॥ এম. আবদুল হাফিজ ॥
পাশ্চাত্যের গণমাধ্যমে প্রায়ই ইরানে আসন্ন আক্রমণের সংবাদ বেরোয়। ওবামা প্রশাসনও ‘টেবিলে সব অপশন থাকার’ পুনরাবৃত্তি করে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী এক যুগেরও বেশি ধরে জল-স্থল-অন্তরীক্ষে যুদ্ধ প্রস্তুতিতে পারস্য উপসাগরে ল্যান্ডিংড্রিলের প্রশিক্ষণ গ্রহণরত। সম্প্রতি পেন্টাগন ওই অঞ্চলে মার্কিনিদের রণপোতের সংখ্যা দ্বিগুণ করেছে। কিছু দিন হলো, ইরানের আকাশে মার্কিন যুদ্ধ ও গোয়েন্দা বিমানের ওড়াউড়িও শুরু হয়েছে। গত বছরের শেষ দিকে ইরানিরা যুক্তরাষ্ট্রের একটি অত্যাধুনিক চালকবিহীন বিমান ভূপাতিতও করেছে।
ইসরাইলি গণমাধ্যমেও গুজবের অন্ত নেই। এমন একটি গুজব হলো, হরমুজ প্রণালীতে জেগে ওঠা ছোট দু’টি দ্বীপে মার্কিনিদের অবস্থান গ্রহণ সম্পর্কিত। তিন বছর আগে গাজা হত্যাকাণ্ডের হোতা বলে পরিচিত ইসরাইলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী গত ফেব্রুয়ারিতেই বলেছিলেন, ইরান আক্রমণের সুযোগ ক্রমেই মিলিয়ে যাচ্ছে, কেননা ইরানের অব্যাহত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ সেটি হতে দেবে না। ইসরাইলি উপপ্রধানমন্ত্রী মোসে ইয়ালন ঘোষণা দেন, তার দেশ যথেষ্টই আত্মবিশ্বাসী যে, তারা ইরানের বাছাই করা যেকোনো লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। তিনি আরো বলেন, ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর প্রধান হিসেবে তার লব্ধ অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি এমন প্রত্যয় ব্যক্ত করছেন।
সদ্য বিদায়ী ফরাসি প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি বলেন, তার যুদ্ধে উসকানি অযৌক্তিক হবে যদি ইরান বোমা অর্জনে এবং পড়শিদের ভীতি প্রদর্শন করতে উন্মাদের মতো আর না ছোটে। সারকোজি হয়তো কখনো ভাবেননি, আধুনিক কালে ইরান কখনো কারো বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেনি। পাশ্চাত্য ও আরব রাজতন্ত্ররাই সাদ্দাম হোসেনকে ইরান আক্রমণ করতে উৎসাহ দিয়েছিল। আট বছর দীর্ঘ সেই যুদ্ধে ১০ লাখ ইরানি আত্মাহুতি দিয়েছিলেন।
পাশ্চাত্যের এসব ভয়ভীতিকে উপেক্ষা করেছে তেহরান। ইরানের ৩৩তম বিপ্লববার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদ বলেছেন, ইসলামি প্রজাতন্ত্র শিগগিরই পারমাণবিক ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ অর্জনের খবর দেবে। শীর্ষ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ইরান তার শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচির অধিকার কিছুতেই বর্জন না করার সঙ্কল্প পুনর্ব্যক্ত করেছেন। ইরান একই নীতিতে অবিচল থেকে বারবার নিজেকে এনপিটিতে স্বাক্ষরকারী দেশরূপে স্বীকার করে আসছে এবং সেই অবস্থানে থেকেই তার একটি শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পরিচালনার অধিকারের কথাই বলে আসছে।
ইরানের সব পারমাণবিক স্থাপনা এবং সেখানে কর্মরত সব কিছুই আইএইএর নজরে আছে। ইরান যে কোনো পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি বা ইউরেনিয়াম তৈরি করেনি তা নিশ্চিত করার জন্য ওই সংস্থাটিই যথেষ্ট। আয়াতুল্লাহ খামেনি পাশ্চাত্যকে কোনো সামরিক অ্যাডভেঞ্চারের বিরুদ্ধে কড়া সতর্ক করে দিয়েছেন এই বলে, যদি কোনো বিরুদ্ধাচরণের সূত্রপাত হয়, সেটি কিন্তু আমেরিকানদের জন্য অন্তত ১০ গুণ ভয়ঙ্কর হবে।
ইসরাইলের হুমকির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে খামেনি বলেন, দেশটি প্রকৃতপক্ষে একটি ক্যান্সার বা টিউমার সমগ্র অঞ্চলের জন্য, যা কেটে ফেলা ছাড়া সমস্যার সুরাহা হবে না।
মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিও প্যানেটা গত ফেব্রুয়ারিতে ব্রাসেলসে গণমাধ্যমকে বলেছেন, এ বছরের মাঝামাঝি কোনো এক সময় ইসরাইল ইরান আক্রমণ করবে। গত ২০ ডিসেম্বর জয়েন্ট চিফ অব স্টাফের চেয়ারম্যান জেনারেল মার্কিন ডেমসসে সিএনএনকে বলেন, ইরানের বিরুদ্ধে প্রয়োগের জন্য সব রকম অপশনই পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। আমরা সেগুলো পরিমার্জন ও পরিশোধন করে দেখছি। ওই অপশনে পৌঁছলে কার্য সিদ্ধি হবে। ‘আমি সন্তুষ্ট আমাদের পরীক্ষণীয় অপশনগুলো এমন এক বিন্দুতে পৌঁছাচ্ছে, যেখানে মনে হয় তা কাজ করবে।’ ইসরাইলের দক্ষিণপন্থী সরকার সর্বক্ষণ ইরানের সাথে যুদ্ধ বাধানোর ফন্দিফিকিরে আছে। এই উগ্র সরকারটি ঠাণ্ডা মাথায় প্রায় স্থির করেই ফেলেছে এবং ধরেই নিয়েছে, বছর শেষে নির্বাচনে জড়িয়ে পড়ার আগে ওবামা প্রশাসনের সামনে ইসরাইলসহ ইরান যুদ্ধের পাট চুকিয়ে ফেলা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই।
কিন্তু ওবামা প্রশাসনের বাস্তববাদীরা জানেন ইরানের বিষয়টি ইরাকের মতো নয়, বরং অনেক আলাদা। মার্কিনিরা ইরাককে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে কাবু করতে ও দখল করতে পেরেছিল। প্রেসিডেন্ট ওবামা ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধের মেজাজকে একটু নমনীয় করতে বলেছিলেন, ইসরাইল তো এখন পর্যন্ত তাদের যুদ্ধের পরিকল্পনাই তৈরি করেনি। তিনি জোর দিয়ে বলেনÑ আমেরিকা ও ইসরাইল যূথবদ্ধভাবেই ইরান সমস্যা সমাধানে কূটনীতির পথে এগিয়ে আসবে। ইত্যবসরে মার্কিন প্রেসিডেন্সির জন্য রিপাবলিকান প্রার্থীরা অবশ্য 'bomb, bomb Iran' -এর ধুয়া তুলেছেন।
এ দিকে পারমাণবিক ইস্যুতে ইরানিরা এত বেশি একতাবদ্ধ, যা আগে কখনো ছিল না। আরব রাজতন্ত্রগুলো পাশ্চাত্যের মনস্তাত্ত্বিক ও অর্থনৈতিক লড়াইকে নিঃসন্দেহে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। তারা জানে স্নায়ুর এই লড়াইয়ে ইরানেরও রয়েছে অনেক কার্ড। আরব দেশগুলোর শিয়া সম্প্রদায়ও ইতোমধ্যে তাদের একাধিক দাবিতে সোচ্চার। তারাও তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়। ইরানের ওপর কোনো যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে ইরান উপসাগরীয় আরব দেশগুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মার্কিন ঘাঁটিগুলোকে টার্গেট করবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন উচ্চপদস্থ ইরানি কর্মকর্তারা।
ইরান একটি যুদ্ধসাপেক্ষে যদি হরমুজ প্রণালী বন্ধ হয়ে যায় এবং তেলের ট্যাংকারগুলো আটকা পড়ে, তাহলে তেলের মূল্য আকাশচুম্বী হবে; যা একটি নির্বাচনী বছরে আমেরিকানদের জন্য সুখকর হবে না। সাথে সাথে একটি সমান্তরাল পথে যুক্তরাষ্ট্র বেপরোয়াভাবে তার ট্রাডিশনাল মিত্র এবং বাণিজ্যিক সহযোগীদের বেকায়দায় ফেলেছে, যার আওতায় ইরান বা ভারতের মতো দেশও রয়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র নিজের একপক্ষীয় অবরোধকে কার্যকর করতে তার সাথে কোনো প্রকার বিবাদবিহীন দেশেরও ক্ষতির কারণ ঘটিয়েছে।
আলোচনার জন্য সম্প্রতি যখন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব রঞ্জন মাথাই ওয়াশিংটনে যান। স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র ভিক্টোরিয়া ল্যান্ড রিপোর্টার্সদের বলেন, ভারত কী করে জ্বালানির একটি বিকল্প উৎস পেতে পারে, সেটিই আলোচ্য। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এক ধরনের Two Track Policy বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে, যাতে ইরানি তেলে অভ্যস্তদের ওই অভ্যাস থেকে ছাড়িয়ে নেয়া এবং বিশ্বজুড়ে সাপ্লাইয়ারকে গ্রাহকদের সাথে যুক্ত করে দেয়া যায়। তারাই তখন গ্রাহকদের বিকল্প উৎসের সন্ধান দেবে।
এরই মধ্যে সৌদি সরকার অঙ্গীকার করেছে, তারা তাদের জ্বালানির উৎপাদন বৃদ্ধি করেছে, যাতে অবরোধের ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে ইরানি তেলের ঘাটতি মেটানো যায়। ওবামা প্রশাসন সম্প্রতি মার্কিন ব্যাংকগুলোকে ওই সব ব্যাংকে গচ্ছিত ইরানি সম্পদ জব্দ করার ক্ষমতা দিয়েছে, যাতে ইরান আর ওই সম্পদকে তার সুবিধামতো অন্যত্র স্থানান্তর করতে না পারে। ইরানের ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ রেজা রহিমি সাম্প্রতিক অবরোধে ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছেন, ইরান অবশ্যই এ অবরোধকে অকার্যকর করবে। অতীতেও ইরান তা করেছে এবং জ্বালানি পিপাসার্তদের কাছে ইরান জ্বালানি বিক্রয়ে সক্ষম হয়েছে।
তবে অবরোধ দেরিতে হলেও তার প্রভাব ফেলছে ইরানের জনজীবনে। মুদ্রাস্ফীতি আর ওষুধের মতো প্রয়োজনীয় বস্তুর মহার্ঘতায় জনজীবন বিপর্যস্ত। ভারত ইরানের তেল-গ্যাস ক্রেতাদের মধ্যে অন্যতম বৃহৎ দেশ। দেশটির শীর্ষ নীতিনির্ধারক বলেন, ইরানি তেলের ওপর তাদের নির্ভরতা ক্রমেই কমছে, তবু ভারতের জন্য ইরানই তাদের জ্বালানির প্রধান উৎস। ভারত অপরিশোধিত তেলের ১২ শতাংশ ইরান থেকে সংগ্রহ করে। ভারত সরকারের সাম্প্রতিক ঘোষণা যে, দেশটি ‘ইরানের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক দৃঢ় করতে সেখানে একটি বড় ডেলিগেশন পাঠাচ্ছে,’ তা ওয়াশিংটনকে নারাজ করেছে। ভারতের বাণিজ্যসচিব রাহুল খুলুর গণমাধ্যমকে বলেছেন, ভারত জাতিসঙ্ঘ আরোপিত অবরোধ বাস্তবায়ন করছে, কিন্তু ইরানে আমাদের প্রেরিতব্য অনেক আইটেমে অবরোধ প্রযোজ্য নয়।
ইরান আইটেম রুপিতে পরিশোধ্য এবং দেশটিতে বিনিময় প্রথায় বাণিজ্য করা যায়। ভারতীয় কর্মকর্তাদের মতে, পাশ্চাত্যের কাছ থেকে এমন চাপ আসার কথা নয় যা ভারতীয় অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এমনকি ইরানের সাথে অবরোধের ফাঁকফোকর দিয়ে পাকিস্তানও বাণিজ্যে আগ্রহী। পাশ্চাত্যের সতর্কীকরণ উপেক্ষা করেই পাকিস্তান ঘোষণা দিয়েছে, ইরানের সাথে দেশটির গ্যাস পাইপলাইনের কাজ অব্যাহত থাকবে। ওয়াশিংটন বরং ভারতের সাথে গ্যাস পাইপলাইন ইস্যুতে অধিক সফল। প্রেসিডেন্ট বুশের ধমকে ভারত অনেক আগেই আইপিআই থেকে সরে এসেছিল। মুখ রক্ষায় ভারত ওজর দিয়েছিল অর্থনৈতিকভাবে প্রকল্প পাকিস্তানকেই বেশি ফায়দা দেবে, ভারতকে নয়।
মার্কিন চাপে আরো অনেক বেসরকারি কোম্পানি ইরানের পরিশোধিত তেল ক্রয়ের চুক্তি বাতিল করেছিল। ওবামা প্রশাসন স্বভাবতই ইরানের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিস্তৃত করার ভারতীয় সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট। তবে সিনিয়র ভারতীয় কর্মকর্তারা ইরানের সাথে সম্পর্ক রাখার বিষয়ে বেশ জেদি। তারা এমনও উল্লেখ করেছেন পাশ্চাত্য তো সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত ভারতকে অনুনয় করেছে মিয়ানমারের সামরিক সরকারকে একঘরে এবং দেশটির সাথে অর্থনৈতিক লেনদেন বন্ধ করতে। এখন আবার ওই পশ্চিমারাই তাদের নিজ স্বার্থে মিয়ানমারে বিনিয়োগ করতে নিজেরাই ছুটছে। ভারতীয়রা মনে করে, এমন পরিস্থিতি আগামী কয়েক বছরে পশ্চিমাদের জন্য ইরানেও বিরাজ করবে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার এবং নিরাপত্তা, রাজনীতি, বৈদেশিক নীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক
পাশ্চাত্যের গণমাধ্যমে প্রায়ই ইরানে আসন্ন আক্রমণের সংবাদ বেরোয়। ওবামা প্রশাসনও ‘টেবিলে সব অপশন থাকার’ পুনরাবৃত্তি করে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী এক যুগেরও বেশি ধরে জল-স্থল-অন্তরীক্ষে যুদ্ধ প্রস্তুতিতে পারস্য উপসাগরে ল্যান্ডিংড্রিলের প্রশিক্ষণ গ্রহণরত। সম্প্রতি পেন্টাগন ওই অঞ্চলে মার্কিনিদের রণপোতের সংখ্যা দ্বিগুণ করেছে। কিছু দিন হলো, ইরানের আকাশে মার্কিন যুদ্ধ ও গোয়েন্দা বিমানের ওড়াউড়িও শুরু হয়েছে। গত বছরের শেষ দিকে ইরানিরা যুক্তরাষ্ট্রের একটি অত্যাধুনিক চালকবিহীন বিমান ভূপাতিতও করেছে।
ইসরাইলি গণমাধ্যমেও গুজবের অন্ত নেই। এমন একটি গুজব হলো, হরমুজ প্রণালীতে জেগে ওঠা ছোট দু’টি দ্বীপে মার্কিনিদের অবস্থান গ্রহণ সম্পর্কিত। তিন বছর আগে গাজা হত্যাকাণ্ডের হোতা বলে পরিচিত ইসরাইলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী গত ফেব্রুয়ারিতেই বলেছিলেন, ইরান আক্রমণের সুযোগ ক্রমেই মিলিয়ে যাচ্ছে, কেননা ইরানের অব্যাহত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ সেটি হতে দেবে না। ইসরাইলি উপপ্রধানমন্ত্রী মোসে ইয়ালন ঘোষণা দেন, তার দেশ যথেষ্টই আত্মবিশ্বাসী যে, তারা ইরানের বাছাই করা যেকোনো লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। তিনি আরো বলেন, ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর প্রধান হিসেবে তার লব্ধ অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি এমন প্রত্যয় ব্যক্ত করছেন।
সদ্য বিদায়ী ফরাসি প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি বলেন, তার যুদ্ধে উসকানি অযৌক্তিক হবে যদি ইরান বোমা অর্জনে এবং পড়শিদের ভীতি প্রদর্শন করতে উন্মাদের মতো আর না ছোটে। সারকোজি হয়তো কখনো ভাবেননি, আধুনিক কালে ইরান কখনো কারো বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেনি। পাশ্চাত্য ও আরব রাজতন্ত্ররাই সাদ্দাম হোসেনকে ইরান আক্রমণ করতে উৎসাহ দিয়েছিল। আট বছর দীর্ঘ সেই যুদ্ধে ১০ লাখ ইরানি আত্মাহুতি দিয়েছিলেন।
পাশ্চাত্যের এসব ভয়ভীতিকে উপেক্ষা করেছে তেহরান। ইরানের ৩৩তম বিপ্লববার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদ বলেছেন, ইসলামি প্রজাতন্ত্র শিগগিরই পারমাণবিক ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ অর্জনের খবর দেবে। শীর্ষ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ইরান তার শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচির অধিকার কিছুতেই বর্জন না করার সঙ্কল্প পুনর্ব্যক্ত করেছেন। ইরান একই নীতিতে অবিচল থেকে বারবার নিজেকে এনপিটিতে স্বাক্ষরকারী দেশরূপে স্বীকার করে আসছে এবং সেই অবস্থানে থেকেই তার একটি শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পরিচালনার অধিকারের কথাই বলে আসছে।
ইরানের সব পারমাণবিক স্থাপনা এবং সেখানে কর্মরত সব কিছুই আইএইএর নজরে আছে। ইরান যে কোনো পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি বা ইউরেনিয়াম তৈরি করেনি তা নিশ্চিত করার জন্য ওই সংস্থাটিই যথেষ্ট। আয়াতুল্লাহ খামেনি পাশ্চাত্যকে কোনো সামরিক অ্যাডভেঞ্চারের বিরুদ্ধে কড়া সতর্ক করে দিয়েছেন এই বলে, যদি কোনো বিরুদ্ধাচরণের সূত্রপাত হয়, সেটি কিন্তু আমেরিকানদের জন্য অন্তত ১০ গুণ ভয়ঙ্কর হবে।
ইসরাইলের হুমকির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে খামেনি বলেন, দেশটি প্রকৃতপক্ষে একটি ক্যান্সার বা টিউমার সমগ্র অঞ্চলের জন্য, যা কেটে ফেলা ছাড়া সমস্যার সুরাহা হবে না।
মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিও প্যানেটা গত ফেব্রুয়ারিতে ব্রাসেলসে গণমাধ্যমকে বলেছেন, এ বছরের মাঝামাঝি কোনো এক সময় ইসরাইল ইরান আক্রমণ করবে। গত ২০ ডিসেম্বর জয়েন্ট চিফ অব স্টাফের চেয়ারম্যান জেনারেল মার্কিন ডেমসসে সিএনএনকে বলেন, ইরানের বিরুদ্ধে প্রয়োগের জন্য সব রকম অপশনই পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। আমরা সেগুলো পরিমার্জন ও পরিশোধন করে দেখছি। ওই অপশনে পৌঁছলে কার্য সিদ্ধি হবে। ‘আমি সন্তুষ্ট আমাদের পরীক্ষণীয় অপশনগুলো এমন এক বিন্দুতে পৌঁছাচ্ছে, যেখানে মনে হয় তা কাজ করবে।’ ইসরাইলের দক্ষিণপন্থী সরকার সর্বক্ষণ ইরানের সাথে যুদ্ধ বাধানোর ফন্দিফিকিরে আছে। এই উগ্র সরকারটি ঠাণ্ডা মাথায় প্রায় স্থির করেই ফেলেছে এবং ধরেই নিয়েছে, বছর শেষে নির্বাচনে জড়িয়ে পড়ার আগে ওবামা প্রশাসনের সামনে ইসরাইলসহ ইরান যুদ্ধের পাট চুকিয়ে ফেলা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই।
কিন্তু ওবামা প্রশাসনের বাস্তববাদীরা জানেন ইরানের বিষয়টি ইরাকের মতো নয়, বরং অনেক আলাদা। মার্কিনিরা ইরাককে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে কাবু করতে ও দখল করতে পেরেছিল। প্রেসিডেন্ট ওবামা ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধের মেজাজকে একটু নমনীয় করতে বলেছিলেন, ইসরাইল তো এখন পর্যন্ত তাদের যুদ্ধের পরিকল্পনাই তৈরি করেনি। তিনি জোর দিয়ে বলেনÑ আমেরিকা ও ইসরাইল যূথবদ্ধভাবেই ইরান সমস্যা সমাধানে কূটনীতির পথে এগিয়ে আসবে। ইত্যবসরে মার্কিন প্রেসিডেন্সির জন্য রিপাবলিকান প্রার্থীরা অবশ্য 'bomb, bomb Iran' -এর ধুয়া তুলেছেন।
এ দিকে পারমাণবিক ইস্যুতে ইরানিরা এত বেশি একতাবদ্ধ, যা আগে কখনো ছিল না। আরব রাজতন্ত্রগুলো পাশ্চাত্যের মনস্তাত্ত্বিক ও অর্থনৈতিক লড়াইকে নিঃসন্দেহে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। তারা জানে স্নায়ুর এই লড়াইয়ে ইরানেরও রয়েছে অনেক কার্ড। আরব দেশগুলোর শিয়া সম্প্রদায়ও ইতোমধ্যে তাদের একাধিক দাবিতে সোচ্চার। তারাও তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়। ইরানের ওপর কোনো যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে ইরান উপসাগরীয় আরব দেশগুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মার্কিন ঘাঁটিগুলোকে টার্গেট করবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন উচ্চপদস্থ ইরানি কর্মকর্তারা।
ইরান একটি যুদ্ধসাপেক্ষে যদি হরমুজ প্রণালী বন্ধ হয়ে যায় এবং তেলের ট্যাংকারগুলো আটকা পড়ে, তাহলে তেলের মূল্য আকাশচুম্বী হবে; যা একটি নির্বাচনী বছরে আমেরিকানদের জন্য সুখকর হবে না। সাথে সাথে একটি সমান্তরাল পথে যুক্তরাষ্ট্র বেপরোয়াভাবে তার ট্রাডিশনাল মিত্র এবং বাণিজ্যিক সহযোগীদের বেকায়দায় ফেলেছে, যার আওতায় ইরান বা ভারতের মতো দেশও রয়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র নিজের একপক্ষীয় অবরোধকে কার্যকর করতে তার সাথে কোনো প্রকার বিবাদবিহীন দেশেরও ক্ষতির কারণ ঘটিয়েছে।
আলোচনার জন্য সম্প্রতি যখন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব রঞ্জন মাথাই ওয়াশিংটনে যান। স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র ভিক্টোরিয়া ল্যান্ড রিপোর্টার্সদের বলেন, ভারত কী করে জ্বালানির একটি বিকল্প উৎস পেতে পারে, সেটিই আলোচ্য। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এক ধরনের Two Track Policy বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে, যাতে ইরানি তেলে অভ্যস্তদের ওই অভ্যাস থেকে ছাড়িয়ে নেয়া এবং বিশ্বজুড়ে সাপ্লাইয়ারকে গ্রাহকদের সাথে যুক্ত করে দেয়া যায়। তারাই তখন গ্রাহকদের বিকল্প উৎসের সন্ধান দেবে।
এরই মধ্যে সৌদি সরকার অঙ্গীকার করেছে, তারা তাদের জ্বালানির উৎপাদন বৃদ্ধি করেছে, যাতে অবরোধের ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে ইরানি তেলের ঘাটতি মেটানো যায়। ওবামা প্রশাসন সম্প্রতি মার্কিন ব্যাংকগুলোকে ওই সব ব্যাংকে গচ্ছিত ইরানি সম্পদ জব্দ করার ক্ষমতা দিয়েছে, যাতে ইরান আর ওই সম্পদকে তার সুবিধামতো অন্যত্র স্থানান্তর করতে না পারে। ইরানের ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ রেজা রহিমি সাম্প্রতিক অবরোধে ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছেন, ইরান অবশ্যই এ অবরোধকে অকার্যকর করবে। অতীতেও ইরান তা করেছে এবং জ্বালানি পিপাসার্তদের কাছে ইরান জ্বালানি বিক্রয়ে সক্ষম হয়েছে।
তবে অবরোধ দেরিতে হলেও তার প্রভাব ফেলছে ইরানের জনজীবনে। মুদ্রাস্ফীতি আর ওষুধের মতো প্রয়োজনীয় বস্তুর মহার্ঘতায় জনজীবন বিপর্যস্ত। ভারত ইরানের তেল-গ্যাস ক্রেতাদের মধ্যে অন্যতম বৃহৎ দেশ। দেশটির শীর্ষ নীতিনির্ধারক বলেন, ইরানি তেলের ওপর তাদের নির্ভরতা ক্রমেই কমছে, তবু ভারতের জন্য ইরানই তাদের জ্বালানির প্রধান উৎস। ভারত অপরিশোধিত তেলের ১২ শতাংশ ইরান থেকে সংগ্রহ করে। ভারত সরকারের সাম্প্রতিক ঘোষণা যে, দেশটি ‘ইরানের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক দৃঢ় করতে সেখানে একটি বড় ডেলিগেশন পাঠাচ্ছে,’ তা ওয়াশিংটনকে নারাজ করেছে। ভারতের বাণিজ্যসচিব রাহুল খুলুর গণমাধ্যমকে বলেছেন, ভারত জাতিসঙ্ঘ আরোপিত অবরোধ বাস্তবায়ন করছে, কিন্তু ইরানে আমাদের প্রেরিতব্য অনেক আইটেমে অবরোধ প্রযোজ্য নয়।
ইরান আইটেম রুপিতে পরিশোধ্য এবং দেশটিতে বিনিময় প্রথায় বাণিজ্য করা যায়। ভারতীয় কর্মকর্তাদের মতে, পাশ্চাত্যের কাছ থেকে এমন চাপ আসার কথা নয় যা ভারতীয় অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এমনকি ইরানের সাথে অবরোধের ফাঁকফোকর দিয়ে পাকিস্তানও বাণিজ্যে আগ্রহী। পাশ্চাত্যের সতর্কীকরণ উপেক্ষা করেই পাকিস্তান ঘোষণা দিয়েছে, ইরানের সাথে দেশটির গ্যাস পাইপলাইনের কাজ অব্যাহত থাকবে। ওয়াশিংটন বরং ভারতের সাথে গ্যাস পাইপলাইন ইস্যুতে অধিক সফল। প্রেসিডেন্ট বুশের ধমকে ভারত অনেক আগেই আইপিআই থেকে সরে এসেছিল। মুখ রক্ষায় ভারত ওজর দিয়েছিল অর্থনৈতিকভাবে প্রকল্প পাকিস্তানকেই বেশি ফায়দা দেবে, ভারতকে নয়।
মার্কিন চাপে আরো অনেক বেসরকারি কোম্পানি ইরানের পরিশোধিত তেল ক্রয়ের চুক্তি বাতিল করেছিল। ওবামা প্রশাসন স্বভাবতই ইরানের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিস্তৃত করার ভারতীয় সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট। তবে সিনিয়র ভারতীয় কর্মকর্তারা ইরানের সাথে সম্পর্ক রাখার বিষয়ে বেশ জেদি। তারা এমনও উল্লেখ করেছেন পাশ্চাত্য তো সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত ভারতকে অনুনয় করেছে মিয়ানমারের সামরিক সরকারকে একঘরে এবং দেশটির সাথে অর্থনৈতিক লেনদেন বন্ধ করতে। এখন আবার ওই পশ্চিমারাই তাদের নিজ স্বার্থে মিয়ানমারে বিনিয়োগ করতে নিজেরাই ছুটছে। ভারতীয়রা মনে করে, এমন পরিস্থিতি আগামী কয়েক বছরে পশ্চিমাদের জন্য ইরানেও বিরাজ করবে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার এবং নিরাপত্তা, রাজনীতি, বৈদেশিক নীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন