সামির আমিন
আপনারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তার সহযোগী, ইউরোপিয়ান এবং অন্যদের দেখছেন। ন্যাটোর অন্যতম সদস্য হিসেবে তুর্কিস্তান, তিউনিসিয়া এবং মিশরের মতো আরব দেশগুলির অন্যত্র আন্দোলনগুলিকে সংহত হতে দেয়নি। লিবিয়ার অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। লিবিয়ার অভিজ্ঞতা ওদেরও রয়েছে। লিবিয়াতে ওরা সফল হয়েছিল। গোড়ার দিকে লিবিয়ায় গাদ্দাফির বিরুদ্ধে কোনও জনপ্রিয় আন্দোলন ছিল না। ছোট ছোট সশস্ত্র গোষ্ঠী দেখা যায়। প্রশ্ন উঠেছে, কোথা থেকে এত অস্ত্র আসছে?
আমরা জানি, শুরু থেকেই পারস্য উপসাগর, পশ্চিমী শক্তির সমর্থন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদতে অস্ত্র আসছে। এই অস্ত্র দিয়েই সেনাবাহিনী, পুলিসকে আক্রমণ করা হচ্ছে। সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলি চিহ্নিত হয়েছে ‘গণতান্ত্রিক মুক্তি বাহিনী হিসেবে। ন্যাটো এই নামেই ওই গোষ্ঠীগুলিকে ডাকে। সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলির সাহায্য ও উদ্ধারের কাজে প্রথমে ফরাসী ও পরে ন্যাটোবাহিনী ছুটে আসে এবং ক্রমশ হস্তক্ষেপ করতে শুরু করে। এই হস্তক্ষেপ সাফল্য পায় এই অর্থে কারণ তা গাদ্দাফির শাসনকে ধ্বংস করতে পেরেছে। কিন্তু এই সাফল্যে ফল কী হয়েছে? এখন কি লিবিয়া গণতন্ত্রের পথে চলেছে? কেউ যদি জানেন যে, নয়া জমানার প্রেসিডেন্ট এমন এক বিচারপতি যিনি বুলগেরিয়ান নার্সদের মৃত্যুকে নিন্দা করেছিলেন তাহলে তার হাসাই উচিত। কী ধরনের গণতন্ত্র! এই গণতন্ত্রে সোমালিয়ান ধাঁচের অস্থিতি দেশকে নড়বড়ে করে তুলছে। তথাকথিত ‘ইসলাম’-এর নামে স্থানীয় ক্ষমতা তৈরি হচ্ছে। স্থানীয় যুদ্ধব্যাপারীরা দেশকে ধ্বংসের পথে নিয়ে চলেছে। কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন, হস্তক্ষেপের অর্থ কি দাঁড়ায় সে দেশের ধ্বংস?
আমি মূল প্রশ্নে ফিরি। কারণ ওরা সিরিয়ার পর একই নীতি প্রয়োগের চেষ্টা করেছিল। অর্থাৎ, প্রথম থেকেই সশস্ত্র বাহিনীর অনুপ্রবেশ। উত্তর থেকে শুরু করে তুর্কিস্তান, বিশেষত হাতে। হাতে-র শরণার্থী শিবির আদৌ উদ্বাস্তু শিবির নয়। খুব কম সংখ্যক শরণার্থীই ওই শিবিরে রয়েছে। আদতে ওখানে সিরিয়ায় হস্তক্ষেপ তথা অনুপ্রবেশের জন্য সশস্ত্র ভাড়াটে সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আমার তুর্কি বন্ধুরা এর প্রমাণ দিয়েছেন। ন্যাটোর শরিক হিসেবে তুর্কিস্তানও এই ষড়যন্ত্রের অংশীদার। জর্ডানের ক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনীর সমর্থন আসছে দক্ষিণের সশস্ত্র বাহিনী দারা-র মাধ্যমে। সরাসরি ইজরায়েল থেকে।
মিশরের মতো সিরিয়ারও একই পরিস্থিতি। বহু বছর ধরে এখানে এক বৈধ সরকার ছিল। এই জাতীয় সরকারের পিছনে জনসমর্থনও ছিল। কিন্তু হাফেজ আসান এর সময় থেকেই এই জনসমর্থন কমতে থাকে। নয়া উদারনীতিবাদ, বেসরকারীকরণের পথে হেঁটে একই সামাজিক বিপর্যয় নেমে আসে। কাজেই, বিশাল, জনপ্রিয় এবং সামাজিক উত্থানের এক বস্তুনিষ্ঠ কারণ ছিল। এই আন্দোলনের সুযোগে সশস্ত্র বাহিনীর সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে, যেখানে জনপ্রিয় গণতান্ত্রিক আন্দোলন দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। বাশার আসাদ-এর বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক শক্তি তথাকথিত ‘প্রতিরোধ’ আন্দোলনে শামিল হতে চায়নি। বাহ্যিক হস্তক্ষেপের রাশ টেনে ধরতে সমর্থ হন আসাদ। হমস্ এবং উত্তরে তুর্কি সীমানা পর্যন্ত। কিন্তু রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরোধিতার বিনিময়ে বিদেশী শক্তির মদতপুষ্ট সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রকৃত সন্ত্রাসবাদ কোনও সমাধান নয়’। প্রকৃত জনপ্রিয় গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে আলোচনাসাপেক্ষে চলতি পরিস্থিতির পরিবর্তনই সমস্যার সমাধান ছিল। এটিই ছিল চ্যালেঞ্জ। এ প্রশ্নই উঠছে। আমরা জানি না। আমি জানি না। আমার মনে হয়, কেউই জানে না আগামীতে কী ঘটবে। এই শাসন ব্যবস্থা বা এই শাসন ব্যবস্থার অধীন মানুষজন বুঝবেন জনপ্রিয় গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাহায্যে ক্ষমতার পুনর্বিন্যাস করা সম্ভব এবং এই পুনর্বিন্যাসই প্রকৃত সংস্কারের অভিমুখ খুলে দিতে পারে। অথবা আজকে যে পরিস্থিতির তারা সম্মুখীন হচ্ছেন সেরকম কোনও বিস্ফোরণের জন্য অপেক্ষা করা। এই অভিমুখে এগোলে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কাছে তাদের পরাজয় ঘটবে।
সিরিয়াসহ এই অঞ্চলে সাম্রাজ্যবাদের প্রকৃত লক্ষ্য কী? গণতন্ত্রের আবাহন আদৌ সাম্রাজ্যবাদের লক্ষ্য নয়। লিবিয়াতে যেভাবে সমাজ ধ্বংস হয়েছে, সেভাবেই দেশে দেশে ধ্বংসলীলায় উদ্যত সাম্রাজ্যবাদ। ইরাকের কথাই ধরুন। ইরাকে ওরা কী করেছে? সাদ্দাম হুসেইনের স্বৈরতন্ত্র সরিয়ে তিনটি আরও নিকৃষ্ট, কদর্য স্বৈরতন্ত্র কায়েম করেছে। দু’টি শিয়া, সুন্নির নামে এবং একটি কুর্দদের নামে। হত্যালীলায় গোটা দেশ ধ্বংস হয়ে গেছে। আমি অন্য কোনও শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না। একদিকে সাম্রাজ্যবাদের ‘মানবিক’ বোমা ছিন্নভিন্ন করেছে হাজার হাজার মানুষের জীবন, অন্যদিকে বিজ্ঞানী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কবিকে নির্বিচারে হত্যা, কাউকে রেয়াত করেনি। এই হত্যার তাণ্ডব গোটা দেশকে ধ্বংস করছে। সিরিয়ায় সাম্রাজ্যবাদের এটিই লক্ষ্য। সিরিয়ায় লিবারেশন আর্মি-র কর্মসূচী কী? আলাওয়াইস, দ্রুজ্স, খ্রীষ্টান, শিয়া সংখ্যালঘুদের সরিয়ে দাও। এর অর্থ সিরিয়ার ৪৫% মানুষ। এর মানে কী? এর অর্থ গণতন্ত্র? এর অর্থ কদর্যতম স্বৈরতন্ত্র এবং দেশের ধ্বংস।
প্রশ্ন এর সঙ্গে কার স্বার্থ জড়িত? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইজরায়েল এবং পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলির। আমেরিকার স্বার্থ কী? এই অঞ্চলে দেশগুলি বিপর্যস্ত হলে পরবর্তী মঞ্চ তৈরি হবে অর্থাৎ ইরানের ধ্বংস। এরফলে চীন, রাশিয়ার মতো বিকাশশীল রাষ্ট্রগুলি এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করার প্রশ্নে পিছু হটবে। এমনকি ভারতও। এটিই লক্ষ্য। এই লক্ষ্যেরই অংশ ইরানসহ মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলির ধ্বংস। একইভাবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির বিপর্যয় এবং দেশে দেশে দুর্বৃত্ত-উন্নয়ন কায়েম ইজরায়েলেরও লক্ষ্য। সিরিয়া চার বা পাঁচটি তাৎপর্যহীন, ছোট রাষ্ট্রে ভেঙে গেলে ইজরায়েলের ঔপনিবেশিকতারই সম্প্রসারণ হবে। একই লক্ষ্য অন্যান্য পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলিরও। গণতন্ত্রের সংগ্রামের নেতৃত্ব ওবামা, সারকোজি, ক্যামেরন-এর পাশে কাতার-এর আমীর এবং সৌদি আরবের রাজার দাঁড়ানো প্রায় প্রহসনে পরিণত হয়েছে। এই ঘটনায় যে কেউ হাসতে পারেন। ইসলামের নামে এই তাবৎ অঞ্চলে এই শক্তি নিজের কর্তৃত্ব কায়েম করতে চায়। নানাভাবে ইসলামের নাম ব্যবহার করা হচ্ছে। লক্ষ্য, মিশরের ধ্বংসসাধন। যদি মিশর শক্তিশালী থাকে তাহলে পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলির কী হবে? নাসেরের আমলে ওসব দেশের কী অবস্থা ছিল আপনারা জানেন। এই শক্তিগুলি মুসলিম ভ্রাতৃত্বের সমর্থন পাচ্ছে। আমি এভাবেই শেষ করতে চাই যে মুসলিম ভ্রাতৃত্বকে কোনো ‘ইসলামিক’ দল হিসেবে দেখা উচিত নয়। কোনো সংগঠন বা দলকে বিচারের মানদণ্ড তা ইসলামিক না ধর্মনিরপেক্ষ-এ হওয়া উচিত নয়। বরং হওয়া উচিত তা প্রতিক্রিয়াশীল না প্রগতিশীল। যখনই যাবতীয় বাস্তব ইস্যুর ভিত্তিতে আমরা মুসলিম ভ্রাতৃত্বকে দেখি তখনই দেখা যায় তারা শ্রমিকশ্রেণীর ধর্মঘটের বিরুদ্ধে, গরিব কৃষকের প্রতিবাদ-প্রতিরোধের বিরুদ্ধে, বেসরকারিকরণের পক্ষে, জন পরিষেবা তুলে দেয়ার পক্ষে। এর অর্থ প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির পক্ষেই এই মুসলিম ভ্রাতৃত্বর অবস্থান। ইসলামকে সামনে রাখা এক প্রতিক্রিয়াশীল দল এই মুসলিম ভ্রাতৃত্ব। এটিই প্রকৃত মানদণ্ড। সাম্রাজ্যবাদী, তাদের দোসর, মধ্যপ্রাচ্যের দেশে দেশে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলির এটির বিশ্বব্যাপী ছবি।
(সামির আমিন মিশরের প্রখ্যাত মার্কসবাদী অর্থনীতিবিদ। তার সাক্ষাৎকার নেন ভারতের প্রখ্যাত মার্কসবাদী সমালোচক আইজাজ আহমেদ। সেই সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতেই উপরের এই নিবন্ধ।)
অনুবাদ: পল্লব মুখোপাধ্যায়
আপনারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তার সহযোগী, ইউরোপিয়ান এবং অন্যদের দেখছেন। ন্যাটোর অন্যতম সদস্য হিসেবে তুর্কিস্তান, তিউনিসিয়া এবং মিশরের মতো আরব দেশগুলির অন্যত্র আন্দোলনগুলিকে সংহত হতে দেয়নি। লিবিয়ার অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। লিবিয়ার অভিজ্ঞতা ওদেরও রয়েছে। লিবিয়াতে ওরা সফল হয়েছিল। গোড়ার দিকে লিবিয়ায় গাদ্দাফির বিরুদ্ধে কোনও জনপ্রিয় আন্দোলন ছিল না। ছোট ছোট সশস্ত্র গোষ্ঠী দেখা যায়। প্রশ্ন উঠেছে, কোথা থেকে এত অস্ত্র আসছে?
আমরা জানি, শুরু থেকেই পারস্য উপসাগর, পশ্চিমী শক্তির সমর্থন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদতে অস্ত্র আসছে। এই অস্ত্র দিয়েই সেনাবাহিনী, পুলিসকে আক্রমণ করা হচ্ছে। সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলি চিহ্নিত হয়েছে ‘গণতান্ত্রিক মুক্তি বাহিনী হিসেবে। ন্যাটো এই নামেই ওই গোষ্ঠীগুলিকে ডাকে। সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলির সাহায্য ও উদ্ধারের কাজে প্রথমে ফরাসী ও পরে ন্যাটোবাহিনী ছুটে আসে এবং ক্রমশ হস্তক্ষেপ করতে শুরু করে। এই হস্তক্ষেপ সাফল্য পায় এই অর্থে কারণ তা গাদ্দাফির শাসনকে ধ্বংস করতে পেরেছে। কিন্তু এই সাফল্যে ফল কী হয়েছে? এখন কি লিবিয়া গণতন্ত্রের পথে চলেছে? কেউ যদি জানেন যে, নয়া জমানার প্রেসিডেন্ট এমন এক বিচারপতি যিনি বুলগেরিয়ান নার্সদের মৃত্যুকে নিন্দা করেছিলেন তাহলে তার হাসাই উচিত। কী ধরনের গণতন্ত্র! এই গণতন্ত্রে সোমালিয়ান ধাঁচের অস্থিতি দেশকে নড়বড়ে করে তুলছে। তথাকথিত ‘ইসলাম’-এর নামে স্থানীয় ক্ষমতা তৈরি হচ্ছে। স্থানীয় যুদ্ধব্যাপারীরা দেশকে ধ্বংসের পথে নিয়ে চলেছে। কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন, হস্তক্ষেপের অর্থ কি দাঁড়ায় সে দেশের ধ্বংস?
আমি মূল প্রশ্নে ফিরি। কারণ ওরা সিরিয়ার পর একই নীতি প্রয়োগের চেষ্টা করেছিল। অর্থাৎ, প্রথম থেকেই সশস্ত্র বাহিনীর অনুপ্রবেশ। উত্তর থেকে শুরু করে তুর্কিস্তান, বিশেষত হাতে। হাতে-র শরণার্থী শিবির আদৌ উদ্বাস্তু শিবির নয়। খুব কম সংখ্যক শরণার্থীই ওই শিবিরে রয়েছে। আদতে ওখানে সিরিয়ায় হস্তক্ষেপ তথা অনুপ্রবেশের জন্য সশস্ত্র ভাড়াটে সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আমার তুর্কি বন্ধুরা এর প্রমাণ দিয়েছেন। ন্যাটোর শরিক হিসেবে তুর্কিস্তানও এই ষড়যন্ত্রের অংশীদার। জর্ডানের ক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনীর সমর্থন আসছে দক্ষিণের সশস্ত্র বাহিনী দারা-র মাধ্যমে। সরাসরি ইজরায়েল থেকে।
মিশরের মতো সিরিয়ারও একই পরিস্থিতি। বহু বছর ধরে এখানে এক বৈধ সরকার ছিল। এই জাতীয় সরকারের পিছনে জনসমর্থনও ছিল। কিন্তু হাফেজ আসান এর সময় থেকেই এই জনসমর্থন কমতে থাকে। নয়া উদারনীতিবাদ, বেসরকারীকরণের পথে হেঁটে একই সামাজিক বিপর্যয় নেমে আসে। কাজেই, বিশাল, জনপ্রিয় এবং সামাজিক উত্থানের এক বস্তুনিষ্ঠ কারণ ছিল। এই আন্দোলনের সুযোগে সশস্ত্র বাহিনীর সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে, যেখানে জনপ্রিয় গণতান্ত্রিক আন্দোলন দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। বাশার আসাদ-এর বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক শক্তি তথাকথিত ‘প্রতিরোধ’ আন্দোলনে শামিল হতে চায়নি। বাহ্যিক হস্তক্ষেপের রাশ টেনে ধরতে সমর্থ হন আসাদ। হমস্ এবং উত্তরে তুর্কি সীমানা পর্যন্ত। কিন্তু রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরোধিতার বিনিময়ে বিদেশী শক্তির মদতপুষ্ট সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রকৃত সন্ত্রাসবাদ কোনও সমাধান নয়’। প্রকৃত জনপ্রিয় গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে আলোচনাসাপেক্ষে চলতি পরিস্থিতির পরিবর্তনই সমস্যার সমাধান ছিল। এটিই ছিল চ্যালেঞ্জ। এ প্রশ্নই উঠছে। আমরা জানি না। আমি জানি না। আমার মনে হয়, কেউই জানে না আগামীতে কী ঘটবে। এই শাসন ব্যবস্থা বা এই শাসন ব্যবস্থার অধীন মানুষজন বুঝবেন জনপ্রিয় গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাহায্যে ক্ষমতার পুনর্বিন্যাস করা সম্ভব এবং এই পুনর্বিন্যাসই প্রকৃত সংস্কারের অভিমুখ খুলে দিতে পারে। অথবা আজকে যে পরিস্থিতির তারা সম্মুখীন হচ্ছেন সেরকম কোনও বিস্ফোরণের জন্য অপেক্ষা করা। এই অভিমুখে এগোলে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কাছে তাদের পরাজয় ঘটবে।
সিরিয়াসহ এই অঞ্চলে সাম্রাজ্যবাদের প্রকৃত লক্ষ্য কী? গণতন্ত্রের আবাহন আদৌ সাম্রাজ্যবাদের লক্ষ্য নয়। লিবিয়াতে যেভাবে সমাজ ধ্বংস হয়েছে, সেভাবেই দেশে দেশে ধ্বংসলীলায় উদ্যত সাম্রাজ্যবাদ। ইরাকের কথাই ধরুন। ইরাকে ওরা কী করেছে? সাদ্দাম হুসেইনের স্বৈরতন্ত্র সরিয়ে তিনটি আরও নিকৃষ্ট, কদর্য স্বৈরতন্ত্র কায়েম করেছে। দু’টি শিয়া, সুন্নির নামে এবং একটি কুর্দদের নামে। হত্যালীলায় গোটা দেশ ধ্বংস হয়ে গেছে। আমি অন্য কোনও শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না। একদিকে সাম্রাজ্যবাদের ‘মানবিক’ বোমা ছিন্নভিন্ন করেছে হাজার হাজার মানুষের জীবন, অন্যদিকে বিজ্ঞানী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কবিকে নির্বিচারে হত্যা, কাউকে রেয়াত করেনি। এই হত্যার তাণ্ডব গোটা দেশকে ধ্বংস করছে। সিরিয়ায় সাম্রাজ্যবাদের এটিই লক্ষ্য। সিরিয়ায় লিবারেশন আর্মি-র কর্মসূচী কী? আলাওয়াইস, দ্রুজ্স, খ্রীষ্টান, শিয়া সংখ্যালঘুদের সরিয়ে দাও। এর অর্থ সিরিয়ার ৪৫% মানুষ। এর মানে কী? এর অর্থ গণতন্ত্র? এর অর্থ কদর্যতম স্বৈরতন্ত্র এবং দেশের ধ্বংস।
প্রশ্ন এর সঙ্গে কার স্বার্থ জড়িত? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইজরায়েল এবং পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলির। আমেরিকার স্বার্থ কী? এই অঞ্চলে দেশগুলি বিপর্যস্ত হলে পরবর্তী মঞ্চ তৈরি হবে অর্থাৎ ইরানের ধ্বংস। এরফলে চীন, রাশিয়ার মতো বিকাশশীল রাষ্ট্রগুলি এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করার প্রশ্নে পিছু হটবে। এমনকি ভারতও। এটিই লক্ষ্য। এই লক্ষ্যেরই অংশ ইরানসহ মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলির ধ্বংস। একইভাবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির বিপর্যয় এবং দেশে দেশে দুর্বৃত্ত-উন্নয়ন কায়েম ইজরায়েলেরও লক্ষ্য। সিরিয়া চার বা পাঁচটি তাৎপর্যহীন, ছোট রাষ্ট্রে ভেঙে গেলে ইজরায়েলের ঔপনিবেশিকতারই সম্প্রসারণ হবে। একই লক্ষ্য অন্যান্য পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলিরও। গণতন্ত্রের সংগ্রামের নেতৃত্ব ওবামা, সারকোজি, ক্যামেরন-এর পাশে কাতার-এর আমীর এবং সৌদি আরবের রাজার দাঁড়ানো প্রায় প্রহসনে পরিণত হয়েছে। এই ঘটনায় যে কেউ হাসতে পারেন। ইসলামের নামে এই তাবৎ অঞ্চলে এই শক্তি নিজের কর্তৃত্ব কায়েম করতে চায়। নানাভাবে ইসলামের নাম ব্যবহার করা হচ্ছে। লক্ষ্য, মিশরের ধ্বংসসাধন। যদি মিশর শক্তিশালী থাকে তাহলে পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলির কী হবে? নাসেরের আমলে ওসব দেশের কী অবস্থা ছিল আপনারা জানেন। এই শক্তিগুলি মুসলিম ভ্রাতৃত্বের সমর্থন পাচ্ছে। আমি এভাবেই শেষ করতে চাই যে মুসলিম ভ্রাতৃত্বকে কোনো ‘ইসলামিক’ দল হিসেবে দেখা উচিত নয়। কোনো সংগঠন বা দলকে বিচারের মানদণ্ড তা ইসলামিক না ধর্মনিরপেক্ষ-এ হওয়া উচিত নয়। বরং হওয়া উচিত তা প্রতিক্রিয়াশীল না প্রগতিশীল। যখনই যাবতীয় বাস্তব ইস্যুর ভিত্তিতে আমরা মুসলিম ভ্রাতৃত্বকে দেখি তখনই দেখা যায় তারা শ্রমিকশ্রেণীর ধর্মঘটের বিরুদ্ধে, গরিব কৃষকের প্রতিবাদ-প্রতিরোধের বিরুদ্ধে, বেসরকারিকরণের পক্ষে, জন পরিষেবা তুলে দেয়ার পক্ষে। এর অর্থ প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির পক্ষেই এই মুসলিম ভ্রাতৃত্বর অবস্থান। ইসলামকে সামনে রাখা এক প্রতিক্রিয়াশীল দল এই মুসলিম ভ্রাতৃত্ব। এটিই প্রকৃত মানদণ্ড। সাম্রাজ্যবাদী, তাদের দোসর, মধ্যপ্রাচ্যের দেশে দেশে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলির এটির বিশ্বব্যাপী ছবি।
(সামির আমিন মিশরের প্রখ্যাত মার্কসবাদী অর্থনীতিবিদ। তার সাক্ষাৎকার নেন ভারতের প্রখ্যাত মার্কসবাদী সমালোচক আইজাজ আহমেদ। সেই সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতেই উপরের এই নিবন্ধ।)
অনুবাদ: পল্লব মুখোপাধ্যায়
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন