মঙ্গলবার, ৮ মে, ২০১২

ইউরোপজুড়ে পরিবর্তনের জোয়ার


ডেভিড গথিয়ার-ভিলারস
ফ্রান্সের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হলাঁদ কীভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সরকারি আর্থিক পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাবেন সে সম্পর্কে এখনও সুস্পষ্টভাবে কিছু বলেননি। তবে বিনিয়োগকারীরা যদি দেখেন যে, নতুন প্রেসিডেন্ট ঘাটতি হ্রাসের ব্যাপারে সুস্পষ্ট পদক্ষেপ নেননি তাহলে তারা বিগড়ে গিয়ে ফ্রান্সের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরও খারাপ করে দিতে পারেন

ফ্রান্সের ভোটাররা রোববারের নির্বাচনে সমাজতান্ত্রিক দলের প্রার্থী ফ্রাঁসোয়া হলাঁদকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেছেন। তিনি অর্থনৈতিক দুর্দশার বোঝাটি ধনীদের ওপর চাপানো এবং চলমান কৃচ্ছ্রসাধন কর্মসূচিকে নমনীয় করার প্রেসক্রিপশনের মাধ্যমে দীর্ঘায়িত 'ইউরো' ঋণ সংকট দূর করার অঙ্গীকার করেছেন।
রক্ষণশীল ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট সারকোজির বিরুদ্ধে ১৭ বছরের মধ্যে প্রথম সমাজতান্ত্রিক হলাঁদের বিজয় জার্মানির প্রেসিডেন্ট অ্যাঙ্গেলা মার্কেলের নীতিকে চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ করে দিয়েছে। মার্কেল অতি ঋণগ্রস্ত ইউরোপীয় দেশগুলোর সরকারি আর্থিক খাতকে পরিশুদ্ধ করার প্রধান প্রতিষেধক হিসেবে ব্যয় হ্রাস ফর্মুলাকে চাপিয়ে দিয়েছিলেন। হলাঁদের প্রথম পদক্ষেপটির বড় ধরনের নিহিতার্থ থাকবে। ইউরোপের ১৭ দেশের আর্থিক ইউনিয়নভুক্ত বিভিন্ন দেশে মন্দা ও বেকারি বিস্তার লাভ করছে। আর এই অর্থনৈতিক মন্দা চলার সময় সরকারি ব্যয় কাটছাঁট করার বিচক্ষণতা নিয়েই ভোটার, রাজনীতিবিদ ও অর্থনীতিবিদদের মধ্যে সন্দেহ ঘনীভূত হয়। অথচ মার্কেলের বক্তব্য হলো সরকারি আর্থিক খাতের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে হলে এটা করা আবশ্যক।
রোববার অনুষ্ঠিত গ্রিসের সংসদ নির্বাচনেও সেখানকার ভোটারদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে দেখা গেছে। ভোটাররা দুটি ক্ষমতাসীন দলকেই প্রত্যাখ্যান করেছে। অনেক লোক ক্ষুদ্র, চরম দক্ষিণপন্থি ও কট্টর বামপন্থি দলকে ভোট দিয়েছে।
জার্মানিতে মার্কেলের খ্রিস্টান ডেমোক্রেটিক পার্টি ও ব্যবসাবান্ধব ফ্রি ডেমোক্র্যাট জোট রোববার অনুষ্ঠিত উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্য শ্চিলেসউইগ-হলস্টেইনের নির্বাচনে পরাজিত হয়েছে। এতে ২০১৩ সালের পর মার্কেলদের জার্মানি শাসন করা আর সম্ভব হবে না বলেই মনে হচ্ছে।
এটা ঠিক যে, ফ্রান্সের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হলাঁদ কীভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সরকারি আর্থিক পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাবেন সে সম্পর্কে এখনও সুস্পষ্টভাবে কিছু বলেননি। তবে বিনিয়োগকারীরা যদি দেখেন যে, নতুন প্রেসিডেন্ট ঘাটতি হ্রাসের ব্যাপারে সুস্পষ্ট পদক্ষেপ নেননি তাহলে তারা বিগড়ে গিয়ে ফ্রান্সের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরও খারাপ করে দিতে পারেন। লন্ডনে গত ফেব্রুয়ারিতে তার সফরের সময় হলাঁদ বিনিয়োগকারীদের এই বলে পুনরায় আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছিলেন যে, তিনি আর যা-ই হোক ঋণভিত্তিক বৃহৎ উদ্যোগকে আর্থিক সহায়তা দেবেন না। বৈদেশিক নীতির ওপর বলতে গিয়ে নির্বাচনের প্রাক্কালে হলাঁদ নির্বাচিত হয়েই আফগানিস্তান থেকে ফরাসি সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবেন বলে উল্লেখ করেছিলেন। হলাঁদের বামপন্থি জোট গত বছর পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়েছে এবং আগামী মাসে অনুষ্ঠিতব্য সংসদের নিম্নকক্ষের নির্বাচনেও তার বাম জোটই বিজয়ী হবে বলে আশা করা হচ্ছে। নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হলাঁদের নীতি ও অঙ্গীকার ভালোভাবে বাস্তবায়নের জন্যও এটা প্রয়োজন।
ইউরো সংকট ফ্রান্সের অর্থনীতিতে গভীর ক্ষতচিহ্ন রেখে গেছে। গত বছর ফ্রান্সের বাণিজ্য ঘাটতি ৭ হাজার কোটি ইউরোতে উন্নীত হয়েছিল। এর অর্থ হলো শক্তিশালী জার্মান অর্থনীতির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় তার সামর্থ্য অব্যাহতভাবে হ্রাস পাওয়া। বেকারত্বের হার ১৩ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে এবং রেটিং সংস্থা স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওরস জানুয়ারিতে ফ্রান্সের অর্থনীতিকে 'ট্রিপল-এ' অবস্থান থেকে নামিয়ে দেয়। প্যারিস তার পর্বতপ্রমাণ ১ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ইউরো ঘাটতি ব্যবস্থাপনা আদৌ সঠিকভাবে করে উঠতে পারবে কি-না বা এ ব্যাপারে তার সামর্থ্য রয়েছে কি-না এ আশঙ্কা থেকে রেটিং সংস্থা এর মানে অবনমন ঘটায়।
ডেভিড গথিয়ার-ভিলারস

এই সংকট ইউরোপের রাজনৈতিক দৃশ্যপটেও ঝাঁকুনি দেয়। গত ২২ এপ্রিল প্রথম ভোটারদের এ অসন্তোষ প্রকাশ্যে আসে। এদিন ফ্রান্সের এক-পঞ্চমাংশ ভোটার কট্টর দক্ষিণপন্থি মারিয়েঁ লি পেনের পক্ষে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। লি পেন ইউরো থেকে বেরিয়ে যাওয়া এবং অভিবাসনবিরোধী সংরক্ষণবাদী প্রস্তাব নিয়ে ভোটের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন। আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো, রোববারের ভোটে ১৯ শতাংশ রেজিস্টার্ড ভোটার অনুপস্থিত ছিলেন এবং ৫ শতাংশের মতো ভোটার খালি ব্যালট পেপার জমা দেন।
মি. হলাঁদ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েই একজন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেবেন। তার এক সহকারী জানান, সমাজতন্ত্রী সংসদ সদস্য জেন-মার্ক অঁরাল্ট প্রধানমন্ত্রীর আসন অলঙ্কৃত করতে পারেন। তার সঙ্গে মার্কেলের রয়েছে ভালো সম্পর্ক। মার্কেলের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য তার এই সম্পর্ক প্রেসিডেন্টের কাজে আসতে পারে।
ফ্রান্সের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট চিরাচরিত ক্ষমতা বিভাজনের নীতিতে বিশ্বাসী এবং তার নির্বাচনী অঙ্গীকারও তাই ছিল। তিনি সারকোজির মতো ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত রাখবেন না নিজের হাতে। তখন সরকারের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড প্রধানমন্ত্রীর হাতেই ন্যস্ত হবে। সারকোজি হলাঁদকে স্বাগত জানান এবং সামনের অগি্নপরীক্ষায় তার সাফল্য কামনা করেন।
দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হতে ব্যর্থ হয়ে কার্যত সারকোজি ইউরো জোনের ভাগ্যবিড়ম্বিত নেতাদের তালিকা আরও প্রসারিত করলেন। সারকোজি এক সময় তার উত্তরসূরি জ্যাক শিরাককে 'অলস রাজা' বলে উপহাস করেছিলেন এবং তিনি নির্বাচিত হলে ফ্রান্সের অর্থনৈতিক ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু ফ্রান্সের অন্য নেতাদের মতো তিনিও ঘাটতি ব্যয় বৃদ্ধির আসক্তি কাটিয়ে উঠতে পারেননি।
তবে আগের সরকারের রেখে যাওয়া আর্থিক সংকটের কারণে সারকোজির পক্ষে রাতারাতি ঋণ-বৃত্ত থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব ছিল না। ব্যাংক ও শিল্পকে রক্ষার জন্য সারকোজি সরকারকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। দেশের বিপুল সামাজিক কল্যাণ ব্যবস্থার সাহায্যে তাকে এগিয়ে আসতে হয়েছে। তার ত্বরিত পদক্ষেপের কারণে ফ্রান্স ২০০৯ সালে অর্থনৈতিক মন্দাজনিত বিপর্যয় এড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু এর ফলে ফ্রান্স আরও বেশি করে ঋণের জালে আটকা পড়ে।
অথচ গত বছর জার্মানির বাণিজ্য উদ্বৃত্ত হয় ১৫৮ বিলিয়ন ইউরো। বেকারত্বের হার ৬ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে আসে।

দি ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল থেকে ভাষান্তর
সুভাষ সাহা

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন