অগ্রণী ইহুদি বুদ্ধিজীবী এবং যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাধিক প্রভাবশালী সংবাদপত্র নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর প্রখ্যাত কলামিস্ট রজার কোহেন। তিনি ইহুদিদের প্রতি ‘ইসলামফোবিয়া’ (ইসলামাতঙ্ক) ছড়ানোতে হাওয়া না দিতে পরামর্শ দিয়েছেন। বরং ইসরাইল কর্তৃক পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের পরাধীন করে ইসরাইলের উপনিবেশ স্থাপনের প্রয়াস ইসরাইলকে একঘরে করে ইসরাইলের অস্তিত্বকেই বিপন্ন করবে বিধায় সে সম্পর্কে হুঁশিয়ারির বুলন্দ আওয়াজ তোলার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন।
নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত ‘যে ইহুদিরা ফিসফিস করে কথা বলে’ শীর্ষক কলামে রজার কোহেন লিখেছেন, ইহুদিদের ইতিহাসে যেসব আলামত রয়েছে তা থেকে এটা পরিষ্কার যে ইহুদিরা অপর একটি জাতিকে পদ্ধতিগতভাবে পরাধীন করে রাখতে সম নয়।
কোহেন যুক্তরাজ্যে ঐতিহ্যগতভাবে যে ‘অ্যান্টিসেমিটিজম’ (ইহুদিবিদ্বেষ) চলে আসছে তার কিছু বর্ণনা দিয়েছেন : যুক্তরাজ্যে বহু ইংরেজ ইহুদি এখনো যখন তারা ইহুদি বলে পরিচয় দেয় তাদের গলার স্বর নামিয়ে ফেলে, তাদের স্বরে একটা কুণ্ঠা ভাব ধরা পড়ে। যুক্তরাজ্যে ইহুদিদের প্রতি কোনো বিদ্বেষের কারণে নয়, অতীত কাল থেকে ব্রিটিশ সমাজে ‘অ্যান্টিসেমিটিজম’-এর যে ধারা বয়ে আসছে, তারই রেশে এ রকমটা হয়। ভদ্র ও মার্জিত আচরণের ইংরেজদের মনের ‘অ্যান্টিসেমিটিজম’ প্রকাশ পায় ছোট ছোট উক্তিতে। যেমনÑ এক ইহুদি ব্যক্তিত্ব ‘হাউজ অব লর্ডস’-এ অন্তর্ভুক্ত হলে এক ইংরেজ ব্যক্তিত্ব মন্তব্য করেন, ‘অবশ্যই ওরা অত্যন্ত ধূর্ত প্রকৃতির।’ দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় কলামিস্ট জোনাথন মার্গোলিস লিখেছেন, এক ইংরেজ জমিদার তার গ্রামে সদ্য বসতি স্থাপন করা এক ইহুদি পরিবারকে তিনি কতই পছন্দ করেন তা বর্ণনায় বললেন, ‘অবশ্য, অন্য সবাই তাদের ঘৃণা করে।’
কোহেন লিখেছেন, ইহুদিদের প্রকৃত পরিচয় কি তা নির্ণয় করা জটিল এবং অনুসন্ধানের ব্যাপার। আমেরিকায় তিনি ইসরাইলের সমালোচনা করায় এবং বিশেষ করে ইসরাইলের পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপনের যা তিনি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে বলেন সমালোচনা করায় যারা স্বঘোষিতভাবে নিজেদের ‘প্রকৃত ইহুদি’ বলে জাহির করে তারা ‘যথেষ্ট ইহুদি নয়’ অথবা ‘স্বনিন্দিত ইহুদি’দের অন্যতম বলে তাকে আখ্যায়িত করে। তিনি লিখেছেন, ‘নিজে আমি একজন নিঃশব্দ এবং পরিচয় প্রকাশে বিমুখ ইহুদিরূপে চলাফেরা করতে অস্বস্তিতে ভুগি।’
তিনি লিখেছেন, যুক্তরাজ্যে বিষয়টি আরো জটিল। যুক্তরাজ্যে প্রায় তিন লাখ ইহুদি বাস করে, আর মুসলিম বাস করে বিশ লাখেরও অধিকÑ এখানে ইহুদিরা ইসরাইল-ফিলিস্তিন বিরোধ এবং ‘রাজনৈতিক ইসলাম’-এর বৃহত্তর প্রবাহে আটকা পড়েছে। কোহেন লিখেছেন, ঐতিহ্যগতভাবে যুক্তরাজ্যে ব্রিটিশ সমাজের অভিজাত স্তরেই ‘অ্যান্টিসেমিটিজম’ (ইহুদিবিদ্বেষ) বিরাজমান, সমাজের নিম্নতম স্তরে শ্রমজীবী পর্যায়ে এটা ততটা প্রকট নয়। অপর দিকে মুসলমানদের প্রতি বিরূপতা ব্রিটিশ সমাজের উচ্চতর এবং প্রাতিষ্ঠানিক স্তরে ততটা নয়, যতটা নিম্নতর স্তরে শ্রমজীবী পর্যায়ে।
কোহেন লিখেছেন, এখন বামপন্থী ইহুদিদের এক প্রচ ‘অ্যান্টিসেমিটিজম’ (ইহুদিবিদ্বেষ) মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে যা ইসরাইলকে অ্যাকাডেমিকভাবে বয়কট করার আহ্বান জানাচ্ছে। মুসলমানদের কিছু ‘অ্যান্টিসেমিটিজম’ও এর সাথে যোগ হয়েছে। তিনি লিখেছেন, ডানপন্থীরা ‘ইউরাবিয়ার (ইউরোপ আরব হয়ে যাচ্ছে) মনগড়া কাহিনী দিয়ে ‘ইসলামফোবিয়া’কে (ইসলাম আতঙ্ক) উসকে দিচ্ছে। তিনি লিখেছেন, মুসলমানেরা ইউরোপ দখল করে নিচ্ছে মর্মে যে মনগড়া কাহিনী ছড়ানো হচ্ছে তার প্রতিক্রিয়ায় নরওয়েতে এন্ডার্স ব্রেইভিক হত্যাযজ্ঞে নামে (৬৩ নরওয়েবাসীকে হত্যা করে); ‘ইউরাবিয়া’র মনগড়া প্রচারণা ইউরোপের ডানপন্থীদের উত্তেজনার রসদ হচ্ছে এবং আমেরিকানদের সঙ্কীর্ণতাবাদী গোঁড়ামিকে উসকে দিচ্ছে।
ইহুদিদের উদার মুক্তবুদ্ধিবাদের দিকে পরিচালিত করার জন্য কারা নেতৃত্ব দেবে? এ প্রশ্নে কলামিস্ট কোহেন ইসরাইলের ‘নেসেট’ (সংসদ) সদস্য যারা ইউরোপের ডানপন্থী নেতাদের সাথে বৈঠক করেছে তাদের নেতৃত্বকে বাতিল করে দেন এই কারণে যে, তারা ‘যেহেতু উভয় গ্রুপই মুসলমানদের সমভাবে ঘৃণা করে সেহেতু উভয় গ্রুপ পরস্পরের দোসর’ এই অদ্ভুত হাস্যকর ধারণার ভিত্তিতে বৈঠকটা করেছে। তিনি ইহুদি লেখিকা মেলানি ফিলিপসের সমালোচনা করেন ‘লন্ডনিস্তান’ নামীয় বইটি প্রণয়ন ও প্রকাশ করার জন্য, যে বইটি ‘ইসলামফোবস’দের (ইসলামাতঙ্কগ্রস্ত) জন্য একটি কেতাবে পরিণত হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে কোহেন লন্ডনের কিংস কলেজে আইনের অধ্যাপক মালিহা মালিক তাকে যে সমান্তরাল উদাহরণ দেখিয়েছেন তা উল্লেখ করেন : এক শতাব্দী আগে ১৯১১ সালে ‘সিডনি স্ট্রিট দখল’ আন্দোলনে লন্ডনের ইস্ট অ্যান্ড এলাকার ইহুদিদের ‘বলশেভিক’ (রাশিয়ান কমিউনিস্ট) বলে আখ্যায়িত করে বলা হয়েছিল যে, এরা ‘বহিরাগত চরমপন্থী’। ব্রিটেনের বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী, ইতিহাসবিদ এবং সর্বাধিক খ্যাত প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন, ‘ইহুদিরা হচ্ছে সারা বিশ্বে সভ্যতাকে উৎখাত করে প্রতিবন্ধী পন্থায় সমাজকে পুনর্গঠন করার বিশ্বব্যাপী এক ষড়যন্ত্রেরই একটা অংশ।’ কোহেন লিখেছেন, এসব থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, এত সব নিন্দনীয় ভূমিকার বোঝায় ভারাক্রান্ত ইতিহাস নিয়ে ইহুদিরা অন্য কোনো জাতিকে পদ্ধতিবদ্ধভাবে নির্যাতনকারীর ভূমিকা গ্রহণ করতে পারবে না। তাই ‘ইসলামফোবিয়া’য় (ইসলামাতঙ্ক) হাওয়া দেয়া থেকে ইহুদিদের সক্রিয়ভাবে বিরত হতে হবে এবং পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের পরাধীন করে সেখানে ইসরাইলের উপনিবেশ স্থাপন প্রয়াসের বিরুদ্ধে প্রচ ভাবে সোচ্চার হতে হবে।
লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক, কলামিস্ট
moyeenulalam@hotmail.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন