শেখ রোকন
ভ্লাদিমির পুতিন প্রধানমন্ত্রিত্বকালে একবার বলেছিলেন, যারা সোভিয়েত ইউনিয়নকে মিস করে না, তারা হৃদয়হীন। কিন্তু যারা সোভিয়েত আমল ফিরিয়ে আনতে চান, তারা মস্তিষ্কহীন। এই কথা বাংলাদেশের জন্য সত্য। সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের হৃদয়ে থাকুক। থাকুক দুঃসময়ে হাত বাড়ানো বন্ধুত্বের সুখস্মৃতি হিসেবে। বহুপাক্ষিক বিশ্বে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের সুবিধা নিতে চাইলে বর্তমান রাশিয়াকে মেনে নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। সোভিয়েত ইউনিয়নের কথা ভেবে ভেবে আমরা গত দুই দশকে রাশিয়ায় যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে তা দেখতে পাইনি। এখন সেদিকে মনোযোগ দেওয়া হোক
চলতি মাসের গোড়ার দিকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের ঢাকা সফর ও তার তাৎপর্য নিয়ে আমাদের ব্যতিব্যস্ত সংবাদমাধ্যমে মস্কোতে 'নতুন' প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের শপথ নেওয়ার খবর স্বভাবতই উপযুক্ত ট্রিটমেন্ট পায়নি। লোকালয়েই যখন বাঘের আনাগোনা, বনের হাতির গতিবিধি কে জানতে চায়! ফলে আর দশটা 'আন্তর্জাতিক' খবরের_ যেমন পাকিস্তানে জনৈক আল্লারাখির নাক ফিরে পাওয়া_ পাশেই রুশ প্রেসিডেন্টের শপথ গ্রহণের খবর ছাপা হয়েছে। তুলনা করা সঙ্গত নয়; তবুও জর্জ ডবি্লউ বুশের দ্বিতীয় মেয়াদ কিংবা বারাক ওবামার শপথ অনুষ্ঠানের কাভারেজ দেখতে পুরনো সংবাদপত্রের পাতা উল্টাতে পারেন অনুসন্ধিৎসু পাঠক। বাংলাদেশের জন্য প্রাসঙ্গিক হোক বা না হোক_ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্ষোভ, নতুন সরকার, রাজনৈতিক অচলাবস্থা প্রভৃতি নিয়ে কলাম লেখার একটা রেওয়াজ আমাদের দেশে গড়ে উঠেছে। পুতিনের তৃতীয় আমল নিয়ে সেসব লেখকেরও আগ্রহ চোখে পড়ল না।
এহ বাহ্য। শপথ অনুষ্ঠান উপলক্ষে ঢাকার রুশ কালচারাল অ্যান্ড সায়েন্স সেন্টারে 'লাইভ প্রদর্শনী' ও গোলটেবিল আলোচনার যে আয়োজন করা হয়েছিল, ঘটনাক্রমে আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। কিন্তু অনুপস্থিত ছিলেন নির্ধারিত অনেকে। প্রধান অতিথিদ্বয়_ ঢাকায় নিযুক্ত নতুন রুশ রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার এ নিকোলায়েভ এবং বাংলাদেশ-রাশিয়া ফ্রেন্ডশিপ সোসাইটির সেক্রেটারি জেনারেল অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর এমপি তো থাকবেনই, সন্দেহ নেই। সঞ্চালক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যও যথারীতি উপস্থিত ছিলেন। তবে নয়জন সম্মানিত ও বিশেষ অতিথির মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মাত্র দু'জন। কোনো অনুষ্ঠানে শতভাগ উপস্থিতি আশা করা বোকামি। নির্ধারিত আলোচকদের জরুরি কাজ পড়ে যেতে পারে। তারা সবাই সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার। ঢাকার যানজট লাঞ্ছিত যাতায়াত ব্যবস্থার কথাও ভুলে যাওয়া চলবে না। কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থাও অনেক সময় অংশগ্রহণকারীদের আগ্রহে ভাটা তৈরি করতে পারে। রুশ কালচারাল সেন্টারে অবশ্য এ বালাই নেই বললেই চলে।
প্রশ্ন অন্যত্র। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্টের শপথ এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে তার প্রভাব_ এমন একটি গোলটেবিল বৈঠক যদি আমেরিকান সেন্টারে আয়োজন করা হতো? সেখানে যদি মার্কিন রাষ্ট্রদূত উপস্থিত থাকতেন? সম্মানিত অতিথিরা কি তখনও অনুপস্থিত থাকতেন? সোভিয়েত আমলের রুশ-মার্কিন তুলনায় কাজ নেই। অনুষ্ঠানটি যদি যুক্তরাজ্য কিংবা জার্মান দূতাবাসের পক্ষ থেকেও আয়োজন করা হতো? ওই গোলটেবিলে উপস্থিত এক সাংবাদিক কানে কানে বললেন, এ ক্ষেত্রে এক পক্ষের প্রতি আগ্রহের তুলনায় বরং অন্য পক্ষের বিরাগভাজন হওয়ার আশঙ্কাই বেশি কাজ করেছে। তার মানে, সেই সোভিয়েত যুগের জুজু!
গত চার দশকে ভলগা ও গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। আমরা যেন সেই বিভাজিত বিশ্বেই বাস করছি। আশির দশকের সোভিয়েত ইউনিয়ন পেরিয়ে একুশ শতকের রাশিয়ায় আসতে পারিনি।
রুশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে গোলটেবিল আলোচনার পাশের টেবিলেই সাজানো রুশ রিয়ার অ্যাডমিরাল সের্গিয়েই পাভলাভিচ জুয়েঙ্কোর বাংলায় অনুবাদিত বই_ 'মনে রেখো আমাদের, হে বাংলাদেশ'। ১৯৭২-৭৪ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের নৌবাহিনী যুদ্ধবিধ্বস্ত চট্টগ্রাম বন্দরকে কর্মক্ষম করে তোলার কর্মসূচি নিয়েছিল। ডুবে থাকা জাহাজ ও মাইন অপসারণ করতে যে নৌবহর তখন চট্টগ্রাম এসেছিল, জুয়েঙ্কো ছিলেন তার অধিনায়ক। ১৯৯৫ সালে তার বইটি মস্কো থেকে প্রকাশিত হয়। রুশ-বাংলাদেশ সম্পর্কের ৪০ বছরপূর্তি উপলক্ষে ঢাকা থেকে তার বাংলা সংস্করণ প্রকাশ হয়েছে।
ভালো হতো রাশিয়ার পরিবর্তিত পরিস্থিতিও যদি এভাবে বাংলাদেশে ভাবান্তর হতো। গোলটেবিলে অংশগ্রহণকারী বক্তারা বলেছেন বটে যে, 'বাংলাদেশ রাশিয়া পরস্পরকে নতুন রূপে আবিষ্কার করছে' (সমকাল, ৮ মে ২০১২); বাস্তবে রাশিয়া এখনও আমাদের কাছে সোভিয়েত ইউনিয়নের নস্টালজিয়া ছাড়া আর কিছু নয়। সেই নস্টালজিয়ায় আমাদের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর বড় অংশের চিন্তা-ভাবনা এখনও আচ্ছন্ন। এ থেকে মুক্তি সহজও নয়।
বস্তুত আশির দশক অবধি সুদূর মফস্বলেরও প্রগতিমনস্ক পরিবারের ঘরে প্রগতি প্রকাশনার বাংলা বই পেঁৗছে গিয়েছিল। কেবল সোভিয়েত শাসন ব্যবস্থার গুণগান নয়; প্রগতির হাত ধরেই বাঙালি মধ্যবিত্তের ঘরে প্রবেশ করেছিলেন তলস্তয়, পুশকিন, গোর্কির মতো মহান লেখকরা। লেখা মানে নিছক ঘটনার ঘনঘটা নয়; রুশ সমাজ, সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাসও এখানে পরিচিতি পেয়েছে। এখনও অনেকের কাছে পরিণত পানীয় মানেই ভদকা। আমাদের বাড়িতেও ডাকযোগে আসত 'উদয়ন'। প্রচ্ছদজুড়ে প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভের গম্ভীর মুখ_ উদয়ন বলতে কেন যেন এই ছবিটাই এখনও চোখে লেগে আছে।
বলা বাহুল্য, অনেকের স্বপ্ন ভেঙে দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে সমাজতন্ত্র বিদায় নিয়েছে। মহাজাগতিক নানা ইস্যুতে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে বাংলাদেশের সমাজতন্ত্রীরাও ছিন্নভিন্ন। আর যাই হোক, তারা রাজনৈতিক ভরসা জাগাতে পারছে না। আমাদের সমাজে বরং সোভিয়েত ইউনিয়নের সাংস্কৃতিক প্রভাবই এখন প্রধান।
মুশকিল হচ্ছে, সাংস্কৃতিক এ নৈকট্যের ওপর দাঁড়িয়ে যে কূটনৈতিক ঘনিষ্ঠতা নতুন মাত্রা পেতে পারত, তা সম্ভব হচ্ছে না। প্রথম কারণ সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজনৈতিক ছায়া পুরোপুরি না কাটা। বিশ্ব রাজনীতিতে রাশিয়ার উত্থান ঘটবে এবং ফের দ্বি-মেরু বিশ্ব প্রতিষ্ঠিত হবে, সাবেক সমাজতন্ত্রীদের কেউ কেউ এখনও এমন স্বপ্ন দেখেন। স্বপ্ন দেখেন, ষাট ও সত্তর দশকের সেই ইন্দো-রুশ মৈত্রীর সেতু পেরিয়ে বাংলাদেশে 'হাত গুটাও মার্কিন' স্লোগান তোলা সম্ভব। দ্বিতীয় কারণ, খোদ রাশিয়ার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক খোলনলচে বদলে যাওয়া।
'সাম্রাজ্যবাদবিরোধী' লড়াইয়ে আমাদের দেশে এখনও যারা রাশিয়াকে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের আসনে দেখতে চান; তারা সাবেক সোভিয়েত দেশগুলো ঘুরে আসতে পারেন। চেচনিয়ার কথা না হয় বাদই থাকল। বেলারুশের নাগরিক আমার ফেসবুক বন্ধু দিমিত্রি একবার বলছিল, সে আশির দশকের সোভিয়েত স্টাইলে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইয়ে আরেক বার নামতে চায়। বহুল উচ্চারিত 'ইঙ্গ-মার্কিন' শক্তি নয়; এবার তার প্রতিপক্ষ রাশিয়া। বিভিন্ন ইস্যুতে রুশ-আমেরিকান হুজ্জত দেখে যারা উজ্জীবিত হন; তারা খোঁজ নিলে দেখবেন এই লড়াই হালুয়ার ভাগাভাগি ছাড়া আর কিছু নয়। আশপাশে তাকালে দেখা যাবে, নয়াদিলি্ল কিংবা বেইজিংয়ের সঙ্গে মস্কোর সম্পর্ক এখন সোভিয়েত আমলে হিসাব-নিকাশে পড়ে নেই।
বাংলাদেশকে এ বাস্তবতা মেনে নিতে হবে। কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আদর্শিক রাশিয়াকে খুঁজতে গেলে বিভ্রান্তই হতে হবে। ইতিমধ্যে রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করতে রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। গ্যাসক্ষেত্রে আসছে রুশ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা গ্যাজপ্রোম। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যও বাড়ছে। ২০১১ সালে সেই বৃদ্ধি ছিল ৪০ শতাংশ। রুশ-বাংলাদেশ বাণিজ্যের সরল অঙ্কে প্লাস বসাতে হলে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাব ও মূর্তির সামনে মাইনাসই হবে উপযুক্ত সমাধান।
শেষ করা যাক ভ্লাদিমির পুতিনের একটি উক্তি দিয়ে। প্রধানমন্ত্রিত্বকালে তিনি একবার বলেছিলেন, যারা সোভিয়েত ইউনিয়নকে মিস করে না, তারা হৃদয়হীন। কিন্তু যারা সোভিয়েত আমল ফিরিয়ে আনতে চান, তারা মস্তিষ্কহীন। এই কথা বাংলাদেশের জন্য সত্য। সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের হৃদয়ে থাকুক। থাকুক দুঃসময়ে হাত বাড়ানো বন্ধুত্বের সুখস্মৃতি হিসেবে। বহুপাক্ষিক বিশ্বে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের সুবিধা নিতে চাইলে বর্তমান রাশিয়াকে মেনে নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। সোভিয়েত ইউনিয়নের কথা ভেবে ভেবে আমরা গত দুই দশকে রাশিয়ায় যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে তা দেখতে পাইনি। এখন সেদিকে মনোযোগ দেওয়া হোক। কূটনীতির পথ ধরে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ক্ষেত্রে ব্রাজিল কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকাকে যে অবস্থানে আমরা বিবেচনা করি, নতুন রাশিয়াকে সেভাবেই দেখতে হবে।
সন্দেহ নেই ইতিমধ্যে যথেষ্ট বিলম্ব হয়েছে। কিন্তু সময় এখনও ফুরিয়ে যায়নি। বড় কথা হচ্ছে, সোভিয়েত ইউনিয়ন নয়, রাশিয়া পুনরাবিষ্কারেই মনোযোগী হতে হবে। বর্তমান রাশিয়ার দোষ-গুণ; বড়র পিরিতির সম্ভাবনা-আশঙ্কা, সব মেনে নিয়েই নতুন করে বন্ধুত্ব হতে হবে। আমরা কি প্রস্তুত?
শেখ রোকন : সাংবাদিক ও গবেষক
skrokon@gmail.com
চলতি মাসের গোড়ার দিকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের ঢাকা সফর ও তার তাৎপর্য নিয়ে আমাদের ব্যতিব্যস্ত সংবাদমাধ্যমে মস্কোতে 'নতুন' প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের শপথ নেওয়ার খবর স্বভাবতই উপযুক্ত ট্রিটমেন্ট পায়নি। লোকালয়েই যখন বাঘের আনাগোনা, বনের হাতির গতিবিধি কে জানতে চায়! ফলে আর দশটা 'আন্তর্জাতিক' খবরের_ যেমন পাকিস্তানে জনৈক আল্লারাখির নাক ফিরে পাওয়া_ পাশেই রুশ প্রেসিডেন্টের শপথ গ্রহণের খবর ছাপা হয়েছে। তুলনা করা সঙ্গত নয়; তবুও জর্জ ডবি্লউ বুশের দ্বিতীয় মেয়াদ কিংবা বারাক ওবামার শপথ অনুষ্ঠানের কাভারেজ দেখতে পুরনো সংবাদপত্রের পাতা উল্টাতে পারেন অনুসন্ধিৎসু পাঠক। বাংলাদেশের জন্য প্রাসঙ্গিক হোক বা না হোক_ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্ষোভ, নতুন সরকার, রাজনৈতিক অচলাবস্থা প্রভৃতি নিয়ে কলাম লেখার একটা রেওয়াজ আমাদের দেশে গড়ে উঠেছে। পুতিনের তৃতীয় আমল নিয়ে সেসব লেখকেরও আগ্রহ চোখে পড়ল না।
এহ বাহ্য। শপথ অনুষ্ঠান উপলক্ষে ঢাকার রুশ কালচারাল অ্যান্ড সায়েন্স সেন্টারে 'লাইভ প্রদর্শনী' ও গোলটেবিল আলোচনার যে আয়োজন করা হয়েছিল, ঘটনাক্রমে আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। কিন্তু অনুপস্থিত ছিলেন নির্ধারিত অনেকে। প্রধান অতিথিদ্বয়_ ঢাকায় নিযুক্ত নতুন রুশ রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার এ নিকোলায়েভ এবং বাংলাদেশ-রাশিয়া ফ্রেন্ডশিপ সোসাইটির সেক্রেটারি জেনারেল অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর এমপি তো থাকবেনই, সন্দেহ নেই। সঞ্চালক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যও যথারীতি উপস্থিত ছিলেন। তবে নয়জন সম্মানিত ও বিশেষ অতিথির মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মাত্র দু'জন। কোনো অনুষ্ঠানে শতভাগ উপস্থিতি আশা করা বোকামি। নির্ধারিত আলোচকদের জরুরি কাজ পড়ে যেতে পারে। তারা সবাই সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার। ঢাকার যানজট লাঞ্ছিত যাতায়াত ব্যবস্থার কথাও ভুলে যাওয়া চলবে না। কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থাও অনেক সময় অংশগ্রহণকারীদের আগ্রহে ভাটা তৈরি করতে পারে। রুশ কালচারাল সেন্টারে অবশ্য এ বালাই নেই বললেই চলে।
প্রশ্ন অন্যত্র। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্টের শপথ এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে তার প্রভাব_ এমন একটি গোলটেবিল বৈঠক যদি আমেরিকান সেন্টারে আয়োজন করা হতো? সেখানে যদি মার্কিন রাষ্ট্রদূত উপস্থিত থাকতেন? সম্মানিত অতিথিরা কি তখনও অনুপস্থিত থাকতেন? সোভিয়েত আমলের রুশ-মার্কিন তুলনায় কাজ নেই। অনুষ্ঠানটি যদি যুক্তরাজ্য কিংবা জার্মান দূতাবাসের পক্ষ থেকেও আয়োজন করা হতো? ওই গোলটেবিলে উপস্থিত এক সাংবাদিক কানে কানে বললেন, এ ক্ষেত্রে এক পক্ষের প্রতি আগ্রহের তুলনায় বরং অন্য পক্ষের বিরাগভাজন হওয়ার আশঙ্কাই বেশি কাজ করেছে। তার মানে, সেই সোভিয়েত যুগের জুজু!
গত চার দশকে ভলগা ও গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। আমরা যেন সেই বিভাজিত বিশ্বেই বাস করছি। আশির দশকের সোভিয়েত ইউনিয়ন পেরিয়ে একুশ শতকের রাশিয়ায় আসতে পারিনি।
রুশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে গোলটেবিল আলোচনার পাশের টেবিলেই সাজানো রুশ রিয়ার অ্যাডমিরাল সের্গিয়েই পাভলাভিচ জুয়েঙ্কোর বাংলায় অনুবাদিত বই_ 'মনে রেখো আমাদের, হে বাংলাদেশ'। ১৯৭২-৭৪ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের নৌবাহিনী যুদ্ধবিধ্বস্ত চট্টগ্রাম বন্দরকে কর্মক্ষম করে তোলার কর্মসূচি নিয়েছিল। ডুবে থাকা জাহাজ ও মাইন অপসারণ করতে যে নৌবহর তখন চট্টগ্রাম এসেছিল, জুয়েঙ্কো ছিলেন তার অধিনায়ক। ১৯৯৫ সালে তার বইটি মস্কো থেকে প্রকাশিত হয়। রুশ-বাংলাদেশ সম্পর্কের ৪০ বছরপূর্তি উপলক্ষে ঢাকা থেকে তার বাংলা সংস্করণ প্রকাশ হয়েছে।
ভালো হতো রাশিয়ার পরিবর্তিত পরিস্থিতিও যদি এভাবে বাংলাদেশে ভাবান্তর হতো। গোলটেবিলে অংশগ্রহণকারী বক্তারা বলেছেন বটে যে, 'বাংলাদেশ রাশিয়া পরস্পরকে নতুন রূপে আবিষ্কার করছে' (সমকাল, ৮ মে ২০১২); বাস্তবে রাশিয়া এখনও আমাদের কাছে সোভিয়েত ইউনিয়নের নস্টালজিয়া ছাড়া আর কিছু নয়। সেই নস্টালজিয়ায় আমাদের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর বড় অংশের চিন্তা-ভাবনা এখনও আচ্ছন্ন। এ থেকে মুক্তি সহজও নয়।
বস্তুত আশির দশক অবধি সুদূর মফস্বলেরও প্রগতিমনস্ক পরিবারের ঘরে প্রগতি প্রকাশনার বাংলা বই পেঁৗছে গিয়েছিল। কেবল সোভিয়েত শাসন ব্যবস্থার গুণগান নয়; প্রগতির হাত ধরেই বাঙালি মধ্যবিত্তের ঘরে প্রবেশ করেছিলেন তলস্তয়, পুশকিন, গোর্কির মতো মহান লেখকরা। লেখা মানে নিছক ঘটনার ঘনঘটা নয়; রুশ সমাজ, সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাসও এখানে পরিচিতি পেয়েছে। এখনও অনেকের কাছে পরিণত পানীয় মানেই ভদকা। আমাদের বাড়িতেও ডাকযোগে আসত 'উদয়ন'। প্রচ্ছদজুড়ে প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভের গম্ভীর মুখ_ উদয়ন বলতে কেন যেন এই ছবিটাই এখনও চোখে লেগে আছে।
বলা বাহুল্য, অনেকের স্বপ্ন ভেঙে দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে সমাজতন্ত্র বিদায় নিয়েছে। মহাজাগতিক নানা ইস্যুতে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে বাংলাদেশের সমাজতন্ত্রীরাও ছিন্নভিন্ন। আর যাই হোক, তারা রাজনৈতিক ভরসা জাগাতে পারছে না। আমাদের সমাজে বরং সোভিয়েত ইউনিয়নের সাংস্কৃতিক প্রভাবই এখন প্রধান।
মুশকিল হচ্ছে, সাংস্কৃতিক এ নৈকট্যের ওপর দাঁড়িয়ে যে কূটনৈতিক ঘনিষ্ঠতা নতুন মাত্রা পেতে পারত, তা সম্ভব হচ্ছে না। প্রথম কারণ সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজনৈতিক ছায়া পুরোপুরি না কাটা। বিশ্ব রাজনীতিতে রাশিয়ার উত্থান ঘটবে এবং ফের দ্বি-মেরু বিশ্ব প্রতিষ্ঠিত হবে, সাবেক সমাজতন্ত্রীদের কেউ কেউ এখনও এমন স্বপ্ন দেখেন। স্বপ্ন দেখেন, ষাট ও সত্তর দশকের সেই ইন্দো-রুশ মৈত্রীর সেতু পেরিয়ে বাংলাদেশে 'হাত গুটাও মার্কিন' স্লোগান তোলা সম্ভব। দ্বিতীয় কারণ, খোদ রাশিয়ার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক খোলনলচে বদলে যাওয়া।
'সাম্রাজ্যবাদবিরোধী' লড়াইয়ে আমাদের দেশে এখনও যারা রাশিয়াকে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের আসনে দেখতে চান; তারা সাবেক সোভিয়েত দেশগুলো ঘুরে আসতে পারেন। চেচনিয়ার কথা না হয় বাদই থাকল। বেলারুশের নাগরিক আমার ফেসবুক বন্ধু দিমিত্রি একবার বলছিল, সে আশির দশকের সোভিয়েত স্টাইলে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইয়ে আরেক বার নামতে চায়। বহুল উচ্চারিত 'ইঙ্গ-মার্কিন' শক্তি নয়; এবার তার প্রতিপক্ষ রাশিয়া। বিভিন্ন ইস্যুতে রুশ-আমেরিকান হুজ্জত দেখে যারা উজ্জীবিত হন; তারা খোঁজ নিলে দেখবেন এই লড়াই হালুয়ার ভাগাভাগি ছাড়া আর কিছু নয়। আশপাশে তাকালে দেখা যাবে, নয়াদিলি্ল কিংবা বেইজিংয়ের সঙ্গে মস্কোর সম্পর্ক এখন সোভিয়েত আমলে হিসাব-নিকাশে পড়ে নেই।
বাংলাদেশকে এ বাস্তবতা মেনে নিতে হবে। কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আদর্শিক রাশিয়াকে খুঁজতে গেলে বিভ্রান্তই হতে হবে। ইতিমধ্যে রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করতে রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। গ্যাসক্ষেত্রে আসছে রুশ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা গ্যাজপ্রোম। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যও বাড়ছে। ২০১১ সালে সেই বৃদ্ধি ছিল ৪০ শতাংশ। রুশ-বাংলাদেশ বাণিজ্যের সরল অঙ্কে প্লাস বসাতে হলে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাব ও মূর্তির সামনে মাইনাসই হবে উপযুক্ত সমাধান।
শেষ করা যাক ভ্লাদিমির পুতিনের একটি উক্তি দিয়ে। প্রধানমন্ত্রিত্বকালে তিনি একবার বলেছিলেন, যারা সোভিয়েত ইউনিয়নকে মিস করে না, তারা হৃদয়হীন। কিন্তু যারা সোভিয়েত আমল ফিরিয়ে আনতে চান, তারা মস্তিষ্কহীন। এই কথা বাংলাদেশের জন্য সত্য। সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের হৃদয়ে থাকুক। থাকুক দুঃসময়ে হাত বাড়ানো বন্ধুত্বের সুখস্মৃতি হিসেবে। বহুপাক্ষিক বিশ্বে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের সুবিধা নিতে চাইলে বর্তমান রাশিয়াকে মেনে নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। সোভিয়েত ইউনিয়নের কথা ভেবে ভেবে আমরা গত দুই দশকে রাশিয়ায় যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে তা দেখতে পাইনি। এখন সেদিকে মনোযোগ দেওয়া হোক। কূটনীতির পথ ধরে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ক্ষেত্রে ব্রাজিল কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকাকে যে অবস্থানে আমরা বিবেচনা করি, নতুন রাশিয়াকে সেভাবেই দেখতে হবে।
সন্দেহ নেই ইতিমধ্যে যথেষ্ট বিলম্ব হয়েছে। কিন্তু সময় এখনও ফুরিয়ে যায়নি। বড় কথা হচ্ছে, সোভিয়েত ইউনিয়ন নয়, রাশিয়া পুনরাবিষ্কারেই মনোযোগী হতে হবে। বর্তমান রাশিয়ার দোষ-গুণ; বড়র পিরিতির সম্ভাবনা-আশঙ্কা, সব মেনে নিয়েই নতুন করে বন্ধুত্ব হতে হবে। আমরা কি প্রস্তুত?
শেখ রোকন : সাংবাদিক ও গবেষক
skrokon@gmail.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন