না দি রা ম জু ম দা র
ফরাসি ভোটদাতারা দ্বিতীয় রাউন্ডে পাকাপাকি বলে দিল যে সুগভীর সংকটের মুহূর্তে একজন সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটই তাদের প্রেসিডেন্ট হবেন। ফলে ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ র্নিবাচিত হন। দীর্ঘ ১৭ বছর পর দ্বিতীয় সোশ্যালিস্ট প্রেসিডেন্ট হিসেবে ওলাঁদ র্নিবাচিত হন। প্রথম সোশ্যালিস্ট প্রেসিডেন্ট ছিলেন ফ্রাঁসোয়া মিতেরাঁ। ওলাঁদ ফ্রান্সের পঞ্চম প্রজাতন্ত্রের সপ্তম প্রেসিডেন্ট (পঞ্চম প্রজাতন্ত্রÑ শার্ল দ্য গ্যল শাসনতন্ত্র্রের পরির্বতন ঘটিয়ে রাষ্ট্রপতির ¶মতা বৃদ্ধি করেন এবং দৈনন্দিন রাষ্ট্রীয় কার্যে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর অংশীদারিত্ব প্রর্বতন করেন। নতুন শাসনতন্ত্র চতুর্থ শাসনতন্ত্র বা চতুর্থ প্রজাতন্ত্রের স্থান নেয়, সৃষ্টি হয় পঞ্চম প্রজাতন্ত্রের)।
২০০৭ ও ২০১২ সালের নির্বাচনে বিজয়ীদের বিজয়ভোটের সংখ্যার দিকে তাকালে ল¶ণীয় পার্থক্য দেখা যায় না। ২০০৭ সালে নিকোলা সারকোজি মোটামুটি ৫২ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন, ২০১২ সালে ওলাঁদও মোটামুটি একই সংখ্যক ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। উভয় নির্বাচনে কম-বেশি ৮৪ শতাংশ ভোটদাতার অংশগ্রহণ স্থিতিশীল; আবার এত বিপুল সংখ্যকের অংশগ্রহণ প্রমাণ করে, ভোটদাতারা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের গুর“ত্বকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে।
সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের আদি প্রার্থী ছিলেন দমিনিক স্ত্রস-কান। ঐতিহাসিকভাবে ফরাসিরা যে দ্য গ্যলীয় কারিশমার ভক্ত, স্ত্রস-কানের তা ছিল; ছিলেন ক্যারিশম্যাটিক। বিদেশের ভ‚মিতে যদি তাকে অনাকাক্সি¶ত কেলেংকারিতে জড়ানো না হতো, তবে ওলাঁদ নয়, স্ত্রস-কানই প্রেসিডেন্ট হতেন। দলের জন্য স্ত্রস-কান কেলেংকারি ছিল বিরাট ধাক্কা এবং স্ত্রস-কানের বিকল্প ওলাঁদকে মনে হল যথেষ্ট নিষ্প্রভ। ফলে সারকোজির পুনর্নির্বাচনও প্রাথমিকভাবে আশাবাদ সৃষ্টি করে। আঞ্জেলা মার্কেল ও ডেভিড ক্যামেরনও তাই বিনাদ্বিধায় তাকে আগাম আশীর্বাদ করেন। ২০০৭ সালে ওলাঁদের সাবেক বান্ধবী সেগোলিন রয়েলকে পরাজিত করে সারকোজি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন; পাঁচ বছর বাদে, রয়েলের সাবেক পার্টনার ওলাঁদ সারকোজিকে পরাজিত করেন। ওলাঁদও রয়েলের একত্রে চারটি সš—ান রয়েছে। ২০০৭ সালের নির্বাচনের পরে তারা আলাদা হয়ে যান।
চোখধাঁধানো ব্যক্তিত্বের অধিকারী সারকোজি পরাজয় মেনে নিয়ে নিজেই সরকারিভাবে ঘোষণা করেন, ‘ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ ফ্রান্সের নতুন প্রেসিডেন্ট এবং তাকে আমাদের সবাইকে সম্মান করতে হবে। আমার এই পরাজয়ের দায়দায়িত্বের সবটুকু আমারই।’ পরে ফোন করে ব্যক্তিগতভাবেও ওলাঁদকে অভিনন্দন জানান। ওলাঁদ সম্পর্কে বলা হয়, তিনি বুদ্ধিমান, বিচ¶ণ, র্ধৈযশীল, সঙ্গতিপূর্ণ, পছন্দনীয়; আর তার রয়েছে ইস্পাতে তৈরি গোপন রক্তনালী।
সারকোজির সুনাম ছিল ওয়ার্কোহলিক হিসেবে; দ¶িণপন্থী সরকারের ¯^রাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে ইরাক যুদ্ধের সরব বিরোধী ছিলেন তিনি। ফরাসিরা তাতে খুশি হয়, কিন্তু ফ্রান্স যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অনেকটা দূরে সরে যায়। সেটা সারকোজি পুষিয়ে নেন ¯^তত্ত¡াবধানে লিবিয়া সংকটের সময়ে। নো ফ্লাই জোন থেকে শুর“ করে লিবীয় জাতীয় পরিষদের সংগঠন, সামরিক ও বেসামরিক সহায় সমর্থন প্রদান, বোমাবর্ষণের সূচনা, গাদ্দাফির পতন ও মৃত্যু পর্যš— সারকোজির নেতৃত্ব ছিল অবিস্মরণীয়। লিবীয় যুদ্ধ তাকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিজ¯^ সেনাবাহিনী ব্যাটল গ্র“পের কর্মদ¶তা আবারও প্রমাণ করার সুযোগ করে দেয়। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি সাহায্য ছাড়াই সামরিক শক্তিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন তথা ইউরোপের আÍনির্ভরশীলতার গুর“ত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। ইউরো-আটলান্টিকের রাজনৈতিক মহল তার এসব কাজকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করে। সরবে কিছু না বললেও বলা যায়, ফরাসিরা আবারও দ্য গ্যলীয় কারিশমার ঝলক দেখে। তবে সারকোজি ¯^য়ং অভিবাসীর সš—ান হলেও অভিবাসীদের তিনি ‘উচ্ছৃংখল জনতা’ বলে অভিহিত করেন। ফ্রান্সই পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যেখানে জাতির জš§ হওয়ার আগে সৃষ্টি হয় প্রজাতন্ত্রের। ফ্রান্সের নাগরিক মাত্রই তাই সহজেই ফরাসি বলে গণ্য হয়ে থাকে। বামপন্থীরা তাকে তিরস্কার তাচ্ছিল্য করে বলত ধনীর সংস্কৃতিবিহীন বন্ধু। চরম দ¶িণপন্থীরা বলত, কথা রাখে না এবং উদারপন্থীরা বলত, সংস্কার শুর“ করেও বন্ধ করে রেখেছে। ফ্রান্সের আলোড়িত, উত্তেজিত এ প্রেসিডেন্ট বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব হতে বাধ্য।
ইইউ’র দীর্ঘ অর্থনৈতিক সংকট ও মন্দা মোকাবেলায় একমাত্র সমাধান হিসেবে সারকোজির ফ্রান্স, মার্কেলের জার্মানিসহ ইইউ’র র¶ণশীল ডানপন্থী সরকারগুলো বাধ্যতামূলক সরকারি ব্যয় সংকোচনের নির্মম কৃচ্ছ্রসাধনের পন্থা বেছে নেয়। এই নীতি একদিকে যেমন চরম ডানপন্থীর সফল উত্থানকে উৎসাহিত করছে, অপরদিকে সাধারণ মানুষ সত্যিকার অর্থেই অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে। তার প্রকাশ ঘটে ‘অক্যুপাই’ মিছিল, তাঁবু গেড়ে অবস্থান ধর্মঘট, এনোনিমাস কর্তৃক ইইউ’র ও বিভিন্ন দেশের সরকারি ওয়েবসাইটের দখল ইত্যাদির মাধ্যমে। সারকোজির রাজনৈতিক অদৃষ্ট এমনই যে স্ত্রস-কানের বিকল্প ওলাঁদ কৃচ্ছ্রসাধনের বদলে গুর“ত্ব দেন প্রবৃদ্ধির ওপর; সংকট উত্তরণের নতুন ফর্মুলার কথা বলেন তিনি। ওলাঁদ তার বিজয় ভাষণে বলেন, ‘বলা প্রয়োজন যে কেবল কৃচ্ছ্রসাধনই আমাদের ভাগ্যের লিখন নয়। আমরা প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধি আনব, এ কথাই আমি আমাদের ইউরোপীয় বন্ধুদের বলব, তবে সবার আগে বলব জার্মানিকে।’ ওলাঁদের নির্বাচনী প্রতিশ্র“তিতে ছিল ৬০ হাজার শি¶কের পুনর্বহাল, কোন কোন পেশার ¶েত্রে অবসর গ্রহণের বয়স ৬২ বছর থেকে কমিয়ে ৬০ বছর করা এবং যাদের বার্ষিক আয় এক মিলিয়ন ইউরোর বেশি, তাদের ওপর বাড়তি আয়কর বসানো। ওলাঁদ নির্র্বাচিত হওয়ার ফলে ২৭ সদস্যের ইইউ’তে র¶ণশীল ডানপন্থী সরকারের সংখ্যা দাঁড়াল ২৫। কৃচ্ছ্রসাধনকে কেন্দ্র করে অনাস্থা ভোটে প্রথম র¶ণশীল ডানপন্থী সরকারের পতন ঘটে ¯োভাকিয়াতে, নির্বাচনে বামপন্থীরা ¶মতায় আসে। এ হিসেবে ফ্রান্স দ্বিতীয় দেশ। তবে ওলাঁদের বিজয়ের তাৎপর্য ভিন্ন। এক, ইইউ’র বাকি র¶ণশীল ডানপন্থী সরকারগুলো নিরš—র কৌশলগত চাপ অনুভব করতে বাধ্য। দ্বিতীয়ত, ইইউ’র মূল জীবনীশক্তি হল ফ্রান্স; আধুনিক ইইউ’র আর্কিটেক্ট ফ্রান্স। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর ফ্রান্স পরাজিত জার্মানিকে নিয়ে সৃষ্টি করে কয়লা ও ইস্পাত সংস্থা এবং আরও চারটি দেশকে নিয়ে সৃষ্টি করে সাধারণ বাজার। ফ্রান্সের রবার্ট শুম্যানের ও জাঁ মনাঁ’র নকশা অনুযায়ী এ দুই সংস্থা থেকে ইইউ নামের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানটির বা¯—বায়ন ঘটে ১৯৯৩ সালে।
ওলাঁদের ফ্রান্স তাই বাজেট সংক্রাš— ‘ফিসকাল চুক্তি’ নিয়ে কথা তুলতেই পারে। ফিসকাল চুক্তির মূলকথা হল কৃচ্ছ্রসাধনের মাধ্যমে ঋণমুক্ত ভারসাম্যের বাজেটে উপনীত হওয়া। অ্যাঞ্জেলা মার্কেলও তা জানেন। সারকোজি-মার্কেল ‘মেরকোজি’ অ¶ গড়ে তুলেছিলেন। ওলাঁদ-মার্কেল হয়তো জš§ দেবেন বন্ধুসুলভ অন্য কোন অ¶ের। ইউরো মুদ্রার ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিš—ার কারণ নেই। ইউরোর জš§ ও প্রচলনের প্রধান কারিগর ফ্রান্সই। তবে ইউরো-আটলান্টিক অঞ্চলের এই ক্রাšি—কালে ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদের ফ্রান্সের ভ‚মিকা কী হবে, তা র্পযবে¶ণের দাবি রাখে।
নাদিরা মজুমদার : প্রাগ প্রবাসী সাংবাদিক
হধফরৎধযসধলঁসফধৎ@মসধরষ.পড়স
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন