হামিদ মির | তারিখ: ০৬-০৫-২০১২
ওসামা বিন লাদেন এখন ইতিহাস। কিন্তু আল-কায়েদা এখনো নতুন ইতিহাস সৃষ্টির ব্যাপারে বদ্ধপরিকর। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা সঠিকভাবেই বারবার বলেছেন, ওসামার মৃত্যুতে আল-কায়েদা দুর্বল হয়ে গেলেও লাদেনের মতবাদ এখনো আফগানিস্তান থেকে ইয়েমেন, ইরাক থেকে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণার উৎস। জীবিত ওসামা থেকে মৃত ওসামা কম বিপজ্জনক নয়।
ওসামার মৃত্যুর পর মে মাসের ২ তারিখ পর্যন্ত ওবামা প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে আটটি সন্ত্রাসবাদী পরিকল্পনা ভণ্ডুল করে দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট ওবামা ওসামাকে হত্যার কৃতিত্ব নিতে পারেন, কিন্তু লাদেন যে তাঁর পছন্দমতো মৃত্যুই বরণ করেছেন, সে ব্যাপারে তিনি ওয়াকিবহাল নন। শত্রুর হাতে ধরা পড়ার বদলে নিহত হওয়া এবং দুনিয়ায় কোনো কবর না থাকাই ছিল লাদেনের পুরোনো স্বপ্ন। ঠিক সেটাই ঘটেছে।
পুরোনো বন্ধু শফিক-আল মাদানির মতো শহীদ হওয়ার জন্য সব সময় প্রার্থনা করতেন ওসামা। প্রথম ১৯৯৭ সালে বিন লাদেনের মুখে আমি শফিকের নাম শুনি। ১৯৯৭ সালের মার্চে আমিই প্রথম পাকিস্তানি সাংবাদিক হিসেবে প্রথম লাদেনের সঙ্গে দেখা করি; এবং ৯-১১-এর সাত সপ্তাহ পরে আমিই শেষ সাংবাদিক, যে তাঁর সাক্ষাৎকার নেয়। ১৯৯৮ সালে আমি তাঁর জীবনী লেখার কাজ শুরু করি। সে সময় তাঁকে প্রশ্ন করি, তাঁর জীবনে কোন কোন মানুষের প্রভাব সবচেয়ে বেশি, কারা তাঁর নায়ক। ওসামা বলেছিলেন, শফিক-আল মাদানির মতো বন্ধু পেয়ে তিনি গর্বিত, যিনি সব সময় শহীদ হতে ভালোবাসতেন।
মদিনা থেকে আগত শফিক ভালো ফুটবল খেললেও তিনি ওসামার সঙ্গে সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে আফগান জেহাদে অংশ নেন। ১৯৯৮ সালের জালালাবাদ লড়াই পর্যন্ত তিনি সব সময় যুদ্ধের সামনের কাতারে থাকতেন। অনন্য শহীদ হতে চাইতেন শফিক। একদা তিনি ওসামাকে বলেছিলেন, ‘ওহ, প্রিয় শেখ ওসামা, শহীদ হওয়ার পর পশুপাখির উদরই যেন হয় আমার কবরস্থান, আমি মাটিতে সমাধিস্ত হতে চাই না। শেষ বিচারের দিন যেন ওই সব পশু ও পাখি আল্লাহর কাছে সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহর নামে যুদ্ধ করার জন্যই শফিক-আল মাদানির দেহকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করা হয়।’
আরপিজি দিয়ে সোভিয়েত ট্যাংক ধ্বংস করায় শফিক-আল মাদানি দারুণ দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন। জালালাবাদে লড়াই চলার সময় একদিন সোভিয়েত সেনারা তাঁকে ঘিরে ফেলে। তাঁরা তিনজন পালানোর চেষ্টা করে দেখলেন যে তাঁদের ঘিরে ফেলা হয়েছে। শফিক ছিলেন অন্য দুজনের থেকে বড়।
শফিক গুলি চালিয়ে ঢাল হয়ে সঙ্গী দুজনকে আড়াল করলেন এবং তাঁদের পালাতে নির্দেশ দিলেন। সামনের দিক থেকে আসা একটি ট্যাংক ধ্বংস করতে পারলেও বাঁ থাকা আরেকটি ট্যাংকের গোলার শিকার হলেন। তাঁর শরীর ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। এভাবেই পূরণ হলো তাঁর স্বপ্ন।
শত্রু এলাকায় নিহত হয়েছিলেন শফিক এবং তাঁর শরীরের কোনো অবশেষ আর পাওয়া যায়নি। কোনো কবরে তাঁকে সমাধিস্থ করা যায়নি। পাখি ও পশুদের পাকস্থলীই হলো তাঁর শেষ আশ্রয়।
ওসামা বিন লাদেন বলেছিলেন, ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহ শফিক-আল মাদানির স্বপ্ন সত্যি করেছেন। তিনি শহীদ হয়েছিলেন এবং আমি আল্লাহর কাছে মোনাজাত করেছিলাম, আমারও যেন শফিক আল মাদানির মতো মৃত্যু হয় এবং আমারও শেষ ঠাঁই যেন মাটিতে না হয়।’
শফিক-আল মাদানির দ্বারা ওসামা বিন লাদেন এতই প্রভাবিত ছিলেন যে, তিনি একটা স্পিডবোট কেনেন এবং সেটাকে জেদ্দায় তাঁদের পারিবারিক বন্দরে রাখেন। তিনি এর নাম দেন শফিক-আল মাদানি। স্পিডবোটটির ইঞ্জিন সরিয়ে আরও শক্তিশালী একটি লাগানো হয়। এই ‘শফিক আল মাদানি’ স্পিডবোটেই আল-কায়েদার সদস্যদের সামুদ্রিক যুদ্ধের প্রথম প্রশিক্ষণ হয়। ওসামাও সমুদ্র দারুণ ভালোবাসতেন। লোহিত সাগরে মাছ ধরতে ধরতে তিনি মিসরীয় তাত্ত্বিক সৈয়দ কুতুবের অনেক বই পড়ে ফেলেন।
ওসামা কখনোই কল্পনা করেননি যে কোথাও কবর না দিয়ে মার্কিন সেনারা তাঁর লাশ সমুদ্রে ডুবিয়ে দেবে। ওবামা প্রশাসন আল-কায়েদাকে কবর দিতে না পারলেও একজন বিশাল মাপের শহীদ জুগিয়ে দিয়েছে। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ ওসামার ব্যবহূত বাড়িটি মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিলেও আল-কায়েদা গুঁড়িয়ে যায়নি।
ওবামা প্রশাসনের ভয়, আইমান আল জাওয়াহিরি হয়তো পাকিস্তানেই লুকিয়ে আছেন। কিন্তু ওসামাকে হত্যার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের মধ্যে আর তেমন সমন্বয় নেই। পাকিস্তান কখনোই সিআইএকে ওসামা পরিবারকে জেরা করার পূর্ণ সুযোগ দেয়নি। কিছুদিন আগেই এই বিরাট পরিবারের সদস্যদের সৌদি কর্তৃপক্ষের হাতে সোপর্দ করা হয়। আল-কায়েদার তরফে গুরুতর প্রতিহিংসামূলক আক্রমণের ভয় ছিল পাকিস্তানের। তারা ভালো করেই জানে, আল-কায়েদার কর্মীরা করাচি বা লাহোরের মতো বড় বড় শহরে লুকিয়ে আছেন। যেকোনো সময় তাঁরা বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারেন। পাকিস্তান কেন আল-কায়েদার হুমকিকে বড় করে দেখছে? গত বছর করাচির মেহরান ঘাঁটিতে হামলার পর থেকে আল-কায়েদার সদস্যরা আফগানিস্তানে চলে যাওয়া শুরু করেছে।
এসব কর্মী আফগান তালেবানদের ন্যাটো সেনাদের ওপর আরও সংগঠিতভাবে হামলা করায় সাহায্য করছেন। একই সঙ্গে তাঁরা পাকিস্তানের পরামর্শে ন্যাটোর সঙ্গে আলোচনা না চালাতেও বলছেন তালেবানদের। এঁদের সবাই সক্রিয় যোদ্ধা নন, তবে অনেকেই তালেবানদের পরামর্শকের ভূমিকা পালন করছেন।
ওবামা প্রশাসনকে অবশ্যই দুনিয়াকে জানিয়ে দিতে হবে, কেন সামি ওসমাকাক ও আমিনে এল খালাফির মতো মার্কিন মুসলিম তরুণেরা সন্ত্রাসবাদের হাতেখড়ি করে। উভয়েই গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাঁরা কখনো আফগানিস্তানে যাননি। সারা জীবনে কোনো আল-কায়েদা নেতার দেখাও তাঁরা পাননি। তার পরও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি তীব্র বিদ্বেষ তাঁদের মনে দানা বেঁধেছে। সামিকে ধরা হয়েছে, কারণ সে ইন্টারনেটে আল-কায়েদার পতাকা খুঁজছিল।
যদি আমেরিকায় বসবাস করেও এসব তরুণের মধ্যে মার্কিন বিদ্বেষ জন্মায়, তাহলে যারা আফগানিস্তান বা পাকিস্তানে আছে, তাদের কী হাল? তারা নিজ চোখে দখলদার বাহিনীর নৃশংসতা দেখছে, তারা নিজ হাতে মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত নিরীহ নারী ও শিশুদের কবরে নামাচ্ছে। এসব ক্রুদ্ধ তরুণের চাপেই তালেবান নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলাপ থেকে সরে এসেছেন।
৯/১১-এর পর যুক্তরাষ্ট্র তার মাটিতে ৫০টিরও বেশি সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনা ভণ্ডুল করে দিয়েছে। কিন্তু আফগানিস্তান আর পাকিস্তান তো আমেরিকা নয়। আমেরিকার সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের প্রধান শিকার এই দুটি দেশ এবং ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুর পরও দেশ দুটি চরম অনিরাপদ। আল-কায়েদার মতাদর্শ অনেকেই না-ও মানতে পারেন, কিন্তু তাঁর মতাদর্শ এখনো বিদ্যমান এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভুল নীতির কারণে তা আরও জোরদার হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের হঠকারী নীতি এবং আল-কায়েদার বিপজ্জনক মতাদর্শের সংমিশ্রণেই এসব ক্রুদ্ধ যুবক তৈরি হচ্ছেন। এসব কারণেই তাঁরা চান শফিক আল মাদানি ও ওসামা বিন লাদেনের মতো শহীদ হতে।
ওবামা ওসামার লাশ গভীর সমুদ্রে নিক্ষেপ করতে পারেন কিন্তু আল-কায়েদার মতাদর্শকে তিনি সমুদ্রে নিমজ্জিত করতে অক্ষম। ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা যদি আল-কায়েদার আক্রমণ ঠেকাতে চায়, তাহলে তাদের অবশ্যই নিজস্ব খারাপ নীতিগুলোকেও সমুদ্রে নিক্ষেপ করতে হবে।
অন্ততপক্ষে, বাগরামে যে মার্কিন সৈন্যরা পবিত্র কোরান পুড়িয়েছে, তাদের শাস্তি দিক। যারা কান্দাহারে নিরীহ নারী ও শিশুদের হত্যা করেছে, যেসব সেনা কর্মকর্তা সালালা চেকপোস্টে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছে, তাদেরও শাস্তি হোক। এসব খুনিকে রক্ষা করতে যাবেন না। যদি করেন, তাহলে ওসামা বিন লাদেনের স্বপ্ন আপনাদের হাতেই সত্যি হবে।
হামিদ মির: পাকিস্তানের জিয়ো টিভির নির্বাহী সম্পাদক।
hamid.mir@geo.tv
ওসামার মৃত্যুর পর মে মাসের ২ তারিখ পর্যন্ত ওবামা প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে আটটি সন্ত্রাসবাদী পরিকল্পনা ভণ্ডুল করে দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট ওবামা ওসামাকে হত্যার কৃতিত্ব নিতে পারেন, কিন্তু লাদেন যে তাঁর পছন্দমতো মৃত্যুই বরণ করেছেন, সে ব্যাপারে তিনি ওয়াকিবহাল নন। শত্রুর হাতে ধরা পড়ার বদলে নিহত হওয়া এবং দুনিয়ায় কোনো কবর না থাকাই ছিল লাদেনের পুরোনো স্বপ্ন। ঠিক সেটাই ঘটেছে।
পুরোনো বন্ধু শফিক-আল মাদানির মতো শহীদ হওয়ার জন্য সব সময় প্রার্থনা করতেন ওসামা। প্রথম ১৯৯৭ সালে বিন লাদেনের মুখে আমি শফিকের নাম শুনি। ১৯৯৭ সালের মার্চে আমিই প্রথম পাকিস্তানি সাংবাদিক হিসেবে প্রথম লাদেনের সঙ্গে দেখা করি; এবং ৯-১১-এর সাত সপ্তাহ পরে আমিই শেষ সাংবাদিক, যে তাঁর সাক্ষাৎকার নেয়। ১৯৯৮ সালে আমি তাঁর জীবনী লেখার কাজ শুরু করি। সে সময় তাঁকে প্রশ্ন করি, তাঁর জীবনে কোন কোন মানুষের প্রভাব সবচেয়ে বেশি, কারা তাঁর নায়ক। ওসামা বলেছিলেন, শফিক-আল মাদানির মতো বন্ধু পেয়ে তিনি গর্বিত, যিনি সব সময় শহীদ হতে ভালোবাসতেন।
মদিনা থেকে আগত শফিক ভালো ফুটবল খেললেও তিনি ওসামার সঙ্গে সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে আফগান জেহাদে অংশ নেন। ১৯৯৮ সালের জালালাবাদ লড়াই পর্যন্ত তিনি সব সময় যুদ্ধের সামনের কাতারে থাকতেন। অনন্য শহীদ হতে চাইতেন শফিক। একদা তিনি ওসামাকে বলেছিলেন, ‘ওহ, প্রিয় শেখ ওসামা, শহীদ হওয়ার পর পশুপাখির উদরই যেন হয় আমার কবরস্থান, আমি মাটিতে সমাধিস্ত হতে চাই না। শেষ বিচারের দিন যেন ওই সব পশু ও পাখি আল্লাহর কাছে সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহর নামে যুদ্ধ করার জন্যই শফিক-আল মাদানির দেহকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করা হয়।’
আরপিজি দিয়ে সোভিয়েত ট্যাংক ধ্বংস করায় শফিক-আল মাদানি দারুণ দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন। জালালাবাদে লড়াই চলার সময় একদিন সোভিয়েত সেনারা তাঁকে ঘিরে ফেলে। তাঁরা তিনজন পালানোর চেষ্টা করে দেখলেন যে তাঁদের ঘিরে ফেলা হয়েছে। শফিক ছিলেন অন্য দুজনের থেকে বড়।
শফিক গুলি চালিয়ে ঢাল হয়ে সঙ্গী দুজনকে আড়াল করলেন এবং তাঁদের পালাতে নির্দেশ দিলেন। সামনের দিক থেকে আসা একটি ট্যাংক ধ্বংস করতে পারলেও বাঁ থাকা আরেকটি ট্যাংকের গোলার শিকার হলেন। তাঁর শরীর ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। এভাবেই পূরণ হলো তাঁর স্বপ্ন।
শত্রু এলাকায় নিহত হয়েছিলেন শফিক এবং তাঁর শরীরের কোনো অবশেষ আর পাওয়া যায়নি। কোনো কবরে তাঁকে সমাধিস্থ করা যায়নি। পাখি ও পশুদের পাকস্থলীই হলো তাঁর শেষ আশ্রয়।
ওসামা বিন লাদেন বলেছিলেন, ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহ শফিক-আল মাদানির স্বপ্ন সত্যি করেছেন। তিনি শহীদ হয়েছিলেন এবং আমি আল্লাহর কাছে মোনাজাত করেছিলাম, আমারও যেন শফিক আল মাদানির মতো মৃত্যু হয় এবং আমারও শেষ ঠাঁই যেন মাটিতে না হয়।’
শফিক-আল মাদানির দ্বারা ওসামা বিন লাদেন এতই প্রভাবিত ছিলেন যে, তিনি একটা স্পিডবোট কেনেন এবং সেটাকে জেদ্দায় তাঁদের পারিবারিক বন্দরে রাখেন। তিনি এর নাম দেন শফিক-আল মাদানি। স্পিডবোটটির ইঞ্জিন সরিয়ে আরও শক্তিশালী একটি লাগানো হয়। এই ‘শফিক আল মাদানি’ স্পিডবোটেই আল-কায়েদার সদস্যদের সামুদ্রিক যুদ্ধের প্রথম প্রশিক্ষণ হয়। ওসামাও সমুদ্র দারুণ ভালোবাসতেন। লোহিত সাগরে মাছ ধরতে ধরতে তিনি মিসরীয় তাত্ত্বিক সৈয়দ কুতুবের অনেক বই পড়ে ফেলেন।
ওসামা কখনোই কল্পনা করেননি যে কোথাও কবর না দিয়ে মার্কিন সেনারা তাঁর লাশ সমুদ্রে ডুবিয়ে দেবে। ওবামা প্রশাসন আল-কায়েদাকে কবর দিতে না পারলেও একজন বিশাল মাপের শহীদ জুগিয়ে দিয়েছে। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ ওসামার ব্যবহূত বাড়িটি মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিলেও আল-কায়েদা গুঁড়িয়ে যায়নি।
ওবামা প্রশাসনের ভয়, আইমান আল জাওয়াহিরি হয়তো পাকিস্তানেই লুকিয়ে আছেন। কিন্তু ওসামাকে হত্যার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের মধ্যে আর তেমন সমন্বয় নেই। পাকিস্তান কখনোই সিআইএকে ওসামা পরিবারকে জেরা করার পূর্ণ সুযোগ দেয়নি। কিছুদিন আগেই এই বিরাট পরিবারের সদস্যদের সৌদি কর্তৃপক্ষের হাতে সোপর্দ করা হয়। আল-কায়েদার তরফে গুরুতর প্রতিহিংসামূলক আক্রমণের ভয় ছিল পাকিস্তানের। তারা ভালো করেই জানে, আল-কায়েদার কর্মীরা করাচি বা লাহোরের মতো বড় বড় শহরে লুকিয়ে আছেন। যেকোনো সময় তাঁরা বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারেন। পাকিস্তান কেন আল-কায়েদার হুমকিকে বড় করে দেখছে? গত বছর করাচির মেহরান ঘাঁটিতে হামলার পর থেকে আল-কায়েদার সদস্যরা আফগানিস্তানে চলে যাওয়া শুরু করেছে।
এসব কর্মী আফগান তালেবানদের ন্যাটো সেনাদের ওপর আরও সংগঠিতভাবে হামলা করায় সাহায্য করছেন। একই সঙ্গে তাঁরা পাকিস্তানের পরামর্শে ন্যাটোর সঙ্গে আলোচনা না চালাতেও বলছেন তালেবানদের। এঁদের সবাই সক্রিয় যোদ্ধা নন, তবে অনেকেই তালেবানদের পরামর্শকের ভূমিকা পালন করছেন।
ওবামা প্রশাসনকে অবশ্যই দুনিয়াকে জানিয়ে দিতে হবে, কেন সামি ওসমাকাক ও আমিনে এল খালাফির মতো মার্কিন মুসলিম তরুণেরা সন্ত্রাসবাদের হাতেখড়ি করে। উভয়েই গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাঁরা কখনো আফগানিস্তানে যাননি। সারা জীবনে কোনো আল-কায়েদা নেতার দেখাও তাঁরা পাননি। তার পরও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি তীব্র বিদ্বেষ তাঁদের মনে দানা বেঁধেছে। সামিকে ধরা হয়েছে, কারণ সে ইন্টারনেটে আল-কায়েদার পতাকা খুঁজছিল।
যদি আমেরিকায় বসবাস করেও এসব তরুণের মধ্যে মার্কিন বিদ্বেষ জন্মায়, তাহলে যারা আফগানিস্তান বা পাকিস্তানে আছে, তাদের কী হাল? তারা নিজ চোখে দখলদার বাহিনীর নৃশংসতা দেখছে, তারা নিজ হাতে মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত নিরীহ নারী ও শিশুদের কবরে নামাচ্ছে। এসব ক্রুদ্ধ তরুণের চাপেই তালেবান নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলাপ থেকে সরে এসেছেন।
৯/১১-এর পর যুক্তরাষ্ট্র তার মাটিতে ৫০টিরও বেশি সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনা ভণ্ডুল করে দিয়েছে। কিন্তু আফগানিস্তান আর পাকিস্তান তো আমেরিকা নয়। আমেরিকার সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের প্রধান শিকার এই দুটি দেশ এবং ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুর পরও দেশ দুটি চরম অনিরাপদ। আল-কায়েদার মতাদর্শ অনেকেই না-ও মানতে পারেন, কিন্তু তাঁর মতাদর্শ এখনো বিদ্যমান এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভুল নীতির কারণে তা আরও জোরদার হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের হঠকারী নীতি এবং আল-কায়েদার বিপজ্জনক মতাদর্শের সংমিশ্রণেই এসব ক্রুদ্ধ যুবক তৈরি হচ্ছেন। এসব কারণেই তাঁরা চান শফিক আল মাদানি ও ওসামা বিন লাদেনের মতো শহীদ হতে।
ওবামা ওসামার লাশ গভীর সমুদ্রে নিক্ষেপ করতে পারেন কিন্তু আল-কায়েদার মতাদর্শকে তিনি সমুদ্রে নিমজ্জিত করতে অক্ষম। ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা যদি আল-কায়েদার আক্রমণ ঠেকাতে চায়, তাহলে তাদের অবশ্যই নিজস্ব খারাপ নীতিগুলোকেও সমুদ্রে নিক্ষেপ করতে হবে।
অন্ততপক্ষে, বাগরামে যে মার্কিন সৈন্যরা পবিত্র কোরান পুড়িয়েছে, তাদের শাস্তি দিক। যারা কান্দাহারে নিরীহ নারী ও শিশুদের হত্যা করেছে, যেসব সেনা কর্মকর্তা সালালা চেকপোস্টে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছে, তাদেরও শাস্তি হোক। এসব খুনিকে রক্ষা করতে যাবেন না। যদি করেন, তাহলে ওসামা বিন লাদেনের স্বপ্ন আপনাদের হাতেই সত্যি হবে।
হামিদ মির: পাকিস্তানের জিয়ো টিভির নির্বাহী সম্পাদক।
hamid.mir@geo.tv
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন