সি রা জু র র হ মা ন
গুন্টার গ্রাস কৈশোরে জার্মানির আর-আর কিশোরদের মতোই হিটলারের কুখ্যাত এসএস বাহিনীর যুব শাখায় যোগ দিয়েছিলেন। নািসবাদের স্বরূপ এবং তার ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া ভেতর থেকে দেখার সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন। যুদ্ধ-পরবর্তীকালে তাঁর কবিতা ও রচনায় সে ফ্যাসিবাদের প্রতি ঘৃণা মূর্ত হয়ে উঠেছে। সেজন্যই তিনি আন্তর্জাতিকভাবে ‘জার্মানির বিবেক’ বলে বর্ণিত।
হিটলার ইউরোপের ওপর এবং তার জের ধরে বিশ্বব্যাপী যে যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিলেন তাতে ১০ কোটি লোক মারা গেছে বলে অনুমান করা হয়। জায়নিস্ট প্রতিষ্ঠানগুলো তখন থেকেই দাবি করে আসছে যে, নািসরা ছয় মিলিয়ন (৬০ লাখ) ইহুদিকে হত্যা করেছিল। তখন থেকে বিশ্বে আধিপত্যবাদী জায়নিস্টরা তাদের ৬০ লাখ নিয়ে এমনই প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে যে, সেই যুদ্ধে নিহত অবশিষ্ট প্রায় সাড়ে নয় কোটির কথা বিশ্ববাসী ভুলেই গেছে বলা চলে।
ইহুদিদের হিটলারের ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে’ পাঠানোর ব্যাপারে ফ্রান্সসহ কোনো কোনো দেশ নািসদের সঙ্গে সহযোগিতা করেছিলো। ব্রিটেনসহ অন্য দেশগুলো নািসবাদের বিবর্তন ও ইহুদি নির্যাতন দেখেও দেখেনি। বস্তুত জার্মানি যখন চেকস্লোভাকিয়া আক্রমণ করে তার আগে পর্যন্ত ব্রিটেনও হিটলারকে তোষণ করেছে। ১৯৩৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বরের আগে ব্রিটেন জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেনি।
যুদ্ধের পর থেকেই বিশ্ব আধিপত্যবাদী জায়নিস্টরা হিটলারের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতার জন্য ইউরোপের দেশগুলোর কাছ থেকে খুবই উচ্চমূল্য আদায় করতে শুরু করে। গোড়াতেই সব ব্যাপারে ইহুদিদের সঙ্গে সহযোগিতা করা এ মহাদেশে যেন রাষ্ট্রধর্ম হয়ে দাঁড়ায়। ইহুদি-বিদ্বেষকে দণ্ডনীয় অপরাধ করা হয় প্রায় সব ইউরোপীয় দেশে। ইউরোপ-আমেরিকার বাধ্যতামূলক সহানুভূতিকে কাজে লাগিয়ে ইহুদিরা ফিলিস্তিনি আরবদের (মুসলিম ও খ্রিস্টান) ভূমিতে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠা করে।
জাতিসংঘের প্রস্তাবে ইহুদি রাষ্ট্রের জন্য যে পরিমাণ ভূমি নির্দিষ্ট করা হয়েছিলো, আজকের ইসরাইল রাষ্ট্রের আয়তন তার প্রায় তিনগুণ। প্রথমেই ইরগুন, স্টার্ন গ্যাং প্রভৃতি মূলত পোলিশ ইহুদি সন্ত্রাসীরা প্রায় আট হাজার বর্ধিত আরব পরিবারকে উচ্ছেদ করে তাদের ভিটেবাড়ি ও আবাদি জমি দখল করে নেয়। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরাইল রাষ্ট্র ফিলিস্তিনের অবশিষ্টাংশও দখল করে। জাতিসংঘ তখন থেকে এই দখল করা আরব ভূমি ছেড়ে যাওয়ার জন্য ইসরাইলকে নির্দেশ দিয়ে বহু প্রস্তাব পাস করেছে, কিন্তু আরবদের ভিটেবাড়ি, আবাদি জমি ও ফলের বাগান উচ্ছেদ করে ইহুদি বসতি নির্মাণ অবিরাম চলছে। জাতিসংঘ অনেক প্রস্তাব পাস করে এসব বসতিকে অবৈধ ঘোষণা করেছে।
এসব প্রস্তাব কার্যকর করা সম্ভব হচ্ছে না এ কারণে যে, ইসরাইলকে বাধ্য করার কোনো প্রস্তাবে সম্মতি দিতে ইউরোপের দেশগুলোকে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে রাজি করানো যাচ্ছে না। জায়নিস্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী ইহুদিরা এসব দেশে সব গুরুত্বপূর্ণ পেশায় ঢুকে পড়েছে। ইউরোপের কোনো দেশে ইহুদিদের সংখ্যা তিন-চার শতাংশের বেশি নয়। কিন্তু সেসব দেশের পার্লামেন্টে এবং সরকারে ইহুদিদের প্রতিনিধিত্ব আনুপাতিকভাবে বেশি। তেমনি এই দেশগুলোর অর্থনীতি এবং মিডিয়াকেও তারা মুঠোর মধ্যে নিয়ে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদি প্রভাব আরও প্রকট। ইহুদি ও ইসরাইলি লবিগুলোর অনুমোদন ছাড়া এখন মার্কিন কংগ্রেসে কোনো আইন পাস করা অথবা কোনো রাজনীতিকের কোনো গুরুত্বত্বপূর্ণ পদে নির্বাচিত হওয়া প্রায় অসম্ভব। ইসরাইলের বিরুদ্ধে কোনো কথা উঠলেই সারাবিশ্বের ইহুদিরা ‘অ্যান্টিসেমিটিজমের’ (ইহুদি-বিদ্বেষের) জিগির শুরু করে দেয়, নািসদের হাতে নিহত ৬০ লাখ ইহুদির কথা তুলে কান্না জুড়ে দেয়। অর্থাত্ ত্রিশের দশকে নািসদের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার দরুন জায়নিস্টরা এখনও পশ্চিমা বিশ্বকে জিম্মি করে রেখেছে, বাকি বিশ্বকেও ব্ল্যাকমেইল করে।
পশ্চিমা সাহায্যে ক্ষুদে হিটলার
ইহুদি-বিদ্বেষ নিষিদ্ধ করার পেছনে আদি যুক্তি ছিল নািসবাদের পুনরাবির্ভাব অসম্ভব করে তোলা। জার্মান ‘মিলিটারিজমের‘ (সামরিক মনোভাবের প্রাবল্য) কারণে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দখলদার শক্তিগুলো (ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েট ইউনিয়ন ও ফ্রান্স) এ জঙ্গিবাদকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য বহু নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা চালু করে। কিন্তু অন্যদিকে ‘শত্রু-পরিবেষ্টিত ইসরাইলের আত্মরক্ষার ‘অজুহাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে সামরিক সাহায্য দান এবং সমরাস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের সাহায্যে ইসরাইল গোপনে পারমাণবিক বোমা তৈরি করেছে। তার অস্ত্রভাণ্ডারে এখন ৪০০টি পারমাণবিক বোমা আছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। কবি গুন্টার গ্রাস এখন ফাঁস করে দিলেন যে, জার্মানিও ইসরাইলকে অস্ত্র সরবরাহ করে আসছে এবং বর্তমানে ইসরাইলের জন্য দুটি পারমাণবিক সাবমেরিন তৈরি করছে।
অবিসংবাদিত সত্য এই যে, ইসরাইল এখন মধ্যপ্রাচ্যে প্রধান সামরিক শক্তি। নিজেরও অত্যন্ত আধুনিক একটা যুদ্ধাস্ত্র তৈরির শিল্প সে গড়ে তুলেছে। ভারতসহ কোনো কোনো দেশ ইসরাইলের কাছ থেকে সমরাস্ত্র আমদানি করে। বস্তুত ভারতেও ইসরাইলের সহযোগিতায় একটা অস্ত্র নির্মাণশিল্প গড়ে উঠেছে। মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক পরাশক্তির অবস্থান স্থায়ী করতে তেলআবিব সর্বদা উদগ্রীব। এ অঞ্চলের অন্য কোন দেশ শক্তিশালী হয়ে ওঠার চেষ্টা করলে ইসরাইল স্বয়ং কিংবা যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যবহার করে সে দেশকে শক্তিহীন করে দেয়া তেলআবিবের পরিচিত কৌশল। ইসরাইল গোড়া থেকেই দাবি করে এসেছে, যে কেউ তার নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ বিবেচনা করলে আগেই তাকে আক্রমণ করার অধিকার ইসরাইলের আছে। অর্থাত্ এক্ষেত্রে সে অভিযোগকারী, জজ ও জুরির ভূমিকা একাই পালন করছে। প্রথমে যুক্তরাষ্ট্র তারপর অন্যান্য পশ্চিমা শক্তি নীরবে তেলআবিবের সে অন্যায় আবদার মেনে নিয়েছে।
ইরানে ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পর সম্ভাবনা দেখা দেয় নতুন আদর্শে উজ্জীবিত ইরান ইসরাইলি আধিপত্যের প্রতি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্ররোচনা ও অস্ত্র সাহায্যে ইরাকের সাদ্দাম হোসেন ইরান আক্রমণ করেন। সেই যুদ্ধ আট বছর ধরে চলে। কিন্তু সে সাদ্দামই যখন বাগদাদের উপকণ্ঠে অসিরাকে একটা পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করেন তখন ১৯৮১ সালে ইসরাইল ভোল-পাল্টানো মার্কিন বোমারু বিমান ব্যবহার করে কেন্দ্রটি উড়িয়ে দেয়।
আট বছরের যুদ্ধের পর ইরান সাময়িকভাবে দুর্বল হয়ে যায়। অন্যদিকে সাদ্দাম হোসেনের নেতৃত্বে ইরাক শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে। তখন থেকে ইসরাইলি গোয়েন্দা বাহিনী মোসাদ প্রচার চালাতে থাকে, সাদ্দাম হোসেন গোপনে গণবিধ্বংসী (পারমাণবিক ও রাসায়নিক) অস্ত্র তৈরি করছেন। গোড়ায় ওয়াশিংটন কিংবা লন্ডন এসব প্রচারণায় বিশেষ কান দেয়নি। কিন্তু ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর (নাইন-ইলেভেন) নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটনে আল কায়েদা সন্ত্রাসের পর মার্কিন জনমত ভয়ঙ্কর রকম ইসলামবিদ্বেষী হয়ে দাঁড়ায়। সে বছরের ৭ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন আফগানিস্তান আক্রমণ করে। ইসরাইল সাদ্দামের কল্পিত গণবিধ্বংসী অস্ত্রের স্তূপের প্রচারণা বাড়িয়ে দেয়। একই সঙ্গে মোসাদ এ মর্মে ভুয়া প্রমাণ দাঁড় করায় যে, সাদ্দাম হোসেন আল কায়েদাকে সাহায্য দিচ্ছেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ আর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টোনি ব্লেয়ার ২০০৩ সালের ২০ মার্চ ইরাকের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ ঘোষণা করেন।
ইরান ওদের লক্ষ্য কেন?
সাদ্দাম ও তার ছেলেদের হত্যা করা হয়েছে। ইরাক দেশটির ধ্বংস এতো ব্যাপক ও সাংঘাতিক হয়েছে যে, আগামী ৫০ বছরে এ দেশটির আবার মাথা তুলে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা নেই। কিন্তু পাশের দেশ ইরানের বৈশিষ্ট্য তার উদ্ভাবনী প্রতিভা ও কঠোর পরিশ্রম। ইসরাইলি উস্কানিতে ইউরোপ-আমেরিকার চাপিয়ে দেয়া অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক অবরোধ সত্ত্বেও দেশটি আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, বিজ্ঞানে-প্রকৌশলে অনেক উন্নতি করেছে। বিশেষ করে পারমাণবিক প্রযুক্তিতে তার অগ্রগতিকে বন্ধুরা প্রশংসার আর শত্রুরা শঙ্কার চোখে দেখছে।
মার্কিন বিশেষজ্ঞরাও বলেছেন, ইরান এখনও পর্যন্ত ইউরেনিয়াম জ্বালানি সমৃদ্ধিকরণের কাজেই অগ্রগতি লাভ করেছে কিন্তু বোমা তৈরির কোনো চেষ্টা সে এখনও করেনি। ইরানের নেতারা বার বার বলছেন—তারা বোমা তৈরি করতে চান না; শুধু পারমাণবিক বিদ্যুত্ উত্পাদনের উন্নত জ্বালানি তৈরি করাই তাদের লক্ষ্য। ইরানের জন্য সমস্যা এই যে, সর্বোচ্চ গ্রেডের ইউরেনিয়াম দিয়ে যেমন সফলভাবে বিদ্যুত্ উত্পাদন করা যায়, তেমনি সে ইউরেনিয়াম আবার বোমা তৈরির কাজেও ব্যবহৃত হতে পারে—যদি সে প্রযুক্তি ইরান আয়ত্ত করতে পারে।
ইসরাইলি গোয়েন্দারা এটা প্রমাণ করার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে যে, বোমা তৈরির প্রযুক্তি ইরান এরই মধ্যে আয়ত্ত করে ফেলেছে এবং আগামী ক’মাসের মধ্যেই তেহরান পারমাণবিক বোমার অধিকারী হবে। মার্কিন সরকারের মূল্যায়ন কিন্তু তেমন নয়। ইচ্ছা করলেও ইরান এত শিগগির বোমা তৈরি করতে পারবে বলে তারা মনে করে না। তা সত্ত্বেও তেলআবিব বোমা ফেলে ইরানের পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্রগুলো ধ্বংস করে দেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে পীড়াপীড়ি, এমনকি ব্ল্যাকমেইল করারও চেষ্টা করছে। ইসরাইলিরা বলছে, ওয়াশিংটন কিছু না করলে তারা নিজেরাই কেন্দ্রগুলোর ওপর আক্রমণ চালাবে। তেমন অবস্থায় ইচ্ছায় হোক কিংবা অনিচ্ছায় হোক, ওয়াশিংটনও সে যুদ্ধে না জড়িয়ে পারবে না। মোসাদের লোকেরা এরই মধ্যে ইরানের একাধিক স্থানে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। এ পর্যন্ত তারা চার ইরানি পারমাণবিক বিজ্ঞানীকে খুনও করিয়েছে।
প্রেসিডেন্ট ওবামার হয়েছে মহাসমস্যা। যদিও তিনি মনে করেন না ইরানের বোমা তৈরির সময় আসন্ন, তবুও ইসরাইলের চাপ এড়িয়ে যাওয়া তার জন্য কঠিন। আর ৭ মাস পরই যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। ওবামা আরও চার বছরের জন্য ক্ষমতা পেতে চান। ইসরাইলি লবিগুলোকে অসন্তুষ্ট করে নির্বাচিত হওয়া তার জন্য সহজ হবে না। অন্যদিকে ইরাক আর আফগানিস্তানে যুগপত্ যুদ্ধে মার্কিন অর্থনীতি কাবু হয়ে পড়েছে। এ দুটি দেশে ওয়াশিংটন যতদিন জড়িত, সেটা দু’দুটি বিশ্বযুদ্ধের মোট মেয়াদের চেয়েও বেশি। মার্কিন ভোটদাতারা এখন যুদ্ধক্লান্ত।
