বুধবার, ৪ এপ্রিল, ২০১২

গাজায় ত্রাণবহরে ইসরায়েলি অভিযানঃ কী কেন কীভাবে



সাজেদ ফাতেমী
ত্রাণ বহরের একটি জাহাজ অভিমুখে ইসরায়েলি কমান্ডোরাঅবরুদ্ধ গাজা অভিমুখী ত্রাণবাহী নৌবহরে হামলা চালিয়ে ব্যাপক নিন্দার মুখে পড়েছে ইসরায়েল। জাতিসংঘ এ জন্য নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে। এ ঘটনার পূর্বাপর ও প্রতিক্রিয়া সংক্ষেপে প্রশ্নোত্তর আকারে তুলে ধরা হলো

নৌবহরের লক্ষ্য কী ছিল? 
উদ্যোক্তা ‘ফ্রি গাজা’ সংগঠন বলছে, তাদের লক্ষ্য ছিল ইসরায়েলি অবরোধ এড়িয়ে গাজা এলাকায় ত্রাণসাহায্য পৌঁছানো এবং ওই এলাকার ‘কারাগারসুলভ পরিস্থিতির ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকর্ষণ করা’। 
সংগঠনটি ফিলিস্তিনিদের সমর্থক মানবাধিকার সংগঠন ও আন্দোলনকর্মীদের একটি জোট। ডেসমন্ড টুটু ও নোয়াম চমস্কির মতো ব্যক্তিত্বের আশীর্বাদ রয়েছে এর পেছনে। ফিলিস্তিনিদের অধিকারের দাবিতে প্রচার-প্রচারণা চালায় এমন বেশ কিছু ইহুদি সংগঠনও তাদের সমর্থন করে।
ইসরায়েল তাদের সম্পর্কে কী বলে? 
ইসরায়েলের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী ড্যানি আয়ালন বলেছেন, ‘সন্ত্রাসী সংগঠন হামাসের সমর্থনে আসা ঘৃণা ও সহিংসতার ওই নৌবহর প্রকৃতপক্ষে পূর্বপরিকল্পিত ও আপত্তিকর এক উসকানি।’ সংগঠনটির সদস্যদের সঙ্গে আল-কায়েদা ও হামাসসহ অন্য জঙ্গিদের যোগাযোগের কথা সুবিদিত বলে মন্তব্য করেন তিনি। মন্ত্রী আরও বলেন, নৌবহরটিতে হানা দিয়ে ইসরায়েলি কমান্ডোরা অস্ত্র পেয়েছে, যা কি না তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহারও করা হয়। তিনি বলেন, ‘সংগঠনটির উদ্দেশ্য ছিল সহিংস, তাদের কর্মপদ্ধতি ছিল সহিংস এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে ঘটনার ফলও হয়েছে সহিংস।’ 
জোটের সদস্যদের মধ্যে ইসরায়েল বিশেষ করে তুরস্কের ইনসানি ইয়ারদিম ওয়াকফি বা ‘মানবিক ত্রাণতহবিল’কে (আইএইচএইচ) চিহ্নিত করেছে জঙ্গিবাদী মুসলিম সংগঠন হিসেবে। অবরোধ ভাঙার অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছে এরাই। সংগঠনটি মুসলমানেরা সমস্যায় আছে (বা ছিল) এমন বিভিন্ন স্থান যেমন বসনিয়া বা চেচনিয়ায় কার্যক্রম চালায়। 
গাজার ওপর ইসরায়েলি অবরোধের ফল কী রকম? 
পয়োব্যবস্থা থেকে স্কুল, কৃষি থেকে স্বাস্থ্যসেবা—সবকিছুই প্রভাবিত হয়েছে এ অবরোধের কারণে। বেকারত্ব বেড়েছে। বেড়েছে বিদ্যুৎ-ঘাটতি। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, গাজা এলাকার প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ বেঁচে থাকে দিনে এক ডলারের কম আয়ে। ৭৫ শতাংশকে নির্ভর করতে হয় খাদ্যসাহায্যের ওপর। কাগজে-কলমে মানবিক ত্রাণসাহায্য ঢুকতে দেওয়া হয়। কিন্তু জাতিসংঘ ও ত্রাণ-সংগঠনগুলোর অভিযোগ, ধরনে মানবিক সাহায্য কিন্তু অন্য কাজেও ব্যবহার করা সম্ভব এমন কিছু ইসরায়েল ঢুকতে দেয় না। 
বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, গাজার আমদানির ৮০ শতাংশই আসে সুড়ঙ্গপথে পাচার হয়ে। 
ইসরায়েলের বক্তব্য হচ্ছে, হামাসকে তার ভূখণ্ডের ভেতরে রকেট হামলা থেকে বিরত রাখতেই এই অবরোধ। দেশটির চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে হামাসকে ধ্বংস করা। কারণ, ইসরায়েল তাদের একটি সন্ত্রাসবাদী সংগঠন মনে করে। তবে নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, এ অবরোধে কাজ হচ্ছে না। জাতিসংঘের জরুরি ত্রাণ-সমন্বয়কারী জন হলমস বলেছেন, এটি হচ্ছে গাজা এলাকার সাধারণ মানুষের ওপর এক গণশাস্তি। 
ইসরায়েল যা করেছে তা কি বৈধ? 
ইসরায়েল আগেই বলেছিল, তারা নৌবহরটিকে গাজায় আসতে দেবে না। তাদের অভিযোগ ছিল, ওই বহরের আয়োজকেরা সামরিক বাহিনীকে উসকে দেওয়ার চেষ্টা করছে। ইসরায়েল আরও দাবি করে, গাজা উপকূল থেকে ২০ নটিক্যাল মাইল সীমানার মধ্যে ঢুকলে তা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হবে। কিন্তু এ মর্মেই সমালোচনা ক্রমশ বাড়ছে যে ইসরায়েল তার সেনাবাহিনীকে যেভাবে ব্যবহার করেছে সেটাই আন্তর্জাতিক মান ও মানবাধিকার আইনের লঙ্ঘন। 
ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ জোর দিয়ে বলছে, আত্মরক্ষার প্রয়োজনেই তাদের সৈন্যরা গুলি করে। তারা রড ও অস্ত্রধারী ত্রাণকর্মীদের আক্রমণের মুখে পড়েছিল।কিন্তু এর বিপক্ষে যুক্তি হচ্ছে, আন্তর্জাতিক আইনে বলা আছে, শক্তি প্রয়োগ করতে হলেও তার মাত্রা হতে হবে সংগতিপূর্ণ। 
ইসরায়েল আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন ভেঙে থাকতে পারে বলেও মনে করছেন অনেকে। কারণ, পত্রিকার খবর অনুযায়ী, কমান্ডোরা জাহাজে চড়ার সময় সেটি গাজা উপকূল থেকে ৮০ মাইল দূরে ছিল। 
ইসরায়েলি মানবাধিকার সংগঠন বাতসেলেম বলেছে, বেসামরিক কর্মকর্তাদের দিয়ে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত করতে হবে। কমান্ডোরা সংগতিপূর্ণ শক্তি প্রয়োগ করেছিল কি না, এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ তাদের ছিল কি না এবং বিকল্প ব্যবস্থার কথা ভাবা হয়েছিল কি না—এগুলোসহ বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর খোঁজার পরামর্শ দিয়েছে ইসরায়েলি সংগঠনটি। 
ঘটনার রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে? 
ইসরায়েল ও পাশ্চাত্য-সমর্থিত ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের মধ্যে দূরত্ব ঘোচানোর পরোক্ষ আলোচনা মে মাসেই আবার শুরু হয়েছে। কিন্তু এতে কার্যকর কোনো অগ্রগতি হবে বলে আশা করছে না কেউই। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে গাজার নিয়ন্ত্রণকারী ইসলামপন্থী হামাসের বিরোধ চলছে। কিন্তু এর পরও ত্রাণবাহী বহরে ইসরায়েলি অভিযান ও ‘হত্যাযজ্ঞের’ তীব্র নিন্দা করেছেন ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। 
ইসরায়েলের প্রতি আন্তর্জাতিক বিশ্বের যে প্রতিক্রিয়া তার ফলে কট্টরপন্থী বলে নিন্দিত হামাসকে এড়িয়ে চলার নীতি নিয়ে নতুন করে ভাবনাচিন্তা হতে পারে। নৌবহরে হামলা ও রক্তপাতের ঘটনার পরপরই গাজার ওপর চলমান অবরোধ প্রত্যাহার বা শিথিলের ডাক দিয়েছেন অনেকে। 
ইসরায়েল-তুরস্ক সম্পর্কের কী হবে? 
এ ঘটনা ইসরায়েলের সঙ্গে তার একমাত্র আঞ্চলিক মুসলিম মিত্রের সম্পর্ক স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। ইতিমধ্যেই দুই দেশের মধ্যে সব সামরিক সহযোগিতা স্থগিত করা হয়েছে। অভিযানে নিহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই তুর্কি সাহায্য সংগঠন আইএইচএইচের সদস্য। তুরস্কের সঙ্গে রয়েছে ইসরায়েলের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ও সামরিক সম্পর্ক। তুরস্ক কিছুদিন ধরে সিরিয়া ও ইসরায়েলের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে মধ্যস্থতার চেষ্টা করে আসছিল। তবে এর পাশাপাশি গাজায় ২০০৮ সালের দমন অভিযানসহ নানা কারণে ইসরায়েল-তুরস্ক সম্পর্ক ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছিল। নৌবহরে হামলায় তিক্ততা চরমে উঠল। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হলেও মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্ক প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইসলামের প্রতি বাড়তি গুরুত্ব না দেওয়ার যে নীতি ছিল তা থেকে গত কয়েক দশকে তুর্কিসমাজ অনেকটাই সরে এসেছে। এই প্রেক্ষাপটে ইসলামপন্থী বিভিন্ন সংগঠনের প্রতি জনসমর্থনের একটি ভিত্তি গড়ে উঠেছে তুরস্কে, যাদের ভূমিকা নিয়ে কখনো কখনো প্রশ্ন উঠছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন