মুহাম্মদ রুহুল আমীন |
আ গামী ২৩ মে বাগদাদে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্সসহ ছয় পরাশক্তিধর দেশগুলো ইরানের সঙ্গে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ব্যাপারে সৃষ্ট জটিলতা নিরসনে এক চূড়ান্ত বৈঠকে বসতে যাচ্ছে। ইতিপূর্বে ‘পক্ষ বৃহত্ শক্তি+এক’ রাষ্ট্রসমূহ গত ১৪ এপ্রিল ইস্তাম্বুলে অনুরূপ এক বৈঠকে আলোচনা শেষে বাগদাদ বৈঠকের দিনক্ষণ ঠিক করেন। ইস্তাম্বুল বৈঠকের পূর্বে ইরানের উপর আরোপিত পাশ্চাত্য নিষেধাজ্ঞা আরো কঠোরতর করা হয়। এ প্রেক্ষিতে সংগত প্রশ্ন হলো: পাশ্চাত্য নিষেধাজ্ঞা আদৌ কার্যকর হবে কি না? বাগদাদ বৈঠকই বা কতটুকু সাফল্য বয়ে আনবে?
ইরানের বিতর্কপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচি বাধাগ্রস্ত করতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা ইরানের উপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা (restrictions) এবং অবরোধ (embargo) আরোপ করে চলেছে। গত ৩১ ডিসেম্বর প্রথমে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ইরানের তেল বিক্রির অর্থের সিংহভাগ আসে তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে এবং সে কারণে মার্কিনীরা মনে করছে এ নিষেধাজ্ঞা ইরানকে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন করবে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার প্রায় এক সপ্তাহ পর গত ৩ জানুয়ারি ব্রাসেলসে এক কূটনীতিক জানান, ২৭ রাষ্ট্রের ইউরোপীয় জোট ইইউ (EU) ইরান থেকে তেল রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপে একমত হয়েছে। গত ২২ জানুয়ারি ইইউ পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের ব্রাসেলস বৈঠকেই ইরান থেকে তেল আমদানি নিষিদ্ধ করায় সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ইইউ ভেবেছিল, ইরান যেহেতু তাদের কাছে মোট রপ্তানির ১৮ শতাংশ তেল বিক্রি করে, তাই এ নিষেধাজ্ঞা ইরানকে নানাভাবে বিপর্যস্ত করবে। একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ইরানী অর্থনীতির সমূহ বিপর্যয় ঘটিয়ে সামাজিক অস্থিতিশীলতা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে ইরানকে শায়েস্তা করার ‘নীল নকশা’ হিসেবে সাম্রাজ্যবাদী জোটের এ কৌশল মোকাবিলায় ইরান তার মানসিক মনোজাগতিক ও বাস্তবিক সকল প্রস্তুতি গ্রহণে পূর্ব থেকেই সার্বিক সতর্কতা অবলম্বন করে আসছিল।
একদিকে উপসাগরে সামরিক উত্তেজনা, অন্যদিকে ইরানে ইসরাইল ও পাশ্চাত্যের সম্ভাব্য আক্রমণ-হুমকি এবং এর বিরুদ্ধে ইরানের পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণের প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক সম্পকিয় শিক্ষার্থীদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো ইরানের বিরুদ্ধে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে কিনা এবং তা না হলে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক মানচিত্রে কি পরিবর্তন আসতে পারে। নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃবৃন্দ ইরান হতে তেল আমদানিকারী রাষ্ট্রসমূহ যেমন- চীন, ভারত, জাপানসহ অন্যত্র ঘন ঘন সফর করেছেন। মার্কিন অর্থমন্ত্রী টিমোথি গেইদনার মধ্য জানুয়ারিতে চীন ও জাপান সফর করলেও আশানুরূপ ফলাফল লাভ করতে পারেননি। প্রথমত, গত ৪ জানুয়ারি চীন দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছে যে, ইরানের বিরুদ্ধে যে কোন একতরফা নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে দেশটি অবস্থান গ্রহণ করবে। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশীয় মিত্র ভারতও ইরানী তেল আমদানি বন্ধ করবে না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে। চীন ও জাপানের পর ইরানী তেলের তৃতীয় বৃহত্ ক্রেতা দেশ ভারত ইরান থেকে ১২ শতাংশ তেল আমদানি করে থাকে। গত ব্রিকস সম্মেলনে মনমোহন সিং সরাসরি ইরানের শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচির পক্ষে ভারতের অবস্থান তুলে ধরেন। দ্বিতীয়ত, ইরান থেকে দ্বিতীয় বৃহত্ তেল ক্রয়কারী দেশ জাপান যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধ সরাসরি অস্বীকার না করলেও বেশ কৌশলে পাশ্চাত্যের দাবি পাশ কাটিয়ে গেছে। ইরান থেকে তেল আমদানি হ্রাসের ঘোষণা করলেও কি পরিমাণ এবং কখন থেকে তা হ্রাস করা হবে এমন স্পষ্ট কোন পরিসংখ্যান জাপান যুক্তরাষ্ট্রকে দেয়নি। জাপানের অর্থমন্ত্রী জুন আজমী যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব সচিব টিমোথির সংগে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ইরান থেকে তেল আমদানি কমাতে জাপান বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ নিবে। তাঁর এ বক্তব্য থেকে পাশ্চাত্যের তেমন কূটনৈতিক অর্জন মিলছে বলে অনুমিত হয় না।
তৃতীয়ত, ইইউ রাষ্ট্রসমূহ ইরানে তৈল অবরোধ বিষয়ের মাত্রা, বৈশিষ্ট্য, প্রকৃতি ও পরিধি নিয়ে বেশ মতপার্থক্যে নিমজ্জিত। যেমন: অর্থনৈতিক সংকটে নিপতিত গ্রীস ইরানের অবরোধের ফলে ভীষণ অর্থনৈতিক দুরবস্থার আশংকা জানিয়েছে। তেহরান থেকে বেশ সুবিধাপ্রাপ্ত গ্রীস ইরানী তেলের উপর নির্ভর করায় উন্নততর বিকল্প পাবে না বলে নিশ্চিত করেছে। সে কারণে দেশটি ইরানে আরোপিত অবরোধের সঙ্গে তেমন একমত প্রকাশ করেনি। গত ফেব্রুয়ারিতে ইরানের উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিকল্প বিষয়ে অনুষ্ঠিত প্যারিস বৈঠকে উপস্থিত কূটনীতিকদের সামনে ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট সারকেজি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছিলেন, ইরানে হস্তক্ষেপ চারদিকে ভয়ংকর যুদ্ধ ও অশান্তির আগুন জ্বালিয়ে দেবে। কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিকল্প অন্বেষণের কারণ এটাই যে, ইরান-অবরোধের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল লাভে ইইউ দেশগুলো নিশ্চিত ও একমত নয়।
চতুর্থত, ইরান অবরোধের বিষয়টিকে অন্য দেশগুলোও সহজভাবে গ্রহণ করেনি। অবরোধ আরোপের পর-পরই বিশ্ববাজারে তেলের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। বাংলাদেশ সরকারও ইতোমধ্যে তেলের মূল্য বাড়িয়েছে। শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসে মনে করেন যে, ইরান অবরোধের ফলে শ্রীলংকার মত ছোট দেশগুলো মারাত্মক অর্থ সংকটে নিপতিত হতে যাচ্ছে এবং এভাবে যুক্তরাষ্ট্র ছোট দেশগুলোকে শাস্তি দিচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। গত জানুয়ারিতে নিউইয়র্কের বাণিজ্যকেন্দ্রে ফেব্রুয়ারিতে সরবরাহ হবে এমন তেলের দাম ৬১ সেন্ট বেড়ে ব্যারেল প্রতি ১০১.৯২ ডলারে দাঁড়িয়েছে এবং ব্রেন্ট নর্থ সি তেলের দাম বেড়ে ব্যারেল প্রতি ১১২.৭৯ ডলারে উন্নীত হয়েছে।
উপরোক্ত কারণে একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, ইরানের বিরুদ্ধে যে অবরোধ আরোপ করা হয়েছে, তা তেমন কার্যকর ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রসহ ইইউ নেতাদের নানা তত্পরতা সত্ত্বেও ভারত ইরান থেকে তেল ক্রয়ে পিছপা হবে না বলে যে ঘোষণা দিয়েছে তা যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশীয় মিত্রের এক বড় অসহযোগিতার উদাহরণ। পাকিস্তানসহ অত্রাঞ্চলের অন্য রাষ্ট্রগুলোও ইরান অবরোধের বিরুদ্ধে যুক্তি তুলে ধরছে এবং স্পষ্ট যে, পাশ্চত্য নীতি প্রচণ্ড বৈশ্বিক প্রতিরোধের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের সময় ভারত যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষরে মুখ্য ভূমিকা পালনকারী কূটনৈতিক নিকোলাস বার্নস ইরান থেকে তেল ক্রয়ে ভারতের সিদ্ধান্তকে যুক্তরাষ্ট্রের গালে চপেটাঘাত বলে অভিহিত করেছেন।
দ্বিতীয়ত, পশ্চিমা নিরাপত্তা কর্মীরা পর্যবেক্ষণ করছেন যে, চীন ও তুরস্কের ব্যাংকিং খাতের সহায়তা নিয়ে ইরান প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয় করছে এবং এভাবে দেশটি জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা ফাঁকি দিতে সক্ষম হচ্ছে। তৃতীয়ত, ২০০৬ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ইরানের বিরুদ্ধে চারদফা নিষেধাজ্ঞার পরও জাতিসংঘ ইরানকে পর্যুদস্ত করতে সক্ষম হয়নি। প্রতীয়মান হচ্ছে ইরানের বিরুদ্ধে কোন নিষেধাজ্ঞা ইরানকে বশ করতে সক্ষম হবে না। চতুর্থত, যে কোন হুমকির মোকাবিলায় মনোকাঠামোগত দৃঢ়তা ও বাস্তবিক প্রস্তুতি কার্যকর প্রতিরোধ হিসেবে কাজ করে থাকে। অবরোধের বিরুদ্ধে ইরানের যে প্রস্তুতি রয়েছে সর্বাংশে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লা আলি খামেনি পশ্চিমা অবরোধের বিরুদ্ধে পাল্টা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। ইতিমধ্যে হরমুজ প্রণালীর কাছে নেমিহড়া পরিচালনার ঘোষণা দিয়েছে তেহরান। খামেনী ঘোষণা করেছেন, “পরমাণু কর্মসূচি পালনে আমাদের লক্ষ্য থেকে কখনো চ্যুত হবো না।” প্রেসিডেন্ট আহমাদিনেজাদও দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছেন যে, কোন নিষেধাজ্ঞা ইরানকে পারমাণবিক কর্মসূচির শান্তিময় কার্যক্রম থেকে বিরত রাখতে পারবে না। গত ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে ইরান পরমাণু স্থাপনা সুরক্ষায় চারদিনব্যাপী সামরিক মহড়া শুরু করছে।পঞ্চমত, পাশ্চাত্য নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বারবার ইরান তার প্রযুক্তিগত সাফল্য প্রদর্শন করছে। ইতিমধ্যে মার্কিন ড্রোন ভূপাতিত করে তার অনুকরণে ইরানী ড্রোন বিমান নির্মাণ করেছে। ১১ ফেব্রুয়ারি তেহরানের আযাদী স্কোয়ারে আহমাদিনেজাদ ঘোষণা করেন, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার সামনে ইরান কখনো মাথা নত করবে না। কেবলমাত্র ইরানকে উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করে গ্রহণযোগ্য আলোচনায় বসলে ইরান প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিবে বলে ইরানী বটমলাইন চিহ্নিত করেন। কিছুদিন আগে ইরানের পারস্য উপসাগরে ইরানী নৌবাহিনীর সামরিক মহড়া ১০ দিন ধরে চালানোর পর এ বছরের প্রথম সপ্তাহে ইরান সফলভাবে ২টি জাহাজ বিধ্বংসী দূরপাল্লার ক্রজ ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালায়। এর একদিন আগে হরমুজ প্রণালীর কাছে মাঝারিপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার সফল সমাপ্তি টানা হয়। সাগরের তলদেশে দীর্ঘ সময় ধরে অভিযান পরিচালনায় সক্ষম ‘গাদির’ নামক সাবমেরিন ২০০৭ সালে অবস্থিত হলেও ইরানের নৌবাহিনীতে আরো দু’টি গাদির সাবমেরিন যুক্ত হয়েছে। নতুন এ সাবমেরিনে উন্নত রাডার ব্যবস্থাসহ সব ধরনের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম রয়েছে। উপরোক্ত আলোচনার আলোকে বলা যায় যে ইরানের উপর কোনরকম অবরোধ পশ্চিমাদের একক স্বার্থ অর্জনে সক্ষম হবে না। ইরান ইতোমধ্যে ইউরোপে তেল বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে, যা ইইউ রাষ্ট্রগুলোকে চরম অপমান করে তার নেতৃবৃন্দের মনোবল ভেঙে দিয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
এমতাবস্থায়, আসন্ন বাগদাদ বৈঠকে সাফল্যের প্রথম ও পূর্বশর্ত হলো পারস্পরিক সম্মান ও সৌজন্য রক্ষার আন্তর্জাতিক রীতি-নীতি বজায় রেখে শান্তিপূর্ণ আলোচনায় ইরানকে মানসিকভাবে তৈরি করা। দ্বিতীয়ত, শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক লক্ষ্যার্জনে আন্তর্জাতিক আইনের বাইরে স্বার্থান্ধ বাস্তববাদী নীতি (selfish realism) ইরানের উপর চাপিয়ে দেয়ার নীতি পরিহার করা একান্ত জরুরী। তৃতীয়ত, শত্রুরাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা না করে প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি হিসেবে পারস্য উপসাগরে ইরানের ঐতিহাসিক মর্যাদা ও জত্যাভিমানের বাস্তবিক (realist )স্বীকৃতি আন্তর্জাতিক নীতির মাপকাঠিতে নিরূপণ করাও প্রয়োজন। অযৌক্তিক হুমকি-ধামকি, অযৌক্তিক অবরোধ এবং বিশেষ করে আন্তর্জাতিক আইনের পথভ্রষ্ট পাশ্চাত্যের স্বভাবসুলভ সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র এবং পররাজ্যগ্রাসী লোলুপনীতি উপসাগরীয় অঞ্চলে পাশ্চাত্যের স্বার্থরক্ষায় তেমন কার্যকর ভূমিকা রাখবে না বলেই মনে হয়। আসন্ন বাগদাদ বৈঠকে যোগদানের পূর্বে পাশ্চাত্য দেশগুলোকে এ বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখতে হবে বাগদাদ বৈঠকে সাফল্যজনক প্রাপ্তি অর্জনের লক্ষ্যে।
++লেখক: সহযোগী অধ্যাপক
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
mramin68@yahoo.co
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন