শুক্রবার, ৬ জুলাই, ২০১২

রোহিঙ্গা সমস্যা : বাস্তবতা ও করণীয়



॥ ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী ॥

আরাকানের আদি নৃগোষ্ঠীর নাম রোহিঙ্গা। এরা ধর্ম বিশ্বাসে মুসলমান। আরাকান বর্তমান মিয়ানমারের বাংলাদেশসংলগ্ন একটি অঞ্চল। এ হিসাবে মিয়ানমার দক্ষিণ-পূর্বাংশের কক্সবাজার জেলার সীমান্তঘেঁষা আমাদের প্রতিবেশী দেশ। আরাকানে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ইতিহাস অতি প্রাচীন। চট্টগ্রামকে বলা হয়, এই ভূখণ্ডে ইসলামের প্রবেশদ্বার। ঐতিহাসিকেরা বলেছেন, খোলাফায়ে রাশেদিনের যুগে চট্টগ্রাম বন্দরে আরব বণিকদের যাতায়াত সূত্রে এখানে ইসলামের প্রচার ঘটে। তখন থেকে আরাকানও ইসলামের ছায়ায় আশ্রয় নেয়।
সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের আগ্রাসনের আগে আরাকানের রাজসভা ছিল বাংলাভাষার চর্চা ও উৎকর্ষতার প্রাণকেন্দ্র। মহাকবি আলাওল, সৈয়দ সুলতান শাহ মুহাম্মদ ছগীর প্রমুখ আরাকান রাজসভাকে কেন্দ্র করে সাহিত্যচর্চা করেন। পদ্মাবতীসহ মধ্যযুগের পুঁথিসাহিত্যের লালনভূমি ছিল আরাকান।
বার্মা ও উপমহাদেশ যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশদের দখলমুক্ত হয়, তখন আরাকান বার্মার সাথে যুক্ত হয়। আরাকান সীমান্তের নাফ নদীর এপারের কক্সবাজার ও টেকনাফ অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত হয় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও বর্তমান বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে। আইয়ুব আমলে পাকিস্তানি শাসকদের ভুল নীতির কারণে বার্মা ও পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তে সব সময় গোলযোগ লেগে থাকত। ফলে অবিশ্বাস ও অশান্তি বলবৎ থাকত দুই দেশের সীমান্তজুড়ে। এর প্রভাব পড়তে থাকে আরাকানের মুসলিম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর। 
রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি আরাকানের সংখ্যালঘু বৌদ্ধদের সাধারণ পরিচয় মগ। স্থানীয় ভাষায় রাখাইন, বার্মা সরকার আরাকানকে রোহিঙ্গামুক্ত করার পলিসি নেয়। রাখাইনেরা সেই পলিসির কারণে মুসলমানদের ওপর যখন-তখন হামলা চালায়। যখন ইচ্ছা ধান-চাল, গরু-ছাগল ছিনিয়ে নেয়। পান থেকে চুন খসলে মারধর করে। বাড়িতে আগুন দেয়। ক্রমেই তাদের নাগরিক অধিকার কেড়ে নেয়া হয়। হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী নৃগোষ্ঠীকে এভাবে অবাঞ্ছিত একটি জনগোষ্ঠীতে পরিণত করা হয়। এমনকি আরাকানের ঐতিহাসিক নামটিও বদলে দিয়ে রাখাইন অঞ্চল রাখা হয়। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার হয়ে টেকনাফগামী মহাসড়কটির নাম আরাকান রোড। জাপান-ব্রিটিশ যুদ্ধের সময় ব্রিটিশেরা বার্মার রণাঙ্গনে যাওয়ার জন্য এটি নির্মাণ করেছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ-বার্মা সীমান্তে বৈরিতা বা অশান্তির অবসান হলেও রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়নের মাত্রা বিন্দুমাত্র কমেনি; বরং বেড়েছে। আশির দশকের শুরুতে রাখাইনদের অত্যাচারে নিপীড়িত মুসলমানেরা বাংলাদেশে শরণার্থী হয়েছিল। তাদের অসহায়ত্বের প্রতি সহানুভূতিশীল সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো দেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়। কিংবা বাংলাদেশি পরিচয়ে চোরাইপথে তারা বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমায়।
১৯৯২ সালে আরেকবার নিপীড়নের শিকার হয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। তখন জাতিসঙ্ঘ শরণার্থী কমিশনসহ অনেক দেশ ত্রাণ তৎপরতা নিয়ে এগিয়ে আসে। কিন্তু তাতে রোহিঙ্গাদের দুর্দশার এতটুকুন সুরাহা হয়নি। সরকারি হিসাব মতে এখনো ৩০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশ ভূখণ্ডে রয়ে গেছে। বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা দুইলাখের ওপর।
২০১২ সালের জুন মাসের শুরুতে একটি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাখাইনরা রোহিঙ্গাদের ওপর দলবদ্ধ হামলা, লুটপাট ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ চালাতে থাকে। ফলে প্রাণভয়ে রোহিঙ্গারা নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করে। কিন্তু বাংলাদেশে সীমান্তরক্ষীরা তাদেরকে ঢুকতে বাধা দেয় এবং অনেককে পুশব্যাক করে। এ ঘটনার প্রেক্ষাপটে জাতিসঙ্ঘ আর জাতিসঙ্ঘের মুরব্বি আমেরিকা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি জোরালো অনুরোধ করে, যাতে রোহিঙ্গাদের আসার জন্য বাংলাদেশের সীমান্ত খুলে দেয়া হয়।
আমাদের প্রশ্নÑ আরাকানে বা রাখাইন অঞ্চলে রোহিঙ্গা নৃগোষ্ঠীর ওপর যুগ যুগ ধরে যে বৈষম্য, বর্ণবাদ ও নির্যাতন চলছে, জাতিসঙ্ঘ তার প্রতিকারের জন্য কী পদক্ষেপ নিয়েছে? বিগত দিনগুলোতে যে ৩০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে এবং জাতিসঙ্ঘ রিলিফ দিয়ে যাচ্ছে, তাদেরকে নিজের ভিটেমাটিতে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য কী ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে? জবাব হলোÑ তেমন কিছুই করেনি। তা হলে আরাকানে নতুন করে সঙ্কট শুরু হওয়ার সাথে সাথে যেখানে মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা যৌক্তিক ছিল, সে কাজটি না করে বাংলাদেশের দুয়ার খুলে শরণার্থীদের গ্রহণ করার জন্য চাপ সৃষ্টির পেছনে কী মতলব থাকতে পারে?
জাতিসঙ্ঘ ও আমেরিকা আফগানিস্তান, ইরাক, ফিলিস্তিন ও বিশ্বের দিকে দিকে মজলুম মুসলমানদের সাথে কী ধরনের আচরণ করেছে ও করছে, তা দুনিয়ার সবাই জানে। এমতাবস্থায় অত্যাচার বন্ধ করতে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির পরিবর্তে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে নিয়ে আসার জন্য তাদের এত দরদ দেখে মনে সন্দেহ সৃষ্টি হওয়া একান্তই স্বাভাবিক।
আমরা দিব্য দেখতে পাচ্ছি, রাখাইনরা এবং মিয়ানমারের শাসকগোষ্ঠী যেমন অত্যাচার-নিপীড়নের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দিয়ে বা হত্যা করে আরাকানকে মুসলিমশূন্য করতে চায়, তেমনি জাতিসঙ্ঘ ও পশ্চিমা দরদি দেশগুলোও রোহিঙ্গাদের নিজেদের পৈতৃক ভিটামাটি থেকে বের করে আনার কৌশল অবলম্বন করেছে। সেই কৌশল হচ্ছেÑ জনসংখ্যার ভারে জর্জরিত বাংলাদেশের ওপর শরণার্থী গ্রহণের জন্য চাপ সৃষ্টি আর রোহিঙ্গাদের অন্তত জাতিসঙ্ঘের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় লাভ এবং পরবর্তী সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের সোনার হরিণ ও অন্যান্য দেশে আশ্রয় নেয়ার প্রলোভন দেয়া। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ দেখে যে কেউ এই বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারবেন। 
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের সর্বোত্তম ও একমাত্র পথ হচ্ছেÑ রোহিঙ্গাদের তাদের পৈতৃক ভিটেমাটিতে নাগরিক মর্যাদা নিয়ে শান্তিতে থাকার ব্যবস্থা করা। এই ব্যবস্থার জন্য এ পর্যন্ত প্রমাণিত হয়েছে যে, বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়া মোটেও নিরাপদ নয়। কারণ, যারা শরণার্থী হয়ে আসে তাদেরকে আর ফেরত নেয়া হয় না, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সে ব্যবস্থা করে না। ফল দাঁড়ায়, এরা নিজের ভিটেমাটি থেকে চিরতরে উৎখাত হয়ে যায়। এখানে বাংলাদেশেও চলতে থাকে শরণার্থীদের নিগৃহীত জীবন। তা ছাড়া বাংলাদেশের আশ্রয় দেয়ার মতো অতিরিক্ত ভূমি ও সামর্থ্য নেই। আরো অধিক শরণার্থীর অনুপ্রবেশ ঘটলে যখন অভাব-অনটন ও চুরি-ডাকাতি বেড়ে যাওয়ার মতো সামাজিক সমস্যা দেখা দেবে, তখন তা সামাল দেয়া কারো পক্ষে সম্ভব হবে না। যদি সৌদি আরব বা অন্য দেশে তাদের পুনর্বাসন করা হয়, তাহলে তো সেই লোভে আরাকান মুসলিমশূন্য হয়ে যাবে, যা মিয়ানমার সরকার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একান্তভাবেই কামনা করে। 
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের আরেকটি পথ চিন্তা করা যেতে পারে আরাকানকে স্বাধীন করে স্বাধীন মুসলিম দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। আমাদের মধ্যে যারা যুক্তি ও বাস্তবতার চেয়ে ভাবাবেগেতাড়িত, তারা এমন স্লোগান শুনলে প্রীত হন, মনে আনন্দ পান। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছেÑ আরাকানকে অদূর ভবিষ্যতে স্বাধীন করা সম্ভব নয়। এর মূল কারণ, স্বয়ং আরাকানের ভেতরকার রোহিঙ্গা মুসলমানেরা স্বাধীনতা চায় না। যাদের স্বাধীনতা দরকার; তারাই যদি না চায় তাহলে বাইরে থেকে জিহাদ করে অন্যদের দিয়ে স্বাধীনতা কায়েম করে দেয়া অসম্ভব। বাইরের ইসলামি জজবাধারী নেতারা এ বাস্তবতাটি বুঝতে না পারার কারণে আরাকানে মুসলমানদের যথেষ্ট ক্ষতি হয়ে গেছে। পাকিস্তান আমলে জাফর কাওয়ালের নেতৃত্বাধীন আরাকানি গেরিলাদের কোন উদ্দেশ্যে প্রশ্রয় দেয়া হয়েছিল, চিন্তা করলে কারণ খুঁজে পাই না। কারণ আমার মনে হয়, এ যাবৎকাল যারা আরাকানকে স্বাধীন করার কথা বলেছেন, তারা দাবি করে বলতে পারবেন না যে, আরাকানের ভেতরকার মুসলিম নেতা বা প্রভাবশালী মহলের এরা কখনো সমর্থন ও সহযোগিতা পেয়েছেন। দ্বিতীয় কারণ ঐতিহাসিক ও খানিকটা তিক্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যে মুহূর্তে মিয়ানমার ও ভারতবর্ষ ছেড়ে ব্রিটিশরা চলে যাবে, তখন বার্মায় প্রচণ্ড সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধে। যেমনটি উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার রূপ নিয়েছিল। বার্মার দাঙ্গা ছিল মগ ও মুসলমানদের মধ্যে। তখন আরাকানের স্থায়ী বাসিন্দা বা রোহিঙ্গারা মগদের দ্বারা প্রতারিত হয়ে বহিরাগতদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। বহিরাগত বলতে চট্টগ্রাম ও পুরো বাংলাদেশ থেকে যাওয়া মুসলমানদের বোঝানো হতো। কারণ চট্টগ্রাম ও বাংলাদেশের মুসলমানরা তখন ভাগ্য বদলের জন্য বার্মায় যেত। সেখানকার ব্যবসায়, বাণিজ্য, সাহিত্য, সংস্কৃতি, মসজিদ, খানকা প্রভৃতি সব কিছুর ওপর বাংলাদেশের বিশেষ করে চট্টগ্রামের লোকদের প্রভাব ছিল। 
সে সময়কার বহিরাগত খেদাও আন্দোলনের এসব রূঢ় বাস্তবতা যাচাইয়ের জন্য ইতিহাসের বই পুস্তক খোঁজার দরকার নেই। চট্টগ্রামের ঘরে ঘরে বয়স্ক লোকদের জিজ্ঞাসাবাদ করলেই এর সত্যতা পাওয়া যাবে।
এই রূঢ় বাস্তবতাকে বিবেচনায় না নিয়ে যারা আরাকানের স্বাধীনতার স্লোগান দেয়, তারা প্রকারান্তরে রোহিঙ্গা মুসলমান ভাইদের ক্ষতিই করে। কারণ, তাতে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন চালানোর অজুহাত খুঁজে পায়।
সবচেয়ে বড় কারণটি হলো, আরাকানকে সাহায্য করার শক্তি আপাতত কারো নেই। এক সাংবাদিক বন্ধু বললেন, ১৯৯২ সালে রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা নিয়ে আমি অনেক ঘোরাঘুরি করেছি। একপর্যায়ে ডা: ইউনুচের ও জনাব শাব্বিরের নেতৃত্বাধীন দু’টি পৃথক রোহিঙ্গা সংহতি আন্দোলনের নেতাদের সাক্ষাৎকার নেয়ার সুযোগ পাই। তাদের বলিষ্ঠ কণ্ঠের দাবি ছিল, আমরা আরাকানকে স্বাধীন করতে চাই। বলেছিলেন তাদের হাতে নাকি সশস্ত্র যোদ্ধা আছে। পরিসংখ্যান জিজ্ঞাসা করলে একপর্যায়ে জানা গেল ডা: ইউনুচের সশস্ত্র যোদ্ধার সংখ্যা দুই হাজার আর শাব্বির সাহেবের দাবি তাদের ৪০০ যোদ্ধা আছে। দুই হাজার বা ৪০০ যোদ্ধার বিশাল বাহিনী নিয়ে মিয়ানমারের নাসাকা বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে কিভাবে জয়ী হবে তার কোনো সদুত্তর তাদের কাছে ছিল না। বিদেশ থেকে কিভাবে অস্ত্রের জোগান আসবে এবং বাংলাদেশ সরকারের সমর্থন না থাকলে কক্সবাজার বা টেকনাফে অস্ত্রের সেই চালান কিভাবে খালাস করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশের ভূমি কিভাবে ব্যবহার করবে সেসব প্রশ্নেরও কোনো জবাব দিতে পারেননি রোহিঙ্গা নেতারা। এর পরও তাদের কাছে যুদ্ধ মহড়া বা অভিযান পরিচালনার ভঙ্গিতে রঙিন ছবি ছিল। জানা যায়, এসব ছবি কোনো গহিন বনে মহড়া দিয়ে তোলা হয়েছে, আর আরাকানের স্বাধীনতার প্রতি সহানুভূতিশীল মধ্যপ্রাচ্যের অর্থশালীদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহে ব্যবহার করা হচ্ছে। এই ছবিগুলো মিয়ানমার সরকারের হাতে গিয়ে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন বাড়ানোর কারণ ঘটাচ্ছে কি না, সে জবাব অপরিণামদর্শী নেতাদের কাছে থাকতে পারে না।
তাহলে রোহিঙ্গাদের বেলায় আমাদের দায়িত্ব কী বা করণীয় কী থাকতে পারে? এর জন্য বিনয়ের সাথে অনুরোধ করব, মুসলমান ভাই হিসেবে রোহিঙ্গাদের জন্য যাদের মন কাঁদে, বিশেষ করে যেসব রোহিঙ্গা মুসলমান ইতোমধ্যে বাংলাদেশ, মধ্যপ্রাচ্য বা বহির্বিশ্বে রয়েছেন তাদেরকে নির্মোহ ও আবেগবর্জিত হয়ে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। আন্তর্জাতিক চক্রান্তের কলাকৌশল বোঝার চেষ্টা করতে হবে। প্রথমে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে যে, আপাতত আরাকানকে বা রোহিঙ্গাদের স্বাধীন করা সম্ভব নয়। তাদেরকে যেভাবেই হোক আরাকানের মাটি কাঁমড়ে থাকতে হবে বা সেখানেই তাদেরকে প্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য নানাভাবে চেষ্টা ও সহায়তা দিতে হবে।
এই সহায়তার প্রথমটি হতে পারে শিক্ষা, রোহিঙ্গাদের স্বতন্ত্র জাতীয় চেতনা ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের স্বার্থে অবশ্যই তাদেরকে ইসলামিয়াত বা ধর্মীয় শিক্ষা দিতে হবে। এর জন্য ব্যাপক আকারে বড় বড় মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন নেই। মসজিদভিত্তিক কুরআন ও মাসয়ালা শিক্ষাই যথেষ্ট। সীমিতসংখ্যক উচ্চতর ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে এগুলোর তত্ত্বাবধান ও শিক্ষক জোগান দেয়া সম্ভব। ঈমান, আমল বা ধর্মকর্ম সম্পর্কে এই প্রাথমিক জ্ঞানই বৈরী পরিবেশে তাদের ধর্মীয় চেতনা উজ্জীবিত রাখার জন্য যথেষ্ট হবে।
ধর্মীয় শিক্ষার মতোই গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সাধারণ শিক্ষা, অর্থাৎ মিয়ানমার সরকার জনসাধারণের জন্য যে শিক্ষাব্যবস্থা চালু রেখেছে, তা আয়ত্ত করার জন্য ছেলেমেয়েদের উৎসাহী করতে হবে। কেননা, সে দেশে প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য এটি প্রধান অবলম্বন। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা বর্জন করে কোনো সমাজের নাগরিকেরা প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে না। এই শিক্ষা হাসিলের ক্ষেত্রে বাধা থাকলে সেটি অতিক্রম করার জন্য দেশের ভেতরে ও বাইরে থেকে আন্দোলন চালাতে হবে।
মসজিদ, মাদরাসাভিত্তিক ধর্মীয় শিক্ষা এবং স্কুল-কলেজের সাধারণ শিক্ষার মতোই গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কারিগরি শিক্ষা। কোনো দেশে সংখ্যালঘু হয়ে মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে হলে তরুণ সমাজকে যতখানি সম্ভব কারিগরি বা হাতের কাজ শেখানোর বিকল্প নেই।
বাংলাদেশে একটি এলাকা আছে, ছোটবেলা থেকে তরুণেরা বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। ফলে যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা থাকতেও তারা লেখাপড়া করতে পারে না। কী কাজ করেন, জিজ্ঞাসা করলে জবাব দেয় বিদেশ যাওয়ার চিন্তায় আছি। তার মানে বেকার। অথচ বিদেশে গিয়ে যেভাবে গতর খাটে, তার অর্ধেক শ্রম, মেধা ও চেষ্টা কাজে লাগালে দেশে সোনা ফলানো সম্ভব হতো। এর মাধ্যমে যে কথাটি বোঝানোর উদ্দেশ্য তা হচ্ছেÑ যতক্ষণ কোনো একটি লক্ষ্যকে জাতীয় জাগরণের মাধ্যমে সহজ করা না হয়, ততক্ষণ সে লক্ষ্য অর্জিত হয় না। রোহিঙ্গা ভাইদেরও আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য নিজের সাধ ও সাধ্যের মধ্যে লক্ষ্য ঠিক করতে হবে। যেভাবেই হোক, নিজের মাটিতে নিজের পায়ে দাঁড়ানোই হবে সেই লক্ষ্য।
কোনো ইসলামি ভূখণ্ডে শত্রুর আক্রমণ হলে বা শত্রুর কোনো ভূখণ্ড জয় করার জন্য জিহাদ করার সওয়াব ও গুরুত্ব সবাই স্বীকার করেন। এ পথে লড়াই করে প্রাণ ত্যাগ করলে শহীদ হবে এবং তা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ হিসেবে গণ্য হবে। যারা আরাকানকে স্বাধীন করার জিহাদে উজ্জীবিত তাদেরকেও ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করার পরামর্শ দিতে চাই যে, যুদ্ধ করে আরাকান জয় করার চিন্তার চেয়ে যারা আরাকানের ভেতরে হাজার বছর ধরে বসবাস করছেন, তাদেরকে সেখানে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ করে দেয়া কী কম জিহাদ। নিজের ভিটেমাটি রক্ষার জন্য যদি নির্যাতন সইতে হয়, এমনকি নিহতও হতে হয়, তা তো আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ ও শাহাদাত হিসেবে গণ্য হবে। এর পরিবর্তে নিজের অবস্থান শত্রুর জন্য ছেড়ে দিয়ে আত্মরক্ষা করার মধ্যে তো কোনো কৃতিত্ব নেই এবং ভবিষ্যৎও তো সম্পূর্ণ অন্ধকার।
এই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধে অন্য যে বিষয়টির দিকে রোহিঙ্গা মুসলিম ভাইদের সাথে সংহতি প্রকাশকারী সচেতন মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই তা হলোÑ একটি রোহিঙ্গা সংহতি তথ্য ব্যাংক প্রতিষ্ঠা। আরাকানের ভেতরে কী চলছে, মুসলমানদের প্রকৃত অবস্থা কীÑ তা আমরা বলতে গেলে সঠিক জানি না। ফলে এই লেখাও লিখছি কিছু তথ্য ও কিছু অনুমানের ওপর নির্ভর করে। ইন্টারনেটের যুগে এ জাতীয় একটি তথ্য ব্যাংক প্রতিষ্ঠা হলে সেটিই হবে রোহিঙ্গা মুসলমানদের প্রতি সংহতি প্রকাশের সর্বোত্তম পন্থা। কারণ, বর্তমান যুগের যুদ্ধাস্ত্রের চেয়ে প্রচার বা মিডিয়াই অধিক কার্যকর। রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর কী ধরনের বৈষম্য, নিগ্রহ ও অত্যাচার চলছে, তা মিডিয়ার সাহায্যে দুনিয়ার মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে। তখন বাইরে থেকে কিভাবে তাদেরকে মিয়ানমারে নাগরিক অধিকার নিয়ে থাকার ব্যবস্থা করা যায়, সে পথ বেরিয়ে আসবে। সচেতন লোকেরা তখন তাদের প্রতি সংহতি জানিয়ে মিছিল, মিটিং, আলোচনা সভা ও লেখালেখির মাধ্যমে বিশ্বজনমত গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারবে। ইসলামি দেশগুলো ওআইসি ও জাতিসঙ্ঘকেও এ ব্যাপারে কার্যকর ভূমিকা রাখতে চাপ দেয়া সহজ হবে। আমার মতে, বর্তমান সময়ে রোহিঙ্গা মজলুম মুসলমান ভাইদের প্রতি সংহতি প্রকাশ ও সাহায্য পৌঁছানোর এটিই কার্যকর পথ। এর পরিবর্তে এমন কোনো ফাঁদে পা দেয়া উচিত হবে না, যা মিয়ানমার সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের স্বদেশ ভূমি থেকে উচ্ছেদ ও সাম্রাজ্যবাদীদের পরিকল্পনা মাফিক তাদের শরণার্থীতে পরিণত করাকে উৎসাহিত করবে। 
২৬-০৬-২০১২
isashahedi@gmail.com

সেই ফাঁসি, সেই ব্রাদারহুড ও আজকের প্রেসিডেন্ট মুরসি



 এমএ বার্ণিক  
বি শ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ মিসরে ড. মুহম্মদ মুরসি প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। গণ-আন্দোলনের মুখে স্বৈরশাসক হোসনি মোবারককে উত্খাতের ১৮ মাসের মাথায় মুসলিম ব্রাদারহুডের এই নেতা সেদেশে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্ট। কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ১৯৭৫ সালে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইডি ডিগ্রি অর্জন করেন। নির্বাচিত হয়েই তিনি ঘোষণা দেন, ‘আমি মিসরের মুসলিম, খ্রিস্টান, নারী, পুরুষ, তরুণদের প্রেসিডেন্ট। মর্যাদার সঙ্গে বসবাস, স্বাধীনতা ও সামাজিক বিচারের জন্য আজ মিসরে ঐক্যের বড় প্রয়োজন।’ ড. মুহম্মদ মুরসি’র এ ভাষণে ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-নির্বিশেষে নিরপেক্ষ থাকার মানসিকতা ফুটে উঠেছে। মুসলিম ব্রাদারহুড ইসলাম ধর্মের যে মর্মবাণী ধারণ করে গড়ে উঠেছে, মুরসি’র ঘোষণার মধ্যে তারই প্রতিফলন ঘটেছে।
ড. মুহম্মদ মুরসি’র বিজয়ের মধ্য দিয়ে তদসম্পর্ক এবং মুসলিম ব্রাদারহুড সম্পর্কে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। প্রথমে ব্যক্তি-মুরসি সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। মিসরের নাইল ডেল্টা (নীল ব-দ্বীপ) প্রদেশের এক গ্রামে মুহম্মদ মুরসি জন্মগ্রহণ করেন। মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতৃত্বে ব্যাপক জনসমর্থনে হোসনি মোবারকের পতনের পর গঠিত দল ‘ফ্রিডম এন্ড জাস্টিস’ পার্টির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি। গত ১৬ ও ১৭ জুন ২০১২ তারিখে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দ্বিতীয় দফা ভোটে ৫৭ দশমিক ৭৩ শতাংশ ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন  তিনি। তদপূর্বে মে মাসে অনুষ্ঠিত প্রথম দফা ভোটে ২৪ শতাংশ ভোট পান তিনি। বর্তমানে ৬০ বছর বয়সী ড. মুহম্মদ মুরসি ৪ সন্তানের জনক। ইতোপূর্বে তিনি মিসরের জাগজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল বিভাগের প্রধান ছিলেন। ২০০০ সালে প্রথম পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। গত বছর হোসনি মোবারকের পতনের পর তিনি মুসলিম ব্রাদারহুডের মুখপাত্র নির্বাচিত হন। ২০১২ সালের ৩০ জুন ড. মুহম্মদ মুরসি মিসরের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।
ইংরেজি ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’ (Muslim Brotherhood) নামটি মিসরবাসী আরবিতে ‘ইখওয়ানুল মুসলিমিন’ হিসেবেই উচ্চারণ করেন। এ সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ হাসানুল বান্না। ১৯২৯ সালের ১১ এপ্রিল তিনি এ সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন। আল-আজহারের এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন শহীদ হাসানুল বান্না। ১৯৪৮ সালে মিসরের বাদশাহ ফারুক প্রথমবার ইখওয়ানুল মুসলিমিনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তারও আগে ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৯ সালে জালেম বাদশাহ ফারুকের আদেশে একদিন মসজিদে যাওয়ার সময় হাসানুল বান্নাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তাঁর মতো একজন আদর্শবাদী ঘাঁটি মানুষ, বাগ্মী ও সত্যপথের সংগঠক বর্তমান দুনিয়ার বুকে বিরল। ১৯৫৪ সালের পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, মিসরে মুসলিম ব্রাদাদারহুডের সদস্যসংখ্যা ছিলো ৫০ লাখ। সে সময় ফিলিস্তিন, সিরিয়া ইরাক ও লেবাননে ব্রাদারহুডের ৩৫০টি শাখা ছিলো।
ইসলামের মৌলিক আদর্শকে সমাজে প্রতিষ্ঠার জন্য মুসলিম ব্রাদারহুড আজীবন লড়াই করেছে। ১৯৪৫ সালের ৮ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত মুসলিম ব্রাদারহুডের মৌলিক সূত্র (Radical Aphorism) নামক এক গ্রন্থে তাদের আদর্শ সম্পর্কে যে সব তথ্য রয়েছে সেগুলোর মধ্যে ছিলো ১। কোরআনের বিশ্লেষণ ও আজকের বৈজ্ঞানিক জগতে তার প্রয়োগ, ২। ঘনিষ্ঠতর সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার  উদ্দেশ্যে ইসলামি আইন-কানুনসমূহের সঠিক ব্যাখ্যা নিরূপণের জন্য ইসলামি রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সহযোগিতা, ৩। সামাজিক ইনসাফ প্রতিষ্ঠার জন্য অর্থনৈতিক সম্পদের সঠিক ব্যবহার ও সামাজিক শ্রেণিসমূহের পুনর্বিন্যাস, ৪। বিশ্ব মুসলিম জীবনমান উন্নত করার জন্য দারিদ্র্য, অস্বাস্থ্য ও অজ্ঞতার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা এবং ৫। বিদেশি প্রভুত্ব বা শোষণ থেকে মুসলিম দেশগুলোকে মুক্ত করা এবং পৃথিবীর সর্বত্র মুসলমান সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষা করা।
১৯৫৪ সালে মিসরের ডিক্টেটর প্রধানমন্ত্রী কর্নেল জামাল আবদুন নাসের মুসলিম ব্রাদারহুডকে পুনরায় বেআইনি ঘোষণা করেন। সেবছর ৮ অক্টোবর ব্রাদারহুডের শীর্ষনেতা ড. হাসানুল হোদায়বীকে গ্রেফতার করা হয়। হোদায়বী ছিলেন ড. হাসানুল বান্নার যোগ্য উত্তরসুরি। কর্নেল নাসের ব্রাদারহুডের কেন্দ্রীয় অফিসসহ ৪০০ শাখা অফিসে তালা ঝুলিয়ে দেন। ব্রাদারহুড কর্তৃক পরিচালিত স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, হাসপাতাল ও কোঅপারেটিভ প্রতিষ্ঠানগুলোও বন্ধ করে দেয়া হয়।
শুধু হোদায়বী নয়, তার সাথে মুসলিম ব্রাদারহুডের আরও ৬ জন বিপ্লবী নেতা মাহমুদ আবদুল লতিফ, ইউসুফ তালাত, আবদুল কাদের ওদা, হিন্দওয়ে দিওয়ার, ইব্রাহিম আল তৈয়ব ও মুহম্মদ ফারাগ আলীকে গ্রেফতার করে তথাকথিত সামরিক  আইনে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। কর্নেল জামাল আবদুন নাসেরের সরকার উচ্ছেদের চেষ্টার অভিযোগ এনে এসব নেতৃবৃন্দকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছিলো।
কর্নেল নাসেরের এহেন অপতত্পরতায় সমগ্র মুসলিম জাহান কেঁপে ওঠে। মুসলিম বিশ্বের চাপের মুখে ড. হাসানুল হোদায়বীকে মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকর করতে বিরত থাকলেও বাকি ৬ জনকে ৭ ডিসেম্বর ১৯৫৪ তারিখ সকাল ৮টা থেকে ১১টার মধ্যে আধাঘণ্টা পরপর ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারা হয়। সে সময় সিরিয়া, লেবানন, জর্দান, সৌদি আরব, ইরাক, ইরান, সুদান পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়াসহ প্রায় সব মুসলিম রাষ্ট্র ব্রাদারহুড নেতাদের মুক্তির দাবিতে মিসরের সরকারের কাছে তারবার্তা পাঠিয়েছিলো। কিন্তু কোন অনুরোধই নাসেরের মন গলাতে পারেনি।
ড. হাসানুল হোদায়বী ব্রাদারহুডে যোগদানের আগে মিসর হাইকোর্টের একজন বিচারপতি ছিলেন। ১৯৫১ সালে তিনি বিচারপতি পদে ইস্তফা দিয়ে মুসলিম ব্রাদারহুডে যোগদান করেন। শহীদ আবদুল কাদের ওদা শুধু মিসরের নয়, সমগ্র মুসলিম জাহানের শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদদের একজন ছিলেন। তিনি ছিলেন মিসরের সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি। ১৯৫০ সালে তিনি বিচারপতি পদে  ইস্তাফা দিয়ে ব্রাদারহুডে যোগদান করেন। শহীদ ইউসুফ তালাত একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ছিলেন। আল  কোরআনের আলোতে আলোকিত এই সিংহপুরুষকে বর্বর নাসের সরকার জেলখানার ভেতরে নির্যাতন করে তার একটি চক্ষু নষ্ট করে দিয়েছিলো। তারপরও ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে দু’হাত তুলে তিনি আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করেছিলেন, “ইহা আল্লাহ, যারা আমার প্রতি অন্যায় করলো, তাদেরকে তুমি ক্ষমা করে দিও।”
শহীদ মুহাম্মদ ফারাগ আলী ছিলেন শহীদ হাসানুল বান্নার ঘনিষ্ঠ সহযোগী। তিনি ব্রাদারহুডের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন। ইতোপূর্বে প্রথম যখন ব্রাদারহুডকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছিলো, তখনও তিনি ‘শান্তি ভঙ্গকারী’ হিসেবে অভিযুক্ত হন এবং পরে বেকসুর খালাস পান। ১৯৫০ সালে মিসরে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময় ফারাগ আলী গেরিলা বাহিনীর সর্বাধিনায়ক মনোনীত হয়েছিলেন। সেই ব্যাঘ্রপুরুষকে নাসের সরকার যখন ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারতে উদ্যত হলো তখন ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন, “বড় সুখের বিষয় যে, আমি আজ শাহাদাত্ লাভ করতে যাচ্ছি।”
শহীদ ইব্রাহিম আল-তৈয়ব ছিলেন মুসলিম ব্রাদারহুডের এক তরুণ নেতা। শাহাদাত্ বরণকালে তাঁর বয়স হয়েছিলো মাত্র ৩২ বছর। তিনি আইন বিষয়ে পাস করেছিলেন এবং ব্রাদারহুডের হেড অফিসে আইন বিভাগে কাজ করতেন। আধুনিক সমাজকাঠামোতে ইসলামি আইনের প্রয়োগ সম্পর্কে গবেষণারত ছিলেন এই যুবনেতা। রাজা ফারুকের শাসনামলে তিনি ১৯৪৯ সালে ৯ মাস কারাবরণ করেন এবং ১৯৫৪ সালে কর্নেল নাসের তাকে ২ মাস কারাগারে অবরুদ্ধ রেখে নির্যাতন করেছিল। ফাঁসির মঞ্চে ইব্রাহিম আল-দৈয়বের শেষবাণী ছিলো, “আল্লাহর অশেষ শুকরিয়া যে, আমি শাহাদাত্ বরণ করছি।” অপরদিকে শহীদ মাহমুদ আবদুল লতিফ ও হিন্দওয়ে দিওয়ার শাহাদাতের সময় অম্লান বদনে বলে গেছেন, “আমরা আল্লাহর নিকট থেকে এসেছি এবং আল্লাহর নিকট ফিরে যাচ্ছি।”
ব্রাদারহুডের নেতৃবর্গের ফাঁসির পেছনে সুয়েজ খালে ইংরেজদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সম্পর্ক জড়িত ছিলো। কারণ ব্রাদারহুড সুয়েজ খাল সম্পর্কে ইংরেজ ও মিসরের সংলাপের ঘোর বিরোধী ছিলো। তারা সুয়েজ খাল থেকে ইংরেজদের শর্তহীন প্রস্থানের দাবিদার ছিলো এবং এ খালকে আন্তর্জাতিক নৌপথ হিসেবে স্বীকৃতি এবং সেটিকে ইংরেজদের হাতে সমর্পণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। ২৮ মার্চ ১৯৫৪ তারিখে জামাল আবদুন নাসের মিসরের সামরিক সরকার হিসেবে ক্ষমতায় বসে সুয়েজ পরিত্যাগ সংক্রান্ত চুক্তিতে ইংরেজদের সাথে স্বাক্ষর করেন (১ সেপ্টেম্বর ১৯৫৪)। মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি এ চুক্তি স্বাক্ষর করেন। চুক্তি স্বাক্ষরের এক মাসের মাথায় জামাল আবদুন নাসেরের প্রাণনাশের চেষ্টা হয় এবং এ জন্য মুসলিম ব্রাদারহুডকে দায়ী করে তাদের আন্দোলনকে বে-আইনি ঘোষণা করা হয়। ৬ জনকে ফাঁসি দেয়া হলেও ৩০০ জন ব্রাদারহুড নেতাকে দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ড এবং ১০ হাজারেরও অধিক ব্যক্তিকে বিভিন্ন প্রকারের শাস্তি দেয়া হয়। এভাবে ইংরেজদের পদলেহনকারী নাসের সরকার ব্রাদারহুডকে নিঃশেষ করে দেয়ার সকল আয়োজন সম্পন্ন করে। কিন্তু আদর্শবাদী সংগঠনের মৃত্যু এতো সহজ নয়। সেই ঘটনার ৫৮ বছর পর ২০১২ সালে ব্রাদারহুড মিসরের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এলো।
মিসরের রাজা ফারুক আর কর্নেল নাসেরের মধ্যে আদর্শগত কোন পার্থক্য ছিলো না। তারা ব্রাদারহুডের নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করে যে নির্যাতন করেছিলো, সভ্য জগতে তার দৃষ্টান্ত বিরল। কারারুদ্ধ এসব খাঁটি মুসলমানকে মাসের পর মাস অনাহারে, অর্ধাহারে রেখে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় মারতে মারতে নাকমুখে রক্ত বের করে দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বেহুঁশ অবস্থায় রাখার পর চোখ খুললেই বলা হতো, “এবার বল, তোমরা ব্রাদারহুডে আর কাজ করবে কি-না?” গরম লোহার চিমটা দিয়ে হাতের আঙ্গুল থেকে একেকটি নখ টেনে টেনে বের করা হতো আর একেকটি টানের পর কিছুক্ষণ থেকে আবার জিজ্ঞাসা করা হতো, “এবার বল, তোমরা ব্রাদারহুড ছাড়তে রাজি আছে কি-না?” শরীর আর অন্তরের সমস্ত জ্বালা দু’ঠোটে চেপে শান্ত অথচ দৃঢ়কণ্ঠে তারা সকলেই জবাব দিতেন, “আল্লাহু আকবার, লিল্লাহিল হামদ” অর্থাত্ আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ, সব প্রশংসা আল্লাহর জন্য। এ হ’ল ব্রাদারহুডের মূল আওয়াজ। এভাবে বাদ্রারহুডের নেতারা জীবনত্যাগ করলেও আদর্শচ্যুত হননি। যাদেরকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিলো তারা ব্যতীত হাজার হাজার ব্রাদারহুডের নেতা-কর্মীকে বছরের পর বছর কারাগারে আটক রেখে নির্যাতন করা হয়েছে।
সর্বশেষে ২০১১ সালে ব্রাদারহুড মিসরের সাধারণ মানুষের নেতৃত্বের সামনে চলে আসে। ফলশ্রুতিতে গণবিক্ষোভের মুখে স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের বিদায়ের পর মিসরের সশস্ত্র বাহিনীর সর্বোচ্চ পরিষদ (স্কাপ) ১৮ মাস সে দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য নানামুখী কাজ করে। এসব কাজের মধ্যে ছিলো হোসনি মোবারক ও তার সহযোগীদের বিচার, বিভিন্ন অনিয়ম ও অবিচার সম্পর্কে তদন্ত পরিচালনা এবং সর্বোপরি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন পরিচালনা। গণতান্ত্রিক পদ্ধতির নির্বাচনে ব্রাদারহুড নেতা উ. মুহম্মদ মুরসি ক্ষমতায় এলেও তিনি এমন এক পরিস্থিতিতে হাল ধরেছেন যখন দেশে কোন পার্লামেন্ট নেই, স্থায়ী কোন সংবিধান নেই, বিধিসংগত ব্যবস্থা নেই। এমতাবস্থায় স্কাপের নিয়মনীতি অনুসরণ করে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে  তাকে এগোতে হবে। ড. মুরসি যে আদর্শে বিশ্বাসী সেই আদর্শকে রাষ্ট্রীয় জীবনে কতটা পরস্ফুিট করতে পারবেন সে ব্যাপারেও রয়েছে নানা মত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মুসলিম ব্রাদারহুডকে কোনদিনই ভলো চোখে দেখেনি, তাই মার্কিন প্রশাসনের নিকট মুরসি’র গ্রহণযোগ্যতা কতটা হবে সে ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে।
তবে মুরসি পন্ডিত ও বিদগ্ধ ব্যক্তিত্ব। সামরিক পরিষদের বেড়াজাল ডিঙ্গিয়ে লাখো জনতার সমর্থন নিয়ে তিনি এগিয়ে যেতে সমর্থ হবেন বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেছেন। মন্ত্রিসভা গঠনের আগে সমাজের সর্ব অংশের সাথে পরামর্শ করার মধ্যে তার দূরদর্শিতার ছাপ ফুটে উঠেছে। তার স্ত্রী নাগলা আলী মাহমুদের বয়স ৫০ বছর। তার বড় ছেলের নাম আহমদ। তাই ‘উম আহমদ’ বা আহমদের মা হিসেবে তিনি পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। বোরকা পরিহিত এই রমণী ‘ফাস্ট লেডি’ হিসেবে পরিচয় দেয়ার ঘোর বিরোধী।
এখানে প্রসঙ্গত আর একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, মানবতার সেবায় মুসলিম ব্রাদারহুড সর্বমহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়। মানবতার সেবার জন্য ব্রাদারহুডের একটি আলাদা বিভাগ রয়েছে। এ বিভাগ থেকে গরীব ও অভাবী লোকদের সাহায্য প্রদান, স্বল্পমূল্যে খাদ্য সরবরাহ, বেকারদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, রোগীদের জন্য বিনামূল্যে চিকিত্সার ব্যবস্থা এবং স্বাস্থ্য রক্ষার পদ্ধতিসমূহ  প্রচার করা হয়। তাছাড়া ব্রাদারহুডের প্রতিটি পেশার বিশেষজ্ঞ শ্রেণী রয়েছেন যারা নিজ নিজ পেশায় কর্মরত পেশাজীবীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির জন্য পরামর্শ প্রদান করে থাকে। এতকিছু সত্ত্বেও ক্ষমতায় আসার পর সামরিক বাহিনীর প্রভাববলয় থেকে ব্রাদারহুড মুক্ত হওয়া এবং ড. মুহম্মদ মুরসিকে সামরিক শাসনের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে দেশ পরিচালনার পাশাপাশি তীব্রভাবে দ্বিধাবিভক্ত, আতংকিত ও ক্ষুব্ধ মিসরীয়দের নেতৃত্ব দেয়া দুরূহ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
n লেখক:সভাপতি, ইতিহাস গবেষণা সংসদ

লিবিয়ায় নির্বাচন: গণতন্ত্রের পথে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ


ম্যাগি মিখাইল
এবার নির্বাচনে সেখানকার ইসলামী দলগুলোর সামনে এক কঠিন চ্যালেঞ্জ উপস্থিত। কারণ গাদ্দাফির সরকার ছিল মূলত ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিতে বিশ্বাসী। মিসরে হোসনি মোবারকও একই পথের পথিক ছিলেন। এসব ইসলামী দলের মধ্যে মডারেট ইসলামী ব্রাদারহুড থেকে শুরু করে উগ্র সালাফি মতবাদে বিশ্বাসী ও সাবেক জিহাদিরা রয়েছে

আবদেল-হাকিম বেলহাজ আফগানিস্তানে সোভিয়েত সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী একজন সাবেক জিহাদি কমান্ডার। অতি সম্প্রতি তিনি তার পুরনো জুব্বা ও যোদ্ধা বেশ ছেড়ে বিজনেস সুট ধরেছেন। এই ব্যক্তিটিই লিবিয়ায় একটি ইসলামী পার্টি গঠন করে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। আজ শনিবার অনুষ্ঠানরত লিবিয়ার সংসদ নির্বাচনে তার দল অন্যদের থেকে এগিয়ে রয়েছে বলে কেউ কেউ ধারণা করছেন। মুয়াম্মার গাদ্দাফির ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে একটানা শাসনের পর সেখানে এটাই গণতন্ত্রের পথে গুরুত্বপূর্ণ প্রথম পদক্ষেপ। রাজধানী ত্রিপোলিতে বিভিন্ন দল ও প্রার্থীর সমর্থনে পোস্টার-ব্যানার দেখে বোঝার উপায় নেই যে, এই দেশটিতেই গাদ্দাফি দীর্ঘকাল সকল রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা নিষিদ্ধ করে রেখেছিলেন। তখন গাদ্দাফির স্বৈরশাসনকেই এক ধরনের গণতান্ত্রিক শাসন নামে অভিহিত করা হতো। নয় মাস আগে গাদ্দাফি উৎখাত ও নিহত হওয়ার পর এই প্রথম গৃহযুদ্ধে দীর্ণ দেশটির ২৮ লাখ ভোটার আজ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে যাচ্ছে। লিবীয়রা মনে করছে, এরপর তাদের ৬০ লাখ লোকের তেলসমৃদ্ধ দেশটির উন্নতি হবে। এখানকার বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ ক্ষমতা বাড়বে।
এদিকে এখনও বেপরোয়া মিলিশিয়া দলগুলো নিজেদের খেয়ালখুশিমতো চলছে। আঞ্চলিক ও গোষ্ঠীগত সংঘাত বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে সহিংসতার বিস্তার ঘটছে। সেখানে বস্তুত কোনো বৈধ তথা নির্বাচিত সরকার না থাকার কারণেই এসব ঘটনা ঘটতে পারছে। আটককৃতদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন, এমনকি হত্যার মতো ঘটনা সেখানে ব্যাপকভাবেই ঘটছে বলে মানবাধিকার সংগঠনগুলো প্রমাণ পেয়েছে।
এবার নির্বাচনে সেখানকার ইসলামী দলগুলোর সামনে এক কঠিন চ্যালেঞ্জ উপস্থিত। কারণ গাদ্দাফির সরকার ছিল মূলত ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিতে বিশ্বাসী। মিসরে হোসনি মোবারকও একই পথের পথিক ছিলেন। এসব ইসলামী দলের মধ্যে মডারেট ইসলামী ব্রাদারহুড থেকে শুরু করে উগ্র সালাফি মতবাদে বিশ্বাসী ও সাবেক জিহাদিরা রয়েছে।
অনেক অর্থ নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় নামা ব্রাদারহুড জাস্টিস ও কনস্ট্রাকশন পার্টি ভালো অবস্থান করে নিতে পেরেছে বলেই মনে হচ্ছে। তরুণ-তরুণীরা ব্রাদারহুডের প্রতীক ধারণ করে ঘরে ঘরে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছে। আর তিনটি দল বেশ আসন জিতে নেবে বলেই মনে হচ্ছে। এই তিনটি দলের মধ্যে রয়েছে_ সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহমুদ জিবরিলের ধর্মনিরপেক্ষ অ্যালায়েন্স ফর ন্যাশনাল ফোর্সেস, বেলহাজ আল-ওয়াতন ও লিবিয়ার প্রাচীন রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল ফ্রন্ট পার্টি। শেষোক্ত এই দলটি গাদ্দাফিকে হত্যা করার জন্য কয়েক দফা চেষ্টা চালিয়েছিল।
২শ' আসনের এই লিবীয় সংসদ নির্বাচিত হওয়ার পর তারা নতুন ট্রানজিশনাল সরকার গঠন করবে এবং নতুন সংবিধান প্রণয়ন ও গণভোটের মাধ্যমে নতুন সংবিধান গ্রহণ না হওয়া পর্যন্ত ওই সরকার দেশ পরিচালনা করবে। নতুন সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২০১৩ সালে। তবে বর্তমান ট্রানজিশনাল সরকার এক ডিক্রিতে বলেছে, ভোটাররা এই প্যানেলের সদস্যদের সরাসরি নির্বাচিত করবে। অর্থাৎ ফেডারেটিভ শাসন প্রতিষ্ঠার একটা প্রচেষ্টা এতে লক্ষণীয়।
মিসর ও তিউনিসিয়াসহ আরব বিশ্বে যে গণবিপ্লব দেখা দেয় এই ফেডারেল ব্যবস্থার মাধ্যমে এর সুফল মিলতে পারে। ওই বিপ্লবের সময় গাদ্দাফিকে উৎখাতের আহ্বানের মধ্য দিয়ে সেখানেও জনগণের প্রতিবাদ-বিক্ষোভ শুরু হয়। কিন্তু তাদের ওপর দমন-পীড়ন চালানো হলে তারা গাদ্দাফি বাহিনীর সঙ্গে যুঝে উঠতে পারে না। তখন প্রয়োজন দেখা দেয় বিদেশি সামরিক ও অন্যান্য সহযোগিতার। ন্যাটো তখন আকাশপথে হামলা চালানোসহ গাদ্দাফি বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে দেওয়ার ব্যবস্থা করে। গাদ্দাফি উৎখাতে নেতৃত্বদানকারী ট্রানজিশনাল কাউন্সিলের সাবেক মুখপাত্র গুমা এল-গামাতি বলেছেন, বিগত ৪৩ বছর ধরে একজন ভাগ্যবিধাতা দেশ শাসন করেছেন, আর এখন হাজারজনের উদ্ভব ঘটেছে। তিনি বলেন, এই নির্বাচন আয়োজনের ফলে মানুষ মনে করছে, অবশেষে ট্রেন চলতে শুরু করেছে অর্থাৎ অচলাবস্থা কাটতে শুরু করেছে। এই নেতাও একটি দল গঠন করে নির্বাচনে অবতীর্ণ হয়েছেন। বিবাদরত লিবিয়ানদের মধ্যে প্রীতি-মৈত্রী প্রতিষ্ঠার মতো কোনো কর্তৃপক্ষ না দেখা যাওয়ায় এতদিন খেয়োখেয়ি চলছিল। এখন নির্বাচনের মাধ্যমে একটি বৈধ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে সে অভাব দূর হতে পারে।
নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে দশকের পর দশক ধরে এক ব্যক্তির শাসনের জন্য বিকশিত হতে না পারা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান-সংস্থাগুলো তাদের বিকাশের সুযোগ পাবে। সরকার অবশ্যই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করবে। নিজেদের খেয়ালখুশিমতো পরিচালিত মিলিশিয়া বাহিনীগুলোকে একটা সামরিক বাহিনীর কমান্ডের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হবে।
নতুন বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হবে। যাতে লিবীয়দের বিবাদগুলো মীমাংসা করা সম্ভব হবে। ধারণা করা হয়, মিলিশিয়া বাহিনীগুলোর হাতে গাদ্দাফি বাহিনীর ৪ হাজারের ওপর সদস্য আটক রয়েছে।
নির্বাচনের জন্য দেশ এখন সম্পূর্ণ উৎসবের মেজাজে রয়েছে। এটা আমাদের জনগণের সংগ্রামের ফসল বলে বেলহাজ উল্লেখ করেন। তিনি বুধবার ত্রিপোলিতে এক নির্বাচনী বক্তব্য দেওয়ার সময় বলেছেন, তারা লিবিয়াকে আধুনিক সমৃদ্ধিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করতে চান। তারা জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনও ঘটাতে চান এবং জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে চান।
কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, নির্বাচনে ধর্মনিরপেক্ষ, স্বতন্ত্র ও ইসলামপন্থিদের একটা মিশ্র অবস্থা লক্ষ্য করা যাবে। তবে অন্যরা মনে করেন, ইসলামপন্থিরা মোট আসনের অর্ধেকের বেশি জিতে নেবে। নেদারল্যান্ডসভিত্তিক আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য সাইফকে তাদের হাতে তুলে দেওয়ার কথা বললেও মিলিশিয়ারা তার বিচার লিবিয়াতেই অনুষ্ঠানের পক্ষপাতী। এক সময় গাদ্দাফির উত্তরসূরি বিবেচিত সাইফের সঙ্গে আঁতাতকারী হিসেবে আইসিসি টিমকে চিহ্নিত করে জিনতান বাহিনী গোটা টিমকে এক মাস আটক করে রেখেছিল।
অন্যদিকে জিবরিলকেও সাবেক গাদ্দাফি সরকারের অংশ মনে করা হয়ে থাকে। কারণ তিনি সে সময় জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান ছিলেন এবং তিনি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়া দেখভাল করতেন।
গত বৃহস্পতিবার অবমুক্ত করা এক রিপোর্টে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্য্যালনাল আইন প্রণেতা ও সরকারকে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করার আহ্বান জানিয়েছে। তারা মানবাধিকার রক্ষার কথাও স্মরণ করিয়ে দেয়।
অ্যামনেস্টির মহিলা মুখপাত্র হাসিবা হাদি এক বিবৃতিতে বলেন, গাদ্দাফি সরকারের বিদায় নেওয়ার পর অনেক মাস পেরিয়ে গেলেও এখনও দেশের নিরাপত্তা মিলিশিয়া বাহিনীগুলোর হাতেই রয়ে গেছে। এর মধ্যে মারাত্মক সব ঘটনা ঘটছে। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা বিঘি্নত হচ্ছে। বিবাদ দেশকে প্রায় বিভক্তির মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে। সারা পূর্বাঞ্চলীয় অংশেই বিভক্তির আওয়াজ বেশ জোরালো। এই অংশটি দশকের পর দশক ধরে গাদ্দাফির শাসনে অনেকটাই পিছিয়ে পড়ে এবং তাদের মধ্যে এক ধরনের বঞ্চনাবোধ জন্ম নেয়। আর এটা গত বছর গাদ্দাফিবিরোধী অভ্যুত্থানের সূতিকাগারও ছিল। তারা দেশের পশ্চিমাংশ থেকে তাদের আসন সংখ্যা অনেক কম হওয়ায় ক্ষুব্ধ। এ জন্য তারা আজকের নির্বাচন বয়কটেরও আহ্বান জানিয়েছিল।
তবে অ্যামনেস্টি বলেছে, দেশের পরিস্থিতি উন্নতির জন্য নির্বাচন হলো প্রথম পদক্ষেপ।

নিউজউইক থেকে ভাষান্তরিত

বৃহস্পতিবার, ৫ জুলাই, ২০১২

যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার সনদ লঙ্ঘন করছে



॥ জিমি কার্টার ॥

বিশ্বজুড়ে মানবাধিকারের জোরালো সমর্থক হিসেবে যে ভূমিকা যুক্তরাষ্ট্র পালন করে এসেছে, তা দেশটি পরিত্যাগ করছে।
এই মর্মে তথ্য উদ্ঘাটিত হয়েছে যে, মার্কিন শীর্ষ কর্মকর্তারা বিদেশে লোকজনকে হত্যার জন্য টার্গেট করছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন মার্কিন নাগরিকও। আমাদের জাতির দ্বারা মানবাধিকার লঙ্ঘন কতটা বিস্তৃত হয়েছে, তার সর্বসাম্প্রতিক ও উদ্বেগজনক প্রমাণ এটা। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সন্ত্রাসবাদী হামলার পর এই প্রবণতার সূচনা। (ডেমোক্র্যাটিক ও রিপাবলিকান) দুই দলেরই প্রশাসনিক ভূমিকা এবং কংগ্রেসের কার্যক্রমের মাধ্যমে এর অনুমোদন দিয়ে এটাকে বাড়িয়ে তোলা হয়েছে। আর সাধারণ জনগণও এ ব্যাপারে ভিন্ন মত প্রকাশ করেনি। এর ফল হলো, এ ধরনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে আমাদের দেশ আর নৈতিক কর্তৃত্বের সাথে জোর দিয়ে কথা বলতে পারছে না।
যুক্তরাষ্ট্র অতীতে ভুল করেছে। তবে অবস্থার নাটকীয় অবনতি ঘটে গত দশকে মানবাধিকারের ব্যাপক লঙ্ঘনের মাধ্যমে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ১৯৪৮ সালে ‘মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা’ গৃহীত হয়েছিল। এটা ছিল ‘স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার ও শান্তির ভিত্তি’। এতে এ মর্মে সাহসী ও সুস্পষ্ট অঙ্গীকার ছিল যে, জনগণকে নির্যাতন-নিপীড়ন করার হাতিয়ার হিসেবে আর ক্ষমতা ব্যবহৃত হবে না। এই ঘোষণা সবার সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিল জীবন, স্বাধীনতা, ব্যক্তির নিরাপত্তা, আইনি সুরক্ষা এবং নির্যাতন কিংবা স্বেচ্ছাচারীভাবে বন্দী করা অথবা বলপূর্বক নির্বাসন থেকে মুক্ত থাকার ক্ষেত্রে।
বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে একনায়কতন্ত্র হটিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আইনের শাসন মজবুত রাখার জন্য মানবাধিকার সংগ্রামীরা ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় প্রেরণা পেয়েছেন এই ঘোষণা থেকে।
এটা উদ্বেগজনক যে, আমাদের (যুক্তরাষ্ট্র) সরকারের সন্ত্রাসবাদবিরোধী নীতিগুলো এসব মূলনীতি জোরদার না করে এখন মানবাধিকার সনদের ৩০টি ধারার অন্তত ১০টি সুস্পষ্টভাবেই লঙ্ঘন করছে। এর মধ্যে ‘নিষ্ঠুর অমানবিক অথবা অমর্যাদাকর আচরণ বা শাস্তি’র ওপর যে নিষেধাজ্ঞা, সে ধারাটিও রয়েছে।
কোনো ব্যক্তি সন্ত্রাসবাদী সংগঠন বা ‘সংশ্লিষ্ট বাহিনী’গুলোর সাথে জড়িত থাকার সন্দেহে তাকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্দী রাখার অধিকার মার্কিন প্রেসিডেন্টকে দেয়া হয়েছে আইন করে। এই ব্যাপক ও অস্বচ্ছ ক্ষমতার অপব্যবহার হতে পারে যদি আদালত কিংবা কংগ্রেস কার্যকর নজরদারি না রাখে। অবশ্য একজন ফেডারেল জজ আইনটি বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধক দাঁড় করিয়েছেন। এই আইন মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার লঙ্ঘন করেছে। তদুপরি অপরাধীরূপে প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত যেকোনো ব্যক্তি নির্দোষ বলে গণ্য হবেন, এই অধিকারেরও পরিপন্থী উপরিউক্ত আইন। এই দুই বিষয়ে দু’টি ধারা আছে মানবাধিকার ঘোষণায়। 
মার্কিন নাগরিকেরা হত্যাকাণ্ড এবং অনির্দিষ্টকালীন অন্তরীণের টার্গেট হচ্ছেন। এর সাথে যোগ হলো সাম্প্রতিক কিছু আইন, যেগুলো বিদেশী গোয়েন্দা নজরদারি আইন, ১৯৭৮-এর নিবৃত্তিমূলক বিধানগুলো বাতিল করে দিয়েছে। এটা করা হয়েছে আমাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকারের নজিরবিহীন লঙ্ঘনের উদ্দেশ্যে। তা হবে, পরোয়ানা ছাড়াই ফোনে আড়ি পেতে এবং ইলেকট্রনিক যোগাযোগব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করে। এমন সব আইন বিদ্যমান, যেগুলো শুধু চেহারা, প্রার্থনার স্থান এবং কারো সাথে সংশ্লিষ্টতার কারণে বন্দী করার অনুমতি দেয়।
চালকবিহীন বিমান বা ড্রোনের হামলায় যে-ই নিহত হোক, তাকেই শত্রু সন্ত্রাসী ঘোষণা করার স্বেচ্ছাচারী বিধান রয়েছে। তদুপরি তার কাছে উপস্থিত থাকা নির্দোষ নারী-শিশুর মৃত্যুকে ধরে নেয়া হয়েছে ‘অনিবার্য’। আফগানিস্তানে এ বছর নিরস্ত্র মানুষের ঘরবাড়িতে ৩০ বারের বেশি বিমান হামলার পর প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই এটা বন্ধ করার দাবি জানালেন। কিন্তু পাকিস্তান, সোমালিয়া ও ইয়েমেনের বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের হামলা চলছেই। অথচ এসব স্থান ‘যুদ্ধ এলাকা’র অন্তর্ভুক্ত নয়। এসব হামলায় কত শত নিরীহ নির্দোষ বেসামরিক লোক মারা পড়েছে, আমরা জানি না। এর প্রতিটি হামলাই ওয়াশিংটনে সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত। অতীতে এটা চিন্তাও করা যেত না। এসব কিছু আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতিকে নিশ্চিতই ক্ষতিগ্রস্ত করছে। উচ্চপর্যায়ের গোয়েন্দা ও সেনাকর্মকর্তারা এবং মানবাধিকার সমর্থকেরা জোর দিয়ে বলেছেন, ড্রোন হামলা অনেক বেড়ে গেছে এবং এতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলোর দিকে ঝুঁকছে। এ হামলা সাধারণ মানুষকে আমাদের বিরুদ্ধে ুব্ধ করে তুলেছে। নির্যাতক সরকারগুলো ড্রোন হামলার দোহাই দিয়ে নিজেদের স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ বৈধ করার প্রয়াস পাচ্ছে।
এ দিকে কিউবার গুয়ান্তানামো বের বন্দিশিবিরে এখনো ১৬৯ জন আছেন। তাদের অর্ধেকই মুক্তি লাভের অনুমতি পেয়েছেন। অথচ তাদের কোনো দিন মুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলা চলে। মার্কিন কর্তৃপক্ষ বলেছে, দোষ স্বীকার করার জন্য বিচারাধীন (তাও শুধু সামরিক আদালতে) কয়েকজনকে নির্যাতন করা হয়েছে। তাদের এক শ’ বারেরও বেশি পানিতে চুবিয়ে অথবা সেমিঅটোমেটিক অস্ত্র ও ড্রিল মেশিনের ভয় দেখিয়ে নতুবা তাদের মায়ের ওপর যৌন হামলার হুমকি দিয়ে এটা করা হয়েছে। বিস্ময়কর হলো, এসব সত্য ঘটনাকে অভিযুক্ত নিজের সমর্থনে ব্যবহার করার উপায় নেই। কারণ মার্কিন সরকার দাবি করছেÑ ‘জাতীয় নিরাপত্তা’র জন্যই এসব করা হয়েছে। অন্যান্য বন্দীর কখনো বিচার হওয়ার কিংবা তাদের ব্যাপারে চার্জশিট দেয়ারও সম্ভাবনা নেই।
যখন জনগণের বিপ্লব দুনিয়া কাঁপিয়ে দিচ্ছে, তখন যুক্তরাষ্ট্র আইনের মৌলিক বিধিবিধান এবং মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের মূলনীতিগুলো দুর্বল না করে শক্তিশালী করা উচিত। কিন্তু পৃথিবীকে নিরাপদ করার বদলে আমেরিকা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। এটা আমাদের শত্রুদের উসকে দিচ্ছে আর দূরে সরিয়ে দিচ্ছে বন্ধুদের।
উদ্বিগ্ন নাগরিক হিসেবে চলার পথ পাল্টে মানবাধিকারের মাপকাঠি মোতাবেক নৈতিক নেতৃত্ব ফিরে পেতে ওয়াশিংটনকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। মানবাধিকারের নীতিমালাকে আমরা নিজেদের বলে গ্রহণ করেছি সরকারিভাবেই। বছরের পর বছর আমরা এগুলোকে লালন করেছি। 
দ্য নিউইয়র্ক টাইমস ২৪ জুন
লেখক : যুক্তরাষ্ট্রের ৩৯তম প্রেসিডন্ট। ২০০২ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী। কার্টার সেন্টার প্রতিষ্ঠাতা।
ভাষান্তরÑ মীযানুল করীম

মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক ও রোহিঙ্গা সমস্যা

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার, পিএসসি (অব.)


ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায়। শক্তিশালী প্রতিবেশী ভারতের স্থল সীমান্ত রয়েছে বাংলাদেশের চতুর্দিক ঘিরে। ভারত ব্যতীত অন্য যে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের স্থল সীমান্ত আছে সেটি হলো মিয়ানমার। মিয়ানমার আমাদের পূর্বদিকের প্রতিবেশী, যে দেশের সঙ্গে আমাদের স্থল সীমানার দৈর্ঘ্য প্রায় ২৪৩ কি. মি.। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক সূত্রে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের যত বেশি যোগাযোগ রয়েছে, মিয়ানমারের সঙ্গে সঙ্গত কারণেই ততটা নেই। তবে ভৌগোলিক অবস্থান এবং মিয়ানমারের উদার ও বহুমুখী বৈদেশিক সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহ প্রকাশের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ বাংলাদেশের জন্য নতুন অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করেছে। মিয়ানমারের সঙ্গে স্থলপথে সংযোগ স্থাপিত হলে বিশ্বের উদীয়মান শক্তি চীন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্য প্রায় সব দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক লেনদেন বাংলাদেশ স্বল্প সময়ে ও খরচে করতে সক্ষম হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সেতু বা ব্রিজ হিসেবে কাজ করতে পারে মিয়ানমার। ১৯৬২ সালে সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে বন্ধ হয়ে যাওয়া দরজা মিয়ানমার ধীরে ধীরে খুলে দিচ্ছে। ফলে বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর দেশটির প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তিসমূহের ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে। ছয় লাখ ৭৬ হাজার ৫৫২ বর্গকিলোমিটার আয়তনের মিয়ানমার বাংলাদেশ থেকে প্রায় চার গুণ বড়। তবে মিয়ানমারের লোকসংখ্যা আমাদের এক-তৃতীয়াংশ, প্রায় ছয় কোটি। অথচ দেশটিতে রয়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ সদস্যের শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনী, যা আকারের দিক থেকে পৃথিবীর নবম বৃহত্তম। ১৯৪৮ সালে তৎকালীন নাম বার্মা, বর্তমানের মিয়ানমার ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতার পর এক যুগেরও কিছু বেশি সময় মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ছিল। কিন্তু ১৯৬২ সালের ২ মার্চ এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে নেয় সে দেশের সামরিক বাহিনী। তারপর থেকে মিয়ানমার সামরিক শাসনের গ্যাঁড়াকলে পড়ে আছে, যেখান থেকে এখনো সম্পূর্ণভাবে বের হতে পারেনি। ১৯৯০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) কাছে শাসনক্ষমতা হস্তান্তর না করে সে দলের নেতা অং সান সু চিকে বন্দী করা হয় এবং গণতন্ত্রকামীদের ওপর শুরু হয় জেল-জুলুম, অত্যাচার ও নির্যাতন। ফলে মিয়ানমারের সামরিক সরকার যুক্তরাষ্ট্রসহ সব পশ্চিমা বিশ্বের সর্বাত্দক নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে। ফলে এক বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্রে পরিণত হয় দেশটি। আমেরিকার অবরোধ ও অবহেলার কারণে মিয়ানমারের সামরিক সরকার চীনকে বিনিয়োগের আমন্ত্রণ জানায়। চীনও তার সুদূরপ্রসারী গ্র্যান্ড স্ট্র্যাটেজির অংশ হিসেবে দক্ষিণ চীন সাগরের বিকল্প পথের সন্ধানে বঙ্গোপসাগর হয়ে ভারত মহাসাগরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের জন্য মিয়ানমারের উপকূলে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ থেকে শুরু করে সড়ক ও রেলপথ উন্নয়নে বড় আকারের বিনিয়োগ করে। সামরিক বাহিনীর সব শাখায় অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ এবং প্রশিক্ষণ প্রদানে অংশ নেয়। তেল, গ্যাস ও খনি শিল্প, বলা যায় একচেটিয়া বিনিয়োগ আধিপত্য বিস্তার করে চীনা কোম্পানিগুলো। কিন্তু ২০০৮ সালে সীমিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচিত অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলদের কর্তৃত্বাধীন বর্তমান মিয়ানমার সরকার চীনের ওপর নজিরবিহীন নির্ভরতার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সজাগ হয়। ফলে ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে মিয়ানমার আন্তর্জাতিক সম্পর্কে একটা ভারসাম্য আনার জন্য ওপেন নীতি গ্রহণ করে এবং এনএলডি নেত্রী অং সান সু চিকে মুক্ত করে নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ করে দেয়। এতদিন মিয়ানমার বিশ্বের দুটি জনবহুল রাষ্ট্র চীন ও ভারতের 'বাফার স্টেটের ভূমিকা পালন করে আসছিল। কিন্তু এখন থেকে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নতুন সামরিক কৌশলের অংশ হিসেবে চীনের প্রভাবকে সীমিত করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও যে মিয়ানমারকে এক ধরনের বাফার স্টেট হিসেবে ব্যবহার করতে চাইবে তা সহজেই অনুমান করা যায়। সাম্প্রতিক সময়ে সমুদ্র সীমানার মতবিরোধ নিষ্পত্তিতে উইন উইন পরিস্থিতি এবং জুন মাসের প্রথমদিকে সৃষ্ট রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ সরকারের সঠিক স্ট্যান্ডের কারণে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নতুন মাত্রায় ওঠার উজ্জ্বল সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শক্তিশালী অর্থনৈতিক জোট আসিয়ানের (অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথ-ইস্ট এশিয়ান নেশন্স) সদস্য সংখ্যা মিয়ানমারসহ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১০টি রাষ্ট্র। অন্য সদস্য হলো_ ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ব্রুনাই, ভিয়েতনাম, লাওস এবং কম্বোডিয়া। এসব দেশের সঙ্গে স্থলপথে সংযোগ স্থাপনকল্পে বাংলাদেশের জন্য একমাত্র গেটওয়ে রাষ্ট্র মিয়ানমার। ৫৫ কোটি মানুষের আসিয়ান এখন বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী অঞ্চল। ফলে তাবৎ বিশ্বের আকর্ষণ ও দৃষ্টি এখন এই দেশগুলোর দিকে। পশ্চিমা বিশ্ব এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আসিয়ানের বাড়তি গুরুত্বের কারণ হলো বিশ্বশক্তি হওয়ার পথে দ্রুত ধাবমান চীন ও ভারতের অবস্থান এ অঞ্চলে। সঙ্গত কারণেই ভারত ও চীন উভয়েই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তাদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা বহু আগে থেকেই অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। আসিয়ান দেশগুলোর অভ্যন্তরে এবং উপকূলীয় অঞ্চলে তেল-গ্যাসের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। দ্রুত প্রবৃদ্ধির ফলে জনশক্তি এবং ভোগ্যপণ্যের চাহিদাও এসব দেশে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তা ছাড়া কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম এবং মিয়ানমারে কৃষি উপযোগী জমির তুলনায় জনসংখ্যা কম হওয়ায় এ দেশগুলোতে বিপুল পরিমাণ জমি অনাবাদি পড়ে থাকে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা যেভাবে বাড়ছে এবং কৃষি জমি দিন দিন যে হারে কমে যাচ্ছে তাতে ওইসব দেশে যদি বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি উদ্যোক্তারা কৃষি ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে পারে, তাহলে একদিকে যেমন বাংলাদেশের অদক্ষ জনশক্তির জন্য ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে, তেমনি আগামীতে আমাদের বাড়তি জনসংখ্যার জন্য খাদ্যশস্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিকল্প সম্ভাবনার পথ খুলে যাবে। মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া এবং লাওস ব্যাপকভাবে বনজসম্পদে সমৃদ্ধিশালী দেশ। অধিক জনসংখ্যা ও স্বল্প আয়তনের দেশ হিসেবে বাংলাদেশে বনজসম্পদের সীমাবদ্ধতা ও ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। ভবিষ্যতে ঘাটতি আরও বৃদ্ধি পাবে। এ ঘাটতি পূরণে স্থলপথে কম খরচে এসব দেশ থেকে টিম্বার ও কাঠ আমদানি করার সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের। আসিয়ান জোটের দেশগুলোর সঙ্গে বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরও সুসংহত করে অপার সম্ভাবনাময় সুযোগের সদ্ব্যবহার করার জন্য বাংলাদেশ যদি মিয়ানমারকে গেটওয়ে হিসেবে কাজে লাগাতে পারে তাহলে সেটি হবে আমাদের জন্য সহজ এবং অর্থনৈতিকভাবে অধিকতর লাভজনক। উদীয়মান বিশ্বশক্তি চীনের সঙ্গে আমাদের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক এখন বহুমুখী। স্থলপথে চীনের সঙ্গে সংযোগ সৃষ্টি করার জন্য ভায়া মিয়ানমারই সবচেয়ে সহজতর পন্থা। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের বিদ্যমান সম্পর্ককে কূটনৈতিক ভাষায় ওয়ার্কিং রিলেশন বলা যায়। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আশানুরূপ পর্যায় না থাকার বহুবিধ কারণ রয়েছে। প্রথমত. ১৯৬২ সাল থেকে মিয়ানমারে সামরিক শাসন থাকায় তারা নিজেরাই কিছুটা অন্তর্মুখী নীতি গ্রহণ করে এবং বহির্বিশ্ব থেকে মোটামুটি বিচ্ছিন্ন থাকে। শুধু চীনের সঙ্গে সামরিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং চীন অত্যন্ত দূরদৃষ্টির মাধ্যমে এ সম্পদশালী দেশটির সব ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। ১৯৬৭ সালে আসিয়ান জোট গঠিত হলেও মিয়ানমার এর সদস্য হয় অনেক পরে, ১৯৯৭ সালে। ভারত অনেক পরে মিয়ানমারের দিকে নজর দেয়। সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং মিয়ানমার সফর করেছেন। বঙ্গোপসাগরে ভারতের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের ঠিক বিপরীতে, অর্থাৎ পূর্বদিকে মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের দক্ষিণদিকে সমান্তরালভাবে প্রসারিত লম্বা লেজের মতো দেখতে ভূখণ্ডে অবস্থিত মিয়ানমারের 'দাউই' বন্দর নির্মাণ করার জন্য ভারত মিয়ানমার একমত হয়েছে। এ বন্দরের মাধ্যমে ভারত আসিয়ান জোটের অন্যান্য দেশের সঙ্গে স্থলপথে যোগাযোগ স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে। একইসঙ্গে মিয়ানমারের আকিয়াব বন্দর ব্যবহার করে ভারত তার উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের সাত প্রদেশের সঙ্গে বিকল্প পথে যোগাযোগ স্থাপনের চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। আগামী চার বছরের মধ্যে উলি্লখিত বন্দরগুলোর নির্মাণ এবং সড়ক ও রেলপথ উন্নয়নের কাজ শেষে ভারত তার পূর্বাঞ্চলের প্রদেশ এবং আসিয়ান দেশগুলোর সঙ্গে স্বল্প দূরত্বের কানেক্টিভিটি সম্পন্ন করতে চায়। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ যদি সঠিক কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে সম্ভাবনাময় কানেক্টিভিটির সঙ্গে সংযোজিত না হতে পারে তাহলে এতদাঞ্চলে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। সুতরাং এতদাঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে একটা ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা এবং আঞ্চলিক সম্ভাবনাকে নিজেদের অনুকূলে কাজে লাগানোর লক্ষ্যে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের উন্নত সম্পর্ক থাকা বাঞ্ছনীয়। এ মুহূর্তে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের পথে অন্যতম বাধা হিসেবে দাঁড়িয়েছে বহুদিন যাবৎ চলে আসা রোহিঙ্গা সমস্যা। রোহিঙ্গা হচ্ছে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে বসবাসকারী মুসলমান জনগোষ্ঠী। এই রাখাইন প্রদেশের সঙ্গে বাংলাদেশের কঙ্বাজারের স্থলসীমান্ত রয়েছে। রাখাইন রাজ্যে রাখাইন সম্প্রদায় সংখ্যাগরিষ্ঠ, যারা মূলত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। মাঝখানে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মিটার উঁচু ভিক্টোরিয়া পাহাড় দ্বারা লম্বালম্বিভাবে দাঁড়িয়ে থাকার কারণে বাদবাকি মিয়ানমারের সঙ্গে রাখাইন রাজ্যের যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনো অনেক কষ্টসাধ্য ও বিপদসংকুল। রোহিঙ্গাদের আদি নিবাস এবং তারা কোন কালে কোথা থেকে এসে এই পাহাড়ি অঞ্চলে বসতি গেড়েছে তা নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতভেদ আছে। তবে কয়েকশ বছর আগে থেকেই রোহিঙ্গারা যে এ অঞ্চলে বসবাস করছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ১৯৪৮ সালে মিয়ানমার স্বাধীন হওয়ার পরপরই এ সমস্যার উদ্ভব হয়। ভাষা, ধর্ম ও সাংস্কৃতিকভাবে বাংলাদেশের বৃহত্তম চট্টগ্রামের লোকজনের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের একটি সাদৃশ্য রয়েছে। ফলে শুরু থেকে মিয়ানমারের সব সরকার, বিশেষ করে ১৯৬২ সালের পর থেকে সামরিক সরকারগুলোর একটা সন্দেহ যে, এ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বৃহত্তর চট্টগ্রামের অধিবাসীদের সহযোগিতায় সুযোগমতো মিয়ানমার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার চেষ্টা করতে পারে। সেখান থেকেই মিয়ানমারের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ও সরকারের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের অবিশ্বাস ও সন্দেহ শুরু হয়। সরকারের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে রোহিঙ্গারা সংগঠিত হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে সীমিত আকারের সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করে। ১৯৮২ সালে সামরিক সরকার আইন করে রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। ফলে সংঘর্ষ বেড়ে যায়, বাড়ে সরকারি বাহিনীর অত্যাচার ও নির্যাতন। একটা সময় পর্যন্ত রোহিঙ্গা মিয়ানমারের আভ্যন্তরীণ সমস্যা ছিল। কিন্তু প্রথমবার ১৯৭৮ এবং দ্বিতীয়বার ১৯৯১ সালে মিয়ানমারের আধা সামরিক বাহিনী নাসাকা এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকজনের সম্মিলিত আক্রমণের ফলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ব্যাপকভাবে রোহিঙ্গাদের আগমন ঘটে। দুই দফায় প্রায় ৩-৪ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসেবে কঙ্বাজার ও টেকনাফ এলাকায় আশ্রয় নেয়। পরবর্তীতে এক থেকে দেড় লাখ শরণার্থী মিয়ানমারে ফেরত যায়। বাংলাদেশে থেকে যাওয়া রোহিঙ্গারা স্বল্পসংখ্যক নির্ধারিত শরণার্থী শিবিরে অবস্থান করলেও, বেশিরভাগই কঙ্বাজার, টেকনাফ এবং চট্টগ্রামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে নিজেদের বলয় সৃষ্টি করে নিজস্ব স্টাইলে বসবাস করতে থাকে। সত্তর দশকের শেষদিকে পাকিস্তানভিত্তিক ধর্মান্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ (হুজি) বাংলাদেশের ধর্মান্ধ গোষ্ঠী জামায়াত ও এর অঙ্গ সংগঠনের সহযোগিতায় বাংলাদেশস্থ রোহিঙ্গাদের মধ্যপ্রাচ্যের অর্থায়নে আফগানিস্তানে সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধে নিয়োজিত করে। আফগানফেরত রোহিঙ্গা যোদ্ধারা গড়ে তোলে একাধিক জঙ্গি সংগঠন, যারা রাখাইন অঞ্চলে নিজেদের দাবি আদায়ে সশস্ত্র সংগ্রামের সূচনা করে। সশস্ত্র সংগঠনের মধ্যে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (RSO); আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (ARNO) এবং আরাকান লিবারেশন ফ্রন্ট (ALF) জাতীয় বেশ কয়েকটি সংগঠন আরাকানের অভ্যন্তরে সশস্ত্র আন্দোলন চালাতে থাকে। তাদের বেশিরভাগ কার্যক্রম পরিচালিত হতো বাংলাদেশ সীমান্ত অঞ্চল থেকে। মিয়ানমারের পক্ষ থেকে অভিযোগ আছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের বেনামি জঙ্গি সংগঠন জেএমবি, জেএমজেবি, হুজি এবং পাকিস্তানভিত্তিক লস্কর-ই-তৈয়বা ও জইসী মুহাম্মদের মতো জঙ্গি সংগঠনগুলো রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্রশস্ত্র দ্বারা সক্রিয়ভাবে আরাকানের ভেতরে অপারেশন পরিচালনায় সহযোগিতা করছে। অভিযোগ আছে, 'রাবেতা আল আলম ইসলামী' নামে একটি এনজিও মধ্যপ্রাচ্যের টাকায় নানা ছদ্মবেশে রোহিঙ্গাদের মধ্যে জঙ্গি প্রশিক্ষণ ও সশস্ত্র তৎপরতায় জড়িত। এ 'রাবেতা আল ইসলামী'র বাংলাদেশি এজেন্ট বা মালিক হচ্ছেন জামায়াতে ইসলামীর একজন নেতা, যিনি সম্প্রতি একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন। অন্যদিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও আইন-শৃঙ্খলার অবনতি হচ্ছে রোহিঙ্গাদের নানারকম দুষ্কর্মের কারণে। অস্ত্র বেচাকেনা, মাদক পাচার, ডাকাতি, ছিনতাইসহ এমন কোনো অপরাধ নেই যার সঙ্গে রোহিঙ্গারা জড়িত নয়। বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে যাচ্ছে এবং সেখানে অপরাধ সংগঠনের কারণে বাংলাদেশের বদনাম হচ্ছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির বা বসতিকেন্দ্রিক জঙ্গি তৎপরতার ফলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে, অন্যদিকে একই সময়ে তা মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের পথে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে অবস্থান করলে তা মিয়ানমার ও বাংলাদেশ উভয় দেশের নিরাপত্তার জন্য বাড়তি হুমকির সৃষ্টি করবে। গত মাসে রাখাইন প্রদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় নতুনভাবে উদ্ভূত রোহিঙ্গা সমস্যা এবং তার রেশ ধরে দুদেশের সরকারের স্ট্যান্ড দেখে বোঝা যায় উভয় সরকারই উপরোক্ত সত্যটি অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছেন। মিয়ানমারের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ সপ্তাহের শুরুতে বাংলাদেশ সফর করে গেলেন।

তিনি আমাদের পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে রোহিঙ্গা ইস্যু সমাধানকল্পে ঘনিষ্ঠভাবে আলোচনা করেছেন। দু-এক মাসের মধ্যে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট জেনারেল থেইন সেইনের বাংলাদেশে আসার কথা রয়েছে। এ সুযোগে রোহিঙ্গা সমস্যাটির একটি স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করা উভয় দেশের জন্য হবে জরুরি এবং মঙ্গলজনক।

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

ই-মেইল : sikder52@gmail.com

আরাফাতের মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না


সুহা আরাফাত
আরাফাতের বিধবা স্ত্রী সুহা আরাফাত আলজাজিরার সঙ্গে এক একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তার স্বামীর মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না। তিনি এটাকে ঘৃণ্য অপরাধ বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি এবং তাদের একমাত্র মেয়ে সুইস একটি প্রতিষ্ঠিত পরীক্ষাগারে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলার সময় এর ফলাফল জানার জন্য কীভাবে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেছেন, তার আনুপূর্বিক বর্ণনা দিয়েছেন। আলজাজিরা থেকে ভাষান্তর করেছেন সুভাষ সাহা

আলজাজিরা :অনুসন্ধানের ফল জানার পর আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
সুহা :আরাফাতের রক্ত, তার পরিধেয় কাপড়-চোপড়, তার টুপি, তার চুল, অন্তর্বাস_ প্রায় সর্বত্র একই তেজস্ক্রিয় পলোনিয়াম পাওয়া গেছে। আসলে তারা উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয় পলোনিয়াম দেখতে পেয়েছেন। তার অর্থ দাঁড়ায়, আরাফাতের মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না।
এখানে আমি অপরাধ সংঘটিত হওয়া দেখতে পাচ্ছি। আর সুইজারল্যান্ডের এই পরীক্ষাগার বিশ্বের সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান। এই ফাইন্ডিংসের সঙ্গে তাদের প্রতিষ্ঠানের সুনাম রক্ষার ব্যাপারটি জড়িয়ে আছে। আর ডাক্তাররা যেটা আবিষ্কার করেছেন, সেটা লুকোছাপার কিছু নেই। এই পর্যায়ে আমরা প্রতিষ্ঠানটির বিশ্বাসযোগ্যতার প্রমাণ পাই।
আরাফাত যখন মৃত্যুবরণ করেন, সেই আট বছর আগে তার শবদেহের কোনোরকম ময়নাতদন্ত হয়নি। তাই আমরা তার মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে কিছুই জানতে পারিনি। তবে এবার যখন তার মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানের অনুরোধ নিয়ে আমার কাছে এলো, তখন আমি তাতে সম্মতি দিই। আমি তখন মনে করি যে, মৃত্যুর পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের আমার কাছে দেওয়া তার পরিধেয় কাপড়চোপড়সহ অন্যান্য জিনিস থেকে এর কিছু আলামত মিলতে পারে। আর এটা জানার পর আলজাজিরা অনেক বড় ঝুঁকি গ্রহণে সম্মত হয়। তখন সুইস পরীক্ষাগারের শরণাপন্ন হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তারা আমার মেয়ের পরীক্ষার জন্য ডিএনএ সংগ্রহ করে। এই তদন্তে মেয়ে আমার সঙ্গেই ছিল। সে প্রকাশ্যে আসতে চায়নি। তবে কীভাবে তার পিতা মৃত্যুবরণ করলেন, কেউ তাকে খুন করেছে কিনা_ সেসব জানার জন্য সে সবসময় উদগ্রীব থাকত। এ কারণেই সে তার ডিএনএ দিয়েছিল। তার ডিএনএ পাওয়ার পর তারা আমার দেওয়া কাপড়চোপড় ও জিনিসপত্র থেকে পাওয়া ডিএনএর সঙ্গে এর মিল খুঁজতে পরীক্ষা চালায়। উভয় ডিএনএর মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তখন তারা নিশ্চিত হয় যে, আমার দেওয়া কাপড়চোপড় ও জিনিসপত্র আরাফাতেরই।
আমরা নয় মাস আগে এই কাজ শুরু করি। আর এতদিন ধরে সঙ্গোপনে একটা অনুসন্ধান কাজ চালানো যে কতটা কঠিন, তা সহজেই অনুমেয়। আমাকে তার প্রতিটা জিনিস খুঁজে বের করতে হয়েছে। তার ওষুধপত্র, তার ঘড়ি_ সবকিছু। এর ফল পেতে আমাদের তিন মাস অপেক্ষা করতে হয়। কারণ, পলোনিয়ামের পরিমাণ কেমন ছিল এবং তা কতটা উচ্চমাত্রার ছিল, সেটা নির্ণয় করা কঠিন কাজ ছিল। এজন্য পরীক্ষাগারটিকে উচ্চ জটিল পরীক্ষা সম্পন্ন করতে হয়।
তারা আরাফাতের কাপড়চোপড় ও জিনিসপত্রে উচ্চমাত্রার যে পলোনিয়ামের সন্ধান পেল, সেটা স্বাভাবিক পলোনিয়াম নয়। এটা ছিল তেজস্ক্রিয় পলোনিয়াম। এ ধরনের তেজস্ক্রিয় পদার্থ সাধারণত অত্যন্ত উন্নত দেশের কাছে থাকে। আমি আসলে এর মাধ্যমে কী বোঝাতে চাইছি, সেটা খোলাসা করে বলার দরকার পড়ে না।
সুতরাং আমরা এখন তার মৃত্যুর ব্যাপারে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, তার মৃত্যুটা স্বাভাবিক ছিল না। ফিলিস্তিনি জনগণ, আরব ও গোটা মুসলিম জাহান এই সত্য জানতে পারবে।
তদন্তের এই ফল পাওয়ার পর আমি অবশ্যই এখন তার দেহাবশেষ কবর থেকে তুলে পরীক্ষার আবেদন জানাব। ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করবে বলে আশা রাখি। আর তারাও তাদের নেতার মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানতে আগ্রহী। চিকিৎসকরা বলেছেন, এতদিন পর কবর থেকে লাশ তুলে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে পলোনিয়ামের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে সেটা যদি উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয়তাসম্পন্ন হয়, তাহলেই কিছুটা পরিমাণে তার অস্তিত্ব মিললেও মিলতে পারে। সুইস চিকিৎসকরা যদিও নিশ্চিত যে, আরাফাতের মৃত্যু এই পলোনিয়াম প্রয়োগেই হয়েছিল, তারপরও বিষয়টি স্পর্শকাতর বিধায় তারা কবর থেকে তার দেহাবশেষ তুলে পরীক্ষা করার মাধ্যমে সব বিতর্কের অবসান ঘটাতে চায়। তবে তাড়াতাড়ি করাটাই ভালো বলে মনে করেন তারা। কারণ বেশি দেরি হয়ে গেলে দেহে পলোনিয়ামের অস্তিত্ব নাও মিলতে পারে।
যদি সত্যি সত্যিই আরাফাতের দেহে পলোনিয়াম প্রয়োগ করা হয়ে থাকে, তবে সব হাড়গোড়েই এর অস্তিত্ব মিলতে পারে। কারণ এটা সারা দেহে ছড়িয়ে যায়।
আমি জানি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে আন্তরিক। কিন্তু তার স্ত্রী হিসেবে আমি আমার কর্তব্য করে যাচ্ছি। আর এ ব্যাপারে চূড়ান্ত দায়টা আমি এবং আমার ১৮ বছরের মেয়ের। সুইস পরীক্ষাগার দিয়ে তদন্তের ব্যাপারে আমাদের অনুমতি ছিল। ফ্রান্স হাসপাতালে যেখানে আরাফাতের চিকিৎসা চলেছে এবং যেখানে তিনি মৃত্যুবরণ করেন, সেখানকার চিকিৎসকদের আমি সব নমুনা সংরক্ষণের জন্য বলেছিলাম। কিন্তু এবার যখন তার রক্ত ও মূত্রের নমুনা চাইতে গেলাম, আমাকে জানানো হলো, তারা সবকিছু ধ্বংস করে ফেলেছে।
আমি তাদের এই জবাবে সন্তুষ্ট হতে পারিনি। সাধারণত ইয়াসির আরাফাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির দেহের বিভিন্ন পরীক্ষার চিহ্ন তারা রাখবেই_ এটাই স্বতঃসিদ্ধ। মনে হয়, তারা এটাকে ঝামেলা মনে করেছে। এতে তারা জড়িত থাকতে চায়নি। যারা তার চিকিৎসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন এমন ৫০ জনের মতো চিকিৎসকের কাছে আমি তথ্য পাওয়ার জন্য চিঠি লিখি। এদের মধ্যে কেউ তথ্য দেন, কেউ অপারগতা প্রকাশ করেন।
আলজাজিরা :আপনার স্বামীর মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করা এবং তার ব্যবহৃত জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করাসহ গোটা অনুসন্ধান প্রক্রিয়াটায় আপনার কেমন বোধ হয়েছে?
সুহা :এটা অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক ছিল। আরও কষ্টের ছিল কারণ, এর সঙ্গে আমার মেয়েও জড়িত ছিল। আমরা তদন্তকাজ চলার সময় দেখেছি, এ নিয়ে অনেকেই আমাদের এড়িয়ে যাচ্ছেন। এ সময় আমার মেয়েকে নিয়ে বারবার হাসপাতালে ছুটে যেতে আমার মনে কষ্টকর অনুভূতি হয়েছে। আর যেহেতু প্রতিরক্ষা গোপনীয়তার সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল পলোনিয়াম, যার অনুসন্ধানে অনেক প্রতিকূলতাকে আমাদের জয় করতে হয়েছে। কারণ, যারা আমাদের তথ্য দেবে তাদের চাকরি হারানোর ভয় ছিল। তবে এটা যন্ত্রণাদায়ক হলেও আমরা আমাদের প্রতিজ্ঞায় ছিলাম অটল। আর যখন এটা পরিষ্কার হচ্ছিল যে, আরাফাতের মত্যুর সঙ্গে একটা গভীর ষড়যন্ত্র রয়েছে, ততই আমাদের চেষ্টা জোরদার হয়। আর তখনকার সময়ে আরাফাত সম্পর্কে ইসরায়েলি নেতৃবৃন্দ ও মার্কিন প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের মন্তব্য মনে করুন। দেখবেন, তারা প্রায় সবাই সমস্বরে আরাফাতকে অপ্রাসঙ্গিক ও শান্তির পথে কাঁটা বলে অভিহিত করছেন। ইসরায়েলের অ্যারিয়েল শ্যারন তো বলেছেন, ঈশ্বর আরাফাতকে তুলে নিয়ে ভালোই করেছেন। না হয় তারাই তাকে খুন করতেন। আর সে সময় আমরা চোখের জলে ভাসছিলাম।
দেখুন, একদিকে আরব বিপ্লবের একনায়কদের শাসনের অবসান ঘটছে, অন্যদিকে এই মানুষরাই দলে দলে আরাফাতের কবরে গিয়ে দোয়া পড়ছে। তাদের কাছে তিনি একজন পীরের মতো। আমরা ফিলিস্তিনের জনগণ হিসেবে এতে গর্ববোধ করি।
আমি ন্যায়বিচারে বিশ্বাস করি। জীবৎকালে বিচার না মিললেও মৃত্যুকালে তা মিলবে। আরব বিপ্লব আসলে এই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম।
আলজাজিরা :তার উত্তরাধিকার বলতে আপনি কী বোঝাতে চান?
সুহা :কোনো ভূমির স্বত্ব ত্যাগ না করা।
আলজাজিরা :আরাফাতের দেহাবশেষ কবর থেকে তুলতে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ও ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের প্রয়োজন হবে। তারা কি আপনাকে অনুমতি দেবে?
সুহা :আমি ইসরায়েলের ব্যাপারে সন্দিহান। তবে চাপ পড়লে তারাও শেষ পর্যন্ত রাজি হতে পারে। তবে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ মৃত্যুরহস্যের কিনারা দেখতে চাইবে। এটাই তো স্বাভাবিক।
আলজাজিরা :পরবর্তী পরীক্ষায়ও যদি একই ফলাফল মেলে, তাহলে ফিলিস্তিনের কোনো পরিবর্তন হবে কি?
সুহা :ফিলিস্তিনে অনেক কিছুই পরিবর্তিত হয়ে যাবে। অনেক সন্দেহ দূরীভূত হবে। কোনো কোনো মানুষ বলেন যে, আরাফাত ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি গ্রহণ করেননি। শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চাননি। তাদের মুখ বন্ধ হবে। আরাফাত আসলে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে শান্তিকে যুক্ত করেছিলেন। জেরুজালেম ছেড়ে দিয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে কোনো আলোচক শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা ভাবতে পারবেন না। তখন ১৯৬৭ সালের সীমান্ত, স্বভূমিতে প্রত্যাবর্তন, বন্দি, পানি_ সব বিষয়ই সামনে চলে আসবে।
আগামী ৫০ বছরেও কোনো আলোচনা আরাফাত যে বিশ্বাসের বীজ আমাদের মধ্যে বপন করে গেছেন, তার থেকে এক চুলও হেলাতে পারবে না। জনগণ আজ জেগে উঠছে।

রবিবার, ১ জুলাই, ২০১২

ইউরোপের উপহার : মুহাম্মদ আসাদ



॥ ড. আবু এন এম ওয়াহিদ ॥

১৯০০ সালের ২ জুলাই তৎকালীন অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির ল’ভোভে (বর্তমানে পোল্যান্ডের অন্তর্গত) এক সম্ভ্রান্ত ইহুদি পরিবারে লিওপল্ড ওয়াইস নামে মুহাম্মদ আসাদের জন্ম হয়। তার পূর্বপুরুষেরা সবাই ধর্মযাজক ছিলেন। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন তার পিতা। তিনি ছিলেন ব্যারিস্টার। ধর্ম শিা দিয়েই লেখাপড়ায় আসাদের হাতেখড়ি। অল্প বয়সেই তিনি হিব্র“ এবং অ্যারামাইক ভাষা শিখে তাওরাত, তালমুদ, মিশনা ও গেমারা বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন করেন। বাইবেল ও তারগুমেও তার স্বচ্ছন্দ বিচরণ ছিল। আসাদের বয়স যখন ১৪, তখন তার পিতা সপরিবারে ভিয়েনায় চলে যান। ওই সময় আসাদ স্কুল পালিয়ে অস্ট্রিয়ার সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। পরে অবশ্য তাকে সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলকভাবে যোগদানের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছিল, কিন্তু তত দিনে অস্ট্রিয়া সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আসাদ ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন, ইতিহাস এবং শিল্পকলা বিষয়ে লেখাপড়া শুরু করেন। ওই সময় ইউরোপের মধ্যে ভিয়েনা ছিল জ্ঞানচর্চা, নতুন ভাবনা-চিন্তার উৎকর্ষের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। আসাদ তার জিজ্ঞাসু মনের ুধা মেটাতে ভ্রমণের উদ্দেশে রওনা দেন মধ্য ইউরোপে। ঘুরতে ঘুরতে ১৯২২ সালের দিকে গিয়ে হাজির হন বার্লিনে। বার্লিনে তিনি প্রথম কোনো এক আমেরিকান নিউজ এজেন্সির অফিসে টেলিফোন অপারেটরের কাজ নেন। তারপর চাকরি পান ইউরোপের বিখ্যাত সংবাদপত্র ‘ফ্রাঙ্কফুর্টার জিটাং’-এর করেস্পন্ডেন্ট হিসেবে। প্রথম দিকে নতুন পেশায় আসাদের অন্যতম নিউজ রিপোর্ট ছিল ম্যাক্সিম গোর্কির স্ত্রীর গোপন বার্লিন মিশনের স্টোরি। তিনি সোভিয়েত রাশিয়ার হয়ে পশ্চিমাদের কাছে সাহায্য সহায়তা চাইতে গিয়েছিলেন বার্লিনে। 
রণশীল ইহুদি পরিবারে জন্ম নিয়ে যথাযথ ধর্মীয় শিার পরও তরুণ আসাদ তত দিনে ধর্মবিশ্বাসের দিক থেকে একজন সংশয়বাদী হয়ে ওঠেন। ওই বিখ্যাত সংবাদপত্রের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি ব্যাপকভাবে ফিলিস্তিন, মিসর, ট্রান্সজর্ডান, সিরিয়া, ইরান, ইরাক, আফগানিস্তান ইত্যাদি দেশ সফর করার সুযোগ পান এবং মুক্তমনে সত্য পথের অনুসন্ধান চালিয়ে যেতে থাকেন। ওই সব দেশে সাধারণ ও শিতি মুসলমানদের সাথে তার ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশার সুযোগ হয়। ফলে মুসলমান এবং ইসলামের প্রতি আসাদের আগ্রহ ও আকর্ষণ বাড়তে থাকে। তখনো তিনি মনে এক 
অন্তঃসারশূন্যতা এবং অপ্রাপ্তির গভীর বেদনা অনুভূত করতে থাকেন। আল্লাহ্ মানুষকে ওহির মাধ্যমে কিভাবে সঠিক পথ দেখাতে পারেন, এ ব্যাপারে তার মন বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে দুলতে থাকে। এ রকম মনের অবস্থায় চাচা ডোরিয়ান ওয়াইসের আমন্ত্রণে আসাদ বেড়াতে যান জেরুসালেমে। সেখানে তিনি চাচার সাথে অনেক দিন কাটান এবং সাধারণ মুসলমানদের অনেক কাছে থেকে দেখার সুযোগ পান। স্বচে দেখে তাদের জীবনযাত্রা হৃদয় দিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করেন। আসাদ মন দিয়ে বোঝার চেষ্টা করেন, কিভাবে ইসলাম ফিলিস্তিনি মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। মুসলমানদের ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা, তাদের জীবনের ওপর আধ্যাত্মিকতার প্রভাব এবং মানসিক শান্তি আসাদের মনকে বিশেষভাবে আন্দোলিত করে। অতৃপ্ত অনুসন্ধানী মন নিয়ে জেরুসালেম ছেড়ে তিনি ফিরে যান বার্লিনে। 
১৯২৬ সালে আসাদের জীবনে ঘটে এক আশ্চর্যজনক ঘটনা। ৩০ বছর পর তিনি নিজে ঘটনাটির বর্ণনা দেন এভাবেÑ ‘১৯২৬ সালের সেপ্টেম্বর। একদিন আসাদ এবং তার স্ত্রী এল্সা বার্লিনের সাবওয়েতে যাচ্ছেন। বসে আছেন একটি আপার কাস কম্পার্টমেন্টে। হঠাৎ নজর পড়ল উল্টো দিকে বসে থাকা এক সহযাত্রীর দিকে। কাপড়-চোপড় বেশভূষায় খুবই সুসজ্জিত, ফিটফাট। মনে হয় সচ্ছল ব্যবসায়ী। কিন্তু যখন তার মুখের দিকে আসাদের চোখ পড়ে, তখন তিনি লোকটির চেহারায় সুখ-শান্তির কোনো আলামত দেখতে পাননি। কেমন যেন এক অব্যক্ত যন্ত্রণা লোকটির বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে ছায়ার মতো তার চোখমুখকে অন্ধকার করে ঢেকে দিয়েছে। অন্তরের লুকানো বেদনা ফুটে উঠছে চেহারায় আর ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা দৃষ্টিতে। আসাদ আশপাশ তাকিয়ে দেখেন, সবার চোখেমুখে একই বেদনার প্রতিচ্ছবি একে একে ভেসে উঠছে। এই যন্ত্রণার উৎস তাদের হৃদয়ের এতই গভীরে, যেন নিজের অজান্তেই চোখে মুখে বেজে উঠছে তার করুণ সুর। শত চেষ্টা করেও এই বিষাদ কেউই লুকিয়ে রাখতে পারছে না বাহ্যিক চাকচিক্যের অবরণে। এতে আসাদের মনে এমনভাবে দাগ কাটল যে, তিনি ইশারায় এল্সাকে দেখালেন। এল্সার চোখে একই দৃশ্য একইভাবে ধরা পড়ল। আসাদ এল্সাকে নিয়ে বাসায় ফিরে আসেন। দেখতে পান, একখানা কুরআন শরিফ তার পড়ার টেবিলে খোলা পড়ে আছে, যা তিনি আগে থেকে পড়ছিলেন। কুরআন শরিফ হাতে নেন বন্ধ করে তুলে রাখবেন ভেবে। হঠাৎ কুরআনের খোলা পাতায় চোখ পড়ে। পড়েন একটি আয়াত : 
‘তোমরা কবরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত লোভের ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে থাকবেÑ আরো চাও, আরো চাও। অবশ্যই তোমরা যদি জানতে, অধিকন্তু, অবশ্যই তোমরা যদি জানতে, অবশ্যই তোমরা যদি নিশ্চয়তার সাথে জানতে, তোমরা দিব্য চোখে দেখতে পেতে, তোমরা কোন জাহান্নামের মধ্যে আছো। সময় এলে অবশ্যই তোমরা নিশ্চয়তার সাথে জানবে এবং শেষ বিচারের দিন তোমাদের জিজ্ঞেস করা হবে, আরামের জীবনে তোমরা কী করেছ’? (আল্ কুরআন : সূরা-১০২)।
এই আয়াত পড়ামাত্র আসাদ কিছুণের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে যান। তার কাছে মনে হয় যেন কুরআনখানা আপনা থেকেই নড়ে উঠছে তার হাতে। সাথে সাথে এল্সাকে আয়াতটি পড়তে বলেন এবং আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলে ওঠেন, ‘সাবওয়েতে মানুষদের চোখেমুখে যে বিষাদের ছবি আজ দেখেছি, এটা কি তারই উত্তর নয়’? আসাদ মনে মনে ভাবেনÑ ‘মানুষের লোভলালসা, ধনদৌলতের প্রতি আকর্ষণ নতুন কিছু নয়। সবকালে সব যুগেই ছিল। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে যান্ত্রিক পশ্চিমা সমাজে মানুষের চাওয়াপাওয়ার যে আকুতি, তার সাথে তের শ’ বছর আগের আরব বেদুঈন সমাজের কোনো তুলনা হতে পারে না। আজ পাশ্চাত্য জগতের মানুষ পাগল হয়ে বিরতিহীনভাবে অর্থবিত্তের পেছনে ছুটছে তো ছুটছে। ‘আরো চাই, আরো চাই, খাই, খাই’, ধরনের পেরেশানি সর্বদা মানুষকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। গতকাল যা পেয়েছে, আজ সে তার চেয়ে বেশি চায়। আজ যা আছে, কাল আরো বেশি পেতে চায়। তের শ’ বছর আগে, যত বিচণ আর দূরদৃষ্টিসম্পন্নই হোন না কেন, বেদুঈনদের মাঝে বেড়ে ওঠা কোনো নিরর আরব মনীষীর পে আধুনিক সভ্যতার এই সীমাহীন চাওয়াপাওয়ার হিসাব মেলানো কোনো অবস্থাতেই সম্ভব হতে পারে না। আমি সত্য খুঁজে পেয়েছি। এই আয়াত এবং এই কুরআন নিশ্চয়ই আল্লাহর বাণী’। বার্লিনের মসজিদে গিয়ে আসাদ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। মাতা-পিতার দেয়া নাম লিওপোল্ড ওয়াইস ছেড়ে নতুন নাম নেন ‘মুহাম্মদ আসাদ’। তার সাথে এল্সাও ইসলামে দীক্ষা নেন। তিনি হাইনরিক নামে সাত-আট বছরের এক ছেলেসহ এল্সাকে বিয়ে করেছিলেন। পিতার সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়। বার্লিনে সাংবাদিক জীবনের অবসান ঘটিয়ে আসাদ সপরিবারে হজব্রত পালন করতে মক্কার দিকে রওনা হন। 
মুহাম্মদ আসাদ হয়ে গেলেন এক ভিন্ন মানুষ, সম্পূর্ণরূপে এক নতুন পথের পথিক। পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান বিবেচনা করে ইসলামকে চলার পথ হিসেবে মনেপ্রাণে গ্রহণ করেন। মক্কায় আসার পর তার জীবনে ঘটল আরেক ঘটনা। মাত্র ৯ দিনের মাথায় অজ্ঞাত রোগে প্রিয়তমা স্ত্রী এল্সাকে হারিয়ে আসাদ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। তবে আল্লাহর ওপর ভরসা হারাননি এবং পবিত্র নগরী মক্কাও ছাড়েননি। তিনি নিয়মিত কা’বার লাইব্রেরিতে পড়তে যেতেন। সেখানে দৈবক্রমে একদিন আসাদের সাথে যুবরাজ ফয়সলের দেখা হলো। ফয়সল আসাদকে নিয়ে যান রাজপ্রাসাদে তার বাবা বাদশাহ আবদুল আজিজ আল্ সাউদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে। প্রথম পরিচয়েই আসাদ নিজের জ্ঞান, দূরদৃষ্টি, বিচণতা এবং অনুসন্ধিৎসু মনের দ্বারা বাদশাহর মন জয় করে ফেলেন। এভাবে রাজপ্রাসাদের দরজা আসাদের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। সেবার আসাদ একটানা ছয় বছর থাকেন মক্কায়। তিনি আরবি ভাষা রপ্ত করেছিলেন। কুরআন-হাদিস অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে পড়ে আত্মস্থ করার চেষ্টা করেন। বেদুঈনদের সাথে ঘোরাফেরা করে আরব এবং মুসলমান সংস্কৃতির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হন। হিব্র“ এবং অ্যারাশিইক জ্ঞান ও বিভিন্ন সময়ে মুসলমান দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা তার এ কাজ অনেক সহজ করে দেয়। 
মুসলমান সমাজ ও সংস্কৃতিকে আরো ভালো করে বোঝার জন্য তিনি আবার ঘুরতে বেরিয়ে পড়েন। ১৯৩২ সালে প্রথম আসেন ভারতে। আসাদের পরিচয় হয় কবি দার্শনিক আল্লামা ইকবালের সাথে। আসাদ ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও চীনের পথে যাত্রা শুরু করবেন। কিন্তু ইকবালের পরামর্শে তিনি আর ওদিকে পা বাড়াননি। পাকিস্তান আন্দোলন এবং ভবিষ্যৎ ইসলামি রাষ্ট্র গঠনে ইকবালের সাথে একযোগে কাজ করতে রাজি হয়ে আসাদ ভারতবর্ষেই রয়ে যান। ১৩৩৯ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। ১৯৩৮ সালে যদিও তিনি জার্মান পাসপোর্ট প্রত্যাখ্যান করে অস্ট্রিয়ান নাগরিকত্ব রাখতে চেয়েছিলেন, তথাপি ব্রিটিশ সরকার তাকে ‘শত্র“ নাগরিক’ গণ্য করে বন্দী করে ফেলে। প্রায় ছয় বছর জেল খেটে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ১৯৪৫ সালে মুক্তি পান। ব্রিটিশ বন্দিশিবিরে প্রায় ৩০০০ আটক ইউরোপিয়ানের মধ্যে আসাদই ছিলেন একমাত্র মুসলমান। বাকি সবাই ছিল নাৎসিদের প্রতি সহানুভূতিশীল বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশের নাগরিক।
১৯৪৭ সালের পর আসাদ পাকিস্তানের নাগরিকত্ব নিয়ে নতুন রাষ্ট্রটির গঠন প্রক্রিয়া ও সংবিধান তৈরির কাজে আত্মনিয়োগ করেন। এ পর্যায়ে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে ইসলামিক রিকনস্ট্রাকশনের পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৪৯ সালে পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে মধ্যপ্রাচ্য বিভাগে তার চাকরি স্থানান্তরিত হয়। তারপর ১৯৫২ সালে তিনি জাতিসঙ্ঘের সদর দফতরে পাকিস্তানের মিনিস্টার প্লেনিপোটেনশিয়ারি নিযুক্ত হলেন। ওই বছরই তিনি চাকরি ছেড়ে তার মাস্টার পিস ‘দ্য রোড টু মেক্কা’ লিখতে শুরু করেন। বইটি প্রথম বের হয় ১৯৫৪ সালে। এই বইয়ের বিষয়বস্তু, লেখার স্টাইল এবং সাহিত্য মান খুবই উন্নত। অনেকের বিবেচনায় এটা নোবেল পুরস্কার পাওয়ার যোগ্যতা রাখে। ‘দ্য রোড টু মেক্কার’ কাজ শেষ করে আসাদ ১৯৫৫ সালে নিউ ইয়র্ক ত্যাগ করেন। কিছু দিন সুইজারল্যান্ডে থাকার পর মরক্কোতে গিয়ে বসবাস করতে লাগলেন। মরক্কোতে বসে দীর্ঘ ১৮ বছরে তিনি তার আরেক কীর্তি পবিত্র কুরআনের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা ‘দ্য মেসেজ অব দ্য কুরআন’-এর সম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপি চূড়ান্ত করেন। এটা প্রকাশিত হয় তার মৃত্যুর অনেক পরে, ২০০৩ সালে। কাউন্সিল অব অ্যামেরিকান ইসলামিক রিলেশনস (কেয়ার) আসাদের ‘দ্য মেসেজ অব দ্য কুরআন’কে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করছে। জিন এবং মে রাজ বিষয়ে আসাদের ব্যাখ্যা ভিন্নধর্মী। শেষ জীবনে মুহাম্মদ আসাদ আশ্রয় নেন স্পেনের ঐতিহাসিক শহর গ্রানাডায়। সেখানে ৯২ বছর বয়সে ১৯৯২ সালের ২৩ ফেব্র“য়ারি তিনি পৃথিবী ছেড়ে অনন্ত যাত্রাপথে লাখো কোটি আত্মার মিছিলে শরিক হন। লেখক : অধ্যাপক, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি; সম্পাদক জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াজ; awahid@tnstate.edu