ফারুক চৌধুরী | তারিখ: ৩০-০৫-২০১২
আমাদের এ অঞ্চলের অনেক দেশের মতো বার্মার (মিয়ানমার) স্বাধীনতাও এসেছে রক্তঝরা পথে। জেনারেল অং সান ছিলেন সেই দেশের মুক্তিযুদ্ধে অগ্রণী ভূমিকা রাখা মুক্তিযোদ্ধা, যাঁর একনিষ্ঠ নেতৃত্ব ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের ৪ জানুয়ারি ১৯৪৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে সেই দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করতে বাধ্য করেছিল। কিন্তু দুঃখের কথা এই যে মিয়ানমারের স্বাধীনতা লাভের মাত্র ছয় মাস আগে, ১৯৪৭-এর জুলাই মাসে তাঁকে অন্য বেশ কজন সহযোগীর সঙ্গে প্রাণ হারাতে হলো, সশস্ত্র কিছু বিভ্রান্ত সৈনিকের অতর্কিত আক্রমণে। তখন জেনারেল অং সানের পরিবারের তৃতীয় সন্তান ও একমাত্র মেয়ে অং সান সু চির বয়স মাত্র দুই। ফুটফুটে, গৌরবর্ণা, সুদর্শনা এ মেয়েটির ঘটা করে নাম রাখা হয়েছিল তাঁর বাবা ‘অং সান’, পিতামহী ‘সু’ আর মা ‘চি’-এর নাম মিলিয়ে—অং সান সু চি। দুই বছর বয়সেই মেয়েটি হলো পিতৃহারা। এই নিবন্ধটি এই মেয়েটির অদম্য সাহস আর অনাবিল ভালোবাসার বিষাদ মাখা বিজয়েরই একটি হূদয় নিংড়ানো বিরল কাহিনি।
স্বামীর মৃত্যুর পর পরিবারের হাল ধরে রাখলেন অং সান সু চির মা খিন চি। নব্যস্বাধীন এই দেশটির কর্মকাণ্ডে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখলেন, একসময়ে রেঙ্গুন জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র নার্স আর বীর মুক্তিযোদ্ধা অং সানের স্ত্রী, খিন চি। তাঁর ভূমিকার স্বীকৃতিতে সরকার ১৯৬০ সালে তাঁকে ভারতে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত করল। তাঁর একমাত্র মেয়ে, কিশোরী অং সান সু চি নয়াদিল্লিতেই তাঁর স্কুলশিক্ষা শেষ করলেন এবং দিল্লির বিখ্যাত লেডি শ্রীরাম কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করলেন ১৯৬৪ সালে। তখন তাঁর বয়স মাত্র উনিশ।
একটি ব্রিটিশ পরিবারের সঙ্গে অন্তরঙ্গতা ও বন্ধুত্ব প্রভাবিত করল; এক অর্থে ঘুরিয়ে দিল তাঁর জীবনের মোড়। ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত লর্ড পল গোর-বুথ নামক একজন পেশাদার কূটনীতিক মিয়ানমারে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ভারতে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেন ১৯৫৬ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত। ১৯৬০ সালেই অং সান সু চির মা নয়াদিল্লিতে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হলেন। প্রথমে রেঙ্গুনে আর তারপর আবার দেখা নয়াদিল্লিতে। এভাবেই এই দুই পরিবারের মধ্যে গড়ে উঠল সম্পর্ক ও ঘনিষ্ঠতা।
১৯৬৪ সালে অং সান সু চি অক্সফোর্ডের সেন্ট হিউজ কলেজে তাঁর স্নাতক ডিগ্রি লাভের জন্য ভর্তি হলেন এবং সেই সময়ে বিলেতে অং সান সু চির অভিভাবক ছিলেন লর্ড পল গোর-বুথ। এই লর্ড পল গোর-বুথের লন্ডনের বাড়িতেই অং সান সু চির দেখা হলো মাইকেল এরিস বলে একজন যুবকের সঙ্গে, যিনি ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের ছাত্র ছিলেন। প্রাচ্য, বিশেষ করে ভুটান সম্পর্কে মাইকেল এরিসের ছিল অসীম আগ্রহ। সু চির মধ্যেই যেন মাইকেল এরিস খুঁজে পেলেন প্রাচ্যের প্রতি তাঁর আকর্ষণের মূর্ত প্রকাশ। পরিচয় পরিণত হলো ভালোবাসায়। সু চি তখন অক্সফোর্ডের সেন্ট হিউজ কলেজের ছাত্রী। সেই অক্সফোর্ডের রয়েছে ছায়াঘেরা নিরিবিলি নান্দনিক অ্যাডিসন ওয়াক। যে পথে তাঁদের নিজ নিজ সময়ে বিচরণ ছিল সি এস লুইস, ওসকার ওয়াইল্ড আর লরেন্স অব অ্যারাবিয়ার মতো স্বনামধন্য কত মানুষের। সেই পথেই মাইকেল এরিস আর অং সান সু চি ঘুরে বেড়াতেন, পথটির মাঝপথে পাথরের তৈরি বেঞ্চে বসে তাঁরা অবলোকন করতেন আকাশকে রাঙিয়ে দিয়ে অদূরের মডলিন কলেজের টাওয়ারটির ওধারে সূর্যের ডুবে যাওয়া। প্রাচ্য আর পাশ্চাত্য মিশে যেত সূর্যডুবা আকাশের সেই রক্তিম আভায়। ২০১১ সালে অক্সফোর্ডের সেন্ট হিউজ কলেজের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী পালিত হলো। সেই উপলক্ষে অং সান সু চি তাঁর পাঠানো এক বাণীতে বলেছিলেন, ‘সুখের মুহূর্তগুলোই দুঃখে সাহস জোগায়। সেন্ট হিউজ আর অক্সফোর্ড আমার স্মৃতিতে চির অমলিন। চারধারে পৃথিবী যখন আঁধার হয়ে আসে, সেই স্মৃতি থেকেই আমি বিশ্বের শোভা আহরণ করি।’ অং সান সু চির অক্সফোর্ডের পালা শেষ হলো। তখন মাইকেল এরিস ভুটানের রাজপরিবারের সদস্যদের শিক্ষক হিসেবে এবং সেই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুবাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। সেই ভুটানেই মাইকেল এরিস অং সান সু চির পাণিপ্রার্থী হলেন। মাইকেল এরিসের কথায়, তাঁদের বিয়ের আগে আট মাসে সু চি তাঁকে ১৮৭টি চিঠি লিখেছিলেন। সেই সব চিঠিতে প্রায়ই একটি কথা থাকত যে যদি অং সান সু চির মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার কোনোদিন প্রয়োজন পড়ে, তাহলে কোনো দাবির নিরিখে নয়, অনুগ্রহ হিসেবেই মাইকেল এরিস যেন তাঁকে সেখানে যেতে দেন। কিন্তু সেই যাওয়া যে একদিন চিরদিনের জন্য হবে, তা তো ভালোবাসার গভীরতায় তাঁদের কল্পনাতেও ছিল না।
১৯৭২-এর ১ জানুয়ারি তাঁদের বিয়ে হলো। নববিবাহিত দম্পতি ঘুরে বেড়ালেন, ভুটান, নেপাল, অরুণাচল আর হিমাচল প্রদেশে। তাঁদের বিয়ে হয়েছিল সেই অঞ্চলের শীতের তুষার শুভ্রতায়। কিন্তু বসন্তে সেই অঞ্চল ফুলে ফুলে সমৃদ্ধ। আপেল আর চেরি ফুলের সম্ভার। হাইবাসকাস ফুলের ঝালর। ‘উদ্ধত যত শাখার শিখরে রডোডেনড্রনগুচ্ছ’, আর হেমন্তে সেই অঞ্চল ফলভারে পরিপক্ব। আপেল, পিচ, চেরি, নাশপাতি, প্লাম। ফলের অবিশ্বাস্য প্রাচুর্য। এর মাঝেই প্রগাঢ় হলো এই দম্পতিটির প্রেম। অক্সফোর্ডে ফিরে গেলেন তাঁরা। মাইকেল এরিস তখন অক্সফোর্ডের সেন্ট এনথনি কলেজের রিসার্চ ফেলো। তার পরের ১৬টি বছর অং সান সু চি আদর্শ গৃহবধূর জীবন যাপন করলেন। তাঁদের দুই সন্তান আলেকজান্ডার আর কিমকে বড় করে তোলার দায়িত্ব নিজ হাতে নিলেন। তাঁদের নিয়ে ঘুরে বেড়ালেন জাপান আর ভারত। এদিকে নিজের লেখাপড়াও অব্যাহত রাখলেন তিনি এবং উচ্চতর ডিগ্রির জন্য ভর্তি হলেন লন্ডন স্কুল অব ওরিয়েন্টাল স্টাডিজে। অক্সফোর্ডের প্রশান্ত সেই পরিবেশে জ্ঞানপিপাসু এই দম্পতিটির নিরিবিলি জীবন ছিল একান্তই উপভোগ্য।
১৯৮৮ সালের ৩১ মার্চের সন্ধ্যা। তাঁদের অক্সফোর্ডের বাড়িতে টেলিফোন বাজল। রেঙ্গুন থেকে পাওয়া এই টেলিফোনে তাঁরা জানলেন যে অং সান সু চির মা খিন চির স্ট্রোক হয়েছে। টেলিফোন পাওয়ার পরপরই একটি স্যুটকেসে কাপড় গুছিয়ে রেঙ্গুনে প্লেন ধরলেন অং সান সু চি। মাইকেল এরিস আর অং সান সু চি তখন কল্পনাই করেননি যে এই যাওয়াই তাঁদের স্বাভাবিক দাম্পত্যজীবনের অবসান ঘটাবে, ইতি টানবে তাঁদের শান্তি-সুখের জীবনের।
রেঙ্গুনে ফিরে অং সান সু চি দেখলেন যে তাঁর দেশে এক অশান্ত পরিবেশ বিরাজ করছে। সামরিক বাহিনীর সঙ্গে গণতন্ত্রকামী জনতার সংঘর্ষ দেশের স্বাভাবিক জীবন অচল করে দিয়েছে। তাঁর মা যে হাসপাতালে ছিলেন, তা ভরে গেছে আহত আর মুমূর্ষূ ছাত্র-জনতার ভিড়ে। অং সান সু চির মিয়ানমার প্রত্যাবর্তনের খবর ছড়িয়ে পড়ল চারধারে। মুক্তিযাদ্ধা বীর অং সানের মেয়ে অং সান সু চি। তাঁর কাছে অসহায় মানুষের প্রত্যাশা অনেক। মিয়ানমারের শিক্ষাবিদদের একটি প্রতিনিধিদল তাঁকে দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার আহ্বান জানাল। এই আবেদন অং সান সু চি কিছুতেই প্রত্যাখ্যান করতে পারলেন না। তিনি সেই দায়িত্ব গ্রহণ করতে রাজি হলেন এবং ২৪টি বছর সব ঘাত-প্রতিঘাতের মাঝেও এই লৌহমানবী তাঁর দায়িত্ব পালনে এখনো আছেন অবিচল।
অক্সফোর্ডে বসে মাইকেল এরিসের ভয় যে তাঁর বাবার মতো অং সান সু চিকে যেন আততায়ীর হাতে প্রাণ হারাতে না হয়। ১৯৮৯ সালে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা তাদের দমন-পীড়নের নীতিতে অং সান সু চিকে গৃহবন্দী করল। তাতে হাঁফ ছেড়েই যেন বাঁচলেন মাইকেল এরিস, এই ভেবে যে তা অন্তত তাঁর স্ত্রীর জীবনটি রক্ষা করবে। এদিকে মাইকেল এরিসও পাশ্চাত্যে মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কথা তুলে ধরতে সচেষ্ট রইলেন। ১৯৯০ সালে মিয়ানমারে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। তাতে ৮২ শতাংশ আসনে জয়লাভ করল অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফল কোনো আমলেই আনল না মিয়ানমারের সামরিক শাসকচক্র। সংগ্রামে অটল রইলেন অং সান সু চি। কখনো বা তাঁকে ঢিলেভাবে গৃহবন্দী করে রাখা হলো, কখনো বা চরম নির্মমতায়। বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিন্ন করে দেওয়া হলো। অং সান সু চির সংগ্রাম সারা পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ১৯৯০ সালেই তিনি রাফটো মানবাধিকার পুরস্কার লাভ করলেন। ১৯৯১ সালে সু চি ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সাখারভ মানবাধিকার পুরস্কার পেলেন। সেই বছরের অক্টোবরেই লাভ করলেন নোবেল শান্তি পুরস্কার। তিনি তাঁর ১ দশমিক ৩ মিলিয়ন ডলারের সেই পুরস্কারটি মিয়ানমারের জনগণের জন্য স্বাস্থ্য ও শিক্ষাক্ষেত্রে ট্রাস্ট গঠনে ব্যবহার করবেন বলে ঘোষণা দিলেন। তাঁর স্বামী মাইকেল এরিস সেই বছরগুলোতে তাঁর দুই সন্তানকে দেখাশোনা করার সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করলেন। ১৯৯১-এ সু চির নোবেল পুরস্কার পাওয়ার বছরে মাইকেল এরিস যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসরের দায়িত্ব পালন করছিলেন।
১৯৯৫ সালের ক্রিসমাসের সময়ে মাইকেল এরিস তাঁর স্ত্রীর কাছ থেকে পেলেন একটি অপ্রত্যাশিত টেলিফোন। সামরিক জান্তা তাঁকে মুক্তি দিয়েছে এবং মাইকেল এরিস আর তাঁর দুই সন্তানকে মিয়ামনমারের ভিসা দেওয়া হয়েছে। ছোট ছেলে কিমকে দেখে তো অং সান সু চি বলেই ফেললেন যে বাড়ন্ত তাঁর ছেলেটিকে এতই অপরিচিত লাগছে যে রাস্তায় দেখা হলে তিনি তাঁর পাশ কাটিয়ে যেতেন। অবশ্য এটা সবার কাছে স্পষ্ট ছিল যে সামরিক জান্তার সু চিকে মুক্তি আর তাঁর পরিবারকে ভিসা দেওয়ার উদ্দেশ্য একটিই। তা হলো, অং সান সু চি তাঁদের সঙ্গেই ফিরে যাবেন। কিন্তু অং সান সু চি গণতন্ত্রের জন্য তাঁর সংগ্রামে এতই জড়িত এবং তাঁর প্রত্যয় এতই দৃঢ় যে তিনি স্থির করলেন, কিছুতেই দেশত্যাগ করবেন না। তা করলে তাঁকে আর ফিরতে দেবে না সামরিক জান্তা। তাই পরিবারের সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ যতই দীর্ঘায়িত হোক না কেন, রেঙ্গুনেই তাঁর অবস্থানে তিনি অনড় রইলেন। ১৯৯৫ সালে মিয়ানমারে তাঁর পরিবারের সেই সফরটিই ছিল স্বামী মাইকেল এরিসের সঙ্গে অং সান সু চির শেষ দেখা।
১৯৯৮ সালে মাইকেল এরিস জানলেন যে তাঁর প্রোস্টেট ক্যানসার হয়েছে এবং তা অন্তিম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। তিনি রেঙ্গুন গিয়ে তাঁর স্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নিতে চাইলেন। ভিসার জন্য অন্তত ৩০ বার তিনি আবেদন করলেন। মিয়ানমার সরকার তা প্রত্যাখ্যান করল। পোপ এবং প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনও মাইকেল এরিসকে ভিসা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন। তাও উপেক্ষিত হলো। অং সান সু চিকে বলা হলো, তিনি অক্সফোর্ডে গিয়ে তাঁর স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে পারবেন। সু চি জানতেন যে তাঁর দেশত্যাগ মানেই নির্বাসন। সু চি তাঁর স্বামীকে ব্রিটিশ দূতাবাস থেকে টেলিফোন করতেন। মাইকেল এরিসও তাঁকে দেশত্যাগ না করার জন্য বলতেন এই কারণে যে তাহলে তাঁর আর দেশে ফেরা হবে না। গণতন্ত্রের জন্য অং সান সু চির আত্মত্যাগ তাহলে ভেস্তে যাবে। সু চির সামনে তখন প্রশ্ন একটি। স্বামী না দেশ। অং সান সু চি নিজেই বলেছেন যে তাঁর প্রতি স্বামীর গভীর ভালোবাসা আর সহমর্মিতাই তাঁকে দেশত্যাগ না করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। আর দেখা হলো না অসাধারণ এই স্বামী আর তাঁর সংগ্রামী স্ত্রীর। ১৯৯৯ সালের ২৭ মার্চ তাঁর ৫৩তম জন্মদিনে মাইকেল এরিস শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। মাইকেল এরিসের মৃত্যুর কদিন আগে সু চি যখন নিশ্চিত যে স্বামীর সঙ্গে আর তাঁর দেখা হবে না কোনোদিন, ব্রিটিশ দূতাবাসে গিয়ে তিনি শেষ বিদায় জানিয়ে একটি ফিল্ম রেকর্ড করেছিলেন। সেদিন তাঁর পরনে ছিল তাঁর স্বামীর প্রিয় রঙের পোশাক আর খোঁপায় গোঁজা ছিল লাল গোলাপ। কিন্তু নিয়তি এতই নির্মম যে ফিল্মটি বিলেত পৌঁছাল মাইকেল এরিসের মৃত্যুর দুই দিন পরে।
এদিকে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা দেশের গণতন্ত্রায়ণে পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে। এই বছর অর্থাৎ ২০১২ সালের এপ্রিলের ১ তারিখে মিয়ানমার পার্লামেন্টের দুই কক্ষের ৪৬টি আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তার মধ্যে সু চির ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি ৪৪টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৪৩টিতে বিজয়ী হয়েছে। অং সান সু চি মিয়ানমারের ৪৪০ সদস্যের প্রতিনিধি সভায় (হাউস অপ রিপ্রেজেনটেটিভস) সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন এবং ২ মে, ২০১২ সালে শপথ গ্রহণ করেছেন। ঘোষণা করা হয়েছে যে অবশেষে ২৪ বছর পর অং সান সু চি মিয়ানমারের বাইরে পা রাখবেন। তিনি ব্যাংককে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম পূর্ব এশিয়ার সভায় অংশ নেওয়ার জন্য ব্যাংকক যাবেন ৩০ মে। মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট থেইন সেইনও সেই সভায় যোগ দেবেন। এই মাসেই সু চিকে পাসপোর্ট প্রদান করা হয়েছে। এতে মনে হচ্ছে যে মিয়ানমার সরকারের সংস্কার পদক্ষেপগুলো সম্বন্ধে অং সান সু চি এখন আস্থাবান। তাই তিনি এই যাত্রায় দেশত্যাগ করতে দ্বিধা করছেন না।
তারপর রয়েছে নাটকীয় আর পরিতৃপ্তিদায়ক কিছু খবর। জানা গেছে, আগামী ১৬ জুন অং সান সু চি নরওয়ের অলসোতে যাবেন, ১৯৯১ সালে তাঁকে প্রদত্ত নোবেল পুরস্কার নিজ হাতে গ্রহণ করতে। কিন্তু তার চেয়েও হূদয়ছোঁয়া আর সন্তুষ্টির খবর হচ্ছে, আগামী ২০ জুন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করবে। ২৪ বছর আগে ১৯৮৮ সালে তাঁর মায়ের অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে তিনি অক্সফোর্ড ত্যাগ করেছিলেন। চিরদিনের জন্য তাঁর অজান্তে যবনিকা পড়েছিল তাঁর স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবনের। তাঁকে অক্সফোর্ডের ডিগ্রি প্রদানের তাৎপর্যটি অবশ্যই হূদয় ছুঁয়ে যায়। তাঁর স্বামী বিলেতে চিরনিদ্রায় শায়িত। সেই দেশের প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরনের আমন্ত্রণে তিনি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভাষণ দেবেন ২১ জুন। বেঁচে থাকলে মাইকেল এরিসের বয়স মাত্র ৬৬ বছর হতো। তাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভাষণ দেওয়ার সন্তুটির সঙ্গে অং সান সু চির মনে মিশে থাকবে তাঁর বন্দী অবস্থায় স্বামী হারানোর বেদনা।
মিয়ানমারে গণতন্ত্রের বিবর্তন সম্বন্ধে শেষকথা বলার সময় হয়তো আসেনি। ১৯৮৮ সালে অং সান সু চি বলেছিলেন, ‘আমার বাবার কন্যা হিসেবে আমার দেশে যা ঘটবে তা সম্বন্ধে আমি উদাসীন থাকতে পারি না।’ কিছুদিন আগে তিনি বলেছেন, ‘আমরা সতর্ক, তবে আশাবাদী।’ যদি এখন মিয়ানমারে শুধু নির্বাচন নয়, অর্থবহ গণতন্ত্র আর মানবাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়, তাহলে অর্জনের মাপকাঠিতে আমাদের সময়ের রাজনৈতিক বিবর্তনের ইতিহাসে অং সান সু চির স্থান নেলসন ম্যান্ডেলার পাশেই হয়তো রইবে।
তবে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, মিয়ানমারের মানুষের মুক্তির সংগ্রামে আপাতত ভালোবাসার জয় হয়েছে। দেশের প্রতি অসীম সাহসী অং সান সু চির অনাবিল ভালোবাসার আর জয় হয়েছে অং সান সু চির প্রতি তাঁর অসাধারণ স্বামী মাইকেল এরিসের সহমর্মী ভালোবাসার।
ফারুক চৌধুরী: সাবেক পররাষ্ট্রসচিব। কলাম লেখক।
zaaf@bdmail.net
স্বামীর মৃত্যুর পর পরিবারের হাল ধরে রাখলেন অং সান সু চির মা খিন চি। নব্যস্বাধীন এই দেশটির কর্মকাণ্ডে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখলেন, একসময়ে রেঙ্গুন জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র নার্স আর বীর মুক্তিযোদ্ধা অং সানের স্ত্রী, খিন চি। তাঁর ভূমিকার স্বীকৃতিতে সরকার ১৯৬০ সালে তাঁকে ভারতে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত করল। তাঁর একমাত্র মেয়ে, কিশোরী অং সান সু চি নয়াদিল্লিতেই তাঁর স্কুলশিক্ষা শেষ করলেন এবং দিল্লির বিখ্যাত লেডি শ্রীরাম কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করলেন ১৯৬৪ সালে। তখন তাঁর বয়স মাত্র উনিশ।
একটি ব্রিটিশ পরিবারের সঙ্গে অন্তরঙ্গতা ও বন্ধুত্ব প্রভাবিত করল; এক অর্থে ঘুরিয়ে দিল তাঁর জীবনের মোড়। ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত লর্ড পল গোর-বুথ নামক একজন পেশাদার কূটনীতিক মিয়ানমারে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ভারতে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেন ১৯৫৬ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত। ১৯৬০ সালেই অং সান সু চির মা নয়াদিল্লিতে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হলেন। প্রথমে রেঙ্গুনে আর তারপর আবার দেখা নয়াদিল্লিতে। এভাবেই এই দুই পরিবারের মধ্যে গড়ে উঠল সম্পর্ক ও ঘনিষ্ঠতা।
১৯৬৪ সালে অং সান সু চি অক্সফোর্ডের সেন্ট হিউজ কলেজে তাঁর স্নাতক ডিগ্রি লাভের জন্য ভর্তি হলেন এবং সেই সময়ে বিলেতে অং সান সু চির অভিভাবক ছিলেন লর্ড পল গোর-বুথ। এই লর্ড পল গোর-বুথের লন্ডনের বাড়িতেই অং সান সু চির দেখা হলো মাইকেল এরিস বলে একজন যুবকের সঙ্গে, যিনি ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের ছাত্র ছিলেন। প্রাচ্য, বিশেষ করে ভুটান সম্পর্কে মাইকেল এরিসের ছিল অসীম আগ্রহ। সু চির মধ্যেই যেন মাইকেল এরিস খুঁজে পেলেন প্রাচ্যের প্রতি তাঁর আকর্ষণের মূর্ত প্রকাশ। পরিচয় পরিণত হলো ভালোবাসায়। সু চি তখন অক্সফোর্ডের সেন্ট হিউজ কলেজের ছাত্রী। সেই অক্সফোর্ডের রয়েছে ছায়াঘেরা নিরিবিলি নান্দনিক অ্যাডিসন ওয়াক। যে পথে তাঁদের নিজ নিজ সময়ে বিচরণ ছিল সি এস লুইস, ওসকার ওয়াইল্ড আর লরেন্স অব অ্যারাবিয়ার মতো স্বনামধন্য কত মানুষের। সেই পথেই মাইকেল এরিস আর অং সান সু চি ঘুরে বেড়াতেন, পথটির মাঝপথে পাথরের তৈরি বেঞ্চে বসে তাঁরা অবলোকন করতেন আকাশকে রাঙিয়ে দিয়ে অদূরের মডলিন কলেজের টাওয়ারটির ওধারে সূর্যের ডুবে যাওয়া। প্রাচ্য আর পাশ্চাত্য মিশে যেত সূর্যডুবা আকাশের সেই রক্তিম আভায়। ২০১১ সালে অক্সফোর্ডের সেন্ট হিউজ কলেজের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী পালিত হলো। সেই উপলক্ষে অং সান সু চি তাঁর পাঠানো এক বাণীতে বলেছিলেন, ‘সুখের মুহূর্তগুলোই দুঃখে সাহস জোগায়। সেন্ট হিউজ আর অক্সফোর্ড আমার স্মৃতিতে চির অমলিন। চারধারে পৃথিবী যখন আঁধার হয়ে আসে, সেই স্মৃতি থেকেই আমি বিশ্বের শোভা আহরণ করি।’ অং সান সু চির অক্সফোর্ডের পালা শেষ হলো। তখন মাইকেল এরিস ভুটানের রাজপরিবারের সদস্যদের শিক্ষক হিসেবে এবং সেই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুবাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। সেই ভুটানেই মাইকেল এরিস অং সান সু চির পাণিপ্রার্থী হলেন। মাইকেল এরিসের কথায়, তাঁদের বিয়ের আগে আট মাসে সু চি তাঁকে ১৮৭টি চিঠি লিখেছিলেন। সেই সব চিঠিতে প্রায়ই একটি কথা থাকত যে যদি অং সান সু চির মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার কোনোদিন প্রয়োজন পড়ে, তাহলে কোনো দাবির নিরিখে নয়, অনুগ্রহ হিসেবেই মাইকেল এরিস যেন তাঁকে সেখানে যেতে দেন। কিন্তু সেই যাওয়া যে একদিন চিরদিনের জন্য হবে, তা তো ভালোবাসার গভীরতায় তাঁদের কল্পনাতেও ছিল না।
১৯৭২-এর ১ জানুয়ারি তাঁদের বিয়ে হলো। নববিবাহিত দম্পতি ঘুরে বেড়ালেন, ভুটান, নেপাল, অরুণাচল আর হিমাচল প্রদেশে। তাঁদের বিয়ে হয়েছিল সেই অঞ্চলের শীতের তুষার শুভ্রতায়। কিন্তু বসন্তে সেই অঞ্চল ফুলে ফুলে সমৃদ্ধ। আপেল আর চেরি ফুলের সম্ভার। হাইবাসকাস ফুলের ঝালর। ‘উদ্ধত যত শাখার শিখরে রডোডেনড্রনগুচ্ছ’, আর হেমন্তে সেই অঞ্চল ফলভারে পরিপক্ব। আপেল, পিচ, চেরি, নাশপাতি, প্লাম। ফলের অবিশ্বাস্য প্রাচুর্য। এর মাঝেই প্রগাঢ় হলো এই দম্পতিটির প্রেম। অক্সফোর্ডে ফিরে গেলেন তাঁরা। মাইকেল এরিস তখন অক্সফোর্ডের সেন্ট এনথনি কলেজের রিসার্চ ফেলো। তার পরের ১৬টি বছর অং সান সু চি আদর্শ গৃহবধূর জীবন যাপন করলেন। তাঁদের দুই সন্তান আলেকজান্ডার আর কিমকে বড় করে তোলার দায়িত্ব নিজ হাতে নিলেন। তাঁদের নিয়ে ঘুরে বেড়ালেন জাপান আর ভারত। এদিকে নিজের লেখাপড়াও অব্যাহত রাখলেন তিনি এবং উচ্চতর ডিগ্রির জন্য ভর্তি হলেন লন্ডন স্কুল অব ওরিয়েন্টাল স্টাডিজে। অক্সফোর্ডের প্রশান্ত সেই পরিবেশে জ্ঞানপিপাসু এই দম্পতিটির নিরিবিলি জীবন ছিল একান্তই উপভোগ্য।
১৯৮৮ সালের ৩১ মার্চের সন্ধ্যা। তাঁদের অক্সফোর্ডের বাড়িতে টেলিফোন বাজল। রেঙ্গুন থেকে পাওয়া এই টেলিফোনে তাঁরা জানলেন যে অং সান সু চির মা খিন চির স্ট্রোক হয়েছে। টেলিফোন পাওয়ার পরপরই একটি স্যুটকেসে কাপড় গুছিয়ে রেঙ্গুনে প্লেন ধরলেন অং সান সু চি। মাইকেল এরিস আর অং সান সু চি তখন কল্পনাই করেননি যে এই যাওয়াই তাঁদের স্বাভাবিক দাম্পত্যজীবনের অবসান ঘটাবে, ইতি টানবে তাঁদের শান্তি-সুখের জীবনের।
রেঙ্গুনে ফিরে অং সান সু চি দেখলেন যে তাঁর দেশে এক অশান্ত পরিবেশ বিরাজ করছে। সামরিক বাহিনীর সঙ্গে গণতন্ত্রকামী জনতার সংঘর্ষ দেশের স্বাভাবিক জীবন অচল করে দিয়েছে। তাঁর মা যে হাসপাতালে ছিলেন, তা ভরে গেছে আহত আর মুমূর্ষূ ছাত্র-জনতার ভিড়ে। অং সান সু চির মিয়ানমার প্রত্যাবর্তনের খবর ছড়িয়ে পড়ল চারধারে। মুক্তিযাদ্ধা বীর অং সানের মেয়ে অং সান সু চি। তাঁর কাছে অসহায় মানুষের প্রত্যাশা অনেক। মিয়ানমারের শিক্ষাবিদদের একটি প্রতিনিধিদল তাঁকে দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার আহ্বান জানাল। এই আবেদন অং সান সু চি কিছুতেই প্রত্যাখ্যান করতে পারলেন না। তিনি সেই দায়িত্ব গ্রহণ করতে রাজি হলেন এবং ২৪টি বছর সব ঘাত-প্রতিঘাতের মাঝেও এই লৌহমানবী তাঁর দায়িত্ব পালনে এখনো আছেন অবিচল।
অক্সফোর্ডে বসে মাইকেল এরিসের ভয় যে তাঁর বাবার মতো অং সান সু চিকে যেন আততায়ীর হাতে প্রাণ হারাতে না হয়। ১৯৮৯ সালে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা তাদের দমন-পীড়নের নীতিতে অং সান সু চিকে গৃহবন্দী করল। তাতে হাঁফ ছেড়েই যেন বাঁচলেন মাইকেল এরিস, এই ভেবে যে তা অন্তত তাঁর স্ত্রীর জীবনটি রক্ষা করবে। এদিকে মাইকেল এরিসও পাশ্চাত্যে মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কথা তুলে ধরতে সচেষ্ট রইলেন। ১৯৯০ সালে মিয়ানমারে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। তাতে ৮২ শতাংশ আসনে জয়লাভ করল অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফল কোনো আমলেই আনল না মিয়ানমারের সামরিক শাসকচক্র। সংগ্রামে অটল রইলেন অং সান সু চি। কখনো বা তাঁকে ঢিলেভাবে গৃহবন্দী করে রাখা হলো, কখনো বা চরম নির্মমতায়। বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিন্ন করে দেওয়া হলো। অং সান সু চির সংগ্রাম সারা পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ১৯৯০ সালেই তিনি রাফটো মানবাধিকার পুরস্কার লাভ করলেন। ১৯৯১ সালে সু চি ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সাখারভ মানবাধিকার পুরস্কার পেলেন। সেই বছরের অক্টোবরেই লাভ করলেন নোবেল শান্তি পুরস্কার। তিনি তাঁর ১ দশমিক ৩ মিলিয়ন ডলারের সেই পুরস্কারটি মিয়ানমারের জনগণের জন্য স্বাস্থ্য ও শিক্ষাক্ষেত্রে ট্রাস্ট গঠনে ব্যবহার করবেন বলে ঘোষণা দিলেন। তাঁর স্বামী মাইকেল এরিস সেই বছরগুলোতে তাঁর দুই সন্তানকে দেখাশোনা করার সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করলেন। ১৯৯১-এ সু চির নোবেল পুরস্কার পাওয়ার বছরে মাইকেল এরিস যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসরের দায়িত্ব পালন করছিলেন।
১৯৯৫ সালের ক্রিসমাসের সময়ে মাইকেল এরিস তাঁর স্ত্রীর কাছ থেকে পেলেন একটি অপ্রত্যাশিত টেলিফোন। সামরিক জান্তা তাঁকে মুক্তি দিয়েছে এবং মাইকেল এরিস আর তাঁর দুই সন্তানকে মিয়ামনমারের ভিসা দেওয়া হয়েছে। ছোট ছেলে কিমকে দেখে তো অং সান সু চি বলেই ফেললেন যে বাড়ন্ত তাঁর ছেলেটিকে এতই অপরিচিত লাগছে যে রাস্তায় দেখা হলে তিনি তাঁর পাশ কাটিয়ে যেতেন। অবশ্য এটা সবার কাছে স্পষ্ট ছিল যে সামরিক জান্তার সু চিকে মুক্তি আর তাঁর পরিবারকে ভিসা দেওয়ার উদ্দেশ্য একটিই। তা হলো, অং সান সু চি তাঁদের সঙ্গেই ফিরে যাবেন। কিন্তু অং সান সু চি গণতন্ত্রের জন্য তাঁর সংগ্রামে এতই জড়িত এবং তাঁর প্রত্যয় এতই দৃঢ় যে তিনি স্থির করলেন, কিছুতেই দেশত্যাগ করবেন না। তা করলে তাঁকে আর ফিরতে দেবে না সামরিক জান্তা। তাই পরিবারের সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ যতই দীর্ঘায়িত হোক না কেন, রেঙ্গুনেই তাঁর অবস্থানে তিনি অনড় রইলেন। ১৯৯৫ সালে মিয়ানমারে তাঁর পরিবারের সেই সফরটিই ছিল স্বামী মাইকেল এরিসের সঙ্গে অং সান সু চির শেষ দেখা।
১৯৯৮ সালে মাইকেল এরিস জানলেন যে তাঁর প্রোস্টেট ক্যানসার হয়েছে এবং তা অন্তিম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। তিনি রেঙ্গুন গিয়ে তাঁর স্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নিতে চাইলেন। ভিসার জন্য অন্তত ৩০ বার তিনি আবেদন করলেন। মিয়ানমার সরকার তা প্রত্যাখ্যান করল। পোপ এবং প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনও মাইকেল এরিসকে ভিসা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন। তাও উপেক্ষিত হলো। অং সান সু চিকে বলা হলো, তিনি অক্সফোর্ডে গিয়ে তাঁর স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে পারবেন। সু চি জানতেন যে তাঁর দেশত্যাগ মানেই নির্বাসন। সু চি তাঁর স্বামীকে ব্রিটিশ দূতাবাস থেকে টেলিফোন করতেন। মাইকেল এরিসও তাঁকে দেশত্যাগ না করার জন্য বলতেন এই কারণে যে তাহলে তাঁর আর দেশে ফেরা হবে না। গণতন্ত্রের জন্য অং সান সু চির আত্মত্যাগ তাহলে ভেস্তে যাবে। সু চির সামনে তখন প্রশ্ন একটি। স্বামী না দেশ। অং সান সু চি নিজেই বলেছেন যে তাঁর প্রতি স্বামীর গভীর ভালোবাসা আর সহমর্মিতাই তাঁকে দেশত্যাগ না করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। আর দেখা হলো না অসাধারণ এই স্বামী আর তাঁর সংগ্রামী স্ত্রীর। ১৯৯৯ সালের ২৭ মার্চ তাঁর ৫৩তম জন্মদিনে মাইকেল এরিস শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। মাইকেল এরিসের মৃত্যুর কদিন আগে সু চি যখন নিশ্চিত যে স্বামীর সঙ্গে আর তাঁর দেখা হবে না কোনোদিন, ব্রিটিশ দূতাবাসে গিয়ে তিনি শেষ বিদায় জানিয়ে একটি ফিল্ম রেকর্ড করেছিলেন। সেদিন তাঁর পরনে ছিল তাঁর স্বামীর প্রিয় রঙের পোশাক আর খোঁপায় গোঁজা ছিল লাল গোলাপ। কিন্তু নিয়তি এতই নির্মম যে ফিল্মটি বিলেত পৌঁছাল মাইকেল এরিসের মৃত্যুর দুই দিন পরে।
এদিকে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা দেশের গণতন্ত্রায়ণে পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে। এই বছর অর্থাৎ ২০১২ সালের এপ্রিলের ১ তারিখে মিয়ানমার পার্লামেন্টের দুই কক্ষের ৪৬টি আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তার মধ্যে সু চির ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি ৪৪টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৪৩টিতে বিজয়ী হয়েছে। অং সান সু চি মিয়ানমারের ৪৪০ সদস্যের প্রতিনিধি সভায় (হাউস অপ রিপ্রেজেনটেটিভস) সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন এবং ২ মে, ২০১২ সালে শপথ গ্রহণ করেছেন। ঘোষণা করা হয়েছে যে অবশেষে ২৪ বছর পর অং সান সু চি মিয়ানমারের বাইরে পা রাখবেন। তিনি ব্যাংককে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম পূর্ব এশিয়ার সভায় অংশ নেওয়ার জন্য ব্যাংকক যাবেন ৩০ মে। মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট থেইন সেইনও সেই সভায় যোগ দেবেন। এই মাসেই সু চিকে পাসপোর্ট প্রদান করা হয়েছে। এতে মনে হচ্ছে যে মিয়ানমার সরকারের সংস্কার পদক্ষেপগুলো সম্বন্ধে অং সান সু চি এখন আস্থাবান। তাই তিনি এই যাত্রায় দেশত্যাগ করতে দ্বিধা করছেন না।
তারপর রয়েছে নাটকীয় আর পরিতৃপ্তিদায়ক কিছু খবর। জানা গেছে, আগামী ১৬ জুন অং সান সু চি নরওয়ের অলসোতে যাবেন, ১৯৯১ সালে তাঁকে প্রদত্ত নোবেল পুরস্কার নিজ হাতে গ্রহণ করতে। কিন্তু তার চেয়েও হূদয়ছোঁয়া আর সন্তুষ্টির খবর হচ্ছে, আগামী ২০ জুন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করবে। ২৪ বছর আগে ১৯৮৮ সালে তাঁর মায়ের অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে তিনি অক্সফোর্ড ত্যাগ করেছিলেন। চিরদিনের জন্য তাঁর অজান্তে যবনিকা পড়েছিল তাঁর স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবনের। তাঁকে অক্সফোর্ডের ডিগ্রি প্রদানের তাৎপর্যটি অবশ্যই হূদয় ছুঁয়ে যায়। তাঁর স্বামী বিলেতে চিরনিদ্রায় শায়িত। সেই দেশের প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরনের আমন্ত্রণে তিনি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভাষণ দেবেন ২১ জুন। বেঁচে থাকলে মাইকেল এরিসের বয়স মাত্র ৬৬ বছর হতো। তাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভাষণ দেওয়ার সন্তুটির সঙ্গে অং সান সু চির মনে মিশে থাকবে তাঁর বন্দী অবস্থায় স্বামী হারানোর বেদনা।
মিয়ানমারে গণতন্ত্রের বিবর্তন সম্বন্ধে শেষকথা বলার সময় হয়তো আসেনি। ১৯৮৮ সালে অং সান সু চি বলেছিলেন, ‘আমার বাবার কন্যা হিসেবে আমার দেশে যা ঘটবে তা সম্বন্ধে আমি উদাসীন থাকতে পারি না।’ কিছুদিন আগে তিনি বলেছেন, ‘আমরা সতর্ক, তবে আশাবাদী।’ যদি এখন মিয়ানমারে শুধু নির্বাচন নয়, অর্থবহ গণতন্ত্র আর মানবাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়, তাহলে অর্জনের মাপকাঠিতে আমাদের সময়ের রাজনৈতিক বিবর্তনের ইতিহাসে অং সান সু চির স্থান নেলসন ম্যান্ডেলার পাশেই হয়তো রইবে।
তবে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, মিয়ানমারের মানুষের মুক্তির সংগ্রামে আপাতত ভালোবাসার জয় হয়েছে। দেশের প্রতি অসীম সাহসী অং সান সু চির অনাবিল ভালোবাসার আর জয় হয়েছে অং সান সু চির প্রতি তাঁর অসাধারণ স্বামী মাইকেল এরিসের সহমর্মী ভালোবাসার।
ফারুক চৌধুরী: সাবেক পররাষ্ট্রসচিব। কলাম লেখক।
zaaf@bdmail.net
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন