॥ জসিম উদ্দিন ॥
সব কিছুকে আমাদের পশ্চিমাদের চোখে দেখতে হয়। এ দেখার সাথে বাস্তবতার অনেক পার্থক্য। মিসরে অনুষ্ঠিত প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনে এ ফারাকটা পরিষ্কার করে দেখা গেল। বিশ্বের যেকোনো জায়গার ঘটনা পশ্চিমা মিডিয়া মুহূর্তে ছড়িয়ে দেয়। অর্থনৈতিক উন্নতি ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সংবাদ সংগ্রহে তাদের অনেক দূর এগিয়ে দিয়েছে। এটা এত দূর এগিয়েছে যে, পশ্চাৎপদ কোনো দেশের ঘটনা সে দেশের মিডিয়ায় প্রচার হওয়ার আগে পশ্চিমা মিডিয়ার সুবাদে বিশ্বব্যাপী প্রচার হয়ে যায়। পেশাগত দক্ষতার কারণে তাদের উপস্থাপনাও অত্যন্ত আকর্ষণীয়। তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা তাই বেশি। বিশ্বাসযোগ্যতা নিজেদের প্রচারণার কাজে ব্যবহার করে সুযোগ বুঝে। তাহরির বিপ্লব-পরবর্তী সংসদ নির্বাচনে ইসলামপন্থী দলগুলো ৭০ শতাংশের বেশি আসন পেয়েছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দেশটির প্রধান দু’টি ইসলামি দল মুসলিম ব্রাদারহুড ও আল নূর পার্টির দুই প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করে সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশন এ ধরনের কিছু করে বসতে পারে সে আশঙ্কা করেই মিসরের প্রধান রাজনৈতিক দল ব্রাদারহুড আরেকজন প্রার্থী রেখেছিল। প্রথম দফা নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, ব্রাদারহুডের দ্বিতীয় পছন্দ মুহাম্মদ মুরসি এগিয়ে রয়েছেন।
মিসরের ক্ষমতাসীন সামরিক পরিষদ চায় সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত থাকুক। মোবারক আমলে বিশাল সামরিক বাহিনী লাগামহীন সুযোগ সুবিধা ভোগ করেছে। নির্বাচিত সংসদের সাথে এ নিয়ে এখন তাদের দ্বন্দ্ব চলছে। প্রধান রাজনৈতিক দল ব্রাদারহুড থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে ক্ষমতা নিয়ে টানাটানিতে সেনাবাহিনীকে পিছু হটতে হবে। অন্য দিকে সামরিক মদদপুষ্ট কাউকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করা গেলে নির্বাচিত সংসদের বিরুদ্ধে তারা একজোটে কাজ করতে পারবে। যদি প্রেসিডেন্ট পদটি অন্তত ব্রাদারহুডের বাইরে রাখা যায় তবে ক্ষমতার দরকষাকষিতে সেনাবাহিনী সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে। এ নীতি নিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সাজানোর চেষ্টা করেছে সামরিক পরিষদ। এ প্রচেষ্টাকে পুরোপুরি ব্যর্থ বা সফল বলা যাবে না। ব্রাদারহুড এবং সেনাবাহিনী উভয়ই রেসে রয়েছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ব্রাদারহুডকে বাইরে ফেলে দেয়ার যে চেষ্টা সেটি আপাতত ব্যর্থ হয়েছে। সেনাবাহিনীর সাজানো নির্বাচনের প্রচেষ্টায় পশ্চিমা মিডিয়া কমবেশি সেনাবাহিনীর অবস্থান সমর্থন করে প্রচারণা চালায়। ব্রদারহুডের প্রধান প্রার্থী আহমেদ সাতের নূর পার্টির প্রার্থী আবু সালেহ ইসমাইল বাদ হয়ে গেলে তারা জোরেশোরে ফোকাস করে আমর মুসার ওপর। তার প্রতিযোগী হিসেবে তুলে আনে ব্রাদারহুডের সাবেক নেতা আবুল ফুতুহকে। রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত আল আহরাম পরিচালিত জরিপ তুলে আনে মুসার ব্যাপক জনসমর্থনের বিষয়টি। অনেক ব্যবধানে পেছনে ছিলেন ফুতুহ। সেখানে ব্রাদারহুডের প্রার্থী মুরসির অবস্থান ছিল প্রধান প্রতিযোগীদের পেছনের সারিতে।
নির্বাচনী ফলাফলে দেখা গেল, আমর মুসা প্রধান পাঁচ প্রতিযোগীর মধ্যে পঞ্চম হয়েছেন, যাকে মুসার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে প্রচারণা চালানো হয়েছিল, সেই আবুল ফুতুহ হলেন তৃতীয়। অন্য দিকে বিস্ময়করভাবে মোবারক সরকারের শেষ সময়ের প্রধানমন্ত্রী আহমদ শফিক হন দ্বিতীয়। মোবারক সরকারের প্রতীক শফিক যে সেনাবাহিনীর প্রধান পছন্দÑ এই নির্বাচনী ফলাফলে তারই প্রমাণ পাওয়া যায়। তৃতীয় হওয়া প্রার্থী হামদিন সাব্বাহি নির্বাচনে কারচুপির যে অভিযোগ এনেছেন তা প্রকৃতপক্ষে সেনাবাহিনী এবং শফিকের বিরুদ্ধে গেছে। তিনি শফিকের চেয়ে সাত লাখ কম ভোট পেয়েছেন। অভিযোগ উঠেছে সেনাবাহিনীকে ৯ লাখ ভোটার আইডি কার্ড সরবরাহ করা হয়েছে। তারা সবাই শফিককে ভোট দিয়েছেন। মোবারক সরকারের যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন তাদের একেক জনকে ভোটের বিনিময়ে ১০০ থেকে ১৫০ পাউন্ড দেয়ার অভিযোগও এসেছে। অর্থাৎ একটি সাজানো নির্বাচনের মাধ্যমে শফিককে জেতানোর অপচেষ্টা হয়েছে। এসব ভোট শফিকের বাক্সে না পড়লে সাব্বাহি যেমন দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসতে পারতেন, তেমনি তিনি আবুল ফুতুহর পেছনে পড়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চতুর্থ হতেন। দ্বিতীয় দফা নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগই থাকত না তার।
আহমেদ শফিক বিমানবাহিনীর ফাইটার পাইলট। তিনি মোবারকের প্রিয় সামরিক অফিসারদের অন্যতম। বিমানবাহিনী প্রধান থেকে অবসরে গিয়ে ২০০২ সালে মোবারকের পর্যটনমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। প্রায় নয় বছর দায়িত্ব পালনের পর মোবারক তাকে পদোন্নতি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম আমর মুসাকে নিয়ে খুব মাতামাতি করলেও শফিকের পেছনে সেনাবাহিনীর সমর্থন সেভাবে প্রকাশ হয়নি। সামরিক পরিষদ তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি অক্ষত রাখার জন্য সাবেক সেনাকর্মকর্তাকে অধিকতর বিশ্বস্ত মনে করে। নীরবে ভোটের হিসাবে এগিয়ে যাওয়ার কারণ যে সেনাবাহিনী তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি। শফিক নির্বাচনের দিন বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র সফরে গেলে জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার বিরদ্ধে স্লোগান দেয়। তারা শফিককে তাহরির বিপ্লবের শত্রু বলেই মনে করে।
ব্রাদারহুডের প্রথম পছন্দের প্রার্থী সাতের সুপরিচিত জাতীয় ব্যক্তিত্ব। সামরিক পরিষদ নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন কমিশন তার প্রার্থিতা বাতিল করলে দ্বিতীয় পছন্দের প্রার্থী দলটির রাজনৈতিক শাখা ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির মুহাম্মদ মুরসিকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করে। সাতেরের তুলনায় মুরসি ব্যাপক পরিচিত কোনো ব্যক্তিত্ব নন। এ সুযোগে পশ্চিমা মিডিয়া ব্যাপক প্রচারণা চালায় আমর মুসাকে নিয়ে। ইসলামপন্থীরা বিভক্ত হয়ে পড়েছে বলে অসংখ্য প্রতিবেদন প্রচার হয়। আলোচনার বাইরে পড়ে যান মুরসি। একটি টেলিভিশন বিতর্ক আয়োজন করা হয় আমর মুসা ও ফুতুহর মধ্যে। মিসরীয় দূতাবাসগুলোতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফল পশ্চিমা মিডিয়ার মিলিত প্রচারণায় প্রথম পানি ঢেলে দেয়। প্রবাসীদের ভোটাভুটি ১০ মে শুরু হয়। মুহাম্মদ মুরসি ব্রাদারহুডের দ্বিতীয় পছন্দ হলেও এমনকি জাতীয়ভাবে ব্যাপক পরিচিত না হলেও তিনিই যে মিসরীয়দের প্রধান পছন্দ তা স্পষ্ট হয়ে যায় এর মাধ্যমে। আরো স্পষ্ট হয়ে যায় জনগণ মিসরীয় ব্রাদারহুডকে ক্ষমতায় দেখতে চায়।
৩৩টি দেশে অনুষ্ঠিত নির্বাচনী ভোট গণনায় মুরসি বিপুল ভোটে এগিয়ে যান। তিনি এক লাখ ছয় হাজার ২৫২ ভোট পান। ৭৭ হাজার ৫০০ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে ব্রাদারহুডের সাবেক সদস্য আবুল ফুতুহ। হামদিন সাব্বাহি ও আমর মুসা যথাক্রমে তৃতীয় ও চতুর্থ হন। অন্য দিকে মোট ভোটে দ্বিতীয় স্থান লাভ করা আহমদ শফিক প্রবাসী ভোটের ফলাফল অনুযায়ী হন পঞ্চম। নির্বাচনে ভোট কারচুপির যে অভিযোগ সেনাবাহিনী ও শফিকের বিরুদ্ধে উঠেছে, সে সন্দেহ প্রবাসীদের ভোটের ফলাফল থেকে আরো জোরদার হয়। কারচুপির সন্দেহ আরো বেড়ে যায় দেশে মুরসির এতটা কম ভোট পাওয়া নিয়েও। যেখানে বাইরের মোট ভোটের ৪০ শতাংশের বেশি পেয়েছেন তিনি। ফুতুহ ও মুরসির ভোট যোগ করলে প্রবাসী ভোটের প্রায় ৮০ শতাংশ এ দু’জন পেয়েছেন। সেখানে দেশে এ দু’জন মিলে পেয়েছেন মাত্র ৪৫ শতাংশ ভোট।
মুরসি কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকৌশল বিষয়ে মাস্টার ডিগ্রি নেন ১৯৭৮ সালে। ১৯৮২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া থেকে পিএইচডি অর্জন করেন। একই বছর সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। সেখানে চার বছর অধ্যাপনার পর দেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। একই সাথে যোগ দেন রাজনীতিতে। মোবারকের শাসনামলে নিজ এলাকা থেকে পরপর দু’বার স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। কয়েকবার কারারুদ্ধ হন। তাহরির বিপ্লবের সময় ব্রদারহুডের রাজনৈতিক শাখা ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস গঠিত হলে তিনি এর চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। সংসদে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। এর মধ্যে একজন দক্ষ সংগঠক ও সুবক্তা হিসেবে স্বীকৃতি পান। ব্রাদারহুডের বিকল্প প্রার্থী হিসেবে প্রেসিডেন্ট প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসার পর প্রচারণা চালানো হয় স্বল্পপরিচিত হওয়ায় মুরসি ভোটের দৌড়ে সবার পেছনে পড়বেন।
ফুতুহ পেয়েছেন মোট ভোটের ১৯ শতাংশ । আল নূর পার্টির প্রার্থিতা বাতিলের পর দলটি অনেকটা আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে ব্রাদারহুডের সাবেক সদস্যকে সমর্থন দেয়। সাব্বাহি পেয়েছেন ২১ শতাংশ ভোট। তিনি ধর্মনিরপেক্ষ বামদের প্রতিনিধি। মোবারকের কট্টর বিরোধী এবং তাহরির বিপ্লবের ঘোরতর সমর্থক। আমর মুসা ১০ শতাংশের মতো ভোট পেয়ে পঞ্চম হয়েছেন। তিনি তাহরির বিপ্লবকে সমর্থন করে ভোট চেয়েছেন। তার অন্যতম সমালোচনার বিষয় ছিল মোবারকের শাসন। জুনের মাঝামাঝি মুরসি ও শফিকের মধ্যে দ্বিতীয় দফা নির্বাচন হবে। সে নির্বাচনে ফুতুহর ১৯ শতাংশ ভোট মুরসির বাক্সে যাওয়ার কথা। ফুতুহ এর মধ্যে শফিকের বিরুদ্ধে ভোট দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। সাব্বাহির সমর্থকেরা মোবারক ও বর্তমান সামরিক পরিষদের কট্টর সমালোচক। ইসলামপন্থীরা ক্ষমতায় আসুক এটাও তারা চান না। তাদের ভোট বিভক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যারা আমর মুসাকে ভোট দিয়েছেন তারা বিপ্লবের সমর্থক। শফিক যে ভোট পেয়েছেন তার একটা বড় অংশ কারচুপির মাধ্যমে এসেছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। জুনের মাঝামাঝিতে হতে যাওয়া প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মুরসির বিজয় এক প্রকার নিশ্চিত। সামরিক পরিষদ আবার যদি শফিকের পক্ষে কারচুপির আশ্রয় নেয় সে ক্ষেত্রে পরিস্থিতি ভিন্ন হবে। এর সাথে বিভ্রান্ত করার জন্য পশ্চিমা মিডিয়া তো আছেই। তবে মিসরীয়দের ভরসা তাহরির বিপ্লবীরা এখনো রাজপথ ছাড়েনি।
jjshim146@yahoo.com
সব কিছুকে আমাদের পশ্চিমাদের চোখে দেখতে হয়। এ দেখার সাথে বাস্তবতার অনেক পার্থক্য। মিসরে অনুষ্ঠিত প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনে এ ফারাকটা পরিষ্কার করে দেখা গেল। বিশ্বের যেকোনো জায়গার ঘটনা পশ্চিমা মিডিয়া মুহূর্তে ছড়িয়ে দেয়। অর্থনৈতিক উন্নতি ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সংবাদ সংগ্রহে তাদের অনেক দূর এগিয়ে দিয়েছে। এটা এত দূর এগিয়েছে যে, পশ্চাৎপদ কোনো দেশের ঘটনা সে দেশের মিডিয়ায় প্রচার হওয়ার আগে পশ্চিমা মিডিয়ার সুবাদে বিশ্বব্যাপী প্রচার হয়ে যায়। পেশাগত দক্ষতার কারণে তাদের উপস্থাপনাও অত্যন্ত আকর্ষণীয়। তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা তাই বেশি। বিশ্বাসযোগ্যতা নিজেদের প্রচারণার কাজে ব্যবহার করে সুযোগ বুঝে। তাহরির বিপ্লব-পরবর্তী সংসদ নির্বাচনে ইসলামপন্থী দলগুলো ৭০ শতাংশের বেশি আসন পেয়েছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দেশটির প্রধান দু’টি ইসলামি দল মুসলিম ব্রাদারহুড ও আল নূর পার্টির দুই প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করে সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশন এ ধরনের কিছু করে বসতে পারে সে আশঙ্কা করেই মিসরের প্রধান রাজনৈতিক দল ব্রাদারহুড আরেকজন প্রার্থী রেখেছিল। প্রথম দফা নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, ব্রাদারহুডের দ্বিতীয় পছন্দ মুহাম্মদ মুরসি এগিয়ে রয়েছেন।
মিসরের ক্ষমতাসীন সামরিক পরিষদ চায় সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত থাকুক। মোবারক আমলে বিশাল সামরিক বাহিনী লাগামহীন সুযোগ সুবিধা ভোগ করেছে। নির্বাচিত সংসদের সাথে এ নিয়ে এখন তাদের দ্বন্দ্ব চলছে। প্রধান রাজনৈতিক দল ব্রাদারহুড থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে ক্ষমতা নিয়ে টানাটানিতে সেনাবাহিনীকে পিছু হটতে হবে। অন্য দিকে সামরিক মদদপুষ্ট কাউকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করা গেলে নির্বাচিত সংসদের বিরুদ্ধে তারা একজোটে কাজ করতে পারবে। যদি প্রেসিডেন্ট পদটি অন্তত ব্রাদারহুডের বাইরে রাখা যায় তবে ক্ষমতার দরকষাকষিতে সেনাবাহিনী সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে। এ নীতি নিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সাজানোর চেষ্টা করেছে সামরিক পরিষদ। এ প্রচেষ্টাকে পুরোপুরি ব্যর্থ বা সফল বলা যাবে না। ব্রাদারহুড এবং সেনাবাহিনী উভয়ই রেসে রয়েছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ব্রাদারহুডকে বাইরে ফেলে দেয়ার যে চেষ্টা সেটি আপাতত ব্যর্থ হয়েছে। সেনাবাহিনীর সাজানো নির্বাচনের প্রচেষ্টায় পশ্চিমা মিডিয়া কমবেশি সেনাবাহিনীর অবস্থান সমর্থন করে প্রচারণা চালায়। ব্রদারহুডের প্রধান প্রার্থী আহমেদ সাতের নূর পার্টির প্রার্থী আবু সালেহ ইসমাইল বাদ হয়ে গেলে তারা জোরেশোরে ফোকাস করে আমর মুসার ওপর। তার প্রতিযোগী হিসেবে তুলে আনে ব্রাদারহুডের সাবেক নেতা আবুল ফুতুহকে। রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত আল আহরাম পরিচালিত জরিপ তুলে আনে মুসার ব্যাপক জনসমর্থনের বিষয়টি। অনেক ব্যবধানে পেছনে ছিলেন ফুতুহ। সেখানে ব্রাদারহুডের প্রার্থী মুরসির অবস্থান ছিল প্রধান প্রতিযোগীদের পেছনের সারিতে।
নির্বাচনী ফলাফলে দেখা গেল, আমর মুসা প্রধান পাঁচ প্রতিযোগীর মধ্যে পঞ্চম হয়েছেন, যাকে মুসার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে প্রচারণা চালানো হয়েছিল, সেই আবুল ফুতুহ হলেন তৃতীয়। অন্য দিকে বিস্ময়করভাবে মোবারক সরকারের শেষ সময়ের প্রধানমন্ত্রী আহমদ শফিক হন দ্বিতীয়। মোবারক সরকারের প্রতীক শফিক যে সেনাবাহিনীর প্রধান পছন্দÑ এই নির্বাচনী ফলাফলে তারই প্রমাণ পাওয়া যায়। তৃতীয় হওয়া প্রার্থী হামদিন সাব্বাহি নির্বাচনে কারচুপির যে অভিযোগ এনেছেন তা প্রকৃতপক্ষে সেনাবাহিনী এবং শফিকের বিরুদ্ধে গেছে। তিনি শফিকের চেয়ে সাত লাখ কম ভোট পেয়েছেন। অভিযোগ উঠেছে সেনাবাহিনীকে ৯ লাখ ভোটার আইডি কার্ড সরবরাহ করা হয়েছে। তারা সবাই শফিককে ভোট দিয়েছেন। মোবারক সরকারের যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন তাদের একেক জনকে ভোটের বিনিময়ে ১০০ থেকে ১৫০ পাউন্ড দেয়ার অভিযোগও এসেছে। অর্থাৎ একটি সাজানো নির্বাচনের মাধ্যমে শফিককে জেতানোর অপচেষ্টা হয়েছে। এসব ভোট শফিকের বাক্সে না পড়লে সাব্বাহি যেমন দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসতে পারতেন, তেমনি তিনি আবুল ফুতুহর পেছনে পড়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চতুর্থ হতেন। দ্বিতীয় দফা নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগই থাকত না তার।
আহমেদ শফিক বিমানবাহিনীর ফাইটার পাইলট। তিনি মোবারকের প্রিয় সামরিক অফিসারদের অন্যতম। বিমানবাহিনী প্রধান থেকে অবসরে গিয়ে ২০০২ সালে মোবারকের পর্যটনমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। প্রায় নয় বছর দায়িত্ব পালনের পর মোবারক তাকে পদোন্নতি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম আমর মুসাকে নিয়ে খুব মাতামাতি করলেও শফিকের পেছনে সেনাবাহিনীর সমর্থন সেভাবে প্রকাশ হয়নি। সামরিক পরিষদ তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি অক্ষত রাখার জন্য সাবেক সেনাকর্মকর্তাকে অধিকতর বিশ্বস্ত মনে করে। নীরবে ভোটের হিসাবে এগিয়ে যাওয়ার কারণ যে সেনাবাহিনী তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি। শফিক নির্বাচনের দিন বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র সফরে গেলে জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার বিরদ্ধে স্লোগান দেয়। তারা শফিককে তাহরির বিপ্লবের শত্রু বলেই মনে করে।
ব্রাদারহুডের প্রথম পছন্দের প্রার্থী সাতের সুপরিচিত জাতীয় ব্যক্তিত্ব। সামরিক পরিষদ নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন কমিশন তার প্রার্থিতা বাতিল করলে দ্বিতীয় পছন্দের প্রার্থী দলটির রাজনৈতিক শাখা ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির মুহাম্মদ মুরসিকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করে। সাতেরের তুলনায় মুরসি ব্যাপক পরিচিত কোনো ব্যক্তিত্ব নন। এ সুযোগে পশ্চিমা মিডিয়া ব্যাপক প্রচারণা চালায় আমর মুসাকে নিয়ে। ইসলামপন্থীরা বিভক্ত হয়ে পড়েছে বলে অসংখ্য প্রতিবেদন প্রচার হয়। আলোচনার বাইরে পড়ে যান মুরসি। একটি টেলিভিশন বিতর্ক আয়োজন করা হয় আমর মুসা ও ফুতুহর মধ্যে। মিসরীয় দূতাবাসগুলোতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফল পশ্চিমা মিডিয়ার মিলিত প্রচারণায় প্রথম পানি ঢেলে দেয়। প্রবাসীদের ভোটাভুটি ১০ মে শুরু হয়। মুহাম্মদ মুরসি ব্রাদারহুডের দ্বিতীয় পছন্দ হলেও এমনকি জাতীয়ভাবে ব্যাপক পরিচিত না হলেও তিনিই যে মিসরীয়দের প্রধান পছন্দ তা স্পষ্ট হয়ে যায় এর মাধ্যমে। আরো স্পষ্ট হয়ে যায় জনগণ মিসরীয় ব্রাদারহুডকে ক্ষমতায় দেখতে চায়।
৩৩টি দেশে অনুষ্ঠিত নির্বাচনী ভোট গণনায় মুরসি বিপুল ভোটে এগিয়ে যান। তিনি এক লাখ ছয় হাজার ২৫২ ভোট পান। ৭৭ হাজার ৫০০ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে ব্রাদারহুডের সাবেক সদস্য আবুল ফুতুহ। হামদিন সাব্বাহি ও আমর মুসা যথাক্রমে তৃতীয় ও চতুর্থ হন। অন্য দিকে মোট ভোটে দ্বিতীয় স্থান লাভ করা আহমদ শফিক প্রবাসী ভোটের ফলাফল অনুযায়ী হন পঞ্চম। নির্বাচনে ভোট কারচুপির যে অভিযোগ সেনাবাহিনী ও শফিকের বিরুদ্ধে উঠেছে, সে সন্দেহ প্রবাসীদের ভোটের ফলাফল থেকে আরো জোরদার হয়। কারচুপির সন্দেহ আরো বেড়ে যায় দেশে মুরসির এতটা কম ভোট পাওয়া নিয়েও। যেখানে বাইরের মোট ভোটের ৪০ শতাংশের বেশি পেয়েছেন তিনি। ফুতুহ ও মুরসির ভোট যোগ করলে প্রবাসী ভোটের প্রায় ৮০ শতাংশ এ দু’জন পেয়েছেন। সেখানে দেশে এ দু’জন মিলে পেয়েছেন মাত্র ৪৫ শতাংশ ভোট।
মুরসি কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকৌশল বিষয়ে মাস্টার ডিগ্রি নেন ১৯৭৮ সালে। ১৯৮২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া থেকে পিএইচডি অর্জন করেন। একই বছর সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। সেখানে চার বছর অধ্যাপনার পর দেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। একই সাথে যোগ দেন রাজনীতিতে। মোবারকের শাসনামলে নিজ এলাকা থেকে পরপর দু’বার স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। কয়েকবার কারারুদ্ধ হন। তাহরির বিপ্লবের সময় ব্রদারহুডের রাজনৈতিক শাখা ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস গঠিত হলে তিনি এর চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। সংসদে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। এর মধ্যে একজন দক্ষ সংগঠক ও সুবক্তা হিসেবে স্বীকৃতি পান। ব্রাদারহুডের বিকল্প প্রার্থী হিসেবে প্রেসিডেন্ট প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসার পর প্রচারণা চালানো হয় স্বল্পপরিচিত হওয়ায় মুরসি ভোটের দৌড়ে সবার পেছনে পড়বেন।
ফুতুহ পেয়েছেন মোট ভোটের ১৯ শতাংশ । আল নূর পার্টির প্রার্থিতা বাতিলের পর দলটি অনেকটা আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে ব্রাদারহুডের সাবেক সদস্যকে সমর্থন দেয়। সাব্বাহি পেয়েছেন ২১ শতাংশ ভোট। তিনি ধর্মনিরপেক্ষ বামদের প্রতিনিধি। মোবারকের কট্টর বিরোধী এবং তাহরির বিপ্লবের ঘোরতর সমর্থক। আমর মুসা ১০ শতাংশের মতো ভোট পেয়ে পঞ্চম হয়েছেন। তিনি তাহরির বিপ্লবকে সমর্থন করে ভোট চেয়েছেন। তার অন্যতম সমালোচনার বিষয় ছিল মোবারকের শাসন। জুনের মাঝামাঝি মুরসি ও শফিকের মধ্যে দ্বিতীয় দফা নির্বাচন হবে। সে নির্বাচনে ফুতুহর ১৯ শতাংশ ভোট মুরসির বাক্সে যাওয়ার কথা। ফুতুহ এর মধ্যে শফিকের বিরুদ্ধে ভোট দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। সাব্বাহির সমর্থকেরা মোবারক ও বর্তমান সামরিক পরিষদের কট্টর সমালোচক। ইসলামপন্থীরা ক্ষমতায় আসুক এটাও তারা চান না। তাদের ভোট বিভক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যারা আমর মুসাকে ভোট দিয়েছেন তারা বিপ্লবের সমর্থক। শফিক যে ভোট পেয়েছেন তার একটা বড় অংশ কারচুপির মাধ্যমে এসেছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। জুনের মাঝামাঝিতে হতে যাওয়া প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মুরসির বিজয় এক প্রকার নিশ্চিত। সামরিক পরিষদ আবার যদি শফিকের পক্ষে কারচুপির আশ্রয় নেয় সে ক্ষেত্রে পরিস্থিতি ভিন্ন হবে। এর সাথে বিভ্রান্ত করার জন্য পশ্চিমা মিডিয়া তো আছেই। তবে মিসরীয়দের ভরসা তাহরির বিপ্লবীরা এখনো রাজপথ ছাড়েনি।
jjshim146@yahoo.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন