বুধবার, ৪ এপ্রিল, ২০১২

গাজা, চমস্কি, ভানুনু: ইসরায়েলের কয়েকটি বিষফোঁড়া



আসজাদুল কিবরিয়া | তারিখ: ২৫-০৬-২০১০
 এ বছরের মে মাসটা ইসরায়েলের দমন-পীড়ন নীতিচর্চার জন্য সম্ভবত বিশেষভাবে কুখ্যাত হয়ে থাকবে। দেশটির বরাবরের একরোখা নীতির বহিঃপ্রকাশ ঘটে এ রকম অন্তত তিনটি ঘটনা ঘটেছে এ মাসে। এর মধ্যে অবরুদ্ধ গাজার জন্য ত্রাণবাহী নৌবহরে নজিরবিহীন হামলায় ১৯ জনের মৃত্যুর ঘটনা বিশ্ববিবেককে নাড়া দিয়েছে। অন্য ঘটনা দুটি এর প্রকৃতির কারণেই তত প্রচার পায়নি। সে দুই ঘটনা দুই সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব নোয়াম চমস্কি ও মোরদেকাই ভানুনুকে ঘিরে।
ইসরায়েল দাবি করছে, ফিলিস্তিনিশাসিত গাজা অভিমুখী ত্রাণবাহী জাহাজে যারা ছিল, তাদের অনেকে জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে যুক্ত বা তাদের প্রতি সহমর্মী। আর কমান্ডোরা রড ও আগ্নেয়াস্ত্রধারী লোকজনের হামলার মুখে আত্মরক্ষার জন্য গুলি করে। ইসরায়েলি অবরোধ ভাঙায় নেতৃত্ব দেওয়া তুর্কিপ্রতিষ্ঠান আইএইচএইচ নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে ঠিকই, কিন্তু ইসরায়েল যে পরিমাণ শক্তি প্রয়োগ করেছে, তা কারোরই সমর্থন পায়নি। জাতিসংঘ এ ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে।
ত্রাণবাহী জাহাজ নাটকের আগে আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে, যা এত বড় আকারে বিশ্বের নজরে আসেনি। আসার কথাও নয়। কারণ, দুটি ঘটনাই ব্যক্তিকেন্দ্রিক। তবে এদের তাৎপর্য মোটেই কম নয়। তিনটি ঘটনাকে মিলিয়ে দেখলে সম্ভবত এ সত্যটিই প্রতিষ্ঠিত হবে যে ইসরায়েল গায়ের জোরের দম্ভে এখনো আন্তর্জাতিক আইনকানুনের তোয়াক্কা করতে আগ্রহী নয়। 
মে মাসের মাঝামাঝিতে যা ঘটল, সেদিকে তাকানো যাক। বিশ্বখ্যাত মার্কিন ভাষাতত্ত্ববিদ ও চিন্তাবিদ নোয়াম চমস্কিকে ইসরায়েল সে দেশে প্রবেশের অনুমতি দেয়নি। চমস্কি ফিলিস্তিনের পশ্চিমতীরের রামাল্লায় অবস্থিত বারজেইত বিশ্ববিদ্যালয় ও ফিলিস্তিন অধ্যয়ন ইনস্টিটিউটে বক্তৃতা দিতে যাচ্ছিলেন। গত ১৬ মে সীমান্তে তাঁকে আটকে দেন ইসরায়েলি অভিবাসন কর্মকর্তারা। বেশ কিছুক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদের পর শেষ পর্যন্ত চমস্কি ও তাঁর মেয়ের পাসপোর্টে ‘এন্ট্রি ডিনায়েড’ (প্রবেশাধিকার প্রত্যাখ্যাত) ছাপ্পড় মেরে দেয়। 
৮২ বছর বয়সী চমস্কি এতে ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এটা খুব পরিষ্কার যে আমি যেসব কথা বলছি, তা ইসরায়েল সরকার পছন্দ করে না।’ 
চমস্কি নিজে একজন ইহুদি ও ইসরায়েলের বড় মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হলেও বরাবরই তিনি ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার দাবির প্রতি সহানুভূতিশীল। মার্কিন ও ইসরায়েলি মধ্যপ্রাচ্যনীতির কঠোর সমালোচক চমস্কি ফিলিস্তিনি এলাকায় ইসরায়েলি দখলদারি ও গাজার সাম্প্রতিক অবরোধের তীব্র বিরোধিতাকারীদের একজন। 
নোয়াম চমস্কির সঙ্গে ইসরায়েলের এহেন বৈরী আচরণ খোদ অনেক ইসরায়েলি বুদ্ধিজীবীকেও ক্ষুব্ধ করেছে।
অন্য ঘটনাটি ঘটে এর পরের সপ্তাহেই, ২৩ মে। ইসরায়েলের পারমাণবিক বোমার গোপন খবর ফাঁস করে সারা বিশ্বে হইচই ফেলে দেওয়া মোরদেকাই ভানুনুকে এদিন আরও তিন মাসের জন্য জেলে পাঠানো হয়।
ইসরায়েলের ইতিহাসে ভানুনু একটি বিরাট অধ্যায়। আজ থেকে ২৪ বছর আগে, ১৯৮৬ সালের ৫ অক্টোবর লন্ডনের সানডে টাইমস পত্রিকার প্রধান শিরোনাম ছিল: ‘রিভিল্ড: দ্য সিক্রেটস অব ইসরায়েলস নিউক্লিয়ার আরসেনাল।’ এ খবরে সারা দুনিয়ায় আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ইসরায়েল বরাবরই পারমাণবিক বোমা তৈরির বিষয়টি অস্বীকার করে এলেও এখন আর তার কোনো উপায় রইল না। 
আর সানডে টাইমস-এর কাছে এ তথ্য ফাঁস করে দিয়েছিলেন ইসরায়েলেরই বিজ্ঞানী মোরদেকাই ভানুনু। তিনি ছিলেন ইসরায়েলের ‘ডিমানো আণবিক প্রকল্পের’ একজন প্রযুক্তিবিদ।
১৯৮১ সালে প্রধানমন্ত্রী মেনাশেম বেগিনের নির্দেশে ইসরায়েলি বিমানবাহিনী ইরাকের ওসিরাকে পারমাণবিক প্রকল্প গুঁড়িয়ে দেয়। তখন থেকেই ভানুনু আণবিক বোমা তৈরির বিষয়ে বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠেন। একপর্যায়ে ১৯৮৫ সালে তাঁকে ডিমানো প্রকল্প থেকে বাদ দেওয়া হয়। ভানুনু দেশত্যাগ করেন। বিভিন্ন দেশ ঘুরে তিনি অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে আশ্রয় নেন। সেই সময়ই তিনি খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেন।
সানডে টাইমস-এর সাংবাদিক পিটার হোওনামের সঙ্গে ভানুনুর পরিচয় ঘটে সিডনিতেই। ১৯৮৬ সালের সেপ্টেম্বরে পিটারের সঙ্গে তিনি লন্ডন আসেন। সিদ্ধান্ত নেন ইসরায়েলের আণবিক বোমাবিষয়ক তথ্য ও ছবি ফাঁস করে দেওয়ার। সানডে টাইমস কর্তৃপক্ষ সতর্কতার সঙ্গে ভানুনুর তথ্য ও ছবিগুলো একাধিক পরমাণুবিশেষজ্ঞ দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে এর সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়। এদিকে ভানুনুর গতিবিধি সন্দেহজনক, এমন গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ইসরায়েল সরকার তাঁকে আটক করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু মিত্র যুক্তরাজ্যের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হতে পারে, এ আশঙ্কায় তাঁকে কৌশলে ইতালিতে নিয়ে আসা হয়। ইসরায়েলের দক্ষ গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের এক নারী এজেন্ট প্রেমের ফাঁদ ফেলে ভানুনুকে রোমে নিয়ে আসেন। তার পরই মোসাদের অন্য এজেন্টরা অপহরণ করে সোজা ইসরায়েলে নিয়ে আসে ভানুনুকে।
ভানুনুকে ১৮ বছরের জেল দেওয়া হয়। এর মধ্যে প্রায় ১২ বছরই তিনি ছিলেন নিঃসঙ্গ কুঠুরিতে। ২০০৪ সালের এপ্রিল মাসে ভানুনু জেল থেকে ছাড়া পান। কিন্তু তাঁর চলাফেরা, দেখা-সাক্ষাতের ওপর নানা ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রায় একঘরে হয়ে পড়া ইসরায়েলের জন্য ভানুনুর কথাবার্তা বা উপস্থিতি সবসময় সুখকর নয়। আর এ জন্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হলেও ইসরায়েল হয়তো তার নিজস্ব কায়দায় এ রকম ভিন্নমতের কণ্ঠরোধ চালিয়েই যাবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন