মহিউদ্দিন আহমদ | তারিখ: ১৬-০৫-২০১২
হিলারি ডায়ান রডহ্যাম, বয়স ৬৫, ইয়েল ল স্কুলের স্নাতক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৬৭তম পররাষ্ট্রমন্ত্রী। আলোচনার পাদপ্রদীপে আছেন ৩২ বছর ধরে। ১৯৭৫ সালে উইলিয়াম জেফারসন ক্লিনটনকে বিয়ে করে স্বামীর নামের শেষাংশ বয়ে বেড়াচ্ছেন। এটা পশ্চিমা দেশগুলোর ট্র্যাডিশন, যদিও আইনি বাধ্যবাধকতা নেই অনেক দেশেই।
১৯৭৯ সালে এক জরিপে যুক্তরাষ্ট্রের ১০০ জন প্রভাবশালী আইনজীবীর তালিকায় তাঁর নাম ছিল। ১৯৮১ সাল থেকে শুরু করে মাঝে দুই বছর বাদ দিয়ে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন পার্শ্বচরিত্রে, আরকানসাস রাজ্যের ফার্স্ট লেডির ভূমিকায়। এই ভূমিকা আরও প্রলম্বিত হয় ২০০০ সাল অবধি, যত দিন স্বামী ক্লিনটন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তারপর তাঁর পথচলা নিজ শক্তিতে ও গতিতে। প্রথমে নিউইয়র্ক থেকে নির্বাচিত সিনেট সদস্য, তারপর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে দলের মনোনয়ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ ও পরাজয় এবং সবশেষে তাঁরই প্রতিদ্বন্দ্বী বারাক ওবামার বিদেশমন্ত্রী হিসেবে আত্মপ্রকাশ। রাজনীতি, কূটনীতি ও সমরনীতিতে তাঁর পারঙ্গমতা ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। ষাটের দশকের গোড়া থেকেই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে গণতন্ত্র রপ্তানির যে পবিত্র মিশন যুক্তরাষ্ট্র শুরু করেছিল ভিয়েতনামে, হিলারির সুযোগ্য নেতৃত্বে তা আরও বিস্তৃত হয়েছে। আরব বসন্ত আলজেরিয়া থেকে ইয়েমেন পর্যন্ত যে ফুল ফোটাচ্ছে, তিনি তার মালাকার।
হিলারি সম্প্রতি ঢাকা সফর করে গেলেন। গণমাধ্যম এবং নাগরিক আলোচনার শীর্ষে ছিলেন তিনি কয়েক দিন। তাঁর গতানুগতিক কিছু আনুষ্ঠানিক কর্মসূচি ছিল, যেমন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক, প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিরোধী দলের নেতার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ, করপোরেট সিভিল সমাজের দুজন প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক ইত্যাদি। এসবের বাইরে তিনি একটি স্কুলের অডিটরিয়ামে তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধিত্বকারী এটি সমাবেশে খোলামেলা কথাবার্তা বলেন। তরুণদের সঙ্গে এ সংলাপটি তাঁর এই সফরের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক দিক।
হিলারি আমাদের দেশের দুই প্রধান অভিভাবক হাসিনা ও খালেদার সঙ্গে কী কথা বলেছেন, তা হয়তো পুরোটা কখনোই জানা যাবে না। অফিসপাড়ায়, চায়ের স্টলে কিংবা পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে বেশ কথাবার্তা, লেখালেখি হয়েছে। যে যাঁর মতো করে বলছেন এবং লিখছেন। তার পরও কৌতূহল থেকে যায়। তিনি কি হাসিনাকে ধমকেছেন? খালেদাকে শাসিয়েছেন? আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বিভাজন, যুযুধান দুই দেশীয় পরাশক্তির বিবাদ এবং পরিণামে গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা, এসব বুঝি তাঁর আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল এবং তিনি মাস্টার মশাইয়ের মতো দুই ছাত্রীকে ঝগড়াঝাঁটি মিটিয়ে সুবোধ বালিকার মতো পড়াশোনায় মন দিতে বলেছেন। আমার মনে হয় না, এ জন্য এত কষ্ট করে, এত তেল পুড়িয়ে, তিনি এসেছিলেন। যাঁরা এ দেশে এবং এ অঞ্চলে মার্কিন নীতি নিয়ে কাজ করেন বা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করেন, তাঁদের কাছে মনে হতে পারে, বিষয়ের ভেতরে আরও বিষয় ছিল।
আমরা জানি, আমাদের দেশে যাঁরা ক্ষমতার শীর্ষে ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন, তাঁদের মাঝেমধ্যে সবক দেওয়ার জন্য ওয়াশিংটন থেকে এত ক্ষমতাধর কাউকে ছুটে আসতে হয় না। এটা তাঁদের রাষ্ট্রদূতই করতে পারেন এবং করেও থাকেন। এমনকি আমাদের দেশে বিভিন্ন দূতাবাসে যাঁরা প্রথম সচিব হিসেবে চাকরি করেন, তাঁরাও প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে, যখন-তখন প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী কিংবা সাবেক অথবা ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রীর কাছে যেতে পারেন, পরামর্শ দিতে পারেন। আমাদের রাষ্ট্রদূত ওয়াশিংটনে তাঁর পুরো মেয়াদে ওই দেশের রাষ্ট্রপতির সাক্ষাৎ একবারও পান না। হয়তো জাতিসংঘের করিডরে কিংবা অন্য কোনো জাতীয় অনুষ্ঠানে তাঁরা দাওয়াত পেলে দূর থেকে নয়ন মেলে দেখে জীবন সার্থক করেন।
নাইন-ইলেভেন দুনিয়াটাকে বদলে দিয়েছে। বদলে দিয়েছে মানুষে-মানুষে, এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের সম্পর্ক। যুক্তরাষ্ট্র তার গ্লোবাল ওয়ার অন টেরর নিয়ে উদ্বিগ্ন। সে দুনিয়াজুড়ে মিত্র খুঁজে বেড়াচ্ছে। বাংলাদেশকে সে আস্থায় নিতে চায়। এই যুদ্ধে কে তার বেশি আস্থাভাজন, সেই সমীকরণের ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় কাকে তাদের পছন্দ। দক্ষিণ এশিয়ার এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা বিরাট প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। বিষয়টা আঞ্চলিক পরাশক্তি ও প্রতিবেশী ভারতের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে কে ভারতপ্রেমিক আর কে তাদের সকাল-সন্ধ্যা গালাগাল করে, সেটা মুখ্য নয়। ভারতের কাছে দুটো বিষয় অগ্রাধিকার পায়। একটা হলো ব্যবসা, অর্থনৈতিক লাভালাভ, অন্যটি হলো তার জাতীয় নিরাপত্তা। এ ব্যাপারে বাংলাদেশে কে তাদের বেশি আস্থাভাজন, তার সন্ধান তারা করবে এবং তাকেই তারা ক্ষমতায় দেখতে চাইবে। ভারত-মার্কিন সম্পর্কের মাঝখানে বাংলাদেশ যদি গসাগুর অঙ্কের মতো একটা কমন ডিনমিনেটর হয়ে যায়, তাতে মার্কিনিদের সুবিধা, ভারতেরও সুবিধা। এই ব্যাপারে হিলারি কী বার্তা নিয়ে গেছেন, সেটা সবচেয়ে বেশি জানেন সম্ভবত তিনজন—হাসিনা, খালেদা এবং হিলারি স্বয়ং। আমরা ততটুকুই জানব, যতটুকু তাঁরা এবং তাঁদের সহকর্মীরা আমাদের জানাবেন। গণমাধ্যমের পর্যবেক্ষন এবং টক শোতে সবজান্তাদের অনুমাননির্ভর কথা দেখে এবং শুনে আমাদের বিভ্রান্ত হওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা থেকেই যায়।
বিদেশ থেকে কাউকে এসে যদি আমাদের একজন নেতাকে বলে দিতে হয়, কোনটা ঠিক আর কোনটা ঠিক নয়, তাতে একজন নাগরিক হিসেবে আমি ছোট হয়ে যাই, অপমানিত বোধ করি। মুশকিল হলো, আমরাই এই সুযোগটা তৈরি করে দিই। আমরা তাদের কাছে নালিশ জানাই, ক্ষোভের কথা বলি এবং একে অপরের বিরুদ্ধে নানা রকম কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক চাপ প্রয়োগ করার জন্য আবেদন-নিবেদন করি। এ সুযোগটি তাঁরাও নেন। সম্প্রতি উইকিলিকসের ফাঁস হয়ে যাওয়া অনেক মন্তব্যে দেখা গেছে, আমাদের অনেক ফেরেশতাতুল্য নেতা, আমলা ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ঘরের অনেক কথাই পরকে বলে দিয়েছেন। কী বলেছেন, তা আর গোপন থাকেনি। ফাঁস হয়ে যাওয়া এসব তথ্য অস্বীকার করে যাঁরা বিবৃতি দিয়েছেন, তাঁদের খুব কম মানুষই বিশ্বাস করেছে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় আমাদের দেশটা এখনো উপনিবেশ। এখন আর সৈন্য দিয়ে জায়গা দখল করতে হয় না। ঋণ আর প্রযুক্তির জালে একটা উন্নয়নশীল দেশের জনগোষ্ঠীকে আটকে দেওয়া যায়, তাকে জিম্মি করে সুবিধা আদায় করা যায়। তাকে যখন-তখন ‘সুপরামর্শ’ দেওয়া যায়। একটা উদাহরণ না দিয়ে পারছি না। বিশ্বব্যাংক এবং ইউএসএইডের উৎসাহ ও প্ররোচনায় রাজশাহী বিভাগে ২০ হাজার গভীর নলকূপ বসানো হয়েছে। এখন এ জন্য চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে আমাদের। পানির স্তর নেমে গেছে অনেক নিচে। মরুকরণপ্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়েছে। এই অপরাধের বিচার হওয়ার দরকার। কারণ, প্রকৃতিই একদিন প্রতিশোধ নেবে।
হিলারি প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। তিনি ঢাকায় যা বলেছেন, তার সারমর্ম আমি এভাবে করতে চাই।
১. বাংলাদেশ তার গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় ঠিক পথেই আছে।
২. আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক বিবাদ মিটিয়ে ফেলা উচিত।
৩. আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক অঙ্গনে বাংলাদেশ বেশকিছু বিষয়ে ইতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
৪. যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পাশে থাকবে।
প্রথম তিনটি বক্তব্য আমরা প্রায়ই শুনি। এগুলো হচ্ছে সাফল্য গাথা। সরকার সব সময় সাফল্য দাবি করে এবং বিরোধী দল সব সময় তা অস্বীকার করে। এসব বিষয়ে মতৈক্য হওয়ার সম্ভাবনা নিকট ভবিষ্যতে নেই। এ জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে সেই দিন পর্যন্ত, যত দিন না রাজনীতির অঙ্গন থেকে এসব অভিজ্ঞ মানুষ অন্তর্নিহিত হবেন এবং নতুনেরা তার জায়গা দখল করবে নীতিনির্ধারক পর্যায়ে। তবে হিলারির শেষ বক্তব্যটি নিয়ে আমার আগ্রহ বেশি।
বাংলাদেশের মানুষ যখন গণহত্যায় শিকার হয়েছিল, যখন তারা স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছিল, তখন যুক্তরাষ্ট্র দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে। যদিও এটা বলা দরকার, যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক সমাজের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আমাদের পাশে ছিল। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, ঢাকায় অবস্থিত মার্কিন কনস্যুলেট জেনারেল আর্চার ব্লাড বাঙালিদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার কারণে এবং সত্যিকার অবস্থাটি তাঁর প্রতিবেদনে তুলে ধরার জন্য হয়রানির শিকার হয়েছিলেন। এখন যদি মার্কিন প্রশাসন সত্যি সত্যি আমাদের পাশে দাঁড়াতে চায়, আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় সমর্থন জোগাতে চায়, তা হবে আমাদের জন্য এটা বড় প্রাপ্তি। কিন্তু এ জন্য আমাদের কী মূল্য দিতে হবে, তাও আমাদের ভেবে দেখা দরকার।
প্রায় চার দশক আগে শিল্পোন্নত দেশগুলো অঙ্গীকার করেছিল, তাদের জাতীয় আয়ের ন্যূনতম ০.৭ শতাংশ বৈদেশিক সাহায্য (ঋণ এবং অনুদান মিলিয়ে) দেবে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে। সুইডেন, নরওয়ে, লুক্সেমবার্গ, ডেনমার্ক ও নেদারল্যান্ড—এ পাঁচটি দেশ ছাড়া আর কেউ কথা রাখেনি। অঙ্গীকার থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সহযোগিতা মাত্র ০.২ শতাংশ (এপ্রিল, ২০১২)। আমি জানি না, আমাদের সরকার, বিরোধী দল কিংবা সিভিল সমাজের কোনো প্রতিনিধি হিলারিকে এই কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন কি না।
হিলারি সংলাপের কথা বলেছেন। অতি উত্তম প্রস্তাব। এ দেশের নাগরিকেরাও তা চান। আলোচনার বিকল্প হলো যুদ্ধ। এটা কে চায়? আমারও পরামর্শ হিলারিকে। ইরান ও উত্তর কোরিয়া নিয়ে আপনারা খুবই বিব্রত, বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ। আমার অনুরোধ, সংলাপ চালিয়ে যান। যুদ্ধের হুমকি দেবেন না। যুদ্ধ হলে অনেক নিরপরাধ মানুষ মারা পড়ে, পঙ্গু হয়, জীবনযাত্রা তছনছ হয়ে যায়। অবশ্য অস্ত্রের উৎপাদন এবং বাণিজ্য বাড়ে এবং তাতে করে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় আয় আরও স্ফীত হয়।
আমি বিশ্বাস করি, আমাদের দেশীয় ‘দুই পরাশক্তি’ তাদের অবস্থান পরিবর্তন করবে। এই পরিবর্তনের গতি হবে অনেক মন্থর। তবে তা আসবে ভেতর থেকেই। ‘অদৃশ্য শক্তি’ কিংবা রাষ্ট্রদূতদের ধমকে কাজ হবে না। হলেও তা হবে ক্ষণস্থায়ী, যেমনটি হয়েছিল ২০০৭-০৮ সালে।
পরিশেষে মার্কিন প্রতিবাদী বুদ্ধিজীবী নোয়াম চমস্কির একটি উক্তি উল্লেখ করতে চাই। তিনি হয়তো কোনো দিনই নোবেল পাবেন না, রাষ্ট্রপতি হবেন না। কিন্তু তাঁর বক্তৃতা টিকিট কেটে শোনার লোকও বাড়ছে দিন দিন। তাঁর কথা যাঁরা শোনেন, তাঁরা আমেরিকান রাষ্ট্রব্যবস্থার আরেকটি দিক। এটাও দিন দিন বাড়ছে। এরাই আমেরিকায় পরিবর্তন আনবে একদিন।
চমস্কি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে পৃথিবীর পয়লা নম্বরের সন্ত্রাসী রাষ্ট্র। মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে একটু পরিবর্তনের হাওয়া লাগলে দুনিয়াটাই পালটে যাবে। হিলারিদের তখন দেশে দেশে গণতন্ত্র ফেরি করে বেড়াতে হবে না। আমরা চাই, মার্কিন রাষ্ট্রটি তার নাগরিকদের সুরক্ষার জন্য যে রকম আচরণ করে, অন্যদের জন্যও একই রকম আচরণ করুক। হিলারি, একটু ভেবে দেখবেন কি?
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।
mohi2005@gmail.com
১৯৭৯ সালে এক জরিপে যুক্তরাষ্ট্রের ১০০ জন প্রভাবশালী আইনজীবীর তালিকায় তাঁর নাম ছিল। ১৯৮১ সাল থেকে শুরু করে মাঝে দুই বছর বাদ দিয়ে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন পার্শ্বচরিত্রে, আরকানসাস রাজ্যের ফার্স্ট লেডির ভূমিকায়। এই ভূমিকা আরও প্রলম্বিত হয় ২০০০ সাল অবধি, যত দিন স্বামী ক্লিনটন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তারপর তাঁর পথচলা নিজ শক্তিতে ও গতিতে। প্রথমে নিউইয়র্ক থেকে নির্বাচিত সিনেট সদস্য, তারপর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে দলের মনোনয়ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ ও পরাজয় এবং সবশেষে তাঁরই প্রতিদ্বন্দ্বী বারাক ওবামার বিদেশমন্ত্রী হিসেবে আত্মপ্রকাশ। রাজনীতি, কূটনীতি ও সমরনীতিতে তাঁর পারঙ্গমতা ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। ষাটের দশকের গোড়া থেকেই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে গণতন্ত্র রপ্তানির যে পবিত্র মিশন যুক্তরাষ্ট্র শুরু করেছিল ভিয়েতনামে, হিলারির সুযোগ্য নেতৃত্বে তা আরও বিস্তৃত হয়েছে। আরব বসন্ত আলজেরিয়া থেকে ইয়েমেন পর্যন্ত যে ফুল ফোটাচ্ছে, তিনি তার মালাকার।
হিলারি সম্প্রতি ঢাকা সফর করে গেলেন। গণমাধ্যম এবং নাগরিক আলোচনার শীর্ষে ছিলেন তিনি কয়েক দিন। তাঁর গতানুগতিক কিছু আনুষ্ঠানিক কর্মসূচি ছিল, যেমন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক, প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিরোধী দলের নেতার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ, করপোরেট সিভিল সমাজের দুজন প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক ইত্যাদি। এসবের বাইরে তিনি একটি স্কুলের অডিটরিয়ামে তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধিত্বকারী এটি সমাবেশে খোলামেলা কথাবার্তা বলেন। তরুণদের সঙ্গে এ সংলাপটি তাঁর এই সফরের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক দিক।
হিলারি আমাদের দেশের দুই প্রধান অভিভাবক হাসিনা ও খালেদার সঙ্গে কী কথা বলেছেন, তা হয়তো পুরোটা কখনোই জানা যাবে না। অফিসপাড়ায়, চায়ের স্টলে কিংবা পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে বেশ কথাবার্তা, লেখালেখি হয়েছে। যে যাঁর মতো করে বলছেন এবং লিখছেন। তার পরও কৌতূহল থেকে যায়। তিনি কি হাসিনাকে ধমকেছেন? খালেদাকে শাসিয়েছেন? আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বিভাজন, যুযুধান দুই দেশীয় পরাশক্তির বিবাদ এবং পরিণামে গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা, এসব বুঝি তাঁর আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল এবং তিনি মাস্টার মশাইয়ের মতো দুই ছাত্রীকে ঝগড়াঝাঁটি মিটিয়ে সুবোধ বালিকার মতো পড়াশোনায় মন দিতে বলেছেন। আমার মনে হয় না, এ জন্য এত কষ্ট করে, এত তেল পুড়িয়ে, তিনি এসেছিলেন। যাঁরা এ দেশে এবং এ অঞ্চলে মার্কিন নীতি নিয়ে কাজ করেন বা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করেন, তাঁদের কাছে মনে হতে পারে, বিষয়ের ভেতরে আরও বিষয় ছিল।
আমরা জানি, আমাদের দেশে যাঁরা ক্ষমতার শীর্ষে ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন, তাঁদের মাঝেমধ্যে সবক দেওয়ার জন্য ওয়াশিংটন থেকে এত ক্ষমতাধর কাউকে ছুটে আসতে হয় না। এটা তাঁদের রাষ্ট্রদূতই করতে পারেন এবং করেও থাকেন। এমনকি আমাদের দেশে বিভিন্ন দূতাবাসে যাঁরা প্রথম সচিব হিসেবে চাকরি করেন, তাঁরাও প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে, যখন-তখন প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী কিংবা সাবেক অথবা ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রীর কাছে যেতে পারেন, পরামর্শ দিতে পারেন। আমাদের রাষ্ট্রদূত ওয়াশিংটনে তাঁর পুরো মেয়াদে ওই দেশের রাষ্ট্রপতির সাক্ষাৎ একবারও পান না। হয়তো জাতিসংঘের করিডরে কিংবা অন্য কোনো জাতীয় অনুষ্ঠানে তাঁরা দাওয়াত পেলে দূর থেকে নয়ন মেলে দেখে জীবন সার্থক করেন।
নাইন-ইলেভেন দুনিয়াটাকে বদলে দিয়েছে। বদলে দিয়েছে মানুষে-মানুষে, এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের সম্পর্ক। যুক্তরাষ্ট্র তার গ্লোবাল ওয়ার অন টেরর নিয়ে উদ্বিগ্ন। সে দুনিয়াজুড়ে মিত্র খুঁজে বেড়াচ্ছে। বাংলাদেশকে সে আস্থায় নিতে চায়। এই যুদ্ধে কে তার বেশি আস্থাভাজন, সেই সমীকরণের ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় কাকে তাদের পছন্দ। দক্ষিণ এশিয়ার এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা বিরাট প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। বিষয়টা আঞ্চলিক পরাশক্তি ও প্রতিবেশী ভারতের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে কে ভারতপ্রেমিক আর কে তাদের সকাল-সন্ধ্যা গালাগাল করে, সেটা মুখ্য নয়। ভারতের কাছে দুটো বিষয় অগ্রাধিকার পায়। একটা হলো ব্যবসা, অর্থনৈতিক লাভালাভ, অন্যটি হলো তার জাতীয় নিরাপত্তা। এ ব্যাপারে বাংলাদেশে কে তাদের বেশি আস্থাভাজন, তার সন্ধান তারা করবে এবং তাকেই তারা ক্ষমতায় দেখতে চাইবে। ভারত-মার্কিন সম্পর্কের মাঝখানে বাংলাদেশ যদি গসাগুর অঙ্কের মতো একটা কমন ডিনমিনেটর হয়ে যায়, তাতে মার্কিনিদের সুবিধা, ভারতেরও সুবিধা। এই ব্যাপারে হিলারি কী বার্তা নিয়ে গেছেন, সেটা সবচেয়ে বেশি জানেন সম্ভবত তিনজন—হাসিনা, খালেদা এবং হিলারি স্বয়ং। আমরা ততটুকুই জানব, যতটুকু তাঁরা এবং তাঁদের সহকর্মীরা আমাদের জানাবেন। গণমাধ্যমের পর্যবেক্ষন এবং টক শোতে সবজান্তাদের অনুমাননির্ভর কথা দেখে এবং শুনে আমাদের বিভ্রান্ত হওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা থেকেই যায়।
বিদেশ থেকে কাউকে এসে যদি আমাদের একজন নেতাকে বলে দিতে হয়, কোনটা ঠিক আর কোনটা ঠিক নয়, তাতে একজন নাগরিক হিসেবে আমি ছোট হয়ে যাই, অপমানিত বোধ করি। মুশকিল হলো, আমরাই এই সুযোগটা তৈরি করে দিই। আমরা তাদের কাছে নালিশ জানাই, ক্ষোভের কথা বলি এবং একে অপরের বিরুদ্ধে নানা রকম কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক চাপ প্রয়োগ করার জন্য আবেদন-নিবেদন করি। এ সুযোগটি তাঁরাও নেন। সম্প্রতি উইকিলিকসের ফাঁস হয়ে যাওয়া অনেক মন্তব্যে দেখা গেছে, আমাদের অনেক ফেরেশতাতুল্য নেতা, আমলা ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ঘরের অনেক কথাই পরকে বলে দিয়েছেন। কী বলেছেন, তা আর গোপন থাকেনি। ফাঁস হয়ে যাওয়া এসব তথ্য অস্বীকার করে যাঁরা বিবৃতি দিয়েছেন, তাঁদের খুব কম মানুষই বিশ্বাস করেছে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় আমাদের দেশটা এখনো উপনিবেশ। এখন আর সৈন্য দিয়ে জায়গা দখল করতে হয় না। ঋণ আর প্রযুক্তির জালে একটা উন্নয়নশীল দেশের জনগোষ্ঠীকে আটকে দেওয়া যায়, তাকে জিম্মি করে সুবিধা আদায় করা যায়। তাকে যখন-তখন ‘সুপরামর্শ’ দেওয়া যায়। একটা উদাহরণ না দিয়ে পারছি না। বিশ্বব্যাংক এবং ইউএসএইডের উৎসাহ ও প্ররোচনায় রাজশাহী বিভাগে ২০ হাজার গভীর নলকূপ বসানো হয়েছে। এখন এ জন্য চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে আমাদের। পানির স্তর নেমে গেছে অনেক নিচে। মরুকরণপ্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়েছে। এই অপরাধের বিচার হওয়ার দরকার। কারণ, প্রকৃতিই একদিন প্রতিশোধ নেবে।
হিলারি প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। তিনি ঢাকায় যা বলেছেন, তার সারমর্ম আমি এভাবে করতে চাই।
১. বাংলাদেশ তার গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় ঠিক পথেই আছে।
২. আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক বিবাদ মিটিয়ে ফেলা উচিত।
৩. আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক অঙ্গনে বাংলাদেশ বেশকিছু বিষয়ে ইতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
৪. যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পাশে থাকবে।
প্রথম তিনটি বক্তব্য আমরা প্রায়ই শুনি। এগুলো হচ্ছে সাফল্য গাথা। সরকার সব সময় সাফল্য দাবি করে এবং বিরোধী দল সব সময় তা অস্বীকার করে। এসব বিষয়ে মতৈক্য হওয়ার সম্ভাবনা নিকট ভবিষ্যতে নেই। এ জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে সেই দিন পর্যন্ত, যত দিন না রাজনীতির অঙ্গন থেকে এসব অভিজ্ঞ মানুষ অন্তর্নিহিত হবেন এবং নতুনেরা তার জায়গা দখল করবে নীতিনির্ধারক পর্যায়ে। তবে হিলারির শেষ বক্তব্যটি নিয়ে আমার আগ্রহ বেশি।
বাংলাদেশের মানুষ যখন গণহত্যায় শিকার হয়েছিল, যখন তারা স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছিল, তখন যুক্তরাষ্ট্র দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে। যদিও এটা বলা দরকার, যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক সমাজের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আমাদের পাশে ছিল। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, ঢাকায় অবস্থিত মার্কিন কনস্যুলেট জেনারেল আর্চার ব্লাড বাঙালিদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার কারণে এবং সত্যিকার অবস্থাটি তাঁর প্রতিবেদনে তুলে ধরার জন্য হয়রানির শিকার হয়েছিলেন। এখন যদি মার্কিন প্রশাসন সত্যি সত্যি আমাদের পাশে দাঁড়াতে চায়, আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় সমর্থন জোগাতে চায়, তা হবে আমাদের জন্য এটা বড় প্রাপ্তি। কিন্তু এ জন্য আমাদের কী মূল্য দিতে হবে, তাও আমাদের ভেবে দেখা দরকার।
প্রায় চার দশক আগে শিল্পোন্নত দেশগুলো অঙ্গীকার করেছিল, তাদের জাতীয় আয়ের ন্যূনতম ০.৭ শতাংশ বৈদেশিক সাহায্য (ঋণ এবং অনুদান মিলিয়ে) দেবে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে। সুইডেন, নরওয়ে, লুক্সেমবার্গ, ডেনমার্ক ও নেদারল্যান্ড—এ পাঁচটি দেশ ছাড়া আর কেউ কথা রাখেনি। অঙ্গীকার থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সহযোগিতা মাত্র ০.২ শতাংশ (এপ্রিল, ২০১২)। আমি জানি না, আমাদের সরকার, বিরোধী দল কিংবা সিভিল সমাজের কোনো প্রতিনিধি হিলারিকে এই কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন কি না।
হিলারি সংলাপের কথা বলেছেন। অতি উত্তম প্রস্তাব। এ দেশের নাগরিকেরাও তা চান। আলোচনার বিকল্প হলো যুদ্ধ। এটা কে চায়? আমারও পরামর্শ হিলারিকে। ইরান ও উত্তর কোরিয়া নিয়ে আপনারা খুবই বিব্রত, বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ। আমার অনুরোধ, সংলাপ চালিয়ে যান। যুদ্ধের হুমকি দেবেন না। যুদ্ধ হলে অনেক নিরপরাধ মানুষ মারা পড়ে, পঙ্গু হয়, জীবনযাত্রা তছনছ হয়ে যায়। অবশ্য অস্ত্রের উৎপাদন এবং বাণিজ্য বাড়ে এবং তাতে করে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় আয় আরও স্ফীত হয়।
আমি বিশ্বাস করি, আমাদের দেশীয় ‘দুই পরাশক্তি’ তাদের অবস্থান পরিবর্তন করবে। এই পরিবর্তনের গতি হবে অনেক মন্থর। তবে তা আসবে ভেতর থেকেই। ‘অদৃশ্য শক্তি’ কিংবা রাষ্ট্রদূতদের ধমকে কাজ হবে না। হলেও তা হবে ক্ষণস্থায়ী, যেমনটি হয়েছিল ২০০৭-০৮ সালে।
পরিশেষে মার্কিন প্রতিবাদী বুদ্ধিজীবী নোয়াম চমস্কির একটি উক্তি উল্লেখ করতে চাই। তিনি হয়তো কোনো দিনই নোবেল পাবেন না, রাষ্ট্রপতি হবেন না। কিন্তু তাঁর বক্তৃতা টিকিট কেটে শোনার লোকও বাড়ছে দিন দিন। তাঁর কথা যাঁরা শোনেন, তাঁরা আমেরিকান রাষ্ট্রব্যবস্থার আরেকটি দিক। এটাও দিন দিন বাড়ছে। এরাই আমেরিকায় পরিবর্তন আনবে একদিন।
চমস্কি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে পৃথিবীর পয়লা নম্বরের সন্ত্রাসী রাষ্ট্র। মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে একটু পরিবর্তনের হাওয়া লাগলে দুনিয়াটাই পালটে যাবে। হিলারিদের তখন দেশে দেশে গণতন্ত্র ফেরি করে বেড়াতে হবে না। আমরা চাই, মার্কিন রাষ্ট্রটি তার নাগরিকদের সুরক্ষার জন্য যে রকম আচরণ করে, অন্যদের জন্যও একই রকম আচরণ করুক। হিলারি, একটু ভেবে দেখবেন কি?
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।
mohi2005@gmail.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন