সোমবার, ১৪ মে, ২০১২

তাহরির বিপ্লব লক্ষ্যচ্যুত করতে চায় সেনাবাহিনী


॥ জসিম উদ্দিন ॥


মিসর একুশ শতকের শুরুতে অভিনব একটি বিপ্লব উপহার দিয়েছে। জনতার অব্যাহত অহিংস জমায়েত বিক্ষোভ একটি বলদর্পী একনায়ককে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করবে চিন্তা করা যায়নি। দু’টি বিষয় প্রমাণ হয়েছে; জনতার ইস্পাতকঠিন ঐক্য অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে। সামরিক শাসক বা একনায়ক যত শক্তিশালী হোক না কেন ঐক্যবদ্ধ জাতির সামনে তার পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। হোসনি মোবারকের পতন গোটা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি ওলটপালট করে দিয়ে বিশ্বের অন্যান্য একনায়কের ভিত কাঁপিয়ে দিলেও মিসরীয় জনগণ এখনো বিপ্লবের ফসল ঘরে তুলতে পারেনি। 
হোসনি মোবারকের পতনের পর ক্ষমতা নেয়া সামরিক পরিষদের কর্মকাণ্ড সন্দেহ সংশয় তৈরি করছে। মোবারকের পছন্দের সামরিক কর্মকর্তাদের নিয়ে এ পরিষদ গঠিত। এর প্রধান ফিল্ড মার্শাল তানতাবি মোবারকের একান্ত অনুগত ছিলেন। রাজনীতিতে প্রভাব অক্ষত রাখার পাশাপাশি নানা সুযোগ-সুবিধা এত দিন যা ভোগ করে আসছিল তা ভবিষ্যতেও নিশ্চিত রাখতে চায় সেনাবাহিনী। মিসরের ব্যবসায়-বাণিজ্যে সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের বিনিয়োগ রয়েছে। রিয়েল এস্টেট ও নির্মাণ ব্যবসায় তারা সরাসরি জড়িত। ইসরাইলের সাথে বিশেষ ছাড়ের বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে মিসরীয় সেনাবাহিনী বড় অঙ্কের সহযোগিতা পায়। ক্ষমতার পালাবদলে এ সুযোগ হাতছাড়া হতে দিতে চায় না সামরিক বাহিনী। সামরিক বাজেট মানে গোপনীয় একটি বিষয়। জনসমক্ষে প্রকাশ না হওয়ার যে রেওয়াজ এত দিন বজায় ছিল, নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে এখন তা প্রকাশ্যে আসার বিষয় নিয়ে সেনাবাহিনী উদ্বিগ্ন। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর এলিটরা যতটা সম্ভব ক্ষমতাকে নিজেদের মধ্যে কুক্ষিগত করে রাখার চেষ্টা করছেন। সেই চেষ্টা করতে গিয়ে নির্বাচিত সংসদের সাথে তাদের বিরোধ বেধেছে। তাদের লক্ষ্য নিজেদের পছন্দনীয় একজন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করিয়ে আনা। তা যদি সম্ভব না হয় সেনাবাহিনী সংসদ ও প্রেসিডেন্টের মধ্যে ক্ষমতার এমন একটি রসায়ন তৈরি করার চেষ্টা করবে, যার নাটাই থাকবে সেনাবাহিনীর হাতে। 
পার্লামেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক শাখা ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি ক্ষমতা চর্চা করতে গিয়ে সামরিক পরিষদের প্রবল বিরোধিতা মোকাবেলা করছে। সংবিধান প্রণয়ন ও বাজেট নিয়ে দেখা দিয়েছে জটিলতা। ১০০ সদস্যের সংবিধান প্রণয়ন কমিটিতে ইতোমধ্যে হস্তক্ষেপ করেছে সেনাবাহিনী। নির্বাচিত কমিটির ক্ষমতা খর্ব করে সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছেন তারা। অন্য দিকে সেনাবাহিনীর করা বাজেট ঠেকিয়ে দিয়েছে সংসদ। এ পরিস্থিতিতে আগামী ২৩ ও ২৪ মে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে সামরিক পরিষদ খেলায় মেতে উঠেছে। নির্বাচনে ২৩ প্রার্থী মনোনয়ন দাখিল করেন। সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পরিষদ ১৩ জনের প্রার্থিতা বাতিল করে। এর মধ্যে প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ পার্টি মুসলিম ব্রাদারহুডের খায়রাত আল-সাতের এবং সংসদে দ্বিতীয় বৃহৎ দল আল-নূর পার্টির হাজেম সালাহ আবু ইসমাইল রয়েছেন। এ দু’জন প্রভাবশালী প্রার্থীকে বাদ দেয়ার পেছনে সেনাবাহিনীর পছন্দের প্রার্থীকে বিজয়ী করে আনার কৌশল কাজ করেছে। জনপ্রিয় ইসলামি দল দু’টিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরিয়ে দেয়ার মাধ্যমে হোসনি মোবারক সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পরবর্তীকালে আরব লিগের মহাসচিব আমর মুসার নির্বাচনে বিজয়ের সম্ভাবনা দেখা দেয়ার মাধ্যমে বিষয়টি পরিষ্কার হয়েছে। আল আহরাম পরিচালিত জরিপে দেখা যাচ্ছে, ৩৯ শতাংশ অংশগ্রহণকারী মুসাকে সমর্থন দিচ্ছে। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আবদেল মনইম আবুল ফুতুহ ২৪ শতাংশ সমর্থন পেয়ে অনেক পিছিয়ে রয়েছেন।
প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বীকে বাদ দেয়ার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন ছলনার আশ্রয় নিয়েছিল। সাবেক গোয়েন্দা প্রধান ওমর সুলাইমানকে বলি দিয়েছেন তারা। অর্থাৎ প্রধান দুই সম্ভাব্য প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিলকে জায়েজ করতে নিজেদের এক প্রার্থী, যিনি সেনাবাহিনী ও সাবেক হোসনি মোবারকের বিশ্বস্ত, তাকেও ঠুনকো কারণে নির্বাচন থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। তার মনোনয়ন বাতিল হওয়া; সেনাবাহিনীর স্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে সুরক্ষা করার সম্ভাবনা বাড়িয়েছে। এর ফলে সংসদ নিয়ন্ত্রণকারী মুসলিম ব্রাদারহুডের সমালোচক আমর মুসার নির্বাচনে জয়ী হওয়ার সুযোগ বেড়েছে। জনমত জরিপে ইতোমধ্যে তার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। অন্য দিকে ৭৫ শতাংশ আসনে বিজয়ী ব্রাদারহুড ও নূর পার্টির ঐক্যের মধ্যে কিছুটা ফাটল ধরেছে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে। খায়রাত আল-সাতেরের প্রার্থিতা বাতিলের পর ব্রাদারহুড মোহাম্মদ মুরসিকে সমর্থন জানিয়েছে। ব্রাদারহুড আগে থেকে ধারণা করেছিল তাদের প্রার্থীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হতে পারে, তাই তারা ডামি প্রার্থীর আয়োজন রেখেছিল। কিন্তু সাতেরের প্রতি জনসমর্থনের যে জোয়ার ছিল, ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক শাখা ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির প্রধান মোহাম্মদ মুরসির প্রতি দেশব্যাপী ততটা সমর্থন নেই।
হাজেম সালাহ আবু ইসমাইলের প্রার্থিতা বাতিলের পর ব্রাদারহুডের মিত্র এবং সংসদের দ্বিতীয় বৃহৎ দল আল-নূর পার্টি আবদেল মনইম আবুল ফুতুহকে সমর্থন দিয়েছে। ফলে ব্রাদারহুডের প্রার্থী মুরসির অবস্থান আরো দুর্বল হয়েছে। আবদেল মনইম ব্রাদারহুডের সাবেক সদস্য। দলের ভেতরে মতবিরোধের জেরে তিনি দল থেকে ছিটকে পড়েন। কিন্তু দেশব্যাপী তার বড় ধরনের প্রভাব রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে আল-নূর পার্টির সমর্থন তাকে অনেকটা এগিয়ে দিয়েছে। সেটা তাকে যতটা না এগিয়ে দিয়েছে, তার চেয়ে বেশি ইতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি করেছে আমর মুসার জন্য। ইসলামিস্টদের মধ্যে মতভেদ ও দূরত্ব সংসদ নির্বাচনে তাদের প্রাপ্ত ৭৫ শতাংশ সমর্থনকে বিভক্ত করেছে। এ পরিস্থিতিতে ইসলামপন্থী অনেক সদস্য আশাহত হয়ে কার্যত আমর মুসার সমর্থন আরো বাড়াচ্ছে। 
হাজেম সালাহ আবু ইসমাইলের প্রার্থিতা বাতিলের পর আল-নূর পার্টির বিক্ষোভকে ইসলামপন্থীদের বিভক্ত করার জন্য এবং জাতীয়ভাবে তাদের ভাবমর্যাদা বিনষ্ট করার কাজে সুচতুরভাবে ব্যবহার হয়েছে। নূর পার্টি তাদের প্রার্থীকে বাদ দেয়ার প্রতিবাদে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বরাবর একটি বিক্ষোভ কর্মসূচির আয়োজন করেছিল ৪ মে। এটি ছিল মাত্র এক হাজার সদস্যের অহিংস মৌন কর্মসূচি। হঠাৎ করে বিক্ষোভ মিছিলটিতে সহিংস আক্রমণ হয়। অজ্ঞাত বন্দুকধারীরা বেপরোয়া গুলি চালিয়ে সেনাবাহিনীর এক সদস্যসহ বিশ বিক্ষোভকারীকে হত্যা করে। আশপাশে হাসপাতাল ও কিনিক বন্ধ হয়ে যায় এই সময়ে (এগুলোর নিয়ন্ত্রণ সেনানিয়ন্ত্রিত সরকারের হাতে)। ফলে আহতদের অনেকের প্রাণ বাঁচানো যায়নি। এটিকে সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত টেলিভিশনে ইসলামিস্টদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হিসেবে দেখানোর চেষ্টা হয়। অভিযোগ করা হয়, পাশের মসজিদের ছাদ থেকে গুলি করা হয়। দুর্বৃত্তদের সবার মুখে দাড়ি ছিল বলে দাবি করে এর সমর্থনে টেলিভিশন ফুটেজও ব্যাপকভাবে সম্প্রচার করা হয়। সবশেষে বলা হয়, এর সাথে আলকায়েদা জড়িত। আলকায়েদা নেতা আইমান আল জাওয়াহিরির ছোট ভাই স্বয়ং এ অভিযান পরিচালনা করেন। ঘটনার শিকার আল-নূর পার্টি হলেও কেবল একজন সেনাসদস্যের হত্যার ছুতা ধরে ব্যাপকভাবে চালানো প্রপাগান্ডা ভালো কাজ দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে ব্রাদারহুডও থমকে দাঁড়িয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আল-নূর পার্টির সাথে তাদের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। সাধারণ মিসরীয়দের মধ্যে জনপ্রিয় ইসলামি দলগুলোর ব্যাপারে দ্বিধাসংশয় তৈরি হয়েছে। সামরিক বাহিনী কার্যত এটাই চায়। ইসলামপন্থীদের পক্ষ থেকে এ ঘটনার জন্য সেনাবাহিনীকে দায়ী করা হচ্ছে। তারা দাবি করছে, ক্ষমতা হস্তান্তর বিঘিœত করতে সেনাবাহিনী বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি করছে। 
তাহরির স্কোয়ার বিপ্লবকে অনেকে মিসরে সেকুলার মতাদর্শের উত্থান বলে প্রচার চালিয়েছেন। আমাদের দেশের অনেক সংবাদমাধ্যমেও এ নিয়ে বামদের লেখালেখিতে তা প্রকাশ পেয়েছে। বাস্তবতা ছিল ভিন্ন; বরং সংসদ নির্বাচনে যার প্রতিফলন ঘটেছে। মূলত দীর্ঘ দমন-নিপীড়নের শিকার ইসলামপন্থীদের একটি বর্ণহীন উত্থান ছিল একুশ শতকের এ মিসরীয় বিপ্লব। মিসরের সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট পদটি বাংলাদেশের মতো আলঙ্কারিক নয়। সংসদের পাশাপাশি প্রেসিডেন্ট পদটিতেও যদি ইসলামপন্থীরা বিজয়ী হয় তাহলে সামরিক কাউন্সিল তথা সুবিধাভোগী মিসরীয় সেনাবাহিনীকে পিছু হটতে হবে। এর ফলে রাজনীতি থেকে সেনাবাহিনীকে সরে দাঁড়াতে হবে। তাদের বাজেট প্রণয়ন করার ক্ষমতা চলে যাবে জনগণের নির্বাচিত সংসদের কাছে। ইসরাইলকে অন্যায়ভাবে সমর্থন করে যাওয়ার বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যে নগদ অনুদান তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা হারাবে সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর বিভিন্ন প্রভাবশালী পদে লাভজনক ব্যবসায় করার যে সুযোগ তা-ও হারাতে হবে। 
এর মধ্যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন শুরু হয়েছে। ১০ মে থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রবাসীরা মিসরীয় দূতাবাসগুলোতে ভোট দিচ্ছেন। প্রধান দুই প্রার্থী আমর মুসা ও আবদেল মনইম আবুল ফুতুহের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছে জমজমাট টেলিভিশন বিতর্ক। মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে ইসলামপন্থীরা ছিটকে পড়েছে, তাই সবার দৃষ্টি এ দু’জনকে ঘিরে। প্রথম দফায় কোনো প্রার্থী যদি ৫০ শতাংশের বেশি ভোট না পান, সে ক্ষেত্রে প্রধান দুই প্রার্থী জুনের মাঝামাঝিতে আবার ভোটের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হবেন। তবে প্রথম রাউন্ডে আমর মুসা ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে যান তাহলে ইসলামিস্টদের হতাশ হতে হবে। অন্য দিকে দ্বিতীয় দফা নির্বাচন হলে ইসলামিস্টদের ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ ঘটবে। তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুরসি অথবা ফুতুহ যিনিই থাকেন, তার পেছনে ঐক্যবদ্ধ হতে পারবেন। তাহলে আমর মুসা নিশ্চিতভাবে হারবেন। নির্বাচনে প্রভাবশালী সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সূক্ষ্ম কারচুপির সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। সে ক্ষেত্রে বিজয় আমর মুসার জন্য অপেক্ষা করবে। তেমনটি হলে একটি গণতান্ত্রিক মিসর প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম আবারো ঝুলে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। 
jjshim146@yahoo.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন