নীরক্তকরবীর মালা/কনক জ্যোতি
বাংলাদেশের উত্তর সীমান্তের ওপাশে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হিল-টাউন বা পাহাড়ি-শহর দার্জিলিং। সেখানে উত্তপ্ত ‘গোর্খাল্যান্ড'' আন্দোলন অবশেষে শান্তিপূর্ণ আলোচনার পথ ধরে এগুচ্ছে বটে; কিন্তু সন্তর্পণে অশান্তির অগ্নিশিখাটিও জ্বলছেই। শক্তির পর লোভ দেখিয়ে এখন তাদেরকে বশীভূত করার অপচেষ্টা করছে ভারতীয়রা। কিন্তু সেই কৌশলও আদৌ সফল হবে কি-না, সেটা নিয়েও জন্ম নিয়েছে নানা সন্দেহ, প্রশ্ন।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশভুক্ত স্বাধীনতাকামী গোর্খা জনগোষ্ঠী বিগত বামফ্রন্ট সরকারের সময় থেকেই পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের দাবিতে দার্জিলিং ও এর আশেপাশের পার্বত্য এলাকার তীব্র আন্দোলন শুরু করে। তাদের এ দাবি নতুন নয়। নিজেদের স্বায়ত্তশাসন ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রশ্নে তাদের সংগ্রাম-লড়াইটি বেশ প্রাচীন। বছরের পর বছর দফায় দফায় বৈঠক, বন্ধ এবং সংঘর্ষের সিরিজ চললেও সমস্যার সমাধান হয়নি; এমনকি, সমাধানের পথে অগ্রসর হওয়াও যায়নি। উগ্র জাতীয়তাবাদী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে তিন মাসের মধ্যে গোর্খাল্যান্ড সমস্যার সমাধানের পথে এগিয়ে যাওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন। মমতা উদাহরণ সৃষ্টি করলেন-তিন মাস নয়, ক্ষমতায় বসার মাত্র ১৮ দিনের মাথায় সমাধানের পথ উন্মুক্ত করেন। কিন্তু সে সমাধান যে সকলে গ্রাহ্য করেনি এবং আন্দোলনকারীদের জন্যে কাঙ্ক্ষিত হয়নি, সেটা হালে টের পাওয়া যাচ্ছে।
সংঘাত ও সংঘর্ষময় গোর্খাল্যান্ড সমস্যাকে মমতা আলোচনার আপাতত টেবিলে এবং চুক্তির আওতায় নিয়ে এলেন এবং একটি চুক্তিতেও আবদ্ধ করলেন। গৃহীত চুক্তি অনুযায়ী গঠিত হচ্ছে একটি বিধিবদ্ধ স্বশাসিত সংস্থা, যা নির্বাচনের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করবে। তরাই-ডুয়ার্সের কিছু এলাকা সংযোজনের দাবি খতিয়ে দেখতেও কমিটি হবে। এ ছাড়া নতুন এই চুক্তি অনুযায়ী বর্তমান পার্বত্য পরিষদ পরিচালনা করবে নতুন বোর্ড, যেখানে প্রশাসনের প্রতিনিধিরা ছাড়াও থাকবেন গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন মোর্চার তিনজন বিধায়ক বা সংসদ সদস্য। পার্বত্য পরিষদের প্রায় ছয় হাজার অস্থায়ী কর্মীকে দেওয়া হবে সব রকমের সরকারি সুযোগ-সুবিধা। পাহাড়ের সার্বিক উন্নয়নে বিশেষ প্যাকেজও থাকছে। তৈরি হয়েছে কেন্দ্র-রাজ্য-গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন মোর্চার মধ্যকার ত্রিপাক্ষিক বৈঠকের রূপরেখা এবং শুরু হয়েছে চূড়ান্ত সমঝোতাপত্রের প্রাথমিক কাজ। এগুলো সমস্যার মূলে যাওয়ার সূচনা হলেও আসল প্রতিষেধক নয় মোটেই। শক্তির কৌশল ছেড়ে লোভ দেখানোর অপকৌশল কি-না, সেটাই প্রশ্নযুক্ত। খোদ গোর্খারাই ভারতীয়দের পদক্ষেপ ও সাধুবাক্যকে সন্দেহের চোখে দেখছে। আসছে ভারতের যে অতীত রেকর্ড, তাতে গোর্খা কেন, অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সদস্যরাও ভারতীয়দের বিশ্বাস করতে ভয় পায়।
প্রশ্ন উঠতে পারে যে, মোর্চা কি পৃথক গোর্খাল্যান্ডের দাবি থেকে সরে এলো? উত্তরে মোর্চা নেতারা জানিয়েছেন যে, দাবি থেকে তারা না সরলেও আপাতত আইনি প্রক্রিয়ায় নতুন সংস্থা তৈরির দাবি রাজ্য সরকার মেনে নেওয়ায় তাঁরা সন্তুষ্ট। তাঁরা মনে করেন, পার্বত্য জনগোষ্ঠীর দাবিকে গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখার ফলে পাহাড়বাসীর ক্ষোভ কমবে। সন্দেহ নেই, গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে নিরবচ্ছিন্নভাবে চলতে থাকা সন্ত্রস্ত পরিস্থিতি বদলাবে। এতদিনকার বিক্ষোভ ও সংঘর্ষে বিধ্বস্ত জনপদ আবার মাথা তুলে দাঁড়াবে। ভঙ্গুর পর্যটন শিল্পও গতি ফিরে পাবে। কেননা, গোর্খাল্যান্ডের মধ্যমণি দার্জিলিং জ্বলছিল আন্দোলনের অনলে। গোর্খা নেতারা জানবাজি দিয়ে আলাদা রাজ্যের জন্যে লড়েছেন। গোর্খারা এখনও মনে করেন, তাঁরা আলাদা জাতি; পশ্চিমবঙ্গের অংশ হয়ে থাকা তাঁদের পরিচিতি ও অস্তিত্বের বিপক্ষে। নিজেদের স্বাধীন সত্তায় বেঁচে থাকার অধিকার গোর্খাদের জন্মগত। কিন্তু সেই জন্মগত অধিকার বছরের পর বছর ভূলুণ্ঠিত ভারতীয় আগ্রাসন ও সম্প্রসারণবাদী আধিপত্যের দ্বারা।
গোর্খারা এক সময় চেয়েছিলেন পূর্ণ স্বাধীনতা। তারপর পৃথক রাজ্য। স্বাধীনতা দূর অস্ত, পশ্চিমবঙ্গের ভেতর থেকেই বের হতে পারছে না তারা। এবার মমতা তাঁদেরকে বশীভূত করে ফেললেন চুক্তির আওতায়। স্বাধীন গোর্খাল্যান্ড নয়, পৃথক রাজ্যও নয়, মমতা-ঘোষিত ‘সুইজারল্যান্ড' হওয়ার জন্য এখন অধীরে অপেক্ষমাণ বঙ্গের সর্বউত্তরের জনজাতি গোর্খারা। কিন্তু সেই সুইজারল্যান্ড আদৌ কতটুকু শান্তির হবে, সেটাই লাখ টাকার প্রশ্ন। এই প্রশ্ন যেমন খোদ গুর্খাদের, তেমনি ভারতের বহু স্বাধীনতাকামী জাতিসত্তারও এবং ভারতের কাছে নিগৃহীত প্রতিবেশী নানা দেশের কোটি কোটি মানুষেরও।
গোর্খাদের হয়ত স্মরণে নেই, ভারতের পেটের মধ্য থেকে বের হওয়া যায় না। নাগারা পারেনি, মিজোরা পারেনি। কাশ্মীর পারছে না। পাঞ্জাব পারছে না। অনেকেই পারছে না, তবে স্বাধীনতার স্পৃহা, আকাঙ্ক্ষা ও উদ্যোগ ছেড়ে দিয়েছে, এমনও নয়। স্বাধীনতা তো আত্মার অংশ, জীবিত থাকতে গেছে সঙ্গে রাখতেই হবে। অতএব স্বাধীনতার দাবি আত্মার সঙ্গে পোষণ করছে কোটি কোটি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নিপীড়ত মানুষ।
ভারত কাউকে না ছাড়লেও টেনে-হিঁচড়ে আনতে পারে ঠিকই। কাশ্মীর দখল করেছে, হায়দারাবাদ, জুনাগড় নিয়েছে। সিকিমকেও গিলে খেয়েছে। এখনও কাকে কাকে খেতে চায়, সেটা তো দিবালোকের মতো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এমনই প্রেক্ষাপটে আগ্রাসী ভারতের ব্যাপারে সহযোগী এক পত্রিকায় অতি মোক্ষম মন্তব্য করেছেন প্রবীণ সাংবাদিক সাদেক খান। তাঁর লেখার শিরোনাম ছিল ‘ভারতীয় রণকৌশলবিদদের আশাভঙ্গের হিক্কা'। মুক্তচিন্তক ফরহাদ মজহারও হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের ভিত্তিতে যে বিশ্লেষণ দাঁড় করিয়েছেন, তাতে ভারতের আশাবাদী হওয়ার কারণ সীমিত।
এশিয়ায় ভারতকে কাঁচকলা দেখিয়ে চীনের উত্থান ও অংশগ্রহণ ভারতের আদি সম্প্রসারণবাদী আগ্রাসনের জন্যে এক জ্বলন্ত বাধা। ভারত পশ্চিমের পাঞ্জাব-কাশ্মীরে যা-ই করুক না কেন, চীনঘেঁষা উত্তর-পূর্বে সহজেই কিছু করতে পারবে না। এখানে চীনের স্বার্থ হানিকর কিছু করা ভারতের পক্ষে সম্ভব নয়। সম্ভব নয়, বাংলাদেশের মতো পনের কোটি জাগ্রত মানুষের দেশকে ক্ষুণ্ণ করে কিছু করাও। ভারত আর যা-ই করুক, ঘুমন্ত বাঘকে জাগাবে না। শত শত বছরের অতীতে যারাই দূর বাংলাকে বিরক্ত করেছে, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাংলার সুলতানগণ, শের শাহ আর ঈসা খানেরা দিল্লীকে অস্বীকার তো করেছেই, এমনকি কখনও কখনও হুমায়ুনকে হটিয়ে দিল্লীর মসনদও দখল করে নিয়েছে।
অতএব বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যবর্তী গুর্খাদের আন্দোলন-সংগ্রাম আর দাবিসমূহকে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণভাবে না দেখা হলে প্রচন্ড ভুল করা হবে। এখানে ভারতীয় উগ্র সম্প্রসারণবাদ-আধিপত্যবাদ খাটবে না। ভারতের উত্তর-পূর্বের সাত পার্বত্য রাজ্যের নানা সমস্যা ও অনাচারকেও অতিদ্রুত ন্যায়সঙ্গতভাবে সমাধান করতে হবে। পাহাড়ি নাগরিকদের স্বাধীন ইচ্ছা ও আন্দোলনের মর্মকে আত্মস্থ করেই ভারতকে এগুতে হবে।
প্রসঙ্গত গোর্খাল্যান্ডের সূত্র ধরে পার্শ্ববর্তী সাত পার্বত্য রাজ্য, যেমন, আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, অরুণাচল, মনিপুর-এর সীমাহীন সমস্যা ও কুশাসন নিয়ে যে জনঅসন্তোষ ঘনীভূত হচ্ছে, সে দিকেও নজর দেয়া দরকার্। রাজ্যগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। ভৌগোলিকভাবে কৌশলপূর্ণ। চীন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সীমান্ত-সংলগ্ন। এমন গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যসমূহের মানুষ সুখে নেই। সেখানে কোনও উন্নয়ন নেই, অগ্রগতি নেই। মানুষের জীবন ও সম্পদ মুক্ত নয়। জনগণ মনে করেন, তারা দিল্লীর দ্বারা শাসিত। ন্যায়সঙ্গত অধিকার বঞ্চিত। এমন অবস্থায় সে অঞ্চলে কাজ করছে বহু স্বাধীনতাকামী গণ ও সশস্ত্র আন্দোলন। যার কারণে পাহাড়ে প্রায়ই শোনা যায় বোমার গর্জন, দেখা যায় লাশ। সেখানে পার্বত্য গোপনে লাঞ্ছিত হয় মানবতা ও মনুষ্যত্ব। খোদ ভারতীয়রা পর্যন্ত সেই নিপীড়নের বিরুদ্ধে। অনেকেই প্রতিবাদও করছেন। সেখানে জরুরি অবস্থার নামে নির্বিচারে অত্যাচার-নির্যাতন আর মানবাধিকার লঙ্ঘনকে কোনওভাবেই মেনে নিতে পারছে না বিশ্ববাসী বিবেকবান মানুষজন।
এটা খুবই আশ্চর্যের কথা যে, ভারত নিজের দেশে কোটি কোটি মানুষকে চেপে রেখে এবং প্রতিবেশীদের নানা অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে বিশ্বসেরা হতে চায়। এশিয়ায় চীনকে হটিয়ে সামরিক-রাজনৈতিক-বাণিজ্যিকভাবে বিশ্বসেরা হওয়ার পথে ভারত কখনও নিজের অপকর্মগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখারও প্রয়োজন বোধ করে না। কিন্তু যে নিজের দেশের নাগরিক ও প্রতিবেশীদের প্রতি অসদাচরণ করে, সে কীভাবে বিশ্বসেরা হতে পারে-এই প্রশ্নটি ভারতীয়রা একবারও ভাবছে না। বিশ্বসেরা গায়ের জোরেই হওয়া সম্ভব নয়-এ জন্য প্রয়োজন জনগণের আস্থা, ভালোবাসা, বিশ্বাস ও সমর্থন। এটা এখনও ভারতের কাছে সুদূরপরাহত। নিজের দেশের ভেতরে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রতি খুশি মানুষের সংখ্যা বেশি, না বেজার মানুষের সংখ্যা বেশি; এই তথ্যটুকু যাচাই করা হলেই তো আসল সত্য উঘাটিত হবে। সকলেই চায়, ভারত সত্যের আয়নায় নিজের চেহারা দেখুক। নিজের আচরণকে ঠিক করুক। সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারলে, ভারতের মধ্যেই ভারতের নাগরিকদের সন্তুষ্ট করা যাবে; দূর ইউরোপ থেকে সুইজারল্যান্ড আমদানি করতে হবে না। শক্তি বা লোভ দিয়ে নয়, ভালোবাসা ও আস্থার শক্তিতে মানুষকে জয় করার শিক্ষা যে দিন ভারত অনুসরণ করবে, সেদিনই প্রকৃত শান্তি আশা করা যাবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন