রবিবার, ২০ মে, ২০১২

আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার :কথায় নয় কাজেও চাই


 মো. আজহারুল ইসলাম  

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলার কিছুদিন পর পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে সামরিক হস্তক্ষেপ শুরু করে। জর্জ বুশের শাসন ব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র ২০০২ ও ২০০৬ সালে মোট দুইবার তাদের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলপত্র (National Security Strategy) প্রণয়ন করে। এতে স্পষ্টভাবে বলা হয়, দুর্বল রাষ্ট্রসমূহ, যেমন আফগানিস্তান, সন্ত্রাসবাদ ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় সুবিন্যস্ত অপরাধের (Transnational organized crime) সহায়ক কিংবা চারণভূমি হিসাবে ব্যবহূত হতে পারে। এ পরিপ্রেক্ষিতে, ওয়াশিংটন দুটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যকে বিবেচনায় রেখে আফগানিস্তানে সামরিক হস্তক্ষেপ চালায়। প্রথমত, তালেবান সরকারকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ এবং দ্বিতীয়ত, আল-কায়দার সন্ত্রাসবাদী ব্যবস্থা ভেঙ্গে দেয়া।
যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ২০০৮ সালের নির্বাচনের পূর্বে আফগান যুদ্ধ থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের প্রতিজ্ঞা করেন। এর ধারাবাহিকতায় ওবামা ২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাসে ঘোষণা করেন যে, ২০১৪ সালের শেষ নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রের শেষ সৈন্যটিও আফগানিস্তান ত্যাগ করবে। চলতি মাসে আকস্মিক আফগান সফরের সময় ওবামা তার ঐ ঘোষণা পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি ঘোষণা করেন, যুক্তরাষ্ট্র ধাপে ধাপে আফগানিস্তান থেকে তার সৈন্য প্রত্যাহার করে নিবে।  এই ঘোষণার পর আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করা ঠিক হবে কিনা এমন বিতর্ক শুরু হয়।
প্রথমত, মার্কিন বাহিনী তালেবান সরকার উচ্ছেদ এবং আল-কায়দার সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধের যে দ্বৈত লক্ষ্য নিয়ে আফগানিস্তানে সামরিক হস্তক্ষেপ শুরু করে তা তারা অল্প কিছুদিনের মধ্যে অর্জন করতে সক্ষম হয়। এরপর থেকে যুক্তরাষ্ট্র আফগান রাষ্ট্র পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করছে। আমাদের একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, পশ্চিমা বিশ্ব যে প্রক্রিয়ায় জাতি পুনর্গঠনের কথা চিন্তা করে তা মধ্য এশিয়ায় বিশেষ করে আফগানিস্তানে সফল নাও হতে পারে। কেননা আফগান সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, প্রথা, মূল্যবোধ, সর্বোপরি জীবনভাবনা পশ্চিমা বিশ্বের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা এবং অনেকটাই স্বতন্ত্র। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের উচিত হবে আফগানিস্তান থেকে তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে আফগানিস্তানের পুনর্গঠনের দায়িত্ব আফগানদের হাতে তুলে দেয়া।
দ্বিতীয়ত, বিখ্যাত চায়নিজ সামরিক পরিকল্পনাবিদ সান-জু-এর মতে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ থেকে কোন দেশ লাভবান হতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্র এক দশকের অধিক সময় ধরে আফগানিস্তানে যুদ্ধ করছে। এই যুদ্ধ ভিয়েতনামের পর আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে  দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ। আফগান যুদ্ধের মতো এমন দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ আর্থিক ও কৌশলগত দিক থেকে খুবই ব্যয়বহুল। যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধনীতির কারণে ভিয়েতনাম যুদ্ধে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের উচিত তার পূর্বের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নেয়া।
তৃতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্র দেশে এবং দেশের বাইরে আফগানিস্তানে একটি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ পরিচালনার পক্ষে জনসমর্থন হারাচ্ছে। মার্কিন জনগণ আফগান যুদ্ধের পরিসমাপ্তি চায়। একটি সাম্প্রতিক সিবিএস জনমত জরিপ মতে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মার্কিন জনগণ আগামী ২ বছরের মধ্যে আফগান যুদ্ধের পরিসমাপ্তি চায়। অন্যদিকে, মার্কিন সৈন্য কর্তৃক কান্দাহারের একটি গ্রামে ১৬ জন সাধারণ আফগান হত্যা এবং সম্প্রতি কোরান পোড়ানোর ঘটনার পর আফগান জনগণের নিকট যুক্তরাষ্ট্র তার গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে। একইভাবে তালেবান বাহিনী এমনকি কারজাই প্রশাসনের উপরও মার্কিন সরকার তার প্রভাব হারাচ্ছে।
চতুর্থত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দাবি করে যে, তারা বর্তমানে আফগান জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, যাতে করে তারা তাদের নিজস্ব নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে পারে। আফগানিস্তানে বর্তমানে প্রায় নব্বই হাজার মার্কিন সৈন্য রয়েছে। নিশ্চিতভাবে, আফগান জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিতে এত অধিক মার্কিন সৈন্যের আফগানিস্তানে উপস্থিতির প্রয়োজন নেই।
পরিশেষে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুধাবন করা প্রয়োজন যে, আফগানিস্তানে বর্তমান মার্কিন স্বার্থ কেবলমাত্র কম মার্কিন সৈন্য উপস্থিতি কিংবা মার্কিন সৈন্যের অনুপস্থিতিতে অর্জন করা সম্ভব। নিঃসন্দেহে, আফগানিস্তানে উপস্থিত থেকে নয় বরং বাইরে থেকে আফগান রাষ্ট্রের পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় তত্ত্বাবধান করাই হবে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমানে উপযুক্ত কৌশল। এখন সময় এসেছে আফগানিস্তানে মার্কিন বাস্তবতা বোঝা এবং আফগানিস্তান থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সৈন্য প্রত্যাহার করা। আমরা আশা করবো মার্কিন প্রেসিডেন্টের সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা শুধুমাত্র ঘোষণামূলক অবস্থান হবে না, বরং সত্যিকার বাস্তবরূপ পাবে।
n লেখক :এমএসএস শেষবর্ষ,
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং রিসার্চ এ্যাসোসিয়েট, সিআইডিএস
azhar.irda@gmil.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন