রবার্ট ফিস্ক | তারিখ: ০৫-০২-২০১১
গত বৃহস্পতিবার ‘কোনার ঘর’ থেকে আপনি দেখতে পেতেন যেসব মিসরীয় ‘প্রেসিডেন্ট’-এর হাত থেকে রেহাই পেতে মরিয়া, তাদের ঔদ্ধত্য ও মূঢ়তা। ‘ভালো মানুষেরা’ নিজেদের আচরণের মাধ্যমে শত্রুপক্ষের সুবিধা করে দেওয়া দুঃখজনক। কিন্তু তাহরির স্কয়ারের নবীন গণতন্ত্রপন্থী বিক্ষোভকারীরা সতর্কতার সঙ্গে কায়রো লড়াই সংগঠিত করেছে। আগেভাগেই তারা বিপুল পরিমাণ পাথরের টুকরো জড়ো করে, ফোন করে আরও পাঠানোর ব্যবস্থা করে আর শেষে মিসরীয় জাদুঘরের পেছনভাগের উড়ালসেতু থেকে মোবারকপন্থী তরুণদের হটিয়ে দেয়। এক দিন পরই মোবারক ক্ষমতা ছাড়বেন—এ ঘটনা হয়তো সেই পূর্বাভাসই দিচ্ছে। হয়তো তা আগের রাতের আগুনে-বোমা ও স্লাইপার গুলির বদলা। কিন্তু মিসরের নতুন ‘বীরদের’ জায়গা থেকে দেখলে সময়টা ভালো যায়নি।
কোনার ঘরটি রেফারির টাচলাইনের মতো। অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগে নির্মিত। দেয়ালের বহির্ভাগে পাথুরে আঙুরলতার সজ্জাসংবলিত কয়েক স্তরের আস্তরণ আর ভেতরটা স্যাঁতসেঁতে, ভগ্নপ্রায়। মার্বেলের ভাঙা সিঁড়ি, দুর্গন্ধময় কাপড়ের দেয়াল-কাগজ ও কাঠের মেঝে। থলের পর থলে ভর্তি পাথরে। এদের চাপে মেঝেতে গোঙানির মতো শব্দ হচ্ছিল। পাথরের টুকরো সব চতুর্ভুজাকৃতি করে ভাঙা। মোবারকপন্থী মানুষদের ওপর ছোড়ার জন্য আনা। মাহমুদ বাসৌনি সড়ক ও শহীদ আবদুল মেনেম রিয়াদ স্কয়ারের কোনায় অবস্থিত এই মার্জিত-বিষণ্ন-পুরোনো বাড়িটির ইতিহাস কেউ বলতে পারছে না। সেটাই স্বাভাবিক। ঘরটির ভঙ্গুর ব্যালকনি থেকে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম সেদিনের পাথরযুদ্ধ। আর এই খুদে গৃহযুদ্ধ নিয়ন্ত্রণে মিসরীয় সেনাবাহিনীর সাহসী ও করুণ প্রচেষ্টা। এ যুদ্ধের পরদিনই জুমাবার; তাই বিক্ষোভকারীরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করছে, স্বৈরাচারের দিন শেষ।
পাথরের ময়দান কৌশলে পেরিয়ে সেনারা মহাসড়কে নেমে আসেন। তাঁরা পাথর নিক্ষেপকারী দুই পক্ষের মধ্যে দুটি অ্যাবরামস ট্যাংক স্থাপন করতে চেষ্টা করতে থাকেন। চার সেনা মাথার ওপর হাত তুলে যুদ্ধবিরতির চিহ্ন দেখান।
কী করুণ পরিস্থিতি! এখানকার যুদ্ধ থামাতে দরকার ছিল চার হাজার সেনা। অথচ ছিলেন মাত্র দুজন ট্যাংকচালক, একজন অফিসার ও চারজন সেনা। আর গণতন্ত্রের সেনানীরা (হ্যাঁ, একটু নৈরাশ্য যোগ করতেই হচ্ছে) সেনাদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টায় থাকলেও এখানে এসে সেনাদের ধৈর্যের দিকটিকে একেবারেই আমলে নেয়নি। মিসরীয় জাদুঘরের বাইরে রাস্তায় তারা ব্যূহ রচনা করে। সবার হাতে ধরা ঢেউ তোলা টিনের ঢাল। হলিউডি ছবিতে রোমান সেনাদের ব্যঙ্গ করছে যেন—তবে বক্ষবর্ম, মুগুরের বদলে তাদের গায়ে টি-শার্ট আর হাতে ধরা তলোয়ারের বদলে লাঠি। কোনার ঘরের বাইরে আমার সামনে এসে দাঁড়াল এক লোক, তার হাতে (বিশ্বাস করুন, পাঠক) সাত ফুট লম্বা লোহার ত্রিশূল। সে জানাল, অনেকের হাতে আছে এমন অস্ত্র। আগের দিনে মোবারকপন্থীদের ঘোড়া, উটের হামলার মতোই এটাও তেমনি খারাপ।
আরেক ইউনিটের পাঁচ সেনা পাশের এক বাড়ি থেকে এক ট্রে মলোটোভ ককটেল উদ্ধার করেছেন। এই কয়েকজনকে নিরস্ত্র করতে পুরো সামরিক অভিযান চালাতে হয়েছে। কানফাটা শব্দে তারা বলছিল, ‘মোবারকের বিদায় কালই।’ আর তারপরই ৪০ ফুট দূরে শত্রুর উদ্দেশে বলছিল, ‘এই বুড়োরা কালই ভাগবে।’ সাধারণ সব খবরও তাদের উজ্জীবিত করছিল—মোবারকের ব্যাপারে ওবামার বক্তব্য কিংবা মিসরীয় সেনাবাহিনী (প্রতিবছর ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার সহায়তা পায় যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে) প্রেসিডেন্টের হাতে অপমানিত হতে হতে ক্লান্ত। ক্ষমতায় থাকার মেয়াদ শেষ হতে বাকি নয় মাস, তবু ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে দেশের ওপর এমন বিপর্যয় নামিয়ে আনার জন্যও মোবারকের ওপর সেনাবাহিনী ক্ষুব্ধ।
হয়তো এ খবর সত্যি। আমার মিসরীয় বন্ধুদের মধ্যে যাঁদের আত্মীয় সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা, তাঁরা আমাকে বললেন, ‘মোবারকের বিদায়ের ব্যাপারে তাঁরা মরিয়া হয়ে পড়েছেন। না হলে হয়তো আবার বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি ছোড়ার নির্দেশ আসবে তাঁদের ওপর।’
কিন্তু বৃহস্পতিবার মোবারকবিরোধীরা ‘হামলা’ করল; পাথর ছুড়ে ও লোহার অস্ত্র দিয়ে। উড়ালসেতুর ওপর অবস্থান নেওয়া মোবারক-সমর্থকদের ওপর। আমি দেখলাম, মোবারকপন্থী কয়েকজন রাস্তায় নেমে এল। তাদের ওপর বৃষ্টির মতো পাথরের টুকরো পড়ছে। তারা মাথার ওপর হাত তুলে শান্তির চিহ্ন দেখাচ্ছে। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হচ্ছে না।
এমন সময় আমি সেই বিপজ্জনক সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলাম। সাদা পাগড়ি মাথায় আর লম্বা লাল কোর্তা পরা, যত্ন করে সাদা দাড়ি আঁচড়ানো, অসাধারণ দেখতে এক ইমাম পাথরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন। তাঁর হাতে চাবুকের মতো কিছু একটা ছিল, সেটা দিয়ে বিক্ষোভকারীদের আঘাত করতে থাকলেন। উভয় পাশ থেকে আসতে থাকা পাথরের মধ্যে তিনি দাঁড়িয়ে। কিছু মানুষ আছে, যারা মোবারকের হাত থেকে রেহাই চায়, কিন্তু এসব হামলা চায় না। এই লোকটা তাদেরই একজন। এক বিক্ষোভকারী মাথায় আঘাত পেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন।
আমি তখন ভোঁ দৌড় দিয়ে দুই ট্যাংকের কাছে চলে গেলাম। একটার আড়ালে আশ্রয় নিলাম। ট্যাংকটির বিশাল গান-ব্যারেলটি ৩৫০ ডিগ্রি ঘুরানো হলো। সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষতা দেখানোর মজার চেষ্টা। ইঞ্জিন থেকে পাথর নিক্ষেপকারীদের চোখে ধুলা ছিটিয়ে দেওয়া হয়। এক সেনা কর্মকর্তা বেরিয়ে এসে ইমামের পাশে দাঁড়ালেন আর মোবারকপন্থীদের পথ করে দিলেন—তাঁর হাতও তখন মাথার ওপর তোলা। তখনো পাথরের শব্দ হচ্ছিল। তবু মধ্যবয়সী কয়েকজন হাত বাড়িয়ে একে অন্যের হাত ধরছিল, সঙ্গীকে সিগারেট সাধছিল।
এমন পরিস্থিতি বেশিক্ষণ থাকেনি। পেছনে তাহরির স্কয়ারে পরিত্যক্ত কংক্রিটের মেট্রো নির্গমন পথের নিচে কিংবা ঘাস বা বন্ধ দোকানের সিঁড়িতে অনেকে ঘুমিয়ে রাত পার করে। অনেকের মাথা ও হাতে ব্যান্ডেজ। আঘাতের চিহ্ন আগামী দিনে তাদের বীরত্বের ব্যাজ; ‘প্রতিরোধ’ লড়াইয়ে, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অংশ নেওয়ার প্রমাণ হয়ে উঠবে। তবু এমন কাউকে পেলাম না, যে বলতে পারে কেন এই স্কয়ার এতটা মূল্যবান।
সত্য যতটা গুরুত্বপূর্ণ, ততটাই প্রতীকী। নামমাত্র উসমানীয় শাসনামলে বাইরে থেকে স্থপতি এনে স্কয়ারটি তৈরি করা হয়েছিল। ‘ইসলামিয়া’ স্কয়ার থেকে নীল নদের দিকে এর অবস্থান। পরবর্তীকালে সেখানে ব্রিটিশরা তৈরি করেছিল বিশালাকার কছর—এল-নীল ব্যারাক। রাস্তার ওপারে এখনো দাঁড়িয়ে আছে ছদ্ম-বারোক দালান, সেখানেই ছিল বাদশাহ ফারুকের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বিশ্বস্ততার সঙ্গে মন্ত্রণালয়টি ব্রিটিশ নির্দেশ মেনে চলত।
পুরো স্কয়ার এককালে সব মিসরীয়র জন্য নিষিদ্ধ ছিল। এই বিরাট ময়দানের পুরো এলাকা নিয়ে গঠিত হয়েছিল নিষিদ্ধ অঞ্চল, দখলদারের ভূমি, কায়রোর কেন্দ্রস্থল; যেখানে মিসরবাসী কখনো পা ফেলতে পারত না। তাই স্বাধীনতার পর ওটা হয়ে উঠল ‘মুক্তি’—‘তাহরীর’— স্কয়ার। এ জন্যই মোবারক এটা রক্ষা করতে চেয়েছেন, আর এ কারণেই যারা তাঁর উচ্ছেদ চায়, তাদেরও এটা হাতছাড়া করা চলবে না।
হেঁটে হেঁটে ফেরার পথে যাদের দেখলাম তারা খুব আশাবাদী, আরও এক রাত আগুনে-বোমা তারা সহ্য করে যেতে পারবে। কেননা, জুমাবারে আসবে প্রত্যাশিত বিজয়। রামি নামের একজনের সঙ্গে কথা হলো, সপ্রতিভভাবে তিনি বললেন, ‘মনে হয় মোবারকের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার জন্য আমাদের এখন একজন জেনারেল দরকার।’ তাঁর আশা হয়তো পূরণ হবে।
ব্রিটেনের দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
রবার্ট ফিস্ক: ব্রিটিশ সাংবাদিক।
গত বৃহস্পতিবার ‘কোনার ঘর’ থেকে আপনি দেখতে পেতেন যেসব মিসরীয় ‘প্রেসিডেন্ট’-এর হাত থেকে রেহাই পেতে মরিয়া, তাদের ঔদ্ধত্য ও মূঢ়তা। ‘ভালো মানুষেরা’ নিজেদের আচরণের মাধ্যমে শত্রুপক্ষের সুবিধা করে দেওয়া দুঃখজনক। কিন্তু তাহরির স্কয়ারের নবীন গণতন্ত্রপন্থী বিক্ষোভকারীরা সতর্কতার সঙ্গে কায়রো লড়াই সংগঠিত করেছে। আগেভাগেই তারা বিপুল পরিমাণ পাথরের টুকরো জড়ো করে, ফোন করে আরও পাঠানোর ব্যবস্থা করে আর শেষে মিসরীয় জাদুঘরের পেছনভাগের উড়ালসেতু থেকে মোবারকপন্থী তরুণদের হটিয়ে দেয়। এক দিন পরই মোবারক ক্ষমতা ছাড়বেন—এ ঘটনা হয়তো সেই পূর্বাভাসই দিচ্ছে। হয়তো তা আগের রাতের আগুনে-বোমা ও স্লাইপার গুলির বদলা। কিন্তু মিসরের নতুন ‘বীরদের’ জায়গা থেকে দেখলে সময়টা ভালো যায়নি।
কোনার ঘরটি রেফারির টাচলাইনের মতো। অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগে নির্মিত। দেয়ালের বহির্ভাগে পাথুরে আঙুরলতার সজ্জাসংবলিত কয়েক স্তরের আস্তরণ আর ভেতরটা স্যাঁতসেঁতে, ভগ্নপ্রায়। মার্বেলের ভাঙা সিঁড়ি, দুর্গন্ধময় কাপড়ের দেয়াল-কাগজ ও কাঠের মেঝে। থলের পর থলে ভর্তি পাথরে। এদের চাপে মেঝেতে গোঙানির মতো শব্দ হচ্ছিল। পাথরের টুকরো সব চতুর্ভুজাকৃতি করে ভাঙা। মোবারকপন্থী মানুষদের ওপর ছোড়ার জন্য আনা। মাহমুদ বাসৌনি সড়ক ও শহীদ আবদুল মেনেম রিয়াদ স্কয়ারের কোনায় অবস্থিত এই মার্জিত-বিষণ্ন-পুরোনো বাড়িটির ইতিহাস কেউ বলতে পারছে না। সেটাই স্বাভাবিক। ঘরটির ভঙ্গুর ব্যালকনি থেকে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম সেদিনের পাথরযুদ্ধ। আর এই খুদে গৃহযুদ্ধ নিয়ন্ত্রণে মিসরীয় সেনাবাহিনীর সাহসী ও করুণ প্রচেষ্টা। এ যুদ্ধের পরদিনই জুমাবার; তাই বিক্ষোভকারীরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করছে, স্বৈরাচারের দিন শেষ।
পাথরের ময়দান কৌশলে পেরিয়ে সেনারা মহাসড়কে নেমে আসেন। তাঁরা পাথর নিক্ষেপকারী দুই পক্ষের মধ্যে দুটি অ্যাবরামস ট্যাংক স্থাপন করতে চেষ্টা করতে থাকেন। চার সেনা মাথার ওপর হাত তুলে যুদ্ধবিরতির চিহ্ন দেখান।
কী করুণ পরিস্থিতি! এখানকার যুদ্ধ থামাতে দরকার ছিল চার হাজার সেনা। অথচ ছিলেন মাত্র দুজন ট্যাংকচালক, একজন অফিসার ও চারজন সেনা। আর গণতন্ত্রের সেনানীরা (হ্যাঁ, একটু নৈরাশ্য যোগ করতেই হচ্ছে) সেনাদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টায় থাকলেও এখানে এসে সেনাদের ধৈর্যের দিকটিকে একেবারেই আমলে নেয়নি। মিসরীয় জাদুঘরের বাইরে রাস্তায় তারা ব্যূহ রচনা করে। সবার হাতে ধরা ঢেউ তোলা টিনের ঢাল। হলিউডি ছবিতে রোমান সেনাদের ব্যঙ্গ করছে যেন—তবে বক্ষবর্ম, মুগুরের বদলে তাদের গায়ে টি-শার্ট আর হাতে ধরা তলোয়ারের বদলে লাঠি। কোনার ঘরের বাইরে আমার সামনে এসে দাঁড়াল এক লোক, তার হাতে (বিশ্বাস করুন, পাঠক) সাত ফুট লম্বা লোহার ত্রিশূল। সে জানাল, অনেকের হাতে আছে এমন অস্ত্র। আগের দিনে মোবারকপন্থীদের ঘোড়া, উটের হামলার মতোই এটাও তেমনি খারাপ।
আরেক ইউনিটের পাঁচ সেনা পাশের এক বাড়ি থেকে এক ট্রে মলোটোভ ককটেল উদ্ধার করেছেন। এই কয়েকজনকে নিরস্ত্র করতে পুরো সামরিক অভিযান চালাতে হয়েছে। কানফাটা শব্দে তারা বলছিল, ‘মোবারকের বিদায় কালই।’ আর তারপরই ৪০ ফুট দূরে শত্রুর উদ্দেশে বলছিল, ‘এই বুড়োরা কালই ভাগবে।’ সাধারণ সব খবরও তাদের উজ্জীবিত করছিল—মোবারকের ব্যাপারে ওবামার বক্তব্য কিংবা মিসরীয় সেনাবাহিনী (প্রতিবছর ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার সহায়তা পায় যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে) প্রেসিডেন্টের হাতে অপমানিত হতে হতে ক্লান্ত। ক্ষমতায় থাকার মেয়াদ শেষ হতে বাকি নয় মাস, তবু ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে দেশের ওপর এমন বিপর্যয় নামিয়ে আনার জন্যও মোবারকের ওপর সেনাবাহিনী ক্ষুব্ধ।
হয়তো এ খবর সত্যি। আমার মিসরীয় বন্ধুদের মধ্যে যাঁদের আত্মীয় সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা, তাঁরা আমাকে বললেন, ‘মোবারকের বিদায়ের ব্যাপারে তাঁরা মরিয়া হয়ে পড়েছেন। না হলে হয়তো আবার বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি ছোড়ার নির্দেশ আসবে তাঁদের ওপর।’
কিন্তু বৃহস্পতিবার মোবারকবিরোধীরা ‘হামলা’ করল; পাথর ছুড়ে ও লোহার অস্ত্র দিয়ে। উড়ালসেতুর ওপর অবস্থান নেওয়া মোবারক-সমর্থকদের ওপর। আমি দেখলাম, মোবারকপন্থী কয়েকজন রাস্তায় নেমে এল। তাদের ওপর বৃষ্টির মতো পাথরের টুকরো পড়ছে। তারা মাথার ওপর হাত তুলে শান্তির চিহ্ন দেখাচ্ছে। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হচ্ছে না।
এমন সময় আমি সেই বিপজ্জনক সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলাম। সাদা পাগড়ি মাথায় আর লম্বা লাল কোর্তা পরা, যত্ন করে সাদা দাড়ি আঁচড়ানো, অসাধারণ দেখতে এক ইমাম পাথরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন। তাঁর হাতে চাবুকের মতো কিছু একটা ছিল, সেটা দিয়ে বিক্ষোভকারীদের আঘাত করতে থাকলেন। উভয় পাশ থেকে আসতে থাকা পাথরের মধ্যে তিনি দাঁড়িয়ে। কিছু মানুষ আছে, যারা মোবারকের হাত থেকে রেহাই চায়, কিন্তু এসব হামলা চায় না। এই লোকটা তাদেরই একজন। এক বিক্ষোভকারী মাথায় আঘাত পেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন।
আমি তখন ভোঁ দৌড় দিয়ে দুই ট্যাংকের কাছে চলে গেলাম। একটার আড়ালে আশ্রয় নিলাম। ট্যাংকটির বিশাল গান-ব্যারেলটি ৩৫০ ডিগ্রি ঘুরানো হলো। সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষতা দেখানোর মজার চেষ্টা। ইঞ্জিন থেকে পাথর নিক্ষেপকারীদের চোখে ধুলা ছিটিয়ে দেওয়া হয়। এক সেনা কর্মকর্তা বেরিয়ে এসে ইমামের পাশে দাঁড়ালেন আর মোবারকপন্থীদের পথ করে দিলেন—তাঁর হাতও তখন মাথার ওপর তোলা। তখনো পাথরের শব্দ হচ্ছিল। তবু মধ্যবয়সী কয়েকজন হাত বাড়িয়ে একে অন্যের হাত ধরছিল, সঙ্গীকে সিগারেট সাধছিল।
এমন পরিস্থিতি বেশিক্ষণ থাকেনি। পেছনে তাহরির স্কয়ারে পরিত্যক্ত কংক্রিটের মেট্রো নির্গমন পথের নিচে কিংবা ঘাস বা বন্ধ দোকানের সিঁড়িতে অনেকে ঘুমিয়ে রাত পার করে। অনেকের মাথা ও হাতে ব্যান্ডেজ। আঘাতের চিহ্ন আগামী দিনে তাদের বীরত্বের ব্যাজ; ‘প্রতিরোধ’ লড়াইয়ে, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অংশ নেওয়ার প্রমাণ হয়ে উঠবে। তবু এমন কাউকে পেলাম না, যে বলতে পারে কেন এই স্কয়ার এতটা মূল্যবান।
সত্য যতটা গুরুত্বপূর্ণ, ততটাই প্রতীকী। নামমাত্র উসমানীয় শাসনামলে বাইরে থেকে স্থপতি এনে স্কয়ারটি তৈরি করা হয়েছিল। ‘ইসলামিয়া’ স্কয়ার থেকে নীল নদের দিকে এর অবস্থান। পরবর্তীকালে সেখানে ব্রিটিশরা তৈরি করেছিল বিশালাকার কছর—এল-নীল ব্যারাক। রাস্তার ওপারে এখনো দাঁড়িয়ে আছে ছদ্ম-বারোক দালান, সেখানেই ছিল বাদশাহ ফারুকের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বিশ্বস্ততার সঙ্গে মন্ত্রণালয়টি ব্রিটিশ নির্দেশ মেনে চলত।
পুরো স্কয়ার এককালে সব মিসরীয়র জন্য নিষিদ্ধ ছিল। এই বিরাট ময়দানের পুরো এলাকা নিয়ে গঠিত হয়েছিল নিষিদ্ধ অঞ্চল, দখলদারের ভূমি, কায়রোর কেন্দ্রস্থল; যেখানে মিসরবাসী কখনো পা ফেলতে পারত না। তাই স্বাধীনতার পর ওটা হয়ে উঠল ‘মুক্তি’—‘তাহরীর’— স্কয়ার। এ জন্যই মোবারক এটা রক্ষা করতে চেয়েছেন, আর এ কারণেই যারা তাঁর উচ্ছেদ চায়, তাদেরও এটা হাতছাড়া করা চলবে না।
হেঁটে হেঁটে ফেরার পথে যাদের দেখলাম তারা খুব আশাবাদী, আরও এক রাত আগুনে-বোমা তারা সহ্য করে যেতে পারবে। কেননা, জুমাবারে আসবে প্রত্যাশিত বিজয়। রামি নামের একজনের সঙ্গে কথা হলো, সপ্রতিভভাবে তিনি বললেন, ‘মনে হয় মোবারকের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার জন্য আমাদের এখন একজন জেনারেল দরকার।’ তাঁর আশা হয়তো পূরণ হবে।
ব্রিটেনের দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
রবার্ট ফিস্ক: ব্রিটিশ সাংবাদিক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন