শনিবার, ৫ মে, ২০১২

মিসরের নির্বাচন নিয়ে নানা হিসাব-নিকাশ


আলী রীয়াজ | তারিখ: ০৬-০৫-২০১২


সংস্কারাচ্ছন্ন অনেকেই ‘১৩’ সংখ্যাটিকে অশুভ বলে মনে করেন এবং যতদূর সম্ভব, এই সংখ্যা এড়িয়ে চলতে চান। মিসরের আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মোট প্রার্থীর সংখ্যা দেখে তাঁরা কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবেন, সেটা আমার জানা নেই। তবে আসন্ন নির্বাচনের সম্ভাব্য ফল যে শুভ না-ও হতে পারে, এমন আশঙ্কা অনেকের মনেই আছে। তার কারণ অবশ্য প্রার্থীসংখ্যা ১৩ জন সেটা নয়, কারণ, নির্বাচনে যেসব প্রার্থী এগিয়ে আছেন, তাঁদের রাজনৈতিক অবস্থান। ২৩ ও ২৪ মে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের জন্য মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন মোট ২৩ জন। কিন্তু এঁদের ১০ জনের মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ার পর এখন যাঁরা প্রার্থী, তাঁদের মধ্য থেকে কেউ যদি ৫০ শতাংশের বেশি ভোট না পান, তবে শীর্ষস্থানীয় দুই প্রার্থীর মধ্যে দ্বিতীয় দফা নির্বাচন হবে ১৬ ও ১৭ জুন। এই প্রক্রিয়ার শেষে আগামী ২১ জুন নতুন প্রেসিডেন্টের নাম ঘোষণা করার কথা। হোসনি মোবারকের অপসারণের পর সেনাবাহিনীর যে কাউন্সিল দেশ শাসন করছে, তারা জুন মাসের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা বলেছিল। নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হলে তারা প্রতিশ্রুত সময়েই ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারবে।
নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠান নিয়ে ২ মে পর্যন্ত কোনোরকম আশঙ্কার কথা কেউই ব্যক্ত করেননি। এর অন্যতম কারণ হলো, গত বছরের নভেম্বর থেকে কয়েক দফায় এ বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত পার্লামেন্টের নির্বাচন সুষ্ঠুভাবেই সম্পন্ন হয়। এতে ভোটারদের অংশগ্রহণও ছিল আশাব্যঞ্জক। উচ্চকক্ষের নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি ছিল কম। তবে নির্বাচন নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ বাড়বে বলেই আশা করা হচ্ছিল। কিন্তু দেশের ইসলামপন্থীদের মধ্যে তুলনামূলকভাবে রক্ষণশীল সালাফিপন্থী দল আল নূরের মনোনীত হাজাম সালেহ আবু ইসমাইলের প্রার্থিতা বাতিলের বিরুদ্ধে অব্যাহত বিক্ষোভ এখন নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে আশঙ্কা তৈরি করছে। ২ মে কায়রোয় আল নূরের সমর্থকদের ওপর দুষ্কৃতিদের হামলায় ২০ জন নিহত হয়। অন্য ইসলামপন্থী প্রার্থীরা তাঁদের প্রচারাভিযান বন্ধ করে দিয়েছেন। ইসলামপন্থী দুই প্রার্থীর প্রচারাভিযান বন্ধ করার সিদ্ধান্ত খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
নির্বাচনে প্রার্থীসংখ্যা ১৩ জন হলেও এখন পর্যন্ত অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে তিনজন প্রার্থীর মধ্যে। এঁরা হচ্ছেনু সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী (আরব লীগের মহাসচিব) আমর মুসা, মুসলিম ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক দল ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির প্রার্থী মুহাম্মদ মুরসি এবং সাবেক ব্রাদারহুড নেতা আবদুল মোনায়েম আবুল ফাত্তাহ। সম্প্রতি ফলাফল অনুমান করতে চাইলে এবং কোনো কোনো মহলে নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে আশঙ্কা বুঝতে চাইলে প্রথমত প্রতিদ্বন্দ্বীদের রাজনৈতিক অবস্থান বোঝা দরকার। দ্বিতীয়ত, এ যাবৎ মুসলিম ব্রাদারহুডের নেওয়া পদক্ষেপগুলো অনুধাবন করা জরুরি।
নির্বাচনে যে ১৩ জন প্রতিদ্বন্দ্বী আছেন আদর্শিক অবস্থান থেকে তাঁদের চার ভাগে ভাগ করা যায়: ১. সাবেক সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ২: ইসলামপন্থী ৩. বামপন্থী বা জাতীয়তাবাদী ৪. গুরুত্বহীন। সাবেক সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে আছেন আমর মুসা এবং আহমেদ শাফিক। মুসা ১০ বছরেরও বেশি সময় মোবারক সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন, পরের ১০ বছর অর্থাৎ ২০০১ থেকে ২০১১ সাল তিনি ছিলেন আরব লীগের মহাসচিব। আহমাদ শাফিক বিমানবাহিনীর একজন এয়ার মার্শাল, তিনি দেশের বেসামরিক বিমান পরিবহনমন্ত্রী ছিলেন। মিসরে গণ-অভ্যুত্থান শুরু হলে তাঁকে মোবারক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করেন ২৯ জানুয়ারি ২০১১। পরে ৩ মার্চ ২০১১ তিনি পদত্যাগ করেন। সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ওমর সুলাইমান মনোনয়নপত্র জমা দিলেও তাঁর মনোনয়নপত্র বাতিল করে দেওয়া হয়। সুলাইমান শুধু যে দেশের গোয়েন্দা সংস্থারই প্রধান ছিলেন, তা নয়, মোবারকের শেষ দিনগুলোতে তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
ইসলামপন্থীদের যে প্রার্থীরা এখন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তাঁদের অন্যতম হলেন মুসলিম ব্রাদারহুড প্রার্থী মুহাম্মদ মুরসি। মুরসির প্রার্থী হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু ব্রাদারহুডের নেতা খায়রাত এল শাতেরের মনোনয়ন বাদ হয়ে গেলে ব্রাদারহুড তাদের দ্বিতীয় পছন্দের প্রার্থীদের নিয়ে নির্বাচনে লড়ছে। ব্রাদারহুড অবশ্য এল শাতেরের প্রার্থিতা বাতিল হবে বলে আশঙ্কা করেই মুরসির মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিল। ইসলামপন্থীদের দ্বিতীয় প্রার্থী হলেন আবদুল মোনায়েম আবুল ফাত্তাহ। ফাত্তাহ মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতৃত্বের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করতে শুরু করেন গত কয়েক বছর ধরে কিন্তু গত বছর মে মাসে তিনি যখন ঘোষণা দেন যে নির্দলীয় হিসেবে হলেও তিনি প্রার্থী হবেন, তখন ব্রাদারহুড তাঁকে বহিষ্কার করে। তৃতীয় ইসলামপন্থী প্রার্থী মুহাম্মদ সালিম আল আওয়া ইসলাম চিন্তাবিদ বলে পরিচিত হলেও তাঁর সমর্থক ও সংগঠন কোনোটিই নেই। ইসলামপন্থী দল ও গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সালাকিপন্থী বলে পরিচিতদের সংগঠন হলো আল নূর। তারা প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছিল হাজাম সালেহ আবু ইসমাইলকে। কিন্তু তার মনোনয়নও বাতিল হয়ে যায়। ফলে আল নূরের কোনো আনুষ্ঠানিক প্রার্থী নেই।
বামপন্থী বা জাতীয়তাবাদী বলে পরিচিত চারজন প্রার্থী হলেন হামেদিন সাম্বাহি, খালেদ আলী, আবুল ইজ আল হারিরি এবং হিসাম বাস্তাউসি। কিন্তু দলগতভাবে এঁদের কারও পক্ষেই নির্বাচনে ভালো ফলাফলের সম্ভাবনা নেই। আইমান নূর, যিনি ২০০৫ সালে মোবারকের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন, তাঁর প্রার্থিতা বাতিল না হলে তিনিই হতেন এই ধারার প্রধান প্রতিনিধি।
প্রার্থীদের রাজনৈতিক অবস্থানের সংক্ষিপ্ত পরিচয় থেকে এটা স্পষ্ট যে দুজন ইসলামপন্থী এবং মোবারক সরকারের সঙ্গে অতীতে সংশ্লিষ্ট একজনই এখন মিসরীয়দের পছন্দের তালিকার শীর্ষে। যদিও মুহাম্মদ মুরসি ব্রাদারহুডের নেতা খায়রাত এল শাতেরের মতো প্রভাবশালী নন, মুরসি বিজয়ী হলে ব্রাদারহুডের মধ্যকার তুলনামূলক রক্ষণশীলেরাই যে দেশ চালাবেন তা বলা যায়। এ রকমও অনুমান করা হয়, মুরসি আসলে এল শাতেরেরই নির্দেশে চলবেন। এল শাতের কতটা রক্ষণশীল তা বোঝার জন্য এটা বলাই যথেষ্ট যে তিনি অমুসলিম ও নারীদের প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনে অযোগ্য বলে বিবেচনার পক্ষে। অন্যদিকে মোনায়েম আবুল ফাত্তাহ তুলনামূলকভাবে উদারপন্থী বলে বিবেচিত। তিনি ব্রাদারহুডের কট্টর অবস্থানের বিরুদ্ধে হলেও তাঁর ইসলামপন্থী অবস্থান মোটেই দুর্বল নয়।
নির্বাচনে মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রার্থীর এগিয়ে থাকাটা মোটেই বিস্ময়কর বিষয় নয় এই কারণে যে পার্লামেন্ট নির্বাচনে ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক দল—ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির নেতৃত্বাধীন জোট ৩৭ শতাংশ ভোট পেয়ে মোট ২৩৫টি আসন পায়। এর মধ্যে তাদের দলের সদস্যই হলো ২১৩ জন। দেশের উচ্চকক্ষের নির্বাচনে তাদের প্রার্থীরা ১০৫টি আসনে বিজয়ী হয়। তাদের প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা ৪৫ শতাংশ। মোবারকের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলনের পর মুসলিম ব্রাদারহুড প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তারা ৩০-৪০ শতাংশের বেশি আসনে প্রার্থী দেবে না। কিন্তু সে প্রতিশ্রুতি থেকে তারা সরে এসেছে। একপর্যায়ে তারা এই প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল যে প্রেসিডেন্ট পদে তারা কোনো প্রার্থী দেবে না—সেটাও তারা শেষ পর্যন্ত রক্ষা করেনি। মিসরের গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে মুসলিম ব্রাদারহুড দেশের সামরিক কাউন্সিলের সঙ্গে কার্যত ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করেছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই তাদের স্বার্থের অনুকূলে কাজ করেছে। গত কয়েক মাসে, বিশেষত পার্লামেন্ট নির্বাচনের পর তাদের সম্পর্কে টানাপোড়েন দেখা দেয়। প্রেসিডেন্ট পদে ব্রাদারহুডের প্রথম পছন্দের প্রার্থী এবং তাদের প্রচারণা থেকে এটা স্পষ্ট যে তারা মিসরীয় রাজনীতিতে পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য সচেষ্ট।
পার্লামেন্ট ও উচ্চকক্ষের নির্বাচনে ব্রাদারহুডের পাশাপাশি যে দলটি ভালো ফল করেছে, তা হলো সালাফিপন্থী আল নূর। পার্লামেন্টে তাদের সদস্য ১২৩ জন। উচ্চকক্ষে তাদের আসনসংখ্যা ৪৫টি। ব্রাদারহুডের তুলনায় আল নূর আরও কট্টরপন্থী ও রক্ষণশীল। প্রেসিডেন্ট পদে তাদের প্রার্থী না থাকায় তাদের সাংগঠনিক শক্তি কার সমর্থনে এগিয়ে আসে, সেটা একটা প্রশ্ন ছিল। এ সপ্তাহে তারা আবুল ফাত্তাহকে সমর্থন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ সিদ্ধান্তের কারণ আবুল ফাত্তাহের আদর্শিক অবস্থান নয়-নেহাতই মুসলিম ব্রাদারহুড-বিরোধিতা। ব্রাদারহুড থেকে বেরিয়ে গিয়ে যাঁরা ১৯৯৬ সালে ওয়াশাত পার্টি তৈরি করেছিলেন, তাঁরাও আবুল ফাত্তাহকে সমর্থন করেছেন। অনেকেই আশা করছিলেন, ওয়াশাত পার্টি সালিম এল-আওয়াকে সমর্থন দেবে। দলের ভেতরে এ নিয়ে ভোটাভুটিতে ২৩ শতাংশ তা-ই চেয়েছিল।
গত কয়েক দিনে আবুল ফাত্তাহ কেবল ইসলামপন্থীদেরই সমর্থন পেয়েছেন তা নয়, মোবারকের বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থানের সবচেয়ে পরিচিত ব্যক্তিত্ব ওয়েল গানিম তাঁর প্রার্থিতার প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। এতে করে আবুল ফাত্তাহ ব্রাদারহুডের প্রার্থী মুরসির চেয়ে এগিয়ে গেলেন কি না, তা বোঝা একটু দুরূহ—কেননা মিসরে এখনো নির্ভরযোগ্য জনমত জরিপের ধারা তৈরি হয়নি। তবে যদি তা ঘটেও থাকে, তাতে আশাবাদী হওয়ার কিছু আছে কি না, অনেক উদারপন্থী ও সেক্যুলার রাজনৈতিক কর্মীর প্রশ্ন।
নির্বাচনের প্রথম দফায় কোনো প্রার্থীই সম্ভবত ৫০ শতাংশের বেশি সমর্থন পাবেন না। এর অর্থ হলো, দ্বিতীয় দফা নির্বাচনের সম্ভাবনাই বেশি। সেই নির্বাচনে দুজন ইসলামপন্থীই প্রতিদ্বন্দ্বী হবেন, নাকি লড়াই হবে সাবেক শাসকগোষ্ঠী-সংশ্লিষ্ট একজনের সঙ্গে ইসলামপন্থী একজনের? এ দুই ধরনের কোনোটিই সম্ভবত কেউ অনুমান করতে পারেননি, যখন মোবারকের বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল।
ইলিনয়, ২ মে 
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন