আজকাল সংকট নিয়ে অনেক কথাবার্তা হচ্ছে। কিন্তু কোন সংকটের কথা বলা হচ্ছে, তাতে ভুগছে কারা? পাশ্চাত্যের জন্য ‘সংকটের’ সুস্পষ্ট অর্থ হচ্ছে অর্থনৈতিক মন্দা, যাতে ধনী দেশগুলো আক্রান্ত হয়েছে। তবে অন্যরা দুনিয়াকে অন্যভাবে দেখে। যেমন বাংলাদেশি সংবাদপত্র দি নিউ নেশন ২০০৮ এর ২৬ অক্টোবর লিখেছে, ‘মন্দা মোকাবিলায় হাজার হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে, অথচ রোম সম্মেলনে খাদ্য ঘাটতি মোকাবিলায় মাত্র ১২.৩ বিলিয়ন ডলার চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু দেওয়া হয়েছে মাত্র এক বিলিয়ন। ২০১৫ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্য দূর করায় জাতিসংঘের আশার বাস্তবায়ন তাই সুদূরপরাহত। সম্পদের অভাব নয়, এর জন্য দায়ী বিশ্বের দরিদ্রদের বিষয়ে দায়িত্বশীলতার অভাব।’
লেখাটিতে ২০০৯ সালের খাদ্য দিবসে বিশ্বের খাদ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে আরও দুঃসংবাদের আশঙ্কা করা হয়েছে। এবং বলা হয়েছে, ‘যদিও সেই সংবাদ সামান্যই গুরুত্ব পাবে’। এর মধ্যে জাতিসংঘ মন্দার জন্য খাদ্যসাহায্য বন্ধ করে দিচ্ছে। এতে করে ভুগবে ইথিওপিয়া, রুয়ান্ডা, উগান্ডাসহ বেশ কয়েকটি দেশ। ধনী দেশগুলো বরাদ্দ কমাচ্ছে তখনই, যখন চরম ক্ষুধার্তদের সংখ্যা এক শ কোটি ছাড়িয়ে গিয়েছে।
অথচ ব্রিটিশরা আড়াই শ বছর আগে যখন বাংলাদেশে আগ্রাসন চালায়, তখন এই দেশ ছিল ধন-সম্পদে পরিপূর্ণ। কিন্তু দ্রুতই দেশটি পরিণত হয় বঞ্চনার শিকারে। বাংলাদেশে খাদ্যঘাটতির বর্তমান অবস্থা দেখায় যে, বাংলাদেশের এই দুরবস্থা কেবল তাদের প্রতি মনোযোগের অভাবের জন্য ঘটেনি, বরং ঘটেছে বৈশ্বিক হর্তাকর্তাদের নিজেদের স্বার্থরক্ষায় অতি মনোযোগের কারণে। অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ ইংল্যান্ডের নীতি প্রণয়ন বিষয়ে বলেছিলেন, ‘আজকের দুনিয়ায় প্রধান নীতিনির্ধারক হলো ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা। সরকারি নীতিতে ব্যবসায়ীরা সবার আগে নিজেদের স্বার্থরক্ষা নিশ্চিত করে, তা জনগণের জীবনে যতই আঘাত হানুক।’
বড় আকারে খাদ্য সংকট প্রথম দেখা দেয় ২০০৮ সালে, হাইতিতে। বাংলাদেশের মতো হাইতিও এখন দারিদ্র্য ও বঞ্চনার প্রতীক। এবং বাংলাদেশের মতোই হাইতিও ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তির আগমনের আগে ছিল চোখে পড়ার মতো ধনী, প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এক বর্ধিষ্ণু জনসংখ্যার দেশ। পরে এ দেশটিই জোগান দেয় ফ্রান্সের বিত্ত-বৈভব। হাইতিতে আজকের খাদ্য সংকটের উত্স খুঁজতে গেলে যেতে হবে ১৯১৫ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের বর্বর, ধ্বংসাত্মক আগ্রাসনের সময়ে। উইলসনের অনেক অপরাধের একটি ছিল, বন্দুকের মুখে হাইতির নির্বাচিত সংসদকে বাতিল করা। কারণ, সেই সংসদ মার্কিন কোম্পানির জন্য হাইতির জমি ছেড়ে দিতে রাজি হয়নি। পরে মার্কিন সংস্থা ইউএসএআইডি (USAID) হাইতিকে ‘ক্যারিবিয়ার তাইওয়ান’ বানাতে কর্মসূচি নিয়ে নেমে পড়ে। তরিকাটা এই—হাইতিকে বাধ্যতামূলকভাবে খাদ্য ও অন্যান্য দ্রব্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করতে হবে। কিন্তু শ্রমজীবী মানুষ এবং বিশেষত নারীদের কাজ করতে হয় সেখানকার মার্কিন কোম্পানিগুলোতে। ১৯৯০ সালে হাইতির প্রথম মুক্ত নির্বাচনে জাঁ-বর্ট্রান্ড অ্যারিস্টিড প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এ রকম অবস্থায় ওয়াশিংটনের আদর্শ প্রতিক্রিয়া হলো, ক্ষমতাচ্যুত করা। কয়েক মাসের মধ্যেই সেনা অভ্যুত্থানে অ্যারিস্টিড ক্ষমতাচ্যুত হন এবং দেশ থেকে বিতাড়িত হন। হাইতিতে চলে ত্রাসের রাজত্ব। সিনিয়র বুশ এবং ক্লিনটন এই সরকারকে যথেষ্ট মদদ দেন। ১৯৯৪ সালে তাঁদের মনে হয়, জনগণকে যথেষ্ট শিক্ষা দেওয়া গেছে, এবার অ্যারিস্টিডকে ফিরতে দেওয়া যায়। তবে শর্তসাপেক্ষে। তাঁকে কঠোর কঠিন নিওলিবারেল ব্যবস্থা আরোপ করতে হবে এবং মেনে নিতে হবে মুক্তবাজারি বিধিবিধান। সুনির্দিষ্ট করে বলা হয়, হাইতির অর্থনীতির জন্য কোনো সুরক্ষা রাখা যাবে না। হাইতির কৃষকেরা দক্ষ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও তারা মার্কিন ভর্তুকিপ্রাপ্ত কোম্পানি-কৃষির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারবে না।
নিওলিবারেল ব্যবস্থায় হাইতি তার অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব হারিয়ে পতিত হয় নৈরাজ্যের মধ্যে। ২০০৪ সালে হাইতির দুই নির্যাতক ফ্রান্স ও আমেরিকা আবারও ক্যু ঘটায় এবং অ্যারিস্টিড আবারও দেশ ছাড়ভ হন। ততদিনে হাইতি নিজেকে খাওয়ানোর যোগ্যতা হারিয়েছে। এ থেকেই জন্ম হয় হাইতির ২০০৮ সালের খাদ্য সংকট ও মূল্যস্ফীতি।
খাদ্য সংকটের মহামারি ছড়িয়েছে দক্ষিণ গোলার্ধে আর উত্তর গোলার্ধের ধনী দেশগুলো ভুগছে অর্থনৈতিক মন্দায়। এ দুটোরই সাধারণ উত্স হলো ১৯৭০-এর দশকে প্রবর্তিত মুক্তবাজারি নিওলিবারেল ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের কেইনসীয় অর্থনৈতিক নীতি অর্থাত্ শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় খাত ও নিয়ন্ত্রিত বাজারের ব্যবস্থাটি পরিত্যক্ত হয়। বাতিল করা হয় জনসমর্থিত সামাজিক সেবামূলক কর্মসূচি। অথচ অনেক অর্থনীতিবিদই মনে করেন, সেটাই ছিল ‘পুঁজিবাদের স্বর্ণযুগ’। আসলে এটা ছিল রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের যুগ। এর প্রাথমিক শর্তগুলো ছিল গবেষণা ও উন্নয়ন, অধিগ্রহণ ও ক্রয়, সরকারি ভর্তুকি ও রাষ্ট্রীয় ছাড়।
সে যুগেই কল্যাণমূলক অর্থনীতি প্রসারিত হয়। তুলনামূলক গণমুখী প্রতিষ্ঠানের বিকাশ ঘটতে থাকে। কেইনসের মতে, পুঁজির লাগামছাড়া কাজকারবারে এই খাতগুলোর বিকাশ বন্ধ হয়। কেইনসের ভাষায়, ‘পুঁজির মুক্তপ্রবাহ এক কাল্পনিক সংসদ সৃষ্টি করে। সেখানে ঋণদাতা আর বিনিয়োগকারীরা সভা করে মুহূর্তে মুহূর্তে সরকারি নীতি দেখভাল করে। যদি তারা দেখে যে, কোনো কাজ তাদের মুনাফার বিরুদ্ধে যায়, জনগণের লাভ হয়, তাহলে তারা পুঁজি সরিয়ে নেয়। কিংবা মুদ্রাস্ফীতি ঘটায় এবং অন্য সব পন্থার আশ্রয় নেয়।’ গণতান্ত্রিক সরকারগুলো তাই দুই জায়গায় বাধা: একটি হলো জনগণ এবং অন্যটি হলো সেই ‘কাল্পনিক সংসদ’। কার্যত, পুঁজিরই জয় ঘটে।
নিওলিবারেলিজম গণতন্ত্রকে পিছু হটতে বাধ্য করে। একেই তারা বলে ‘গণতন্ত্রে উত্তরণ’। এর মাধ্যমে জনগণকে আরও প্রান্তিক করে দেওয়া হয়। এর একটা রূপ দেখা গেল, পাবলিক রিলেশন ইন্ডাস্ট্রির তরফে গত মার্কিন নির্বাচনে নির্বাচনী মাতোয়ারা। ওবামা তাদের কাছে ‘২০০৮ বছরের সেরা বাজারজাত পণ্য’ নির্বাচিত হয়েছেন। এই ইন্ডাস্ট্রির নির্বাহীরা সোল্লাসে স্বীকার করছেন যে, ‘৩০ বছর আগে নির্বাচনী প্রার্থীদের পণ্যের ব্র্যান্ডের মতো জনপ্রিয় করার যে ধারা শুরু হয়েছিল, ওবামাা জয় সেই ধারার সবচেয়ে বিরাট সাফল্য।’ ৩০ বছর আগে প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানকে দিয়ে এ রকম প্রচারণার সূত্রপাত হয়। ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস-এ এক নির্বাহী বলেন যে, রিগ্যানের পর ওবামার বিজয়ই কোম্পানিগুলোর বোর্ডরুমে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলবে। ব্যাপারটা কি তাহলে কোম্পানির সিইও নির্বাচন করার মতো? রিগ্যানই প্রথম সিইওদের ভূমিকা নতুন করে সংজ্ঞায়িত করেন। তিনি তাদের শেখান, ‘আপনার কোম্পানিকে আপনি দেবেন নতুন দৃষ্টিভঙ্গি।’ এভাবেই আশির দশকে রাজনীতি ও ব্যবসা একাকার হয়ে যেতে থাকে। ব্যবসায়ীরা রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে থাকেন, এমনকি তাঁরা তাঁদের পছন্দমতো প্রার্থীকে পণ্যের মতো করে বাজারজাত করার কৌশলও প্রয়োগ করতে থাকেন।
তখন থেকে গণতন্ত্র আর কিছু নয়, ব্যবস্থাপনার বিষয় মাত্র। এর জন্য নীতি, আদর্শ ও জনমুখী কর্মসূচি নয়, চাই একগুচ্ছ চালাকচতুর ব্যবস্থাপক। এদের হাতেই ক্রমাগতভাবে কল্যাণমূলক অর্থনীতি কোণঠাসা হতে থাকে এবং গণতন্ত্র হতে থাকে দুর্বল।
পাশ্চাত্যের ধনী পুঁজিবাদী দেশের সংকট আর বাংলাদেশের মতো গরিব পুঁজিবাদী দেশের সংকট ও আশা তাই এক নয়। সর্বদাই যা হয়, সংকটের বেশি শিকার হয় গরিবেরা। বাংলাদেশকে শিগগিরই ভয়ংকর খাদ্য সংকটের চেয়েও বড় সংকটের মোকাবিলা করতে হবে। সমুদ্রের উচ্চতা যেভাবে বাড়ছে, তাতে দেশটির সবচেয়ে উত্পাদনশীল বড় এলাকা ডুবে যেতে পারে। বর্তমান সংকট আরো ত্বরান্বিত হচ্ছে হিমালয় পর্বতের হিমবাহ গলে যাওয়ার ফলে। এর ফলে যে বিরাট বিরাট নদীব্যবস্থা দক্ষিণ এশিয়াকে জীবন্ত রেখেছে, সেগুলোও লুপ্ত হবে। আর সেটাই হবে অরুন্ধতী রায়ের ভাষায় মানুষের নির্বুদ্ধিতার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।
বোস্টন রিভিউ থেকে নেওয়া বক্তৃতার নির্বাচিত অংশের অনুবাদ ফারুক ওয়াসিফ
নোয়াম চমস্কি: খ্যাতনামা ভাষাতাত্ত্বিক। মার্কিন অধ্যাপক ও লেখক।
লেখাটিতে ২০০৯ সালের খাদ্য দিবসে বিশ্বের খাদ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে আরও দুঃসংবাদের আশঙ্কা করা হয়েছে। এবং বলা হয়েছে, ‘যদিও সেই সংবাদ সামান্যই গুরুত্ব পাবে’। এর মধ্যে জাতিসংঘ মন্দার জন্য খাদ্যসাহায্য বন্ধ করে দিচ্ছে। এতে করে ভুগবে ইথিওপিয়া, রুয়ান্ডা, উগান্ডাসহ বেশ কয়েকটি দেশ। ধনী দেশগুলো বরাদ্দ কমাচ্ছে তখনই, যখন চরম ক্ষুধার্তদের সংখ্যা এক শ কোটি ছাড়িয়ে গিয়েছে।
অথচ ব্রিটিশরা আড়াই শ বছর আগে যখন বাংলাদেশে আগ্রাসন চালায়, তখন এই দেশ ছিল ধন-সম্পদে পরিপূর্ণ। কিন্তু দ্রুতই দেশটি পরিণত হয় বঞ্চনার শিকারে। বাংলাদেশে খাদ্যঘাটতির বর্তমান অবস্থা দেখায় যে, বাংলাদেশের এই দুরবস্থা কেবল তাদের প্রতি মনোযোগের অভাবের জন্য ঘটেনি, বরং ঘটেছে বৈশ্বিক হর্তাকর্তাদের নিজেদের স্বার্থরক্ষায় অতি মনোযোগের কারণে। অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ ইংল্যান্ডের নীতি প্রণয়ন বিষয়ে বলেছিলেন, ‘আজকের দুনিয়ায় প্রধান নীতিনির্ধারক হলো ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা। সরকারি নীতিতে ব্যবসায়ীরা সবার আগে নিজেদের স্বার্থরক্ষা নিশ্চিত করে, তা জনগণের জীবনে যতই আঘাত হানুক।’
বড় আকারে খাদ্য সংকট প্রথম দেখা দেয় ২০০৮ সালে, হাইতিতে। বাংলাদেশের মতো হাইতিও এখন দারিদ্র্য ও বঞ্চনার প্রতীক। এবং বাংলাদেশের মতোই হাইতিও ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তির আগমনের আগে ছিল চোখে পড়ার মতো ধনী, প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এক বর্ধিষ্ণু জনসংখ্যার দেশ। পরে এ দেশটিই জোগান দেয় ফ্রান্সের বিত্ত-বৈভব। হাইতিতে আজকের খাদ্য সংকটের উত্স খুঁজতে গেলে যেতে হবে ১৯১৫ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের বর্বর, ধ্বংসাত্মক আগ্রাসনের সময়ে। উইলসনের অনেক অপরাধের একটি ছিল, বন্দুকের মুখে হাইতির নির্বাচিত সংসদকে বাতিল করা। কারণ, সেই সংসদ মার্কিন কোম্পানির জন্য হাইতির জমি ছেড়ে দিতে রাজি হয়নি। পরে মার্কিন সংস্থা ইউএসএআইডি (USAID) হাইতিকে ‘ক্যারিবিয়ার তাইওয়ান’ বানাতে কর্মসূচি নিয়ে নেমে পড়ে। তরিকাটা এই—হাইতিকে বাধ্যতামূলকভাবে খাদ্য ও অন্যান্য দ্রব্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করতে হবে। কিন্তু শ্রমজীবী মানুষ এবং বিশেষত নারীদের কাজ করতে হয় সেখানকার মার্কিন কোম্পানিগুলোতে। ১৯৯০ সালে হাইতির প্রথম মুক্ত নির্বাচনে জাঁ-বর্ট্রান্ড অ্যারিস্টিড প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এ রকম অবস্থায় ওয়াশিংটনের আদর্শ প্রতিক্রিয়া হলো, ক্ষমতাচ্যুত করা। কয়েক মাসের মধ্যেই সেনা অভ্যুত্থানে অ্যারিস্টিড ক্ষমতাচ্যুত হন এবং দেশ থেকে বিতাড়িত হন। হাইতিতে চলে ত্রাসের রাজত্ব। সিনিয়র বুশ এবং ক্লিনটন এই সরকারকে যথেষ্ট মদদ দেন। ১৯৯৪ সালে তাঁদের মনে হয়, জনগণকে যথেষ্ট শিক্ষা দেওয়া গেছে, এবার অ্যারিস্টিডকে ফিরতে দেওয়া যায়। তবে শর্তসাপেক্ষে। তাঁকে কঠোর কঠিন নিওলিবারেল ব্যবস্থা আরোপ করতে হবে এবং মেনে নিতে হবে মুক্তবাজারি বিধিবিধান। সুনির্দিষ্ট করে বলা হয়, হাইতির অর্থনীতির জন্য কোনো সুরক্ষা রাখা যাবে না। হাইতির কৃষকেরা দক্ষ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও তারা মার্কিন ভর্তুকিপ্রাপ্ত কোম্পানি-কৃষির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারবে না।
নিওলিবারেল ব্যবস্থায় হাইতি তার অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব হারিয়ে পতিত হয় নৈরাজ্যের মধ্যে। ২০০৪ সালে হাইতির দুই নির্যাতক ফ্রান্স ও আমেরিকা আবারও ক্যু ঘটায় এবং অ্যারিস্টিড আবারও দেশ ছাড়ভ হন। ততদিনে হাইতি নিজেকে খাওয়ানোর যোগ্যতা হারিয়েছে। এ থেকেই জন্ম হয় হাইতির ২০০৮ সালের খাদ্য সংকট ও মূল্যস্ফীতি।
খাদ্য সংকটের মহামারি ছড়িয়েছে দক্ষিণ গোলার্ধে আর উত্তর গোলার্ধের ধনী দেশগুলো ভুগছে অর্থনৈতিক মন্দায়। এ দুটোরই সাধারণ উত্স হলো ১৯৭০-এর দশকে প্রবর্তিত মুক্তবাজারি নিওলিবারেল ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের কেইনসীয় অর্থনৈতিক নীতি অর্থাত্ শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় খাত ও নিয়ন্ত্রিত বাজারের ব্যবস্থাটি পরিত্যক্ত হয়। বাতিল করা হয় জনসমর্থিত সামাজিক সেবামূলক কর্মসূচি। অথচ অনেক অর্থনীতিবিদই মনে করেন, সেটাই ছিল ‘পুঁজিবাদের স্বর্ণযুগ’। আসলে এটা ছিল রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের যুগ। এর প্রাথমিক শর্তগুলো ছিল গবেষণা ও উন্নয়ন, অধিগ্রহণ ও ক্রয়, সরকারি ভর্তুকি ও রাষ্ট্রীয় ছাড়।
সে যুগেই কল্যাণমূলক অর্থনীতি প্রসারিত হয়। তুলনামূলক গণমুখী প্রতিষ্ঠানের বিকাশ ঘটতে থাকে। কেইনসের মতে, পুঁজির লাগামছাড়া কাজকারবারে এই খাতগুলোর বিকাশ বন্ধ হয়। কেইনসের ভাষায়, ‘পুঁজির মুক্তপ্রবাহ এক কাল্পনিক সংসদ সৃষ্টি করে। সেখানে ঋণদাতা আর বিনিয়োগকারীরা সভা করে মুহূর্তে মুহূর্তে সরকারি নীতি দেখভাল করে। যদি তারা দেখে যে, কোনো কাজ তাদের মুনাফার বিরুদ্ধে যায়, জনগণের লাভ হয়, তাহলে তারা পুঁজি সরিয়ে নেয়। কিংবা মুদ্রাস্ফীতি ঘটায় এবং অন্য সব পন্থার আশ্রয় নেয়।’ গণতান্ত্রিক সরকারগুলো তাই দুই জায়গায় বাধা: একটি হলো জনগণ এবং অন্যটি হলো সেই ‘কাল্পনিক সংসদ’। কার্যত, পুঁজিরই জয় ঘটে।
নিওলিবারেলিজম গণতন্ত্রকে পিছু হটতে বাধ্য করে। একেই তারা বলে ‘গণতন্ত্রে উত্তরণ’। এর মাধ্যমে জনগণকে আরও প্রান্তিক করে দেওয়া হয়। এর একটা রূপ দেখা গেল, পাবলিক রিলেশন ইন্ডাস্ট্রির তরফে গত মার্কিন নির্বাচনে নির্বাচনী মাতোয়ারা। ওবামা তাদের কাছে ‘২০০৮ বছরের সেরা বাজারজাত পণ্য’ নির্বাচিত হয়েছেন। এই ইন্ডাস্ট্রির নির্বাহীরা সোল্লাসে স্বীকার করছেন যে, ‘৩০ বছর আগে নির্বাচনী প্রার্থীদের পণ্যের ব্র্যান্ডের মতো জনপ্রিয় করার যে ধারা শুরু হয়েছিল, ওবামাা জয় সেই ধারার সবচেয়ে বিরাট সাফল্য।’ ৩০ বছর আগে প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানকে দিয়ে এ রকম প্রচারণার সূত্রপাত হয়। ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস-এ এক নির্বাহী বলেন যে, রিগ্যানের পর ওবামার বিজয়ই কোম্পানিগুলোর বোর্ডরুমে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলবে। ব্যাপারটা কি তাহলে কোম্পানির সিইও নির্বাচন করার মতো? রিগ্যানই প্রথম সিইওদের ভূমিকা নতুন করে সংজ্ঞায়িত করেন। তিনি তাদের শেখান, ‘আপনার কোম্পানিকে আপনি দেবেন নতুন দৃষ্টিভঙ্গি।’ এভাবেই আশির দশকে রাজনীতি ও ব্যবসা একাকার হয়ে যেতে থাকে। ব্যবসায়ীরা রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে থাকেন, এমনকি তাঁরা তাঁদের পছন্দমতো প্রার্থীকে পণ্যের মতো করে বাজারজাত করার কৌশলও প্রয়োগ করতে থাকেন।
তখন থেকে গণতন্ত্র আর কিছু নয়, ব্যবস্থাপনার বিষয় মাত্র। এর জন্য নীতি, আদর্শ ও জনমুখী কর্মসূচি নয়, চাই একগুচ্ছ চালাকচতুর ব্যবস্থাপক। এদের হাতেই ক্রমাগতভাবে কল্যাণমূলক অর্থনীতি কোণঠাসা হতে থাকে এবং গণতন্ত্র হতে থাকে দুর্বল।
পাশ্চাত্যের ধনী পুঁজিবাদী দেশের সংকট আর বাংলাদেশের মতো গরিব পুঁজিবাদী দেশের সংকট ও আশা তাই এক নয়। সর্বদাই যা হয়, সংকটের বেশি শিকার হয় গরিবেরা। বাংলাদেশকে শিগগিরই ভয়ংকর খাদ্য সংকটের চেয়েও বড় সংকটের মোকাবিলা করতে হবে। সমুদ্রের উচ্চতা যেভাবে বাড়ছে, তাতে দেশটির সবচেয়ে উত্পাদনশীল বড় এলাকা ডুবে যেতে পারে। বর্তমান সংকট আরো ত্বরান্বিত হচ্ছে হিমালয় পর্বতের হিমবাহ গলে যাওয়ার ফলে। এর ফলে যে বিরাট বিরাট নদীব্যবস্থা দক্ষিণ এশিয়াকে জীবন্ত রেখেছে, সেগুলোও লুপ্ত হবে। আর সেটাই হবে অরুন্ধতী রায়ের ভাষায় মানুষের নির্বুদ্ধিতার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।
বোস্টন রিভিউ থেকে নেওয়া বক্তৃতার নির্বাচিত অংশের অনুবাদ ফারুক ওয়াসিফ
নোয়াম চমস্কি: খ্যাতনামা ভাষাতাত্ত্বিক। মার্কিন অধ্যাপক ও লেখক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন