বৃহস্পতিবার, ৩১ মে, ২০১২

পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের নগ্নরূপ

কনক জ্যোতি

বিগত দুই দশকের পৃথিবীতে নিজের একক মদমত্ত শক্তিতে  পুঁজিবাদ প্রচন্ড আগ্রাসী থাবায় সবকিছু তছনছ করে দিচ্ছে। পৃথিবী এবং এর  মানব সমাজকে ভাসিয়ে দিচ্ছে যুদ্ধ, রক্ত, মৃত্যু, ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও নিপীড়নের বিভীষিকায়। পুঁজিবাদের রাজনৈতিক প্রতাপ সাম্রাজ্যবাদরূপী ভয়াল অক্টোপাসের বর্বরতায় গ্রাস করেছে মানব সভ্যতাকে। পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের একচ্ছত্র দাপটের নৃশংস ধারার নাম দেয়া হয়েছে ‘বিশ্বায়নের যুগ', যেখানে তাবৎ পৃথিবী বন্দি পশ্চিমা সভ্যতার অসভ্য আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-মনোদার্শনিক বলয়ে।
সমাজতন্ত্রের পতিত-পচা লাশের ওপর দাঁড়িয়ে বিগত নববই দশকে পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের সর্বাত্মক নবউত্থান সংঘটিত হয়। সে সময় মানবিকতা ও সাম্যের সুমহান আদর্শে বিশ্বের দেশে দেশে মানবমুক্তির মহামন্ত্ররূপে ইসলামের পুনর্জাগরণ ঘটে। সামগ্রিক জীবনব্যবস্থা হিসেবে ইসলামের সম্ভাবনাকে ঠেকাতে তখন পশ্চিমের পন্ডিতকুল এবং বিশ্বের দেশে দেশে তাদের লোকাল এজেন্টগণ ইসলামের বিরুদ্ধে তথাকথিত মৌলবাদ, জঙ্গীবাদ, ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার লেভেল লাগিয়ে ইসলামমুখী জনমতকে বিভ্রান্ত করতে সচেষ্ট হয়। তখন সেইসব জ্ঞানপাপী তারস্বরে চিৎকার করতে থাকে পুঁজিবাদের পক্ষে। বলতে থাকে, পুঁজিবাদ হলো উদার, গণতান্ত্রিক, ব্যক্তিস্বাধীনতাপন্থী ইত্যাদি ইত্যাদি। মাত্র দুই দশকেই পুঁজিবাদের দানবীয় শরীর থেকে দুর্গন্ধ বের হওয়া শুরু করেছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, পুঁজিবাদও অচিরেই ইতিহাসের অাঁস্তাকুড়ে গিয়ে সমাজতন্ত্রের পতিত-পচা লাশের পাশে ঠাঁই নেবে।
ইউরো-আমেরিকার একশ্রেণীর পন্ডিত গত দুই দশকে বিশ্বব্যাপী প্রচার চালিয়েছিলেন যে, সাম্প্রতিক সময়ের পুঁজিবাদের চেহারাটা হলো ‘মানবিক' (!)। কিন্তু তাদের সেই চড়া সুরের গান গত শতকে পুঁজিবাদ নিজেই বাতিল করে দেয় নিজ কুকর্ম দিয়ে, নিজ নির্মমতা দিয়ে, সারা দুনিয়ায় লাখ লাখ মানুষকে বেকার বানিয়ে, কোটি কোটি মানুষকে অনাহারে রেখে এবং সংখ্যাতীত নারী ও পুরুষকে যুদ্ধ, হত্যা, রক্ত, মৃত্যুর বিভীষিকার মধ্যে ফেলে দিয়ে।
বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা-এর ‘ক্ষুধা' সংক্রান্ত ২০০৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে সারা বিশ্বে একশত কোটির বেশি মানুষ খিধে পেটে ঘুমিয়েছেন। খাদ্য ও আর্থিক সঙ্কট বিশ্বব্যাপী ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা ঐতিহাসিক পর্যায়ে বাড়িয়ে তুলেছে। এই অনাহারী মানুষদের অধিকাংশেরই বাস গরিব দেশগুলোতে। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় ৬৪ কোটি ২০ লাখ, আফ্রিকার সাহারা সন্নিহিত এলাকায় ২৬ কোটি ৫০ লাখ, লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে ৫ কোটি ৩০ লাখ, নিকট-প্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় ৪ কোটি ২০ লাখ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশ হিসেবে পরিচিত দেশটিতে দীর্ঘকাল ধরে থাকা অনাহারী মানুষের সংখ্যা ছিল দেড় কোটি। 
আদি-অন্তহীন বিপুল-বিশাল বৈশ্বিক ক্ষুধার্ত মানুষের ওপর পুঁজিবাদ যখন একের পর এক আক্রমণ শাণাচ্ছে, বিশ্বায়ন তখন পুঁজিবাদের একান্ত সহযোগীর মতো দাঁড়িয়েছিল। অথচ একশ্রেণির পশ্চিমা পন্ডিত এহেন বিশ্বায়নের মাঝেই দেখেছিলেন ‘মানুষের বেঁচে থাকার জীয়নকাঠি'! আজকাল অবশ্য এ পন্ডিতরা এ বিষয়ে আর মুখ খোলেন না। ‘মানবিক' পুঁজিবাদের মতোই ‘মহান' বিশ্বায়ন এ পন্ডিতদের হাস্যকর-দালালির চেহারাটি সারা বিশ্বের সামনে নগ্নভাবে দেখিয়ে দিয়েছে।
বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মহাপরিচালক বিগত নববই'র দশকেই বলেছিলেন, ‘‘ক্ষুধাকে হটিয়ে দেয়ার অর্থনৈতিক ও কারিগরি উপায় আমাদের আছে। যা নেই, সেটা হচ্ছে, ক্ষুধা চিরতরে দূর করার রাজনৈতিক ইচ্ছা।’’ অনেক আগে, ১৯৭৪ সালে, তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হেনরি কিসিঞ্জারও প্রায় একই রকমের একটি কথা বলেছিলেন, যা ছিল কিসিঞ্জারের মুখ দিয়ে বের হওয়া স্বল্পসংখ্যক সত্য-কথার একটি: ‘‘ক্ষুধা অবসানের সামর্থ্য বিশ্বের রয়েছে। তা করায় ব্যর্থতা অক্ষমতার প্রতিফলন নয়, রাজনৈতিক ইচ্ছার অভাবেরই প্রতিফলন।’’
পুঁজিবাদ কখনওই লাভ ও ব্যবসায়িক স্বার্থবিহীন এমন কোনও রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রকাশ করে না। খাদ্যদ্রব্যের ব্যবসা ও মুনাফার জন্যেই পুঁজিবাদ বিশ্বে খাদ্যের প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম সঙ্কট চায়; ক্ষুধার্ত মানুষের বিপন্ন মুখ দেখতে চায়। ফলে গত দশক ক্ষুধা অবসানে পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার রাজনৈতিক ইচ্ছার অভাব প্রকটভাবে দেখা গেছে। পৃথিবীর নানা জায়গায় গরীবদের আয়ের অধিকাংশটুকুই খরচ করতে হয়েছে খাবার কেনায়। দশকটির শেষ ভাগে অন্যতম ঘটনা ছিল বিভিন্ন দেশে খাদ্য-দাঙ্গা। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী ২০০৮ সালে ৩৭টি দেশে খাদ্যের জন্যে দাঙ্গা হয়। হাইতির অনেক মানুষকে শুকনো বা ভিজা কাদা খেয়ে ক্ষুধা মেটাতে হয়। একই সময়কালে বিশ্বের দেশে দেশে খাদ্যদ্রব্যের দাম এত বেড়ে যায় যে, প্রায় সব দেশের সরকার বিচলিত ও শঙ্কিত হয়ে পড়ে স্থিতিনাশের আশঙ্কায়।
পুঁজিবাদের শোষণের কারণে গরীব আর দেউলিয়া মানুষ কেবল দক্ষিণ গোলার্ধের বৈশিষ্ট্য হয়ে থাকেনি; পুঁজিশাসিত বিশ্ব ব্যবস্থার কেন্দ্রস্থ দেশগুলোতেও অবস্থান করেছিল এবং এখনও করছে। যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম ভার্জিনিয়ায় ফুড স্ট্যাম্পের ওপর নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা ছিল সেখানকার মোট জনসংখ্যার ১৬ শতাংশের বেশি। সবচেয়ে বেশি ছিল সে দেশের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে, ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে ১৭.১ শতাংশ। এর এক বছর আগে এ হার ছিল ১৫.১ শতাংশ। মিসিসিপি (২০০৮ সালের জানুয়ারিতে ১৫.০ এবং ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ১৬.৬ শতাংশ), মিসৌরি একই সময়কালে যথাক্রমে ১৪.৮ এবং ১৬.৮, টেনেসি ১৪.৫ এবং ১৬.৬ শতাংশ। ইডাহোতে ফুড স্ট্যাম্পের ওপর নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা এক বছরে বেড়ে যায় ৩২ শতাংশ, নেভাডা, উটা ও ফ্লোরিডায় তা বৃদ্ধি পায় প্রায় ২৯ শতাংশ। এ পরিসংখ্যান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র কৃষি মন্ত্রণালয়ের খাদ্য ও পুষ্টি সার্ভিস। উল্লেখ করা দরকার যে, যুক্তরাষ্ট্রে দারিদ্র্য পরিমাপের একটি নির্ভরযোগ্য পন্থা হচ্ছে ফুড স্ট্যাম্পের ওপর নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা। গত দুই দশকেই যুক্তরাষ্ট্রে ‘ফুড ইনসিকিওর' বা ‘খাদ্যের দিক থেকে নিরাপত্তাহীন' এবং ‘ভেরি লো ফুড ইনসিকিওর' বা ‘খাদ্যের দিক থেকে খুবই নিরাপত্তাহীন' নামে দু'দল অতি দরিদ্র মানুষের অস্তিত্ব আর অস্বীকার করে রাখা সম্ভব হয়নি। পুঁজিবাদের সেই স্বর্গে বেঁচে থাকার জন্য দরকার এমন পরিমাণ ক্যালোরি কেনার মত অর্থ বা ঋণ এই মানুষদের ছিল না। সে দেশে গত দুই দশকের শেষ বড় দিনের উৎসবগুলোতে লঙ্গরখানায় দেখা গেছে হাজার হাজার নিরন্ন মানুষের লম্বা লাইন। কেবল টেক্সাসে ফুড স্ট্যাম্পের ওপর নির্ভর করা মানুষের সংখ্যা ছিল ৩০ লাখ। সারা যুক্তরাষ্ট্রে ফুড স্ট্যাম্প পেয়েছে প্রায় তিন কোটি ২০ লাখ আমেরিকানবাসী। অনুমান করা হয় যে, যুক্তরাষ্ট্রে আরও অন্তত এক কোটি মানুষ ফুড স্ট্যাম্প পায় না, যদিও তা তাদের দরকার। নিয়ম অনুযায়ী ফুড স্ট্যাম্পে একজন ব্যক্তি সর্বাধিক পান সপ্তাহে প্রায় ৫০ ডলার; সে হিসাবে প্রতি বেলা খাবারের জন্য সে মানুষটির কপালে বরাদ্দ হচ্ছে মাত্র দু ডলারের কিছু বেশি। আমেরিকার বাজারে দু ডলার খুবই তুচ্ছ অঙ্ক। পুঁজিবাদের মোড়ল তার নাগরিকদের এটাও দিতে পারছে না।
ধনী দেশের বিপরীতে গরীব দেশগুলোতে অবস্থা কেমন ছিল বিশ্বায়নের যুগে পুঁজিবাদের সর্বগ্রাসী এই পরিস্থিতিতে? যুদ্ধ, খরা, মহামারী ও সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদ সৃষ্ট নানা দুর্যোগের কবলে নিপতিত হয়ে দারিদ্র্য ও অনাহারের বিশ্বায়িত মানব-মুখমন্ডল বিশ্বের সর্বত্র দেখা গেছে। এমনকি, পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের প্রধান দোসর যুক্তরাজ্যও রেহাই পায়নি। যুক্তরাজ্যের মানুষের মধ্যে  অসচ্ছল হওয়ার হার ২০০৯ সালে বৃদ্ধি পায় ২৮.২ শতাংশ। পরিসংখ্যান এটাও জানিয়েছে যে, প্রতি বছরই ব্রিটেন-যুক্তরাজ্যে প্রতি ৬০ জনে একজন অসচ্ছল হয়ে পড়ে। ব্রিটিশ কোম্পানিগুলোতে দেউলিয়াত্বের লাল বাতি জ্বলার হার ছিল ৫০ শতাংশ।
পুঁজি যখন মন্দ অবস্থার মুখোমুখি হয়, তখন শ্রমের ওপরেও চাপ পড়ে। বিগত দুই দশকে এবং বর্তমানেও সেটাই দেখা যাচ্ছে। আর এটাই হচ্ছে পুঁজিবাদের ত্রুটি ও অক্ষমতার নানামুখী প্রকাশ। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ‘গ্লোবাল এমপ্লয়মেন্ট ট্রেন্ডস টু ২০০৯' শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে ২০০৯ সালে বিশ্বে পাঁচ কোটিরও বেশি মানুষ কর্মহীন-বেকার হয়েছে। সারা দুনিয়ায় তালিকাভুক্ত বেকারের সংখ্যা আইএলও-এর মতে ২৫ কোটি। পুঁজিবাদের মহাসঙ্কটের কারণে আরও ২০ কোটি মজুর চরম দারিদ্রে্যর মধ্যে চলে যাবে এবং এর ফলে ২০১০ সালটি থেকে বিশ্বে ‘শ্রমজীবী গরিবের' সংখ্যা দাঁড়াবে ১৫০ কোটি। এ সংখ্যা বিশ্বের সমগ্র শ্রমজীবী মানুষের মোট সংখ্যার অর্ধেক। ‘দ্য কস্ট অব কোআরশন' নামের আরেকটি গবেষণা প্রতিবেদনে আইএলও জানিয়েছে যে, বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে পুঁজিবাদী অর্থ ও সমাজ ব্যবস্থায় সাম্রাজ্যবাদী প্রক্রিয়ায় ‘বলপূর্বক মেহনত আদায়ের মাধ্যমে দুনিয়ার মজুরদের কাছ থেকে বছরে শোষণ করে নেওয়া হচ্ছে ২০ বিলিয়ন বা দুই হাজার কোটি ডলার'।
বিশ্বায়নের যুগে পুঁজিবাদী অর্থ ও সমাজ ব্যবস্থায় সাম্রাজ্যবাদী প্রক্রিয়ার মধ্যে আরও অনেক বীভৎস ক্ষত লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বর্তমান মহা আর্থিক সঙ্কটের ফলে পৃথিবী জুড়ে মানুষ পাচার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করেছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা। ওইসিডি-এর হিসাব অনুসারে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বেকারত্বের ৭০ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক খাতভুক্ত। আইএলও-এর তথ্য অনুসারে বিশ্বে বলপূর্বক মেহনত করানোর ৭৭ শতাংশই ঘটে এই অঞ্চলে। পূর্ব ইউরোপে শ্রম-শোষণের শিকার মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে। বেলারুশে ৮০ হাজার মানুষ ‘নিখোঁজ' বলে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। অনুমান করা হচ্ছে, এরা কাজ করার জন্য রাশিয়াসহ বিভিন্ন পার্শ্ববর্তী দেশে গেছে; কিন্তু অস্তিত্ব রক্ষার জন্য নানা স্থানে, এমনকি জেল-হাজতে ঠাঁই পেয়েছে। এদের আর কোনও স্থায়ী বা নির্দিষ্ট ঠিকানাও পাওয়া যাচ্ছে না। ইউরোপের সবচেয়ে গরিব দেশ হিসাবে পরিচিত মলদোভার এক-চতুর্থাংশ মানুষ দেশান্তরী হতে বাধ্য হয়েছে। এরা জীবিকার তাগিদে অনিশ্চিত গন্তব্যে হারিয়ে গেছে।
খোদ জাতিসংঘের কর্তারাও স্বীকার করেছেন যে, সস্তা পণ্য আর সেবার চাহিদা বিশ্বব্যাপী আধুনিক দাস ব্যবস্থার সৃষ্টি করেছে। উল্লেখ করা দরকার যে, আধুনিক কালের (বিশ্বায়নের পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী কালের) এ দাস ব্যবস্থা হচ্ছে বলপূর্বক মজুর খাটানো। জাতিসংঘের কর্তাদের আশঙ্কা যে, আর্থিত সঙ্কটের প্রতিক্রিয়ায় আরও শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কর ফাঁকি দেয়াসহ নানা বেআইনি তৎপরতার চেষ্টা চালাবে; নিজ প্রতিষ্ঠানে মজুরদের সঠিক তথ্য দেবে না; এদের বেতন ও চাকরির কোনও নিয়ম মানা হবে না। এ উদ্দেশ্যে এ সব শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে অনেক কাজ-কারবার করতে হবে অতি গোপনে বা অনৈতিক-অবৈধ পথে। আর্থিক সঙ্কটের মুখে থাকা অনেক নামকরা বহুজাতিক কোম্পানি পর্যন্ত বলপ্রয়োগ, সস্তা মজুরি, শিশু শ্রম, নারী শ্রম লুণ্ঠনসহ নানাবিধ অপকর্মে লিপ্ত হচ্ছে। আর এগুলোই হচ্ছে পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের ‘উপহার'।
ইত্যাকার কারণে পৃথিবীতে যে কোনও সময়ের চেয়ে গত দুই দশকে এবং বর্তমান সময়ে শ্রমিক অসন্তোষ তীব্রতর হয়। শ্রমিক-মজুরদের প্রতিবাদ-বিক্ষোভ বৃদ্ধি পাওয়া শোষণের তীব্রতার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়ারূপে চিহ্নিত করা যায়। অনেক জায়গায় মালিকরা মজুরদের পাওনা পারিশ্রমিক দেয়নি; অনেক জায়গায় মজুরদের বাধ্য করা হয়েছে সম্মত কর্মশর্তাবলীর চেয়ে খারাপ অবস্থায় কাজ করতে। ইউরোপের কোনও কোনও দেশে চীনা মজুররা প্রবল শোষণের মধ্যে পড়েছেন। বিদেশী মজুরদের মজুরি না দেয়া সংক্রান্ত অভিযোগ কোনও কোনও দেশে ১১১ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। চীনের শ্রম অবস্থার কারণে প্রায় দুই কোটি শ্রমিক কাজ ছেড়ে স্ব স্ব গ্রামে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। ফিলিপাইনে কাজ হারিয়েছে ১৮ লাখ মানুষ (২০০৯ সালে)। যুক্তরাষ্ট্র, জিব্রাল্টার, মিসর, ফ্রান্স, মেক্সিকো, চিলি, রাশিয়া, ভারত, গ্রীস, বাংলাদেশ এবং আরও অনেক দেশে মজুরদের বিভিন্ন ধরনের আন্দোলন ঘটে গত দশকে। যুক্তরাষ্ট্রে মজুররা কারখানা দখল করে নেয়। সেই মজুরদের প্রতি খোলা সমর্থন জানায় সমাজের সর্বস্থরের মানুষ। বিক্ষোভ কোথাও কোথাও দাঙ্গায় রূপ নেয়। এ সব দাঙ্গা ছিল পুঁজির যাত্রাপথ নিশ্চিত করতে নানা চেষ্টার বিরুদ্ধে জনমানুষের সুস্পষ্ট বিরোধিতার প্রকাশ।
পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের আরেকটি বিশ্বব্যাপ্ত নগ্নরূপ দেখা যাচ্ছে নানা ধরনের একতরফা হামলা, চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ, আগ্রাসনের রক্তাক্ত ধারা ও সামরিক-সশস্ত্র রণ-হুঙ্কার ইত্যাদি বর্বর আচরণের মাধ্যমে। চলছে বিশ্বের প্রাকৃতিক সম্পদ ও ভূ-রাজনীতিগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে দখলদারিত্ব, সামরিক তৎপরতা ও সামরিক ঘাঁটি বিস্তারের অব্যাহত ধারায়। বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসী বোমা হামলা, আফগানিস্তান ও ইরাকে আক্রমণ, পাকিস্তানে যুদ্ধের বিস্তৃতি, শ্রীলঙ্কায় সংঘাত, আফ্রিকার দেশে দেশে বিশৃক্মখলা সৃষ্টি, নানা দেশে সরকার উৎখাতের মাধ্যমে দালাল ও তাবেদারদের ক্ষমতায় বসানো, দক্ষিণ ওসেটিয়া যুদ্ধ, চেচনিয়ায় সামরিক অভিযান, দারফুরে হত্যাযজ্ঞ, কঙ্গোয় যুদ্ধ ইত্যাদি ঘটনার মাধ্যমে পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ বিশ্বের শান্তি বিনষ্ট করে চলেছে। পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ তথা পশ্চিমা ইউরো-আমেরিকান গোষ্ঠীর লাঠিয়াল বাহিনী নামে কুখ্যাত ন্যাটোর বিস্তৃতি আরও বৃদ্ধি করার মাধ্যমে সঙ্কট ও উত্তেজনাকেও বাড়িয়ে তোলা হয়। সোমালিয়ার উপকূলে নাটকীয় ও রহস্যজনকভাবে উত্থান ঘটানো হয় জলদস্যুদের। পৃথিবীর বিভিন্ন ক্ষুদ্র রাষ্ট্রকে ব্যর্থ বা আধা-ব্যর্থ রাষ্ট্রে পর্যবসিত করা হয় নানা হস্তক্ষেপ ও ইন্ধনের মাধ্যমে। বিভিন্ন সম্পদে সমৃদ্ধ রাষ্ট্রগুলোকে ব্যর্থ বা অর্ধ-ব্যর্থ লেবেল দিয়ে সেগুলোকে দুর্বল করা হয় এবং সেখানে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর হস্তক্ষেপের পথ উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। সামগ্রিকভাবে আন্তর্জাতিক লুটপাটের একটি অবাধ চারণভূমিতে পরিণত করা হয়েছে পৃথিবীকে।
ইউরো-আমেরিকার পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদী চক্রের কুকাজ সম্পর্কে আরও স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে অস্ত্র প্রতিযোগিতা ও অস্ত্র উৎপাদনের হিড়িক দেখে। বিশ্ব শান্তিপূর্ণ ও স্বাভাবিকভাবে চললে এতো অস্ত্রের প্রয়োজন হতো না। অস্ত্রের বিস্তার প্রমাণ করছে যে, পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ পৃথিবীর মানব সভ্যতার বিরুদ্ধে একটি গোপন ও অঘোষিত যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। পুরো পরিসংখ্যান জানা না গেলেও বিশ্বের একশটি বড় অস্ত্র উৎপাদন কোম্পানির অস্ত্র বিক্রির পরিমাণ ২০০৬ সালে ছিল ৩১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ৬৩ শতাংশ ছিল ৪১টি মার্কিন কোম্পানির, পশ্চিম ইউরোপের ৩৪টি কোম্পানির ছিল ২৯ শতাংশ। রুশ অস্ত্র তৈরি কোম্পানিগুলোরও বিপুল বৃদ্ধি ঘটে। উত্তর আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপীয় অস্ত্র শিল্পে ২০০৭ সালে একীভূত হওয়া ও কিনে নেয়ার ৫০টি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটে। এগুলোর মধ্যে তিনটি ছিল ইউরোপে আন্তঃসীমান্ত ও ১৬টি ছিল আন্তঃআটল্যান্টিক। আন্তঃআটল্যান্টিক একীভূত হওয়া ও কিনে নেয়ার প্রায় সবক'টি ঘটনাই ছিল ব্রিটিশ ও আমেরিকান কোম্পানিগুলোর মধ্যে। আরও সংহত আন্তঃইউরোপীয় ইউনিয়নভিত্তিক অস্ত্র শিল্প ও বাজার গড়ে তোলার জন্য অব্যাহত রাজনৈতিক ও কৌশলগত উদ্যোগ অব্যাহত ছিল এবং সেটা এখনও রয়েছে। এ লক্ষ্যে ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা সংস্থা সামরিক-রণনীতিগত দু'টি দলিলের ব্যাপারে একমতও হয়েছে। একটি হচ্ছে, ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা কারিগরি ও শিল্প ভিত্তি সংক্রান্ত। অপরটি, সামরিক গবেষণা ও প্রযুক্তি কর্মনীতি সংক্রান্ত। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৯ থেকে ২০০৮, এই সময়কালে বিশ্ব সামরিক ব্যয় ৪৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। সামরিক ব্যয়ের দিক থেকে সাম্প্রতিক সময়ে শীর্ষস্থানীয় ১০টি দেশ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, জার্মানী, জাপান, ইতালি, সৌদি আরব ও ভারত। স্টকহোমভিত্তিক ‘ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইন্সটিটিউট'-এর গবেষণা তথ্যে জানা যায় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ব্যয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে প্রকৃত অর্থে সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছিয়েছে। এর আরেকটি প্রমাণ হলো, ব্যাপকভাবে সংঘাত-গৃহযুদ্ধ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা যুদ্ধের প্রকোপ। পরিসংখ্যান জানাচ্ছে যে, ২০০৭ সালে বিশ্বের ১৩টি স্থানে ১৪টি বড় ধরনের সশস্ত্র সংঘর্ষ ঘটে। ২০০৮ সালে এসে এর সংখ্যা দাঁড়ায় ২৬টিতে। এর ফলে মানবাধিকার ও শান্তি ইতিহাসে সবচেয়ে চরম বিপদের মধ্যে পড়েছে।
পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ তাদের জীবনকে সুখী, শান্তিপূর্ণ, স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ করার জন্য সম্পদ বণ্টন ও ভোগ ব্যবস্থা থেকে বৈষম্য দূর করতে সমাজের আমূল পরিবর্তনের প্রয়াস চালায়। বিশ্বের নানা প্রান্তে এ কারণেই মানবমুক্তির মহামন্ত্ররূপে ইসলামের দ্রুত বিকাশ ঘটতে থাকে। যুদ্ধ বা বলপ্রয়োগে পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী চক্র মানুষের এই বিশ্বাস ও আস্থার জায়গাটিকে দখল করতে পারেনি। ফলে চলে অন্য খেলা। দেখা যায়, সাধারণ মানুষের পরিবর্তনমুখী বা ইসলামপ্রিয় প্রয়াসকে সরিয়ে চলতি ব্যবস্থার মধ্যেই আটকে রেখে বিদ্যমান পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী অবস্থাটি টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োগ করা হয় এনজিও-পন্থা। বৈষম্যের মূল কারণ দূর করার পথে নেয় না এ পন্থা। এ পন্থার অন্যতম পরীক্ষাগার আফ্রিকার দেশগুলো, বাংলাদেশ, নেপাল। কিন্তু সকল দেশেই এনজিও-পন্থা পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের গুচ্ছ-গুচ্ছ দালাল ও বশংবদ তৈরি করে এই বিশ্ব শোষকদের সাহায্য করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনি। প্রমাণ হয় যে, সমাজের মধ্যকার শোষণ ও অব্যবস্থা এনজিওগুলো নিরসন করতে পারেনি। বরং শোষণ ও অবস্থার দুষ্টচক্রে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারে। পাশাপাশি মানুষের মধ্যকার দেশপ্রেমিক-বিশ্বাসী-সংগ্রামশীলতাকেও ধ্বংস করে দিচ্ছে পুঁজিবাদী বিশ্বের মদদপ্রাপ্ত এনজিওগুলো।
পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমা বিশ্ব চলমান বিশ্বায়নের যে সংজ্ঞা ও সীমা নির্ধারিত করেছে, বিগত দুই দশকে পৃথিবীতে জ্বালিয়ে দিয়েছে নরকের অগ্নিকুন্ড। চলছে দুটি যুদ্ধের আগুন; সময়ের মাপকাঠিতে এই দুই যুদ্ধের আগুন, ইরাক ও আফগানিস্তান, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে দীর্ঘতর। লাখ লাখ মানুষ, যারা ঘটনাচক্রে নয়, সুনির্দিষ্ট আক্রমণের কারণে মারা যাচ্ছে, তাদের পরিচয় হলো মুসলমান। লেবানন ও মধ্যপ্রাচ্যের রক্ত আর মৃত্যু দিনে দিনে ক্লান্ত হয়ে যাওয়ায় এবং প্রতিরোধের মুখে গণঅভ্যুত্থানের দিকে চলে যাওয়ায়, পশ্চিমা বন্দুক-বোমা-আক্রমণের দিক বদল হয়েছে এক মুসলিম জনপদ থেকে আরেক মুসলিম অঞ্চলে। পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ পৃথিবী ও এর মানুষকে শোষণ ও নির্যাতন করছে---এটা খুবই সত্য কথা। কিন্তু এর চেয়ে নির্মম সত্য হলো শোষণ, নির্যাতন, আক্রমণ হচ্ছে কেবল মুসলিম অঞ্চলেই। সমাজতন্ত্রের লাশের ওপর একচ্ছত্রভাবে দাঁড়িয়ে বসনিয়ার মুসলমানদের নিধনের মাধ্যমে যার সূচনা ঘটেছিল, সেটা এখন ইরাক ও আরব বিশ্বের তেল, আফগানিস্তান থেকে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত দেশসমূহের জ্বালানি, প্রাকৃতিক সম্পদ ও ভূ-কৌশলগত অঞ্চলের অধিকার হরণের ক্ষেত্রে পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে। পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী পৃথিবীর মানচিত্রের জ্বলন্ত ও রক্তাক্ত অংশটুকুর আজকের পরিচয় হলো মুসলিম জগত।
বিশ্বায়নের পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের পৃথিবীর মানুষ দেখতে পাচ্ছে শত-শত কোটি মানুষ কান্না ও রক্তে ভেসে যাচ্ছে। ভেসে যাচ্ছে তাদের জীবন, সম্পদ, সংগ্রাম, ভূখন্ড, এমনকি, পায়ের তলার মাটিটুকুও। ভেসে যাচ্ছে তাদের পরিচয়, অস্তিত্ব, বিশ্বাস আর অধিকার। এই আক্রান্ত মানুষের মৌলিক পরিচয়, তারা মুসলমান। তাদের রক্তে ভেজা পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ আরও আরও মুনাফা ও লুটপাটের জন্য পাগলা ঘোড়ার মতো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তাবৎ বিশ্ব---যার হাত থেকে শান্তিকামী কোনও মানুষেরই রেহাই পাওয়ার সুযোগ নেই। মানুষের স্বপ্ন, সংসার, দেশ, জনপদ তছনছ করতে করতে এই উন্মাদ পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ পুরো মানব বংশকেই শোষণ ও দারিদ্রে্যর অন্ধ গহবরে ঠেলে দিচ্ছে। যুদ্ধ, উত্তেজনা, দাঙ্গা আর তাবেদার গোষ্ঠীর মাধ্যমে পৃথিবীতে সৃষ্টি করা হয়েছে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ও বীভৎস বিশৃক্মখলা। পুরো মানব সভ্যতাকেই বিষাক্ত শ্বাপদের ছোবলে ছোবলে আক্রান্ত করছে এবং গণমানুষের মুক্তি ও পুনরুত্থানের যে কোনও উদ্যোগকেই নস্যাৎ করছে পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী ইউরো-আমেরিকান চক্র। বানোয়াট পন্ডিতদের মধুর কথায় যে পুঁজিকে বলা হয়েছিল ‘মানবিক', সেই পুঁজি আসলে কতোটা শোষক, কতোটা নিপীড়ক, কতোটা নৃশংস ইতিহাস সেটা আবারও দেখতে পাচ্ছে। যেভাবে সমাজতান্ত্রিক সামাজিক-সম্প্রসারণবাদের আড়ালে মানুষকে মিথ্যা সাম্যের-স্বর্গরাজ্যের প্রলোভন দিয়েছিল সাবেক সোভিয়েট ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ; তেমনিভাবে পুঁজিবাদের রঙিন-মোহময় জগতের ভোগ ও যথেচ্ছাচারের দিকে পৃথিবীর মানুষকে এখন টানছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ইউরো-আমেরিকান পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী মতাদর্শ। কিন্তু শোষণ-নিপীড়নের ছদ্মাবরণে কোনও অমানবিক দর্শন ও আদর্শই পৃথিবীতে টিকে থাকতে পারে না---তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে। ভেঙে পড়ে নমরূদের প্রাসাদের মতো। ৭০ বছরেই ভেঙে পড়েছিল সমাজতান্ত্রিক শোষণ ও নিপীড়ন। পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদের যে বীভৎস-অমানবিক নগ্নরূপ দেখা যাচ্ছে, তাতে এহেন সভ্যতাবিনাশী আদর্শের ৭০ বছরও টিকে থাকার ক্ষমতা নেই। জাগ্রত মানুষের মুক্তির পদতলে অচিরেই কবর রচিত হবে মানবধ্বংসী পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের স্বপ্নসাধ।

ইসলামাতঙ্ক না ছড়ানোর জন্য ইহুদি বুদ্ধিজীবীর আহ্বান


॥ মঈনুল আলম ॥

অগ্রণী ইহুদি বুদ্ধিজীবী এবং যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাধিক প্রভাবশালী সংবাদপত্র নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর প্রখ্যাত কলামিস্ট রজার কোহেন। তিনি ইহুদিদের প্রতি ‘ইসলামফোবিয়া’ (ইসলামাতঙ্ক) ছড়ানোতে হাওয়া না দিতে পরামর্শ দিয়েছেন। বরং ইসরাইল কর্তৃক পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের পরাধীন করে ইসরাইলের উপনিবেশ স্থাপনের প্রয়াস ইসরাইলকে একঘরে করে ইসরাইলের অস্তিত্বকেই বিপন্ন করবে বিধায় সে সম্পর্কে হুঁশিয়ারির বুলন্দ আওয়াজ তোলার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন।
নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত ‘যে ইহুদিরা ফিসফিস করে কথা বলে’ শীর্ষক কলামে রজার কোহেন লিখেছেন, ইহুদিদের ইতিহাসে যেসব আলামত রয়েছে তা থেকে এটা পরিষ্কার যে ইহুদিরা অপর একটি জাতিকে পদ্ধতিগতভাবে পরাধীন করে রাখতে সম নয়।
কোহেন যুক্তরাজ্যে ঐতিহ্যগতভাবে যে ‘অ্যান্টিসেমিটিজম’ (ইহুদিবিদ্বেষ) চলে আসছে তার কিছু বর্ণনা দিয়েছেন : যুক্তরাজ্যে বহু ইংরেজ ইহুদি এখনো যখন তারা ইহুদি বলে পরিচয় দেয় তাদের গলার স্বর নামিয়ে ফেলে, তাদের স্বরে একটা কুণ্ঠা ভাব ধরা পড়ে। যুক্তরাজ্যে ইহুদিদের প্রতি কোনো বিদ্বেষের কারণে নয়, অতীত কাল থেকে ব্রিটিশ সমাজে ‘অ্যান্টিসেমিটিজম’-এর যে ধারা বয়ে আসছে, তারই রেশে এ রকমটা হয়। ভদ্র ও মার্জিত আচরণের ইংরেজদের মনের ‘অ্যান্টিসেমিটিজম’ প্রকাশ পায় ছোট ছোট উক্তিতে। যেমনÑ এক ইহুদি ব্যক্তিত্ব ‘হাউজ অব লর্ডস’-এ অন্তর্ভুক্ত হলে এক ইংরেজ ব্যক্তিত্ব মন্তব্য করেন, ‘অবশ্যই ওরা অত্যন্ত ধূর্ত প্রকৃতির।’ দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় কলামিস্ট জোনাথন মার্গোলিস লিখেছেন, এক ইংরেজ জমিদার তার গ্রামে সদ্য বসতি স্থাপন করা এক ইহুদি পরিবারকে তিনি কতই পছন্দ করেন তা বর্ণনায় বললেন, ‘অবশ্য, অন্য সবাই তাদের ঘৃণা করে।’
কোহেন লিখেছেন, ইহুদিদের প্রকৃত পরিচয় কি তা নির্ণয় করা জটিল এবং অনুসন্ধানের ব্যাপার। আমেরিকায় তিনি ইসরাইলের সমালোচনা করায় এবং বিশেষ করে ইসরাইলের পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপনের যা তিনি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে বলেন সমালোচনা করায় যারা স্বঘোষিতভাবে নিজেদের ‘প্রকৃত ইহুদি’ বলে জাহির করে তারা ‘যথেষ্ট ইহুদি নয়’ অথবা ‘স্বনিন্দিত ইহুদি’দের অন্যতম বলে তাকে আখ্যায়িত করে। তিনি লিখেছেন, ‘নিজে আমি একজন নিঃশব্দ এবং পরিচয় প্রকাশে বিমুখ ইহুদিরূপে চলাফেরা করতে অস্বস্তিতে ভুগি।’
তিনি লিখেছেন, যুক্তরাজ্যে বিষয়টি আরো জটিল। যুক্তরাজ্যে প্রায় তিন লাখ ইহুদি বাস করে, আর মুসলিম বাস করে বিশ লাখেরও অধিকÑ এখানে ইহুদিরা ইসরাইল-ফিলিস্তিন বিরোধ এবং ‘রাজনৈতিক ইসলাম’-এর বৃহত্তর প্রবাহে আটকা পড়েছে। কোহেন লিখেছেন, ঐতিহ্যগতভাবে যুক্তরাজ্যে ব্রিটিশ সমাজের অভিজাত স্তরেই ‘অ্যান্টিসেমিটিজম’ (ইহুদিবিদ্বেষ) বিরাজমান, সমাজের নিম্নতম স্তরে শ্রমজীবী পর্যায়ে এটা ততটা প্রকট নয়। অপর দিকে মুসলমানদের প্রতি বিরূপতা ব্রিটিশ সমাজের উচ্চতর এবং প্রাতিষ্ঠানিক স্তরে ততটা নয়, যতটা নিম্নতর স্তরে শ্রমজীবী পর্যায়ে।
কোহেন লিখেছেন, এখন বামপন্থী ইহুদিদের এক প্রচ ‘অ্যান্টিসেমিটিজম’ (ইহুদিবিদ্বেষ) মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে যা ইসরাইলকে অ্যাকাডেমিকভাবে বয়কট করার আহ্বান জানাচ্ছে। মুসলমানদের কিছু ‘অ্যান্টিসেমিটিজম’ও এর সাথে যোগ হয়েছে। তিনি লিখেছেন, ডানপন্থীরা ‘ইউরাবিয়ার (ইউরোপ আরব হয়ে যাচ্ছে) মনগড়া কাহিনী দিয়ে ‘ইসলামফোবিয়া’কে (ইসলাম আতঙ্ক) উসকে দিচ্ছে। তিনি লিখেছেন, মুসলমানেরা ইউরোপ দখল করে নিচ্ছে মর্মে যে মনগড়া কাহিনী ছড়ানো হচ্ছে তার প্রতিক্রিয়ায় নরওয়েতে এন্ডার্স ব্রেইভিক হত্যাযজ্ঞে নামে (৬৩ নরওয়েবাসীকে হত্যা করে); ‘ইউরাবিয়া’র মনগড়া প্রচারণা ইউরোপের ডানপন্থীদের উত্তেজনার রসদ হচ্ছে এবং আমেরিকানদের সঙ্কীর্ণতাবাদী গোঁড়ামিকে উসকে দিচ্ছে।
ইহুদিদের উদার মুক্তবুদ্ধিবাদের দিকে পরিচালিত করার জন্য কারা নেতৃত্ব দেবে? এ প্রশ্নে কলামিস্ট কোহেন ইসরাইলের ‘নেসেট’ (সংসদ) সদস্য যারা ইউরোপের ডানপন্থী নেতাদের সাথে বৈঠক করেছে তাদের নেতৃত্বকে বাতিল করে দেন এই কারণে যে, তারা ‘যেহেতু উভয় গ্রুপই মুসলমানদের সমভাবে ঘৃণা করে সেহেতু উভয় গ্রুপ পরস্পরের দোসর’ এই অদ্ভুত হাস্যকর ধারণার ভিত্তিতে বৈঠকটা করেছে। তিনি ইহুদি লেখিকা মেলানি ফিলিপসের সমালোচনা করেন ‘লন্ডনিস্তান’ নামীয় বইটি প্রণয়ন ও প্রকাশ করার জন্য, যে বইটি ‘ইসলামফোবস’দের (ইসলামাতঙ্কগ্রস্ত) জন্য একটি কেতাবে পরিণত হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে কোহেন লন্ডনের কিংস কলেজে আইনের অধ্যাপক মালিহা মালিক তাকে যে সমান্তরাল উদাহরণ দেখিয়েছেন তা উল্লেখ করেন : এক শতাব্দী আগে ১৯১১ সালে ‘সিডনি স্ট্রিট দখল’ আন্দোলনে লন্ডনের ইস্ট অ্যান্ড এলাকার ইহুদিদের ‘বলশেভিক’ (রাশিয়ান কমিউনিস্ট) বলে আখ্যায়িত করে বলা হয়েছিল যে, এরা ‘বহিরাগত চরমপন্থী’। ব্রিটেনের বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী, ইতিহাসবিদ এবং সর্বাধিক খ্যাত প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন, ‘ইহুদিরা হচ্ছে সারা বিশ্বে সভ্যতাকে উৎখাত করে প্রতিবন্ধী পন্থায় সমাজকে পুনর্গঠন করার বিশ্বব্যাপী এক ষড়যন্ত্রেরই একটা অংশ।’ কোহেন লিখেছেন, এসব থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, এত সব নিন্দনীয় ভূমিকার বোঝায় ভারাক্রান্ত ইতিহাস নিয়ে ইহুদিরা অন্য কোনো জাতিকে পদ্ধতিবদ্ধভাবে নির্যাতনকারীর ভূমিকা গ্রহণ করতে পারবে না। তাই ‘ইসলামফোবিয়া’য় (ইসলামাতঙ্ক) হাওয়া দেয়া থেকে ইহুদিদের সক্রিয়ভাবে বিরত হতে হবে এবং পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের পরাধীন করে সেখানে ইসরাইলের উপনিবেশ স্থাপন প্রয়াসের বিরুদ্ধে প্রচ ভাবে সোচ্চার হতে হবে।
লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক, কলামিস্ট
moyeenulalam@hotmail.com

জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের সামনে কী?

লন্ডন সুপ্রিম কোর্টের বাইরে অ্যাসাঞ্জের ভক্তদের প্রতিবাদ লন্ডন সুপ্রিম কোর্টের বাইরে অ্যাসাঞ্জের ভক্তদের প্রতিবাদ
মশিউল আলম | তারিখ: ০১-০৬-২০১২

উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, পরিপূর্ণ স্বচ্ছতার পক্ষে লড়াকু সাইবার-যোদ্ধা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে যাঁরা ভালোবাসেন, গত মঙ্গলবার ব্রিটিশ সুপ্রিম কোর্টের রায় শুনে তাঁরা উদ্বিগ্ন হয়ে ভাবছেন, অ্যাসাঞ্জের এখন কী হবে?
আর যাঁরা এই ‘হ্যাকার’কে মনে করেন ‘মোস্ট ডেঞ্জারাস ম্যান ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’, তাঁকে আল-কায়েদার জঙ্গিদের মতো গুলি করে মারতে চান, গুয়ানতানামো কারাগারে পাঠাতে চান, গুপ্তচরবৃত্তি-সংক্রান্ত আইনের আওতায় বিচার করে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করতে চান, তাঁরা উৎফুল্লমনে ভাবছেন, এই তো বেটাকে বাগে পাওয়া গেছে!
গত মঙ্গলবার সকালে ব্রিটেনের সর্বোচ্চ আদালতের সাতজন বিচারকের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ রায় দিয়েছে, জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে ইউরোপীয় প্রত্যর্পণ চুক্তির আওতায় যুক্তরাজ্য থেকে সুইডেনে প্রত্যর্পণে কোনো আইনি বাধা নেই। তাই এখন মনে করা হচ্ছে, সুইডিশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের আঠারো মাসের দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের একটি পর্যায় শেষ হতে চলেছে। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ এখন তাঁকে সুইডিশ কর্তৃপক্ষের হাতে প্রত্যর্পণ করবে। সুইডেনে অ্যাসাঞ্জকে লড়তে হবে দুই নারীর বিরুদ্ধে; যাঁরা তাঁর বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। কিন্তু অ্যাসাঞ্জের দুর্ভাগ্য, তাঁরাই তাঁর বিরুদ্ধে যৌন অসদাচরণের অভিযোগ তুলে মামলা ঠুকে দিয়েছেন। অবশ্য তাঁদের অভিযোগের সত্য-মিথ্যা নির্ধারণ করা ব্রিটেনের সুপ্রিম কোর্টের কাজ ছিল না। সুপ্রিম কোর্টের বিচার্য ছিল, অ্যাসাঞ্জকে সুইডেনে পাঠানোয় কোনো আইনি বাধা আছে কি না।
দুই সাবেক ভক্ত তরুণীর দায়ের করা মামলায় সুইডিশ প্রসিকিউটর অফিস ২০১০ সালের নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে ইউরোপীয় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। অ্যাসাঞ্জ তখন লন্ডনে, ব্রিটিশ পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। অ্যাসাঞ্জ লুকিয়ে থাকতে বেশ পারঙ্গম। শেষে ইন্টারপোলের ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়ান্টেড লিস্টে’ প্রচার করা হয় তাঁর নাম: আন্তর্জাতিক হুলিয়া। অ্যাসাঞ্জ তখনো পলাতক। কারণ, তাঁর বিশ্বাস, যৌন অসদাচরণের অভিযোগ আসলে অজুহাত। সুইডিশ কর্তৃপক্ষ তাঁকে পেতে চায় আমেরিকার হাতে তুলে দিতে। কারণ, আমেরিকানদের কাছে তিনি তত দিনে হয়ে উঠেছেন বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক ব্যক্তি। ইরাক ও আফগানিস্তানের যুদ্ধে মার্কিন সেনাদের বর্বরতার প্রত্যক্ষ বিবরণ-সংবলিত যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পাঠানো ‘ফিল্ড রিপোর্ট’ আর সারা বিশ্বের মার্কিন দূতাবাস ও কূটনৈতিক মিশনগুলোর গোপন তারবার্তা—সব মিলিয়ে প্রায় পাঁচ লাখ গোপন নথিপত্র—উইকিলিকসের মাধ্যমে ইন্টারনেটে ফাঁস করে দিয়ে অ্যাসাঞ্জ পরিণত হয়েছেন আমেরিকার এক নম্বর শত্রুতে। তাই, তাঁর ধারণা, আমেরিকা সুইডেনকে দিয়ে তাঁকে পাকড়াও করে নিয়ে যাবে; মার্কিন গুপ্তচরবৃত্তি-সংক্রান্ত আইনের আওতায় বিচার করবে, যার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
তাই লন্ডনে অ্যাসাঞ্জ আত্মগোপনে চলে যান। একপর্যায়ে লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশ অ্যাসাঞ্জের আইনজীবীদের বলে, অ্যাসাঞ্জ যেন সুইডিশ মামলাটির বিষয়ে কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে তাদের সঙ্গে দেখা করেন। ২০১০ সালের ৬ ডিসেম্বর অ্যাসাঞ্জ তাঁর আইনজীবীদের সঙ্গে নিয়ে লন্ডনের এক থানায় যান পুলিশের প্রশ্নের জবাব দিতে। কিন্তু পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে এক ওয়েস্টমিনস্টার ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে। অ্যাসাঞ্জের আইনজীবীরা তাঁর জামিনের আবেদন করেন, কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট নামঞ্জুর করেন। তার পরের ১০ দিন অ্যাসাঞ্জকে কাটাতে হয় দাগি কয়েদির পোশাক পরে লন্ডনের ওয়ান্ডসওয়ার্থ কারাগারে। ১৭ ডিসেম্বর তাঁকে এমন শর্তে জামিন দেওয়া হয়, তিনি লন্ডনের আশপাশেই থাকবেন, প্রতিদিন নিকটস্থ থানায় সশরীরে গিয়ে খাতায় সই করে আসবেন। তাঁর পায়ের গোড়ালিতে সব সময় বাঁধা থাকবে একটা ইলেকট্রনিক ট্যাগ। সেই থেকে আজ প্রায় ১৮ মাস জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ এক অদ্ভুত গৃহবন্দী, যাঁর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়নি।
ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট আদালত অ্যাসাঞ্জকে জামিন দেয়নি। অ্যাসাঞ্জ আপিল করেছেন হাইকোর্টে। হাইকোর্ট নিম্ন আদালতের রায় বহাল রেখেছে। অ্যাসাঞ্জ তারপর গেছেন সুপ্রিম কোর্টে। সুপ্রিম কোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে পর পর দুই দিন শুনানি হলো গত ফেব্রুয়ারিতে। কিন্তু রায় সঙ্গে সঙ্গে দেওয়া হলো না। সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে বলা হলো, বিচারপতিরা সময় নেবেন। কত সময়? সপ্তাহ চারেক। কিন্তু চার সপ্তাহ নয়, চার মাস পেরোনোর পর রায় এল। পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের সাত বিচারপতির মধ্যে পাঁচজন ভোট দিয়েছেন প্রত্যর্পণের পক্ষে, দুজন বিপক্ষে। বিচারপতিদের সভাপতি নিকোলাস ফিলিপস রায় ঘোষণা করার পর সাংবাদিকদের বলেছেন, অ্যাসাঞ্জের বিষয়টা নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছা মোটেও সহজ ছিল না।
আসলে, এই আঠারো মাস ধরে আইনি বিতর্ক চলেছে মূলত একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে। অ্যাসাঞ্জের যৌনতা-বিষয়ক অভিযোগের সঙ্গে সেটার কোনো সম্পর্কই নেই। বিষয়টা হলো, অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে ইউরোপীয় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিলেন সুইডেনের পাবলিক প্রসিকিউটর। অ্যাসাঞ্জকে যুক্তরাজ্য থেকে সুইডেনে প্রত্যর্পণের আবেদনও করেছেন তিনিই। প্রশ্ন হলো, একজন প্রসিকিউটরের কি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা এবং আসামি প্রত্যর্পণের দাবি জানানোর এখতিয়ার আছে? ইউরোপীয় প্রত্যর্পণ চুক্তির একটি ধারা বলে, প্রত্যর্পণ মামলা দায়ের করতে পারবেন শুধু ‘কমপিটেন্ট জুডিশিয়াল অথরিটি’ বা যথাযথ বিচারিক কর্তৃপক্ষ। সুইডিশ পাবলিক প্রসিকিউটর এই ক্ষেত্রে যথাযথ বিচারিক কর্তৃপক্ষ হিসেবে বিবেচিত হবেন কি না—এই প্রশ্নেরই সুরাহা হচ্ছিল না এতটা সময় ধরে। অ্যাসাঞ্জের পক্ষের আইনজীবীরা বরাবর বলার চেষ্টা করেছেন, সুইডিশ পাবলিক প্রসিকিউটর যথাযথ বিচারিক কর্তৃপক্ষ হতে পারেন না; কারণ তিনি অভিযোগকারীদের পক্ষ নিয়ে বিচার করার আগেই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দণ্ড দিতে চান, তিনি বিচারকের ভূমিকা পালন করতে পারেন না। অর্থাৎ, আইন প্রয়োগকারী ও বিচারক একই কর্তৃপক্ষ হতে পারে না।
অ্যাসাঞ্জের আইনজীবীদের এ যুক্তি ব্রিটিশ সুপ্রিম কোর্টে শেষ পর্যন্ত টিকল না। তবে অ্যাসাঞ্জের আইনজীবীরা রায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টকে চ্যালেঞ্জ করবেন বলে অ্যাসাঞ্জের প্রত্যর্পণ দুই সপ্তাহের জন্য স্থগিত রাখার আর্জিসহ একটি ‘জরুরি আবেদন’ জানালে সুপ্রিম কোর্ট সেটা মঞ্জুর করেছে। অর্থাৎ, অ্যাসাঞ্জকে এখনই সুইডেনে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে না। সামনে আরও দুই সপ্তাহ সময় আছে। এর মধ্যে অ্যাসাঞ্জের আইনজীবীরা এ রায়ের বিরুদ্ধে আরও কিছু যুক্তিতর্ক, বক্তব্য তুলে ধরবেন। সেসবও যদি ধোপে না টেকে, তাহলে অ্যাসাঞ্জের সামনে থাকবে আরও একটা ধাপ: তিনি আপিল করবেন ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালতে। ইউরোপীয় আদালত ১৪ দিনের মধ্যে তাদের সিদ্ধান্ত জানাবে। অর্থাৎ, মোট আরও এক মাস অ্যাসাঞ্জ লন্ডনেই থাকছেন।
কিন্তু তারপর? অ্যাসাঞ্জকে তো শেষ পর্যন্ত সুইডেনে যেতেই হবে। সেখানে তাঁকে মুখোমুখি হতে হবে তাঁর সাবেক ভক্ত দুই তরুণীর তোলা সেই সব অপ্রীতিকর অভিযোগের। তার চেয়েও গুরুতর বিষয় হলো, ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ যখন তাঁকে সুইডিশ কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেবে, তখন সুইডিশ কর্তৃপক্ষ তাঁকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাবে কারাগারে। যে মামলার তদন্ত এখনো শুরুই হয়নি, কবে সেই মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে, কত দিন ধরে তার শুনানি চলবে, কে জানে। আর এই পুরোটা সময় অ্যাসাঞ্জকে কাটাতে হবে সুইডেনের কারাগারে; ব্রিটেনের মতো গৃহবন্দী হিসেবে নয়, পুরোপুরি কারাবন্দী হিসেবে। আর, নিউইয়র্ক টাইমস-এর দুই প্রতিবেদক জন এফ বার্নস ও রবি সোমাইয়া, যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ ও উইকিলিকস নিয়ে রিপোর্ট করছেন, তাঁরা যে রকম আভাস দিচ্ছেন, তাতে শঙ্কা হচ্ছে, অ্যাসাঞ্জের সামনে আরও বড় বিপদ অপেক্ষা করছে। স্ট্র্যাটফোর নামের এক মার্কিন বেসরকারি গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যভান্ডার থেকে উইকিলিকসের ফাঁস করা গোপন ই-মেইল থেকে আভাস পাওয়া যাচ্ছে, অ্যাসাঞ্জকে সুইডেন থেকে আমেরিকায় নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ভেতরে ভেতরে কী কী তৎপরতা চলছে। মঙ্গলবার ব্রিটিশ সুপ্রিম কোর্টের রায় ঘোষণার পর উইকিলিকস তাদের ওয়েবসাইটে একটি আনুষ্ঠানিক বিবৃতি প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হচ্ছে, জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে একযোগে তৎপর হয়ে উঠেছে ব্রিটেন, সুইডেন ও আমেরিকা। এমনকি তাঁর স্বদেশ অস্ট্রেলিয়ার সরকারও ওই তিনটি দেশের সরকারের সঙ্গে যোগ দিয়েছে।
মশিউল আলম: সাংবাদিক
mashiul.alam@gmail.com

মঙ্গলবার, ২৯ মে, ২০১২

অং সান সু চি: একটি ভালোবাসার গল্প


ফারুক চৌধুরী | তারিখ: ৩০-০৫-২০১২
আমাদের এ অঞ্চলের অনেক দেশের মতো বার্মার (মিয়ানমার) স্বাধীনতাও এসেছে রক্তঝরা পথে। জেনারেল অং সান ছিলেন সেই দেশের মুক্তিযুদ্ধে অগ্রণী ভূমিকা রাখা মুক্তিযোদ্ধা, যাঁর একনিষ্ঠ নেতৃত্ব ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের ৪ জানুয়ারি ১৯৪৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে সেই দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করতে বাধ্য করেছিল। কিন্তু দুঃখের কথা এই যে মিয়ানমারের স্বাধীনতা লাভের মাত্র ছয় মাস আগে, ১৯৪৭-এর জুলাই মাসে তাঁকে অন্য বেশ কজন সহযোগীর সঙ্গে প্রাণ হারাতে হলো, সশস্ত্র কিছু বিভ্রান্ত সৈনিকের অতর্কিত আক্রমণে। তখন জেনারেল অং সানের পরিবারের তৃতীয় সন্তান ও একমাত্র মেয়ে অং সান সু চির বয়স মাত্র দুই। ফুটফুটে, গৌরবর্ণা, সুদর্শনা এ মেয়েটির ঘটা করে নাম রাখা হয়েছিল তাঁর বাবা ‘অং সান’, পিতামহী ‘সু’ আর মা ‘চি’-এর নাম মিলিয়ে—অং সান সু চি। দুই বছর বয়সেই মেয়েটি হলো পিতৃহারা। এই নিবন্ধটি এই মেয়েটির অদম্য সাহস আর অনাবিল ভালোবাসার বিষাদ মাখা বিজয়েরই একটি হূদয় নিংড়ানো বিরল কাহিনি। 
স্বামীর মৃত্যুর পর পরিবারের হাল ধরে রাখলেন অং সান সু চির মা খিন চি। নব্যস্বাধীন এই দেশটির কর্মকাণ্ডে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখলেন, একসময়ে রেঙ্গুন জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র নার্স আর বীর মুক্তিযোদ্ধা অং সানের স্ত্রী, খিন চি। তাঁর ভূমিকার স্বীকৃতিতে সরকার ১৯৬০ সালে তাঁকে ভারতে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত করল। তাঁর একমাত্র মেয়ে, কিশোরী অং সান সু চি নয়াদিল্লিতেই তাঁর স্কুলশিক্ষা শেষ করলেন এবং দিল্লির বিখ্যাত লেডি শ্রীরাম কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করলেন ১৯৬৪ সালে। তখন তাঁর বয়স মাত্র উনিশ।
একটি ব্রিটিশ পরিবারের সঙ্গে অন্তরঙ্গতা ও বন্ধুত্ব প্রভাবিত করল; এক অর্থে ঘুরিয়ে দিল তাঁর জীবনের মোড়। ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত লর্ড পল গোর-বুথ নামক একজন পেশাদার কূটনীতিক মিয়ানমারে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ভারতে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেন ১৯৫৬ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত। ১৯৬০ সালেই অং সান সু চির মা নয়াদিল্লিতে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হলেন। প্রথমে রেঙ্গুনে আর তারপর আবার দেখা নয়াদিল্লিতে। এভাবেই এই দুই পরিবারের মধ্যে গড়ে উঠল সম্পর্ক ও ঘনিষ্ঠতা।
১৯৬৪ সালে অং সান সু চি অক্সফোর্ডের সেন্ট হিউজ কলেজে তাঁর স্নাতক ডিগ্রি লাভের জন্য ভর্তি হলেন এবং সেই সময়ে বিলেতে অং সান সু চির অভিভাবক ছিলেন লর্ড পল গোর-বুথ। এই লর্ড পল গোর-বুথের লন্ডনের বাড়িতেই অং সান সু চির দেখা হলো মাইকেল এরিস বলে একজন যুবকের সঙ্গে, যিনি ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের ছাত্র ছিলেন। প্রাচ্য, বিশেষ করে ভুটান সম্পর্কে মাইকেল এরিসের ছিল অসীম আগ্রহ। সু চির মধ্যেই যেন মাইকেল এরিস খুঁজে পেলেন প্রাচ্যের প্রতি তাঁর আকর্ষণের মূর্ত প্রকাশ। পরিচয় পরিণত হলো ভালোবাসায়। সু চি তখন অক্সফোর্ডের সেন্ট হিউজ কলেজের ছাত্রী। সেই অক্সফোর্ডের রয়েছে ছায়াঘেরা নিরিবিলি নান্দনিক অ্যাডিসন ওয়াক। যে পথে তাঁদের নিজ নিজ সময়ে বিচরণ ছিল সি এস লুইস, ওসকার ওয়াইল্ড আর লরেন্স অব অ্যারাবিয়ার মতো স্বনামধন্য কত মানুষের। সেই পথেই মাইকেল এরিস আর অং সান সু চি ঘুরে বেড়াতেন, পথটির মাঝপথে পাথরের তৈরি বেঞ্চে বসে তাঁরা অবলোকন করতেন আকাশকে রাঙিয়ে দিয়ে অদূরের মডলিন কলেজের টাওয়ারটির ওধারে সূর্যের ডুবে যাওয়া। প্রাচ্য আর পাশ্চাত্য মিশে যেত সূর্যডুবা আকাশের সেই রক্তিম আভায়। ২০১১ সালে অক্সফোর্ডের সেন্ট হিউজ কলেজের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী পালিত হলো। সেই উপলক্ষে অং সান সু চি তাঁর পাঠানো এক বাণীতে বলেছিলেন, ‘সুখের মুহূর্তগুলোই দুঃখে সাহস জোগায়। সেন্ট হিউজ আর অক্সফোর্ড আমার স্মৃতিতে চির অমলিন। চারধারে পৃথিবী যখন আঁধার হয়ে আসে, সেই স্মৃতি থেকেই আমি বিশ্বের শোভা আহরণ করি।’ অং সান সু চির অক্সফোর্ডের পালা শেষ হলো। তখন মাইকেল এরিস ভুটানের রাজপরিবারের সদস্যদের শিক্ষক হিসেবে এবং সেই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুবাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। সেই ভুটানেই মাইকেল এরিস অং সান সু চির পাণিপ্রার্থী হলেন। মাইকেল এরিসের কথায়, তাঁদের বিয়ের আগে আট মাসে সু চি তাঁকে ১৮৭টি চিঠি লিখেছিলেন। সেই সব চিঠিতে প্রায়ই একটি কথা থাকত যে যদি অং সান সু চির মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার কোনোদিন প্রয়োজন পড়ে, তাহলে কোনো দাবির নিরিখে নয়, অনুগ্রহ হিসেবেই মাইকেল এরিস যেন তাঁকে সেখানে যেতে দেন। কিন্তু সেই যাওয়া যে একদিন চিরদিনের জন্য হবে, তা তো ভালোবাসার গভীরতায় তাঁদের কল্পনাতেও ছিল না।
১৯৭২-এর ১ জানুয়ারি তাঁদের বিয়ে হলো। নববিবাহিত দম্পতি ঘুরে বেড়ালেন, ভুটান, নেপাল, অরুণাচল আর হিমাচল প্রদেশে। তাঁদের বিয়ে হয়েছিল সেই অঞ্চলের শীতের তুষার শুভ্রতায়। কিন্তু বসন্তে সেই অঞ্চল ফুলে ফুলে সমৃদ্ধ। আপেল আর চেরি ফুলের সম্ভার। হাইবাসকাস ফুলের ঝালর। ‘উদ্ধত যত শাখার শিখরে রডোডেনড্রনগুচ্ছ’, আর হেমন্তে সেই অঞ্চল ফলভারে পরিপক্ব। আপেল, পিচ, চেরি, নাশপাতি, প্লাম। ফলের অবিশ্বাস্য প্রাচুর্য। এর মাঝেই প্রগাঢ় হলো এই দম্পতিটির প্রেম। অক্সফোর্ডে ফিরে গেলেন তাঁরা। মাইকেল এরিস তখন অক্সফোর্ডের সেন্ট এনথনি কলেজের রিসার্চ ফেলো। তার পরের ১৬টি বছর অং সান সু চি আদর্শ গৃহবধূর জীবন যাপন করলেন। তাঁদের দুই সন্তান আলেকজান্ডার আর কিমকে বড় করে তোলার দায়িত্ব নিজ হাতে নিলেন। তাঁদের নিয়ে ঘুরে বেড়ালেন জাপান আর ভারত। এদিকে নিজের লেখাপড়াও অব্যাহত রাখলেন তিনি এবং উচ্চতর ডিগ্রির জন্য ভর্তি হলেন লন্ডন স্কুল অব ওরিয়েন্টাল স্টাডিজে। অক্সফোর্ডের প্রশান্ত সেই পরিবেশে জ্ঞানপিপাসু এই দম্পতিটির নিরিবিলি জীবন ছিল একান্তই উপভোগ্য।
১৯৮৮ সালের ৩১ মার্চের সন্ধ্যা। তাঁদের অক্সফোর্ডের বাড়িতে টেলিফোন বাজল। রেঙ্গুন থেকে পাওয়া এই টেলিফোনে তাঁরা জানলেন যে অং সান সু চির মা খিন চির স্ট্রোক হয়েছে। টেলিফোন পাওয়ার পরপরই একটি স্যুটকেসে কাপড় গুছিয়ে রেঙ্গুনে প্লেন ধরলেন অং সান সু চি। মাইকেল এরিস আর অং সান সু চি তখন কল্পনাই করেননি যে এই যাওয়াই তাঁদের স্বাভাবিক দাম্পত্যজীবনের অবসান ঘটাবে, ইতি টানবে তাঁদের শান্তি-সুখের জীবনের।
রেঙ্গুনে ফিরে অং সান সু চি দেখলেন যে তাঁর দেশে এক অশান্ত পরিবেশ বিরাজ করছে। সামরিক বাহিনীর সঙ্গে গণতন্ত্রকামী জনতার সংঘর্ষ দেশের স্বাভাবিক জীবন অচল করে দিয়েছে। তাঁর মা যে হাসপাতালে ছিলেন, তা ভরে গেছে আহত আর মুমূর্ষূ ছাত্র-জনতার ভিড়ে। অং সান সু চির মিয়ানমার প্রত্যাবর্তনের খবর ছড়িয়ে পড়ল চারধারে। মুক্তিযাদ্ধা বীর অং সানের মেয়ে অং সান সু চি। তাঁর কাছে অসহায় মানুষের প্রত্যাশা অনেক। মিয়ানমারের শিক্ষাবিদদের একটি প্রতিনিধিদল তাঁকে দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার আহ্বান জানাল। এই আবেদন অং সান সু চি কিছুতেই প্রত্যাখ্যান করতে পারলেন না। তিনি সেই দায়িত্ব গ্রহণ করতে রাজি হলেন এবং ২৪টি বছর সব ঘাত-প্রতিঘাতের মাঝেও এই লৌহমানবী তাঁর দায়িত্ব পালনে এখনো আছেন অবিচল।
অক্সফোর্ডে বসে মাইকেল এরিসের ভয় যে তাঁর বাবার মতো অং সান সু চিকে যেন আততায়ীর হাতে প্রাণ হারাতে না হয়। ১৯৮৯ সালে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা তাদের দমন-পীড়নের নীতিতে অং সান সু চিকে গৃহবন্দী করল। তাতে হাঁফ ছেড়েই যেন বাঁচলেন মাইকেল এরিস, এই ভেবে যে তা অন্তত তাঁর স্ত্রীর জীবনটি রক্ষা করবে। এদিকে মাইকেল এরিসও পাশ্চাত্যে মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কথা তুলে ধরতে সচেষ্ট রইলেন। ১৯৯০ সালে মিয়ানমারে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। তাতে ৮২ শতাংশ আসনে জয়লাভ করল অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফল কোনো আমলেই আনল না মিয়ানমারের সামরিক শাসকচক্র। সংগ্রামে অটল রইলেন অং সান সু চি। কখনো বা তাঁকে ঢিলেভাবে গৃহবন্দী করে রাখা হলো, কখনো বা চরম নির্মমতায়। বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিন্ন করে দেওয়া হলো। অং সান সু চির সংগ্রাম সারা পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ১৯৯০ সালেই তিনি রাফটো মানবাধিকার পুরস্কার লাভ করলেন। ১৯৯১ সালে সু চি ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সাখারভ মানবাধিকার পুরস্কার পেলেন। সেই বছরের অক্টোবরেই লাভ করলেন নোবেল শান্তি পুরস্কার। তিনি তাঁর ১ দশমিক ৩ মিলিয়ন ডলারের সেই পুরস্কারটি মিয়ানমারের জনগণের জন্য স্বাস্থ্য ও শিক্ষাক্ষেত্রে ট্রাস্ট গঠনে ব্যবহার করবেন বলে ঘোষণা দিলেন। তাঁর স্বামী মাইকেল এরিস সেই বছরগুলোতে তাঁর দুই সন্তানকে দেখাশোনা করার সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করলেন। ১৯৯১-এ সু চির নোবেল পুরস্কার পাওয়ার বছরে মাইকেল এরিস যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসরের দায়িত্ব পালন করছিলেন।
১৯৯৫ সালের ক্রিসমাসের সময়ে মাইকেল এরিস তাঁর স্ত্রীর কাছ থেকে পেলেন একটি অপ্রত্যাশিত টেলিফোন। সামরিক জান্তা তাঁকে মুক্তি দিয়েছে এবং মাইকেল এরিস আর তাঁর দুই সন্তানকে মিয়ামনমারের ভিসা দেওয়া হয়েছে। ছোট ছেলে কিমকে দেখে তো অং সান সু চি বলেই ফেললেন যে বাড়ন্ত তাঁর ছেলেটিকে এতই অপরিচিত লাগছে যে রাস্তায় দেখা হলে তিনি তাঁর পাশ কাটিয়ে যেতেন। অবশ্য এটা সবার কাছে স্পষ্ট ছিল যে সামরিক জান্তার সু চিকে মুক্তি আর তাঁর পরিবারকে ভিসা দেওয়ার উদ্দেশ্য একটিই। তা হলো, অং সান সু চি তাঁদের সঙ্গেই ফিরে যাবেন। কিন্তু অং সান সু চি গণতন্ত্রের জন্য তাঁর সংগ্রামে এতই জড়িত এবং তাঁর প্রত্যয় এতই দৃঢ় যে তিনি স্থির করলেন, কিছুতেই দেশত্যাগ করবেন না। তা করলে তাঁকে আর ফিরতে দেবে না সামরিক জান্তা। তাই পরিবারের সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ যতই দীর্ঘায়িত হোক না কেন, রেঙ্গুনেই তাঁর অবস্থানে তিনি অনড় রইলেন। ১৯৯৫ সালে মিয়ানমারে তাঁর পরিবারের সেই সফরটিই ছিল স্বামী মাইকেল এরিসের সঙ্গে অং সান সু চির শেষ দেখা।
১৯৯৮ সালে মাইকেল এরিস জানলেন যে তাঁর প্রোস্টেট ক্যানসার হয়েছে এবং তা অন্তিম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। তিনি রেঙ্গুন গিয়ে তাঁর স্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নিতে চাইলেন। ভিসার জন্য অন্তত ৩০ বার তিনি আবেদন করলেন। মিয়ানমার সরকার তা প্রত্যাখ্যান করল। পোপ এবং প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনও মাইকেল এরিসকে ভিসা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন। তাও উপেক্ষিত হলো। অং সান সু চিকে বলা হলো, তিনি অক্সফোর্ডে গিয়ে তাঁর স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে পারবেন। সু চি জানতেন যে তাঁর দেশত্যাগ মানেই নির্বাসন। সু চি তাঁর স্বামীকে ব্রিটিশ দূতাবাস থেকে টেলিফোন করতেন। মাইকেল এরিসও তাঁকে দেশত্যাগ না করার জন্য বলতেন এই কারণে যে তাহলে তাঁর আর দেশে ফেরা হবে না। গণতন্ত্রের জন্য অং সান সু চির আত্মত্যাগ তাহলে ভেস্তে যাবে। সু চির সামনে তখন প্রশ্ন একটি। স্বামী না দেশ। অং সান সু চি নিজেই বলেছেন যে তাঁর প্রতি স্বামীর গভীর ভালোবাসা আর সহমর্মিতাই তাঁকে দেশত্যাগ না করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। আর দেখা হলো না অসাধারণ এই স্বামী আর তাঁর সংগ্রামী স্ত্রীর। ১৯৯৯ সালের ২৭ মার্চ তাঁর ৫৩তম জন্মদিনে মাইকেল এরিস শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। মাইকেল এরিসের মৃত্যুর কদিন আগে সু চি যখন নিশ্চিত যে স্বামীর সঙ্গে আর তাঁর দেখা হবে না কোনোদিন, ব্রিটিশ দূতাবাসে গিয়ে তিনি শেষ বিদায় জানিয়ে একটি ফিল্ম রেকর্ড করেছিলেন। সেদিন তাঁর পরনে ছিল তাঁর স্বামীর প্রিয় রঙের পোশাক আর খোঁপায় গোঁজা ছিল লাল গোলাপ। কিন্তু নিয়তি এতই নির্মম যে ফিল্মটি বিলেত পৌঁছাল মাইকেল এরিসের মৃত্যুর দুই দিন পরে।
এদিকে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা দেশের গণতন্ত্রায়ণে পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে। এই বছর অর্থাৎ ২০১২ সালের এপ্রিলের ১ তারিখে মিয়ানমার পার্লামেন্টের দুই কক্ষের ৪৬টি আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তার মধ্যে সু চির ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি ৪৪টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৪৩টিতে বিজয়ী হয়েছে। অং সান সু চি মিয়ানমারের ৪৪০ সদস্যের প্রতিনিধি সভায় (হাউস অপ রিপ্রেজেনটেটিভস) সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন এবং ২ মে, ২০১২ সালে শপথ গ্রহণ করেছেন। ঘোষণা করা হয়েছে যে অবশেষে ২৪ বছর পর অং সান সু চি মিয়ানমারের বাইরে পা রাখবেন। তিনি ব্যাংককে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম পূর্ব এশিয়ার সভায় অংশ নেওয়ার জন্য ব্যাংকক যাবেন ৩০ মে। মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট থেইন সেইনও সেই সভায় যোগ দেবেন। এই মাসেই সু চিকে পাসপোর্ট প্রদান করা হয়েছে। এতে মনে হচ্ছে যে মিয়ানমার সরকারের সংস্কার পদক্ষেপগুলো সম্বন্ধে অং সান সু চি এখন আস্থাবান। তাই তিনি এই যাত্রায় দেশত্যাগ করতে দ্বিধা করছেন না।
তারপর রয়েছে নাটকীয় আর পরিতৃপ্তিদায়ক কিছু খবর। জানা গেছে, আগামী ১৬ জুন অং সান সু চি নরওয়ের অলসোতে যাবেন, ১৯৯১ সালে তাঁকে প্রদত্ত নোবেল পুরস্কার নিজ হাতে গ্রহণ করতে। কিন্তু তার চেয়েও হূদয়ছোঁয়া আর সন্তুষ্টির খবর হচ্ছে, আগামী ২০ জুন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করবে। ২৪ বছর আগে ১৯৮৮ সালে তাঁর মায়ের অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে তিনি অক্সফোর্ড ত্যাগ করেছিলেন। চিরদিনের জন্য তাঁর অজান্তে যবনিকা পড়েছিল তাঁর স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবনের। তাঁকে অক্সফোর্ডের ডিগ্রি প্রদানের তাৎপর্যটি অবশ্যই হূদয় ছুঁয়ে যায়। তাঁর স্বামী বিলেতে চিরনিদ্রায় শায়িত। সেই দেশের প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরনের আমন্ত্রণে তিনি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভাষণ দেবেন ২১ জুন। বেঁচে থাকলে মাইকেল এরিসের বয়স মাত্র ৬৬ বছর হতো। তাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভাষণ দেওয়ার সন্তুটির সঙ্গে অং সান সু চির মনে মিশে থাকবে তাঁর বন্দী অবস্থায় স্বামী হারানোর বেদনা।
মিয়ানমারে গণতন্ত্রের বিবর্তন সম্বন্ধে শেষকথা বলার সময় হয়তো আসেনি। ১৯৮৮ সালে অং সান সু চি বলেছিলেন, ‘আমার বাবার কন্যা হিসেবে আমার দেশে যা ঘটবে তা সম্বন্ধে আমি উদাসীন থাকতে পারি না।’ কিছুদিন আগে তিনি বলেছেন, ‘আমরা সতর্ক, তবে আশাবাদী।’ যদি এখন মিয়ানমারে শুধু নির্বাচন নয়, অর্থবহ গণতন্ত্র আর মানবাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়, তাহলে অর্জনের মাপকাঠিতে আমাদের সময়ের রাজনৈতিক বিবর্তনের ইতিহাসে অং সান সু চির স্থান নেলসন ম্যান্ডেলার পাশেই হয়তো রইবে।
তবে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, মিয়ানমারের মানুষের মুক্তির সংগ্রামে আপাতত ভালোবাসার জয় হয়েছে। দেশের প্রতি অসীম সাহসী অং সান সু চির অনাবিল ভালোবাসার আর জয় হয়েছে অং সান সু চির প্রতি তাঁর অসাধারণ স্বামী মাইকেল এরিসের সহমর্মী ভালোবাসার।
ফারুক চৌধুরী: সাবেক পররাষ্ট্রসচিব। কলাম লেখক। 
zaaf@bdmail.net

পাকিস্তান শেষ কার্ডও খেলেছে


মোহাম্মদ তাকী
ন্যাটো সরবরাহে পাকিস্তানের অবরোধ আরোপ অনেকটা রাস্তায় শিশু-কিশোরদের ক্রিকেট খেলার মতো। সেখানে দেখা যায়, একজন ছেলে হয়তো বল বা ব্যাটের মালিক। খেলার ফলাফল ওর পছন্দ না হলে সে সেখান থেকে তার বল বা ব্যাট নিয়ে চলে যেতে পারে অবলীলায়। ভাবখানা এই, দেখি তোমরা আমার বল বা ব্যাট ছাড়া কী করে খেলা খেলতে পার! রাস্তার খেলায় অবশ্য কখনও কখনও এ ধরনের আবদার চলতে পারে। কিন্তু সেখানেও বাদবাকি খেলোয়াড়রা তাৎক্ষণিকভাবে বিকল্প ব্যবস্থা করে ফেললে এ ধরনের কৌশলে কাজ দেয় না। আফগানিস্তানে ন্যাটো সরবরাহের দুই-তৃতীয়াংশের মতো পাকিস্তানের রুট ব্যবহার করেই সম্পন্ন হচ্ছিল। তবে রুটটা সস্তাও নয়। আমার কাছে ন্যাটোর একজন শীর্ষস্থানীয় সরবরাহকারী বলেছেন, এক বোতল পানির দাম যেখানে ফ্লোরিডায় ৫০ সেন্টের মতো পড়ে, সেখানে পাকিস্তানি রুট ব্যবহার করে ওই পানি আফগানিস্তান পর্যন্ত পেঁৗছতে এর দাম উঠে আট ডলারের মতো। পাকিস্তান এই নেটওয়ার্ক যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অপরিহার্য মনে করে রাস্তার ছেলেদের ক্রিকেট খেলার মতো আচরণ করছে।
তবে শিকাগোতে অনুষ্ঠিত ন্যাটোর শীর্ষ বৈঠক পাকিস্তানের অপরিহার্যতার তত্ত্বকে অসার প্রমাণ করেছে। ন্যাটো এখন লাতভিয়া থেকে রাশিয়া, কাজাখস্তান, উজবেকিস্তানের ভেতর দিয়ে কিরঘিস্তানের বিশেখ ও তাজিকিস্তান হয়ে সড়ক রুটটি বেশি করে ব্যবহার করতে চাইছে। এখানে তুরস্ক হয়ে এবং জর্জিয়ার কৃষ্ণসাগর বন্দর সুবিধা ব্যবহারেরও সুযোগ রয়েছে। এই রুটটি দীর্ঘ; কিন্তু নিরাপদ বিকল্প। পাকিস্তান তার ভেতর দিয়ে ন্যাটো সরবরাহ পেঁৗছানোর পথকে বিকল্পহীন মনে করে নীতি প্রণয়নে বড় রকমের ভুল করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য বিকল্প কার্ড তার হাতে আর নেই।
শিকাগো বৈঠক পর্যন্ত পাকিস্তানি সার্কেলের এই চিন্তা বিভ্রম বজায় থাকাটা সত্যিই বিস্ময়ের। ন্যাটো শীর্ষ বৈঠকের কয়েকদিন আগে নাসিম জেহরা ফরেন পলিসি আফপাক চ্যানেলে লেখেন : প্রথমত, শিকাগো বৈঠকের প্রাক্কালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারির সঙ্গে বৈঠকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তাৎক্ষণিক ক্ষমা চাইবেন। দ্বিতীয়ত, পরিকল্পিত গোয়েন্দা বিমান হামলার আগে যুক্তরাষ্ট্র তাদের হামলার টার্গেট, কী কারণে হামলা চালানো হবে, কোন এলাকায় হামলা চালানো হবে, হামলার সংখ্যা কত হবে_ ইত্যাকার বিষয় পাকিস্তান কর্তৃপক্ষকে অবহিত করবে। তৃতীয়ত, পাকিস্তানি সরবরাহ রুট ব্যবহারের ফি নির্ধারণের ব্যাপারে উভয়পক্ষ অধিকতর গ্রহণযোগ্য অর্থ ধার্যে একমত হবে। চতুর্থত, সালালার মতো আর কোনো ঘটনা ঘটবে না এটা ন্যাটোকে নিশ্চয়তা দিতে হবে। এটা একজন প্রধান শিক্ষিকার তার ছাত্রদের সংশোধনের উদ্দেশ্যে শাস্তি দেওয়ার মতো মনে হয় না!
সত্যিকথা বলতে কি, পাকিস্তানের অধিকাংশ বিশ্লেষক ও যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত কূটনীতিক তাদের চাহিদাপত্র প্রস্তুত করার ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সত্যিকার মনোভাব কী তা অনুধাবন করতে পারেননি। বিষয়টা এমন নয় যে, একবার ভুল হয়ে গেছে, এবারের মতো মাফ করে দিন আর ভুল হবে না_ এমনটা বললেই সব সংকটের অবসান ঘটে যাবে। এ ক্ষেত্রে ন্যাটো ও যুক্তরাষ্ট্রের জবাবটা সাদামাটা হতে পারে। তারা পাকিস্তানি বিতরণ রুটকে বাদ দিয়ে ব্যয়বহুল রুট ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। পাকিস্তানি রুট ব্যবহার করতে গেলে তাদের অর্থ গুনলেই চলবে না, এর জন্য ক্ষমা ভিক্ষাও করতে হবে। আর বিকল্প রুট ব্যবহার করলে ক্ষমা-ঘেন্না কিছুই নেই, বাড়তি কিছু অর্থ লাগবে এই যা। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এবং তার উপদেষ্টামণ্ডলী সেই পুরনো ধ্যান-ধারণা এখনও লালন করে চলেছেন। কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যেন বলেছিলেন, পাকিস্তানের যুক্তরাষ্ট্রকে যতটা প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তানকে প্রয়োজন। তিনি সাংবাদিক/ফটোগ্রাফার মার্গারেট বুরকি-হোয়াইটকে আরও বলেছিলেন, পাকিস্তান বিশ্বের একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা... এখান থেকে রাশিয়া খুব দূরে নয়। আর যুক্তরাষ্ট্রের এখন উত্থান ঘটছে। যুক্তরাষ্ট্র এখন যেমন গ্রিস ও তুরস্ককে শক্তিআলী করার জন্য কাঁড়ি কাঁড়ি ডলার ঢালছে, তেমনি একটা সময় আসবে যখন পাকিস্তানে অস্ত্র ও অর্থ সাহায্য দিতে তারা এগিয়ে আসবে। পাকিস্তানি চিন্তাধারায় দীর্ঘ ৬৫ বছরেও তেমন পরিবর্তন আসেনি। তবে যেটা পরিবর্তন হয়েছে সেটা হলো, পাকিস্তান এখন আর ভূরাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে নেই।

ড. মোহাম্মদ তাকীর লেখাটি আউটলুক থেকে ভাষান্তর করেছেন সুভাষ সাহা

সোমবার, ২৮ মে, ২০১২

ন্যাটোর রূপান্তর প্রয়োজন



 ড. আহমদ আনিসুর রহমান 
ন্যাটো (N.A.T.O.)-এর উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক হচ্ছে। আর দুরু দুরু বুক কাঁপছে অনেকেরই—না জানি ন্যাটো এবার আবার কোথায় এ্যাকশন নেয়। কিভাবে কোথায়। কি পর্যায়ের। এ ভয় শুধু যারা ন্যাটো এ্যাকশনের মুখোমুখি পড়বে যেসব সমাজ সেখানকার লোকদেরই নয়—খোদ ন্যাটো সদস্য দেশের লোকদেরও। তাদের সন্তানেরা কোথায় কিভাবে ন্যাটো এ্যাকশনে প্রেরিত হতে পারে—যুদ্ধে বুঝতে তাদের করের টাকা কোথায় কোন বিদেশি যুদ্ধের আগুনে নিক্ষিপ্ত হয়। আবার ন্যাটো এ্যাকশনের মাধ্যমে কোথায় কোনখানে কোন অঘটনঘটন পটীয়সীদের দমন করে দীঘমেয়াদি শান্তির রক্ষা হয়। সেদিকেও খেয়াল অনেকের। আর ন্যাটো এ্যাকশনে প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও রসদ সরবরাহে মুনাফার আশা নিয়েও হিসেব-কেতাব অস্ত্র ও রসদ ব্যবসায়ীদের। এ্যাকশনের ক্ষেত্রভূমি ঘিরেও তেল থেকে তুলা—বহুরকম ব্যবসায়ের সম্ভাবনার হিসাব আবার অন্যদের। এ্যাকশন বলে কথা—ন্যাটোর এ্যাকশন।
এই ন্যাটোকে নিয়েই—N.A.T.O., No Action Talk only বলে রসিকতা করা হতো। আজকে ন্যাটোর এ্যাকশন-এর পর এ্যাকশন— আফগানিস্তান থেকে লিবিয়া পর্যন্ত। তার মুখে ন্যাটো নিয়ে ওমন রসিকতার সুযোগ আর নেই। এটা কি ন্যাটোর অলসতা ঝেড়ে ফেলে অবশেষে কর্মচঞ্চল হয়ে ওঠার লক্ষণ? বাস্তবে না। বাস্তব হলো, এটা ন্যাটোর চরিত্রের মৌলিক পরিবর্তনের খবর। ন্যাটো তার মূল চরিত্র বদলে এখন পুরনো বোতলে নতুন মদসম—এই মদের মদিরা আলাদা, মাতলামোও ভিন্ন।
চরিত্রগতভাবে ন্যাটোর মূলত মৌলিকভাবেই No Action Talk only হবার কথা ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কিছুটা পরেই ন্যাটো উত্তর অ্যাটলান্টিক মহাসমুদ্রের দুপাশের মিত্র শক্তিসমূহের, মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর পশ্চিম ইউরোপের মিত্রশক্তিসমূহের আঁতাত হিসেবে সৃষ্ট হয়। যুদ্ধ করতে নয়—যুদ্ধের প্রতিষেধক হিসেবে। যুদ্ধের যে বিভীষিকা থেকে পশ্চিম ইউরোপকে মিত্রবাহিনীর চার বছরের প্রতিরক্ষামূলক প্রতিযুদ্ধ বের করে আনে, সেই বিভীষিকায় যাতে পশ্চিম ইউরোপকে আবার পড়তে না হয় তার ব্যবস্থা হিসেবে। জার্মানীর নাত্সী সরকার কর্তৃক সূচিত সেই ভয়াবহ যুদ্ধকে ঠেকাতে পশ্চিম ইউরোপের দরকার হয়েছিল পশ্চিমে অ্যাটলান্টিক পারের যুক্তরাষ্ট্র, পূর্বে জার্মানীর পূর্বপ্রান্তের বিজয়াভিযান ঠেকানো সোভিয়েট ইউনিয়ন, আর ভারতবর্ষ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য আর চীনের ঔপনিবেশিক আর আধা ঔপনিবেশিক শাসনাধীন সেইসব জনগণের যাদের পক্ষে পশ্চিম ইউরোপীয়দের প্রতিপক্ষে জার্মানী-জাপানের অক্ষশক্তির পক্ষে যাওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। নানা কূটনৈতিক-রাজনৈতিক লেনা-দেনার প্রতিজ্ঞা-প্রতিশ্রুতির কেনা-বেচার মাধ্যমে ভারতবর্ষ, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া আর চীনের জনগণের রাজনৈতিক সাহায্য আদায় করে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েট ইউনিয়নের সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ নিয়ে পশ্চিম ইউরোপ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আত্মরক্ষা করে। এশিয়ার জাপানের সমর্থনপুষ্ট মধ্য ইউরোপীয় জার্মানীর বিজয়মূলক যুদ্ধাভিযানের ধ্বংসলীলা থেকে। কিন্তু ঐ যুদ্ধ শেষ হবার আগেই দেখা দেয় আরো দুই যুদ্ধের লক্ষণ—সোভিয়েট ইউনিয়ন আর চীনের কম্যুনিস্ট আর দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের ঔপনিবেশিক শাসনাধীন জাতিসমূহের পরস্পর সহায়ক পশ্চিম ইউরোপ-বিরোধী নতুনতর আরেক যুদ্ধের। সোভিয়েট ইউনিয়নের সরাসরি যুদ্ধ আর এশীয় জনগণের ‘গণযুদ্ধের’ মুখে পশ্চিম ইউরোপের টিকে থাকবার একমাত্র আশা-ভরসা হিসেবে দেখা দেয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সাগরপারের হওয়ার কারণেই অনেকটা প্রায় অক্ষত থেকে যাওয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। উপনিবেশসমূহ ছুটে গেলে পশ্চিম ইউরোপের বৃটেন ফ্রান্সের মতো পুচকে পুচকে রাজ্যের ইতিমধ্যেই বিধ্বস্ত অর্থনীতিতে মার্কিন আর্থিক সাহায্য আর তাদের খেয়ে ফেলবার জন্য হা করে তেড়ে আসা বিশাল সোভিয়েট সামরিক শক্তির বিপক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নবতারুণ্যমণ্ডিত, আণবিক বোমা সমন্বিত সমরশক্তি—এ দুই ছিল দৃশ্যমান ভরসা। ঐ ভরসার ওপর ভর করে ডুবন্ত পশ্চিম ইউরোপ হাত বাড়ায় অ্যাটলান্টিক পারের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে। বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়বার হুমকি দেয়া যে সোভিয়েট সমর্থিত যুদ্ধবাজ কম্যুনিজম—যার সমর্থন খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরকার শ্রমিক শ্রেণী আর কৃষ্ণাঙ্গ সংখ্যালঘুর ভেতরও মনে হচ্ছিল—তাকে স্বোপকূলে সজোরে পৌঁছবার পূর্বেই প্রতিরোধের প্রয়োজন যুক্তরাষ্ট্রও অনুভব করে। দু’পক্ষেরই এই কম্যুনিজম পরিচালিত বিস্তৃততর বিশ্বযুদ্ধ ঠেকানোর কাজে সাক্ষাত্ স্বার্থ দু’পক্ষকে একত্র করে উত্তর অ্যাটলান্টিক চুক্তি সংঘ (N.A.T.O.) প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী করে। ঐ সংঘের উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধ করা নয়—যুদ্ধ ঠেকানো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পরিস্থিতিতে সামরিক মৈত্রী চুক্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত ন্যাটোর মতো একটি সামরিক রাজ্যসংঘের পক্ষে যুদ্ধ না করে যুদ্ধ ঠেকানো সম্ভব ছিল। যুদ্ধ নয়— যুদ্ধের প্রতিপক্ষে যুদ্ধ থেকেও ভয়ংকর পরিণতি প্রদানের ইচ্ছাশক্তির প্রকাশের মাধ্যমে ‘ডিটারেন্স’ দিয়ে। উচ্চতর আণবিক যুদ্ধাস্ত্রের মালিকানার মাধ্যমে ঐ পরিণতি প্রদানের ক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রের তখন ছিল। ন্যাটো প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ছিল সোভিয়েত্ ইউনিয়নকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিত্রতার মাধ্যমে যে কোন অগ্রযাত্রামূলক যুদ্ধের প্রতিপক্ষে ঐরূপ পরিণতির দৃশ্যমান হুমকি দিয়ে রাখা, মাত্র কয়েকদিন পূর্বে জাপানে আণবিক বোমা দিয়ে যে ধ্বংসলীলা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সংঘটন করে দেখিয়েছিল তা সোভিয়েত শাসক ও জনগণের ভুলে যাবার কথা ছিল না। ঐ দৃশ্যমান হুমকিতে কাজ হয়েছিল।   সোভিয়েত কম্যুনিস্ট বাহিনীর অগ্রযাত্রা মধ্য ইউরোপ পর্যন্ত এসেই থমকে দাঁড়িয়েছিল। এভাবে কম্যুনিজমের সমরশক্তিকে ঠেকিয়ে রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিপুল অর্থসাহায্যে পশ্চিম ইউরোপের যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে আবার এমনকি পূর্বের চেয়েও বেশি চাঙ্গা করে তুলে যেখানে কম্যুনিজমের গরীবীর মাধ্যমে অগ্রযাত্রার রাজনৈতিক পথও রুদ্ধ করা হয় ন্যাটোর হুমকিনির্ভর সামরিক প্রতিরক্ষার ছত্রছায়ায়।
এই ছিল ন্যাটোর মূল উদ্দেশ্য ও মূল চরিত্র। যুদ্ধ না করে যুদ্ধ ঠেকিয়ে রাখবার জন্য দাঁড় করিয়ে রাখা একটি দৃশ্যমান যন্ত্র বিশেষ। তার No Action Talk only  হবারই কথা ছিল কিন্তু সেই No Action Talk only গত অস্তিত্ব ও উপস্থিতিই ছিল পশ্চিম ইউরোপকে সোভিয়েত সমরাভিযানের যুদ্ধ থেকে রক্ষা করবার মোক্ষম উপায়।
বিংশ শতাব্দীর শেষপ্রান্ত নাগাদ সোভিয়েত ইউনিয়ন বিধ্বস্ত হয়, চীনে কম্যুনিস্ট বিশ্ব বিজয়বাদীদেরও হয় তিরোধান। এমতাবস্থায় পশ্চিম ইউরোপকে কম্যুনিস্ট বিশ্বের বিজয়াভিযানমূলক ঘোষিত যুদ্ধ থেকে বাঁচাবার জন্য ন্যাটোর আর দরকার থাকে না। সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন কম্যুনিস্ট বাহিনী পুঞ্জের পঙ্গপালকে ভয় দেখিয়ে থামিয়ে রাখা হস্তিবাহিনীস্বরূপ ন্যাটো এবার অর্থহীন অথচ প্রতুল ব্যয়বহুল এক শ্বেতহস্তিতে পরিণত হয়। একে নিয়ে কি করা? এই চিন্তা থেকেই ন্যাটোর মূল চরিত্র— No Action Talk only ভিত্তিক একটি কার্যকর ভয় দেখানো (deterrant) শক্তি থেকে বদলে অনেকটা No Action Talk only গত এমন একটি যুদ্ধবাজ সমিতিতে পরিণত করা হয় সম্প্রতি, যা তার মূল কার্যক্ষেত্র, উত্তর আটলান্টিক ছেড়ে বহু দূর মধ্য এশিয়ায় আফগানিস্তানে এসে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। সেখান থেকে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে লিবিয়ায়। তারপর না জানি কোথায় জড়াবে। হয়ত সিরিয়ায়, ইরানে। এসব জায়গাই উত্তর আটলান্টিক থেকে অনেক দূরে। কম্যুনিস্টদের এখানে গন্ধ বাতাস নেই। আর যেসব সন্ত্রাসী দমনে ন্যাটোর মত এক বিশাল সমরযন্ত্র অত বড় বড় অভিযান করছে-সেসব সন্ত্রাসীদের যে স্বাভাবিক সমরাভিযানে (Conventional War fare-এ) পরাস্ত করা কোনদিনই সম্ভব নয়।
তাদের গেরিলাযুদ্ধের চরিত্রের কারণেই তা সমরবিদমাত্রই জানেন। ন্যাটোর সমরবিদগণ ত অবশ্যই। ঐ সন্ত্রাসদমনমূলক যুদ্ধের সার্থক উপায় ও লুসিয়াল পাই-এর মত মার্কিন বিশেষজ্ঞরাই অনেক আগেই দিয়েছেন-তা যে সমরাভিযান নয় বরং মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ তাও সমরবিদদের জানা। আর যেইসব শকুন ছানার মত পুঁচকে পুঁচকে স্বৈরাচারী শাসকদের-গণতন্ত্রের স্বার্থে ধ্বংস করবার জন্য ন্যাটোর মত এমন বিশাল সমরযন্ত্রের ভয়ংকর বিশাল সমরাভিযান আজকের প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সহায়তায় তাদের এক ছো মেরে তুলে নিয়ে আসা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক সরকারের পক্ষেই সম্ভব। তার জন্য অত বড় যুদ্ধায়োজনের দরকার হয় না- অত লক্ষ লক্ষ নিরীহ সাধারণ মানুষের যুদ্ধগত ভোগান্তিরও দরকার হয় না, তাহলে ন্যাটোর এতসব যুদ্ধগত তোড়জোড় কেন? ‘এই কেন’-এর সম্ভাব্য উত্তর বেশ কয়েকটিই হতে পারে। তার বিবরণে বিশ্লেষণে এখানে নাই বা গেলাম। কিন্তু ন্যাটোর এই বিশাল অপচয়মূলক ও ভয়ংকর এই অনেকটা অযথা অ্যাকশন প্রবণ হয়ে পড়ার সমাধান দরকার। সেই সমাধানের প্রথম পদক্ষেপ হবে-যেই পরিস্থিতিও যেই সাক্ষাত্ সমর (Conventional War) গত কারণে আদিতে ন্যাটোর প্রতিষ্ঠা তা যেহেতু আর নেই সেহেতু সাক্ষাত্ সমর (Conventional War) গত এক সামরিক বাহিনীপুঞ্জ হিসেবে ন্যাটোরও প্রয়োজন আর উপযোগ আজ ফুরিয়েছে তা অনুধাবন করা। এই অনুধাবনের পথ ধরে ন্যাটোকে হয় তুলে দিতে হয়- যেমন তার প্রতিপক্ষ Warsaw pact আজ আর ঐরূপ আরেক সাক্ষাত্ সমরমূলক সমরযন্ত্র রূপে উঠে গিয়েছে। নয় তাকে সন্ত্রাস প্রতিরোধমূলক অন্য ধরনের এক বাহিনীপুঞ্জে পরিবর্তন করে ফেলে বজায় রাখতে হয়। যদি এই দ্বিতীয়োল্লিখিত পথে অগ্রসর হতে হয়, তাহলে তার সাক্ষাত্ সমরমূলক বাহিনীসমূহকে তুলে দিয়ে (dismantle) করে। তার সোনার ছেলেদের যার যার বাড়ি ফেরত পাঠিয়ে তার উচ্চতর সেনানায়কদের চাকরি বজায় রেখে তাদের অধীনে পুরো ন্যাটোকে নতুন করে একদিকে সন্ত্রাস প্রতিরোধমূলক মনস্তাত্বিক যুদ্ধের যন্ত্রে রূপান্তরিত করা দরকার। তার জন্য তার সাক্ষাত্ সমর-গত বাহিনীসমূহের বিকল্প হিসেবে দাঁড় করানো দরকার নতুন দুই শাখা (ক) OECD-এর মত একটি আর্থ কাঠামোগত উন্নয়ন সহায়ক প্রতিষ্ঠান পূর্বের কম্যুনিজমে পর্যবসিত হওয়ার প্রবণতাশীল মনোভাব বা উপনিবেশবাসী ইউরোপীয় শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের জনগণের বিদ্রোহ স্পৃহার মতই আজকের মৌলবাদে আকৃষ্ট হওয়ার প্রবণতাশীল তৃতীয় বিশ্বের জনগণের অস্থিরতার গোড়া যেই অসহনীয় দারিদ্র্যতার মূলোত্পাটনের জন্য। (খ) মৌলবাদ প্রবণ সমাজসমূহের সাংস্কৃতিক মূলবোধগত মনস্তত্বের অনুসন্ধান অনুধাবন ও বিশ্লেষণ পূর্ব তদানুযায়ী সেখানকার ব্যাপকতর জনসাধারণের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের সন্ত্রাস ও সংঘাত বিরোধী সেইসব দিককে ব্যাপকভাবে প্রচারিত, প্রসারিত ও লালন করে নবাবিষ্কৃত মৌলবাদের ধারক বাহকদের সেভাবেই ব্যাপকতর জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে হবে যেভাবে সন্ত্রাসবিরোধী প্রথম সার্থকযুদ্ধ-এর উদাহরণ, মালয়দ্বীপে  পঞ্চাশের দশকে কম্যুনিজমকে পরাভূত করবার যুদ্ধ করা হয়েছিল। এমআইটি-এর প্রফেসর লুসিয়ান পাই-দের মত রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও মনস্তত্ব বিশেষজ্ঞদের সাক্ষাত্ সরেজমিনে পথনির্দেশনার মাধ্যমে মালয় উপদ্বীপের  ঐ শিক্ষণীয় কম্যুনিজম হারানো যুদ্ধে যেমন জয় হয়েছিল আজকেও  তেমন বিশেষজ্ঞদের পথনির্দেশনায় মৌলবাদী ও অন্যান্য মতাদর্শগত সন্ত্রাসবাদকে পরাজিত করা সম্ভব। চলমান ন্যাটোর সাক্ষাত্ সমরগত (Conventional War fare-এর) মশা মারতে কামান দাগা কৌশল তা মোটেই সম্ভব নয়।
n লেখক : রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ। ঢাকা ও হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতপূর্ব শিক্ষক, প্রফেসর।

ব্রাদারহুড বনাম সেনাবাহিনী



॥ জসিম উদ্দিন ॥

সব কিছুকে আমাদের পশ্চিমাদের চোখে দেখতে হয়। এ দেখার সাথে বাস্তবতার অনেক পার্থক্য। মিসরে অনুষ্ঠিত প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনে এ ফারাকটা পরিষ্কার করে দেখা গেল। বিশ্বের যেকোনো জায়গার ঘটনা পশ্চিমা মিডিয়া মুহূর্তে ছড়িয়ে দেয়। অর্থনৈতিক উন্নতি ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সংবাদ সংগ্রহে তাদের অনেক দূর এগিয়ে দিয়েছে। এটা এত দূর এগিয়েছে যে, পশ্চাৎপদ কোনো দেশের ঘটনা সে দেশের মিডিয়ায় প্রচার হওয়ার আগে পশ্চিমা মিডিয়ার সুবাদে বিশ্বব্যাপী প্রচার হয়ে যায়। পেশাগত দক্ষতার কারণে তাদের উপস্থাপনাও অত্যন্ত আকর্ষণীয়। তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা তাই বেশি। বিশ্বাসযোগ্যতা নিজেদের প্রচারণার কাজে ব্যবহার করে সুযোগ বুঝে। তাহরির বিপ্লব-পরবর্তী সংসদ নির্বাচনে ইসলামপন্থী দলগুলো ৭০ শতাংশের বেশি আসন পেয়েছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দেশটির প্রধান দু’টি ইসলামি দল মুসলিম ব্রাদারহুড ও আল নূর পার্টির দুই প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করে সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশন এ ধরনের কিছু করে বসতে পারে সে আশঙ্কা করেই মিসরের প্রধান রাজনৈতিক দল ব্রাদারহুড আরেকজন প্রার্থী রেখেছিল। প্রথম দফা নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, ব্রাদারহুডের দ্বিতীয় পছন্দ মুহাম্মদ মুরসি এগিয়ে রয়েছেন। 
মিসরের ক্ষমতাসীন সামরিক পরিষদ চায় সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত থাকুক। মোবারক আমলে বিশাল সামরিক বাহিনী লাগামহীন সুযোগ সুবিধা ভোগ করেছে। নির্বাচিত সংসদের সাথে এ নিয়ে এখন তাদের দ্বন্দ্ব চলছে। প্রধান রাজনৈতিক দল ব্রাদারহুড থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে ক্ষমতা নিয়ে টানাটানিতে সেনাবাহিনীকে পিছু হটতে হবে। অন্য দিকে সামরিক মদদপুষ্ট কাউকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করা গেলে নির্বাচিত সংসদের বিরুদ্ধে তারা একজোটে কাজ করতে পারবে। যদি প্রেসিডেন্ট পদটি অন্তত ব্রাদারহুডের বাইরে রাখা যায় তবে ক্ষমতার দরকষাকষিতে সেনাবাহিনী সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে। এ নীতি নিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সাজানোর চেষ্টা করেছে সামরিক পরিষদ। এ প্রচেষ্টাকে পুরোপুরি ব্যর্থ বা সফল বলা যাবে না। ব্রাদারহুড এবং সেনাবাহিনী উভয়ই রেসে রয়েছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ব্রাদারহুডকে বাইরে ফেলে দেয়ার যে চেষ্টা সেটি আপাতত ব্যর্থ হয়েছে। সেনাবাহিনীর সাজানো নির্বাচনের প্রচেষ্টায় পশ্চিমা মিডিয়া কমবেশি সেনাবাহিনীর অবস্থান সমর্থন করে প্রচারণা চালায়। ব্রদারহুডের প্রধান প্রার্থী আহমেদ সাতের নূর পার্টির প্রার্থী আবু সালেহ ইসমাইল বাদ হয়ে গেলে তারা জোরেশোরে ফোকাস করে আমর মুসার ওপর। তার প্রতিযোগী হিসেবে তুলে আনে ব্রাদারহুডের সাবেক নেতা আবুল ফুতুহকে। রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত আল আহরাম পরিচালিত জরিপ তুলে আনে মুসার ব্যাপক জনসমর্থনের বিষয়টি। অনেক ব্যবধানে পেছনে ছিলেন ফুতুহ। সেখানে ব্রাদারহুডের প্রার্থী মুরসির অবস্থান ছিল প্রধান প্রতিযোগীদের পেছনের সারিতে।
নির্বাচনী ফলাফলে দেখা গেল, আমর মুসা প্রধান পাঁচ প্রতিযোগীর মধ্যে পঞ্চম হয়েছেন, যাকে মুসার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে প্রচারণা চালানো হয়েছিল, সেই আবুল ফুতুহ হলেন তৃতীয়। অন্য দিকে বিস্ময়করভাবে মোবারক সরকারের শেষ সময়ের প্রধানমন্ত্রী আহমদ শফিক হন দ্বিতীয়। মোবারক সরকারের প্রতীক শফিক যে সেনাবাহিনীর প্রধান পছন্দÑ এই নির্বাচনী ফলাফলে তারই প্রমাণ পাওয়া যায়। তৃতীয় হওয়া প্রার্থী হামদিন সাব্বাহি নির্বাচনে কারচুপির যে অভিযোগ এনেছেন তা প্রকৃতপক্ষে সেনাবাহিনী এবং শফিকের বিরুদ্ধে গেছে। তিনি শফিকের চেয়ে সাত লাখ কম ভোট পেয়েছেন। অভিযোগ উঠেছে সেনাবাহিনীকে ৯ লাখ ভোটার আইডি কার্ড সরবরাহ করা হয়েছে। তারা সবাই শফিককে ভোট দিয়েছেন। মোবারক সরকারের যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন তাদের একেক জনকে ভোটের বিনিময়ে ১০০ থেকে ১৫০ পাউন্ড দেয়ার অভিযোগও এসেছে। অর্থাৎ একটি সাজানো নির্বাচনের মাধ্যমে শফিককে জেতানোর অপচেষ্টা হয়েছে। এসব ভোট শফিকের বাক্সে না পড়লে সাব্বাহি যেমন দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসতে পারতেন, তেমনি তিনি আবুল ফুতুহর পেছনে পড়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চতুর্থ হতেন। দ্বিতীয় দফা নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগই থাকত না তার। 
আহমেদ শফিক বিমানবাহিনীর ফাইটার পাইলট। তিনি মোবারকের প্রিয় সামরিক অফিসারদের অন্যতম। বিমানবাহিনী প্রধান থেকে অবসরে গিয়ে ২০০২ সালে মোবারকের পর্যটনমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। প্রায় নয় বছর দায়িত্ব পালনের পর মোবারক তাকে পদোন্নতি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম আমর মুসাকে নিয়ে খুব মাতামাতি করলেও শফিকের পেছনে সেনাবাহিনীর সমর্থন সেভাবে প্রকাশ হয়নি। সামরিক পরিষদ তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি অক্ষত রাখার জন্য সাবেক সেনাকর্মকর্তাকে অধিকতর বিশ্বস্ত মনে করে। নীরবে ভোটের হিসাবে এগিয়ে যাওয়ার কারণ যে সেনাবাহিনী তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি। শফিক নির্বাচনের দিন বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র সফরে গেলে জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার বিরদ্ধে স্লোগান দেয়। তারা শফিককে তাহরির বিপ্লবের শত্রু বলেই মনে করে।
ব্রাদারহুডের প্রথম পছন্দের প্রার্থী সাতের সুপরিচিত জাতীয় ব্যক্তিত্ব। সামরিক পরিষদ নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন কমিশন তার প্রার্থিতা বাতিল করলে দ্বিতীয় পছন্দের প্রার্থী দলটির রাজনৈতিক শাখা ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির মুহাম্মদ মুরসিকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করে। সাতেরের তুলনায় মুরসি ব্যাপক পরিচিত কোনো ব্যক্তিত্ব নন। এ সুযোগে পশ্চিমা মিডিয়া ব্যাপক প্রচারণা চালায় আমর মুসাকে নিয়ে। ইসলামপন্থীরা বিভক্ত হয়ে পড়েছে বলে অসংখ্য প্রতিবেদন প্রচার হয়। আলোচনার বাইরে পড়ে যান মুরসি। একটি টেলিভিশন বিতর্ক আয়োজন করা হয় আমর মুসা ও ফুতুহর মধ্যে। মিসরীয় দূতাবাসগুলোতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফল পশ্চিমা মিডিয়ার মিলিত প্রচারণায় প্রথম পানি ঢেলে দেয়। প্রবাসীদের ভোটাভুটি ১০ মে শুরু হয়। মুহাম্মদ মুরসি ব্রাদারহুডের দ্বিতীয় পছন্দ হলেও এমনকি জাতীয়ভাবে ব্যাপক পরিচিত না হলেও তিনিই যে মিসরীয়দের প্রধান পছন্দ তা স্পষ্ট হয়ে যায় এর মাধ্যমে। আরো স্পষ্ট হয়ে যায় জনগণ মিসরীয় ব্রাদারহুডকে ক্ষমতায় দেখতে চায়।
৩৩টি দেশে অনুষ্ঠিত নির্বাচনী ভোট গণনায় মুরসি বিপুল ভোটে এগিয়ে যান। তিনি এক লাখ ছয় হাজার ২৫২ ভোট পান। ৭৭ হাজার ৫০০ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে ব্রাদারহুডের সাবেক সদস্য আবুল ফুতুহ। হামদিন সাব্বাহি ও আমর মুসা যথাক্রমে তৃতীয় ও চতুর্থ হন। অন্য দিকে মোট ভোটে দ্বিতীয় স্থান লাভ করা আহমদ শফিক প্রবাসী ভোটের ফলাফল অনুযায়ী হন পঞ্চম। নির্বাচনে ভোট কারচুপির যে অভিযোগ সেনাবাহিনী ও শফিকের বিরুদ্ধে উঠেছে, সে সন্দেহ প্রবাসীদের ভোটের ফলাফল থেকে আরো জোরদার হয়। কারচুপির সন্দেহ আরো বেড়ে যায় দেশে মুরসির এতটা কম ভোট পাওয়া নিয়েও। যেখানে বাইরের মোট ভোটের ৪০ শতাংশের বেশি পেয়েছেন তিনি। ফুতুহ ও মুরসির ভোট যোগ করলে প্রবাসী ভোটের প্রায় ৮০ শতাংশ এ দু’জন পেয়েছেন। সেখানে দেশে এ দু’জন মিলে পেয়েছেন মাত্র ৪৫ শতাংশ ভোট।
মুরসি কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকৌশল বিষয়ে মাস্টার ডিগ্রি নেন ১৯৭৮ সালে। ১৯৮২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া থেকে পিএইচডি অর্জন করেন। একই বছর সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। সেখানে চার বছর অধ্যাপনার পর দেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। একই সাথে যোগ দেন রাজনীতিতে। মোবারকের শাসনামলে নিজ এলাকা থেকে পরপর দু’বার স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। কয়েকবার কারারুদ্ধ হন। তাহরির বিপ্লবের সময় ব্রদারহুডের রাজনৈতিক শাখা ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস গঠিত হলে তিনি এর চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। সংসদে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। এর মধ্যে একজন দক্ষ সংগঠক ও সুবক্তা হিসেবে স্বীকৃতি পান। ব্রাদারহুডের বিকল্প প্রার্থী হিসেবে প্রেসিডেন্ট প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসার পর প্রচারণা চালানো হয় স্বল্পপরিচিত হওয়ায় মুরসি ভোটের দৌড়ে সবার পেছনে পড়বেন। 
ফুতুহ পেয়েছেন মোট ভোটের ১৯ শতাংশ । আল নূর পার্টির প্রার্থিতা বাতিলের পর দলটি অনেকটা আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে ব্রাদারহুডের সাবেক সদস্যকে সমর্থন দেয়। সাব্বাহি পেয়েছেন ২১ শতাংশ ভোট। তিনি ধর্মনিরপেক্ষ বামদের প্রতিনিধি। মোবারকের কট্টর বিরোধী এবং তাহরির বিপ্লবের ঘোরতর সমর্থক। আমর মুসা ১০ শতাংশের মতো ভোট পেয়ে পঞ্চম হয়েছেন। তিনি তাহরির বিপ্লবকে সমর্থন করে ভোট চেয়েছেন। তার অন্যতম সমালোচনার বিষয় ছিল মোবারকের শাসন। জুনের মাঝামাঝি মুরসি ও শফিকের মধ্যে দ্বিতীয় দফা নির্বাচন হবে। সে নির্বাচনে ফুতুহর ১৯ শতাংশ ভোট মুরসির বাক্সে যাওয়ার কথা। ফুতুহ এর মধ্যে শফিকের বিরুদ্ধে ভোট দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। সাব্বাহির সমর্থকেরা মোবারক ও বর্তমান সামরিক পরিষদের কট্টর সমালোচক। ইসলামপন্থীরা ক্ষমতায় আসুক এটাও তারা চান না। তাদের ভোট বিভক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যারা আমর মুসাকে ভোট দিয়েছেন তারা বিপ্লবের সমর্থক। শফিক যে ভোট পেয়েছেন তার একটা বড় অংশ কারচুপির মাধ্যমে এসেছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। জুনের মাঝামাঝিতে হতে যাওয়া প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মুরসির বিজয় এক প্রকার নিশ্চিত। সামরিক পরিষদ আবার যদি শফিকের পক্ষে কারচুপির আশ্রয় নেয় সে ক্ষেত্রে পরিস্থিতি ভিন্ন হবে। এর সাথে বিভ্রান্ত করার জন্য পশ্চিমা মিডিয়া তো আছেই। তবে মিসরীয়দের ভরসা তাহরির বিপ্লবীরা এখনো রাজপথ ছাড়েনি। 
jjshim146@yahoo.com

আমরা কি রাশিয়া পুনরাবিষ্কারে প্রস্তুত?


শেখ রোকন
ভ্লাদিমির পুতিন প্রধানমন্ত্রিত্বকালে একবার বলেছিলেন, যারা সোভিয়েত ইউনিয়নকে মিস করে না, তারা হৃদয়হীন। কিন্তু যারা সোভিয়েত আমল ফিরিয়ে আনতে চান, তারা মস্তিষ্কহীন। এই কথা বাংলাদেশের জন্য সত্য। সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের হৃদয়ে থাকুক। থাকুক দুঃসময়ে হাত বাড়ানো বন্ধুত্বের সুখস্মৃতি হিসেবে। বহুপাক্ষিক বিশ্বে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের সুবিধা নিতে চাইলে বর্তমান রাশিয়াকে মেনে নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। সোভিয়েত ইউনিয়নের কথা ভেবে ভেবে আমরা গত দুই দশকে রাশিয়ায় যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে তা দেখতে পাইনি। এখন সেদিকে মনোযোগ দেওয়া হোক

চলতি মাসের গোড়ার দিকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের ঢাকা সফর ও তার তাৎপর্য নিয়ে আমাদের ব্যতিব্যস্ত সংবাদমাধ্যমে মস্কোতে 'নতুন' প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের শপথ নেওয়ার খবর স্বভাবতই উপযুক্ত ট্রিটমেন্ট পায়নি। লোকালয়েই যখন বাঘের আনাগোনা, বনের হাতির গতিবিধি কে জানতে চায়! ফলে আর দশটা 'আন্তর্জাতিক' খবরের_ যেমন পাকিস্তানে জনৈক আল্লারাখির নাক ফিরে পাওয়া_ পাশেই রুশ প্রেসিডেন্টের শপথ গ্রহণের খবর ছাপা হয়েছে। তুলনা করা সঙ্গত নয়; তবুও জর্জ ডবি্লউ বুশের দ্বিতীয় মেয়াদ কিংবা বারাক ওবামার শপথ অনুষ্ঠানের কাভারেজ দেখতে পুরনো সংবাদপত্রের পাতা উল্টাতে পারেন অনুসন্ধিৎসু পাঠক। বাংলাদেশের জন্য প্রাসঙ্গিক হোক বা না হোক_ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্ষোভ, নতুন সরকার, রাজনৈতিক অচলাবস্থা প্রভৃতি নিয়ে কলাম লেখার একটা রেওয়াজ আমাদের দেশে গড়ে উঠেছে। পুতিনের তৃতীয় আমল নিয়ে সেসব লেখকেরও আগ্রহ চোখে পড়ল না।
এহ বাহ্য। শপথ অনুষ্ঠান উপলক্ষে ঢাকার রুশ কালচারাল অ্যান্ড সায়েন্স সেন্টারে 'লাইভ প্রদর্শনী' ও গোলটেবিল আলোচনার যে আয়োজন করা হয়েছিল, ঘটনাক্রমে আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। কিন্তু অনুপস্থিত ছিলেন নির্ধারিত অনেকে। প্রধান অতিথিদ্বয়_ ঢাকায় নিযুক্ত নতুন রুশ রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার এ নিকোলায়েভ এবং বাংলাদেশ-রাশিয়া ফ্রেন্ডশিপ সোসাইটির সেক্রেটারি জেনারেল অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর এমপি তো থাকবেনই, সন্দেহ নেই। সঞ্চালক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যও যথারীতি উপস্থিত ছিলেন। তবে নয়জন সম্মানিত ও বিশেষ অতিথির মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মাত্র দু'জন। কোনো অনুষ্ঠানে শতভাগ উপস্থিতি আশা করা বোকামি। নির্ধারিত আলোচকদের জরুরি কাজ পড়ে যেতে পারে। তারা সবাই সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার। ঢাকার যানজট লাঞ্ছিত যাতায়াত ব্যবস্থার কথাও ভুলে যাওয়া চলবে না। কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থাও অনেক সময় অংশগ্রহণকারীদের আগ্রহে ভাটা তৈরি করতে পারে। রুশ কালচারাল সেন্টারে অবশ্য এ বালাই নেই বললেই চলে।
প্রশ্ন অন্যত্র। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্টের শপথ এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে তার প্রভাব_ এমন একটি গোলটেবিল বৈঠক যদি আমেরিকান সেন্টারে আয়োজন করা হতো? সেখানে যদি মার্কিন রাষ্ট্রদূত উপস্থিত থাকতেন? সম্মানিত অতিথিরা কি তখনও অনুপস্থিত থাকতেন? সোভিয়েত আমলের রুশ-মার্কিন তুলনায় কাজ নেই। অনুষ্ঠানটি যদি যুক্তরাজ্য কিংবা জার্মান দূতাবাসের পক্ষ থেকেও আয়োজন করা হতো? ওই গোলটেবিলে উপস্থিত এক সাংবাদিক কানে কানে বললেন, এ ক্ষেত্রে এক পক্ষের প্রতি আগ্রহের তুলনায় বরং অন্য পক্ষের বিরাগভাজন হওয়ার আশঙ্কাই বেশি কাজ করেছে। তার মানে, সেই সোভিয়েত যুগের জুজু!
গত চার দশকে ভলগা ও গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। আমরা যেন সেই বিভাজিত বিশ্বেই বাস করছি। আশির দশকের সোভিয়েত ইউনিয়ন পেরিয়ে একুশ শতকের রাশিয়ায় আসতে পারিনি।
রুশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে গোলটেবিল আলোচনার পাশের টেবিলেই সাজানো রুশ রিয়ার অ্যাডমিরাল সের্গিয়েই পাভলাভিচ জুয়েঙ্কোর বাংলায় অনুবাদিত বই_ 'মনে রেখো আমাদের, হে বাংলাদেশ'। ১৯৭২-৭৪ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের নৌবাহিনী যুদ্ধবিধ্বস্ত চট্টগ্রাম বন্দরকে কর্মক্ষম করে তোলার কর্মসূচি নিয়েছিল। ডুবে থাকা জাহাজ ও মাইন অপসারণ করতে যে নৌবহর তখন চট্টগ্রাম এসেছিল, জুয়েঙ্কো ছিলেন তার অধিনায়ক। ১৯৯৫ সালে তার বইটি মস্কো থেকে প্রকাশিত হয়। রুশ-বাংলাদেশ সম্পর্কের ৪০ বছরপূর্তি উপলক্ষে ঢাকা থেকে তার বাংলা সংস্করণ প্রকাশ হয়েছে।
ভালো হতো রাশিয়ার পরিবর্তিত পরিস্থিতিও যদি এভাবে বাংলাদেশে ভাবান্তর হতো। গোলটেবিলে অংশগ্রহণকারী বক্তারা বলেছেন বটে যে, 'বাংলাদেশ রাশিয়া পরস্পরকে নতুন রূপে আবিষ্কার করছে' (সমকাল, ৮ মে ২০১২); বাস্তবে রাশিয়া এখনও আমাদের কাছে সোভিয়েত ইউনিয়নের নস্টালজিয়া ছাড়া আর কিছু নয়। সেই নস্টালজিয়ায় আমাদের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর বড় অংশের চিন্তা-ভাবনা এখনও আচ্ছন্ন। এ থেকে মুক্তি সহজও নয়।
বস্তুত আশির দশক অবধি সুদূর মফস্বলেরও প্রগতিমনস্ক পরিবারের ঘরে প্রগতি প্রকাশনার বাংলা বই পেঁৗছে গিয়েছিল। কেবল সোভিয়েত শাসন ব্যবস্থার গুণগান নয়; প্রগতির হাত ধরেই বাঙালি মধ্যবিত্তের ঘরে প্রবেশ করেছিলেন তলস্তয়, পুশকিন, গোর্কির মতো মহান লেখকরা। লেখা মানে নিছক ঘটনার ঘনঘটা নয়; রুশ সমাজ, সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাসও এখানে পরিচিতি পেয়েছে। এখনও অনেকের কাছে পরিণত পানীয় মানেই ভদকা। আমাদের বাড়িতেও ডাকযোগে আসত 'উদয়ন'। প্রচ্ছদজুড়ে প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভের গম্ভীর মুখ_ উদয়ন বলতে কেন যেন এই ছবিটাই এখনও চোখে লেগে আছে।
বলা বাহুল্য, অনেকের স্বপ্ন ভেঙে দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে সমাজতন্ত্র বিদায় নিয়েছে। মহাজাগতিক নানা ইস্যুতে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে বাংলাদেশের সমাজতন্ত্রীরাও ছিন্নভিন্ন। আর যাই হোক, তারা রাজনৈতিক ভরসা জাগাতে পারছে না। আমাদের সমাজে বরং সোভিয়েত ইউনিয়নের সাংস্কৃতিক প্রভাবই এখন প্রধান।
মুশকিল হচ্ছে, সাংস্কৃতিক এ নৈকট্যের ওপর দাঁড়িয়ে যে কূটনৈতিক ঘনিষ্ঠতা নতুন মাত্রা পেতে পারত, তা সম্ভব হচ্ছে না। প্রথম কারণ সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজনৈতিক ছায়া পুরোপুরি না কাটা। বিশ্ব রাজনীতিতে রাশিয়ার উত্থান ঘটবে এবং ফের দ্বি-মেরু বিশ্ব প্রতিষ্ঠিত হবে, সাবেক সমাজতন্ত্রীদের কেউ কেউ এখনও এমন স্বপ্ন দেখেন। স্বপ্ন দেখেন, ষাট ও সত্তর দশকের সেই ইন্দো-রুশ মৈত্রীর সেতু পেরিয়ে বাংলাদেশে 'হাত গুটাও মার্কিন' স্লোগান তোলা সম্ভব। দ্বিতীয় কারণ, খোদ রাশিয়ার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক খোলনলচে বদলে যাওয়া।
'সাম্রাজ্যবাদবিরোধী' লড়াইয়ে আমাদের দেশে এখনও যারা রাশিয়াকে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের আসনে দেখতে চান; তারা সাবেক সোভিয়েত দেশগুলো ঘুরে আসতে পারেন। চেচনিয়ার কথা না হয় বাদই থাকল। বেলারুশের নাগরিক আমার ফেসবুক বন্ধু দিমিত্রি একবার বলছিল, সে আশির দশকের সোভিয়েত স্টাইলে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইয়ে আরেক বার নামতে চায়। বহুল উচ্চারিত 'ইঙ্গ-মার্কিন' শক্তি নয়; এবার তার প্রতিপক্ষ রাশিয়া। বিভিন্ন ইস্যুতে রুশ-আমেরিকান হুজ্জত দেখে যারা উজ্জীবিত হন; তারা খোঁজ নিলে দেখবেন এই লড়াই হালুয়ার ভাগাভাগি ছাড়া আর কিছু নয়। আশপাশে তাকালে দেখা যাবে, নয়াদিলি্ল কিংবা বেইজিংয়ের সঙ্গে মস্কোর সম্পর্ক এখন সোভিয়েত আমলে হিসাব-নিকাশে পড়ে নেই।
বাংলাদেশকে এ বাস্তবতা মেনে নিতে হবে। কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আদর্শিক রাশিয়াকে খুঁজতে গেলে বিভ্রান্তই হতে হবে। ইতিমধ্যে রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করতে রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। গ্যাসক্ষেত্রে আসছে রুশ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা গ্যাজপ্রোম। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যও বাড়ছে। ২০১১ সালে সেই বৃদ্ধি ছিল ৪০ শতাংশ। রুশ-বাংলাদেশ বাণিজ্যের সরল অঙ্কে প্লাস বসাতে হলে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাব ও মূর্তির সামনে মাইনাসই হবে উপযুক্ত সমাধান।
শেষ করা যাক ভ্লাদিমির পুতিনের একটি উক্তি দিয়ে। প্রধানমন্ত্রিত্বকালে তিনি একবার বলেছিলেন, যারা সোভিয়েত ইউনিয়নকে মিস করে না, তারা হৃদয়হীন। কিন্তু যারা সোভিয়েত আমল ফিরিয়ে আনতে চান, তারা মস্তিষ্কহীন। এই কথা বাংলাদেশের জন্য সত্য। সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের হৃদয়ে থাকুক। থাকুক দুঃসময়ে হাত বাড়ানো বন্ধুত্বের সুখস্মৃতি হিসেবে। বহুপাক্ষিক বিশ্বে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের সুবিধা নিতে চাইলে বর্তমান রাশিয়াকে মেনে নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। সোভিয়েত ইউনিয়নের কথা ভেবে ভেবে আমরা গত দুই দশকে রাশিয়ায় যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে তা দেখতে পাইনি। এখন সেদিকে মনোযোগ দেওয়া হোক। কূটনীতির পথ ধরে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ক্ষেত্রে ব্রাজিল কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকাকে যে অবস্থানে আমরা বিবেচনা করি, নতুন রাশিয়াকে সেভাবেই দেখতে হবে।
সন্দেহ নেই ইতিমধ্যে যথেষ্ট বিলম্ব হয়েছে। কিন্তু সময় এখনও ফুরিয়ে যায়নি। বড় কথা হচ্ছে, সোভিয়েত ইউনিয়ন নয়, রাশিয়া পুনরাবিষ্কারেই মনোযোগী হতে হবে। বর্তমান রাশিয়ার দোষ-গুণ; বড়র পিরিতির সম্ভাবনা-আশঙ্কা, সব মেনে নিয়েই নতুন করে বন্ধুত্ব হতে হবে। আমরা কি প্রস্তুত?

শেখ রোকন : সাংবাদিক ও গবেষক
skrokon@gmail.com

সিরিয়ায় ন্যাটো সাম্রাজ্যবাদীদের চক্রান্ত এগিয়ে চলেছে


বদরুদ্দীন উমর
সিরিয়ায় লিবিয়ার মতো তেল নেই। কিন্তু স্ট্র্যাটেজিক দিক দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়ার গুরুত্ব অনেক। ইসরায়েল সিরিয়ার ঘোরতর শত্রু। কাজেই সিরিয়ার বর্তমান সরকার উচ্ছেদ ইসরায়েলের হাত শক্ত করার জন্য প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, লেবাননের সঙ্গে সিরিয়ার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। সিরিয়ার বর্তমান সরকার ফেলে দিতে পারলে এরপর তারা সহজেই লেবাননের ওপর সামরিকভাবে চড়াও হতে পারে। তা ছাড়া ইরান তো অবশ্যই আছে। সিরিয়ার সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ ও বন্ধুত্বপূর্ণ। সিরিয়ার সরকার উৎখাত হলে ইরান খুব ক্ষতিগ্রস্ত ও দুর্বল হবে। এসব দিক দিয়ে সিরিয়ার বাশার আল আসাদের সরকার উৎখাত মধ্যপ্রাচ্যে সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থ নিরাপদ করার জন্য প্রয়োজনীয়

ইউরো-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের এবং সৌদি আরব ও কাতারের যৌথ উদ্যোগে গঠিত সরকারবিরোধী সন্ত্রাসীদের দ্বারা মধ্য সিরিয়ার হুলা শহরে ২৫ মে ৯০ জন নিহত হয়েছে, যার এক-তৃতীয়াংশই হলো শিশু। এ চক্রান্তমূলক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে তার দায়দায়িত্ব বাশার আল আসাদের সরকারের ওপর চাপিয়ে তাদের দ্বারা গঠিত তথাকথিত সিরিয়ান ন্যাশনাল কাউন্সিলের নেতারা এখন জাতিসংঘের সামরিক হামলার মাধ্যমে সিরিয়ার সরকার উচ্ছেদের আওয়াজ তুলেছে। এ হত্যাকাণ্ডকে সিএনএন, বিবিসি এবং কাতারের আল জাজিরা টেলিভিশন এবং সাম্রাজ্যবাদ নিয়ন্ত্রিত পত্রপত্রিকা সিরিয়া সরকারের ক্রাইম হিসেবে অভিহিত করে প্রচার চালাচ্ছে। তারা অনেক লাশের ছবি টেলিভিশনে দেখাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে তারা লিবিয়ায় একই কায়দায় যে কাজ করেছিল সিরিয়ায়ও তাই করছে। ইয়েমেনি সরকারের গুলিতে নিহত লোকদের ছবি টেলিভিশনে দেখিয়ে সেটা গাদ্দাফির সেনাবাহিনীর কাজ বলে তারা প্রচার করেছিল। এ ধরনের ধাপ্পাবাজি করতে তারা অভ্যস্ত এবং এর যথেষ্ট অভিজ্ঞতাও তাদের আছে। শুক্রবারের হত্যাকাণ্ড সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর কাজ বলে তারা প্রচার করলেও সিরিয়া সরকার এর প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছে, এর সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। এটা সরকারবিরোধীদের কাজ। (উধরষু ঝঃধৎ ২৮.৫.২০১২) নিজেরা এ কাজ করে সরকারকে হেয়প্রতিপন্ন করা এবং এর ছুতো করে তারা জাতিসংঘকে সিরিয়া সরকারের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে চাপ দেওয়ার উদ্দেশ্যেই এটা করেছে।
সিরিয়ার সরকারি বাহিনী বসে নেই। তারা অবশ্যই বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজন অনুযায়ী আক্রমণ করছে। তাতে বেসামরিক নিরীহ লোকজনও মারা যাচ্ছে; কিন্তু এটা অবশ্যই লক্ষ্য করতে হবে যে, সিরিয়ার সরকারি বাহিনীকে এ কাজে একভাবে বাধ্য করা হচ্ছে। কারণ সাম্রাজ্যবাদের সাহায্যপুষ্ট ও তাদের দ্বারা প্ররোচিত সশস্ত্র বাহিনী সরকারি বাহিনী, বিভিন্ন সরকারি স্থাপনা এবং সরকার সমর্থক জনগণের ওপরও সশস্ত্র আক্রমণ পরিচালনা করছে। এর ফলে বেসামরিক লোকজনের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর বহু লোকও হতাহত হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে কোনো সরকারই যে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারে না, তা বলাই বাহুল্য।
লিবিয়াতেও ফ্রান্স, ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র এভাবেই বেনগাজিতে এক সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলেছিল তাদের অর্থ, অস্ত্র ও রাজনৈতিক সহায়তা দিয়ে। সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সহায়তার অর্থ ছিল মুয়াম্মার গাদ্দাফির বিরুদ্ধে এক ব্যাপক রাজনৈতিক প্রচারণা চালানো। সে কাজে তারা পরিপূর্ণ সাফল্য অর্জন করেছিল, কারণ বিশ্বজোড়া বৈদ্যুতিন ও মুদ্রিত প্রচারমাধ্যমই তাদের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু এসব সত্ত্বেও সেই ভাড়াটে বিদ্রোহী বাহিনীকে দিয়ে গাদ্দাফিকে পরাস্ত করার ক্ষমতা তাদের ছিল না। এটা উপলব্ধি করেই তারা লিবিয়ায় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে ঘড় ভষু তড়হব দাবি করে নিরাপত্তা পরিষদে। প্রস্তাবের সীমা সম্পূর্ণ লঙ্ঘন করে তারা লিবিয়ায় ন্যাটো বাহিনীকে দিয়ে বোমাবর্ষণ করিয়েছিল। এর মাধ্যমে তারা গাদ্দাফির বিশাল বাহিনী তো ধ্বংস করেছিলই, তার ওপর তাদের স্থলবাহিনীকে প্রায় নির্মূল করেছিল।
কিন্তু তাদের এ আক্রমণের সব থেকে অপরাধমূলক দিক ছিল হাজার হাজার নিরীহ বেসামরিক লোকজনের ওপর বোমাবর্ষণ করে তাদের হত্যা করা। গাদ্দাফির বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ডের যে অভিযোগ তারা করেছিল তার বহুগুণ হত্যা ন্যাটোর বিমান আক্রমণের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদীরা করেছিল; কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের প্রচারমাধ্যমের শক্তি এত বেশি যে তারা সত্যকে মিথ্যা এবং মিথ্যাকে সত্য বানিয়ে শেষ পর্যন্ত গাদ্দাফিকে হত্যা এবং লিবিয়ায় তার শাসন উচ্ছেদ করে, লিবিয়াকে এমন আইনের পদানত করে, তাদের তেলসম্পদ ব্যাপকভাবে লুণ্ঠন করছে।
এ প্রসঙ্গে অবশ্যই বলা দরকার যে, লিবিয়ার এই অবস্থা হতো না যদি রাশিয়া ও চীন নিরাপত্তা পরিষদে নো ফ্লাই জোনের বিরুদ্ধে ভেটো দিত। কিন্তু সেটা না দিয়ে তারা ন্যাটোভুক্ত সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গেই হাত মিলিয়েছিল। এভাবে হাত মেলানোর ফলে শেষ পর্যন্ত তারা কিছুই পায়নি। তাদের হাতে ফ্রান্স, ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র তামাক খেয়েছে। কোন বুদ্ধি ও বিবেচনার বশবর্তী হয়ে তারা এ কাজ করেছিল তা বোঝা মুশকিল। কোন অভিজ্ঞতার কথাই বা তারা চিন্তা করেছিল, সেটাও জানা নেই। কিন্তু লিবিয়ায় তাদের এ অভিজ্ঞতার পর তারা এখন সাবধান হয়ে জাতিসংঘ কর্তৃক লিবিয়ার মতো সিরিয়ায় নো ফ্লাই জোন চালু করার বিরুদ্ধে ভেটো দিয়েছে। তাদের এই ভেটো ন্যাটোভুক্ত সাম্রাজ্যবাদীদের জন্য অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হয়েছে। কাজেই এখন সরাসরি সিরিয়া আক্রমণ করতে না পেরে তারা তাদের দ্বারা সংগঠিত সন্ত্রাসী বাহিনীর মাধ্যমে সিরিয়ায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে নিযুক্ত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে তাদের কিছু সাফল্য এসেছে, কিন্তু এ কাজ করে সিরিয়া সরকারকে যেভাবে তারা ফেলে দেওয়ার চিন্তা করেছিল সেটা হয়নি।
সিরিয়ায় লিবিয়ার মতো তেল নেই। কিন্তু স্ট্র্যাটেজিক দিক দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়ার গুরুত্ব অনেক। ইসরায়েল সিরিয়ার ঘোরতর শত্রু। কাজেই সিরিয়ার বর্তমান সরকার উচ্ছেদ ইসরায়েলের হাত শক্ত করার জন্য প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, লেবাননের সঙ্গে সিরিয়ার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। সিরিয়ার বর্তমান সরকার ফেলে দিতে পারলে এরপর তারা সহজেই লেবাননের ওপর সামরিকভাবে চড়াও হতে পারে। তা ছাড়া ইরান তো অবশ্যই আছে। সিরিয়ার সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ ও বন্ধুত্বপূর্ণ। সিরিয়ার সরকার উৎখাত হলে ইরান খুব ক্ষতিগ্রস্ত ও দুর্বল হবে। এসব দিক দিয়ে সিরিয়ার বাশার আল আসাদের সরকার উৎখাত মধ্যপ্রাচ্যে সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থ নিরাপদ করার জন্য প্রয়োজনীয়।
আরব লীগ নামে যে সংগঠনটি আছে এটি সব সময়ই ইঙ্গ-মার্কিন-ফরাসি সাম্রাজ্যবাদীদের অনুগত হিসেবেই কাজ করেছে এবং এখনও করছে। এটাই একটা বড় কারণ, যে জন্য আরব দেশগুলো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়াতে সক্ষম হয়নি। শুধু তাই নয়, সৌদি আরবের মতো রাষ্ট্রটি ইসরায়েলবিরোধী অনেক কথাবার্তা বললেও যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে তারা ইসরায়েলের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেই চলে। এসব দিক বিবেচনা করলে মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতিকে বেশ কঠিনই বলতে হবে। এ পরিস্থিতিতে ন্যাটোভুক্ত সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো ও তাদের পদানত আরব লীগ এখন সিরিয়ায় গণহত্যার কথা বলে ব্যাপকভাবে এসব প্রচার চালাচ্ছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরাক ও সিরিয়ায় লাখ লাখ নিরীহ বেসামরিক লোক, নারী-শিশু-বৃদ্ধ হত্যা করলেও তার বিরুদ্ধে বিশ্বজোড়া কোনো বড় আকারের প্রতিবাদ ও বিরোধিতা দেখা যায় না। এর কারণ বর্তমান বিশ্বে জনমত খুব চাতুর্যের সঙ্গে প্রচারমাধ্যমের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। এই প্রচারমাধ্যম হলো সাম্রাজ্যবাদী দেশ ও তাদের মক্কেল দেশগুলোর পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণে।
২৮.৫.২০১২

রবিবার, ২৭ মে, ২০১২

ফরাসি দেশে সমাজতন্ত্রী প্রেসিডেন্ট

ফরাসি দেশে সমাজতন্ত্রী প্রেসিডেন্ট



॥ এবনে গোলাম সামাদ ॥

ফরাসি দেশে নির্বাচন হয়ে গেল। নির্বাচনে হেরে গেলেন মধ্য ডানপন্থী হিসেবে পরিচিত নিকোলাস সারকোজি। প্রেসিডেন্ট থাকাবস্থায় নিকোলাস সারকোজি পরাজিত হন। ইতঃপূর্বে কোনো ফরাসি প্রেসিডেন্টকে এভাবে পরাজিত হতে হয়নি। ফরাসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন ফরাসি সমাজতন্ত্রী দলের প্রার্থী ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদে। ফরাসি দেশে দীর্ঘ দিন ধরে কোনো সমাজতন্ত্রী প্রেসিডেন্ট হননি। এর আগে সমাজতন্ত্রী প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন ফ্রাঁসোয়া মিত্রঁ। তিনি প্রেসিডেন্ট ছিলেন ১৯৮১ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত। মিত্রঁ সমাজতন্ত্রী হয়েও ফরাসি দেশে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির প্রবর্তন চাননি। বর্তমান সমাজতন্ত্রী প্রেসিডেন্টও যে চাইবেন তা মনে করার কোনো কারণ নেই। তিনি হয়তো জনকল্যাণে বরাদ্দ করবেন আরো কিছু বেশি অর্থ। যার ফলে ফরাসি দেশে বাড়বে জনকল্যাণের মাত্রা। ফরাসি সমাজতন্ত্রীরা ইউরোপের অন্যান্য দেশের সমাজতন্ত্রীদের মতো অনুসরণ করতে চাচ্ছেন কল্যাণব্রতী রাষ্ট্রের ধারণা। সাবেক সমাজতন্ত্রী ধ্যানধারণাকে তারা এখন আর আঁকড়ে ধরে রাখার পে নন। তারা কার্যত হয়ে উঠেছেন রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত মিশ্র অর্থনীতির প।ে তাদের আর বলা যায় না ঠিক সমাজতান্ত্রিক দর্শনের অনুসারী হিসেবে। ফরাসি সমাজ দার্শনিক ও রাজনীতিবিদ লিওঁ বুর্জোয়া (১৮৫১-১৯২৫) প্রচার করেন তার সমাজতান্ত্রিক দর্শন (Solidarism)। তিনি বলেন, সমাজে যারা অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জন করেন, তারা যে সেটা করতে পারেন কেবলই নিজের যোগ্যতার জন্য, তা নয়। সামাজিক পরিস্থিতি তাদের এই সাফল্য অর্জনে সুযোগ দেয়। এবং এনে দেয় তাদের সাফল্য। সুতরাং সম্পদে কেবল তাদের অধিকার থাকতে পারে না। সম্পদে তাদেরও অধিকার আছে, যারা অন্যকে সম্পদ অর্জনে সাহায্য করছে। আদর্শ সমাজে তাই সম্পদের বণ্টন হতে হবে এমনভাবে যে, যারা সম্পদ অর্জনে সহায়তা করছেন, তাদেরও অর্জিত সম্পদের ওপর থাকতে হবে কিছু অধিকার। অর্থনীতিকে হতে হবে সামাজিক, যাতে হতে পারে সমাজের সবারই কল্যাণ। বুর্জোয়া বলেন, এর জন্য বড়লোকদের আয়ের ওপর বসাতে হবে কর। আর এই করের টাকা দিয়ে সাহায্য করতে হবে গরিব জনসমষ্টিকে। তাদের থাকতে হবে জীবনযাত্রার ন্যূনতম মান, খেয়ে পরে বাঁচার অধিকার। শিাব্যবস্থা হতে হবে অবৈতনিক এবং সবার জন্য উন্মুক্ত। সবার জন্য থাকতে হবে দুর্ঘটনা-বীমা। শ্রমিকদের থাকতে হবে ন্যূনতম মজুরির বিধান। থাকতে হবে শ্রমসময়ের বিধান। সরকারকে নির্মাণ করতে হবে বাড়িঘর, যা মানুষ কিনতে পারবে সহজেই। থাকতে হবে বিনামূল্যে চিকিৎসার বিধান। এসব করতে পারলে সমাজসঙ্গতি বাড়বে। আর সমাজসঙ্গতি বাড়লে ঘটবে সামগ্রিকভাবে সমাজের উন্নতি। মোটামুটিভাবে ফরাসি সমাজতন্ত্রীর ধারণা, সমাজসঙ্গতি বাড়ানোর দর্শনের ধারণা এখন হয়ে উঠছে প্রায় একই রকম। সমাজতন্ত্রীরা এখন মনে করেন না যে, সমাজের অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য উৎপাদনের উপায় (means of production) রাষ্ট্রায়ত্ত করতেই হবে। তারা এখন বলেন না, কলকারখানা জমিজমা আর এক কথায় প্রাকৃতিক সম্পদ হতে হবে রাষ্ট্রিক। ব্যক্তিগত মালিকানা বলে থাকবে না আর কিছু। রাষ্ট্র পরিচালনা করবে একটা দেশের সমগ্র অর্থনীতিকে। সমাজতন্ত্র আর রাষ্ট্রতন্ত্র এখন আর একত্র করে দেখছেন না সমাজতন্ত্রীরা। তারা চাচ্ছেন উৎপাদিত সম্পদের সামাজিক সুবণ্টন। আর এক কথায় সামাজিক অর্থনীতি গড়ে তোলাকে। তারা মনে করছেন, তাদের আদর্শ হিসেবে ফ্রান্সে এক সময় কমিউনিস্টরা খুব শক্তিশালী হয়ে উঠেছেন। কিন্তু এখন তারা হয়ে পড়েছেন মতাশূন্য। কারণ ফ্রান্সের মানুষ গণতন্ত্র চায়। চায় না কোনো দলের একক শাসন। সমাজতন্ত্রী এবং কমিউনিস্টদের মধ্যে একটি বড় পার্থক্য হলো, সমাজতন্ত্রীরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন কিন্তু কমিউনিস্টরা তা করেন না। ফলে ফ্রান্সে তাদের প্রভাব এখন বিশেষভাবেই কমে গিয়েছে। ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদে তার নির্বাচনী প্রচারের সময় বলেন, তিনি বড়লোকদের ওপর কর বাড়াবেন। আর এই করের টাকায় গরিব জনসমষ্টির জীবনযত্রার মান বাড়াতে বিনিয়োগ করবেন। কিন্তু এ েেত্র উঠছে প্রশ্ন। তিনি বড়লোকদের ওপর কতটা কর আরোপ করবেন, আর সেই করের অর্থ কিভাবে ব্যয়িত হবে দরিদ্র জনসাধারণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে। এ েেত্র করের অর্থ অপচয় হওয়ার সম্ভাবনা থাকছে। এ প্রসঙ্গে ফরাসি কর-ব্যবস্থা নিয়ে কিছু কথা বলা যেতে পারে। ফরাসি কর-ব্যবস্থা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, সুইডেন, ডেনমার্ক ও নরওয়ের মতো নয়। এসব দেশে আয়করের মাত্রা হলো বেশি। এসব দেশে কর প্রধানত আরোপ করা হয় মানুষের আয়ের ওপর। এসব দেশে আয়কর ধরা হয় প্রগতিশীলভাবে। প্রগতিশীল বলতে বোঝায় আয় বাড়ানোর সাথে সাথে অধিক হারে কর দেয়ার বিধিকে। কিন্তু ফরাসি দেশে আয়ের ওপর করের মাত্রা ধার্য হয় কম। কর প্রধানত হলো পরো। করের বোঝা শেষ পর্যন্ত তাই গিয়ে পড়ে আয়ের ওপর নয়, খরচের ওপর। ফরাসি কর-ব্যবস্থায় প্রত্য করের চেয়ে পরো করের মাত্রা বেশি। পরো করের একটা বিশেষ দৃষ্টান্ত হলো বিক্রয় কর (Sale tax), যা আসলে হলো ক্রয় কর (Purchase tax)। ফরাসি দেশে তাই কর বাড়ানোর মাত্রা দাঁড়ায় বড়লোকের চেয়ে তুলনামূলক গরিব জনসাধারণের ওপর বেশি। এ ছাড়া বাড়ে ঘাটতি ব্যয়ের পরিমাণ। যা বাড়ায় মুদ্রাস্ফীতি (Currency inflation)। ফরাসি মুদ্রার ক্রয়মতা স্থিতিশীল রাখা হয়ে ওঠে খুবই কষ্টকর। ফরাসির বর্তমান সমাজতন্ত্রী প্রেসিডেন্ট তাই বড়লোকের ওপর কর বসিয়ে তুলনামূলক দরিদ্র জনসমষ্টির জীবনযাত্রার মান কিভাবে উন্নত করতে পারবেন তা নিয়ে থাকছে সংশয়। ফ্রান্স এখন ইউরো মুদ্রার অংশীদার। সে তার নিজের মুদ্রাব্যবস্থার ওপর আর আগের মতো নিয়ন্ত্রণ রাখে না। এ েেত্রও থাকছে মুদ্রা নিয়ন্ত্রণে সমস্যা। ফ্রান্সে এখন বেকার সমস্যা আগের তুলনায় বেড়েছে। ফ্রান্সের নেই আগের মতো বিশাল সাম্রাজ্য। ফরাসিরা আগে তাদের সাম্রাজ্যে গিয়ে যেমন কাজ করতে পারতেন, এখন আর তা সম্ভব নয়। নিজ দেশেই হচ্ছে তাদের কর্মসংস্থান। সমাজতন্ত্রী প্রেসিডেন্ট বলছেন, তিনি কর্মসংস্থান বাড়াবেন আর এর জন্য বাড়াবেন সরকারি পূর্তকাজের পরিমাণ। কিন্তু সরকারি পূর্তকাজ বাড়ানো আর একটা দেশের পণ্য উৎপাদন বাড়া সমার্থক নয়। পণ্য উৎপাদন যদি না বাড়ে, কিন্তু যদি অর্থের জোগান বেড়ে যায়, তবে পণ্য কেনার মতা কমতে থাকে। কারণ অর্থের সরবরাহ বাড়ানোর অর্থ দাঁড়ায় পণ্যের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায়। চাহিদা অনুসারে পণ্যের সরবরাহ না বাড়লে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় অনিবার্য হয়ে ওঠে। আর সাধারণ মানুষ পারে না দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে পণ্য কিনতে। তাকে পড়তে হয় অর্থনৈতিক দুরবস্থারই মধ্যে। অর্থের সরবরাহ বাড়িয়ে তাই সম্ভব হয় না দারিদ্র্য বিমোচন করা। ফ্রান্স আমাদের মতো দরিদ্র দেশ নয়। কিন্তু তবু ফ্রান্সের আছে অর্থনৈতিক সমস্যা। আর ফরাসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য আনতে পারবেন মানুষের মনে এই আশা জাগিয়ে। কিন্তু বাস্তবে তিনি কতটা সফল হবেন তা আমাদের পে আন্দাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। হয়তো দেখা যাবে বর্তমান প্রেসিডেন্ট সমস্যার সমাধান করতে না পেরে জড়িয়ে পড়ছেন অধিক সঙ্কটে।
আমি একসময় ফরাসি দেশে ছাত্র ছিলাম। ফরাসি দেশ আমার কাছে মনে হয়েছে অনেক স্বচ্ছ। যদিও সেখানে দরিদ্র ছিল। আর এখনো আছে। পৃথিবীর কোনো দেশই দরিদ্রমুক্ত নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শতকরা ১৩ ভাগ লোক এখন বাস করেন দারিদ্র্যসীমার নিচে। ফরাসি দেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে কতভাগ মানুষ বাস করেন তার পরিসংখ্যান আমার জানা নেই। তবে ফরাসি দেশে একধরনের মানুষ আছে, যারা পথে-ঘাটে ভিা করেবৃত্তি। এদের বলা হয় কশা। ফরাসি সমাজে কশার উদ্ভব হয় কেন, তা বলা যায় না। এরা কোনো কাজ করে না। নেশা করে, শুয়ে থাকে রাস্তায়। এদের দেখে প্রথমে মনে হতে পারে ফরাসি দেশ বুঝি খুবই গরিব। কিন্তু আসলে তা নয়। ফরাসি দেশে অর্থনীতিতে আছে কৃষি ও শিল্পের মধ্যে বিশেষ ভারসাম্য। অনেক উন্নত দেশের েেত্র যেটা নেই। ফরাসি গ্রাম্য জীবন আমার কাছে বিশেষ ভালো লেগেছে। আমার মনে জেগে আছে তার স্মৃতি। ফ্রান্সে এখন সৃষ্টি হয়েছে একটি বিশেষ সমস্যা, যা আমি যখন ফ্রান্সে ছিলাম তখন ছিল না। ফ্রান্সে আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া ও মরক্কো থেকে অনেক মুসলমান উপনিবেষ্টিত হয়েছেন। যাদের সন্তান সন্ততির মিলিত সংখ্যা এখন হয়ে উঠেছে প্রায় ৫০ লাখের কাছাকাছি। এদের নিয়ে বিশেষ সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে ফ্রান্সে। এরা এক দিকে বিদেশী অন্য দিকে এদের ধর্মবিশ্বাস ফরাসিদের থেকে অনেক ভিন্ন। এদের সাথে তাই ফরাসিদের সৃষ্টি হতে পারছে সমাজ বিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে বলে সংস্কৃতির সঙ্ঘাত। জাতিসত্তার দিক থেকেও এসব উপনিবিষ্টরা হয়ে উঠতে পারছেন না ফরাসি। এদের পূর্বপুরুষ ফ্রান্সে গিয়েছিলেন উন্নত জীবনযাত্রার খোঁজে। কিন্তু তাদের সেই ঈপ্সিত জীবনযাত্রার মান কোনোভাবেই অর্জিত হতে পারেনি। আমার মনে হয় ফরাসি দেশে এদের উপনিবিষ্ট হওয়াটা যুক্তিযুক্ত হয়নি। আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া ও মরক্কোতে রয়েছে যথেষ্ট প্রাকৃতিক সম্পদ। এসব দেশের মানুষের উচিত নিজের দেশে থেকে সুখী হওয়ার চেষ্টা করা। নিজের দেশের অর্থনীতি বিকাশে আত্মনিয়োগ করা। ফ্রান্সে গিয়ে ভাগ্য উন্নয়নের চেষ্টা করা নয়। মরক্কো ছিল ফরাসি প্রটেক্টরে। তিউনিসিয়াও ছিল ফরাসি প্রটেক্টরে। আলজেরিয়া সরাসরি ছিল ফরাসি শাসনের অধীন। আলজেরিয়াতে গিয়ে বহু ফরাসি উপনিবেষ্টিত হয়েছিলেন। তাদের হাতে চলে যায় আলজেরিয়া সমুদ্র উপকূলবর্তী উর্বর ভূমির এক-তৃতীয়াংশ। আলজেরীয় আরবরা চেয়েছেন ফরাসি শাসনের অবসান। ফরাসি দেশের সাথে আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া ও মরক্কোর মানুষের মিলমিশ হয়নি। ফ্রান্স থেকে তাই ফরাসিরা এখন চাচ্ছেন ফ্রান্সে উপনিবিষ্ট হওয়া মরক্কো, আলজেরীয় ও তিউনিসিয়ানদের বহিষ্কার। ফ্রান্সে মুসলমান মেয়েদের হিজাব পরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এটা না করলেও হয়তো চলত। আমি যখন ফ্রান্সে ছিলাম তখন হিজাব কোনো সমস্যা ছিল না। মরক্কো, আলজেরীয় ও তিউনিসিয়া থেকে যাওয়া মেয়েদের দেখেছি ফরাসি মেয়েদের মতোই পোশাক পরতে। তাদের কাউকে হিজাব পরতে দেখিনি। কিন্তু এখন ফ্রান্সে যে কারণেই হোক হিজাব পরতে চাচ্ছিলেন কিছু মুসলিম মহিলা। ফ্রান্সে এটা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে রাষ্ট্রিক আইন করে। যে রকম আইন ইতঃপূর্বে ফরাসি দেশে করার কোনো প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়নি। আমি ছাত্র থাকাকালীন ফরাসি পুলিশ এক দিন আমাকে ঘিরে ধরেছিল আলজেরীয় মুক্তি সংস্থার সাথে যুক্ত মানুষ হিসেবে। কিন্তু তারা আমার পাসপোর্ট দেখে ছেড়ে দেয়। নিয়ে যায় না কারাগারে। সেটা ১৯৬২ সালের প্রথম দিকের কথা। ফ্রান্সের নতুন প্রেসিডেন্ট উপনিবিষ্ট বিদেশীদের সম্পর্কে কী নীতি গ্রহণ করবেন তা আমরা জানি না। কিন্তু তাকে সম্মুখীন হতে হবে এই জটিল সমস্যারও। ফ্রান্স পাঁচটি বৃহৎ শক্তির মধ্যে একটি। জাতিসঙ্ঘে রয়েছে তার ভেটো প্রদানের মতা। তার হাতে রয়েছে পরমাণবিক অস্ত্র। ফ্রান্স আগের মতো শক্তির অধিকারী না হলেও এখনো বিশ্বরাজনীতিতে পালন করছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। ফ্রান্স ন্যাটো জোটের মধ্যে আছে। ন্যাটো জোটের সাথে আফগানিস্তানে এসেছে ফরাসি সৈন্য। ইরান নিয়ে কোনো সঙ্ঘাত সৃষ্টি হলে ফ্রান্স তাতে জড়িয়ে পড়তে পারে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ফ্রান্স কী ভূমিকা পালন করবে তা-ও হয়ে থাকছে প্রশ্নসাপে। এ েেত্র ফরাসি প্রেসিডেন্টকে নিতে হবে অনেক কঠিন সিদ্ধান্ত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশে ফ্রান্স কি জড়াবে কোনো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে? 
ফ্রান্সে এখন কোনো সংসদীয় গণতন্ত্র নেই। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের মতো শক্তিধর নন। ফ্রান্সে প্রধানমন্ত্রী আছেন। প্রধানমন্ত্রীর থাকে মন্ত্রিপরিষদ। ফ্রান্সে প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টের মধ্যে মতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। ফ্রান্সে রাষ্ট্রব্যবস্থায় এটা হয়ে আছে একটা সমস্যা। একা প্রেসিডেন্ট ফ্রান্সে ইচ্ছামতো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। ফ্রান্সে কার্যত এখন রয়েছে দ্বৈত শাসনব্যবস্থা। এর উদ্ভব হতে পেরেছে ১৯৫৮ সালের পর থেকে। ১৯৫৮ সালের পর সার্ল দ্য গোল-এর মতায় আসার পর থেকে। তিনি প্রবর্তন করে গেছেন এই দ্বৈত শাসনব্যবস্থা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে তৃতীয় ফরাসি রিপাবলিকে ৭০ বছরের মধ্যে সরকার পতন ঘটেছে ১০৬ বার। অর্থাৎ প্রত্যেক মন্ত্রিসভার গড়পড়তায় স্থিতি হয়েছে আট মাস। তার বেশি নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রতিষ্ঠা হয় চতুর্থ ফরাসি রিপাবলিক। ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৫৮ সালের মধ্যে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছে ২০টি। দ্য গোল এসে এই ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটান এবং প্রবর্তন করেন বর্তমান ফরাসি সংবিধানের। বর্তমান ফরাসি সংবিধানে অবশ্য ঘটানো হয়েছে দ্য গোল প্রবর্তিত সংবিধানের কিছু ধারার পরিবর্তন। যেমনÑ দ্য গোল রচিত সংবিধানে ফরাসি প্রেসিডেন্ট হতে পারতেন সাত বছরের জন্য নির্বাচিত। কিন্তু এখন ফরাসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন পাঁচ বছরের জন্য। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইচ্ছা করলে পারেন না ফরাসি প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করতে। ফরাসি দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যে ভোট হয়ে গেল, তাতে ভোটের ব্যবধানকে খুব বড় বলা যায় না। পরাজিত প্রেসিডেন্ট পেয়েছেন শতকরা ৪৮ ভাগ ভোট। অন্য দিকে ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদে পেয়েছেন শতকরা ৫২ ভাগ ভোট। ভোটের এই ব্যবধানকে বাস্তব েেত্র খুব বড় ব্যবধান বলা যায় না। ফ্রান্সে তাই থাকছে বিরাট দণিপন্থী মতামতেরও প্রাধান্য। ফ্রান্স বামপন্থার দিকে ঢুকে পড়েছে ঠিক এ রকম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা মোটেও যুক্তিযুক্ত নয়। 
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

লিবিয়া, সিরিয়া, এবং তা ছাড়িয়ে... সাম্রাজ্যবাদী বসন্ত?

সামির আমিন
আপনারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তার সহযোগী, ইউরোপিয়ান এবং অন্যদের দেখছেন। ন্যাটোর অন্যতম সদস্য হিসেবে তুর্কিস্তান, তিউনিসিয়া এবং মিশরের মতো আরব দেশগুলির অন্যত্র আন্দোলনগুলিকে সংহত হতে দেয়নি। লিবিয়ার অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। লিবিয়ার অভিজ্ঞতা ওদেরও রয়েছে। লিবিয়াতে ওরা সফল হয়েছিল। গোড়ার দিকে লিবিয়ায় গাদ্দাফির বিরুদ্ধে কোনও জনপ্রিয় আন্দোলন ছিল না। ছোট ছোট সশস্ত্র গোষ্ঠী দেখা যায়। প্রশ্ন উঠেছে, কোথা থেকে এত অস্ত্র আসছে?

আমরা জানি, শুরু থেকেই পারস্য উপসাগর, পশ্চিমী শক্তির সমর্থন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদতে অস্ত্র আসছে। এই অস্ত্র দিয়েই সেনাবাহিনী, পুলিসকে আক্রমণ করা হচ্ছে। সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলি চিহ্নিত হয়েছে ‘গণতান্ত্রিক মুক্তি বাহিনী হিসেবে। ন্যাটো এই নামেই ওই গোষ্ঠীগুলিকে ডাকে। সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলির সাহায্য ও উদ্ধারের কাজে প্রথমে ফরাসী ও পরে ন্যাটোবাহিনী ছুটে আসে এবং ক্রমশ হস্তক্ষেপ করতে শুরু করে। এই হস্তক্ষেপ সাফল্য পায় এই অর্থে কারণ তা গাদ্দাফির শাসনকে ধ্বংস করতে পেরেছে। কিন্তু এই সাফল্যে ফল কী হয়েছে? এখন কি লিবিয়া গণতন্ত্রের পথে চলেছে? কেউ যদি জানেন যে, নয়া জমানার প্রেসিডেন্ট এমন এক বিচারপতি যিনি বুলগেরিয়ান নার্সদের মৃত্যুকে নিন্দা করেছিলেন তাহলে তার হাসাই উচিত। কী ধরনের গণতন্ত্র! এই গণতন্ত্রে সোমালিয়ান ধাঁচের অস্থিতি দেশকে নড়বড়ে করে তুলছে। তথাকথিত ‘ইসলাম’-এর নামে স্থানীয় ক্ষমতা তৈরি হচ্ছে। স্থানীয় যুদ্ধব্যাপারীরা দেশকে ধ্বংসের পথে নিয়ে চলেছে। কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন, হস্তক্ষেপের অর্থ কি দাঁড়ায় সে দেশের ধ্বংস?

আমি মূল প্রশ্নে ফিরি। কারণ ওরা সিরিয়ার পর একই নীতি প্রয়োগের চেষ্টা করেছিল। অর্থাৎ, প্রথম থেকেই সশস্ত্র বাহিনীর অনুপ্রবেশ। উত্তর থেকে শুরু করে তুর্কিস্তান, বিশেষত হাতে। হাতে-র শরণার্থী শিবির আদৌ উদ্বাস্তু শিবির নয়। খুব কম সংখ্যক শরণার্থীই ওই শিবিরে রয়েছে। আদতে ওখানে সিরিয়ায় হস্তক্ষেপ তথা অনুপ্রবেশের জন্য সশস্ত্র ভাড়াটে সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আমার তুর্কি বন্ধুরা এর প্রমাণ দিয়েছেন। ন্যাটোর শরিক হিসেবে তুর্কিস্তানও এই ষড়যন্ত্রের অংশীদার। জর্ডানের ক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনীর সমর্থন আসছে দক্ষিণের সশস্ত্র বাহিনী দারা-র মাধ্যমে। সরাসরি ইজরায়েল থেকে।

মিশরের মতো সিরিয়ারও একই পরিস্থিতি। বহু বছর ধরে এখানে এক বৈধ সরকার ছিল। এই জাতীয় সরকারের পিছনে জনসমর্থনও ছিল। কিন্তু হাফেজ আসান এর সময় থেকেই এই জনসমর্থন কমতে থাকে। নয়া উদারনীতিবাদ, বেসরকারীকরণের পথে হেঁটে একই সামাজিক বিপর্যয় নেমে আসে। কাজেই, বিশাল, জনপ্রিয় এবং সামাজিক উত্থানের এক বস্তুনিষ্ঠ কারণ ছিল। এই আন্দোলনের সুযোগে সশস্ত্র বাহিনীর সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে, যেখানে জনপ্রিয় গণতান্ত্রিক আন্দোলন দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। বাশার আসাদ-এর বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক শক্তি তথাকথিত ‘প্রতিরোধ’ আন্দোলনে শামিল হতে চায়নি। বাহ্যিক হস্তক্ষেপের রাশ টেনে ধরতে সমর্থ হন আসাদ। হমস্ এবং উত্তরে তুর্কি সীমানা পর্যন্ত। কিন্তু রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরোধিতার বিনিময়ে বিদেশী শক্তির মদতপুষ্ট সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রকৃত সন্ত্রাসবাদ কোনও সমাধান নয়’। প্রকৃত জনপ্রিয় গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে আলোচনাসাপেক্ষে চলতি পরিস্থিতির পরিবর্তনই সমস্যার সমাধান ছিল। এটিই ছিল চ্যালেঞ্জ। এ প্রশ্নই উঠছে। আমরা জানি না। আমি জানি না। আমার মনে হয়, কেউই জানে না আগামীতে কী ঘটবে। এই শাসন ব্যবস্থা বা এই শাসন ব্যবস্থার অধীন মানুষজন বুঝবেন জনপ্রিয় গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাহায্যে ক্ষমতার পুনর্বিন্যাস করা সম্ভব এবং এই পুনর্বিন্যাসই প্রকৃত সংস্কারের অভিমুখ খুলে দিতে পারে। অথবা আজকে যে পরিস্থিতির তারা সম্মুখীন হচ্ছেন সেরকম কোনও বিস্ফোরণের জন্য অপেক্ষা করা। এই অভিমুখে এগোলে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কাছে তাদের পরাজয় ঘটবে।

সিরিয়াসহ এই অঞ্চলে সাম্রাজ্যবাদের প্রকৃত লক্ষ্য কী? গণতন্ত্রের আবাহন আদৌ সাম্রাজ্যবাদের লক্ষ্য নয়। লিবিয়াতে যেভাবে সমাজ ধ্বংস হয়েছে, সেভাবেই দেশে দেশে ধ্বংসলীলায় উদ্যত সাম্রাজ্যবাদ। ইরাকের কথাই ধরুন। ইরাকে ওরা কী করেছে? সাদ্দাম হুসেইনের স্বৈরতন্ত্র সরিয়ে তিনটি আরও নিকৃষ্ট, কদর্য স্বৈরতন্ত্র কায়েম করেছে। দু’টি শিয়া, সুন্নির নামে এবং একটি কুর্দদের নামে। হত্যালীলায় গোটা দেশ ধ্বংস হয়ে গেছে। আমি অন্য কোনও শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না। একদিকে সাম্রাজ্যবাদের ‘মানবিক’ বোমা ছিন্নভিন্ন করেছে হাজার হাজার মানুষের জীবন, অন্যদিকে বিজ্ঞানী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কবিকে নির্বিচারে হত্যা, কাউকে রেয়াত করেনি। এই হত্যার তাণ্ডব গোটা দেশকে ধ্বংস করছে। সিরিয়ায় সাম্রাজ্যবাদের এটিই লক্ষ্য। সিরিয়ায় লিবারেশন আর্মি-র কর্মসূচী কী? আলাওয়াইস, দ্রুজ্স, খ্রীষ্টান, শিয়া সংখ্যালঘুদের সরিয়ে দাও। এর অর্থ সিরিয়ার ৪৫% মানুষ। এর মানে কী? এর অর্থ গণতন্ত্র? এর অর্থ কদর্যতম স্বৈরতন্ত্র এবং দেশের ধ্বংস।

প্রশ্ন এর সঙ্গে কার স্বার্থ জড়িত? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইজরায়েল এবং পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলির। আমেরিকার স্বার্থ কী? এই অঞ্চলে দেশগুলি বিপর্যস্ত হলে পরবর্তী মঞ্চ তৈরি হবে অর্থাৎ ইরানের ধ্বংস। এরফলে চীন, রাশিয়ার মতো বিকাশশীল রাষ্ট্রগুলি এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করার প্রশ্নে পিছু হটবে। এমনকি ভারতও। এটিই লক্ষ্য। এই লক্ষ্যেরই অংশ ইরানসহ মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলির ধ্বংস। একইভাবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির বিপর্যয় এবং দেশে দেশে দুর্বৃত্ত-উন্নয়ন কায়েম ইজরায়েলেরও লক্ষ্য। সিরিয়া চার বা পাঁচটি তাৎপর্যহীন, ছোট রাষ্ট্রে ভেঙে গেলে ইজরায়েলের ঔপনিবেশিকতারই সম্প্রসারণ হবে। একই লক্ষ্য অন্যান্য পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলিরও। গণতন্ত্রের সংগ্রামের নেতৃত্ব ওবামা, সারকোজি, ক্যামেরন-এর পাশে কাতার-এর আমীর এবং সৌদি আরবের রাজার দাঁড়ানো প্রায় প্রহসনে পরিণত হয়েছে। এই ঘটনায় যে কেউ হাসতে পারেন। ইসলামের নামে এই তাবৎ অঞ্চলে এই শক্তি নিজের কর্তৃত্ব কায়েম করতে চায়। নানাভাবে ইসলামের নাম ব্যবহার করা হচ্ছে। লক্ষ্য, মিশরের ধ্বংসসাধন। যদি মিশর শক্তিশালী থাকে তাহলে পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলির কী হবে? নাসেরের আমলে ওসব দেশের কী অবস্থা ছিল আপনারা জানেন। এই শক্তিগুলি মুসলিম ভ্রাতৃত্বের সমর্থন পাচ্ছে। আমি এভাবেই শেষ করতে চাই যে মুসলিম ভ্রাতৃত্বকে কোনো ‘ইসলামিক’ দল হিসেবে দেখা উচিত নয়। কোনো সংগঠন বা দলকে বিচারের মানদণ্ড তা ইসলামিক না ধর্মনিরপেক্ষ-এ হওয়া উচিত নয়। বরং হওয়া উচিত তা প্রতিক্রিয়াশীল না প্রগতিশীল। যখনই যাবতীয় বাস্তব ইস্যুর ভিত্তিতে আমরা মুসলিম ভ্রাতৃত্বকে দেখি তখনই দেখা যায় তারা শ্রমিকশ্রেণীর ধর্মঘটের বিরুদ্ধে, গরিব কৃষকের প্রতিবাদ-প্রতিরোধের বিরুদ্ধে, বেসরকারিকরণের পক্ষে, জন পরিষেবা তুলে দেয়ার পক্ষে। এর অর্থ প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির পক্ষেই এই মুসলিম ভ্রাতৃত্বর অবস্থান। ইসলামকে সামনে রাখা এক প্রতিক্রিয়াশীল দল এই মুসলিম ভ্রাতৃত্ব। এটিই প্রকৃত মানদণ্ড। সাম্রাজ্যবাদী, তাদের দোসর, মধ্যপ্রাচ্যের দেশে দেশে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলির এটির বিশ্বব্যাপী ছবি।

(সামির আমিন মিশরের প্রখ্যাত মার্কসবাদী অর্থনীতিবিদ। তার সাক্ষাৎকার নেন ভারতের প্রখ্যাত মার্কসবাদী সমালোচক আইজাজ আহমেদ। সেই সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতেই উপরের এই নিবন্ধ।)

অনুবাদ: পল্লব মুখোপাধ্যায়