা থাকে; এর বাহক একজন বাঙালী মুসলমান। এটি একটি অবিশ্বাস্য ব্যাপার যে একবিংশ শতকে এসেও নাৎসি জার্মানির একটি মডেল রাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মেনে নিয়েছে এবং ইদানীং সকলে মিয়ানমারের নতুন সরকারকে হাত কচলে বেশ খোশামোদ করছে। 
উত্তর আরাকান প্রদেশ বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকা। এখানকার রোহিঙ্গারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইনদের হাতেই সর্বাধিক নিগৃহীত হয়। এদের বিয়ে করতে হলে প্রশাসন থেকে পূর্বানুমতি নিতে হয়, যা সচরাচর মিলে না। বাচ্চারা স্কুলে যেতে পারে না। রোহিঙ্গাদের এখান হতে অন্য প্রদেশে যাওয়া বেআইনী। মিয়ানমারের সেনা ও পুলিশ বাহিনীতে কোন রোহিঙ্গা মুসলমানের চাকরি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। স্থানীয় রাখাইনরা সুযোগ পেলেই দাঙ্গাহাঙ্গামা শুরু করে। এসবের কোন বিচার কখনও হয় না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আরাকান রাজ্যে প্রথম বড় ধরনের দাঙ্গা হয় ১৯৬২ সালে। তখন কয়েক হাজার রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু কক্সবাজার হয়ে চট্টগ্রাম প্রবেশ করে। কয়েক হাজার থাইল্যান্ডেও চলে যায়। সে সময় যারা চট্টগ্রামে এসেছিল পরবর্তীকালে তারা এখানকার মানুষের সঙ্গে মিশে গেছে। 
স্বাধীন বাংলাদেশে ভিটামাটি হতে উচ্ছেদ হয়ে রোহিঙ্গাদের প্রথম অনুপ্রবেশ ঘটে ১৯৭৮ এবং ১৯৭৯ সালে যখন আরাকানে বর্মার সেনাবাহিনী অপারেশন ‘নাগামিন’ নামে একটি জাতিগত শুদ্ধি অভিযান শুরু করে। সে ধাক্কায় বাংলাদেশে প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটে। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সমস্যাটির কোন কূটনৈতিক সমাধানের চেষ্টা না করে নাফ নদীতে নৌবাহিনীর যুদ্ধ জাহাজ পাঠায়। সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ ঘটায়। পাল্টা বর্মাও একই কাজ করে। কিন্তু সমস্যা সমস্যাই থেকে যায়। আরেকটি ধাক্কা আসে ১৯৯০-৯১ সালে যখন প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তার এমন অমানবিক আচরণের প্রতিবাদ করার জন্য একটি দেশও বাংলাদেশের পাশে কার্যকরভাবে দাঁড়ায়নি। শুধু জাতিসংঘের উদ্বাস্তু বিষয়ক সংস্থা কিছু রিলিফসামগ্রী নিয়ে কক্সবাজার, টেকনাফ, উখিয়া, কুতুপালং প্রভৃতি রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে তাদের পাশে দাঁড়ায় তবে তা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। বর্তমানে সরকারীভাবে দু’টি শরণার্থী শিবির আছে। বাংলাদেশ মাঝে মাঝে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের সে দেশে ফেরত পাঠাতে কয়েকবার চেষ্টা করেও তেমন একটা সফল হয়নি। তারা শুধু কয়েক হাজার শরণার্থীকে ফিরিয়ে নিয়ে সাফ জানিয়ে দেয়Ñ বাকিরা তাদের দেশের নাগরিক নয়। বাংলাদেশের মতো একটা দেশের পক্ষে সম্ভব নয় কয়েক লাখ শরণার্থীকে বছরের পর বছর চারদিকে তারকাঁটার বেড়া দিয়ে আটক করে রাখা। বর্তমানে দুই ক্যাম্পে শুধু ত্রিশ হাজারের মতো তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গা আছে বাকিরা দেশের জনারণ্যে মিশে গেছে এবং বিভিন্ন সময় তারা একশ্রেণীর দালাল আর অসাধু সরকারী কর্মকর্তাদের সহায়তায় বাংলাদেশী পাসপোর্ট নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য দেশে শুধু চলেই যায়নি সেসব দেশে বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছে। এর ফলে বাংলাদেশের সুনামের যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে। অন্যদিকে তাদের একটি বড় অংশ বাংলাদেশে মাদক ব্যবসা এবং নারী ও শিশু পাচারসহ নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ছে। ইতোমধ্যে কয়েক শ’ রোহিঙ্গা চট্টগ্রাম শহরে চলে এসেছে। চট্টগ্রাম এমএ আজিজ স্টেডিয়ামের চারপাশের সকল খালি জায়গা ইতোমধ্যে তাদের দখলে চলে গেছে। এলাকাটি হয়ে পড়েছে সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য। তবে সব চাইতে যেটি ভয়াবহ সমস্যা এই রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো এখন জঙ্গী তৈরির প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এদের নিয়ে গোপনে কাজ করে সৌদি আরবভিত্তিক রাবিতাত আল ইসলাম, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ঐক্যজোট, হেফাজতে ইসলামসহ অনেক ধর্মান্ধ মৌলবাদী দল ও জঙ্গীবাদী সংগঠন। 
রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে সবচাইতে হতাশাজনক ভূমিকা পালন করেছে গণতন্ত্রের মানসকন্যা খ্যাত আউন সান সুচি। এ ব্যাপারে তার কোন কার্যকর ভূমিকা চোখে পড়ে না। সম্প্রতি তিনি অসলোতে একুশ বছর পূর্বে তাকে প্রদত্ত শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার নিতে গিয়ে তাঁর বক্তৃতায় বলেনÑপ্রবাসী বার্মিজরা মিয়ানমারে সকল নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠীর মাঝে শান্তি ফিরিয়ে আনতে গুরুপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। ব্যস, ওটুকুই । 
সম্প্রতি নতুন করে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা প্রবেশকে কেন্দ্র করে নানা বিতর্কের জন্ম হয়েছে। সরকার নতুন করে কোন রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে দিতে নারাজ। সার্বিক বিচারে এটি সরকারের একটি সঠিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু সরকারের সিদ্ধান্তের সঙ্গে অনেকে দ্বিমত প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, সরকারের উচিত আরও একটু মানবিক হওয়া। এই প্রসঙ্গে দেশের বিশিষ্ট কয়েক ব্যক্তি ইতোমধ্যে বিবৃতি দিয়েছেন। জামায়াত-বিএনপি বলেছে, সরকারের উচিত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া। একজন সিনিয়র সাংবাদিক কলাম লিখে বলেছেন, রোহিঙ্গাদের যেন আবার বাঘের মুখে ঠেলে দেয়া না হয়। সরকারী দলের এক সংসদ সদস্য পত্রিকায় মন্তব্য প্রতিবেদন লিখে বলেছেনÑরোহিঙ্গাদের অবস্থা দেখে তার রাতে ঘুম হয় না। জাতিসংঘ আর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা বাংলাদেশকে অনুরোধ করেছে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে। জামায়াত আর বিএনপির বলার মধ্যে একটা বড় বদমতলব আছে। বিএনপি আমলে এই রোহিঙ্গাদের অনেকেই ভোটার হয়েছে। সে ভোট তাদের বাক্সে পড়বে। তাদের আমলেই সবচাইতে বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশী পাসপোর্ট নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে গেছে। জামায়াত ও সমমনা দল, ব্যক্তি ও গোষ্ঠী এদেরকে তাদের জিহাদী আর সন্ত্রাসী কাজে ব্যবহার করবে। এদের প্রতি আন্তর্জাতিক সহানুভূতি আদায়ের জন্য এরা অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করছে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়কার বিখ্যাত মাইলাই গণহত্যার একটি ছবি তারা নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের ছবি বলে ইন্টারনেটে আপলোড করেছে। অন্য আর একটি ছবি আছে যেটি আসলে থাই পুলিশের হাতে ধৃত গোটাপঞ্চাশেক রোহিঙ্গার। পুলিশ তাদের সমুদ্রের বালিতে উপুড় করে শুয়ে রেখেছে। কিন্তু ছবির ক্যাপসান দেয়া আছে বর্মার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা মেরে ফেলে রেখেছে। টেকনাফে এখন কিছু মোবাইল ফোনের দোকানে কিছু হিন্দী ছবির নির্যাতনের দৃশ্যের ক্লিপিং পাওয়া যায় যা রোহিঙ্গা নির্যাতনের ছবি হিসেবে মোবাইলে ডাউনলোড করে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এটি সত্য, সাম্প্রতিক দাঙ্গায় অনেক রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে, অনেক নারী ধর্ষিত হয়েছে। তবে এই ছবিগুলোর কোনটাই সে সবের নয়। টেকনাফ আর কক্সবাজারে জামায়াতের নেটওয়ার্ক বেশ শক্তিশালী। শোনা যায়, অনেক রোহিঙ্গা গোপনে জামায়াতীদের বাড়িতেও আশ্রয় নিয়েছে। পুরো এলাকা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার দাবি সংবলিত পোস্টারে ছেয়ে গেছে। রোহিঙ্গারা এখানে নানা ধরনের সামাজিক অস্থিরতার জন্ম দিচ্ছে। ইতোমধ্যে এসব এলাকার দিনমজুরদের মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভ দানা বাঁধছে। কারণ যেখানে একজন দিনমজুরের দৈনিক পারিশ্রমিক দেড় থেকে দুই শ’ টাকা সেখানে একজন রোহিঙ্গা শ্রমিক পাওয়া যায় পঞ্চাশ টাকা দিয়ে। যাঁরা মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দিতে বলেন তাঁরা এখানকার বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে অবহিত নন। বাংলাদেশ অতীতে সব সময় মানবিক আচরণ করেছে, এখনও করছে। কিন্তু তাতে ফলাফল শূন্য। এ সম্পর্কে আমাদের বিশিষ্টজনরা একেবারেই নিশ্চুপ। 
কেউ কেউ অনেকটা অর্বাচীনের মতো রোহিঙ্গাদের সমস্যাকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করেন। একাত্তর সালে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করছিলাম। সেই যুদ্ধে এক কোটি বাঙালী শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। আমরা একটা প্রবাসী সরকার গঠন করেছিলাম। শরণার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছিল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। তারা যাতে নিরাপদে নিজ দেশে ফিরে যায় সে চেষ্টা করেছিল ভারত। যুদ্ধ শেষে দ্রুততম সময়ে প্রত্যেক বাংলাদেশী নিজ দেশে ফিরে এসেছিলেন। ভারতে থেকে গিয়েছে তেমন বাঙালী হাতে গোনা যায়। একাত্তরের বাংলাদেশের শরণার্থীদের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের তুলনা করা চরম মূর্খতার শামিল। 
এটি ঠিক মিয়ানমার বাংলাদেশের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী। তাদের সঙ্গে আমাদের অনেক অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িত। তবুও রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ চুপ থাকতে পারে না। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মহল থেকে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য সকল ধরনের কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে। প্রয়োজনে বিষয়টা জাতিসংঘের নজরে আনতে হবে। এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র, চীন বা ভারত তেমন কিছু করবে বলে মনে হয় না। কারণ নতুন মিয়ানমারের অফুরন্ত সম্পদ ও সম্ভাবনার দিকে এখন তাদের সকলের লোলুপ দৃষ্টি। সকলে নিজের স্বার্থ রক্ষাকে সবচাইতে বেশি গুরুত্ব দেয়। কিছুদিনের মধ্যে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরের কথা রয়েছে। বাংলাদেশকে এই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক মজবুত করার বিষয়ে নিশ্চয় আলাপ হবে। রোহিঙ্গা সমস্যার মতো একটি সমস্যা জিইয়ে রেখে কোন সম্পর্কই যে কার্যকর হবে না তা তাকে বুঝতে দিতে হবে। বাংলাদেশ অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা সমস্যার মীমাংসা করেছে। এই সমস্যারও সমাধান হবে, তা মানুষ আশা করতেই পারে। এটি যত না গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশের জন্য তার চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মিয়ানমারের জন্য। এর ব্যত্যয় ঘটলে একটি নতুন গণতান্ত্রিক মিয়ানমারের অভ্যুদয় অধরাই থেকে যাবে।
বিএনপি-জামায়াতের কথা বাদ দিলাম। বাকি যাঁরা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দিতে ওকালতি করছেন তাঁদের প্রতি সম্মান রেখেই বলছিÑবাস্তবতাটা উপলব্ধি করুন, নিজের দেশের স্বার্থটাকে সবার ওপর স্থান দিন। এখনও বাংলাদেশ সরকার এবং জনগণ রোহিঙ্গাদের প্রতি অনেক মানবিক আচরণ করছে। 

লেখক : শিক্ষাবিদ ও বিশ্লেষক। জুন ২২, ২০১২