সমরবাদের কথা পশ্চিমারা ভুলে গেছে
আগেই বলেছি, জার্মানিতে অ্যান্টিসেমিটিজম নির্মূল করতে গিয়ে আমেরিকা আর ইউরোপ জার্মান মিলিটারিজমের অভিশাপের কথা ভুলে গেছে। গুন্টার গ্রাস সম্প্রতি একটি জার্মান সাময়িকীতে প্রকাশিত ‘যে কথা বলতেই হবে’ শীর্ষক কবিতায় সে কথাটা আবার বিশ্ববাসীকে মনে করিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন—‘যে যুদ্ধবাজ জার্মানিকে দু’দুটো বিশ্বযুদ্ধে লিপ্ত করেছে, সে ভূত এখন ইসরাইলের ঘাড়ে চেপেছে।’ নাম না করে তিনি বলেছেন, ইরান এখনও পারমাণবিক বোমা তৈরি করেনি, তবুুও তার ‘প্রথম আক্রমণের’ অধিকারের জোরে ইসরাইল ইরান আক্রমণের হুমকি দিচ্ছে; অথচ ইসরাইল নিজেই গোপনে তৈরি করেছে সে বোমা।
গুন্টার গ্রাস ‘যে কথা বলতেই হবে’ কবিতায় লিখেছেন : ‘এতকাল কেন আমি নীরব আর আটকা পড়ে ছিলাম/এমন একটি বিষয়ে যেটা প্রকাশ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলায়/আমরা যারা বেঁচে থাকব সে যুদ্ধের পরে/বড়জোর পাদটীকা হয়েই থাকব আমরা।’
‘প্রথমেই আক্রমণের কথিত অধিকার/ধ্বংস করে দিতে পারে ইরানি জাতিকে/যারা কে গলাবাজ আর সাজানো জলসার পদানত/কেননা তার অধীনে নাকি অ্যাটম বোমা তৈরির কাজ চলছে।’
‘তবু অন্য সে দেশটির নাম নিতে কেন আমার ভরসা হচ্ছে না/বহু বছর ধরে যারা অ্যাটম বোমা গোপন রেখেছে ও বাড়াচ্ছে/আর সবার নজরদারি আর তদারকির বাইরে।’ লিখেছেন গুন্টার গ্রাস।
যে ইহুদিরা একদা নির্যাতিত ছিল, তারা এখন নির্যাতক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইঙ্গিতে গুন্টার গ্রাস বলতে চেয়েছেন, জার্মান সমরবাদ প্রথমে ইউরোপে এবং তার জের ধরে বাকি বিশ্বে সর্বনাশ ডেকে এনেছিল, ইসরাইলি সমরবাদও তেমনি মধ্যপ্রাচ্যে অশান্তি ডেকে আনতে চায় এবং সে অশান্তি খুব সম্ভবত বৃহত্তর বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে।
গুন্টার গ্রাস এতকাল ইসরাইলসহ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত ছিলেন। বহুবার তিনি ইসরাইল সফরও করেছেন। কিন্তু ইসরাইলি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলে দিয়েছেন—তাকে আর ইসরাইলে আসতে দেয়া হবে না। বিশ্বব্যাপী ইসরাইলি লবিগুলো তার সমালোচনার প্রতিযোগিতা শুরু করে দিয়েছে বলেই মনে হয়। এতকাল যিনি ‘হিরো’ ছিলেন, মাত্র একটি কবিতা লিখে তিনি জায়নিস্ট জগতে ‘ভিলেন’ হয়ে গেলেন।
কালো মেঘের রুপালি বর্ণচ্ছটার মতো একটা আশার আলো আছে জার্মান চিন্তানায়ক গুন্টার গ্রাসের এই সাময়িক বিপত্তির মধ্যে। ইসরাইল যে সত্যি সত্যি বিশ্বশান্তির প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে, সে কথা এখন অনেকেই ভাবতে শুরু করবেন। গুন্টারের সাহিত্য অনেকেই পড়েননি কিন্তু তার এই বহু আলোচিত কবিতাটি বহু দেশে, বহু ভাষায় অনূদিত ও প্রকাশিত হয়েছে। (লন্ডন, পহেলা বৈশাখ, ১৪১৯)
serajurrahman@btinternet.com
হিটলার ইউরোপের ওপর এবং তার জের ধরে বিশ্বব্যাপী যে যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিলেন তাতে ১০ কোটি লোক মারা গেছে বলে অনুমান করা হয়। জায়নিস্ট প্রতিষ্ঠানগুলো তখন থেকেই দাবি করে আসছে যে, নািসরা ছয় মিলিয়ন (৬০ লাখ) ইহুদিকে হত্যা করেছিল। তখন থেকে বিশ্বে আধিপত্যবাদী জায়নিস্টরা তাদের ৬০ লাখ নিয়ে এমনই প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে যে, সেই যুদ্ধে নিহত অবশিষ্ট প্রায় সাড়ে নয় কোটির কথা বিশ্ববাসী ভুলেই গেছে বলা চলে।
ইহুদিদের হিটলারের ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে’ পাঠানোর ব্যাপারে ফ্রান্সসহ কোনো কোনো দেশ নািসদের সঙ্গে সহযোগিতা করেছিলো। ব্রিটেনসহ অন্য দেশগুলো নািসবাদের বিবর্তন ও ইহুদি নির্যাতন দেখেও দেখেনি। বস্তুত জার্মানি যখন চেকস্লোভাকিয়া আক্রমণ করে তার আগে পর্যন্ত ব্রিটেনও হিটলারকে তোষণ করেছে। ১৯৩৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বরের আগে ব্রিটেন জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেনি।
যুদ্ধের পর থেকেই বিশ্ব আধিপত্যবাদী জায়নিস্টরা হিটলারের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতার জন্য ইউরোপের দেশগুলোর কাছ থেকে খুবই উচ্চমূল্য আদায় করতে শুরু করে। গোড়াতেই সব ব্যাপারে ইহুদিদের সঙ্গে সহযোগিতা করা এ মহাদেশে যেন রাষ্ট্রধর্ম হয়ে দাঁড়ায়। ইহুদি-বিদ্বেষকে দণ্ডনীয় অপরাধ করা হয় প্রায় সব ইউরোপীয় দেশে। ইউরোপ-আমেরিকার বাধ্যতামূলক সহানুভূতিকে কাজে লাগিয়ে ইহুদিরা ফিলিস্তিনি আরবদের (মুসলিম ও খ্রিস্টান) ভূমিতে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠা করে।
জাতিসংঘের প্রস্তাবে ইহুদি রাষ্ট্রের জন্য যে পরিমাণ ভূমি নির্দিষ্ট করা হয়েছিলো, আজকের ইসরাইল রাষ্ট্রের আয়তন তার প্রায় তিনগুণ। প্রথমেই ইরগুন, স্টার্ন গ্যাং প্রভৃতি মূলত পোলিশ ইহুদি সন্ত্রাসীরা প্রায় আট হাজার বর্ধিত আরব পরিবারকে উচ্ছেদ করে তাদের ভিটেবাড়ি ও আবাদি জমি দখল করে নেয়। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরাইল রাষ্ট্র ফিলিস্তিনের অবশিষ্টাংশও দখল করে। জাতিসংঘ তখন থেকে এই দখল করা আরব ভূমি ছেড়ে যাওয়ার জন্য ইসরাইলকে নির্দেশ দিয়ে বহু প্রস্তাব পাস করেছে, কিন্তু আরবদের ভিটেবাড়ি, আবাদি জমি ও ফলের বাগান উচ্ছেদ করে ইহুদি বসতি নির্মাণ অবিরাম চলছে। জাতিসংঘ অনেক প্রস্তাব পাস করে এসব বসতিকে অবৈধ ঘোষণা করেছে।
এসব প্রস্তাব কার্যকর করা সম্ভব হচ্ছে না এ কারণে যে, ইসরাইলকে বাধ্য করার কোনো প্রস্তাবে সম্মতি দিতে ইউরোপের দেশগুলোকে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে রাজি করানো যাচ্ছে না। জায়নিস্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী ইহুদিরা এসব দেশে সব গুরুত্বপূর্ণ পেশায় ঢুকে পড়েছে। ইউরোপের কোনো দেশে ইহুদিদের সংখ্যা তিন-চার শতাংশের বেশি নয়। কিন্তু সেসব দেশের পার্লামেন্টে এবং সরকারে ইহুদিদের প্রতিনিধিত্ব আনুপাতিকভাবে বেশি। তেমনি এই দেশগুলোর অর্থনীতি এবং মিডিয়াকেও তারা মুঠোর মধ্যে নিয়ে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদি প্রভাব আরও প্রকট। ইহুদি ও ইসরাইলি লবিগুলোর অনুমোদন ছাড়া এখন মার্কিন কংগ্রেসে কোনো আইন পাস করা অথবা কোনো রাজনীতিকের কোনো গুরুত্বত্বপূর্ণ পদে নির্বাচিত হওয়া প্রায় অসম্ভব। ইসরাইলের বিরুদ্ধে কোনো কথা উঠলেই সারাবিশ্বের ইহুদিরা ‘অ্যান্টিসেমিটিজমের’ (ইহুদি-বিদ্বেষের) জিগির শুরু করে দেয়, নািসদের হাতে নিহত ৬০ লাখ ইহুদির কথা তুলে কান্না জুড়ে দেয়। অর্থাত্ ত্রিশের দশকে নািসদের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার দরুন জায়নিস্টরা এখনও পশ্চিমা বিশ্বকে জিম্মি করে রেখেছে, বাকি বিশ্বকেও ব্ল্যাকমেইল করে।
পশ্চিমা সাহায্যে ক্ষুদে হিটলার
ইহুদি-বিদ্বেষ নিষিদ্ধ করার পেছনে আদি যুক্তি ছিল নািসবাদের পুনরাবির্ভাব অসম্ভব করে তোলা। জার্মান ‘মিলিটারিজমের‘ (সামরিক মনোভাবের প্রাবল্য) কারণে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দখলদার শক্তিগুলো (ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েট ইউনিয়ন ও ফ্রান্স) এ জঙ্গিবাদকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য বহু নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা চালু করে। কিন্তু অন্যদিকে ‘শত্রু-পরিবেষ্টিত ইসরাইলের আত্মরক্ষার ‘অজুহাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে সামরিক সাহায্য দান এবং সমরাস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের সাহায্যে ইসরাইল গোপনে পারমাণবিক বোমা তৈরি করেছে। তার অস্ত্রভাণ্ডারে এখন ৪০০টি পারমাণবিক বোমা আছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। কবি গুন্টার গ্রাস এখন ফাঁস করে দিলেন যে, জার্মানিও ইসরাইলকে অস্ত্র সরবরাহ করে আসছে এবং বর্তমানে ইসরাইলের জন্য দুটি পারমাণবিক সাবমেরিন তৈরি করছে।
অবিসংবাদিত সত্য এই যে, ইসরাইল এখন মধ্যপ্রাচ্যে প্রধান সামরিক শক্তি। নিজেরও অত্যন্ত আধুনিক একটা যুদ্ধাস্ত্র তৈরির শিল্প সে গড়ে তুলেছে। ভারতসহ কোনো কোনো দেশ ইসরাইলের কাছ থেকে সমরাস্ত্র আমদানি করে। বস্তুত ভারতেও ইসরাইলের সহযোগিতায় একটা অস্ত্র নির্মাণশিল্প গড়ে উঠেছে। মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক পরাশক্তির অবস্থান স্থায়ী করতে তেলআবিব সর্বদা উদগ্রীব। এ অঞ্চলের অন্য কোন দেশ শক্তিশালী হয়ে ওঠার চেষ্টা করলে ইসরাইল স্বয়ং কিংবা যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যবহার করে সে দেশকে শক্তিহীন করে দেয়া তেলআবিবের পরিচিত কৌশল। ইসরাইল গোড়া থেকেই দাবি করে এসেছে, যে কেউ তার নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ বিবেচনা করলে আগেই তাকে আক্রমণ করার অধিকার ইসরাইলের আছে। অর্থাত্ এক্ষেত্রে সে অভিযোগকারী, জজ ও জুরির ভূমিকা একাই পালন করছে। প্রথমে যুক্তরাষ্ট্র তারপর অন্যান্য পশ্চিমা শক্তি নীরবে তেলআবিবের সে অন্যায় আবদার মেনে নিয়েছে।
ইরানে ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পর সম্ভাবনা দেখা দেয় নতুন আদর্শে উজ্জীবিত ইরান ইসরাইলি আধিপত্যের প্রতি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্ররোচনা ও অস্ত্র সাহায্যে ইরাকের সাদ্দাম হোসেন ইরান আক্রমণ করেন। সেই যুদ্ধ আট বছর ধরে চলে। কিন্তু সে সাদ্দামই যখন বাগদাদের উপকণ্ঠে অসিরাকে একটা পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করেন তখন ১৯৮১ সালে ইসরাইল ভোল-পাল্টানো মার্কিন বোমারু বিমান ব্যবহার করে কেন্দ্রটি উড়িয়ে দেয়।
আট বছরের যুদ্ধের পর ইরান সাময়িকভাবে দুর্বল হয়ে যায়। অন্যদিকে সাদ্দাম হোসেনের নেতৃত্বে ইরাক শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে। তখন থেকে ইসরাইলি গোয়েন্দা বাহিনী মোসাদ প্রচার চালাতে থাকে, সাদ্দাম হোসেন গোপনে গণবিধ্বংসী (পারমাণবিক ও রাসায়নিক) অস্ত্র তৈরি করছেন। গোড়ায় ওয়াশিংটন কিংবা লন্ডন এসব প্রচারণায় বিশেষ কান দেয়নি। কিন্তু ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর (নাইন-ইলেভেন) নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটনে আল কায়েদা সন্ত্রাসের পর মার্কিন জনমত ভয়ঙ্কর রকম ইসলামবিদ্বেষী হয়ে দাঁড়ায়। সে বছরের ৭ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন আফগানিস্তান আক্রমণ করে। ইসরাইল সাদ্দামের কল্পিত গণবিধ্বংসী অস্ত্রের স্তূপের প্রচারণা বাড়িয়ে দেয়। একই সঙ্গে মোসাদ এ মর্মে ভুয়া প্রমাণ দাঁড় করায় যে, সাদ্দাম হোসেন আল কায়েদাকে সাহায্য দিচ্ছেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ আর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টোনি ব্লেয়ার ২০০৩ সালের ২০ মার্চ ইরাকের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ ঘোষণা করেন।
ইরান ওদের লক্ষ্য কেন?
সাদ্দাম ও তার ছেলেদের হত্যা করা হয়েছে। ইরাক দেশটির ধ্বংস এতো ব্যাপক ও সাংঘাতিক হয়েছে যে, আগামী ৫০ বছরে এ দেশটির আবার মাথা তুলে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা নেই। কিন্তু পাশের দেশ ইরানের বৈশিষ্ট্য তার উদ্ভাবনী প্রতিভা ও কঠোর পরিশ্রম। ইসরাইলি উস্কানিতে ইউরোপ-আমেরিকার চাপিয়ে দেয়া অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক অবরোধ সত্ত্বেও দেশটি আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, বিজ্ঞানে-প্রকৌশলে অনেক উন্নতি করেছে। বিশেষ করে পারমাণবিক প্রযুক্তিতে তার অগ্রগতিকে বন্ধুরা প্রশংসার আর শত্রুরা শঙ্কার চোখে দেখছে।
মার্কিন বিশেষজ্ঞরাও বলেছেন, ইরান এখনও পর্যন্ত ইউরেনিয়াম জ্বালানি সমৃদ্ধিকরণের কাজেই অগ্রগতি লাভ করেছে কিন্তু বোমা তৈরির কোনো চেষ্টা সে এখনও করেনি। ইরানের নেতারা বার বার বলছেন—তারা বোমা তৈরি করতে চান না; শুধু পারমাণবিক বিদ্যুত্ উত্পাদনের উন্নত জ্বালানি তৈরি করাই তাদের লক্ষ্য। ইরানের জন্য সমস্যা এই যে, সর্বোচ্চ গ্রেডের ইউরেনিয়াম দিয়ে যেমন সফলভাবে বিদ্যুত্ উত্পাদন করা যায়, তেমনি সে ইউরেনিয়াম আবার বোমা তৈরির কাজেও ব্যবহৃত হতে পারে—যদি সে প্রযুক্তি ইরান আয়ত্ত করতে পারে।
ইসরাইলি গোয়েন্দারা এটা প্রমাণ করার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে যে, বোমা তৈরির প্রযুক্তি ইরান এরই মধ্যে আয়ত্ত করে ফেলেছে এবং আগামী ক’মাসের মধ্যেই তেহরান পারমাণবিক বোমার অধিকারী হবে। মার্কিন সরকারের মূল্যায়ন কিন্তু তেমন নয়। ইচ্ছা করলেও ইরান এত শিগগির বোমা তৈরি করতে পারবে বলে তারা মনে করে না। তা সত্ত্বেও তেলআবিব বোমা ফেলে ইরানের পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্রগুলো ধ্বংস করে দেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে পীড়াপীড়ি, এমনকি ব্ল্যাকমেইল করারও চেষ্টা করছে। ইসরাইলিরা বলছে, ওয়াশিংটন কিছু না করলে তারা নিজেরাই কেন্দ্রগুলোর ওপর আক্রমণ চালাবে। তেমন অবস্থায় ইচ্ছায় হোক কিংবা অনিচ্ছায় হোক, ওয়াশিংটনও সে যুদ্ধে না জড়িয়ে পারবে না। মোসাদের লোকেরা এরই মধ্যে ইরানের একাধিক স্থানে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। এ পর্যন্ত তারা চার ইরানি পারমাণবিক বিজ্ঞানীকে খুনও করিয়েছে।
প্রেসিডেন্ট ওবামার হয়েছে মহাসমস্যা। যদিও তিনি মনে করেন না ইরানের বোমা তৈরির সময় আসন্ন, তবুও ইসরাইলের চাপ এড়িয়ে যাওয়া তার জন্য কঠিন। আর ৭ মাস পরই যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। ওবামা আরও চার বছরের জন্য ক্ষমতা পেতে চান। ইসরাইলি লবিগুলোকে অসন্তুষ্ট করে নির্বাচিত হওয়া তার জন্য সহজ হবে না। অন্যদিকে ইরাক আর আফগানিস্তানে যুগপত্ যুদ্ধে মার্কিন অর্থনীতি কাবু হয়ে পড়েছে। এ দুটি দেশে ওয়াশিংটন যতদিন জড়িত, সেটা দু’দুটি বিশ্বযুদ্ধের মোট মেয়াদের চেয়েও বেশি। মার্কিন ভোটদাতারা এখন যুদ্ধক্লান্ত।
সমরবাদের কথা পশ্চিমারা ভুলে গেছে
আগেই বলেছি, জার্মানিতে অ্যান্টিসেমিটিজম নির্মূল করতে গিয়ে আমেরিকা আর ইউরোপ জার্মান মিলিটারিজমের অভিশাপের কথা ভুলে গেছে। গুন্টার গ্রাস সম্প্রতি একটি জার্মান সাময়িকীতে প্রকাশিত ‘যে কথা বলতেই হবে’ শীর্ষক কবিতায় সে কথাটা আবার বিশ্ববাসীকে মনে করিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন—‘যে যুদ্ধবাজ জার্মানিকে দু’দুটো বিশ্বযুদ্ধে লিপ্ত করেছে, সে ভূত এখন ইসরাইলের ঘাড়ে চেপেছে।’ নাম না করে তিনি বলেছেন, ইরান এখনও পারমাণবিক বোমা তৈরি করেনি, তবুুও তার ‘প্রথম আক্রমণের’ অধিকারের জোরে ইসরাইল ইরান আক্রমণের হুমকি দিচ্ছে; অথচ ইসরাইল নিজেই গোপনে তৈরি করেছে সে বোমা।
গুন্টার গ্রাস ‘যে কথা বলতেই হবে’ কবিতায় লিখেছেন : ‘এতকাল কেন আমি নীরব আর আটকা পড়ে ছিলাম/এমন একটি বিষয়ে যেটা প্রকাশ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলায়/আমরা যারা বেঁচে থাকব সে যুদ্ধের পরে/বড়জোর পাদটীকা হয়েই থাকব আমরা।’
‘প্রথমেই আক্রমণের কথিত অধিকার/ধ্বংস করে দিতে পারে ইরানি জাতিকে/যারা কে গলাবাজ আর সাজানো জলসার পদানত/কেননা তার অধীনে নাকি অ্যাটম বোমা তৈরির কাজ চলছে।’
‘তবু অন্য সে দেশটির নাম নিতে কেন আমার ভরসা হচ্ছে না/বহু বছর ধরে যারা অ্যাটম বোমা গোপন রেখেছে ও বাড়াচ্ছে/আর সবার নজরদারি আর তদারকির বাইরে।’ লিখেছেন গুন্টার গ্রাস।
যে ইহুদিরা একদা নির্যাতিত ছিল, তারা এখন নির্যাতক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইঙ্গিতে গুন্টার গ্রাস বলতে চেয়েছেন, জার্মান সমরবাদ প্রথমে ইউরোপে এবং তার জের ধরে বাকি বিশ্বে সর্বনাশ ডেকে এনেছিল, ইসরাইলি সমরবাদও তেমনি মধ্যপ্রাচ্যে অশান্তি ডেকে আনতে চায় এবং সে অশান্তি খুব সম্ভবত বৃহত্তর বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে।
গুন্টার গ্রাস এতকাল ইসরাইলসহ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত ছিলেন। বহুবার তিনি ইসরাইল সফরও করেছেন। কিন্তু ইসরাইলি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলে দিয়েছেন—তাকে আর ইসরাইলে আসতে দেয়া হবে না। বিশ্বব্যাপী ইসরাইলি লবিগুলো তার সমালোচনার প্রতিযোগিতা শুরু করে দিয়েছে বলেই মনে হয়। এতকাল যিনি ‘হিরো’ ছিলেন, মাত্র একটি কবিতা লিখে তিনি জায়নিস্ট জগতে ‘ভিলেন’ হয়ে গেলেন।
কালো মেঘের রুপালি বর্ণচ্ছটার মতো একটা আশার আলো আছে জার্মান চিন্তানায়ক গুন্টার গ্রাসের এই সাময়িক বিপত্তির মধ্যে। ইসরাইল যে সত্যি সত্যি বিশ্বশান্তির প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে, সে কথা এখন অনেকেই ভাবতে শুরু করবেন। গুন্টারের সাহিত্য অনেকেই পড়েননি কিন্তু তার এই বহু আলোচিত কবিতাটি বহু দেশে, বহু ভাষায় অনূদিত ও প্রকাশিত হয়েছে। (লন্ডন, পহেলা বৈশাখ, ১৪১৯)
serajurrahman@btinternet.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন