ইকবাল আজিজ
এমন একটা সময় ছিল, যখন সারাবিশ্বে বাংলাদেশের প্রধান পরিচয় ছিল দুর্যোগপ্রবণ দেশ হিসেবে। বাংলাদেশে সংঘটিত ঘূর্ণিঝড় কিংবা জলোচ্ছ্বাসের খবর পৃথিবীর বিখ্যাত সব পত্রিকায় শিরোনাম হতো; বিদেশী রাষ্ট্র ও সাহায্য সংস্থা ছুটে আসত ত্রাণসামগ্রী নিয়ে। আমরা এই ব্যবস্থাতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু সময় বদলে গেছে; নানা সমস্যায় জর্জরিত ৫৫ হাজার বর্গমাইলের ছোট্ট বাংলাদেশ তার আপন শক্তিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। এখন দেশের উপকূল ভাগে ও অভ্যন্তরে গড়ে উঠেছে কার্যকর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা; সেই সঙ্গে বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে নির্মিত হয়েছে বেশ কিছু আশ্রয়কেন্দ্র। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার সামর্থ্য আমরা অর্জন করেছি। দুর্যোগের আগাম খবর পেলে আমরা কার্যকরভাবে দুর্যোগ মোকাবেলা করতে পারি। এ কারণে এখন আর বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস কিংবা বন্যা আগের মতো অসংখ্য মানুষ মারা যায় না। দুর্যোগ মোকাবেলার এ সামর্থ্য অর্জন অবশ্যই আমাদের কৃতিত্ব। তবু আমাদের অনেক সমস্যাÑজনসংখ্যা বৃদ্ধি, পুষ্টিহীনতা, যানজট, বেকারত্ব প্রভৃতি আমাদের উন্নয়নের পথে প্রধান বাধা। তবু সব বাধা পেরিয়ে আমাদের এগিয়ে যাওয়া বিদেশে অনেকেই নজর কেড়েছে। সম্প্রতি পৃথিবীর কয়েকটি বিখ্যাত দৈনিক পত্রিকায় বাংলাদেশ বিষয়ে ইতিবাচক প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। এসব লেখা পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে, বিদেশীরা তখন বাইরে থেকে নিরপেক্ষভাবে আমাদের অবস্থা পর্যালোচনা করেছে। তবে দেশের ভেতরে আমরা প্রতিনিয়ত যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, সঙ্কট ও বিশৃঙ্খলা অবলোকন করেছিÑযে কারণে স্বদেশের একটি নেতিবাচক মানচিত্র আমাদের চেতনায় স্থায়ী হয়ে গেছে। হয়ত স্বদেশের আকাশে হতাশার যে কালো মেঘ দেখা যাচ্ছেÑতার আড়ালে লুকিয়ে আছে সূর্যের হাসি। তবে শত সমস্যা সত্ত্বেও দেশের অবস্থা যে বদলে গেছে তা এখন দিবালোকের মতো সত্য।
বাঙালী মধ্যবিত্তের জীবনে এখন পরিবর্তন এসেছে। দেশের মধ্যে কক্সবাজার বা অন্য কোন ট্যুরিস্ট স্পটে বেড়াতে গেলে এ পরিবর্তনটি স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। আগে ভ্রমণ ছিল উচ্চ মধ্যবিত্তের বিলাসিতা; এখন বাংলাদেশের নিম্নমধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষেরাও বছরের একবার বা দুবার সপরিবারে বেড়াতে যান কক্সবাজার কিংবা অন্য কোন স্বাস্থ্যনিবাসে। মাত্র দু’দশক আগে কক্সবাজারে ছিল হাতেগোনা মাত্র কয়েকটি উন্নতমানের হোটেল ও মোটেল; এখন তা কয়েক ডজন। এছাড়া কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত দীর্ঘ সমুদ্রসৈকতে আরও কিছু ট্যুরিস্ট স্পট গড়ে উঠেছে। আছে ‘ইনানী’ নামের একটি আশ্চর্য সুন্দর পর্যটন কেন্দ্র। ঈদ কিংবা অন্য কোন বড় উৎসবের সময় এসব জায়গায় ভিড় উপচে পড়ে। বেসরকারী উদ্যোগে ইতোমধ্যে কক্সবাজারে একাধিক ফাইভ স্টার হোটেল নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে কক্সবাজার বিমানবন্দরকে একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হিসেবে গড়ে তোলার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। এর ফলে হয়ত আগামী এক দশকে কক্সবাজারে বিদেশী পর্যটকের আগমন বহু গুণ বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু দেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত সাধারণ পর্যটকরা তখন কোথায় যাবেন? এ ধরনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে এক ধরনের পরিকল্পনাহীনতা ও বিশৃঙ্খলা বাংলাদেশের উন্নয়নের পথে প্রধান বাধা। তবু ১৬ কোটি মানুষ প্রতিনিয়ত নিজেদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের উন্নয়নের জন্য চেষ্টা করছে। নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে তাদের এ সংগ্রাম বৃথা যায়নি। এত কম আয়তনের দেশে এত বেশি জনসংখ্যা পৃথিবীর আর কোথাও নেই। অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা দুটি দেশই বাংলাদেশের চেয়ে কমপক্ষে ৫০ গুণ; কিন্তু এ দুটি দেশের মিলিত জনসংখ্যা বাংলাদেশের তুলনায় অনেক কম। দুটি দেশেই প্রাকৃতিক, খনিজ ও অন্যান্য সম্পদ আছে বাংলাদেশের তুলনায় কয়েক শতগুণ বেশি। অথচ বাংলাদেশের জনগণ দৃঢ় আশা ও নিরন্তর পরিশ্রমের ওপর ভর করে এগিয়ে চলেছে।
পাকিস্তানী আমলে পাট, চামড়া, চা ছিল বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল উৎস। কিন্তু স্বাধীনতার পর উন্নয়নের অবকাঠামো বদলে গেছে। স্বাধীনতার মাত্র এক দশক পরেই পোশাক শিল্প বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিকাশের মূল ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ব্যবসায় কয়েক শত কোটি ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে এবং দেশের মোট রফতানি আয়ের ৭৮ শতাংশ আসছে পোশাক শিল্প থেকে। এক সময় পোশাক শিল্পে চীনের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ছিল; কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে এই খাতে বাংলাদেশের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এখন চীনের পরই বাংলাদেশ দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক উৎপাদনকারী দেশ। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, আগামী এক দশক ধরে বাংলাদেশে বিপুলভাবে পোশাক শিল্পের এ বিকাশ অব্যাহত থাকবে। প্রতিযোগিতামুখর এ বিশ্বে পোশাক শিল্পে বাংলাদেশের এ সাফল্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশ ২০১১ সালে ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়াকে পেছনে ফেলে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রফতানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। তবে বিদ্যুত ও গ্যাস সঙ্কটের কারণে আগামীতে বাংলাদেশে পোশাক শিল্পের উন্নয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। পোশাক শিল্পে দক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং বিদ্যুতসহ অন্যান্য সহযোগিতা নিশ্চিত করা গেলে বাংলাদেশে নারী শ্রমিকদের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। পোশাক শিল্পের জন্য দেশের বিপুলসংখ্যক নারী সম্মানজনকভাবে বেঁচে থাকার পথ খুঁজে পেয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই তারা হয়েছে স্বাবলম্বী। বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নে পোশাক শিল্পের কার্যকর ভূমিকা রয়েছে।
তবে দেশের ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য অনেক বেড়েছে, যা একটি কল্যাণমূলক সমাজ গড়ার অন্যতম অন্তরায়। বৈষম্যের বিষয়টি বাদ দিলে দেশব্যাপী অর্থনৈতিক উন্নয়নের চিত্রটি মোটেই অনুজ্জ্বল নয়। দুর্নীতি, অনিয়ম ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা সত্ত্বেও দেশে প্রতিবছর ৬ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, কিছুটা সুপরিকল্পিতভাবে অগ্রসর হলে বাংলাদেশের পক্ষে সহজেই ৭ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব। দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে দেশের রাজনৈতিক নীতিনির্ধারক ও অর্থনীতিবিদদের এই লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা উচিত। ৭ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশগুলোর মধ্যে আছে চীন, ভারত, কম্বোডিয়া, মোজাম্বিক ও উগান্ডা। উন্নত দেশগুলো থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কলকারখানা ও উৎপাদন ব্যবস্থা স্থানান্তর এ ধরনের প্রবৃদ্ধির অন্যতম কারণ। ভবিষ্যতে উন্নত দেশগুলোর সহায়তায় বাংলাদেশে আরও বেশি কলকারখানা স্থাপিত হতে পারে। বাংলাদেশের সস্তা শ্রমশক্তিও এর অন্যতম কারণ। তবে এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে অবশ্যই নিজের স্বার্থের কথা ভাবতে হবে।
বিদেশীদের স্বার্থে ও বিদেশী সহযোগিতা দেশের মাটিতে এমন কোন কারখানা স্থাপন করা উচিত হবে না, যার ফলে পরিবেশ দূষণের আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া আগামীতে স্বনির্ভরতা অর্জন ও নিজ অস্তিত্ব রক্ষার লক্ষ্যে বাংলাদেশকে অবশ্যই তার সংরক্ষিত কৃষিজমি ও বনভূমি সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে। এ কাজটি শুরু করা দরকার এখনই।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনসহ অনেক বিদেশী নেতাই বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নে মুগ্ধ হয়েছেন। ইতোমধ্যে কেউ কেউ নারী উন্নয়নকে বাংলাদেশের উন্নয়নের সম্পূরক বলে অভিহিত করেছেন। অবশ্য এজন্য সরকার অবশ্যই কৃতিত্বের অধিকারী। বাংলাদেশে নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে যে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে তা অবশ্যই দেশব্যাপী নারী উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশেষ সহায়ক হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জাতীয় সংসদ; কৃষি শ্রমিক থেকে প্রকৌশলী, চিকিৎসক, সেনাবাহিনী, আমলাতন্ত্র সর্বত্র বাংলাদেশের নারীরা দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেছেন। ভবিষ্যতে এ ধারা অব্যাহত রাখতে হবে।
সবকিছু মিলিয়ে গত দুই দশকে আমাদের প্রাপ্তি অনেক। সবচেয়ে প্রধান প্রাপ্তি হলো, বিদেশীদের কাছে বাংলাদেশের বদলে যাওয়া ভাবমূর্তি। ২০০০ সালে ভারত ভ্রমণে গিয়ে বাংলাদেশ বিষয়ে অনেক কথা শুনতে হয়েছে বিদেশী পর্যটকদের কাছ থেকে। বাংলাদেশ বিষয়ে এক ওলন্দাজ পর্যটক মন্তব্য করেছিলেন, ‘বাংলাদেশ? যেখানে ঘন ঘন বন্যা হয়?’ আমার ধারণা, একদিনে বাংলাদেশের সেই নেতিবাচক ভাবমূর্তি বদলে গেছে। এখন বাংলাদেশ বলতে অনেক কিছু বোঝায়। বাংলাদেশ বলতে নারীর ক্ষমতায়ন, ক্রিকেটে সম্মানজনক স্থান, পোশাক শিল্পে উন্নয়ন ও নিয়মিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন এসবকে বোঝায়। ১৬ কোটি মানুষের অব্যাহত চেষ্টার মধ্য দিয়ে এ সাফল্য অর্জিত হয়েছে। এ ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। এজন্য দরকার রাজনীতিকদের উন্নয়নমূলক ঐক্য ও সদিচ্ছা।
iqbalaziz.poet@gmail.com
বাঙালী মধ্যবিত্তের জীবনে এখন পরিবর্তন এসেছে। দেশের মধ্যে কক্সবাজার বা অন্য কোন ট্যুরিস্ট স্পটে বেড়াতে গেলে এ পরিবর্তনটি স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। আগে ভ্রমণ ছিল উচ্চ মধ্যবিত্তের বিলাসিতা; এখন বাংলাদেশের নিম্নমধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষেরাও বছরের একবার বা দুবার সপরিবারে বেড়াতে যান কক্সবাজার কিংবা অন্য কোন স্বাস্থ্যনিবাসে। মাত্র দু’দশক আগে কক্সবাজারে ছিল হাতেগোনা মাত্র কয়েকটি উন্নতমানের হোটেল ও মোটেল; এখন তা কয়েক ডজন। এছাড়া কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত দীর্ঘ সমুদ্রসৈকতে আরও কিছু ট্যুরিস্ট স্পট গড়ে উঠেছে। আছে ‘ইনানী’ নামের একটি আশ্চর্য সুন্দর পর্যটন কেন্দ্র। ঈদ কিংবা অন্য কোন বড় উৎসবের সময় এসব জায়গায় ভিড় উপচে পড়ে। বেসরকারী উদ্যোগে ইতোমধ্যে কক্সবাজারে একাধিক ফাইভ স্টার হোটেল নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে কক্সবাজার বিমানবন্দরকে একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হিসেবে গড়ে তোলার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। এর ফলে হয়ত আগামী এক দশকে কক্সবাজারে বিদেশী পর্যটকের আগমন বহু গুণ বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু দেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত সাধারণ পর্যটকরা তখন কোথায় যাবেন? এ ধরনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে এক ধরনের পরিকল্পনাহীনতা ও বিশৃঙ্খলা বাংলাদেশের উন্নয়নের পথে প্রধান বাধা। তবু ১৬ কোটি মানুষ প্রতিনিয়ত নিজেদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের উন্নয়নের জন্য চেষ্টা করছে। নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে তাদের এ সংগ্রাম বৃথা যায়নি। এত কম আয়তনের দেশে এত বেশি জনসংখ্যা পৃথিবীর আর কোথাও নেই। অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা দুটি দেশই বাংলাদেশের চেয়ে কমপক্ষে ৫০ গুণ; কিন্তু এ দুটি দেশের মিলিত জনসংখ্যা বাংলাদেশের তুলনায় অনেক কম। দুটি দেশেই প্রাকৃতিক, খনিজ ও অন্যান্য সম্পদ আছে বাংলাদেশের তুলনায় কয়েক শতগুণ বেশি। অথচ বাংলাদেশের জনগণ দৃঢ় আশা ও নিরন্তর পরিশ্রমের ওপর ভর করে এগিয়ে চলেছে।
পাকিস্তানী আমলে পাট, চামড়া, চা ছিল বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল উৎস। কিন্তু স্বাধীনতার পর উন্নয়নের অবকাঠামো বদলে গেছে। স্বাধীনতার মাত্র এক দশক পরেই পোশাক শিল্প বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিকাশের মূল ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ব্যবসায় কয়েক শত কোটি ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে এবং দেশের মোট রফতানি আয়ের ৭৮ শতাংশ আসছে পোশাক শিল্প থেকে। এক সময় পোশাক শিল্পে চীনের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ছিল; কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে এই খাতে বাংলাদেশের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এখন চীনের পরই বাংলাদেশ দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক উৎপাদনকারী দেশ। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, আগামী এক দশক ধরে বাংলাদেশে বিপুলভাবে পোশাক শিল্পের এ বিকাশ অব্যাহত থাকবে। প্রতিযোগিতামুখর এ বিশ্বে পোশাক শিল্পে বাংলাদেশের এ সাফল্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশ ২০১১ সালে ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়াকে পেছনে ফেলে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রফতানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। তবে বিদ্যুত ও গ্যাস সঙ্কটের কারণে আগামীতে বাংলাদেশে পোশাক শিল্পের উন্নয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। পোশাক শিল্পে দক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং বিদ্যুতসহ অন্যান্য সহযোগিতা নিশ্চিত করা গেলে বাংলাদেশে নারী শ্রমিকদের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। পোশাক শিল্পের জন্য দেশের বিপুলসংখ্যক নারী সম্মানজনকভাবে বেঁচে থাকার পথ খুঁজে পেয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই তারা হয়েছে স্বাবলম্বী। বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নে পোশাক শিল্পের কার্যকর ভূমিকা রয়েছে।
তবে দেশের ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য অনেক বেড়েছে, যা একটি কল্যাণমূলক সমাজ গড়ার অন্যতম অন্তরায়। বৈষম্যের বিষয়টি বাদ দিলে দেশব্যাপী অর্থনৈতিক উন্নয়নের চিত্রটি মোটেই অনুজ্জ্বল নয়। দুর্নীতি, অনিয়ম ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা সত্ত্বেও দেশে প্রতিবছর ৬ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, কিছুটা সুপরিকল্পিতভাবে অগ্রসর হলে বাংলাদেশের পক্ষে সহজেই ৭ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব। দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে দেশের রাজনৈতিক নীতিনির্ধারক ও অর্থনীতিবিদদের এই লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা উচিত। ৭ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশগুলোর মধ্যে আছে চীন, ভারত, কম্বোডিয়া, মোজাম্বিক ও উগান্ডা। উন্নত দেশগুলো থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কলকারখানা ও উৎপাদন ব্যবস্থা স্থানান্তর এ ধরনের প্রবৃদ্ধির অন্যতম কারণ। ভবিষ্যতে উন্নত দেশগুলোর সহায়তায় বাংলাদেশে আরও বেশি কলকারখানা স্থাপিত হতে পারে। বাংলাদেশের সস্তা শ্রমশক্তিও এর অন্যতম কারণ। তবে এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে অবশ্যই নিজের স্বার্থের কথা ভাবতে হবে।
বিদেশীদের স্বার্থে ও বিদেশী সহযোগিতা দেশের মাটিতে এমন কোন কারখানা স্থাপন করা উচিত হবে না, যার ফলে পরিবেশ দূষণের আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া আগামীতে স্বনির্ভরতা অর্জন ও নিজ অস্তিত্ব রক্ষার লক্ষ্যে বাংলাদেশকে অবশ্যই তার সংরক্ষিত কৃষিজমি ও বনভূমি সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে। এ কাজটি শুরু করা দরকার এখনই।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনসহ অনেক বিদেশী নেতাই বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নে মুগ্ধ হয়েছেন। ইতোমধ্যে কেউ কেউ নারী উন্নয়নকে বাংলাদেশের উন্নয়নের সম্পূরক বলে অভিহিত করেছেন। অবশ্য এজন্য সরকার অবশ্যই কৃতিত্বের অধিকারী। বাংলাদেশে নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে যে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে তা অবশ্যই দেশব্যাপী নারী উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশেষ সহায়ক হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জাতীয় সংসদ; কৃষি শ্রমিক থেকে প্রকৌশলী, চিকিৎসক, সেনাবাহিনী, আমলাতন্ত্র সর্বত্র বাংলাদেশের নারীরা দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেছেন। ভবিষ্যতে এ ধারা অব্যাহত রাখতে হবে।
সবকিছু মিলিয়ে গত দুই দশকে আমাদের প্রাপ্তি অনেক। সবচেয়ে প্রধান প্রাপ্তি হলো, বিদেশীদের কাছে বাংলাদেশের বদলে যাওয়া ভাবমূর্তি। ২০০০ সালে ভারত ভ্রমণে গিয়ে বাংলাদেশ বিষয়ে অনেক কথা শুনতে হয়েছে বিদেশী পর্যটকদের কাছ থেকে। বাংলাদেশ বিষয়ে এক ওলন্দাজ পর্যটক মন্তব্য করেছিলেন, ‘বাংলাদেশ? যেখানে ঘন ঘন বন্যা হয়?’ আমার ধারণা, একদিনে বাংলাদেশের সেই নেতিবাচক ভাবমূর্তি বদলে গেছে। এখন বাংলাদেশ বলতে অনেক কিছু বোঝায়। বাংলাদেশ বলতে নারীর ক্ষমতায়ন, ক্রিকেটে সম্মানজনক স্থান, পোশাক শিল্পে উন্নয়ন ও নিয়মিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন এসবকে বোঝায়। ১৬ কোটি মানুষের অব্যাহত চেষ্টার মধ্য দিয়ে এ সাফল্য অর্জিত হয়েছে। এ ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। এজন্য দরকার রাজনীতিকদের উন্নয়নমূলক ঐক্য ও সদিচ্ছা।
iqbalaziz.poet@gmail.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন