নোয়েলে লেনয় | তারিখ: ১৬-০৫-২০১২
নির্বাচনে জয়ের পরপরই ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদকে একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, প্রেসিডেন্ট ওবামার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় কোন ভাষায় কথা বলা তিনি পছন্দ করবেন? তাঁর উত্তরে অনেক কিছু প্রকাশ পায়। তিনি বিদায়ী প্রেসিডেন্ট নিকোলা সারকোজির দিকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, ‘সাবেক প্রেসিডেন্টের থেকে আমি সাবলীলভাবে ইংরেজি বলি। কিন্তু ফরাসি প্রেসিডেন্টের অবশ্যই ফরাসি বলা উচিত।’
বৈশ্বিক যোগাযোগের সাধারণ ভাষা হিসেবে ইংরেজির ওপর তাঁর দখলের কথা বলার সময় ওলাঁদ নিজেকে আধুনিক রাষ্ট্রনায়ক হিসেবেই উপস্থাপন করেছেন। একই সঙ্গে তিনি আন্তর্জাতিক মঞ্চে ফ্রান্সকে প্রভাবশালী অবস্থানে দেখানোরও চেষ্টা করেন। তিনি অবশ্য আন্তর্জাতিকতাবাদ এবং সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের ব্যাপারে তাঁর অঙ্গীকারও জানান। ফ্রান্স হলো এমন এক দেশ, যে দেশ কূটনৈতিক ক্ষেত্রে তার সত্যিকার ক্ষমতার চেয়েও বেশি ভাব নিয়ে থাকে। সুতরাং আপন সুবিধার খাতিরেই ফ্রান্সকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের চেয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মাধ্যমে কাজ করে যেতে হবে।
ওলাঁদের এই জ্ঞান টনটনা যে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক কারণে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ফ্রান্সের ভূমিকাকে অন্য দেশের থেকে আলাদা হতে হবে। নির্বাচনের ঠিক আগে আগে প্রকাশিত তাঁর বই ভাগ্যবদল-এ (চেঞ্জিং ডেসটিনি) তিনি আশ্বস্ত করেছেন যে ফ্রান্সের বার্তা হবে বিশ্বজনীন, যা হবে ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের স্মারক। আমেরিকান বিপ্লবের মতোই, যা মুক্তি ও গণতন্ত্রের বিজয় হিসেবে চিহ্নিত।
ফ্রান্সে তেমনটা মনে করা না হলেও আমেরিকানরা ফ্রান্স আর ‘সমাজতন্ত্র’কে সমার্থক ভেবে থাকে। তাহলেও ওলাঁদের জন্য এটা দুর্বলতা নয়, বরং শক্তিই। নবাগত হিসেবে তাঁর কোনো কূটনৈতিক অভিজ্ঞতা নেই বললেই চলে। এখন তাঁকে কাজের মাধ্যমেই সামর্থ্যের প্রমাণ দিতে হবে। এবং আমেরিকায়ও, ওবামাও অচিরেই বুঝতে পারবেন, ফরাসি রাষ্ট্রে শিগগিরই কোনো পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে না। বরং উল্টোটাই ঘটবে, ওলাঁদের আসল ইচ্ছা হলো ওবামার নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে কাজ করা।
তবে ওলাঁদকে তাঁর পূর্বসূরি সারকোজির থেকে কম মার্কিন-পছন্দ ভাবার কারণ নেই। বলা হয়ে থাকে, সারকোজি হলেন ফ্রান্সের ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি যুক্তরাষ্ট্র-ঘেঁষা প্রেসিডেন্ট। ওলাঁদ গত বছরে লিবিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপ সমর্থন করেছিলেন। সিরিয়ায় আসাদের শাসনের বিরুদ্ধে নিন্দা জানানোর মিছিলেও তিনি পিছিয়ে ছিলেন না। তাঁর একজন ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক মিত্র সম্প্রতি ঘোষণা করেছেন, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের উচিত সিরিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপের অনুমোদন দেওয়া, আর তা যদি হয়, তাহলে ফ্রান্স সেই প্রচেষ্টায় অংশগ্রহণের দৃশ্য কল্পনা করতে পারে।
ওলাঁদ একই সঙ্গে ইরান বিষয়েও কঠিন পন্থা নেওয়ার পক্ষপাতী। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের বিষয়ে তাঁর বইয়ে বিল ক্লিনটনের দ্বি-রাষ্ট্রিক সমাধানকেই সমর্থন করা হয়েছে, যেখানে জেরুজালেমের জন্য বিশেষ মর্যাদা থাকবে। ফ্রান্সের সঙ্গে আরব দুনিয়া প্রশ্নেও ওলাঁদ মোটাদাগে ওবামার কায়রো বক্তৃতা অনুসারে অংশগ্রহণমূলক সম্পর্ক রাখার পক্ষে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, ২০০৯ সালে সারকোজির সিদ্ধান্তে ফ্রান্সকে ন্যাটোর সামরিক কমান্ডের অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্তও মেনে চলবেন। সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফ্রান্সে এখনো বিতর্ক রয়ে গেলেও, এমনকি সারকোজির দলের অনেকে এর বিরোধিতা করলেও ওলাঁদ ইউরোপীয় প্রতিরক্ষানীতির দুর্বলতা সম্পর্কে খুবই সচেতন যে তা কোনোভাবেই ন্যাটোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পারবে না। অবশ্যই তিনি ন্যাটো ঘোষিত তারিখের দুই বছর আগে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন। পাশাপাশি বলেছেন, এর প্রায়োগিক ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে আলোচনার দরকার আছে। ওলাঁদ মিত্রদের সঙ্গে কতটা কার্যকরভাবে কারবার করতে পারেন, এটা থেকেই সেটা প্রমাণ হবে।
আর সব ইউরোপীয়র মতোই ফরাসিরাও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে বাইরের ব্যাপার মনে করে না। তার মানে ইইউয়ের সিদ্ধান্ত মানে তা ফ্রান্সের অভ্যন্তরীণ নীতিতেও প্রভাব ফেলবে। এই বিচারে ওলাঁদের পক্ষে ইউরোপপন্থী নেতা হিসেবে ভালো করার সুযোগ রয়েছে। শক্তিশালী ইউরোপই পারবে উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো, বিশেষত চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ভারসাম্য রক্ষা করতে। শক্তিশালী ইউরোপই পারবে ইউরোপীয় ব্যবসা-বাণিজ্যকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত হওয়া থেকে রক্ষা করতে। তা করতে পারা মানে বেকারত্ব সমস্যাকে লাঘব করতে সমর্থ হওয়া।
সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে ওলাঁদ বলেছেন, ‘ফ্রান্স অন্য আর দশটা ইউরোপীয় দেশের মতো নয় এবং এর প্রেসিডেন্ট নন অন্য নেতাদের মতো কেউ।’ ফরাসিরা এটা শুনে বেজায় খুশি। কিন্তু এই কথা ওলাঁদের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জও হাজির করে, একবিংশ শতকের বিশ্বায়নের বাস্তবতায় এই প্রতিশ্রুতিকে সত্য বলে প্রমাণ করা খুবই কঠিন।
খালিজ টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত।
নোয়েলে লেনয়: সাবেক ফরাসি মন্ত্রী।
বৈশ্বিক যোগাযোগের সাধারণ ভাষা হিসেবে ইংরেজির ওপর তাঁর দখলের কথা বলার সময় ওলাঁদ নিজেকে আধুনিক রাষ্ট্রনায়ক হিসেবেই উপস্থাপন করেছেন। একই সঙ্গে তিনি আন্তর্জাতিক মঞ্চে ফ্রান্সকে প্রভাবশালী অবস্থানে দেখানোরও চেষ্টা করেন। তিনি অবশ্য আন্তর্জাতিকতাবাদ এবং সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের ব্যাপারে তাঁর অঙ্গীকারও জানান। ফ্রান্স হলো এমন এক দেশ, যে দেশ কূটনৈতিক ক্ষেত্রে তার সত্যিকার ক্ষমতার চেয়েও বেশি ভাব নিয়ে থাকে। সুতরাং আপন সুবিধার খাতিরেই ফ্রান্সকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের চেয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মাধ্যমে কাজ করে যেতে হবে।
ওলাঁদের এই জ্ঞান টনটনা যে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক কারণে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ফ্রান্সের ভূমিকাকে অন্য দেশের থেকে আলাদা হতে হবে। নির্বাচনের ঠিক আগে আগে প্রকাশিত তাঁর বই ভাগ্যবদল-এ (চেঞ্জিং ডেসটিনি) তিনি আশ্বস্ত করেছেন যে ফ্রান্সের বার্তা হবে বিশ্বজনীন, যা হবে ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের স্মারক। আমেরিকান বিপ্লবের মতোই, যা মুক্তি ও গণতন্ত্রের বিজয় হিসেবে চিহ্নিত।
ফ্রান্সে তেমনটা মনে করা না হলেও আমেরিকানরা ফ্রান্স আর ‘সমাজতন্ত্র’কে সমার্থক ভেবে থাকে। তাহলেও ওলাঁদের জন্য এটা দুর্বলতা নয়, বরং শক্তিই। নবাগত হিসেবে তাঁর কোনো কূটনৈতিক অভিজ্ঞতা নেই বললেই চলে। এখন তাঁকে কাজের মাধ্যমেই সামর্থ্যের প্রমাণ দিতে হবে। এবং আমেরিকায়ও, ওবামাও অচিরেই বুঝতে পারবেন, ফরাসি রাষ্ট্রে শিগগিরই কোনো পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে না। বরং উল্টোটাই ঘটবে, ওলাঁদের আসল ইচ্ছা হলো ওবামার নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে কাজ করা।
তবে ওলাঁদকে তাঁর পূর্বসূরি সারকোজির থেকে কম মার্কিন-পছন্দ ভাবার কারণ নেই। বলা হয়ে থাকে, সারকোজি হলেন ফ্রান্সের ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি যুক্তরাষ্ট্র-ঘেঁষা প্রেসিডেন্ট। ওলাঁদ গত বছরে লিবিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপ সমর্থন করেছিলেন। সিরিয়ায় আসাদের শাসনের বিরুদ্ধে নিন্দা জানানোর মিছিলেও তিনি পিছিয়ে ছিলেন না। তাঁর একজন ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক মিত্র সম্প্রতি ঘোষণা করেছেন, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের উচিত সিরিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপের অনুমোদন দেওয়া, আর তা যদি হয়, তাহলে ফ্রান্স সেই প্রচেষ্টায় অংশগ্রহণের দৃশ্য কল্পনা করতে পারে।
ওলাঁদ একই সঙ্গে ইরান বিষয়েও কঠিন পন্থা নেওয়ার পক্ষপাতী। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের বিষয়ে তাঁর বইয়ে বিল ক্লিনটনের দ্বি-রাষ্ট্রিক সমাধানকেই সমর্থন করা হয়েছে, যেখানে জেরুজালেমের জন্য বিশেষ মর্যাদা থাকবে। ফ্রান্সের সঙ্গে আরব দুনিয়া প্রশ্নেও ওলাঁদ মোটাদাগে ওবামার কায়রো বক্তৃতা অনুসারে অংশগ্রহণমূলক সম্পর্ক রাখার পক্ষে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, ২০০৯ সালে সারকোজির সিদ্ধান্তে ফ্রান্সকে ন্যাটোর সামরিক কমান্ডের অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্তও মেনে চলবেন। সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফ্রান্সে এখনো বিতর্ক রয়ে গেলেও, এমনকি সারকোজির দলের অনেকে এর বিরোধিতা করলেও ওলাঁদ ইউরোপীয় প্রতিরক্ষানীতির দুর্বলতা সম্পর্কে খুবই সচেতন যে তা কোনোভাবেই ন্যাটোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পারবে না। অবশ্যই তিনি ন্যাটো ঘোষিত তারিখের দুই বছর আগে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন। পাশাপাশি বলেছেন, এর প্রায়োগিক ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে আলোচনার দরকার আছে। ওলাঁদ মিত্রদের সঙ্গে কতটা কার্যকরভাবে কারবার করতে পারেন, এটা থেকেই সেটা প্রমাণ হবে।
আর সব ইউরোপীয়র মতোই ফরাসিরাও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে বাইরের ব্যাপার মনে করে না। তার মানে ইইউয়ের সিদ্ধান্ত মানে তা ফ্রান্সের অভ্যন্তরীণ নীতিতেও প্রভাব ফেলবে। এই বিচারে ওলাঁদের পক্ষে ইউরোপপন্থী নেতা হিসেবে ভালো করার সুযোগ রয়েছে। শক্তিশালী ইউরোপই পারবে উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো, বিশেষত চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ভারসাম্য রক্ষা করতে। শক্তিশালী ইউরোপই পারবে ইউরোপীয় ব্যবসা-বাণিজ্যকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত হওয়া থেকে রক্ষা করতে। তা করতে পারা মানে বেকারত্ব সমস্যাকে লাঘব করতে সমর্থ হওয়া।
সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে ওলাঁদ বলেছেন, ‘ফ্রান্স অন্য আর দশটা ইউরোপীয় দেশের মতো নয় এবং এর প্রেসিডেন্ট নন অন্য নেতাদের মতো কেউ।’ ফরাসিরা এটা শুনে বেজায় খুশি। কিন্তু এই কথা ওলাঁদের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জও হাজির করে, একবিংশ শতকের বিশ্বায়নের বাস্তবতায় এই প্রতিশ্রুতিকে সত্য বলে প্রমাণ করা খুবই কঠিন।
খালিজ টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত।
নোয়েলে লেনয়: সাবেক ফরাসি মন্ত্রী।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন